প্রিয় সুখ পর্ব-৩১

0
65

প্রিয় সুখ-৩১
____________
খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন। টেবিল ভর্তি মানুষ সোফা ভর্তি অতিথি। নীহারিকাও যুক্ত হয়েছে। অথচ তার মুখে পরিতোষ বিহিন এলোমেলো ভাবভঙ্গী। সে রোবর্টের মত কাজ করছে। কখনো এটি এগিয়ে দিচ্ছে কখনো ওটা করতে সাহায্য করছে। বিমুগ্ধ বসেছে অদ্ভুত স্থানে। সদর দরজার সামনে সে চেয়ার বিছিয়ে তার উপরে বসে খাবারের প্লেট হাত খাচ্ছে। অবশ্যয় সে হাতে খাচ্ছে না। নীহারিকার দেওয়া শিক্ষা গুলো তার সচরাচর মনে থাকে না। সে ভুলে গিয়েছে। তার চামচের কুট কুট শব্দ। নীহারিকা তার দিকে একবারও তাকায়নি। এটা হচ্ছে অভিমান।
রাগ আর অভিমানের মাঝে বিরাট পার্থক্য। রাগ হয় মানুষের বাহিরের প্রকাশ ভঙ্গী। আর অভিমান হচ্ছে মনের গভীরে ক্ষত তৈরি করা। গভীর সেই ক্ষতের যন্ত্রণায় নিজে জ্বলে পুড়ে কষ্টে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু বিপরীত মানুষের কাছে তা প্রকাশ না করা। রেগে গেলে মানুষ হেরে যায় আর অভিমানে লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা। যা তাকে নিজের অজান্তে ভালোবাসা অনুভব করায়। পৃথিবী শুদ্ধ সকলের প্রতি রাগ প্রকাশিত করা সহজ সম্ভব হলেও অভিমান শুধুই ভালোবাসার নামে বরাদ্দকৃত। ভালোবাসা ব্যতিত কেউ অভিমানে ক্ষতবিক্ষত হতে পারে না করতেও পারে না। রাগটা নীহারিকা ঝেরেছে। কিন্তু অভিমান তার শিরায় শিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অঙ্গে অঙ্গে দৌড়ে বেরাচ্ছে। নীহারিকার এই অভিমান বিমুগ্ধকে ভিতর থেকে আঘাত করলেও তার একটুও খারাপ লাগছে না। বিমুগ্ধের মনে হচ্ছে সে যা করেছে বেশ করেছে। তার এই মনোভাব ভয়াবহ রকমের ভুল হলেও সে শিকার করছে না এবং করবে না। নীহারিকাকে জোর করে আফিয়া বিলকিস বিমুগ্ধের দিকে পাঠিয়ে দিল। কারণ ছেলেটা একা বসেছে। ঠিক মত খাবার নিতে পারছে না। এখন নীহারিকা ব্যতিত সকলে খাবার খেতে ব্যস্ত। লীলাবতী নীহারিকার প্রতি মুগ্ধ। মেয়েটির মন অসম্ভব ভালো তার ধারণা। যখন তার খুব সমস্যা হচ্ছিল নীহারিকা তাকে একদম মেয়ের মত সাহায্য করেছে। মাত্র একটু সময়েই তার মনে হচ্ছে এই মেয়েটি মোটেও সাধারণ নয়। তার ছেলের পছন্দ ভালো না, মেয়েটি আসলেই ভালো। নীহারিকা বিমুগ্ধের দিকে যেতেই সবার চোখ তার দিকে। আপাতত অঘোষিত শত্রু তারা। এটা বাড়ির বয়স্ক থেকে বাচ্চা সবাই জানে। নীহারিকাকে বিমুগ্ধ খেয়াল করল না। শুধু অনুভব করল। নীহারিকা তার আশেপাশে থাকলেই সে বুঝতে পারে। আলৌকিক ব্যাপার স্যাপার। নীহারিকা একপিস দু’ পিস দিল না সম্পূর্ণ বাটির মাংস ঠেলে দিল। এখনও মনে হচ্ছে সে ঠান্ডা হতে পারছে না। বিমুগ্ধ হাসল। সুন্দর করে। তারপর ঝোলে ভরা প্লেটেই হাত চুবিয়ে দিল। তার চামুচ ডুবে গেছে চেপ্টা প্লেটের নিচে। বিমুগ্ধ ফিসফিস করে বলল,’ আমার ফোনটা পকেট থেকে বের করতে সাহায্য করো।’
নীহারিকার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বিমুগ্ধ নিজেই এক হাতে বের করে প্লেটের একটি ছবি তুলে বলল,’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখাতে হবে। তাদের আম্মি কত খারাপ সার্ভ করে। কুকিং তো করতেই পারে না। তার মাঝে সার্ভিংটাও পারে না। আফসোস।’ বিমুগ্ধ শব্দ করে খাওয়ায় মনোনিবেশ করল। নীহারিকার কান লাল হয়ে গেল। ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন। আম্মি বলতে বিমুগ্ধ কি বুঝিয়েছে বুঝতে পেরে সে ঝুপ করে কেঁটে পড়ল। যাওয়ার আগে অসভ্য বলে একটা গালিও অবশ্য দিয়েছে। বিমুগ্ধ সেই গালি খেয়ে নিয়ে হো হো করে হাসতে লাগল। সবার চোখ তার দিকে এবং তার প্লেটের দিকে। প্লেট ভর্তি মাংস থৈ থৈ করছে। আফিয়া মাথা চাপড়ালেন। মেয়েটাকে যে কেন দিয়ে আসতে বলেছেন! এদের সমস্যা কি? দু’ জন যেন দুই মেরু।

নীহারিকা নিজের রুমে এসে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। তার বিছানার উপরে বিছানো রয়েছে পাঁচটি প্যাকেট। সে আরও অবাক হয়ে গেল যখন প্যাকেট গুলো খুলল। তার ভিতরে ওড়না আর ওড়না। প্রথম প্যাকেট খুলে সে একটি লাল ওড়না আবিষ্কার করল। তার ভিতরে ছোট করে লেখা,’ আম্মা, কখনো সামান্য বিষয়ে মন খারাপ করতে নেই। তোমাকে আমি কঠিন করে বড় করেছি।’ নীহারিকা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। এতো সুন্দর ওড়না বাবা কখন কিনেছে ভাবতে শুরু করল। সকালের ঘটনা থেকেই মনে হয় তিনি কিনে নিয়ে এসেছেন। নীহারিকা খুশি হয়ে সেটি গায়ে জড়িয়ে কিছুক্ষণ ঘুরল। তারপর কৌতুহলি হয়ে দ্বিতীয়টি খুলল। খুলে সে আরও অবাক। এটির রঙ্গও লাল। টকটকা লাল ওড়নার উপরে সোনালী সুতোর কাজ। এটির মাঝেও চিরকুট রয়েছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে যার লেখা তার হাতের লেখা খুবই জঘন্য। না পড়েও নীহারিকা বুঝতে পারল এটি জাওয়াদের দেওয়া। একজন ডাক্তারের চেয়ে বিশ্রী হাতের লেখা খুব কম মানুষের হয়। তার লেখা দেখে নীহারিকা বিরক্ত হয়েই হেসে ফেলল। সেখানে লেখা,’ তোমার ওড়না পছন্দ বললেই হতো। আমি ওড়নার একটি রাজ্য তৈরি করে দিতাম।’ একজন ডাক্তার এতো আবেগী কথা কিভাবে বলে! নীহারিকা ওড়নাটা পড়লো না। সে রেখে দিল প্যাকেটে। এটির একটা ব্যবস্থা করবে। তারপরের ওড়না আগের গুলোর চেয়ে অসম্ভব সুন্দর। এটি প্রিয়মের। নীহারিকা চট করে ধরে ফেলল। কারণ তার ভাইয়ের পছন্দ অসম্ভব সুন্দর। চিরকুটের লেখা পড়ে নীহারিকা হাসতে লাগল।
‘ কাঁদবি না। দূর্বল রাজকন্যার সাথে যুদ্ধ করে মজা নেই। বুঝতেই পারছিস আমার রাজ্য অনেক শক্তিশালী। ফলে হেরে যাবি। সো মেয়েদের ভং ছাড় ইউ আর এ ব্রেব গার্ল। যদিও শাকচুন্নী।’
নীহারিকা ভাবছে আর দু’ টি কার? কে দিয়েছে? সে কিছুক্ষণ প্যাকেট গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল।
খুলতে যেন সাহসের প্রয়োজন। নীহারিকা বুক ভরে নিশ্বাস নিলো। তারপর সাদার উপরে নীল রঙ্গের প্যাকেটি খুলল। সেখানেও লাল ওড়না দেখে সে হতবম্ভ। এই নিয়ে হয়েছে চারটা। এতো লাল ওড়না দিয়ে সে কি করবে? নীহারিকা চিরকুট খুজলো। কিন্তু পেলো না। এদিক সেদিক উল্টালো। নেই। ওড়না মেলে সে সত্যি চমকে গেলে। এতো সুন্দর লাল ওড়না! লালের উপরে লাল সুতোর কাজ। ওড়নাটি গায়ে জড়িয়ে নীহারিকা আয়নার সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। সবচেয়ে সুন্দর ওড়না এটি। এধরণের ওড়না নীহারিকা কখনো সামনাসামনি দেখেনি। হঠাৎ চোখ পড়ল পাশের কাগজের উপরে। ওড়নার গায়ে পিন করা। নীহারিকা হাতে নিলো। দোকানের সিল এটি। তার উপরে লেখা,
‘ তোমাকে আমি ঘৃণা করি। কিন্তু আমার ছেলে যেহেতু তোমাকে কষ্ট দিয়েছে তাই দুঃখিত। তুমি কি বলতে পারবে আমার মায়ের মত দেখতে কেন তুমি?’
সপ্তম আকাশ থেকে পড়ল যেন নীহারিকা। এটি তার জেঠার কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার। খুশিতে সে পাগলের মত ঘুরল। এদিক সেদিক ছুটল। একটি দশ বছরের বাচ্চার মত নিজের আচরণে সে ঝুঁকে মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগল। চারপাশের বিস্তর চুল ঝুলে পড়ল দু’ পাশ থেকে মুখের উপরে। তার ঝুম ঝুম হাসির শব্দে ঘরময় আনন্দ লাফালাফি ঝাপাঝাপি করছে। প্রচন্ড সুখি অনুভব হচ্ছে। আজ থেকে নীহারিকা ঠিক করেছে তার জেঠাকে বড় বাবা ডাকবে। কেউ একজন বলেছিল, এটাকেই প্রিয় সুখ বলে। দুঃখের পরেই যা আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে। মানুষ যে সুখের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। নীহারিকার চোখ চকচক করে উঠল। আনন্দে অভিভুত হয়ে সে প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে মানুষ তো এভাবেই খুশি হয়। আজ এই মুহূর্তে নীহারিকার মনে হচ্ছে তার বড় বাবা হয়ে উঠা মানুষটা তার শুধু শুধু হঠাৎ করে প্রিয় হয়ে উঠেছে। এই প্রিয় মানুষদের নিয়ে বেঁচে থাকাইতো প্রিয় সুখ। বিমুগ্ধের কথা মনে পড়ল। হ্যা বিমুগ্ধই তো বলেছিল ‘ অপেক্ষা করতে করতে দুঃখ নিবারণ করতে করতে যে ভালোবাসা আসে তাই প্রিয় সুখ।’ বিমুগ্ধের উপরে তার রাগ অভিমান কিছুই কাজ করছে না। যা কাজ করছে তা হচ্ছে অনুভূতি। তাকে কাঁদানোর জন্যে সে বিমুগ্ধের উপরেও খুব খুশি। এমন আনন্দের জন্য মানুষ রোজ কাঁদতে পারবে। রোজ রোজ। নীহারিকা যত্ন করে স্তবক করল। পাশে রাখল। তারপর শেষ প্যাকেট খুলে ফেলল। এই ওড়নাটি হুবহু আগের ওড়নার মত দেখতে। নীহারিকা চোখ বন্ধ করে রাখল অনেকক্ষণ। ঘ্রাণ আসছে। নতুন ওড়নার সাথে মিশে আছে একটি সুবাস। এই ওড়না কেউ বুকে জড়িয়ে রেখেছিল অনেক সময় ধরে। নীহারিকা ছুয়ে দেখল না। সেটি ঠিক সেভাবেই রেখে দিল। শুধু সবুজ চিরকুটের কাগজটি লুকিয়ে নিলো গোপনে। একদম যত্নে সেটি নিজের কাছে রেখে দিল। কেন? কি করতে? কিসের জন্য? সে জানে না। তার শুধু মনে হচ্ছে ওড়নার চেয়ে ওটা গুরুত্বপূর্ণ খুব। মিতু আপু দরজায় এসে দাড়িয়েছে। এসব তার কামাল। সবাই এসে তাকে ধরিয়ে দিয়েছে একটি একটি করে। তাযিন ভাইয়েরটা বাদে বাকি সব প্যাকেট তিনি নিজেই নিয়ে এসেছেন। তাযিন ভাই তো নিজেই এসে রেখে গিয়েছিলেন। নীহারিকার দিকে এসে উত্তেজিত হয়ে বললেন,’ অনেক গুলো ওড়না তাই না?’
‘ হ্যা আপু। তুই জানিস বড় বাবাও আমাকে একটি ওড়না দিয়েছে।’ উজ্জ্বল চোখ নীহারিকার। অন্যমনস্ক মোনভাব। মিতু আপু ভ্রু কুঁচকে নিয়ে বললেন,’ বড় বাবাটা কে? তোর বাপের বড় আবার কোন বাপ?’
‘ ধুর আমার বাপের ভাই হচ্ছে বড় বাবা। আপু আমার না খুব খুশি লাগছে।’
‘ এতো খুশি লাগার কি আছে? তুই কি ওই লোকের ফ্যান ট্যান হয়ে গেলি না কি?’
‘ অনেকটা পছন্দ হয়ে গেছে।’ নীহারিকা মিষ্টি ঠোঁটে দৃষ্টি সুন্দর হাসল। মিতু আপু মুখটা বাঁকিয়ে বললেন,’ তোর বড় বাপ আমার কি হইবো রে?’
‘ তোর খালু হবে। চিন্তা কর তুই তারে খালু ডাকলি আর সে গম্ভীর গলায় তোরে বলল এই মেয়ে কাকে খালু ডাকছ? খালু হবে তোমার বাপ।’ নীহারিকা শব্দ করে হাসছে। মিতু আপু মিনমিনে গলায় বলল,’ বলতেও পারে। লোকটা তাযিন ভাইয়ের কপি।’
‘ একদম ওই অসভ্যের সাথে তুলনা করবি না। তিনি ভালো।’
‘ বাপরে বাপ ভালো হয়ে গেল?’ মিতু আপুর বিস্ময় নজর। নীহারিকা হাসতে লাগল। আজকে ঠোঁটে শুধু হাসি তার। মিতু আপুর দিকে ঝুঁকে প্যাকেট দুটি এগিয়ে দিয়ে বলল,’ এগুলো যে দিয়েছে তাদের কাছে পৌছে দিয়ে আয়।’
‘ তুই কিভাবে বুঝলি আমি নিয়ে এসেছি?’ চোরের মত বললেন তিনি। নীহারিকা জাওয়াদের দেওয়া চিরকুটের পিছনে কিছু লিখে দিল। মিতু আপুর দিকে এগিয়ে এসে বলল,’ ঢং করবি না। দিয়ে আয়।’
‘ কার কার এগুলো?’
‘ নিয়ে আসার সময় প্যাকেট দেখিস নি কার থেকে কোনটা নিয়ে আসছিস?’
‘ আচ্ছা যা জাওয়াদ ভাইয়ারটা চিনলাম। ওটা কার।’
‘ তোর তাযিন ভাইয়ের।’
‘ তোর ভাই না?’ মিতু আপুর জহুরী নজরে তাকাল। নীহারিকা বিব্রত বিরক্ত হলো। বলল,’ ওই অসভ্য আমার ভাই হতেই পারে না।’
‘ সেটাই। উনাকে ভাই ডাকবি না কিন্তু।’ মিতু আপু দৌড় ছিল। নীহারিকা তিনটি ওড়না খুলে মাথায় দিয়ে বসে রইল। আয়নায় তাকে বউ বউ লাগছে। একদম নববধূর মত লাল মুখশ্রী হয়ে উঠেছে। শুধু একটি লাল শাড়ির প্রয়োজন। বড্ড প্রয়োজন!
_____________
নাফিজ উদ্দীন চমৎকার আরও একটি কাজ করলেন। তিনি বিমুগ্ধের জন্য একটি সবুজ ফতুয়া নিয়ে আসলেন। সেটি প্রিয়মের মাধ্যমে তার রুমেও পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু কোন কিছু উল্লেখ করলেন না। বুঝার উপায় নেই কোথা থেকে এসেছে এই উপহার কিন্তু বিমুগ্ধের চতুর মস্তিষ্ক এটি ধরে নিয়েছে। তার আব্বি কখনো উপহার দেয় না। এটা তার দোষ বা গুন যাই হোক কিছু একটা। তিনি এই জীবনে ছেলে মেয়েদের কোন উপহার দেননি। যা লেগেছে তাদের আম্মি কিনে দিয়েছেন। তিনি শপিংই করেন না তেমন। একটু অসামাজিক বলা চলে। বিমুগ্ধ ফতুয়া পড়ে দেখল। একটু ঢিলা। কিন্তু তার গায়ে সুন্দর মানিয়েছে। চুল ঠিক করল। বোতাম খোলা রাখল। হাতা ভাজ করল। হাফ হাতা ফতুয়াকে সে আরও একটু উঠিয়ে দিল। সাদা পেশি ফুলে এটে রয়েছে। বিমুগ্ধ একটি থ্রি কোয়াট প্যান্ট পড়ে নিল। শরীরে লাগাল সুগন্ধি। আজকে কি স্পেশাল দিন? মিতু আপু ঢুকে বললেন,’ আপনার উপহার রিজেক্ট করা হয়েছে।’
‘ রিজেক্ট করে দিল?’ বিমুগ্ধের জলদগম্ভীর গলা। মিতু আপুও রাশ ভারী গলায় বললেন,’ হ্যা দিল।’
‘ আপনি কিছু বললেন না?’
‘ আমি কেন আপনার পক্ষ নিব? আপনি আমাকে কিভাবে ফাঁসিয়েছেন ভুলিনি।’
‘ আচ্ছা।’
‘ কি আচ্ছা? শাহিন ভাই কি যে অত্যাচার করছে আপনি জানেন? আমাকে তিনি ডেলিভারী গার্ল বানিয়ে দিয়েছে। কখনো ওমুক রেস্টুরেন্টের কফি নিয়ে আসতে বলছে কখনো ওমন বিরিয়ানী নিয়ে আসতে বলছে, মাঝে মাঝে ফুটপাতের খাবার নিয়ে আসতে বলছে। আমার আর কোন কাজই নেই যেন। তবুও মাফ নেই সব কাজও করাচ্ছে। কিছু বললেই ধমক দিচ্ছে। বলছে আমাকে মাগনা টাকা দিবে না কি? আপনি বলুন এত কাজ কি আমার ভুত করছে?’
‘ না আপনিই করছেন।’ বিমুগ্ধ হাতে কালো ফিতার ঘড়ি পড়ল। মিতু আপু কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,’ তাহলে আমাকে কেন এসব শুনাচ্ছে?’
‘ জানি না।’
‘ আপনার কারণে ফেঁসেছি।’
‘ জি না। নিজের কারণে ফেঁসেছেন। আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন আপনি। আমি নই। আমার কাছে এই বিপদ থেকে বের হওয়ার বুদ্ধি আছে।’
‘ বলুন দ্রুত।’ মিতু আপুর উৎকণ্ঠা। বিমুগ্ধ আরও গম্ভীর ভাবে বলল,’ বিয়ে করে নিন।’
‘ বিয়ে করে নিব?’ অবাক হয়ে বলল মিতু আপু।
‘ করবেন। করতেই হবে। বিয়ে করা উচিৎ। বাধ্যতামূলক সওয়াব সাধন।’ বিমুগ্ধ বাহিরে চলে আসল। মিতু আপু তাযিন ভাই তাযিন ভাই করে চেঁচাল। কে শুনে কার কথা। সে তো চলেই গেল। এতো এটেটিউড আসে কোথা থেকে?

লোহিত টকটকে একটি গোল কুর্তি পড়েছে নীহারিকা। তার ঠোঁটে রক্তিম লিপস্টিক। মুখমন্ডলের সাথে রং মিলে একাকার। মাথায় রক্তবর্ণ ওড়না। তাকে লাল ফুল মনে হচ্ছে। একটি বিমুগ্ধ সিঁদুর রঙ্গা সালভিয়া ফুল। যার ফুল, কলি, মঞ্জরি, সবই একই রঙ্গের। সোফার রুমে তার বাবা আর মেসবাহ কথা বলছেন। নীহারিকা চারপাশে তার বড় বাবা হয়ে উঠা নবীন উদ্দীনের খোঁজ করছে। আজকে একটি বিশেষ দিন বটে। আজ প্রিয়মের জন্ম দিন। কথাটি এখানে কেউ জানে না। বিশেষ করে তার বাবা মা সে, মিতু আপু বাদে কেউ জানে না। মিতু আপু প্রিয়মের জন্মদিন উপলক্ষে একটু ফুর্তির আয়োজন করেছে। এসব বাহানা মাত্র। মূল তথ্য হচ্ছে মিতু আপুকে সবাই জোর করে এসব করতে বাধ্য করেছে। বেচারির আগের মাসের টিউশন ফি তার মা নিয়ে এসেছেন। ছোট খালামনি অবশ্য টাকাটি ফ্রিতে দেয়নি। মিতু আপুকে তিনি গুনে গুনে চারটা থাপ্পড় দিলেন। কথা বলা বন্ধ করলেন। বাড়িতে যাতে আর জীবনে না যায় তারও ঘোষণা করলেন। নীহারিকা সেদিন নিজেকে অনেক ভাগ্যবান ভেবেছে। সে এক রাত বাহিরে থেকে আসার পরেও তাকে কেউ কিছু বলেনি। আজব বিষয়! এসব দৃশ্য বাংলাদেশের মাটিতে দেখা যায় না। নবীন উদ্দীনকে দেখা যাচ্ছে। তিনি একটি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। নীহারিকা আরও একটি চেয়ার নিয়ে তার পাশে বসল। তিনি চোখ উল্টে একবার দেখে ফিরিয়ে নিলেন। হঠাৎ কিছু আলাদা বিষয় লক্ষ্য করে তিনি বিদ্যুতের ন্যায় ক্ষণিকের জন্য দীপ্তিমান নজরে তাকালেন। নীহারিকা ওড়না নেড়েচেড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে তার দেওয়া দোপাট্টা পড়ে ঘুর ঘুর করছে। নীহারিকা উঠে ঘুরে ঘুরে প্রশ্ন করল,’ কেমন লাগছে আমাকে?’
নবীন উদ্দীন আরও আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। নীহারিকা ফিসফিস করে কি যেন গাইল। নবীন উদ্দীনের চশমা ভিঁজে উঠল। তিনি নিজের চক্ষুর সামনে যেন নতুন রূপে নিজের মাকে দেখছেন। নীহারিকা পাশে বসল। বলল,’ আপনার মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তাই আমি তার মত দেখতে হয়েছি। আর ধন্যবাদ বড় বাবা।’ নবীন উদ্দীনের চোখ কখন যে ভিঁজে গেলো তিনি বুঝলেন না। কঠিন হৃদয়ের তাকে নীহারিকা শুধু শুধু কাঁদিয়ে দিল। মেয়েটি দারুন ক্ষমতার অধিকারী। নবীন উদ্দীন বিরক্ত গলায় বললেন,’ধন্যবাদের কিছু নেই। আমার ছেলে তোমার ওড়না ছিড়েছে তাই দিয়েছি। আর এটা এভাবে পড়ে পড়ে ঘুরছ কেন?’
‘ তাহলে কি করব?’ নীহারিকা মৃদু দুলল। নবীন উদ্দীন বড় বিরক্ত হয়ে বললেন,’ রেখে দিবে। পারলে ফেলে দিবে। তোমাকে আমার ভালো লাগছে না। সামনে থেকে যাও।’
‘ সুন্দর মানুষকে সুন্দর বলতে হয় আপনি জানেন না?’
‘ জানি কিন্তু তুমি সুন্দর নও। আমার মা সুন্দরী ছিল। তুমি তার মত হয়েছ। প্রকৃত অর্থে তোমার কোন রূপ নেই।’
নীহারিকা চট জলদি রেগে গেল। বলল,’ আপনার মা আমার মত দেখতে আমি তার মত নই।’
‘ সে আগে এসেছে দুনিয়ায়।’
‘ আগে আসলেই সব ক্রেডিট উনার? আজব পাবলিক।’
‘ কে আমি না আমার মা?’
‘ দু’ জনেই।’
নীহারিকা উঠে গেল। এত রাগ মেয়েটার! নবীন উদ্দীন চশমা ঠেলে দিলেন। কাগজ পড়তে মনোযোগী তিনি। নীহারিকা পিছনে হেঁটে এসে বলল,’ বড় বাবা আপনি মানুষটা তেমন ভালো না।’
নাফিস উদ্দীন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মেয়ের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন,’ বড় বাবা কাকে ডাকছ?’
নীহারিকা শুকনো ঢোক গিলে চুপ করে গেল। নবীন উদ্দীন বললেন,’ আমাকে ডাকছে। তোর সমস্যা কি?’
‘ তোকে আমার মেয়ে জেঠা ডাকবে। তোমাকে না বলেছি এদের থেকে দুরে থাকবে? যাও।’
নবীন উদ্দীন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। নীহারিকার এক হাত টেনে নিজের পিছনে নিয়ে বললেন,’ তুমি আমার আশেপাশেই থাকবে। আর আমাকে বড় বাবা বলেই ডাকবে।’
‘ না ডাকবে না।’ নাফিস উদ্দীনের ঘাড় ত্যাড়া জবাব। তিনি মেয়েকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে আসলেন। নবীন উদ্দীন আবার টেনে নিজের দিকে নিয়ে দিল। বলল,’ তোমার বাপকে বলে দেও তুমি আমাকে বড় বাবাই ডাকবে।’
‘ আচ্ছা।’ নীহারিকা বলল। নাফিস পুরো আগুন হয়ে বললেন,’ নীহারিকা তুমি আমার মেয়ে তাকে তুমি বড় বাবা ডাকবে না।’
‘ আচ্ছা।’ নীহারিকার একুই উত্তর।
‘ তুমি ডাকবে।’
‘ তুমি ডাকবে না।’
‘ ডাকবে বলেছি মানে ডাকবেই।’
‘ ডাকবে না ডাকবে না ডাকবে না।’ নীহারিকা টানাটানিতে অতিষ্ঠ হয়ে গেল। এখন সে অনুভব করছে ওড়নার কতটা খারাপ লেগেছিল। সে এদিকেও হ্যা বলতে পারছে না ওদিকেও পারছে না। দু’ জনে বেশ উত্তেজিত। নীহারিকা এবার একটু জোরে চেঁচাল। বলল,’ আমার যা খুশি হবে তাই করব। আপনারা চুপ করুন। বাবা তুমি চলো। আর আপনি বসুন।’ যেতে যেতে সে একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,’ আমি বড় বাবাই ডাকব।’ ডান চোখ টিপল নীহারিকা। নবীন উদ্দীন বিহ্বল নয়নে ঠোঁটে হেসে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে ঠিক আছে বুঝিয়ে দিল।
_________
গোধূলি লগ্ন। চিত্তমুগ্ধকরণ পরিবেশ। সবুজ গাছের মাঝে মাঝে আকাশ দেখা যাচ্ছে। নীল সাদার মিশ্র আকাশ। শীত আসছে দক্ষিনে ভেসে ভেসে। ঘাসে চেপে বসছে পরন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ। হালকা রূপলী রোদ্দুরের ছোঁয়া পাগল করে দিচ্ছে প্রকৃতি পরিবেশ। মন মাতানো একটি ঘ্রাণ ভাসছে। নিঃশ্বাসের সাথে মিশে যাচ্ছে সেই স্নিগ্ধতা। হৃদয় ডুবে যাচ্ছে সূর্যের কড়া দুপুরের সাথে। নিরুদ্যম এই হাওয়ার উৎস হেমন্তের বিদায়ের। বৃষ্টি ছুটি নিয়েছে। কিছুদিন তার দেখা পাওয়া যাবে না। বিকেলের বিষণ্ণতাকে শীত অবরোধ করেছে। সেও হৃদয়ে ধুকপুক বাড়াবে না কিছুদিন। বিকেলকে মিষ্টি মধুর রোদের নামে করে দিয়েছে শীত। রসালো মধুর মত তৃপ্ত সেই রোদে বসে গল্প করা যাবে। চুপি চুপি হৃদযন্ত্র প্রেমে পড়বে। রোদ মুখে এসে আলিঙ্গন করবে এক মুগ্ধতার। ছড়িয়ে দিবে ভালবাসা। মহাব্বত হবে এক পা চায়ের সাথে। চুমুকে চুমুকে বুক পিঞ্জিরার দীঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে। ঠিক তেমনই বিকেলে বাড়ির ছোট সদস্যগুলো হাজির হয়েছে উঠানের মাঝদরিয়ায়। বড় মাঠটি ছোট হয়ে গিয়েছে। সামনের বিশাল বিল্ডিং অনেকখানি রোদ নিজের মাঝে গ্রাস করে নিচ্ছে। নীহারিকা এসে দাড়িয়েছে নিজের পূর্বের বারান্দার নিচে। সেখানে একটি অপরাজিতা গাছ লাগানো হয়েছে। আজ সে আরও একটি লাগাবে। কিছু গাছ তার বারান্দায়ও আছে। নিচে থেকে কিছু বেয়ে উঠেছে। কিছু বারন্দা থেকে গ্রিল ছুঁয়েছে। নীহারিকা একটি গর্ত করল। তার মুখে এসে পড়ছে কৃশানুর মত আলোকরশ্মি। অন্তরীক্ষে যেটুকু রোদ জমা ছিল সব এসে পড়ল নীহারিকার অরুণ তনুতে। চোখমুখ কুঁচকে সে নিজের কার্যসম্পাদনে ব্যস্ত। বিমুগ্ধ বারান্দা থেকে দেখছে সেই দৃশ্যপট। নিচে জাওয়াদ বেতের টেবিলে বসেছে। তার হাতে চা। সেও যে নীহারিকাকে দেখছে সেটা বুঝতে পেরে দ্রুত বেগে নিচে চলে এসেছে বিমুগ্ধ। তারপর অনুমতি বিহীন মনোযোগ নষ্ট করল জাওয়াদের। দিনমণিকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে জাওয়াদের মুখের সামনে সে। যেটুকু জৌলুস জাওয়াদের মুখে ছিল তা অচিরেই বিরক্তিতে রূপ নিয়েছে। চোখ মুখ শক্ত করে সে বিমুগ্ধকে বলল,’ এখানে বসেছ কেন?’
গম্ভীর মুখ বিমুগ্ধের। জাওয়াদের কথা শুনেও সে তাকালো না তার দিকে। বিরক্তি আকাশ স্পর্শ করল জাওয়াদের। সারাদিন সহ্য করতে হয়েছে এই মানুষটিকে। সীমানা অতিক্রম হয়েছে।
‘ তোমার সমস্যা কি? আমার সামনে বসেছ কেন? সরে বসো।’
‘ সরতে হবে কেন? চলুন চা খাই দু’ জনে মিলে।’ বিমুগ্ধ নিজের কাপটি টেবিলের উপরে শব্দ করে রাখল।
‘ তোমার সাথে চা খাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। তুমি সরে বসো প্লিজ।’ ব্যতিব্যস্ত সুর কণ্ঠে। বিমুগ্ধ শান্ত চোখে তাকালো। বলল,’ তার দিকে তাকাবেন না। আপনি নিজের কাজে মন দিন।’
চমকে গিয়ে জাওয়াদ রুষিত নেত্রে তাকিয়ে বলল,’ নীহারিকার দিকে?’
‘ অবশ্যয়।’
‘ তোমার স্বল্প জ্ঞানকে প্রশারিত করার জন্য বলে রাখছি নীহারিকা আমার হবু ওয়াইফ হতে চলেছে। আজকে আমরা এ বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। আর নিজের হবু ওয়াইফকে আমি দেখব কি দেখব না সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে? সিরিয়াসলি? তাযিন তুমি নিজেকে খুব চালাক মনে করতে পারো। কিন্তু আমি তার থেকেও বেশি।’
বিমুগ্ধ কিছুই বলল না। সরেও বসল না। জাওয়াদ রেগে লাল হয়ে উঠল। বিতৃষ্ণ গলায় বলল,’ তুমি আমাকে বিরক্ত করছ?’
‘ জি করছি। কারণ আপনি আমাকে করছেন।’
‘ আমি তোমাকে বিরক্ত করছি?’
‘ হ্যা করছেন। আপনি আপনার হবু ওয়াইফকে দেখার চক্করে আমার মন মস্তিষ্ককে বিরক্ত করছেন চূড়ান্ত ভাবে। এতে আমি যথেষ্ট বিরক্ত ডাঃ জাওয়াদ।’
জাওয়াদ ভড়কে গেল। উত্তেজিত হয়ে সে প্রায় চিৎকার করতে নিয়েছিল। পিছনে নাফিস উদ্দীনকে আসতে দেখে হিশহিশিয়ে বলল,’ তোমাকে দেখে নিব আমি। নীহারিকার থেকে দূরে থাকবে। তা না হলে নিজের হুলিয়া নিজেই চিনতে পারবে না।’ বিমুগ্ধ স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে রইল। জাওয়াদের কটকট নজর দেখেও সে একটুও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। এক ভ্রু উপরে তুলে সে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। জাওয়াদের মনে হচ্ছে বিমুগ্ধ তাকে অপমান করছে। এই নিশ্চুপ প্রতিবাদ অনেকটা জুতো পিটার মত।
সে প্রতিবাদ করছে না তার মানে এই নয় সে দূর্বল। সে প্রতিবাদ করছে না এটা তার ভদ্রতা। বিমুগ্ধ ভদ্রতা মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,’ আপনি ভালো আছেন ডাঃ জাওয়াদ?’
জাওয়াদ আসমান থেকে জমিনে পড়ে ব্যথায় কাতরানোর মত নয়নে তাকাল। নাফিজ উদ্দীন তাদের দু’ জনের খুব কাছে। জাওয়াদ সেটা লক্ষ্য করে বলল,’ ভালো। তোমার কি খবর?’
‘ আমার অস্থির ভালো। নিজের নিকেতন, নিজের মানুষ নিজের পরিবার, নিজের রুম এবং নিজের রানীকে চোখের সামনে রোজ দেখতে পারার মাঝে মনোমুগ্ধকর ব্যাপার থাকে বুঝলেন হার্ট সার্জেন।’ বিমুগ্ধের ফোন বেজে চলেছে। সে উঠে দাড়াল। পিছনে তাকিয়ে দেখল নীহারিকা হাত পরিষ্কার করে দাড়িয়ে পড়েছে। পিছনের টেপের পানি দিয়ে সে হাত ধৌত করছে। বিমুগ্ধ হাসল। যে হাসি নীহারিকা ব্যতিত কেউ দেখেই না।

টেবিলের উপরে রাখা হলো কেক। এই কেক খাওয়ার জন্য রাখেনি মিতু আপু। আজকে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। মিতা এবং রূবাইদা আপুর সাথে তার কলহ লেগেছে। রূবাইদা আপু শুধু শুধুই ইদানিং খিটখিট করে। আগে এই কন্যাকে এমন চিত্রে দেখা যায়নি। মিতা তো জাত শয়তান আপুর দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু রূবাইদাকে ভালো লাগত। মেয়েটি খুব ফালতু হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। তাকে তিনি বাতিল ঘোষণা করেছেন মনে মনে। ফলস্বরূপ তাকে এই গোপন পার্টির খবর দেওয়া হয়নি। কিন্তু সে এসে হাজির। কেকের রহস্য হচ্ছে কেক কেঁ/টে মিতার মুখ ডুবিয়ে দিবেন তিনি। প্রিয়ম আসলো ঠিকই কিন্তু এসব কেক টেক সে কাঁ/টছে না। তার ভাষ্যমতে এসব বাচ্চাদের অতিরঞ্জিত ব্যাপার সেপার। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে। এসব করার কোন ইচ্ছে তার নেই। কেক খাবে। এবং একটা ট্রিট সে তার বোনেদের দিবে। কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে সে একটি টেনে নিয়ে বসল। মিতু আপু করুন মুখে জিজ্ঞেস করলেন,’ সত্যি কাঁ/টবি না।’
‘ নো। নেভার।’ প্রিয়ম ফোন রেডি করছে। ছবিটবি তুলবে একটু। মাঝে মাঝে ছবি তোলা ভালো। মন ভালো থাকে। আজকের দিনটা বিশেষ। স্মৃতিবন্দি করতে হবে। মিতু আপু নিজেই কেক কাঁ/টলেন। ওপাশের পূজার মার আগ্রহের শেষ নেই। বিগত কিছু দিন ধরে তিনি উকিঝুঁকিতে ব্যস্ত। এ বাড়িতে হচ্ছে কি চিন্তা করতে করতে তিনি প্রায় শেষ। মিতু আপু কেক নিজেই খেয়ে ফেললেন। তারপর চেয়ারে বসে বললেন,’ যার যার মনে চায় খা। প্রিয়ম একটা গান ধর।’
প্রিয়ম ভালো গান পারে। এক সময় তার গায়ক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাবার পছন্দ না বলে সেক্রিফাইস করতে হয়েছে। সব সময় বাবা মা নয় মাঝে মাঝে তাদের জন্যে ছেলে মেয়েও আত্মত্যাগ করে। স্বপ্ন ছাড়ে। নীহারিকা কাজের মেয়েটিকে গিটার নিয়ে আসতে বলল। প্রিয়ম রোদচশমা পড়েছে। তার এখন গান করতে ইচ্ছে করছেনা। হাতের ঘড়িটি সে নেড়েচেড়ে দেখছে। টাইটান ব্র্যান্ডের ঘড়িটি অরিজিনাল। সে এটি নিবেনা ঠিক করেছে। তাযিন ভাইয়ের সাথে তো তার সম্পর্ক ভালো না। মানুষটিকে সে একদম পছন্দ করে না। প্রিয়ম সেটি হাতেই রেখে দিল। আপাতত থাক বক্সটি। গিটার হাতে সে বসল। তার আশেপাশে বাকিরাও। টেবিলে নাস্তা সাজিয়েছে ফাবিহা। তারপর বসে পড়ল মাঠে গোল হয়ে। প্রিয়ম চোখ বুঝে ভাবল কোন গানটি গাওয়া যায়। তারপর বলল,’ তোরা কেউ গা আমার মুড কাজ করছে না।’ আনজুম গদগদ চোখে তার দাভাইয়ের দিকে তাকাল। দূরে দাড়িয়ে সে খুব সিরিয়াস হয়ে কথা বলছে ফোনে। জাওয়াদ এদের বসতে দেখে এদিকে এগিয়ে এসে বসল। আনজুম মিতু আপুর কানে ফিসফিস করে বলল,’ দাভাইকে ডাকো। সে খুব ভালো গান করে। কিন্তু কম গায় খুব। তুমি ডাক দেও তো।’
মিতু আপু আঁতকে উঠে চোখ উল্টে নিল। মুখে বলল,’ আমি? যদি চেঁচামেচি করে?’
‘ নীহারিকা বললে সে নিশ্চয় গাইবে।’ আনজুম মন খারাপ করে বলল। মিতু আপু বলল,’ জীবনেও বলবে না।’
ফাবিহা আরও ঘেঁষে বলল, আমি ডাকছি।’
মিতু আপু ঠেলে দিয়ে বলল,’ যা যা।’ ফাবিহা দৌড়ে গেল। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বিমুগ্ধ ফোন রেখে বলল,’ গান গাইতে পারব না। যেতে পারেন আপনি।’
ফাবিহা চমকে গেল। কিভাবে বুঝলো বুঝার চেষ্টা করে সে তিন মিনিট নষ্ট করল। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,’ আজ তো প্রিয়মের জন্মদিন। আপনি তো জানেন না। তার জন্য গাইতেই পারেন।’
‘ আপনাদের সব সময় এসব ছোট খাটো অনুষ্ঠানে গানের কথা মনে পড়ে কেন? আর কিছু নেই না কি? আজব।’ বিমুগ্ধ এগিয়ে তো গেল কিন্তু গাইবে না বলেই ঠিক করল। সবাই বসেছে নিচে। সে নবাবের মত বসল চেয়ারে। নীহারিকা মুখ কুঁচকে বলল,’ আপনি খুব অভদ্র। নিজেকে রাজা ভাবেন না কি?’
বিমুগ্ধ হাসল তার দিকে তাকিয়ে। সূর্যমুখি রূপ নিয়েছে নীহারিকা। বিমুগ্ধ বলল,’ এখানে উপস্থিত সকলে অভদ্র।’
‘ আপনিই ভদ্র। দেন একটা গান শুনান।’ মিতু আপু জোর গলা। নীহারিকা তীর্যক চোখে একবার তাকিয়ে বলল,’ বাংলা গান বাদে সব বাদ। উনার বাজ খাই ইংলিশ শুনতে চাইছি না। আমাদের দেশের মাটিতে বসে ব্রিটিশদের আজাইরা ইংরেজি চালানো নিষিদ্ধ।’ প্রিয়ম বোনের সাথে হ হ করে মাথা নাচাল। রূবাইদা ফোঁড়ন কাঁটল,’ ইংলিশ গান হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল মানের। তোমরা ভালো করে ধরতে পারো না তাই বলে অপমান করবে না।’
‘ আর আমাদের দেশে বসে চোরেদের গান গাওয়া বুঝি খুব সম্মানের।’ মিতু আপু ঠেস মেরে বলল।
‘ চোর কাকে বললে মিতু আপু? কাকে?’ রূবাইদার কর্কশ গলা। মিতু আপু নীহারিকার কোলে মাথা এলিয়ে বলল,’সারা পৃথিবী থেকে চুরি করে যারা সম্মানিত বড়লোক্স ধনী রাষ্ট্র আমি তাদের কথা বলছি। তবে ডোন্ট মাইন্ড রূবাইদা আপু চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। এটি আরও কার্যকর যদি ধরা পড়েও বুক ফুলিয়ে থাকা যায়। এখন চোরেদের চামচামি বন্ধ করুন।’
‘ আমেরিকা আর ইংল্যান্ড এক নয় মিতু আপু।’ রূবাইদা রেগে আছে। তার দেশকে এসব বলায় একদম সহ্য
হচ্ছে না। কিন্তু মিতু আপু তো তার দেশকে বলেনি। বলেছে ব্রিটিশদের। রেগে যাচ্ছে কেন শুধু শুধু। নীহারিকা হাসল নিশ্চুপ হয়ে। বিমুগ্ধ হঠাৎ গান ধরল। খুব অদ্ভুৎ গান।
‘ এ বুকে বইয়ে যমুনা
নিয়ে অথৈ প্রেমের জল
তারই তীরে গড়বো আমি
আমার প্রেমের তাজমহল
আমার প্রেমের তাজমহল’
প্রিয়ম দ্রুত সুর ধরল। একটি দুষ্টুমি ভরা মুহূর্ত হঠাৎ প্রেমময় হয়ে উঠল। সকলের মনে জেগেছে গোধুলি চৈতন্য। জেগেছে এক অন্যরকম শিহরণ। ভালোবাসার একটি তাজমহল তৈরি করা সহজ। হৃদয় নামক জমিনে একটি তাজমহল তৈরি করে নেওয়ার মাঝে বড় কোন সমস্যা নেই। আছে রাশিরাশি অনুভূতিতে মিশ্রীত একটি দালান, একটি সাগর। যে সাগরের অথৈ জলে ভাসে শুধু প্রেম। ভালোবাসায় ভরা বক্ষপিঞ্জিরা ডুবে যায় সেই প্রেমজলে। বিমুগ্ধের ঠোঁটে হৃদয় ভুলানো হাসি। নীহারিকা তাকালো না। প্রেমের তাজমহল গড়া এতো সহজ!
অর্ধেক গান গেয়ে বিমুগ্ধ উঠে গেল। সকলের হৃদয় ক্ষুন্ন করতে এই ব্যক্তির দারুন লাগে। নীহারিকা অসহ্য নজরে তাকাল। প্রিয়মও বিরক্ত। কিছুক্ষণ আগে তার গান করতে ইচ্ছে করছে। মুড ভালো হয়েছে। এর মাঝেই এই লোক সব নষ্ট করে দিল। ধেৎ করে উঠল সে। সবার মন খারাপ দেখে সে ভাবল আরও একটি গান ধরা যায়। পুরনো গান। সে গাইতে লাগল একটি দুষ্টুমিষ্টি গান। তার ফিচেল গলা,’
‘ উত্তরে ভয়ংকর জঙ্গল
দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল
উত্তরে ভয়ংকর জঙ্গল… দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল..
পূর্ব-পশ্চিম-দুই দিগন্তে নদী
মাথায় বুদ্ধি নাই এক তুলা_ আমি দুলা আত্ম ভুলা
মাকান দিপে দিশা_হারাই যদি।
মিতু আপু উঠে সম্পূর্ণ কেক মিতার মাথায় ঠেলে দিল। সে চিৎকার করে উঠল। মিতু আপু হাসতে লাগল। এই জন্যেই তো তিনি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। এই মেয়ে তার চুলে চুইংগাম লাগিয়েছিল। চুল কাঁটতে হয়েছে অনেকটুকু। প্রতিশোধ। প্রিয়ম গান থামালো না। সে গাইছে আর হাসছে। তাদের পাগলামি দেখে সবাই হো হো করে হাসছে। বিমুগ্ধ ফোনে কথা বলতে বলতে সেদিকে তাকাল দেখল এক গোধূলি লগ্নের রক্তলাল নীহারিকাকে। যে খিলখিল করে হাসছে। চারপাশের সব যেন থমকে গেছে। এই দৃশ্য একদম নতুন। যা রোজ সে দেখতে চাইত। বিমুগ্ধ দাড়িয়ে ছিল বাড়ির দেয়ালের খুব পাশে। উপরের পানির হাউজ পুরে পানি ঝুপ ঝুপ করে পড়ছে। সেই পানি গড়িয়ে পড়ছে বিমুগ্ধের মাথায় শরীরে। সব ভিজে সে কাক ভেজা। তার হাতের ফোন হাতের জায়গায়। চোখ আগের মতই। এতো পানির স্রোত তার দৃষ্টি পরিত্যক্ত করতে অক্ষম। নীহারিকা হাসির তালে সব ভুলে এক পাগল পাড়া পরিবেশ সৃষ্টি করে দিল। তার দিকে কিছু চক্ষু অস্থির হয়ে দেখছে। মাটিতে গড়াগড়ি ধরণের হাসি হাসছে সে। দু’ পাশের গাল ফুলে লাল হয়ে আছে। সূর্যের কিরণে কপোলের দু’ পাশ চিকচিক করছে। চোখ জলে থৈ থৈ। মিতা চুলের কেক তুলে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় মিতু আপুকে ধরে নিলেন। তার চুল টেনে ধরলেন। মিতু আপুও কম না। বাহিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে নাফিস উদ্দীন ছুটে আসলেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি বাকরূদ্ধ হয়ে গেলেন। কিছু বলার মত ভাষা নেই তার। কিন্তু তিনিও হাসছেন। তার মেয়েকে এভাবে হাসলে যে কতটা সুন্দর লাগে এটা তিনি অনেক দিন পরে ধরতে পেরেছেন। সত্যি অসাধরণ তার প্রাণ খোলা হৃদয় গলানো হাসি। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে তার সব হাসি উবে গেল। মুখ থমথমে করে তিনি দেখলেন বিমুগ্ধ ভিজে যাচ্ছে। তার মাথায় গড়িয়ে পড়ছে পানি। তার শরীর ভিজে টুইটম্বুর। কিন্তু সে চোখ সরাচ্ছে না। সে তাকিয়ে আছে গভীর থেকে গভীর নয়নে। তার চোখ পড়তে নাফিস উদ্দীনের মুহূর্ত সময় লাগল। নিজের মেয়েকে এভাবে তাকিয়ে দেখা একদম সহ্য হচ্ছে না। তিনি এগিয়ে গিয়ে আরও বিস্মৃত হয়ে পড়লেন। জাওয়াদ তার মেয়েকে পছন্দ করে। ঠিক আছে। কিন্তু তিনি যে তার চোখে কখনো ভালোবাসা দেখবেন সেটা কল্পনাতীত। তিনি একবার পিছনে তাকালেন। একবার সামনে। এই চোখের ভাষা তার অজানা নয়। আজ বাবা হয়েছে বলে কি তিনি ভুলে যাবেন একসময় এই নজরে তিনিও প্রিয়তমাকে দেখতেন? নাফিস উদ্দীন হুংকার ছেড়ে চিৎকার করে বললেন,’ প্রিয়ম যাও পানির মটর অফ করে এসো।’ মুহূর্তের মাঝে হাসি হাসি পরিবেশ ভয়ে গ্রাস হয়ে পড়ল। প্রিয়ম তাকাল। বাবাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠল। রাগে বাবার চোয়াল শক্ত। নীহারিকা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। একবার সে জাওয়াদকে দেখল। যে তার দিকে অধীর আবেগে তাকিয়ে। অন্য দিকে তাকিয়ে দেখল ভিজে যাওয়া বিমুগ্ধের বিমুগ্ধ করা নেশালো গভীর উষ্ণ আঁখিপল্লব।
_________________
নাফিস উদ্দীন নবীন সাহেবের সামনে বসে বললেন,’তোর ছেলেকে আমার পছন্দ হচ্ছে না।’
নবীন উদ্দীন টিভি দেখছিলেন। চোখে হেসে বললেন,’ তোর মেয়েকেও আমার পছন্দ না।’
‘ আমি আমার মেয়েকে তোর ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছি না যে তুই তাকে পছন্দ করবি আমি আশা করছি। তোর ছেলে যদি আমার মেয়েকে পছন্দ করে থাকে তাহলে সাবধান করবি। কিছু বলছি না দেখে ভেবেছিস আমি দূর্বল। মোটেও না। তোর ছেলেকে বুঝিয়ে দিবি। যেন দূরে থাকে আমার মেয়ের থেকে।’
‘ বাপরে, তোর মেয়ে এমন কি রে? যে আমার ছেলে তোর মেয়েকে পছন্দ করতে যাবে? শুন আমার ছেলের খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোর ওই বাংলাদেশি বদরাগী মেয়ের পিছনে ঘুরবে। আমার ছেলে হচ্ছে কোটিতে একটি। সে তার যোগ্য মেয়েকে বিয়ে করবে। তোর মেয়ে এসবের ধারে কাছে নেই।’
অপমানে নাফিসের মুখ থমথমে হয়ে গেল। রাগে তিনি ললাট ভাঁজ করলেন। বললেন,’ আমার মেয়ে যেমনই হোক তোর ছেলে তার যোগ্যই না। অসভ্য ছেলে একটি।’
‘ কি বললি তুই?
‘ বেশ করেছি।’
‘ সাহস বেড়ে গেছে না? তোদের বাড়িতে আসাই উচিৎ হয়নি।’ নবীন রিমোট ছুঁড়ে দিলেন সোফায়। নাফিস উদ্দীন হাসল। এবার ঠিক হয়েছে। বেশ হয়েছে। যেই না ছেলে, তার পিছনে ঘুরে নাফিসের মেয়ে? ইম্পসিবল।
নবীন উদ্দীন গম্ভীর গলায় বললেন,’ যা তো। তোর সাথে কথা বলার রুচি নেই।’ নাফিস উদ্দীন ক্ষোভ নিয়ে তাকাল। উঠে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে বলল,’ একটা কথা বলি?’
‘ এতক্ষণ সিনেমা দেখাচ্ছিলি বুঝি?’
‘ তোর পা এমন হলো কিভাবে?’ করুন চোখে তাকাল নাফিস। এই ধরনের সহানুভূতি চক্ষু দেখলে রাগে গা রি রি করে নবীনের। কিন্তু আজ তেমন হলো না। চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,’ আমার ছেলে তোকে খুব অপছন্দ করে এই কারণে।’
‘ আমি কি করেছি?’ বিস্ময় গলা নাফিসের। একটু থেমে বললেন,’ তুই যখন বাড়ি ছেড়েছিস তখন তুই সুস্থ ছিলি।’
‘ আমি এখনও সুস্থ। একটা পা না থাকলে মানুষ অসুস্থ থাকে না। তোর জন্য মাকে শেষ বার দেখতে পারলাম না।’
‘ আমার দোষ তুই সারা জীবন দিবি আমি জানি। অথচ তুই চাইলেই আসতে পারতি। তোকে খবর দিয়েছিলাম।’
নাফিস উদ্দীন উঠে গেলেন। বেরিয়ে আসল বুক থেকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস।
‘ আমি সেদিন এক্সিডেন্ট করেছিলাম। একটি পা বাদ দেওয়া হয়েছিল। জ্ঞান ছিলো না সাত দিন। তোর জন্য আমি মাকে দেখতে পারলাম না। বাবা যদি সেদিন তোর পক্ষ না নিতো, তোর দোষ গোপন না করত, তোর অপরাধের শাস্তি তোকে দিত আমি তাহলে রাগ করে বাড়ি ছাড়তাম না। আমিও মাকে দেখতে পেতাম।’ নবীন উদ্দীন স্বাভাবিক হওয়ার জন্য চোখ বন্ধ করলেন। নাফিস উদ্দীন ব্যথিত চোখে তাকিয়ে যাওয়ার আগে বলল,’ আমাকে শাস্তি দেওয়ার খুব ইচ্ছে তোর ভাই? কিন্তু আমি আর শাস্তি নিতে পারব না। আমার মেয়েকে এসবে জড়াবি না। আমি জানি তোরা ওকে দিয়ে আমাকে শাস্তি দিতে চাস। কিন্তু বিশ্বাস কর আমার মেয়ে মায়ের মতই পবিত্র সত্ত্বার তৈরি।’
নবীন উদ্দীন সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তিনি মেয়েটিকে ভালোবাসেন এবং ঘৃণা করেন। ক্ষতি করা সম্ভব নয়। আপন মানুষ থেকে প্রতিশোধ নেওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। তিনি কখনো প্রতিশোধ পরায়ণ ছিলেন না। আর না কখনো হবেন।

মুক্তা দৌড়ে আসল লীলাবতীর কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ সর্বনাশ হইয়া গেছে মেডাম।’
লীলাবতী তখন আফিয়ার সাথে গল্প করছিলেন। সন্ধ্যা পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের যেতে হবে। কিন্তু আফিয়া রিকোয়েস্ট করেছে রাতের খাবার খেয়ে যাতে যায়। সবাই মিলে রান্না কিছুক্ষণ আগে শেষ করে গল্প করতে বসেছে। আজ কি সর্বনাশ কম হয়েছে যে আরও বাকি আছে! বিরক্ত হয়ে তিনি চ এর মত শব্দ করে বললেন,’ তোমাকে কত বার বলেছি এত এক্সাইটেড হয়ে কথা না বলতে। আমি জানি নরমাল একটি বিষয়কে তুমি এখন টেনে টেনে বড় করবে।’
‘ না গো মেডাম সত্যি সর্বনাশ হই গেছে।’
‘ এতো কথা না বলে বলো কি হয়েছে।’ আফিয়া বিলকিস উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলেন। রাবেয়া ফুফু আরও একটু আগ্রহী হলেন। তিনি আপাতত চাচ্ছেন জাওয়াদের সাথে তার একটি মেয়ের বিয়ে দিতে। ফলস্বরূপ লীলাবতীর বেশি খাতির যত্ন তিনিই করছেন। মুক্তা রসিয়ে রসিয়ে বলল,’ জাওয়াদ ভাইজান আর ওই খালাম্মার পোলা মারামারি করতাছে। কি ভয়ংকর মা গো মা।’ শামাখালামনি বিপদজনক চোখে তাকিয়ে বললেন,’ কি যা তা বলছ তুমি?’
‘ সত্যি কইতাছি। বিশ্বাস না হইলে যাইয়া দেখেন। ওই তো কি যেন ফালাইছে।’ বলেই মুক্তা ছুটল। লীলাবতী অসহায়ের মত করে বললেন,’ আফিয়া আমাকে একটু সাহায্য করবেন প্লিজ?’
‘ অবশ্যয়। এভাবে বলছেন কেন? আমরা তো আপন জনই।’ রাবেয়া ফুফুর আহ্লাদি গলা। তিনিই টেনে নিয়ে গেলেন লীলাবতীকে।
ড্রইং রুমের অবস্থা নাজে হাল। বিমুগ্ধ এক ঘুষিতে জাওয়াদের বুক ব্যথিত করে তুলেছে। তার টি-শার্ট প্রায় এক পাশে ঝুলে রয়েছে। জাওয়াদের ইন করা মেরুন শার্ট এলোমেলো। বিমুগ্ধের ঠোঁট ফেঁটেছে। হাতে নখের দাগ। গাল লাল। জাওয়াদের অবস্থা বেশি শোচনীয়। কিন্তু তার মুখ অক্ষত। নাফিস উদ্দীন দৌড়ে এসে চিৎকার করে বললেন,’ সমস্যা কি তোমাদের? বাচ্চাদের মত মারামারি করছ কেন? এসব বন্ধ করো।’
‘ না করবে না। মাই ডিয়ার সন তোমাকে জিততেই হবে।’ নবীন উদ্দীন ছেলেকে উৎসাহ দিয়ে একটি তালি মেরে বসলেন। যেন তিনি ফাইটিং কম্পিটিশন দেখছেন। বিমুগ্ধ জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। তার কপাল বেয়ে পড়ছে ঘামের ধারা। শরীর ঘেমে লাল হয়ে গেছে। জাওয়াদের সাদা মুখ আলতা বর্ণ ধারণ করেছে। সিল্কি চুল চোখের সামনে এসে পড়ছে। লীলাবতী আতঙ্কে ফেঁটে পড়লেন। কাঁদো কাঁদো গলায় ডাকলেন,’ জাওয়াদ বাবা এসব বন্ধ করো।’ জাওয়াদ চিৎকার করে বলল,’ নো আম্মু। তুমি এসব দেখবে না। যাও এখান থেকে।’ জাওয়াদ বিমুগ্ধকে পা দিয়ে লেং মেরে ফেলে দিলো। ওহ সিট করে চেঁচাল নবীন সাহেব। মেসবাহর মুখের ভাব ভঙ্গী গম্ভীর। তিনি ছেলেকে উৎসাহও দিচ্ছেন না আবার ময়দান থেকে নেমেও আসতে বলছেন না। নাফিস উদ্দীন এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নবীন সাহেব হাত ধরে বললেন,’ তুই কই যাচ্ছিস?’
‘ এদের থামাতে।’
‘ থামাতে হবে না। দেখি কে জিতে।’
‘ জিতে মানে কি? পাগল হয়ে গেলি? বাড়িটাকে পাগলাগারদ বানিয়ে ছাড়ছিস তোরা।’
‘ এটা তো পাগলাগারদই। পৃথিবীর সব মানুষই পাগল। এই যে তুই এখন পাগলামি করছিস। বসে পর।’
তিনি টেনে বসিয়ে দিলেন পাশের সোফায়। আশ্চর্য হয়ে সকলে মারামারি রেখে তাকে দেখছে। তার এতো উৎসাহ কিসের? এই লোকের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে। লীলাবতী অনুরোধের সুরে বললেন,’ নবীন সাহেব এসব বন্ধ করতে বলুন।’
‘ আরে মিস সুন্দরী এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? মনে মনে পাগল ভাবছেন আর পাগলামী দেখবেন না? এতো হতে পারে না। শান্ত হন।’
‘ আপনার ছেলে আমার ছেলেকে মারছে আর আপনি আমাকে শান্ত হতে বলছেন?’
‘ আপনার ছেলে তো শিশুবাচ্চার মত তাকিয়ে আছে তাই না? সেও আমার ছেলেকে মারছে। দুটি অ্যাডাল্ট ছেলে নিজেদের মাঝে মারামারি করছে। এটাতে এতো সমস্যা হচ্ছে কেন আপনাদের? ব্রেব বয়। বিমুগ্ধ ডান পা দূর্বল এই ছেলের। ডান পায়ে তোমার বাম পা ঢুকিয়ে দেও। হাত নেও পিঠে। ইয়েস ইয়েস মাই বয়। গ্রেট।’
লীলাবতী কেঁদে কেঁদে স্বামীকে থামাতে বলছেন। তিনিও যাচ্ছেন না। গোয়ারের মত বসে আছেন। দিশেহারা হয়ে গেলেন তিনি। শামাখালামনি চুপ করে দেখছে। ডাক দিচ্ছেন। কিন্তু কাছে যাচ্ছেন না। তার ছেলের রাগ এখন আকাশ সম। কাছে গেলে সব ধ্বংসস্তূপ করে দিবে। নবীন ছাড়া কেউ থামাতে পারবে না। লীলাবতী পাশে থাকায় নবীন বললেন,’ আমার ছেলে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন বুঝলেন। ছোট থেকে ওকে আমি সব শিখিয়েছি। সব ধরণের প্রতিকূলতার সাথে আমার ছেলে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এই যে দেখুন এই পরিবেশ কেমন জমিয়ে দিয়েছে।’
‘ আপনি চুপ করুন। এসব থামিয়ে দিন। আমার ছেলে মারামারি কখনো করেনি। সে এসব পারে না। যেতে দিন।’
‘ কে বলল পারে না? আমার ছেলের ঠোঁট এবং কান সেই ফাঁটিয়েছে। আমার ছেলে কিন্তু ইচ্ছে করে তার মুখে আঘাত করছে না। বিমুগ্ধের মাত্র দশ মিনিট লাগবে আপনার ছেলেকে চিৎ করে শুইয়ে দিতে। তাই থ্যাংকস বলুন তাকে।’
‘ আপনার ছেলে তো ফাইটার আমার ছেলে নয়।’
‘ আপনার ছেলে একটা গাঁধা। খেলতে হয় সমানে সমানে। শক্তিশালীদের সাথে দূর্বল মায়ের সামনে খেলার কোন মানে আছে? আপনি সরে বসুন তো আমাকে এনজয় করতে দিন।’
বিমুগ্ধ জাওয়াদকে একপাশ দিয়ে তুলে নিচে ফেলে দিল। জাওয়াদ যেন হাল ছাড়বেই না। তার শার্ট ছিড়ে গেছে। হাত পা ছিঁড়েছে পাশের ফার্নিচারের সাথে। কয়েকটি কাঁচের জিনিস ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গিয়েছে। বিমুগ্ধ জাওয়াদকে সেদিকে থেকে মারতে মারতে সরিয়ে নিয়ে আসল। মূলত জাওয়াদকে সে আহত করতে চাইছে কিন্তু কেঁ/টে নয়। তার হাড়ে হাড়ে ব্যথা ধরিয়ে দিবে সে। জাওয়াদ ইচ্ছে করে বিমুগ্ধের চোয়ালে ঘুঁষি দিচ্ছে। সে তো আর খেলোয়ার নয় ফলে রুলস বা নিয়ম সে মানবে না। বিমুগ্ধ ঠোঁট হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে জাওয়াদের কলার ধরল। ফিসফিসিয়ে বলল,’ আপনার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। শুধু নীহারিকাকে মাথা থেকে ঝেরে ফেলুন।’ জাওয়াদ টি-শার্ট ছিড়ে ফেলে বলল,’ তোমার সাথেও আমার শত্রুতা নেই। শুধু নীহারিকা থেকে দূরে থাকবে বিমুগ্ধ। আমার সাথে তোমার শত্রুতা, ভালো ঠেকবে না।’
‘ তাহলে আমাদের মাঝে এখন কি হচ্ছে? বন্ধুত্ব?’ জাওয়াদ বিমুগ্ধ লাল চোখমুখে হাসল। যা দেখে লীলাবতী গগন বিদায়ী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’ আমার ছেলেটাকে ছেড়ে দিন। ও কেমন কেমন করছে।’
‘ কেমন কেমন করছে না মিস লীলাবতী সে হাসছে। আর হাসা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। শক্তি পাওয়া যায়। এই যে হাসছে এর মাধ্যমে সে শক্তি পাবে। দিল তো আমার ছেলেকে ফেলে! এটাই বুঝাতে চেয়েছি।’
লীলাবতী আর কিছু বলার মত ভাষা পেলেন না। তার মোমের পুতুলের মত ছেলের নাজেহাল অবস্থা দেখে তিনি যতটানা চমকে যাচ্ছেন তার চেয়ে বেশি হিংস্রতা দেখে আশ্চর্য হচ্ছেন। এতো হিংস্র জাওয়াদ কবে হলো?

ছাদে ছবি তোলা শেষ করার আগেই চিৎকারে ছুটে আসল মিতু আপুরা সবাই। আশ্চর্য হয়ে এই দৃশ্য দেখে বিহ্বল চোখে নীহারিকা প্রশ্ন করল,’ কি হচ্ছে এখানে?’
তার কণ্ঠ কানে যেতেই বিমুগ্ধ এবং জাওয়াদ দু’ জনেই দু’ জনকে কঠিন এক ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলল। ব্যথায় তাদের কপোকাত অবস্থা। তবুও কেউ যেন কাউকে ছাড়বেই না। মাঝখানে নীহারিকা দাড়িয়ে দু’ জনের দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে সে বুঝতেই পারছে না এরা করতে চাইছেটা কি? বিমুগ্ধ হাত ঝারতে ঝারতে বলল,’ কিছুই হচ্ছে না। তুমি মাঝ থেকে সরে দাড়াও। ব্যথা পাবে। আমাদের ডিস্টার্ব হচ্ছে।’ জাওয়াদ সাই দিয়ে বলল,’ইয়েস। সরে দাড়াও। সত্যি ব্যথা পাবে।’ নীহারিকার মুখ ঝুলে পড়ল। তাদের মারামারি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। লীলবতী চিৎকার করছে। দাদামশায় হুংকার দিচ্ছেন। কারো কথার কোন দামই নেই। তারা রক্তারক্তি কান্ড অব্যাহত রেখেছে। আতঙ্কিত মুহূর্ত। কিন্তু কেউ ছাড়ছে না কাউকে। নীহারিকা মাঝে দাড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে আর অচেতন মনে মনে ওহ আল্লাহ! ওহ আল্লাহ করছে।
——-
চলবে………….
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি সুন্দর গুন।
@হাফসা_আলম