প্রিয় সুখ-৩৯
হাফসা আলম
_______________
একঝাঁক পাখি উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। ছাদের আশেপাশের সুপারি গাছ নড়েচড়ে উঠেছে। ফাবিহা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে। চোখের তারায় তারায় ভাসছে তারা। ফাবিহা পাশের মুঠো ফোন হাতে নিলো। কারো নাম্বার লিখে আবার কেঁটে দিল। এভাবে বেশ সময় পার করার পরে তার মনে হলো এবার কলটা করা উচিৎ। ফোন কানে ধরতেই ভাবল আচ্ছা উচিৎ কেন? প্রশ্নটি সে করেই ফেলল,’ আচ্ছা আপনাকে কি ফোন করা উচিৎ ছিলো?’
শান্ত গাড়ি কশে ব্রেক করল। ফোন মুখের সামনে নিয়ে এসে সে দেখল আননোন নাম্বার। কেউ ফোন করে এভাবে প্রশ্ন করে? মেয়ের গলা না? শান্তর সব গার্লফ্রেন্ডের নাম্বার তো নাম দিয়ে সেভ করাই থাকে। শান্ত একটু থ হয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল,’ তুমি কি রুহি?’
ফাবিহা বিরক্ত গলায় বলল,’ না।’
‘ খিস্ট্রেন?’
‘ না।’
‘ এডা?’
‘ না।’
‘ আমিরা?’
‘ না।’
‘ তাহলে আপনি কে?’
‘ মেয়েদের লিস্ট শেষ? আপনার গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা একটু কম হয়ে গেলো না?’
শান্ত হেসে উঠে বলল,’ আমার গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা শুনলে তুমি বিস্মৃত হয়ে যাবে ফাবিহা। নাম্বার কোথায় পেয়েছ?’
‘ চিনে ফেললেন? সাংঘাতিক ব্যাপার।’ ফাবিহার কণ্ঠে অবাকতা। শান্ত পানির বোতল খুঁজে নিয়ে বলল,’ শ্যাম কন্যার কণ্ঠ ধরা কঠিন বিষয় না।’
‘ আপনি প্রথমেই ধরতে পেরেছেন? তাহলে মজা করছিলেন কেন?’
‘ মাজার কিছু নেই এরা সব আমার সত্যি কারের গার্লফ্রেন্ড, এক্স গার্লফ্রেন্ড।’
‘ বর্তমান কে?’
‘ খ্রিস্টেন।’
‘ বিদেশি? আপনার সাথে বিদেশি মেয়ে মানাবে না। বাংলাদেশি মেয়ে খুঁজে বিয়ে করছেন না কেন?’
শান্ত হো হো করে হাসল। বিয়ে শব্দটি হাস্যকর। খুবই হাস্যকর।
‘ তুমি কি আমাকে এসব বলার জন্য কল করেছ?’
‘ আরে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলব।’
শান্ত সিরিয়াস হয়ে বলল,’ তুমি কি পালিয়েছ? তোমার বাকি দুই বোনের মত?’
ফাবিহা রেগে বলল,’ পালাব কেন?’
‘ না ভাবলাম তোমাদের তো পালানোর স্বাভাব।’
‘ পালানোর জন্য কারণের প্রয়োজন। কেউ পালায় নিজের স্বাধীনতার জন্য, কেউ পালায় নিজের মানুষের ভালোর জন্য। কেউ বা পালায় ভালোবাসার জন্য। আমার তো ভালোবাসার মানুষ নেই।’
অশান্ত এই মনে বৃষ্টি নামুক। কিছু একটা হোক। কালো এই রাস্তা ধরে হেঁটে আসুক। সে বরং পালিয়ে বাঁচুক। শান্ত চুপ করে বসে ভাবছে ফাবিহা কেন তাকে ফোন করেছে? তার সাথে তো ফোনে কথা বলার মত সম্পর্ক নেই। ফাবিহার কোন ভালোবাসার মানুষ নেই কেন? থাকা উচিৎ ছিলো। যার হাত ধরে সেও পালিয়ে যেত। শান্ত কি সেই মানুষটি হতে পারত? না সে নিজে ফাবিহা নামক এই নারী থেকে পালিয়ে বাঁচে। কিছু নারী অতিরিক্ত পবিত্র হয়। এদের সাথে শান্তদের মত ছেলে মানায় না। ফাবিহাও চুপ। দু’ দিকের নিরবতা ঠেলে শুধু বাতাসের শব্দ। শীতল বাতাসে কান লাল হয়ে উঠছে। ফাবিহা এবার আসল কথা বলল,’ আমার বিয়ে। ছেলে চট্টগ্রাম এয়ারফোর্সের একজন পাইলট। এখনো দেখিনি তাকে। কালকে বিয়ে। কেউ জানে না। নীহারিকা মিতু আপুকেও বলা হয়নি। আপনার কি মনে হচ্ছে ছেলে দেখতে কেমন হবে?’
শান্ত চুপ করে বসে রইল। সে বলতে চাইছে না। বিয়ে ঘটিত ব্যাপার গুলো তার ভালো লাগে না। কিন্তু যা বলতে চাইছে তা সমাজ শুনতে চাইছে না। শান্ত মনে মনে বলল,’ ফাবিহা শ্যাম বর্ণের আকাশ। তুমি বিয়ে করো না। বিয়ে করা তো ফরজ না। এই পৃথিবীর বুকে দু’ একটা মানুষ অবিবাহিত থাকলে কোন সমস্যা নেই। তুমি বিয়ে করো না। একদমই না।
‘ আপনি এখানে এসেছিলেন যখন তখন খুব অশান্ত ছিলেন। এখন এতো শান্ত কেন?’
‘ অশান্ত সব কিছুকে একটা সময় শান্ত হতে হয়। পৃথিবীর সব কিছুর দু’ পাশ আছে।’
‘ আমার হবু হাজবেন্ড কেমন হবে বলুন?’
শান্ত হাসতে লাগল। ফাবিহা ইনোসেন্ট গলায় বলল,’বলুন তো।’
‘ সে খুব সুন্দর হবে। দুধে আলতা গায়ের রং হবে। লম্বা চওড়া বডি বিল্ডার টাইপের হবে। যেমন টিভি সিনেমায় হয়। যেমনটা মেয়েদের স্বপ্ন পুরুষ হয়। তোমার বাকি দুই বোনের জীবন সঙ্গীর থেকেও তোমার জীবন সঙ্গী বেস্ট হবে। সবচেয়ে বড় কথা সে তোমাকে খুব ভালোবাসবে। অসম্ভব ভালোবাসা যাকে বলে।’
‘ কালো মেয়েকে কেউ অসম্ভব ভালোবাসে?’ ফাবিহা অবাক হয়ে গেল। আকাশের দিকে তার বিস্মৃত চোখ। শান্ত অন্তর থেকে হাসল,’ বাসে। নারীরা জগতে এসেছে শুধু ভালোবাসার জন্য। এদের ভালো না বেসে উপায় নেই।’
‘ সব নারী ভালোবাসা তো পায় না।’
‘ পায়। তুমি কি সবার খবর রাখো না কি?’
ফাবিহা একটু চুপ থেকে বলল,’ আপনি কি কোন নারীকে ভালোবেসেছেন?’
শান্ত থমকালো। সত্যি কি সে বেসেছে? ভালোবাসা কি এতটাই সহজ বস্তু না কি!
‘ মাকে ভালোবাসা হয়ে উঠেনি। বোন আমার নেই। জীবনের প্রথম দু’ নারীর কাছে হারার পরে আমার মনে হলো আর ভালোবাসা যায় না। আর যদি তুমি বলো আই লাভ ইউ বলা ভালোবাসা তাহলে আমি বলব আমি বহু বার বহু নারীকে ভালোবেসেছি। আর যদি তুমি বলো এটা বলার সাথে মন অনুভূতি হৃদয়ের একটা ব্যাপার থাকতে হবে তাহলে আমি বলব সেটা নেই। মানে আমি কাউকে ভালোবাসি না। বাসতেও পারি না। ভালোবাসা সবার দ্বারা হয় না।’
শান্ত থেমে গেল। কি ভেবে প্রশ্ন করল,’ তুমি সবার আগে আমাকে কল করেছ তোমার বিয়ের খবর দিতে? কাহিনী কি?’
ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ কারণ আমি আপনাকে পছন্দ করি। ভালো লাগে। আপনার সাথে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কোথায় যাওয়া যায় বলুন তো?’
শান্ত আকাশ থেকে পড়ল এমন করে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। ফাবিহা এমন একটা কথা বলল? চোখ বুঝে সিটের সাথে হেলে শুয়ে রইল সে অনেকক্ষণ। ফাবিহা হাসতে হাসতে বলল,’ মজা করছিলাম। ভয় পেলেন না কি?’
শান্ত চট করে চোখ খুলে ফেলল। সে কি সত্যি ভয় পেয়েছে? না কি অনুভূতির অনুভবে ডুবে কিছু একটা খুঁজতে লেগেছে? শান্ত খুব পজিটিভ ধর্মী ছেলে। বিদেশে বড় হওয়ার ফলে তার মাঝে বাঙ্গালী ইমোশনাল কাজ করে কম। সে দ্রুত নিজেকে সারিয়ে তুলে বলল,’ না অবাক হয়েছি। বাংলাদেশের মেয়েরা সাধারণত নিজের মনের কথা এভাবে হুট করে বলে দিবে এটা ভেবে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম।’
‘ কেন আমরা এমনটা করতে পারি না?’
‘ পারো না। পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের একটি রূপ আকার আকৃতির সাথে কিছু নিয়মও আছে। তাই নিয়ম ভাঙ্গা যাবে না। বিয়ের জন্য অগ্রীম শুভেচ্ছা।’
‘ সে যদি আমাকে অসম্ভব ভালো না বাসে তাহলে কি আমি আপনার কাছে চলে আসতে পারব?’ ফাবিহার গলা ভারী হয়ে গেল। শান্ত বুঝতে পারল। কিছু একটা হয়েছে। আশেপাশে না। বক্ষপিঞ্জিরায়। সে ফিসফিস করে বলল,’ অবশ্যয়।’
সে ফোন কেঁটে দিল। বন্ধ করে রাখল। সে জানে ফাবিহা কখনো ফিরে আসবে না। সে একসময় খুবই আনন্দিত হবে এই বিয়ের জন্য। শান্ত গাড়ির স্টেনে মাথা রেখে শুয়ে রইল। তার কি কষ্ট হচ্ছে? ফাবিহাকে কি সে বলবে,’ তুমি পালিয়ে এসো। আমার সাথে আমেরিকা চলো। আমার দেশে। দু’ জনে বিয়ে করব।’ বিয়ে! শান্ত তো জীবনেও বিয়ে করবে না। কখনো না। বিয়ে করা অসম্ভব বস্তু তার জন্য। সে চিৎকার করে কড়া শব্দে বলল,’ স্যরি ফাবিহা। আমি চাই এই রাতের তারার মতই তোমার জীবন শুভ সুন্দর উজ্জ্বল হোক।’
কিছু ভালোলাগারও বিচ্ছেদ হয়। শেষ হয়। সব গল্প সুন্দর হয় না। শান্ত অনেক দিন পরে কাঁদল। তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আজ কাঁদতে না পারলে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে কাঁদা প্রয়োজন। কিন্তু সে তো মাঝে মাঝেও কাঁদে না। আজ না হয় কাঁদুক। কান্না সুন্দর। অক্টবরের বৃষ্টির মতই ঝকঝকে।
‘ Repentance will not touch you Fabiha. Repentance will burn me. In such a way coal burns and becomes bloody. অনুতপ্ত তোমাকে ছুঁয়ে যাবে না ফাবিহা। অনুতপ্ত আমাকে জ্বালিয়ে দিবে। যেমন ভাবে কয়লা জ্বলে রক্তাক্ত হয়ে।’
______________
পৃথিবীর চিরসুন্দর কিছু দৃশ্য থাকে। এই কক্ষটির চিত্র অনেকটা এমনই। নাফিস উদ্দিন মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে শুয়ে আছেন। বিছানায় তার বাবা ঘুমচ্ছে। ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ার ফলে হাত পায়ের ব্যাথা তাকে খুব জ্বালাতন করে। কাল রাতেও খুব কামড়াচ্ছিল যেন শরীর। নাফিস উদ্দিন বাবার ঘরে পানি রাখতে এসে এই দৃশ্য
দেখে বসে পড়লেন। হাত পা মালিশ করতে করতে তিনি এখনেই বাবার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ধরফর করে উঠে বসলেন। এটা মিতুয়ার গলা। মেয়েটা এমন হঠাৎ হঠাৎ উচ্চশব্দ করে! তিনি ঘুমঘুম চোখে উঠে দাঁড়ালেন। অনুভব করলের ঘাড় ব্যথিত খুব। পা জোড়া চলে না যেন। বসে বসে ঘুমানো সহজ বিষয় নয়। ধিরে দরজা টানলেন। যেন বাবার ঘুম নষ্ট না হয়। ড্রয়িং রুমে এসে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তার মেয়েও চিৎকার করছে তা বেশ বুঝতে পারছেন। গম্ভীর মুখ আরও একটু গম্ভীর করে তিনি রান্না ঘরের দিকে গেলেন। বিরিয়ানির ঘ্রাণে ঘর মৌ মৌ করছে। সাথে খাসির মাংস। আজ বাড়িতে উৎসব আছে না কি? নীহারিকা ততক্ষণে বিকট চিৎকার করে বলল,’ মা তুমি রান্না বন্ধ করে বলো এই নিউজ আমাদের আগে দেওনি কেন?’
আফিয়া বড়ই খোশ মেজাজে রয়েছে। তিনি খুন্তি নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুচকি হাসি ঠোঁটে ধরে রেখেছেন। মেয়ের এমন আজব প্রশ্নের বানেও নড়ার নাম নেই। নাফিস উদ্দীন চশমা পড়ে নিয়ে বললেন,’ চিৎকার করছ কেন তোমরা?’ নীহারিকা এক ছুঁটে বাবার সামনে দাড়িয়ে চুড়ান্ত দুঃখে ভেসে গিয়ে বলল,’ বাবা ফাবিহার বিয়ে হয়ে গেছে। কালকে।’
নাফিস উদ্দীন একটু চমকালেন। তিনি ভেবেছিলেন মেয়েরা জানে এই বিষয়। যেহেতু এই তিন বোন একে অপরের প্রাণ। এতো গুরুতর বিষয় না বলে তো থাকা যায় না। বাবার চমক চোখ দেখেই নীহারিকা আরও দুঃখ প্রকাশ করে বলল,’ তুমি জানতে?’
‘ হ্যাঁ। এতো বড় চোখ করছ কেন? আমি ভেবেছি তুমি জানো।’
‘ আমি বা আমরা দু’ জনই জানতাম না বাবা। এটা কি উচিৎ হলো? তোমরা এটা কিভাবে করলে? আজ থেকে বাসায় কিছুই খাব না। এসবই মা করেছে। তার হাতের রান্না ছোঁয়া নিষেধ।’
নীহারিকা সোফায় পা গোল করে শুয়ে পড়ল। মিতু আপুর হতাশ গলায় ফিসফিসে সুরে বললেন,’ বলিস কি! এতো মজার খাবার মিস করব? ফাবিহার বিয়ে ওতো ইম্পর্টেন্ট নয়। আমাদের বংশে মেয়েদের বিয়ে সুন্দর করে আনন্দের সাথে হয় না। চল খাই। খালামনি তুমি অন্যায় করেছ। তাই তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ। কিন্তু খাবার আমি….।’ নীহারিকা মুখ চেপে বাকি অংশ পাল্টে বলল,’ খাবই না। তুই চল এখান থেকে।’ নীহারিকা রাগে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে মিতু আপুর হাত টানতে টানতে ছাদ ঘরে নিয়ে গেল। সেখানেই তাদের বাসস্থান। নাফিস উদ্দিন খুবই বিরক্তির সহিত স্ত্রীকে বললেন,’ এসব কেন করেছ? ওদের জানার ইচ্ছে এবং অধিকার রয়েছে।’
‘ শুনো বেশি কথা বলবে না। ওদের জানাতাম আর এরা সবচেয়ে ভালো মেয়েটার মাথা খেয়ে এদের মতই তৈরি করত। পরে দেখা যেত বাড়ির তিন মেয়েই পালাতক আসামি। নিজের মেয়েকে সামলাও। মেয়েদের এতো রাগ ভালো না। স্বামীর ঘরে এমন রাগ দেখালে তোমার ঘাড়েই এসে পড়বে। বজ্জাতের হাড্ডি এক একটা।’ নাফিস উদ্দিনের কটমট দৃষ্টিও উপেক্ষা করলেন আফিয়া বিলকিস। বিড়বিড় করে নাফিস উদ্দিন বললেন,’ এই বংশের মেয়েরাই এমন। আমার কি দোষ। সব বদের হাড্ডি।’
‘ কি বললে তুমি? আমি কিছু শুনছি না মনে করেছ? নিশ্চয়ই আমাকে বিড়বিড় করে গালি দিচ্ছ। তাই না? বলছ না কেন?’
নাফিস উদ্দিন জিব কাঁটলেন। মুখে পেপার ধরে বললেন,’ বলেছি তোমাদের মত উচ্চ বংশের মেয়ে পেয়ে আমাদের মত পুরুষের জীবন ধন্য।’
আফিয়ার মন মেজাজ খুব ভালো। তাই ভেংচি কেটে চলে গেলেন। এই লোক এবং তার মেয়ের সব কিছুতে ঢং!
_____________
মুঠো ফোনটি অবজ্ঞায় পড়ে থাকলেও আজ বেশ কদর হয়েছে এর। বিছানার চাদরের উপরে ধীরে যত্ন করে রেখে নীহারিকা ফিসফিস করে মিতু আপুকে বলল,’ তোর কি মনে হয় ফোন ধরবে?’
মিতু আপু কুটিল হেসে বলল,’ অবশ্যয়। এতে কোন সন্দেহ নেই।’
‘ আমাদের এতো বড় ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করে নিলো আর আজ তার বিয়ের প্রথম সকালে সে আমাদের ঝাড়ি খেতে ফোন ধরবে অবিশ্বাস্য নয় কি?’
‘ নয় নয়।’ বলতে বলতে ফোন রিসিভ হয়ে গেল। নীহারিকা আশ্চর্য্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে বসে রইল। ফাবিহা নরম মলায়ম সুরে বলল,’ আসসালামুয়ালাইকুম মিতুয়া আপু এবং নীহারিকা।’
দু’ জনেই মুখ চাওয়া চাই করে সালামের জবাব নিল থমথমে কন্ঠে। ফাবিহা রাসভারী কণ্ঠে বলল,’ নিশ্চয়ই বাসর ঘরের কাহিনী শুনতে ফোন করা হয়েছে?’
‘ নিশ্চয় রাগ ভাঙ্গাতে এতো সকালে ফোন নিয়ে বসে থাকা হয়েছে?’ নীহারিকা গম্ভীর হয়ে বলল। ফাবিহার প্রতিক্রিয়া ধরা যাচ্ছে না। মিতু আপু সব ঠেলে ঠুলে দুঃখের সাগর নিয়ে বলল,’ তুই এইটা একটা কাজ করলি? মা খালারা তো এক একটা শাকচুন্নির মা, তুই কি কাজ করলি এটা?’
ফাবিহা ছোট করে উত্তর দিল,’ মা নিষেধ করেছে। তুই পালিয়েছিস তাই এটা তোর শাস্তি ছিলো বলে।
‘ থাপড়ে গাল লাল করে দিব তোর। সামনে আয় একবার। ফোন ধরলি কেন বেয়াদপ? আমাদের সস্তা মনে করেছিস? তোর বিয়েতে যাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি না কি? কি ঢঙ্গের বিয়ে! হুহ মনে হচ্ছে শারুখের বিয়ে।’
‘ শারুখের বিয়ে তো আমার বাপের সময়েই হয়ে গেছে। নতুন কারো নাম বল।’
‘ চুপ বেয়াদপ। মুখে মুখে তর্ক না করে বল ছেলেটা কে? নিশ্চয় কোন গাঁধা। মা তো ভালো কিছু খুঁজে বের করতে পারে না।’
‘ বাবা খুঁজে বের করেছে।’ ছোট ছোট করে বলল ফাবিহা। নীহারিকা এবার আরও কাছে ঘেষে বসল। সে কথা বলবে না ঠিক করেছে। শুধু শুনবে। মিতু আপু সব কাহিনী এক সাইডে রেখে বলল,’ তাহলে সেই গাঁধার কাহিনী বল। যেই পছন্দ করুক হবে একটা আস্ত গাঁধা।’
‘ বাসর ঘরেই দেখা হয়েছে। নীহারিকা কি তোর পাশে? ও কি রাগ করেছে? আর কথা বলছে না কেন?’
নীহারিকা অভিমান করে কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। মিতু আপু বলল,’ এতো কথা রাখ তো। সেই ছেলেটার কথা বল। কালো? ল্যাংড়া? না কি অন্ধ টন্ধ? মদ টদ খায়?’ ফাবিহা চমকে গেল। অবাক হয়ে রইল কিছুক্ষণ। মিতু আপু বাবা মায়ের সম্পর্কে এধরনের ধারণা কিভাবে পোষণ করতে পারে? তারা কি তাদের নিজের মেয়ে নয়? বাবা মা কি জেনে বুঝে এমন করে না কি? তবুও কষ্ট হয় মিতু আপুর অতীত ভেবে। তাই নিজেকে শুধরে নিয়ে আসর জমজমাট করতে বলে উঠল,’ শুন নীহুকে বল ঢং করতে না। আমি জানি ও এখন কান পেতে শুনে আছে। কাছে এসে বসতে বল। আমি সম্পর্ণ ডিটেইলস বলব। আসতে পারিসনি তো কি হয়েছে আমি না হয় বাসর রাত সেক্রিফাইজ করব। কেউ করে কখনো বল? তুই ওতো আমাদের সব বলিসনি। আমি বলব। একদম এ টু ঝেট।’
নীহারিকা নাক মুখ কুঁচকে নিয়ে উঠে বসল। মিতু আপু বিস্মৃত হয়ে বলল,’ সব বলবি? কি কি করলি তোরা? একদম প্রাইভেট টপিক্স?’
‘ অবশ্যয় বলব। আমি মিথ্যা বলি না।’
এবার নীহারিকা মুখ খুলল। অত্যন্ত বিরক্ত গলা তার,’ এসব আমি শুনব না। শুধু সাধারণ বিষয় বললেই হবে। আমি এখনো সিঙ্গেল। বিয়ে হয়নি। আর তোরা পার্সোনাল টপিক্স খুলে বসেছিস? ছিঃ।’
‘ ছিঃ ছিঃ করছিস কেন? যেন এসব নতুন পৃথিবীতে উদ্ভব হয়েছে? না কি এসব তুই জানিসই না? চার বছরের শিশু তুই? চুপ কর বজ্জাত। তুই বল ফাবিহা। লজ্জা হলেও বলবি। এটা তোর শাস্তি। চরম শাস্তি।’
ফাবিহা লাজুক হেসে ব্যাখা করতে গিয়ে একদম কাল রাতে চলে গেল।
ক্লান্ত হয়ে যখন ফাবিহা রুমে প্রবেশ করল সে চমকে গেল। এতো সুন্দর নীল ফুল দিয়ে রুমটি সাজানো যে তার চোখ নিভে যেতে চাইল। সারা বিছানার চার পাশে লতার মত ঝুলছে নীল ফুল। বিছানার মাঝে হলুদ গোলাপের পাপড়ি। চারপাশের কাঁচের ফুলদানিতে রজনীগন্ধা। কি সুন্দর ঘ্রান! সে চমকে চমকে চার পাশে তাকালো। একটি মাঝারি সাইজের সাধারণ একটি রুম। মাঝে একটি সুন্দর হোটেল রুমের মত বিছানা। দু’ পাশে দু’ টি ছোট টেবিল ল্যাম্প রাখার টেবিল। এক কোণে একটি এক সিটের বিন। একটি এক সিটের হাতের আকৃতির সোফা। একটা আলমিরা। একটা টেবিল। শেষ আর কিছু নেই। রুম তবে ভর্তি হয়নি। ফাবিহা বুঝল বেশ বড়ই রুম। বিছানার পিছনে একটি বিমানের ছবি। নীল আকাশের গালিচা বেয়ে উড়ছে একটি শুভ্র দু’ পাখার বিমান। পড়ার টেবিলের দেয়ালেও প্লাস্টিকের ছোট ছোট বিমান লাগানো। একদম বাচ্চাদের মত। হেসে ফেলল ফাবিহা। লোকটা বাচ্চা টাচ্চ নয় তো আবার? পরক্ষণে মনে পড়ল সে তো পাইলট। বিমানের ড্রাইভার। ঘরে তিনটি জানালা। একদম বিছানার পিছনে একটি জানালা। আর দক্ষিণের দিকে দু’ টি জানালা পাশাপাশি খুব। সাদা নীল পর্দা উড়ছে। বাহিরে শীতের হিমেল হাওয়া। ফাবিহা প্রথমে নিজের মাথার লাল ওড়না সরিয়ে রাখল চেয়ারের উপরে। বিছানায় বসল না। তার এই বিছানার চেয়ে জানালার প্রতি আগ্রহ বেশি। তাকে যখন এক অল্প বয়সি মেয়ে এই ঘরে দিয়ে গেল তখন বলে গেলো বিছানায় বসতে। আরও কি কি যেন বলেছিল। ফাবিহা সব বেমালুম ভুলে বসে আছে। জানালার দু’ পাল্লা খুলেই বিস্ময়ে চোখ তার আকাশ বাতাস। একদম হাত বরাবর দু’ টি কাঠ গোলাপ গাছ পাশাপাশি দাড়িয়ে। একটি হালকা গোলাপী রঙ্গের সাথে গাঢ় মেজেন্ডার ছড়াছড়ির আর অন্যটি সাদা হলুদ রঙ্গের। হতবিহ্বল নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ফাবিহা। তারপরই উৎসাহ তাকে এতটাই চেপে ধরল যে সে হাতের চুড়ি খুলে ফ্লোরে টেবিলি ছুড়তে লাগল। ঝুন ঝুন শব্দে সারা ঘর মুখিয়ে গেল। তার শাড়ির ভারী আঁচল সে একদম ঠেলে কোমড়ে গুঁজে নিল। তারপর জানালার উপরে এক পা দিয়ে দাড়িয়ে হাত বাড়াল। কয়েকটা ফুল হাতেও আসল। আরও নেওয়ার আগ্রহে সে ঝুঁকে গেল। তখনই কেউ হাত টেনে ধরল। ফাবিহা হতচকিত হয়ে চোখ বড় করে পাশে তাকাল। সাথে সাথে ভূত দেখার মত এক চিৎকার দিয়ে বলল,’ আপনি কে? এখানে কি করছেন? হাত ধরেছেন কেন? নাউজুবিল্লাহ এটা কি ধরনের অসভ্যতা?’
ফাবিহা ঘৃণায় জড়জড়িত হয়ে হাত নাচাতে লাগল। পা পিছলে সে পড়েই যাচ্ছিল। সামনের ব্যক্তি টেনে তাকে নামিয়ে দিল। বুকের সাথে ধাক্কা হলো। ফাবিহা আরও কয়েক ধাপ চমকাল। চোখে মুখে ছুঁটে আসল রক্তিম আভা। রাগে ভাসা ভাসি চোখ। আগ্নির মত তান্ডব চোখে মুখে। ঠোঁটে আগুণের ছড়াছড়ি। সামনের মানুষটি মোহনীয় চোখে স্তব্ধ হয়ে চেয়েই রইল। ফাবিহার হাত নাচানাচিতে সে ফিরে এলো আকাশ দুনিয়া থেকে। বেরিয়ে এলো মনবাড়ির অনুভূতির কুঠুরি থেকে। ফাবিহা এবার চিৎকার করে ডাকতে লাগল,’ কেউ আছেন? বাঁচাও বাঁচাও।’
আশ্চর্যের চরম শেখরে উঠে ছেলেটি বলল,’ এভাবে চিৎকার করছ কেন? মানুষ অন্য কিছু ভাববে। বাসায় আমার আম্মু আব্বু আছে।’
‘ আপনার বাবা মা বাসায় থাকার পরেও অন্যের ঘরে ঢুকে গেলেন? এটা কেমন বেহায়াপনা? আমার হাজবেন্ড কোথায়? এটা তার রুম আপনি জানেন না?’
ফাবিহা মনে মনে হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। আচ্ছা টিভি সিনেমার মত তাকে বিক্রি করে দেয়নি তো তার হাজবেন্ড নামক মানুষটা? দোয়া পড়ল সে। ছেলেটির হাতে এখনো তার হাত। গায়ে একটি টি-শার্ট। পরনে কালো ট্রাউজার। ধবধবে সাদার উপরে কেউ যেন আলতা ছড়িয়ে দিয়েছে। খোঁচা নো দাড়ি। দু’ পাশের গাল মেয়েদের মত রক্তিম। ঠিক নীহারিকার রেগে যাওয়া মুখের মত। ঠোঁট জোড়া কেমন লালছে। চোখের পাঁপড়ি কি ভারী! এতো সুদর্শন মানুষ পৃথিবীতে আছে না কি? এ তো জাওয়াদের চেয়েও সুন্দর। ফাবিহা হঠাৎ জোড়ে জোড়ে আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগল। তার কান্ডে সামনের ব্যক্তি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েই রইল। তবে হাত ছাড়ল না। এতো রাতে গাছে হাত দেওয়ায় জ্বীন চলে আসেনি তো আবার? হতেই পারে। হঠাৎ ভাবল জ্বীন হলে এতো চুপ থাকত না। নিশ্চয় খারাপ মানুষ। সে আবার চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ আমার হাজবেন্ড কই? আপনি কে ভাই? হাত ছাড়ুন। আন্টি? আঙ্কেল? আপনারা কি শুনতে পারছেন? কে যেন ঘুরে ঢুকেছে? অসভ্য হাত ছাড়।’ ফাবিহার এমন কেইকুই দেখে ছেলেটি এবার হাত ছেড়ে দিল। এক দৌড়ে ফাবিহা দরজার কাছে গিয়ে দেখল এই লোক ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। কত বড় শয়তান? তওবা! সে দরজা খুলে বাহিরে যেতে নিতেই ছেলেটি এসে দ্রুত দরজা আবার লাগিয়ে দিল। তারপর আশ্চর্য গলায় বলল,’ তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?’
‘ কিভাবে চিনব আজব? কে আপনি? আমার হাজবেন্ড কই?’
ফাবিহার চোখ জ্বালা করছে। এতো সুন্দর কেন এই মানুষ। আল্লাহ, এতো সুন্দর! সে বিস্মৃত হয়ে কিছুক্ষণ বেহায়ার মত তাকিয়ে খুঁজে বের করতে চাইল খুঁত কোথায় আছে। না নেই। শান্তও তো সুন্দর। তাযিন ভাইও সুন্দর। বেশিই ফ্যাশনেবল হলেও সুন্দর। আর জাওয়াদ তো পুরাই ও মাই গড টাইপ। তাহলে এই ছেলে আরও সুন্দর হলো কিভাবে? ফাবিহা দু’ হাতে চোখ কচলাতে লাগল। ছেলেটি বলল,’ নিজের হাজবেন্ডকে তুমি দেখনি? তাকে চিনো না?’
‘ চিনব না কেন? তবে দেখিনি। আপনি কি দেখেছেন? তাহলে তাকে ডেকে দিন তো? আচ্ছা আপনি অসভ্যের মত লোক নন তো?’
ইফতি হেসে ফেলল। তার হাসি এতই সুন্দর ছিলো যে ফাবিহা চমকে গিয়ে বলল,’ আপনি তো অসম্ভব সুন্দর। আশ্চর্য!’
এবার ফাবিহার ভয় করছে না। আর যাই হোক এতো সুন্দর ছেলে তার কাছে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসবে না। এদের রুচি এতটাও খারাপ হবে না। চাঁদের মত চকচক করা রূপ তার মত অন্ধকারের দিকে ছুঁটার প্রশ্নই আসে না। নিজেকে সে দ্রুত সামলে নিল। বাচ্চাদের মত ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হলো। এধরণের ছেলেদের সে ভয় পায় না। মিতু আপু হলে পা ভেঙ্গে দিত। নীহারিকা হলে তো গলাই কে টে দিত। সে বরং একটু সাহসিকতা দেখাল। ক্ষতি নেই। ফাবিহাকে এভাবে চুপ করে একদম স্বাভাবিক হতে দেখে ইফতি বলল,’ এখন ভয় করছে না?’
‘ জি না। আপনি কে বলুন তো? এখানে কি করছেন? আমার হাজবেন্ডের কোন ভাই হন? মশকারি করতে এসেছেন?’
তারপর সে সোফার গায়ে বসল। ইফতি তার এতো দীর্ঘজীবন দশায় এতটা অবাক হতে পারেনি আর। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফাবিহার দিকে তাকিয়ে রইল। কোন সাজ নেই মেয়েটির মুখে। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক। হাতেও কোন চুড়ি নেই। আলতা রাঙ্গা হাত। ফুলের গাজরা বাঁধা। রজনী আর গোলাপের মিলমিশ। চোখের কালো পাঁপড়ি নড়ছে রিনরিন করে। গভীর একজোড়া নিকশ কালো অন্ধকারের মনি। যেন চাঁদের উপরে দু’ টি কালো তারা। শ্যামলা গায়ের যেন সবই সুন্দর। সরু নাক। একটু সুন্দর আঁকা ঠোঁট! ইফতির ঘোর লেগে গেল। কি অশ্চর্য সৌন্দর্য্য। ফাবিহার ঠোঁট কাঁপছে। ইফতির হৃদয় কেঁপে উঠল। বাহিরের শীতল হাওয়ায় সামনের চুল উড়ছে। ঝরঝর বাতাস যেন এক ছলৎ রক্ত ছুঁড়ে মারছে মুখে। শ্যামলা গালে গোলাপী আভা কি দারুন। ফাবিহা নিজের ভ্রুতে হাত বুলিয়ে ঠোঁট উল্টো পিঠে মুছল। এই দৃশ্যও যেন কত সুন্দর। ঘামে তার কপাল চিকচিক করছে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে কাতর। অথচ কি কঠিন। শক্ত হৃদয় নিয়ে বসে আছে। যেন কোন ভয় নেই। যা হবার হোক তার সাহস কমবে না। ফাবিহার সবচেয়ে সুন্দর জিনিস তার চোখ। কতটা সুন্দর হলে কারো হৃদয় ভেঙ্গে গুড়িয়ে নতুন করে গড়তে পারবে ঠিক তার থেকেও একটু বেশি সুন্দর। আর চুল! ইফতি সেই দীঘল কালো বিশাল চুল দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ল। সেই চুল কি আরও বড় হয়েছে? না কি আগের মতই সিল্কি রেশমের মতই চোখে মুখে জড়িয়ে যায়। সে উঠে চট করে ফাবিহার খোঁপা টেনে খুলে ফেলল। এক টানে দাঁড় করিয়ে ঘুরিয়ে দিল। ঝপঝপ করে চুল খুলে খুলে পিঠ ছড়িয়ে কোমর বেয়ে নেমে গেল। ছড়িয়ে গেল চারপাশে। সামনে পিছনে পিঠে। যেন ঘরময় হয়ে গেল। ইফতির এমন কান্ডে ফাবিহা রেগে আগুন হয়ে হাত তুলল থাপড় দিতে। ইফতি চট করে ধরে নিয়ে চুল দেখতে দেখতে বলল,’ আমিই তোমার সেই আমার হাজবেন্ড আমার হাজবেন্ড। যাকে খোঁজ করে মরে যাচ্ছিলে। এবার চুপ করো।’
ফাবিহার মাথায় ভেঙ্গে যেন পাহাড় পর্বত ধ্বসে পড়ল। কি বলে এই লোক? পাগল হয়ে গেছে না কি? সে দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’ আপনার মাথা কি খারাপ? আপনি কেন সে হবেন? কে আপনি? কি যেন নাম? ধুর আঙ্কেলের ছেলে কই?’
‘ তুমি আমার নামও জানো না?’ ইফতির বিস্ময় এবার চোখে মুখে ধরা পড়ল। সে শুনেছে এই বংশের মেয়েরা হচ্ছে এক একটা অষ্টম নবম দশম আশ্চর্য। কিন্তু তেমন বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজ সে একশত পার্সেন্ট শিউর এরা কেউ সাধারণ মানুষই নয়। ফাবিহা একটু চুপ থেকে বলল,’ আপনার নাম না জানারই কথা। কে আপনি বলুন তো?’
‘ তোমার হাজবেন্ডের নাম কি সেটা বলো? আমারটা বলতে হবে না।’ ইফতি তার দু’ হাত পকেটে গুঁজে নিল। ফাবিহা ভারী লজ্জা পেল। সে তো জানেই না কে তার স্বামী কি তার নাম? কিন্তু এই লোক তার হাজবেন্ড হতেই পারে না। সে শিউর। তাই বলল,’ সে যাই হোক কিন্তু আপনি সে নন। বের হন রুম থেকে।’
‘ এটা আমারই রুম। আর এই যে তুমিটাও আমারই। এখানের সব আমার।’ ইফতি ওড়না তুলে নিল হাতে। বাড়িয়ে পরিয়ে দিল ফাবিহার মাথায়। লাল টকটকে একটি ওড়না শ্যামবর্ণের মুখশ্রীকে বিহ্বল করে দেওয়ার মত লাগছে। ইফতি হতবিহ্বল হয়ে গেল। একদম যেমনটা সে প্রথম আকাশে উড়তে পেরে হয়েছিল তার থেকেও বহু গুন বেশি। আনমনেই সে বলল,’ তুমি এতো সুন্দর! এতটা!’ ফাবিহা রেগে গেল। তাকে তিরস্কার করা হচ্ছে? কত বড় সাহস? সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার পিছন পিছন ইফতিও বের হয়ে আসল। উপরের তলায় কেউ নেই। সবাই নিচে। ফাবিহা নিচে নামার পথেই তার দেখা হলো ইসরাতের সাথে। সাথে সাথে তার পিছনে একপ্রকার লুকিয়ে সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ আন্টি আপনার ছেলে কোথায়? ঘরে একটা অন্য পুরুষ ঢুকেছে কোন সাহসে? আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছি। আপনার ছেলে কই?’ ইসরাত তাজ্জব হয়ে আঁতকে উঠে বলল,’ অন্য কেউ মানে কি আম্মু? কে ঢুকেছে? কার এতো সাহস? দেখি চলো?’ তিনি হাত ধরে নিয়ে গেল ফাবিহাকে। অর্ধেক পথেই ইফতিকে দেখে ক্রূর কণ্ঠে বললেন,’ তোমার ঘরে কে ঢুকেছে? কার সাহস এতো বেশি?’ ফাবিহা উঁকি দিয়ে মুখ হা করে ফেলল। ইফতি তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কি আজব মেয়ে! মায়ের দিকে চোখ ঘুরিয়ে সে বলল,’ আমিই ছিলাম আম্মু। অন্ধকারে চিনতে পারেনি তো তাই এভাবে চলে এসেছে। আর তোমার ছেলে যেন কয়টা?’
ইসরাত অবাক হয়ে বলল,’ একটাই তো। তাও তুই। তোকে কিন্তু আমি ভুলি না। হ্যা মানলাম একটু ভুলে যাওয়ার স্বাভাব আছে তাই বলে নিজের ছেলেকে কে ভুলে যায় বলো ফাবি? ও আমারই ছেলে। পাইলট ছেলে। এই ওকে নিয়ে যা। মজা করবি না এমন। ভয় পেয়েছে মেয়েটা।’
ফাবিহা এবার দারুন ভয় পেল। সে এতোটাই ভয় পেলো যে পড়ে যেতে নিলো। ইফতি দু’ হাতে তাকে ধরল। তার মা একটু হেসে নিচে নেমে গেলেন। ইফতি পাঁজাকোলে তুলতেই ফাবিহা শক্তি খরচ করে চেঁচাতে চাইল। কিন্তু পারল না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। মা কি শেষমেশ তাকে হাসির পাত্রী করে তুলবে? এতো সুন্দর একটি ছেলে ধরে তাকে বিয়ে দিয়ে দিল? কেন? তার কান্না আসছে। সহ্য হচ্ছে না। সে মানতে পারছে না শান্তর মিলে যাওয়া কথাকে। কিভাবে সম্ভব? ইফতি তাকে বিছানায় বসিয়ে তার পাশে চেয়ার টেনে বসল। ফাবিহা একদম গুঁটিয়ে গেল যেন। ইফতি বলল,’ সমস্যা কি? আমাকে পছন্দ হয়নি তোমার?’
ফাবিহা চোখ ছোট করে বলল,’ আপনি একটু বেশিই সুন্দর না? এতো সুন্দর মানুষ হওয়ার কি দরকার ছিলো। ধুর।’ সে একদম আস্তে আস্তে বলল। তার চোখ মুখ গোলাপি হয়ে যাচ্ছে কষ্টে। ইফত্তি অবাক হয়ে বলল,’ সুন্দর বলে তোমার কষ্ট হচ্ছে?’
‘ খুবই বেশি হচ্ছে।’ ফাবিহার কলিজা কাঁপছে। বুক ধকধক শব্দ করছে। লোকটি কি ভাবে যেন তাকিয়ে থাকে। ইফতির মন একদমই খারাপ হয়ে গেল। সুন্দর বলে এই প্রথম কেউ তাকে পছন্দ করছে না। তাও যার কাছে সে সবচেয়ে বেশি প্রধান্য পেতে চায় সেই কন্যাটি। তার শ্যামাঙ্গিনী।
‘ তোমার কালো ছেলে পছন্দ?’
ফাবিহা এবার একটু ফ্রি ফ্রি হয়ে বলল,’ সেটাও নয়। তবে আমি তো বেশি সুন্দর না। আর আপনি বেশিই সুন্দর।’
‘ কে বলেছে তুমি সুন্দর নও ফাবিহা?’
‘ বলতে হয় না। সত্য আরশির মত হয়। দাঁড়ালেই দেখা যায়।’
‘ তুমি কি পাগল?’
‘ আমাদের পরিবারের মেয়েদের ছেলেরা এসবই বলে।’
হো হো করে হেসে ফেলল ইফতি। ফাবিহা চেয়েই রইল সেই হাসির দিকে। কি ভয়াবহ হাসিরে বাবা! না এই ছেলের মাঝে গাফলাহ আছে। চরম গাফলা। এতো সুন্দর একটি ছেলে তাকে বিয়ে করে ফেলল? ভাবা যায়?
‘ আপনি সত্যি আমাকে বিয়ে করেছেন?’
‘ মিথ্যা হবে কেন?’
‘ কিন্তু কেন? আজব। আপনার কি মেয়ের অভাব পড়েছে? বাংলাদেশে মেয়ে নেই? কি জঘন্য একটা বিষয়।’
‘ কিসের জঘন্য?’ চোখ মুখ কুঁচকে নিল ইফতি। ফাবিহা আরাম করে বসে বলল,’ আপনার সাথে আমার বিষয়টিই জঘন্য। জোর করে বিয়ে তাই না? বুঝি বুঝি।’ ফাবিহা আনমনেই হাসল। ইফতি এসব দেখে চোখ মুখ আরও কুঁচকে নিল। ফাবিহা বলল,’ বাবা মা গুলোও না ধরে বেধে মান্দার গাছে ছাড়ু ঝুলাইতে লেগে যায়। সমস্যা নেই বুঝলেন। আর দুই এক বছরে আমার লেখাপড়া শেষ। আপনি বরং একটু আমার সুবিধা দেখুন। আমিও আপনার সুবিধা দেখব।’
এক চোখ মারল ফাবিহা। ভরকে গিয়ে ইফতি কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ কি সুবিধা দিবে আমাকে?’
ফাবিহা এবার তোড়জোর করে বলল,’ শুনুন আপনার নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড আছে? বাবা মা মেনে নেয়নি? জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল? আহ কি করুন কাহিনী। আপনি চিন্তায় অস্থির হবেন না। চোখ মুখ এত ফ্যাকাশে করছেন কেন? সহজ করুন। আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে থাকতে পারেন।’
‘ হ্যাঁ?’
‘ জি হ্যাঁ। আমার সমস্যা নেই। এমনতেও আমার এসব সংসার ধর্ম নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। এখন আপনাকে আমি এতো বড় সুযোগ করে দিব তার বিনিময়ে তো অবশ্যয় কিছু নিব। তাই না?’
‘ টাকা চাই তোমার?’ ইফতির কঠিন গলা। চোখ জোরা কেমন লাল লাল। গাল মেয়েদের মত হয়ে উঠছে। রক্তিম রক্তিম। ফাবিহা জিভ কেঁটে বলল,’ ছিঃ। এমন নয়। আপনি আমার পড়াটা কন্টিনিউ করাবেন। চাকরী পাওয়ার সাথে সাথে টাকা ব্যাক করব। আই প্রমিস। আর আমাদের বংশের মেয়েরা একটু পাগলাটে হলেও আমরা কথা রাখি। যুক্তি মঞ্জুর কি না বলুন?’ ফাবিহা হাত এগিয়ে দিল। দু’ ক্রশ দূরের ইফতি নিস্তব্ধ অন্ধকার হয়ে রইল। মেয়েটির মুখে ক্লেশ মাত্র নেই। কত সহজে অনায়াসে এসব যুক্তি শর্ত নিয়ে হাজির হচ্ছে। তাকে এতোটা অপছন্দ করার মত কি আছে? যার জন্য হাজারো মেয়ের লাইন সে কি না শেষে স্বীয়স্ত্রীর দুয়ারে এসে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল! ইফতি উঠে দাড়াল। হাত মিলালো না। জানালার বাহিরে হাত দিয়ে সে ফুল ছিড়ায় মন দিল। বাসর রাতে কত ধরণের গল্প হয়। কত ধরণের কাহিনী হয়। অথচ সে কখনো শুনেনি বউ ফুল ছিড়তে এভাবে জানালায় উঠে। কি ভয়াবহ!
ফাবিহা গুনগুন করে গান করতে করতে সামান্য চোখ লেগে এসেছিলো। মাথায় আদ্র স্পর্শে চোখ খুলল। চেয়ে দেখল। ঘুমজোড়ানো চোখে সে ঘোরে চলে গেল। কি সুন্দর! এতো রূপবান পুরুষ এজগতে আছে? তাও তার শিউরে বসে? সে চট করে উঠে বসল। চেয়ারের গা থেকে উঠতেই মাথা ঘুরঘুর করতে লাগল। কেমন যেন অনুভূতি। কি করছে এই লোক পিছনে বসে? সুযোগ নিচ্ছে? অবশ্য তার সুযোগ নিতে যাবে কেন? সে একটু কাঁচুমাচু হয়ে এদিক সেদিক নড়তেই ইফতির গম্ভীর্য্যে ভরা গলা পাওয়া গেল,’ ডোন্ট মুভ। অলরেডি হিউজ রাবিশ বকা হয়ে গেছে তোমার। এখন বসে থাকো।’ কাঁচা ঘুম ভাঙ্গায় ফাবিহার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। ইফতি সামনে এসে চেয়ার টেনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্নিমিষ চাহনী। গভীর, সচ্ছ, কাঁচের মত দৃষ্টি। মোলায়ম ভালোবাসা কাব্যিক নজর। এসব স্বপ্নের মত। বাস্তবে এমন কিছুই ঘটে না। তা না হলে শান্ত কেন এলো না। অশান্ত এই মনে বাসা বাঁধাই কঠিন। এই যে রং নেই রূপ নেই। এধরনের মেয়েদের কুলও নেই কিনারাও নেই। ফাবিহা বিরক্ত হলো নিজের চিন্তা ভাবনায়। তার সব আছে। আল্লাহ আছে। ছেড়ে গেলে যাবে। ডিভোর্স হতে ভয় কিসের যদি পৃথিবীর মালিক সাথে থাকে। সে একটু ইতস্তত করছে। ইফতির ভ্রুক্ষেপই নেই। সে তার গভীর নেশালো চক্ষু বাধিয়ে রেখেছে। খুঁক খুঁক করে কাশল ফাবিহা। অথচ ইফতির খবরই হলো না। লম্বা কালো কুঁচকুঁচে রেশমের মত কোমল চুলের ভাঁজে কাঠগোলাপ গেঁথে আছে। কানের পাশে দু’ টি ফুল। সোজা শিঁথি করা। তেলতেলে গালজোড়া চকচক করছে। মন্ত্রমুগ্ধ কর। আকর্ষণীয়। কাতর করে তোলার মত সেই চোখে তাকিয়ে ইফতি বলল,’তুমি ভারী সুন্দর ফাবিহা। বড্ড বেশিই সুন্দর।’ চমকে উঠে তাকিয়ে রইল ফাবিহা। মনে মনে ক্ষুদ্ধ খুব। তাকে নিয়ে তামাশা করছে এই লোক। আচ্ছা বজ্জাত! সে বলল,’ আপনি কোথায় ঘুমাবেন? আমার তো ঘুম পাচ্ছে।’
‘ বলো কি ঘুমিয়ে যাবে? আজ না বাসর রাত। এই রাতে না কি কেউ ঘুমায় না।’
‘ কে বলল আপনাকে?’ ফাবিহা লজ্জায় থরথর করে কাঁপছে। তার কণ্ঠের মিহি সুর গুলো যেন ইফতির হৃদয়কে আরও গুড়িয়ে দিয়ে কাতর করে দিল। সে মাতাল করা গলায় বলল,’ এটাই সত্য। রাতুল বলেছে।’
‘ সত্য তবে সব জায়গায় না। আমার জায়গায় আপনার গার্লফ্রেন্ড হলে সত্য হতো।’
‘ আমার তো কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। আছে শুধু বউ। বউ দিয়ে হবে না?’
‘ আপনার মজা শেষ? ঘুমাই আমি। টা টা।’
ফাবিহা বিছানায় উঠে শুয়ে গেল। ইফতিও অপর পাশ দখল করতে এগিয়ে আসল। চেঁচাল ফাবিহা। বলল,’ একি আপনি এখানে কি করছেন?’
ইফতি বসতে বসতে বলল,’ ঘুমাবো।’
‘ আমার সাথে? এক বিছানায়?’
‘ স্বামী স্ত্রী তো এক বিছানায় ঘুমায় তুমি জানতে না?’
ফাবিহা আগাগোড়া কিছুই বুঝল না। শুধু শুকনো ঢোক গিলে অস্বস্থি ভরা নয়নে চেয়ে রইল। তারপর ভাবল এই লোক তাকে আর কিই বা করবে। সে শুয়ে গেল। ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ইফতির মাথায় দুষ্টোমির ভুত চড়ে বসেছে। এক হাত ফাবিহার গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা শরীরের উপরে রাখতেই এক লাফে বিছানা থেকে পড়ে গেল ফাবিহা। শব্দ করে কোমড় ধরে বসল সে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলল,’ আপনার সমস্যাটা কি? গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? লজ্জা করে না মেয়েদের গায়ে হাত দিতে? ছিঃ। শেম অন ইউ। হাউ রিডিকিউলাস।’
‘ মেয়েদের গায়ে হাত দিলাম কই?’ ইফতি বিছানার উপর থেকে ফাবিহার মুখ বরাবর ঝুঁকে রইল। ভয়ে ফাবিহা আরো লেপ্টে গেল ফ্লোরের সাথে। ইফতি বেশ মজা পাচ্ছে। ভিতু ভিতু মুখ কেমন কুঁচকে আছে। কম্পিত হচ্ছে শরীর মন আত্না।
‘ আপনার আমাকে মেয়ে মনে হচ্ছে না?’ হালকা রাগ মিশ্রীত কণ্ঠ তার।
‘ না মনে হচ্ছে না।’
‘ কি মনে হচ্ছে ছেলে? হিজরা?’
‘ এসব মনে হতে যাবে কেন? যেটা মনে হওয়ার সেটাই মনে হচ্ছে।’
‘ কি মনে হচ্ছে?’
‘ বউ। বউ মনে হচ্ছে। পাইলটের উড়ানচণ্ডি শ্যামকন্যা বউ। যার দীর্ঘ কালো নেশালো চুল। মাতাল করা আখি উতলা করার ওষ্ঠ। ঝাপসা করা পাঁপড়ি। যথেষ্ট নয় কি?’
ফাবিহা মুখটা ছোট করে ভাবল। কি মোহনীয় কথাবার্তা। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলো। লোকের মতলব খারাপ। কিছু তো একটা আছে? তা না হলে তার মত মেয়ে যাকে দুনিয়াতে তিন ভাই দুই বোন বাদে কেউ কখনো তারিফ করেনি এমন কি যার মা তার জন্য চিন্তায় চিন্তায় সকাল বিকাল পার করত সে হঠাৎ অন্য বাহিরের একজন পাইলট তার উপরে বিখ্যাত সৌন্দর্য্যে মন্ডিত পুরুষের ভালো লেগে গেল? এ যে অসম্ভবের চেয়েও অসম্ভব তা ফাবিহার মত ওয়েল এডুকেটেড মেয়ে বেশ জানে। তার সাথে ভেলকি বাঁজি চলবে না বাবা জি। ফাবিহা নিজে একটু সরে এসে টি-শার্টের কলার ধরে টেনে নিচে ফেলে দিল ইফতিকে। ঘটনার আকর্ষকতায় ইফতি প্রচন্ড ব্যাথায় চিৎকার করল। ফাবিহা এই দৃশ্য দেখে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে। ইফতি চিৎকার থামিয়ে এক হাতে ফাবিহার সরু কোমড় টেনে কাছে নিয়ে আসতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল ফাবিহার অঙ্গে অঙ্গে। তার বুকের বেসামাল তর্ক দ্বন্দে জর্জড়িত হয়ে পড়ল সে। নিঃশ্বাস হয়ে উঠল অন্য জগতের ঝড়ের মত। ইফতি এক হাতে চুল কানের কাছে গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,’ তোমাকে আমি একটু খানিই সুযোগ দিচ্ছি। কারণ যেহেতু তুমি না দেখে শুনে আমাকে বিয়ে করেছ তাই তোমার একটু সময়ের প্রয়োজন। তবে তাই বলে তোমাকে ছেড়ে দিব? এটা অসম্ভব কলিজা পাখি। ওহ নামটা সুন্দর তো।’ সে নিজে নিজেই হাসল। ফাবিহার রুহ থেমে যাচ্ছে যাচ্ছে অবস্থা। তবুও সে আগ্রহ নিয়ে সেই হাসি দেখছে। সে শান্তকে ভুলে যাচ্ছে। এই হাসি তার প্রথম প্রেম প্রেম অনুভূতিকে মাত দিয়ে দিচ্ছে। হারিয়ে দিচ্ছে। ভয়ংকর ভাবে গায়েব করে দিচ্ছে।
ফাবিহা দম বন্ধ করে আছে। ইফতি তাকে জড়িয়ে তার গায়ের সাথে লেগে ঘুমিয়ে আছে। তার সব চুল সে নিজের মুখের উপরে দিয়ে রেখেছে। সেই ভারী নিঃশ্বাস চুল গলিয়ে ফাবিহার মাথায়, গলায় ঘাড়ে কাধে ছড়িয়ে পড়ছে। শরীর কেমন গরম হয়ে উঠছে। সে নড়াচড়া করলেই বিপদ। তাকে আরও জরিয়ে ধরছে। আষ্টেপৃষ্ঠে। একটা সময় ফাবিহা ছাড়াতে চাইতেই ইফতি তার বুকের এক পাশে মাথা রেখে হাত কোমড় আকঁড়ে ধরে আরও কাছে নিবিড় ভাবে গোপনে নিজের খুব নিকটে রেখে দিল। এক বিন্দু খালি নেই যেন দু’ জনের মাঝে। ফাবিহা চাঁদের হালকা আলোয় দেখল এক অবিশ্বাস্য অপরূপ পুরুষকে। তাকে এভাবে বিয়ে করে এই পুরুষ কোন ফিল্মি ফিলিংস নিতে চাইছে কে জানে? সে ডান হাতে চুল সরিয়ে দিল কপাল থেকে। মৃদূ কোঁকড়ানো চুল। মাথা ভর্তি ঝাকড়ানো। এই লোকের নাম কি? ওহ নামই তো জানা হলো না। ফাবিহার ঘুম হলো না সারা রাত। এভাবে একটি ছেলের এতোটা কাছে এসে ঘুমানো যায় না কি? নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে সে ঘুমালোই না। ভোরের দিকে ইফতির নিজেকে খালি খালি লাগতেই সে উঠে বসল। ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল। শ্যামকন্যা কোথায়? সে ধরফরিয়ে উঠে ভালো করে চোখ দু’ হাতে কঁচলে দেখল তার দক্ষিনের জানালার পাশে বিনের উপরে গোল হয়ে নিজের উড়না প্যাচিয়ে ঘুমচ্ছে সে। তার এলোকেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুখের উপরে চোখের উপরে। এ যে বহু বছর আগের স্মৃতি! সে উঠে গিয়ে সামনে বসল। চেয়ার টেনে। টেবিলে হাত রেখে গালে ভর করে তাকিয়ে থাকল সময় নিয়ে। মিনিট নিয়ে। ঘন্টা নিয়ে। সূর্যের তির্যক আলো ফাবিহার মুখ চোখ উজ্জ্বল করে এক অপরূপা রুপে আবিষ্কার করল। ইফতি ভেবে পেলো না মানুষ সৌন্দর্য্যের কতটা জুড়ে দখল করতে পারে? সৌন্দর্য স্রষ্টা কত রকম তৈরি করতে পারে! তার সৌন্দর্য্য সৃষ্টির মিলন গুলো কতটা বিমোহিত কর! এই যে এই মেয়েটি যদি ধবধবে সাদা ফর্সা একটি মেয়ে হতো তাহলে তার মায়া রূপ, সৌন্দর্য্য, বিলাসী চোখ, অমূল্য কেশ, মনমোহনীয় অধর সব তো ম্লান হয়ে যেত। হারিয়ে যেত।
সৌন্দর্য্য তো সৌন্দর্য্যই হয়।
গায়ের রংটি শুধু মানিয়ে নেওয়ার জন্যেই রয়।
সে দু’ হাত মেলে দিয়ে ছায়া দিল ফাবিহার চোখে। সে ঘুমাক। কিছু মানুষকে ঘুমিয়ে থাকলে স্বর্গীয় লাগে। এই যে হচ্ছে ফাবিহা কোন ঐশ্বরিক রমনী। পাগল করার মত রূপের অধিকারীনি।
__________
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন। 🍁