প্রিয় সুখ-৪৩
হাফসা আলম
______________
অর্পণ, শান্ত, মুহিব এক প্রকার ছুটে এসেছে গুলশানের নাইট ক্লাবে। রাত তখন এগারোটা। বাহিরে ভয়ংকর তুফান। অর্পন শরীরের পানি ঝেরে বলল,’ গরুটার জন্য আর কত কি করতে হবে আল্লাহ জানে।’
‘ সেটাই মুহিতা যদি জানতে পারে আমি নাইট ক্লাবে এসেছি তাহলে বাসায় ঢুকতেই দিবে না।’ মুহিবের টেনশন সুর। সে দোয়া দরুদ পড়ে ভিতরে প্রবেশ করল। সব তখন রমরমা। মাত্র লোকজন আসতে শুরু করেছে। শান্তর কার্ড দিয়ে ঢুকেছে তারা। এই ক্লাবে প্রায় আসে সে। বিমুগ্ধ আগে আসতো তার সাথে হ্যাং আউট করতে। কিন্তু বেশ অনেক সময় ধরে তেমন আসে না। টেবিলের উপরে গ্লাস ভর্তি ভোদকা দেখে শান্ত লোভ সামলাতে না পেরে গট গট করে গিলে নিলো দুই পেগ। চারপাশে বিমুগ্ধকে খুঁজতে খুঁজতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ইংরেজি কয়েকটা বিশ্রী গালি দিয়ে পিঠ থেকে ঠেলে তাকে সরিয়ে দিলো বিমুগ্ধ। শান্ত চেঁচিয়ে বলল,’ হালা এমন মরার মত শুইয়া আছস ক্যা?’
‘ কারণ আমি মরে গেছি।’ বিমুগ্ধ টলমলে সুর। অর্পন তাকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে বলল,’ আগেই তো বলেছি তুলে নিয়ে বিয়ে করে নে। দরকার হলে প্রিয়মের মাথায় বন্দুক ধরতাম। তখন তো শুনলি না। এখন মর শালা।’
‘ তোর বোনকে আমার লাশও বিয়ে করবে না। তাই শালা ডাকবি না বেয়াদপ।’
অর্পন চুপ করে গেলো। তার ইচ্ছে করছে দুই চারটা চড় থাপ্পড় গালে বসাতে। কিন্তু বসালো না। বেচারা আগেই দুঃখি। রেগে তাকিয়ে রইলো শুধু। শান্ত ভোদকা গিলছে আর বলছে,’ শুন আমার কাছে ভালো প্ল্যান আছে।’
মহিত আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলো,’ কি প্ল্যান?’
চিপস মুখে পুরে বলল,’ আজকে রাতেই ওই নীহারিকা মহাজগৎ সৌরজগৎকে তুলে নিয়ে আসবো।’
‘ পুলিশে দিবে ওর জল্লাদ বাপ। কিছু দিন পরে বাবা হবো তাই জেলে যেতে চাইছি না। ভালো আইডিয়া দে?’ মহিত পাশে বসলো। বিমুগ্ধ আবার মাথা ফেলেছে টেবিলে। শান্ত একটু ভেবে বলল,’ পাইছি রে!’
তার চিৎকারে সকলে লাফিয়ে উঠল বিমুগ্ধ বাদে। অর্পন বলল,’ কি পেয়েছিস?’
‘ আমরা সোজা জাওয়াদকে কিডন্যাপ করবো। সময় মত বর না আসলে বাংলাদেশের সমাজ নিয়ম অনুযায়ি মেয়ের বাবা মা অসহায় হয়ে যার তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়। ঠিক তখনই আমরা ঘোড়ায় করে আমাদের দোস্তকে পাঠিয়ে দিবো হিরো সাহেব সাজিয়ে। নাক উঁচু বাপও তখন কিছু করতে পারবে না।’
শান্ত হো হা করে হাসতে শুরু করলো। অর্পন বিরক্ত। কিন্তু মুহিবের পছন্দ হয়েছে আইডিয়া। সে দ্রুত কাঁধ চাপড়ে বলল,’ তোর মাথায় শুধু গবর নয় একটু বুদ্ধিও আছে।’ শান্ত ধাক্কিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,’ তোর মাথায় ওই একটুও নাই। গা থেকে মদের গন্ধ আসলে তোর বউ কাঁচা চিবিয়ে খাবে তোকে। বলদের মত আমার পাশে বসতে আসছে যতসব।’
মুহিব চিন্তা করে দেখলো সত্যি তো! বিমুগ্ধ ঢুলতে ঢুলতে উঠে দাড়িয়ে বলল,’ সব সমস্যার মূল আমার হিটলার চাচা।’
তিনজনে এক সাথে বলল,’ জি হুজুর জি হুজুর জি হুজুর।’
‘ সমস্যার আগুনে ঘিয়ের মত কাজ করে ওই জাওয়াদ। কারণ সে মিষ্টার পারফেক্ট।’
‘ জি হুজুর।’
‘ সব কিছুর মূলে আমার চাচাতো ভাই প্রিয়ম। কথায় কথায় মারামারি করতে আসে।’
‘ জি হুজুর।’
‘ আর সবচেয়ে বড় ঝামেলা, বড় কষ্ট, বড্ড বেদনা, বড্ড আবেগ, এক চামুচে বিস্তর মায়া, বিস্তর প্রেম, বিস্তর ভালোবাসা রাগেশ্বসী।’
‘ জি হুজুর।’
‘ আমার নিঃশ্বাস বন্ধের কারণ নীহারিকা।’
‘ জি হুজুর।’
‘ আমাকে তিলে তিলে শেষ করার নাম নীহারিকা।’
‘ জি হুজুর।’
‘ আমার আনন্দ, খুশি, প্রিয় সুখকে কবর দিতে উঠে পড়ে লেগেছে যেই নারী সেই নারীই রাগেশ্বরী।’
‘ জি হুজুর।’
‘ আর সে নিজের বাবা মায়ের কথায় সব করতে পারে। সব সব। ভালো একজন মেয়ে।’
‘ জি হুজুর।’
‘ আর এই ভালো মেয়েকে একজন ভালো, সৎ, নিষ্ঠাবান, এবং আদর্শ্য ভালোবাসার মানুষ তৈরি করবে এই বিমুগ্ধ।’
তিনজন জি হুজুর বলার আগেই বিমুগ্ধ নিজের গাড়িতে উঠে বসেছে। মাতালটাকে ধরে ছলেবলে বের করছিলো তারা। অথচ মিনিটে সব উল্টে দিয়ে সে গাড়ি ড্রাইভ করে মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। অর্পন উচ্চ ধ্বনিতে বলল,’ মুহিব গাড়ি নিয়ে আয় দ্রুত।’
মুহিব দিলো এক দৌড়। শান্ত মাথায় হাত দিয়েছে।
‘ শালা মরবে। পুরো দমে মাতাল সে।’
অতিরিক্ত অস্থির শুনালো তাদের কথা। তিনজনেই চিন্তায় শেষ। গাড়ি নিয়ে দ্রুত বের হয়ে রাস্তায় উঠেছে। বিমুগ্ধের গাড়ি তখন সিগন্যাল ভেঙ্গে বহু দূরে। পুলিশকে টাকা গুজে দিয়ে অর্পণ জীবনে প্রথম মনে হয় এমন দুর্নিতি করলো। অথচ তার মাঝে কোন অপরাধ বোধ নেই। সে পাগল হয়ে যাচ্ছে বিমুগ্ধের এলোমেলো গাড়ি চালানো দেখে। হন্য হয়ে ছুটে গিয়েও তারা হতভম্ব। জোড়ে ব্রেক কষলো অর্পণ। শান্ত চিৎকার করে জানালা দিয়ে বলল,’ বিমুগ্ধ গাড়ি থামা। এই শুয়োর তোরে আমি খাইয়া ফেলমু গাড়ি না থামাইলে। ওই হালারপুত।’ মুহিব চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। শান্তর চিৎকার পৌছানোর আগেই গাড়ি বিরাট একটি বটগাছের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। সাদা কালো ধোঁয়ায় ক্ষণকালেই পরিবেশ ভারী। তিন জনে ছুঁটে এসে দরজা ধরে টানতে শুরু করলো। শান্তর চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে। হাত দিয়ে তীব্র আঘাত করছে কাঁচের জানালায়। মুখে বিশ্রী সব গালি। মুহিবও তার সাথে জোড়ালো ঘুষিতে কাঁচ ভেঙ্গে ফেলেছে। সাথে দুজনেরই হাত আহত। অর্পন দরজা ভিতর থেকে খুলে টেনে বের করলো বিমুগ্ধকে। পানি নিয়ে এসে খাওয়ালো। মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়েছে সে। শরীর রক্তাক্ত। অর্পণ রক্ত বন্ধ করতে একটি রুমাল চেপে ধরে বিষন্ন কন্ঠে শুধু বলল,’ শান্ত জাওয়াদকে তুলে নিয়ে আমাদের গোডাউনে আটকে রাখবি। রাগেশ্বরীকে না পেলে তার জ্ঞানী বাবা সত্যি মরবে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। হারামিটা এতো পাগল ওই মেয়ের জন্য? আমি কল্পনা করতে পারছি না সব সময় সর্বজান্তা হয়ে ঘুরা দুনিয়ার পরোয়া না করা ছেলেটা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাবে সাধারণ একটি মেয়ের প্রেমে? কবে এতো ভালোবাসলি দোস্ত?’
বিমুগ্ধের রক্তাক্ত শরীর দেখে মুহিবের চোখে জল। ছলছল চোখে সে তাকিয়ে রইলো তার সবচেয়ে উদ্ভট কাজ করা বন্ধুর দিকে। শান্ত শুধু নির্বাক। ছোট থেকে দেখে আসা ছেলেটা ভালোবাসার ঝড়ে এভাবে লন্ডভন্ড হয়ে গেলো? বিমুগ্ধের তখন একটু একটু চোখ খোলা। বিড়বিড় করে সে বলছে,’ একটুও ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি বিশ্বাস কর। কিভাবে যেন হয়েছে। হঠাৎ করে এক আতঙ্কিত ভালোবাসা হয়ে গেছে। ‘
________________
দাদামশায় অভিমানী মানুষ। বয়স হওয়ার সাথে সাথে মানুষ বাচ্চাদের মত হয়ে যায়। তিনিও এখন তেমনই। ছেলে মেয়েগুলো বড় হয়েছে। নিজেদের মর্জির মালিক তারা। তিনি ছেলে নাফিসের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যখন ছোট ছিলেন খুব বাবা ভক্ত ছিলেন। বাবার কথা ছাড়া কোন কিছু করতেন না। এমন কি আফিয়া বিলকিসের প্রেমে পাগল হয়েও বাবাকে বলেছিলেন তার পছন্দ না হলে করবে না বিয়ে। এমন একটা ছেলে কি না বাবার কথারও কোন দাম দিলো না? জগৎ মনে হয় এমনই। আগে ছেলে ছিলো তাই বাবার সব কথা শেষ মনে করতো। এখন বাবা হয়েছে। নিজের সন্তানের সুখই সবার আগে। রাত তখন অনেক। কিন্তু গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বেশিরভাগ স্থানে এখন বেশ রাত করেই হয়। চারপাশের আলোকসোজ্জা দেখে তিনি ভাবছেন কার বাসায় থাকবেন এই দিনে? দুই ছেলেই একদম ত্যাড়া। একুই দিনে দুই নাতি নাতনীর বিয়ে দেওয়ার কি আছে! এতো রাগ কোথা থেকে পেয়েছে এরা? নিজেই বুঝলেন তার থেকেই পেয়েছে। আফিয়া খাবার নিয়ে এসে বলল,’ বাবা কিছু প্রয়োজন হলে ডাক দিবেন।’
তিনি পিছু ডাকলেন,’ শুনো বৌমা বড় বৌমার সাথে তোমার কথা হয়েছে আর?’
আফিয়ার কাঁচুমাচু চোখ মুখ। তিনি বুঝলেন নাফিস পছন্দ করছে না বলে আফিয়া লুকিয়ে কথা বলে। চোখের মোটা চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। সময় নিয়ে খাবার দেখে বললেন,’ দুই বাড়ির বিরিয়ানির ভিন্নতা আমি বুঝি। বয়স এমনে এমনে হয়নি বুঝলে মা।’
‘ বাবা দয়া করে ধীরে বলুন। আপা খুব মন থেকে দিয়েছে। তারও তো একমাত্র ছেলের বিয়ে।’
‘ আমি বুঝি। আমি তো তারও দাদা। আমার ভালো লেগেছে। তুমি যাও তাকে বলে দিও আমার দোয়া সব সময় আমার নাতি নাতনীদের জন্য ছিলো, আছে, থাকবে। তারা যেখানেই থাকুক যার সাথেই থাকুক ভালো থাকুক সুখে থাকুক।’
আফিয়া বিলকিসের হঠাৎ খুব কান্না পেলো। মনে জাগলো ইশশ মেয়েটার যদি বিমুগ্ধের সাথে বিয়ে হতো! সামনেই থাকত। কত সুন্দর হতো! পরক্ষণে মাথা থেকে ঝেরে ফেলল সব।
নাফিস উদ্দিন ছেলের সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবি পড়েছে। ড্রয়িং রুম সুন্দর করে সাজানো হয়ে গেছে। নীহারিকার কাজিন, দুলাভাই সকলে আনন্দের সাথে সব পরিপাটি করছে। একটি মাদুরের উপরে সাদা গদি পেতেছে। পছনের দেয়াল জুড়ে সাদা পর্দা উড়ছে। জানালার কাছে হওয়ায় পিছনের ঝড়ো হাওয়া শরীর ঠান্ডা করে দিচ্ছে। সাদা হলুদের নেটের পর্দার উপরে গাঁধা, বেলি ফুলের মালা পেচানো হয়েছে। পিছনের দিকে কয়েকটি সাদা বালিশ। সমস্ত গদিতে অসংখ্যা ফুলের সমারোহ। সাদা এবং লাল ফুল। শাহিন ভাই খুব ছলনা করে কিছু ফুল নিয়ে এসেছে। তাকে হঠাৎ গোপনে রুমে যেতে দেখে মিতু আপুর চোখ মুখ সন্দেহের তীব্রতা। তিনিও পিছনে গিয়ে দরজার কাছে দাড়ালেন। শাহিন ভাই দেখলো না। নিজের মত আওলাঝাওলা দুটি হাতের বালা তৈরি করলো ফুল দিয়ে। গোলাপ, গাধা, মাঝে আবার সুন্দর বেলী। মিতু আপু দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাসলেন। তার এতো আদর আদর লাগলো। পিছন থেকে ঝাপিয়ে পড়ে গাল ভর্তি চুমু দিলেন। হঠাৎ আক্রমনে শাহিন ভাই প্রথমে ভুত বলে চিৎকার করতে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস পুরুষালী সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। চুপ করে যাওয়া সেই ঠোঁটেও একটু মিষ্টি প্রেম পেয়েছেন। কোলের উপরে টেনে নিয়ে এসে হাতে সেগুলো পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন,’ তুমি এখনো বাচ্চাদের মতই রয়ে গেলে।’
‘ কেন আপনার ভালো লাগে না?’ মিতু আপু মন দিয়ে ব্যস্ত শাহিন ভাইকে দেখছে।
‘ আমি চাই তুমি সব সময় এমন থাকো আমার মিতুয়া।’ একটু চুমু গাল বেয়ে ঠোঁটে গড়ানোর আগেই চিৎকার করে ফাবিহা বলল,’ তোমরা দরজা বন্ধ করে এসব রঙ্গোঢঙ্গো করতে পারো না।’
শাহিন ভাই খুব লজ্জা পেয়ে বের হয়ে গেলেন। শত হোক ফাবিহারা বাচ্চা কাল থেকে তাকে ভাই বলেই জানে। আর উনি বোন ভেবে এসেছে। লজ্জায় তার কালো গালও লাল হয়ে উঠলো। মিতু আপুর কোন লজ্জা নেই। বড় গলায় বলল,’ তোর জন্য চুমুটা খাইতে পারলাম না।’
‘ ছিঃ কি নির্লজ্জ তুই মিতু আপু।’
‘ ঢং কম করো পিও। সর হাদারাম। আহারে আমার চুমু।’ চুমু চুমু করে মিতু আপু বের হয়ে গেলো। ফাবিহা অবাক হয়ে বলল,’ চুমু বুঝি এতো জরুরি বিষয়? কই আমার তো কখনো মনে হয়নি।’
‘ কারণ তুমি কখনো এর সৌন্দর্য্য, মাদকতা বুঝনি বোকা মেয়ে।’
‘ সেটা আবার কিভাবে বুঝে?’ বলেই পাশে তাকিয়ে দেখলো ইফতি পাশে এসে দাড়িয়েছে। ফাবিহা লজ্জায় গলে গেলো। সব শুনে ফেলেছে? ছিঃ। সে শাহিন ভাইয়ের মতই কেঁটে পড়তে পড়তে শুনলো ইফতি বলছে,’ বুঝিয়ে দিবো শুধু আমার কাছে এসো পিওও।’
______
কাঁচা হলুদ শাড়ির রানী গোলাপী পাড়। হাতে সাদা লাল ফুলের আস্তরণ, কানে রজনীগন্ধার তৈরি দুল, মাথায় গোলাপের টিকলি, নাকে সুন্দর একটি ফুলের তৈরি নথ পড়ানো হয়েছে। বাঙ্গালী নিয়মে শাড়ির কোমরে মোড়ানো হয়েছে ফুলের কোমর বন্ধনী। চোখে মুখে একটু সাজগোছ, উদাসীন এক মায়াবী মনি। নীহারিকার বাবা মা মুগ্ধ চোখে মেয়েকে দেখলেন। হয় তো সকল বাবা মায়ের স্বপ্ন মেয়েকে একজন যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু নাফিস উদ্দিন চেয়েছেন তার মেয়েকে সুন্দর একটি জীবন দিতে। যেই জীবন তার তৈরি করা হবে। তিনি সব সময় চাইতেন পৃথিবীর সেরা সব তার মেয়ের হাতের মুঠতে থাকুক। সেই সেরাটা ধর্মীয় দিক হোক বা উন্নত যুগ হোক। তাই সব সময় তিনি যেটা ভালো মনে করতেন সেটাই মেয়েকে করতে বলতেন। মেয়ের যতই আপত্তি থাকুক। তার ধারণা এই জগতে তার মেয়ের সবচেয়ে ভালো সেই চায়। তিনিই বুঝেন তার মেয়ের ভালো কিসে। এমন কি মেয়ে নিজেও জানে না। এসব হলুদ টলুদ তার মোটেও পছন্দ না। কিন্তু এখনকার যুগের সব মেয়েই মোটামুটি পছন্দ করে তাই আফিয়া বিলকিস মেয়ের হলুদ করছেন। একপ্রকার বাধ্য হয়েই মেয়েকে হলুদ লাগালো নাফিস উদ্দিন। নীহারিকা কেমন জল ছলছল নয়নে বাবাকে দেখছে। নাফিস উদ্দিনের বুকটা ধুকপুক করে কেঁপে উঠলো। আফিয়া হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন। নীহারিকা কঠিন হৃদয়ের। তবুও বাবা মায়ের দিকে তাকালো না। চোখ সরিয়ে নিলো। এই কান্না কত বেদনার তা জগতের তিন শ্রেনী বুঝে বাবা মা এবং মেয়ে। আর সকলে উপর থেকে শুধু দেখে কিন্তু গভীরে অনুভব করার ক্ষমতা নেই। নাফিস উদ্দিন ধরা গলায় ধমকে উঠলেন,’ কাঁদছ কেন? এখানে কাঁদার কি হলো? হলুদ লাগাও।’
‘ মেয়েটা কাল চলে যাবে। আমার কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছে। তুমি তো বাবা তোমার কি মায়ের মত কষ্ট হবে? থাকো বাহিরে বাহিরে।’
চোখে আঁচল চেপে ধরলেন তিনি। নাফিস উদ্দিন স্ত্রীর মাথায় হাত বালালেন। কিছু বললেন না। বাবারা হাউ মাউ করে কাঁদতে পারে না। গদগদ করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না। সন্তানকে সব সময় শাসনে রাখে। তার মানে এই নয় তারা পাথর। তারা হৃদয়হীন বরফ খন্ড। তিনি পাঞ্জাবির হাত চোখে আলগোছে ডোলে নিলেন। কেউ না বুঝলেও নীহারিকা দেখলো তার বাবার চোখ লাল। প্রিয়ম বোনকে হলুদ লাগালো না। সে সামনেই আসলো না। কি যে হোল তার রুমের দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ চেপে শুয়ে রইলো। মিতু আপুরা খুব আনন্দ করলো। রাত তখন বারোটা বিশ। নাচ করার আয়োজন হচ্ছিলো। ঠিক তখনই ঝড়ের তীব্র শব্দের সাথে সাথে বিদ্যুৎ পালালো। চারপাশে হৈচৈ শুরু হয়েছে। মোমবাতির আলোতে রুমের প্রতিটি কোনা হলুদ হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে কক্ষ গুলোও গায়ে হলুদ পড়েছে। নীহারিকা বিরক্ত। নিজের রুমে যাবে ঠিক করেছে। তখনই দরজা ভেঙ্গে ফেলার মত ধাক্কা ধাক্কির শব্দ। কারেন্ট চলে যাওয়ায় ফ্যান গুলোর শব্দ নেই। ফলে একটু শব্দই অনেক শুনাচ্ছে, এটা তো উড়াধূনা। প্রিয়ম মাত্রই বের হয়েছে। চোখ মুখ ফুলে ঢোল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব কেঁদেছে। দরজার শব্দে নাফিস উদ্দিন চেঁচিয়ে বলল,’ কে এমন বেয়াদপের মত কাজ করছে? আসছি তো।’
প্রিয়ম ছুটে গিয়ে বলল,’ আমি খুলছি দাড়াও।’
দরজার পাল্লা সরিয়ে সামনের মানবকে দেখে সে হতভম্বের মত চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু মানবের গায়েই লাগলো না এমন ভাবে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে সে। শান্ত, অর্পন কোন ভাবেই ধরে রাখতে পারলো না। তাদের মাথায় হাত। বিমুগ্ধ তাদের চিন্তাকে আরও প্রখর করে নাফিস উদ্দিনের দিকে রাগ ক্ষোভ নিয়ে তাকালো।
‘ তো আপনি মিষ্টার নাফিস উদ্দিন? নাক উচুঁ সৎ মানুষ তাই তো?’
বিমুগ্ধের কণ্ঠে সকলে স্তব্ধ হয়ে জড়ো হয়েছে। নীহারিকাও ছুটে আসলো। সে বুঝতে পেরেছে বিমুগ্ধ আজকেও গন্ডগোল করবে। বিশেষ করে বাবার সাথে বেয়াদপি। ছেলেটা এতো অপছন্দ কেন করে তার বাবাকে? সে দ্রুত এগিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বিমুগ্ধ হাতের ইশারায় চুপ করতে বলল। নীহারিকা বিমুগ্ধের চোখ মুখ ভালো করে দেখছে না। অন্ধকার অনেকটা এই দিকে। তবুও তার কঠিন শক্ত চোখ দেখে নীহারিকার গলা শুকিয়ে আসছে। আফিয়া দ্রুত বোন পুত্রের কাছে গিয়ে বললেন,’ বাবা তুমি এখানে কি করছ?’
‘ কেন আপনার মেয়ের গায়ে হলুদে এসেছি। সে না আমার কাজিন হয়?’
নাফিস উদ্দিন বললেন,’ আমি তোমাকে দাওয়াত করিনি। আর তোমার বাসায়ও অনুষ্ঠান। যাও।’
বিমুগ্ধের গলা গম্ভীর,’ আপনি তো অভদ্র তাই নিজের আপন ভাইয়ের পরিবার, আপনার বউয়ের বড় বোনের পরিবার কাউকেই দাওয়াত করেননি। না না আপনি আসলে কিপ্টা। আমরা আসলে তো টাকা বেশি যাবে। কি ভয়াবহ কিপ্টা দেখ অর্পন?’
অর্পন মুখে হাত ডলছে। এই ছেলে আজ মরবে তো মরবে সাথে সবাইকে নিয়ে মরবে। ফিসফিস করে বলল,’ তুই মাতাল হয়ে আছিস সরে আয়। পরে মেয়ে তুলে নিয়ে বিয়ে করলেও মেনে নিবে না। প্লিজ বেয়াদপী করা বন্ধ কর।’
‘ কিসের বেয়াদপী? তুই দেখ কি কঞ্জুস চাচা আমার। দূরে সর।’ বলে সে আবার নাফিস উদ্দিনের দিকে তাকালো। ততক্ষণে তার পরিবারও ছুটে এসেছে মুহিবের সাথে। নবীন উদ্দিন বললেন,’ মাই সন বাসায় চলো।’
‘ না যাবো না। নাফিস উদ্দিন যান তো বিরিয়ানি নিয়ে আসুন।’
নাফিসের চোখ মুখ তখন রক্তিম। চড় দেওয়ার জন্য হাত সুলাচ্ছে। মিতু আপু ভয়ে শাহিন ভাইকে বললেন,’ কেন এসেছে তাযিন ভাই? আল্লাহ এখন কি হবে?’
‘ চুপ করো। এসেছে বেশ করেছে। তোমার নাক উঁচা খালাতো বোনকে তুলে নিয়ে যাক একদম।’
‘ নাউজুবিল্লাহ কি বলো এসব? আল্লাহ মাফ করুক।’
‘ তুমি নিশ্চয়ই জানো ভালোবাসা না পেলে কেমন লাগে তাই চুপ করে দেখো।’
বিমুগ্ধ নাফিস উদ্দিনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’ দাড়ান দাড়ান আপনি থাকেন। এই হলুদ স্টার নার্সারি আপনি নিয়ে আসুন। মাংস বেশি দিবেন। আপনাদের নাকি খাসির বিরিয়ানি করেছে বাবুর্চি বলে খুব নাম করা দেখি কেমন খেতে।’
নীহারিকার কি হলো কে জানে নির্জীব থেকে জীব হয়ে উঠল যেন। ছুঁটে চলে গেলো। যেন চঞ্চল হরিণ শাবক। বিরিয়ানির সাথে শশাও নিয়ে এসেছে। সকলকে অবাক করে দিয়ে বিমুগ্ধ ফ্লোরে বসে পড়লো। প্রিয়মকে বলল,’ এই ওদের জন্যও নিয়ে আয়।’
সকলে গোল গোল চোখ করে দেখছে। শান্ত, অর্পন, মুহিবের গলা দিয়ে নামছে না। তবুও গিলছে। নীহারিকা বিমুগ্ধকে দেখছে। অভুক্ত যেন কত যুগের। মন দিয়ে খাবার খাচ্ছে। নাফিস উদ্দিনের শরীর রাগে রি রি করছে। ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে কটমট করে। নবিন উদ্দিনও কম না। নাফিস উদ্দিনকে বলল,’ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? কম পড়বে না। দরকার হলে আমি রেঁধে দিয়ে যাবো তোর বিরিয়ানি।’
‘ খেয়ে দেয়ে বিদায় নিতে বলো তোমার ছেলেকে। আমার মেয়ের অনুষ্ঠান নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে।’
নবীন মুখ বাঁকালো। ছেলেকে নিয়ে তিনি ভিষণ চিন্তিত। শামা খালামনি চোখ মুখ ঢেকে কাঁদছেন বোনের পাশে। আবেগ ঢেলে বলছেন,’ তোর জামাইটা এমন কেনরে? আমার ছেলেটার কষ্ট দেখলো না? কত পছন্দ করতো বল।’
‘ সবই বুঝি আপা। কি আর করবে বলো এটাই ভাগ্য। তারা একে অপরের নয়।’
নীহারিকা বাবার লাল চোখের দিকে তাকিয়ে বিমুগ্ধের পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,’ বিমুগ্ধ চলে যান। কেন এমন করছেন।’
বিমুগ্ধ জবাব দিলো না। শুধু চোখ তুলে একটু তাকালো। আবার অভুক্তের মত খাওয়া শুরু করলো। নাফিস উদ্দিন পাইচারি করছেন। রাগ তার আকাশে। এবার নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলল,’ তুমি ইচ্ছে করে এসব করলে তাই না? দেখো তাযিন বেয়াদপির লিমিট আছে। আমি তোমার চাচা হই। এধরনের কাজ তুমি করতে পারো না। তোমার কাজিনের বিয়েতে তুমি অশান্তি করছ। অথচ তুমি উচ্চ শিক্ষিত একজন ছেলে।’
বিমুগ্ধ প্লেটে হাত ধুচ্ছে। খুব শৃঙ্খল ছেলেটার কি অবস্থা! ফাবিহা কাঁদছে ইফতির হাত জড়িয়ে ধরে। বিমুগ্ধ উঠে দাড়ালো। তাকে একটু একটু দেখা যাচ্ছে। মুখমন্ডল কেমন লাল! নাফিস উদ্দিন শান্ত হয়ে গেলেন। ছেলেটা হয় তো অসুস্থ। তাই কাছে এসে বুঝিয়ে বললেন,’ দেখো তোমার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। ভাইয়ের ছেলে আদর করে বলছি বাড়ি যাও নিজের অনুষ্ঠানের দিকে মন দেও। দেখো তোমার এসব দেখে মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। জীবনসঙ্গীকে কষ্ট দিলে সৃষ্টিকর্তা নারাজ হয়।’
বিমুগ্ধ এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি নাক মুখ কুঁচকে বললেন,’ ছিঃ ছিঃছিঃ তুমি মদ খেয়েছ? তোমার যে এতো জঘন্য রূপ আছে আমি জানতাম না। বের হও।’
‘ কি মশকিল আপনার বিরিয়ানি তো দুই নাম্বার। তা না হলে এটা খেয়েও মদের গন্ধ দূর হলো না? ঠকে গেলেন তো নাফিস উদ্দিন। বড় দুঃখ আপনার জন্য।’
‘ হয়েছে এবার যাও। তুমি মদ গাঁজা যা খুশি গিলো আমার কি।’
বিমুগ্ধ নীহারিকার দিকে এতক্ষণে মনোযোগ দিয়ে তাকালো। সকলকে উপেক্ষা করে তার সামনে এসে দাড়িয়ে বলল,’ তোমাকে ফুলের শেহজাদীর মত লাগছে রাগেশ্বরী। হলুদ শেহজাদী। কেন বার বার মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাবো, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, আমার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে? বলো কেন এমন মনে হচ্ছে? তুমি এতো পাষাণ কেন?’
নীহারিকার শক্ত খোলসে ফাঁটল ধরছে। চোখ চিড়ে জল ছলছল। কি একটা বেদনা বুকের মাঝের সকল দম টেনে নিচ্ছে। সে ঠোঁট কামড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নাফিস উদ্দিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে মেয়ের কান্না দেখছেন। তিনি হতভম্বের মত জিজ্ঞেস করলেন,’ কেন কাঁদছ নীহারিকা?’
ঠিক তখনই সকলের চোখ আকাশে তুলে, ভাবনা চিন্তাকে উলটপালট করে, সকল আত্মসম্মানের বুকে পাড়া দিয়ে বিমুগ্ধ নাফিস উদ্দিনের দুটি পা জড়িয়ে ধরে বসে গেলো। উপস্থিত সকলের চোখ তখন বের হয়ে আসা বাকি। স্বয়ং নাফিস উদ্দিন নড়ে গেলের হৃদয় থেকেও পা থেকেও। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,’ কি করছ তুমি বিমুগ্ধ? পা ছাড়ো?’
বিমুগ্ধ কাঁদছে। ছোট বাচ্চাদের মত। নাফিস উদ্দিন তার মাথা সরিয়ে তুলতে চাইলেন। আত্মঅহংকারী ছেলেটা এমন করছে কেন? তিনি সরিয়ে দিয়ে আবার বললেন,’ পা ছেড়ে কথা বলো প্লিজ।’
বিমুগ্ধ ছাড়লো না। আরও জোড়ে চেপে ধরলো। আফিয়া বিলকিস কাছে আসলো সরাতে। তার আঁচল জড়িয়ে ধরলো। নীহারিকা পাথরের পাহাড় হয়ে গেলো মুহূর্তে। বিমুগ্ধ! বিমুগ্ধ তার বাবার পা জড়িয়ে ধরেছে? মায়ের আঁচল ধরেছে? উপস্থিত সকলের চোখ ভিজে গেল। নানু ঘুমঘুম চোখে এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে এসে বললেন,’ কি হইলো? আমার নাতিডা কান্দে ক্যান?’
শামা মাকে আটকে ধরলেন। মিতু আপুর মাও জড়িয়ে ধরে রাখলেন মাকে। শামা খালামনির সেই কি কান্না। বিমুগ্ধ অনেক সময় পরে বলল,’ ছোট বাবা আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার মেয়েটাকে আমার করে দিন। আমাকে দিয়ে দিন। এক জীবনে কত দান করেছেন! এই দানের বিনিময়ে আমি রোজ আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দোয়া করবো। বলবো আমাকে ছোট জান্নাত দিলেও হবে আমার ছোট বাবাকে বড় জান্নাত দিন আল্লাহ। বিশ্বাস করুন আমি এই দোয়া পাঁচ বার করবো দিনে। তবুও আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার রাগী মেয়েটিকে আমার নাম করে দিন। বড় জান্নাতের বিনিময়ে দয়া করে দিন আমাকে।’
দম বন্ধকর পরিবেশকে আরও দম বন্ধ করে দিলো বিদ্যুৎ। নাফিস উদ্দিন দেখলেন তার সাদা পাঞ্জাবি ভর্তি রক্ত। তিনি নিজের কঠিনতাকে উগড়ে ফেলে নিচে তাকিয়ে দেখলেন একটি র ক্তাক্ত ছেলে তার পা জড়িয়ে ধরে বসে আছে! তার মেয়ের জন্য? এই দৃশ্য কতটা মনস্তাপ সেটা উপস্থিত সকলে অনুভব করতে পারছে। দাদামশায় নিজে বললেন,’ একে দ্রুত হসপিটালে নেও নবীন। কি করেছে নিজের!’
নবীন উদ্দিন বৈরাগী চোখে ছেলেকে দেখছেন। তার আত্মঅহংকারী ছেলে, অন্যের মনের কথা বলে দিতে পারা উচ্চশিক্ষিত, সম্মানীত ছেলে! তিনি স্তম্ভিত। নীহারিকা মূর্ছিত হয়ে বিমুগ্ধকে ধাক্কা দিতে দিতে বলল,’ হসপিটালে চলুন প্লিজ। এই আপনার এতো জখম কিভাবে হয়েছে? এই বিমুগ্ধ?’
বিমুগ্ধ নাফিস উদ্দিনকে পুনোরায় বলল,’ আপনার মেয়ের ধারণা আমি আপনাকে মানাতে পারিনি। তাই ঠিক করেছি সারা জীবন এভাবে বসে থাকবো। এভাবেই আমার মৃত্যু হোক। আমি কঙ্কাল হয়ে যাবো তবুও আপনার পা ছাড়বো না। কখনো ছাড়বো না। ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ আপনার মেয়েকে আমাকে দিয়ে না দিবেন।’
‘ বিমুগ্ধ তুমি হসপিটালে চলো। আমরা পরে এই বিষয়ে বসে কথা বলবো।’ থমথমে কণ্ঠ নাফিসের। বিমুগ্ধের বন্ধুরাও তাকে সরাতে পারছে না। তিনি প্রিয়মকে ডেকে বললেন,’ ওকে সরাও দ্রুত। ভয়াবহ অবস্থা।’ প্রিয়ম অশ্রু চোখে বলল,’ বাবা আপুকে দিয়ে দেও। কি হবে সর্বোচ্চ? খুব সুন্দর ছেলেটিকে পাবে না। কিন্তু তাযিন ভাইয়াতো বেঁচে যাবে। বাবা সে আমার বোনকে এমন ভাবে চাইছে কেন? এই কেনোর উত্তর কি? অসম্ভব ভালোবাসা?’
নাফিস উদ্দিনের চোয়াল কেঁপে উঠলো। ভালোবাসা! ভালোবাসা তো তিনি বুঝেন। অনুভব করেন। মন কত পাগলামি করেছে। কিন্তু এভাবে তো এই জীবনে কাউকেই চেয়েছেন বলে মনে হয় না। তিনি আবার কন্ঠ নরম করে বললেন,’ তাযিন প্লিজ চলো হসপিটালে।’ বিমুগ্ধ গড় গড় করে র ক্ত বমি করেছে। জাওয়াদ অনেক্ষণ থেকে এসব দেখছে। তাকে কেউ এখনো দেখেনি। সে আশ্চর্য্য হয়ে রইলো। অর্পন বলল,’ ইন্টারনাল ব্লি ডিং হচ্ছে বিমুগ্ধ প্লিজ হসপিটালে চল।’
‘ না বললাম না। আমি যাবো না যাবো না মানে যাবো না।’
‘ তাযিন তোর পায়ে পড়ছি চল।’ মুহিব হাত ধরে টেনে আনতে চাইলো। বিমুগ্ধ বিকট কন্ঠে চিৎকার করে বলল,’কেউ কথা বলবে না। আমি আমার ছোট বাবার সাথে কথা বলছি। শুধু এবং শুধু মাত্র তার সাথে।’
নাফিস উদ্দিন হতবুদ্ধিমত বললেন,’ তুমি আমাকে এতো সম্মান দিচ্ছো কেন? আমার মেয়ের জন্য!’
‘ তাহলে বুঝুন আপনার মেয়ে আমার কাছে কি? কতটা চাই, কতটা ভালোবাসি!’
নাফিস উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকালো।
‘ আমার মেয়ের মনেও কি তোমার জন্য এমন অনুভূতি আছে? সেও কি তোমার হতে চায়?’
বিমুগ্ধ চোখ মুখ মলিন করে বলল,’ ভিক্ষুককে দান করার সময় কি দানকৃত অর্থ সম্পদকে জিজ্ঞেস করেন সে তার কাছে যাবে কি না? ধরে নিন আমি ভিক্ষুক। আপনার মেয়ে অতি মূল্যবান মানুষ। আর আপনি দয়ালু দানকারী। তাকে দান করে দিন না।’ বিমুগ্ধের বাচ্চাদের মত কণ্ঠ, জেদ। নাফিস উদ্দিন মেয়েকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। মেয়েটা এতো কাঁদছে কেন? এই কান্নার মানে কি তিনি বুঝে না? না কি এতো দিন বুঝতেই পারেনি? নীহারিকা ধীর পায়ে হেঁটে বাবার হাত নিজের গালে মায়ের হাত বুকে চেপে ধরে ভাঙ্গা গলায় বলল,’ বিশ্বাস করো আমি এটা চাইনি। আমি এমন কখনো ছিলামই না। কখনো এমন অনুভব করিনি। কখনো বুঝতে পারিনি আমার সাথেও এমন কিছু হবে। কিন্তু কিন্তু কিভাবে যেন হয়ে গেছে। ওই অদ্ভুৎ লোকটা কিভাবে যেন আমার ভিতরের সবকিছুকে টেনে নিয়ে গেছে নিজের করে। আমি সত্যি বলছি বাবা আমি মোটেও এটা চাইনি। এতো বিরক্তিকর একজন পুরুষকে আমি কখন কিভাবে নিজের মাঝে জায়গা দিয়েছি সেই অনুভূতিটুকুও বুঝতে পারিনি আমি। বাবা আমি খুব খুব খুব দুঃখিত। আমার দ্বারা সেই ভয়ংকর পাপপুর্ণ্য হয়েছে। তুমি উনাকে বলো প্লিজ হসপিটালে যেতে। এতো র ক্ত বাবা! আমার চোখ জ্বলে যাচ্ছে। ভিতরের সব যেন কেউ নির্দয় ভাবে টেনে ছিড়ে ফেলছে। মা তোমার তো খুব আদরের তুমি বলো হসপিটালে যেতে। প্লিজ বলো। বাবা প্লিজ।’
নীহারিকাকে কেউ কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি। কেউ না। সকলে পাথরের মত জমে গেছে তার কান্নায়। স্বয়ং বিমুগ্ধর হাতও আলগা হয়ে চোখ মুখে ফুঁটেছে হতভম্বতা। চোখের নেত্রবারি হৃদয়ে রচিত সকল ব্যথা, সকল কাঁটাছেঁড়ায় ঔষুধ হয়ে লেপ্টে যাচ্ছে। সে খুব নিম্ন গলায় ঘোরের মাঝে বলল,’ কাঁদলে তোমাকে বীভৎস রকমের মোহনীয় লাগে রাগেশ্বরী।’
নাফিস উদ্দিন মেয়েকে টেনে তুললেন। তার চোখ মুখ ভিষণ কঠিন এখন। কেমন যেন শক্ত আবরণ। নীহারিকার কান্না দেখে মিতু আপু ফাবিহা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। বিমুগ্ধকে বলল,’ আপনি হসপিটালে চলুন তাযিন ভাই। নীহু কত কাঁদছে।’
‘ কাঁদুক তাতে আমার কি? দান সদকা না নিয়ে যাচ্ছিনা ছোট বাবা।’ আবারও জাপ্টে পা ধরলো সে। নাফিস উদ্দিন বিব্রত কণ্ঠে বলল,’ হসপিটালে চলো বিমুগ্ধ। এই বিষয়ে বললাম তো পরে কথা বলবো।’
‘ এসবে কাজ হবে না। আগে কথা দিন।’
নাফিস উদ্দিন অসহায় হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। ভাইটার চোখ মুখ ফ্যাকাসে। একটা মাত্র ছেলে। তাও একটা পাগল! মায়াই হলো তার। অন্তত নিজের বাচ্চা গুলোতো সুস্থ। এই পাগলকে নিয়ে ভাইয়ের অবস্থা নিশ্চয়ই খারাপ। প্রচন্ড দুঃখ নিয়ে তিনি বললেন,’ আরে দান তো মন থেকে করতে হয়। আমার মন তো দান করতে চাইছে না। তবুও কথা দিচ্ছি মনকে বুঝাবো।’
‘ নীহারিকার বাবা হয়ে নয় আমার ছোট বাবা হয়ে কথা দিন তাহলেই উঠবো।’
নাফিস উদ্দিন শক্ত চোখ মুখ নিয়ে পা ঝাড়া দিলো। বিমুগ্ধ সাপের মত প্যাচিয়ে আছে। ছেলেটার এতো শক্তি! নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়েই তিনি বললেন,’ ঠিক আছে তোমার কথা আমি ভাববো। তোমার ভালোদিক খারাপ দিক নিয়ে চিন্তাভাবনা করবো। এবার নীহারিকার বাবা হয়ে নয় তোমার ছোট বাবা হয়েই করবো। তবে মনে রাখবে খারাপ কিছু যদি থাকে তোমার মধ্যে তুমি বাতিল।’
বিমুগ্ধ শিশুদের মত খিলখিল করে হাসলো। একটা ছেলেকে এভাবে হাসলে কেমন লাগে কেউ জানে না কিন্তু বিমুগ্ধকে একদম ছোট তিন চার বছরের বাচ্চাদের মত লাগলো। ততক্ষণে সে নাফিস উদ্দিনের পায়ে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। সকলে ধরে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। নীহারিকার হাতটা শুয়ে শুয়েই শক্ত করে ধরলো সে। গরম হাতটির দিকে তাকিয়ে নীহারিকা অশ্রুতে ডুবুডুবু চোখে বিষন্ন মিটিমিটি কন্ঠে বলল,’ আপনি একটা বদ্ধ উম্মাদ পুরুষ বিমুগ্ধ।’
এতো যন্ত্রণার মাঝেও বিমুগ্ধের ঠোঁটের লেগে থাকা হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কত সুখি। কত আনন্দিত। ভালোবাসা গুলো এমন কেন? কেন এমন পাগল করে তুলে সকলকে? কেন সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মত মনের উপরে মানুষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই? কিছু কিছু প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না। এক অদৃশ্য অনুভূতিকে চোখে মুখে ফুঁটিয়ে বিমুগ্ধ শুধু র ক্তে ভেজা ঠোঁট নেড়ে বলল,’ আরও আরও উম্মাদ হবো। আমি যে মনের ডাক্তার!
_______________
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন।🕊️