প্রিয় সুখ-৪৭
হাফসা আলম
.
চেম্বার চারতলায়। লিফটে রোগীদের প্রচণ্ড ভীর। লিফট আসতেই কার আগে যে ঢুকবে তার প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়। দেশের মানুষ এতো হারে হসপিটালে আসে তার প্রমাণ এটি। শাহিন ভাই তো মাস্ত অফিস রুমে এসির নিচে কাজ করতে অভ্যস্ত। আজকে এমন ভীরের মাঝে পড়ে তার অবস্থা খারাপ। শেষে উপায় না পেয়ে পায়ে হেঁটে তিনি চারতলায় উঠলেন। শ্যামবর্ণের মুখটি ঘামে ভিজে গেছে। খোলা জায়গা জুড়ে রোগী, বাচ্চা, বৃদ্ধের তুমুল ভীর। সকলে অপেক্ষায় আছে সিরিয়ালের। মাঝের কেবিনের সামনের অংশ দেখে রিতিমত ভিমড়ি খেলেন তিনি। ইফতিকে বললেন,’ আয় হায় বাংলাদেশে এতো পাগল আছে আমার তো জানাই ছিলো না।’
মৃদূ হাসলো ইফতি। জাবাবে বলল,’ এরা পাগল না ভাই এরা মানসিক ভাবে কোন না কোন মুসিবতে আছে। পাগল হলে তো পাগলাগারদে থাকত।’
‘ তাও ঠিক বলেছ।’ কথাটা বলেই তিনি একটি চেয়ারে বসলেন। পাশে একজন লোক বসে আছে। তার হাতে একটি খাতা। ধৈর্য্য নিয়ে কি সব লিখছে। একটু পর পর হঠাৎ উদাস হয়ে পড়ছে। শাহিন ভাই ধীরে সুস্থে জানতে চাইলো,’ আপনার সমস্যা কি ভাই?’
লোকটি একনজর দেখে নিয়ে বলল,’ ডিপ্রেশন।’
‘ এটা আর এমন কি! এই জগতের বেশিরভাগ মানুষই ডিপ্রেশনের রোগী। তাই বলে কি ডাক্তারের কাছে চলে আসবেন? টাকা এতো সস্তা? ধুর মিয়া বাড়ি যান।’
‘ সামান্য ডিপ্রেশনের জন্য বাঙ্গালী টাকা খরচ করবে? এই লোক দুই একদিন পর পর সুইসাইড করতে যায়। তার না কি জগৎ সংসার ভালো লাগে না। শুধু ভাবে এই পৃথিবীতে তার কি কাজ। এসব পাগলী দেখে তার পরিবার ডাক্তার দেখাচ্ছে।’ পাশের মাঝ বয়সি লোকটি বলল এসব। শাহীন ভাই চুপ করে দেখলো সত্যি লোকটির আচরণ অদ্ভুৎ। রিশেপসনে জিজ্ঞেস করলেন,’ সিরিয়াল কত পর্যন্ত?’
‘ সাত চল্লিশ। আপনার নাম?’
‘ শাহিন।’
‘ আপনার সিরিয়াস চল্লিশে।’
শাহিন ভাই স্তব্দ। পিছন ঘুরে চাইলেন। এতো এতো পাগলের সাথে বসতে হবে? খুব বিরক্ত তিনি। দুটি সিট খালি হতেই সোজা হয়ে শুয়ে পড়লেন। ইফতিকে বসতেও বলেননি। এতে অবশ্য ইফতি কিছু মনে করেনি। সে ফিট মানুষ। বহু সময় হাঁটা চলা করতে পারবে অনায়াসে। শাহিন ভাইকে ঘুমিয়ে যেতে দেখে সে চমকে গেল। পর পর হেসে ফেলল। মিতু আপু এবং তার স্বামী দুইজনেই সেম ক্যাটাগরির অনেকটা। দুনিয়ার কোন পরোয়া নেই এদের। মন যা চায় করতে হবে। করতে হবেই। যদিও মিতু আপু ওভার!
সাড়ে নয়টায় তাদের ডাক পড়লো। ভিতরে ঢুকতেই রেগে মেগে আগুন হয়ে টেবিল থাপড়ে বলল,’ এসব কি তাযিন? তোমার সাথে দেখা করতে আমাদের তিন ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে।’
তাযিন তাদের দেখে অবাক হলো না। হলো বিরক্ত। আজকাল তার মত সাইক্রিয়াটিস্টেরও বল নিয়ে বসে বসে রাগ কমাতে হচ্ছে। হলুদ একটি বল সব সময় তার হাতে থাকছে। এসব হয়েছে বিয়ে করে। বিয়ে যে প্রেসার বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সেটা সে বুঝে গেছে।
‘ এটা হসপিটাল। আমি রোগী দেখি এখানে। রোগী হয়েই আসতে হবে। এটাই নিয়ম।’ গাম্ভীর্যে ভরাট সুর। কপালের নীলছে রগ গুলো ইফতি দেখতে পাচ্ছে।
‘ গুলি করি তোমার নিয়মের।’
‘ আচ্ছা। এবার বলুন সমস্যা কি দুইজনের?’ বিমুগ্ধ চেয়ারে হেলান দিলো। তাকে খুব জ্ঞানী ডাক্তার মনে হচ্ছে। পেশাদার একটি ব্যপার ঘুরছে শরীর জুড়ে। অথচ এই ছেলেটি কি সব ড্রেস পড়ে ঘুরে বেড়ায় বাহিরে। ইফতির স্পষ্ট মনে আছে তার বিয়েতে একটি শর্টস পড়ে গিয়েছিলো। পায়ে আবার সেন্ডেল। ঢোলা হাতাকাঁটা সাদা কুশিকাটার কাজের শার্ট। যার প্রায় সব বোতাম খোলা। নিচের দুটি ব্যতিত।
‘ অনেক সমস্যা। তুমি তো ভালো করেই জানো বউ ছাড়া থাকতে কেমন লাগে। তোমার কাজিন এমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে কেন? দু মাস ধরে সে নিজের খালার বাসায় থাকছে। এটা কোন কথা?’
‘ বউ থাকলে কেমন লাগে আমি সেটাই জানি না। আপনার খালাতো শ্বশুড়ই আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। বউয়ের থেকে কিছু আশা করছি না।’
‘ তাও ঠিক। তোমার দুঃখ একটু না অনেকটা বেশি। বেচারা।’ শাহিন ভাই মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করলো। বিমুগ্ধ বেশ বিরক্ত। সাথে তার রাগ উঠছে। শাহিন ভাই আবার মনে করিয়ে দিলো সে বিবাহিত ব্যাচেলর। সে হাতের বল ছুড়ে মারলো তার মুখে। নাকের উপরে আঘাত। হঠাৎ আক্রমনে তাজ্জব শাহিন ভাই বললেন,’ চরম বেয়াদপ তো তুমি!’
‘ আমি জানি। আপনারা আমার সময় নষ্ট না করে কাজের কথা বলুন।’
‘ প্রোসার হাই।’ শাহিন ভাই হাত এগিয়ে দিলো। পরীক্ষা করে দেখা গেলো সত্যিই তার প্রেসার বেশি। প্রেসারের যন্ত্র পাশে রেখে বিমুগ্ধ বলল,’ আপনার উচিৎ ঘুমানো। ভালো ঘুম হচ্ছে না তাই এই অবস্থা।’
‘ কিভাবে ঘুমাবো? আমার বউ তো তোমার শ্বশুরের বাড়িতে।’
‘ আমার বউও আমার শ্বশুরেরবাড়িতে। আমার তো প্রেসার বাড়ছে না!’ বিমুগ্ধ ঘাড়ে হাত বুলালো। ইফতির দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনার কি সমস্যা?’
‘ আমার বউও তার খালামনির বাসায়।’
‘ এটা কি পুলিশ স্টেশন? না কি উদ্ধারকারীর কেবিন? আপনাদের কি ধরনা আপনাদের বউ আমি তুলে নিয়ে আসবো?’
ইফতি হেসে ফেলল বিমুগ্ধের রাগ দেখে। এই ছেলে এতো রাগ করতে পারে তা তো উনার জানা ছিলো না।
‘ আপনাদের এসব শেষ হলে আসতে পারেন আমি রোগী দেখবো।’
শাহিন ভাই মন খারাপ করলো। তিনি সত্যি একটি মহান কাজে এসেছেন। কিন্তু তাযিনের কড়া রূপ দেখে চেয়ার ছেড়ে দাড়ালো। পিছন থেকে স্বরটি আদেশের মত শুনালো,’ ভিজিট দিয়ে যাবেন বাহিরে।’
শাহিন ভাইয়ের খোশ মেজাজ ফিরে আসলো। একটি খাম বের করে তার টেবিলে রেখে বলল,’ এখানেই ভিজিট আছে শালাবাবু।।’
তারপর টপ করে বের হয়ে গেলেন তিনি। ইফতি হেসে বলল,’ আসলে সে তোমার বিয়ের গিফট দিতে এসেছিলো। আমি আজই ঢাকায় এসেছি। ধরে নিয়ে আসলো। তবে বউকে না পেয়ে কিন্তু আমার নিজেরও প্রেসার বাড়ছে।’ হাসিটা ঝুলিয়েই বের হয়ে গেলো। তাযিন খাম খুলে দেখলো একটি হানিমুন প্যাকেজ। সুইজারল্যান্ডের। নিজের কপাল চাপড়ালো সে। যেখানে বিয়ের বয়স তিন মাস, অথচ তার নিজের বিয়ে করা বউকে সে রাতে ঘুমানোর আগে একনজর আর সকালে কখনো কখনো চা খেতে বসায় বারান্দায় একনজর দেখে। সেখানে সে যাবে মধুচন্দ্রিমা করতে! ড্রয়ারে রেখে দিলো খামটি। রোগী দেখা শেষ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল। চেয়ার ছেড়ে সোফার বুকে শরীর এলিয়েছে। মুঠো ফোন হাতে নিজের বোনের কর্তৃকর্ম দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস ফেলো সে। তার বোনের ব্রেকাপ হয়েছে। রূবাইদার কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক করা ছিলো। তাদের দুজনের কয়েক বছরের রিলেশন, যা তার জন্য ভেঙ্গেছে। তারপর থেকেই সে নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত রাখে। অদ্ভুৎ অদ্ভুৎ কাজ করে অনলাইনে। এখানে সেখানে ঘুরে ট্রাভেল ব্লগ করছে। খাবারের ছবি থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কম বেশি অনেক কিছুই সে অনলাইন জগতে শেয়ার করে। আগেও এসবে সে খুব আগ্রহী ছিলো। এখন আরও বেশি। পেইজের সবচেয়ে জনপ্রিয় শো তার বাবা এবং চাচার দ্বন্দ। এর একটি সুন্দর নাম দিয়েছে দর্শকশ্রেনী উদ্দিন বাড়ির সুদিন। আজ তেমনই সুদিন। ঘড়িতে বাজে এগারোটার বেশি। অথচ দুজনে তর্ক করছে রাস্তার লাইট নিয়ে। মানুষ মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে সব। সাইকোলজির দিক থেকে দেখতে গেলে এটিও একটি মানসিক রোগ। অন্যের সমস্যায় আনন্দ পাওয়া। অনেক সময় রাস্তায় দেখা যায় মারামারি হচ্ছে আর একদল তা দেখছে। তাদের চোখে মুখে থাকে উত্তেজনা। পৃথিবীর অনেক মানুষের এই সমস্যা আছে। মনের দ্বিতীয় রূপ সব সময় পৌশাচিক। অন্যের কষ্টে, অন্যের দুঃখে, অন্যের সমস্যায় আনন্দ পাওয়া মানুষের কাছে খুব সাধারণ। কারণ ভিন্ন। কিন্তু প্রতিটি মানুষ কারো না কারো কষ্টে, দুঃখে বা ব্যর্থতায় আনন্দ পায়। যেমন বিমুগ্ধ জাওয়াদের কষ্টে আনন্দ পায়। এটাই জগতের এক অদ্ভুৎ রোগ। যা সে নিজে ডাক্তার হয়েও সারাতে পারেনি। পারবে না কখনো। নীহারিকার জীবনে যত জাওয়াদই আসবে তাদের কষ্টে দুঃখে ব্যর্থতায় বিমুগ্ধ আনন্দ পাবে। পৌশাচিক আনন্দ। এর একটি নাম আছে। ঈর্ষাপরায়ণ। বিমুগ্ধ সেই রোগে আক্রান্ত। প্রতিদিন এক বাক্য বলার জন্য যে নাম্বারটিতে কল করে সে নাম্বার ফোনের স্কিনে চেপে ধরলো। জানালার বাহিরের গোল সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আমি আমার স্ত্রীকে হৃদয়ের সবটুকু উজার করে ভালোবাসি এটা কি সে জানে রাগেশ্বরী?’
ও পাশের ঘোলা কন্ঠটি বলেছে,’ জানে, জানে বলেই সে আপনার হয়েছে, জানে বলেই জগৎ তাকে আপনার করেছে, জানে বলেই সে আপনার স্ত্রীর রূপে আপনার হৃদয়ে বাসা গড়েছে।’
ফোনটি লাইলচ্যুত হয়েছে। সারাদিনের সকল ক্লান্তি, সকল চিন্তার ভাসা ভাসা বলি রেখা মিলিয়ে ঠোঁট দুটিতে নিদারুন একজোড়া হাসি এসে থেমেছে।
____________
‘ চা গরম চা গরম চা গরম’ মিতু আপুর হাতে ট্রে ভর্তি চায়ের পেয়ালা। আজ শুক্রবার। এর বাহিরেও আজকে একটি বিশেষ দিন। দাদির মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে দুপুরে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে মাদ্রাসা এবং এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য। এবং সকল রান্না নিজেরা করবে ঠিক করা হয়েছে। এখন ঘড়িতে সকাল সাতটা। সবে সবে উঠে আসছে সকলে। বাড়ির সামনের ছোট উঠান জুড়ে চেয়ার বিছানো হচ্ছে। মিতু আপু চা করে নিয়ে এসেছে। শাহিন ভাই সবচেয়ে বেশি খুশি। কালকে রাতেই তিনি এই উপলক্ষে খালাশ্বাশুরিতে বাড়িতে এসে উঠেছে। তাই আজকের সকাল তার জন্য বেশ সুন্দর। চায়ের কাপে হাত রাখতেই মিতু আপু চেঁচিয়ে বলল,’ মুখ ধুয়ে কাজে নামুন। একশোর বেশি মানুষের আয়োজন করতে হবে।’
এসব কথায় শাহিন ভাইয়ের কিচ্ছু যায় আসে না। বেহায়ার মত চা হাতে শালীর পাশে বসলেন তিনি। চুমুক দিয়ে মুখে শব্দ করে বললেন,’ আরে এতো চিন্তার কি আছে আমাদের বাড়িতে তো বাবুর্চি আছেই?’
‘ সেটা কে?’ মিতু আপু ভাবতে বসলো। প্রিয়ম চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে মুখে পুড়ে বলল,’ ওই যে আসছে?’ সকলে সামনের দিকে তাকালো। বিমুগ্ধ এবং তার পরিবারকে একে একে আসতে দেখে এক যোগে হেসে ফেলল। রোদ্রমূখীর এসবে মনোযোগ নেই। সে চোখ উপর নিচ করে বিস্কুট চুবানো দেখছে। প্রিয়ম যখন চায়ে বিস্কুট রাখছে সে একবার তাকাচ্ছে আবার যখন খাচ্ছে মুখের দিকে একবার তাকাচ্ছে। প্রিয়ম একবার তাকে দেখেই বিরক্ত হয়ে ঘুরে বলল,’ এমন আপদ ঘাড়ে পরলো সরার নামই নেই। সকাল সকাল হাজির হয়। এই মেয়ে ঘুমায় না? দূর খাওয়াও যাবে না শান্তিতে।’ মনের কথা সে মুখে বলেছে খুব আস্তে। উঠে বসেছে বোনের পিছনে চেয়ার নিয়ে। রোদ্রমুখির মুখে কি যেন মিস করে ফেলার দুঃখ ভেসে উঠতে উঠতে নিভেছে। কারণ তার সামনে বসেই নীহারিকাও বিস্কুট ভিজিয়ে খাচ্ছে। উৎফুল্ল চিত্তে সে বলল,’ আমিও খাবো।’
সাথে সাথে চোখ মুখ কুঁচে গেলো নীহারিকার। এই মেয়ে এলিয়েন না কি? তারা যাই করছে প্রথমে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে পরে নিজে করার জন্য পাগল হয়ে পরছে।
‘ অবশ্যয়। পরোটা দিয়েও ডুবিয়ে খেতে পারেন। খুব ভালো খেতে। কিন্তু আপনি তো মডেল। এসব খাবার খাওয়া উচিৎ হবে না মনে হয়।’ বিমুগ্ধ একটি চেয়ারে দুই পাশে পা রেখে নীহারিকার একদম সামনে বসলো মুখমুখি। তাকিয়ে রইলো জনম জনমের লোভি দৃষ্টি মেলে। হঠাৎ এমন করায় হতচকিত হয়ে নীহারিকার চা উঠে পরলো একটু তার হাতে। বিমুগ্ধকে দেখে রৌদ্রমুখির উৎফুল্লতা বেড়েছে। হড়বড়ানো গলায় বলল,’ ওয়াও মিষ্টার হ্যান্ডস্যাম ইউ লুক লাইক এক রেড ওয়াইন।’
মেরুন রঙ্গের একটি টি শার্ট, আজ ফুল প্যান্ট পড়েছে সে। ঢোলা টিশার্টটিতে অসংখ্য ডিজাইন। দিনের প্রথম সূর্যের সৌন্দর্য্য তার শরীরে পড়ে চিকচিক করছে। ছোট করে কাঁটা চুল গুলোর সাথে তার মুখের ক্ষুদ্র দাড়ি গুচ্ছ বেশ মানান সই। দাড়ি চুলে হালকা লালছে ভাব। ডিম্বাকৃতির মুখশ্রী জুড়ে স্নিগ্ধতা, হাস্য উজ্জ্বল। ছেলেটি ইদানিং মাত্রা অতিরিক্ত খুশি থাকে। বহু বছরের খুশি তার চাপা রঙ্গের ঠোঁট দুটিতে নিঁখুত করে আঁকা। নীহারিকার ভ্রু কুঁচকেছে। ছোট ছোট করে তাকিয়েছে বিমুগ্ধের দিকে। বিমুগ্ধ হঠাৎ
করে সকলের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট গলায় বলল,’ সবাই চোখ বন্ধ করো।’
‘ কেন কেন?’ মিতু আপু ট্রে নিচে রেখে এগিয়ে আসলো।
বিমুগ্ধ চোখ মুখ খুব গুরুত্বপূর্ণ করে বলল,’ একটা ম্যাজিক হবে, সাথে মজার রেসিপি।’ নীহারিকার কঠিন চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,’ কেউ চোখ খুলবে না ৫০ সেকেন্ড।’ আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে একবার দেখে নিলো। না বড়রা কেউ এদিকে নেই। শুধু গুটি কয়েক মানুষ চেয়ারে বসেছে তারা। সকলে বিশ্বাস করলো তাকে এবং খুব সিরিয়াস হয়ে ম্যাজিকের আশায় চোখ বন্ধ করলো। বিমুগ্ধ এই সুযোগ লুফে নিয়েছে। জাদু বলে সে নীহারিকার হাতটি নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নিলো। নরম পুরুষালী এই হাতটি চিনতে একটুও কষ্ট হয় না নীহারিকার। লোকটি তার হাত দিয়ে কি করবে ভাবতে ভাবতে ভেজা রুক্ষ দুটি ঠোঁট নিজের হাতের উলটো পিঠে পেয়ে রিতিমত শিউরে উঠলো সে। প্রেমি হৃদয় নারী সত্ত্বা সব কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে তাকে লজ্জাবতী কাছের মত নুইয়ে দিলো। চোখ দুটি মৃদূ খুলে সে আবিষ্কার করলো এক অন্য পুরুষকে। যে পুরুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে কখনো আসেনি, কল্পনায় কখনো ভেসে উঠেনি, কখনো রাস্তার অলিগলিতে তার দেখামেলেনি। এই পুরুষ স্বামী রূপে পবিত্র পুরুষ! তার প্রতিটি স্পর্শ নীহারিকার মত শক্ত হয়ে থাকা নারী হৃদয়ে ভয়াবহ ঝড় তোলে। যেই সেই ঝড় নয় অনুরক্তির ঝড়, প্রলয় নিয়ে আসে হৃদয়ে। চা পড়া অংশ টুকু বিমুগ্ধ গভীর চুমুর সাথে চুষে নিয়েছে নিজের গহীনে। তার দুটি জ্বলন্ত নেশা ধরানো চোখ নীহারিকার ধীর গতিতে খুলতে থাকা চোখ দুটিতে নিবন্ধ। সেই চোখের দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারলো না নীহারিকা। এই আবেশ, এই নেশা, এই আদরমাখা প্রনয় একদম নতুন তার জন্য একদম অন্যরকম পাগল করা অনুভূতি।
একটি চোখ খুলে রেখে প্রেমঘন এই মুহূর্ত রৌদ্রমূখী দেখে নিয়েছে। নিজের ক্যামেরায় এই দৃশ্য ধারণ করতে সে ভুলেনি। ৫০ সেকেন্ড! শুধু মাত্র ৫০ সেকেন্ডে বিমুগ্ধ তার হৃদয়ের কতটুকু আবেগ ঢেলে দিতে পেরেছে কি না জানা নেই। কিন্তু তার স্ত্রীর হৃদয়ে সে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আঁছড়ে পরেছে তা তার ছুটে চলে যাওয়ার দৃশ্যেই প্রমানীত। মিতু আপু চোখ খুলে প্রচন্ড উৎকন্ঠা নিয়ে বলল,’ ম্যাজিক কই?’
‘ ওই যে?’ বিমুগ্ধ চেয়ারের মাথায় নিজের মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো নীহারিকার দিকে। শুধু দেখলো না তার লজ্জিত মুখশ্রী, কিন্তু বিষ্মৃত হয়ে ফাবিহা বলল,’ এই মেয়ের কি হয়েছে?’
‘ ম্যাজিক হয়েছে ম্যাজিক।’ রৌদ্রমূখী ক্যামেরার দৃশ্যটি সকলকে দেখিয়ে দিয়েছে। হৈ হৈ করে উঠলো পরিবেশ। চেপে ধরলো বিমুগ্ধের কাঁধ।
‘ ওরে প্রেমিক পুরুষ বাবুর্চি এই তোমার ম্যাজিক?’
বিমুগ্ধের মত পোশাকে নির্লজ্জতা দেখানো পুরুষটির গাল দুটি লজ্জায় কেমন যেন খিঁচে গেলো। পরপর সে নিজেকে সামলে প্রিয়মকে একটা ঝাড়ি দিয়ে বলল,’ রুমে যা। এখানে কি?’
সে যেতে যেতে রৌদ্রমূখীকে একটা গালি দিয়ে গেলো। বিমুগ্ধ এবার শাহীন ভাইয়ের কথার জবাবে বলল,’ কে যেন বউকে না পেয়ে প্রেসার বাড়িয়ে সাইক্রিয়াটিস্ট কাছে গেছে?’
দ্রুত মুখ চেপে ধরলো শাহিন ভাই। ফিসফিস গলায় বলল,’ মান ইজ্জত ডুবাবে না কি? আমি যে বউ পাগল এটা সকলের সামনে ঢোল পিটানোর প্রয়োজন নেই।’
‘ আমি যে প্রেমিক পুরুষ সেটাও ঢোল পিটানো বন্ধ করুন। যে দুর্দশা বউ থেকেও আমি সিঙ্গেল। তার মাঝে দুই একটা সুযোগ লুফে নিতেই সবাই হামলে পড়ছেন।’
‘ ওই হই কি দুঃখ তাযিন ভাইয়ের। আপনার ম্যাজিকাল লাভ তো দেখে নিয়েছি। এবার মজার কিছু তৈরি করে খাওয়ান। লাইক এয়াম্মি।’ ফাবিহার প্রবোধ দেওয়া কন্ঠ। ইফতি খুব শান্ত স্বাভাবের। এই সময় সে ফোঁড়ন কেঁটে বলল,’ আমিও ভালো রান্না করতে পারি।’
‘ হ্যা আমার দেখা হয়েছে সৌভাগ্য ক্রমে। যে কি না লবন আর চিনির পার্থক্য বুঝে না সে যে কত বড় শেফ জানা আছে।’
ইফতির মুখটা বেজার হয়ে গেছে। সে নিজের ব্যক্তিগত নারীকে একদা চা করে খাইয়েছে। শুধু চিনির বদলে দুই চামচ লবন দিয়ে ফেলেছিলো। এখনো খোটা দিচ্ছে। ফাবিহা আড়চোখে বিমানের ড্রাইভারের মুখটা দেখলো। তার মলিন মুখ দেখে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,’ তবে উনি ভালো ড্রাইভার। খুব সেফলি মানুষজনকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাখির মত উড়িয়ে নিয়ে যায়। লাইক এক বার্ড।’
বউয়ের মুখের সামান্য তারিফ কি ইফতির হাসির কারণ হয়েছে? তাই তো পেপারের নিতে তার অত্যন্ত সুন্দর মুখটির রক্তিম ঝলক দেখা যাচ্ছে।
রান্নার আয়োজন শুরু হয়েছে। বড় একটি টেবিলে কাচা মাছ, মাংস, সবজি, ডাল রাখা। বিমুগ্ধ এবং তার বাবা সাদা এপ্রোন গায়ে টেবিলের সামনে দাড়িয়ে পড়েছে কাঁটা কাটি করতে। নাফিস উদ্দিনের সাথে বিমুগ্ধের সম্পর্ক বেশ ঠান্ডা অথচ তারা প্রতিদিন সকালে এক সাথে নামাজে যায়। একজন আর একজনকে ডেকে নিয়ে আসে। গম্ভীর মুখে গল্প করে। এলাকার মানুষের চোখে এই দৃশ্যটি যেমন সুন্দর তেমন হিংসাত্মক। এমন জামাই শ্বশুর কেউ কখনো দেখেনি। রাগ উঠলে একে অপরের সাথে রাস্তায় দাড়িয়ে ঝগড়া করে। খোঁচা মারে। আবার এক সাথে ভোরের পরিবেশ উপভোগ করতে বের হয়ে পড়ে কনভার্স পরে। নাফিস উদ্দিন অলস প্রকৃতির মানুষ। হাঁটতে একদম পছন্দ করতেন না। যেহেতু বাইক আছে গলির মোড়েও তিনি সেই বাইকের পেটে চড়ে যেতেন। কিন্তু বিমুগ্ধ একদিন সূক্ষ্ম ভাবে বিশাল খোঁচা গায়ে লাগিয়ে বললেন,’ আপনি যে হারে মোটা হচ্ছেন, রিক্সায় আপনার পাশে আমার খালামনি বসে কিভাবে? আপনার একারই তো একটা রিক্সার প্রয়োজন। কি আর করবে বেচারি বাঙ্গালী নারী। ভাবে জামাই যেমনই হোক তার পায়ে পরে থাকলেই স্বর্গ পাবে। আমেরিকায় হলে এতো দিনে সুন্দর, কিউট, আমার মতই কোন এক ফিট ব্যক্তির…’ বিমুগ্ধ থেমেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো বেলুনের মত রাগে ফুলতে থাকা শ্বশুরকে। নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল,’ ছেলের মা হতেন। আপনার ছেলে প্রিয়মও তো আপনার মত ফুলছে। কি বিশ্রী অবস্থা। সকলে অস্বাস্থ্যকর। এক কাজ করুন আমার খালামনি আর বউকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিন।’
নাফিস উদ্দিন চেতে গিয়ে বললেন,’ চুপ করো বেয়াদপ। তুমি তো দেখছি আমার বউকেই ভাগিয়ে দিবে।’
‘ দিলে বুঝবেন ওয়াইফ পৃথিবীর এমন এক প্রাণ যা না থাকলে কত শূন্য শূন্য লাগে।’
গলা ছেড়ে বিমুগ্ধ একটি গান ধরল,’
কেন লাগে শূন্য শূন্য বলো,
তোমায় ছাড়া এত!
আপনি কি তা বলতে পারেন?’
নাফিস উদ্দিন রেগে আগুন চোখে তাকিয়ে একটি লাঠি ছুড়ে মারলো তার গায়ে। যেতে যেতে তার মুচকি রসিক হাসি বিমুগ্ধ দেখলো না। দরজার সামনে দাড়িয়ে তিনি ঘুরে বললেন,’ আমার দোয়া, তুমি নামক বদমাইশ ছেলেটির সবকিছু শূন্য শূন্য লাগুক আমার মেয়েকে ছাড়া।’
তাদের কম্বিনেশন এমনই। এই মেঘ এই বৃষ্টির মত। সম্পর্কের রং মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন হচ্ছে। বিমুগ্ধ অনুভব করে ছোট চাচার সাথে ছোট বেলা থেকে যদি সে থাকত তাহলে কত আনন্দ হতো, কত আবেগের স্মৃতি উড়ে বেড়াতো মস্তিষ্কে। ইশশ সেই সময় গুলো তো ফিরে আসবে না। সে বরং এই সময় গুলো ইনজয় করতে চায়। পরের দিন থেকে নাফিস উদ্দিন জগিং সুটে হাজির। প্রায় দুই ঘন্টা দৌড়ের উপরে থাকেন তিনি। ডায়বেটিস কিছুদিনেই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে দেখে তিনি আরও একধাপ প্রসন্ন। বিমুগ্ধ অবশ্য নতুন মিশনে নেমেছে। এই লোকের ভাত খাওয়া কমানোর মিশন। এই তো চলছে জীবন। সুন্দর না?
_______
রোদ উঠেছে। এসে পরছে সকলের চোখে মুখে। চুলা তৈরি করা হয়েছে ইট দিয়ে। বড় বড় পাতিল গুলো নামিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। পিছনের পানির কলে বসে নীহারিকা প্লেট গুলো সুন্দর করে ধূয়ে নিচ্ছে, মিতু আপু শশা কাঁটতে গিয়ে হাত কেঁটে জগৎ উদ্ধার করেছে। এখন ছাগলের মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। যেন তার গলা কাঁটা হয়েছে। এসবে বেশ বিরক্ত সকলে, একমাত্র শাহিন ভাই ব্যাতিত। কারণ তার জন্য বিরক্ত হওয়া পাপ! মহা পাপ। এই পাপ এই জন্মে তিনি করতে পারবেন না। বউয়ের হাত নিয়ে হা হুতাশের শেষ নেই তার। আফিয়া বিলকিস এবং শামা খালামনির ছুটির দিন। সকল নারীরা অল্প বিস্তর কাজ করছে। আজকের সকল রান্না থেকে শুরু করে কাঁটার কাজ করবে বাবুর্চি ওর উপ্রে মাস্টার শেফ উদ্দিন পরিবারের দুই বিখ্যাত সদস্য। শান্ত এসেছে একচমৎকার সাইকেলে করে। এটি সে নতুন কিনেছে। তার হঠাৎ করে শখ হয়েছে সাইকেল চালিয়ে সমগ্র বিশ্ব ভ্রমণ করার। সে এসেই আন্টিদের সাথে চেয়ারে বসে ছিলতে থাকা মটরশুটি, শশা, গাজর টমেটো গিলছে। মাহিতের একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। ফলে সে ব্যস্ত নতুন বাবা হয়ে। অর্পনও কাজে আটকে পড়েছে। তিশা দেশের বাহিরে তাই সে জগতের সবচেয়ে মজার মজার ঘটনা মিস করে সেখানে বসেই কাঁদছে। তার সব সময়ের নীতি যদি নিজে ফেল করো তাহলে দুঃখ কিন্তু যদি বন্ধু পাশ করে তাহলে মহা দুঃখ। সে কিছুতেই মানতে পারেছে না তাকে ছাড়া এই জগৎ এতো দ্রুত গতিতে চলছে। তাই সে শান্তকে গালি দিতে দিতে বলল,’ হালার পুতের দল তোগোরে সামনে পাইলে কাঁচা খামু।’
শান্ত সকল আয়োজন দেখিয়ে আরও একটু জ্বালিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,’ আগামী সাপ্তাহে আমরা সমুদ্রে যাচ্ছি সখি! তোমার জন্য আমার একটুও দুঃখ হচ্ছে না। মর তুই বিদেশের মাটিতে।’
‘ ভাই তোর পায়ে পড়ি এখন যাইছ না। আমি আসলে যাইছ। প্লিজ ভাই। তোর দুইটা পায়ে পড়ি।’
‘ ধর পা।’ পায়ের দিকে ক্যামেরা দেখিয়ে শান্ত নিজের জুতো খুলে ফেলল। মুজা খুলতেই তিশার চিক্কুর। যেন মুজা তার মুখে ছুড়েছে এমন ভাবে বলল,’ দূর কর এটা শয়তান। এই বল না নীহারিকাও যাবে?’ ফিসির ফিসির করে জানতে চাইলো সে। শান্ত ভাবুক হয়ে ক্যামেরা ঘুরিয়ে নাফিস উদ্দিনের দিকে দেখিয়ে বলল,’ এই লোক থাকতে তো মনে হয় না। তবে এই লোক টপকে গেলে নিয়েই যাব।’
‘ চুপ হারামজাদা। এভাবে কারো মৃত্যু চাইবি তুই!’
‘ দূর বা ল আমি তো টপকে যাওয়া মানে রাজি হওয়া বুঝাইছি।’
‘ আচ্ছা শুন আমি দ্রুত আসবো। আমারে ছাড়া কোথাও যাইছ না ভাই।’
‘ তোর এই বিশ্রী থোবরা নিয়ে সর এখন।’
ফোনটি কেটে আবার শশা খাচ্ছে সে। এই বাড়ির সার্কাস মিস করার মত না। যেমন আফিয়া বিলকিস গর্ব এবং দুঃখ মিশিয়ে বলল,; আপা তোর কপাল খুব ভালো। দেখ দুলাভাইও রান্না পারে, ছেলেও। অন্য দিকে এই দুই বাপ ছেলে রান্না তো দূর আলু কাঁটতেই পারেনা।’
খোঁচা! বড্ড বড় খোঁচা! বিমুগ্ধ এবং তার বাবার জন্য
সুযোগ পেলেই তিনি খোঁচার শিকার হচ্ছেন। গায়ে কেমন কারেন্ট চলে আসলো। তেড়ে বিমুগ্ধকে সরিয়ে দিয়ে বললেন,’ এই মাছ আমি কাঁটবো।’
বিমুগ্ধ প্রথমে চমকে গেল। ছরি ধারালো বেশ। হাত কেঁটে যেতে পারে। তাই সে বলল,’ দেখুন দক্ষতা ছাড়া এসব মাছ কাঁটা কঠিন।’
ছয় কেজির মহাশোল মাছটি যেন তাকিয়ে আছে নাফিস উদ্দিনের দিকে। আঁশটে গন্ধে তার বমি আসবে আসবে অবস্থা। মেয়ের মত তিনিও মাছ পছন্দ করেন না তেমন, সাথে তিনি এবং তার মেয়ে এসব কাজে একে বারে আনাড়ি। তবুও আজ স্ত্রীর কথায় গায়ে হিট লেগেছে। দমার মানুষ নন তিনি। তাই চাপাতি হাতে তুলে নিলেন তিনি। নবীন উদ্দিন মুরগি কাঁটছে দ্রুত গতিতে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে কত দক্ষ তিনি। ছোট ভাইয়ের বাচ্চাদের মত কাজ দেখে তিনি বললেন,’ এসব তোর কাজের বিষয় না। বাচ্চারা আর যাই হোক মাছ কাঁটতে পারে না। তাও এতো বড় মাছ। তুই বরং অফিস রুমের হাওয়া খেয়ে কাজ কর।’
‘ তুমি চুপ থাকো। আজকে আমি এসব করেই দেখাবো।’ জিদ্দি গলাটা দেখে হেসে ফেলল বিমুগ্ধ। একদম হো হো করে। তার উৎজীবিত হাসিটা দেখতে এতো সুন্দর ছিলো যে নাফিস উদ্দিন হা করে কিছু সময় দেখলো। বিমুগ্ধ চাপাতি হাত থেকে নিয়ে বলল,’ আগে মাছের উপরের অংশ পরিষ্কার করতে হবে ছোট বাবা। চলুন আপনাকে শিখিয়ে দি। বিনিময়ে আমারে পে করতে হবে।’
নাফিস উদ্দিন তাজ্জব হয়ে বললেন,’ লজ্জা লাগছে না শ্বশুরের থেকে পেমেন্ট চাইতে?’
আগুনের কাছ থেকে শাহিন ভাই বলে উঠলো,’ এ তো পুরো নির্লজ্জ। হসপিটালেও বিল চেয়ে বসেছে বোন জামাই থেকে।’
‘ মেধা, দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে যখন তাকে পেশায় রূপ দেওয়া হয় তখন সেটি হয়ে উঠে আমার অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। এবং আমি যদি সেই মাধ্যমকে কাজে না লাগিয়ে ফ্রি সার্ভিস দিতে শুরু করি তাহলে আমার পেশার অপমান হবে। তাই পেমেন্ট করতেই হবে। আমি আপনাকে রান্না শিখাবো বিনিময়ে আমার মূল্য চুকাবেন। শেষ।’
বিরক্ত হয়ে উঠে নাফিস উদ্দিন রাজি গলায় বলল,’ ওকে ওকে। চলো মাছ কাটি আগে।’ প্রিয়ম দৌড়ে এসে বলল,’ আমি তো ছোট ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে?’
‘ ছোট বড়, নারী পুরুষ সব সমান আমার চোখে।’
তবুও প্রিয়ম দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে বিমুগ্ধ কিভাবে চামচ দিয়ে মাছের উপরের অংশ ছেটে দিচ্ছে। এসবের মেশিন তার বাসায় এবং রেস্টুরেন্টে আছে। কিন্তু হাতের কাছে যা থাকে তা দিয়ে শিখানো ভালো বলে সে এটা ব্যবহার করছে। তারপর লম্বা একটি ছুরির সাহায্যে মাথা আলাদা করে নিলো। বিশাল মাথাটা নানা অংশে বিভক্ত করতে হবে। মুগডাল দিয়ে মুড়ি ঘন্ট করা হবে মাছের মাথার। নাফিস উদ্দিন একটি ছুরি হাতে নিয়ে বলল,’ এবার আমি কাঁটবো।’
বিমুগ্ধ মাছের শরীর তার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। ছুরি চালাতে একদমই অদক্ষ তিনি। ফলস্বরূপ উল্টাপাল্টা পিস হচ্ছে। বিমুগ্ধ তার হাত ধরলো। গ্লাভসের উপরটা মাছের রক্তে মাখামাখি। নীহারিকা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে নাক ছিটকে সরে গেলো। কিন্তু নাফিস উদ্দিন খুব উৎসাহ পাচ্ছে। তার চোখে মুখে কিছু শিখতে পারার এক অভূতপূর্ব কৌতুহল। বিমুগ্ধ তার হাত ধরে প্রতিটি মাছ পিস করছে। শিক্ষকের মত বুঝিয়ে বলল,’ এর বেশি ছোট করা যাবে না। হ্যা এবার ঠিক আছে। ওয়াও আপনি তো খুব ভালো ছাত্র।’
‘ ছোট থেকেই আমার মেধা ভালো। তোমার বাপের মত আমি ফেল করিনি।’ গর্বের সাথে বললেন তিনি। নবীন উদ্দিন মুগির পা তার দিকে ছুড়ে ফেলে বলল,’ ওই আমি কবে ফেল করছি? তুই নিজেই তো দশম শ্রেনীর বোর্ড পরীক্ষায় ফেল করে সুইসাইড করতে গিয়েছিলি।’
নাফিস উদ্দিন রেগে মেগে বলল,’ আমার ছেলে মেয়ের সামনে সেই বিষয়ে কথা বলবে না ভাইয়া। ভালো হবে না। ফেল করিনি। আমি পরীক্ষা দিতে পারিনি টাইফয়েডের জন্য।’
‘ সে যাই হোক ফেল তো ফেলই। তাই না প্রিয়ম?’ নবীন উদ্দিনের পাশেই দাড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে তার মুরগি কাঁটার দৃশ্য উপভোগ করছিলো সে।
‘ হ্যা।’ তার মনোযোগ অন্য দিকে। সে তাকিয়ে আছে বড় বাবার হাতের দিকে। নাফিস উদ্দিন ক্ষেপে তার দিকে তাকাতেই সে ভয় পেয়ে ভুল করে বলে ফেলল,’ বাবা তুমি একুই ক্লাসে দুই বছর ছিলে?’
‘ তুমি এদের সাথে থেকে এদের মত হয়ে যাচ্ছ। যাও দেখো মশলা কোথায়।’ কঠিন স্বর তার। বিমুগ্ধ নিজের বাবার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বুঝালো আজকের দিনে ভেজাল না করতে। তিনি শুনার মানুষ নন। ঠেস মেরে বলল,’ আমাদের মত হলে তো মানুষই হবে। তোর মত হলে হবে ফেলটুস।’
প্রিয়ম হো হো করে হেসে ফেলল। বাবার দিকে তাকিয়েও সেই হাসি গিলতে পারেনি। খুশিতে দৌড় দিয়ে নীহারিকাকে বলল,’ আপু বাবা বলে ফেল করেছে? অথচ আমরা মাসিক পরীক্ষায় খারাপ করলেও কি ঝারি দিতো।’
নীহারিকা হাসলো না। কারণ সে এবার জীবনে প্রথম বড় ব্যবধানে ফেল করেছে ইনকোর্সে। প্রিয়ম যে কোন সময় সেটি ফাঁস করে শ্বশুরবাড়ির সামনে ইজ্জত ধুয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা বিমুগ্ধ! সে যদি জানে খুব মজা নিবে। মানুষের মন পড়তে পারার বিশেষ জ্ঞান সম্পূর্ণ বিমুগ্ধ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আরে উনার মেয়েও তো ফেল করে। এটা আর এমন কি। অনেক নাম্বার পেয়েছে এবার। দশ। তবে আশিতে।’
‘ কি কি তুই ফেল করেছিস?’ ফাবিহা মিতু আপু হামলে পড়লো তার উপরে। বাবা তো বেজাই রেগে। নীহারিকার চোখ মুখ কেমন চুপসে গেছে। সে দৌড় দেওয়ার পায়তারা করছে।
‘ আল্লাহ তুই কেমনে ফেল করছস নীহু? তুই না বইয়ে মুখ ডুবিয়ে পড়ে ছিলি?’ ছোট খালামনির কথায় নীহারিকা রাগ দেখিয়ে বলল,’ ফেল করেছি তো কি হয়েছে? জীবন যুদ্ধে এক দুইবার ফেল করা এমন কোন বড় বিষয় না।’
‘ অনেক বড় কিছু। শ্বশুড়বাড়িতে থাকলে না হয় তোরা বাপ বেটি মিলে তাদের দোষ দিতি। এখন ফেল করলি কেন?’
‘ সেটাই। ফেল যখন যে কোন বাসায় হচ্ছে তাহলে মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া উত্তম। কি বলেন খালামনি?’ বিমুগ্ধের উঁচু গলায় সবাই এক জোগে বলে উঠলো,’ ওরে সুযোগ বাজজজ।’
নাফিস উদ্দিন মেয়ের অবস্থা দেখে দমলেন। বিমুগ্ধের উদ্দেশ্যে বললেন,’ ফেল করা খুব একটা বড় বিষয় না। এবারের মত মাফ করেছি। আর তুমি এতো উড়াউড়ি করবে না বেয়াদপের মত। আমার মেয়েকে আমি কখন শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো এটা তোমায় বলতে হবে না। আপাতত মাছ কাঁটো।’
বিমুগ্ধ মুখটা কুঁচকে রইলো কিছুক্ষণ। রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সকলে। নাফিস উদ্দিন কোমড়ে বেঁধেছে গামছা। বিমুগ্ধ তাকে পেয়াজ দিতে বলছে পাতিলে। তেলের বিকট শব্দে তিনি লাফিয়ে ঝাপিয়ে উঠছেন। এটা দেখে সকলে হো হো করে হাসছে। নবীন উদ্দিন প্রিয়মের হাত দিয়ে সবজি ঢালছেন। সে ক্রিকেট বল ছুড়ার মত করে ছুড়ছে সব। তেলের ছিটায় দৌড়ে এ পাশ থেকে ওই পাশে যাচ্ছে। ছেলেদের কাজে মেয়েরা খিলখিলিয়ে উঠছে। আঞ্জুম নেমেছে ব্লগিং করতে। সে তার ফ্যানদের নাফিস উদ্দিনকে দেখিয়ে বলছে,’ দর্শক সে আমার ছোট বাবা। একটু রাগী কিন্তু বেশ ভালো। আজ তার প্রথম রান্না। হা হা হা। দেখো কি অবস্থা! এবার বুঝতে পেরেছ ছোট বাবা খালামনি কত কষ্ট করে রান্না করে?’
নাফিস উদ্দিন ঘেমে নেয়ে তাল গোল পাকিয়ে বললেন,’ সত্যি মেয়েরা অনেক কষ্ট করে। রান্না ঘরে আমি লোন নিয়ে হলেও এসি কিনে দিবো আফিয়া।’
আরও একচোট হাসির রোল পড়ে যাচ্ছে। দেয়ালের উপরে বসে বসে অনেকে এই বাড়ির অসম্ভব সুন্দর মিলিত পাগলামি গুলো দেখছে। কেউ কেউ গেটে ঝুলে আছে।
এই তপ্ত তৃপ্তিদায়ক সুখ অনুভূতি সম্ভোগ করছেন দাদামশাই। একটি বেতের পাটির উপরে বসে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে উনার চোখ দুটি ভারী হয়ে আসলো। যেন অদৃশ্য এক রমনী ভেসে উঠলো চোখের পাতায়। যার প্রতিটি রাত অতিবাহিত হয়েছে নিজের ছেলেদের দূরত্বে চোখে পানিতে গাল ভিজিয়ে।
সকলের পাগলামীতে বিরক্ত হয়ে নীহারিকা তার দাদামশায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরল। মুখের উপরে দিয়ে রেখেছে শিফনের উড়না। যদিও ওই দিকে প্যান্ডেল করা হয়েছে। কিন্তু এদিকে বেশ গরম। ওড়নার ফাঁক গলিয়ে সূর্যকিরণ চোখে পড়ছে মৃদূ ভাবে। সেই চোখে তাকিয়ে দাদামশায়ের চোখে জল গুনতে গুনতে সে জিজ্ঞেস করল,’ কেমন লাগছে এসব?’
‘ কোন সব?’ চোখ মুছে তাকালেন তিনি।
‘ ওই যে পাগলামীগুলো!’ হাতটা উঠিয়ে দেখালো নীহারিকা। ‘ বাড়িটা তো পাগলা গারদ করে ছাড়বে তোমার পাগলের ডাক্তার নাতী।’
‘ হা হা, পাগল হওয়া থেকে যদি এতো খুশি, এতো আনন্দ, এতোটা মিশে থাকা যায় তাহলে পাগলই ভালো। চলো সবাই পাগল হয়ে যাই।’ দাদামশাই আনন্দ ঘন গলায় বলল। নীহারিকা তার হাতটি ধরে বলল,’ আমি পাগল হতে পারবো না দাদামশাই।’
‘ কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন তিনি। নীহারিকা গলার স্বর নামিয়ে বলল,’ আমি আরও আগেই পাগল হয়েছি।’ একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,’ তুমি আজ কতটা খুশি?’
‘ অনেক অনেক। ভাগ্যিস তাযিন তোমার প্রেমে পড়েছে, ভাগ্যিস সে তোমাকে এতো ভালোবেসেছে তাই তো আজ আমরা সবাই এক সাথে একটি ফ্রেমে বন্দি জীবনে বাস করছি।’
‘ প্রেমে পড়তে তো সে বাধ্য। আমাকে ভালোবাসতেই হতো।’
নীহারিকার ঠোঁটে দুর্ভেদ্য হাসি। গলায় রহস্য। গভীর উদাসীনতা।
‘ কেন কেন?’ আশ্চর্য্য গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি। নীহারিকা উঠে তার কাঁধে মাথা রাখলো। ওড়না সরছে একটু একটু করে। তার সেই গভীর মিশমিশে কালো চোখে তাকিয়ে বিমুগ্ধ দূর থেকেই কি যেন বলছে! হয় তো ভালোবাসার কথা, নয় তো প্রেমের দুই একটি বাক্য!
‘ কারণ আমি নীহারিকা। যাকে ভালোবাসার জন্যেই বিমুগ্ধের জন্ম হয়েছে।’ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সৌন্দর্য্যের মত নীহারিকার সেই হাসি যা খুব কম দেখা যায়। যে হাসির অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়। বিমুগ্ধের হাত কেঁটেছে সেই হাসি দেখতে দেখতে। নাফিস উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ছুটাছুটি লাগিয়ে দিলেন। বকা দিতে শুরু করলেন,’ এতো অমনোযোগী কেন তুমি? তুমি কি নকল করে শেফ হয়েছ? হাত কাঁটে কিভাবে তোমার?’ বিমুগ্ধ বিড়বিড় করে বলল,’ আপনার মেয়ের প্রানখোলা হাসি শুধু আমার হাতের নয় সমস্ত শরীরের রক্ত প্রবাহ তুমুল বেগে ছুটাছুটি করাতে যথেষ্ট।’
তার পিঠে একটি চাপড় মেরে তিনি বললেন,’ হুশে আসো বেয়াদপ। আমার মেয়েকে তো তুমি নজরে নজরে শেষ করবে।’
‘ আমি যখন আপনার মেয়ের দিকে তাকাই আমার সঙ্গে থাকা ফেরেশতারা মাশআল্লাহ বলে দেয়।’
‘ হ্যা তারা তোমার বাপের কেনা তো?’
‘ ওরে বাপরে!’ নাফিস উদ্দিন কাঁটা জায়গা চেপে ধরলেন। বিমুগ্ধ নিজের হাত ঝাকি দিচ্ছে।
নীহারিকা গোপনে একটি সুন্দর নিশ্বাস ফেলে বলল,’ এই আনন্দ আমার প্রিয়। এই সুখ আমার প্রিয়। তুমি দেখছ তো দাদু তোমার স্বপ্নের প্রিয় সুখ আজ বাস্তবে রূপান্তরীত। তার বিনিময়ে আমার কিছু চাই দাদামশাই?’
‘ যা চাইবে সব দিবো।’ দাদামশাই নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
‘ দাদুর সেই কানের দুল দিবে আমাকে। যা সে সব সময় কানে পড়তো।’
‘ আরে ওটা তো অনেক পুরানো। তুমি বরং তিন লেয়ারের হারটি নিও।’
‘ না। ওটা প্রিয়মের বউকে দিবে। ওই দুল আমার খুব পছন্দ। কারণ দাদু বলেছে ওটা তুমি তোমার প্রথম বেতন দিয়ে কিনেছিলে।’
‘ হা হা হা তোমার দাদু দেখছি এসবও বলতো আমি ভাবতাম আনরোমান্টিক মহিলা।’
‘ সে আমার মত। উপরে আনরোমান্টিক ভিতরে খুব খুব প্রনয়প্রেমি।’
‘ সে তো তুমি পুরোই তার মত। যাও দিয়ে দিবো তোমাকে। নিজ হাতে পরিয়ে দিবো।’ কথাটা শেষ করে তিনি আবার সামনে তাকালেন। তার ছেলেদের অদ্ভুৎ মিলন চোখে ভরে দেখছেন। নীহারিকাও তার বৃদ্ধ কাঁধে মাথা রেখে সেই দৃশ্য উপভোগ করছে। ভয়াবহ এই সৌন্দর্য্যের নামই প্রিয় সুখ। প্রিয়দের সুখ। সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই সুখ।
______________
রাত নেমেছে। নেমেছে সকলের শরীর জুড়ে ক্লান্তি, অবসাদ। সারাদিনের ধকল, এতো গুলো মানুষকে খাবার রান্না করে খাওয়ানো সহজ বিষয় নয়। পরিবারের মেয়েরা রান্না না করলেও বাকি অনেক কাজ করে তাদের শরীরও বিছানায় ডুবে গেছে। একটি স্বপ্নের মত দিন পার করে কেউ কেউ গভীর ঘুমে তলিয়েছে। রাত ডাকা পাখিদের শব্দ শুনা যাচ্ছে গুন গুন। রাতের চাঁদ চলে এসেছে মাঝ আকাশে। ঘড়ির শব্দ বলছে রাত তিনটা বাজে। বাহিরে স্নিগ্ধ বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের তোপের মুখে সূর্যের গরম হার মেনে এখন পরিবেশ ঠান্ডা। কাঁথা মুড়িয়ে নীহারিকা তখন গভীর ঘুমে। নরম আরামের ঘুমটি ধুপ শব্দে ছুঁটে গেছে। সে উত্তেজিত ভঙ্গিতে উঠে বসে চারপাশ দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম ঘুম চোখে বেশ অনেক কিছু ঝাপসা দেখছে। চোখের উপরে হাত বুলিয়ে সে আবার তাকিয়ে নিজের পড়ার টেবিলের উপরে এক মানব শরীর দেখে রিতিমিত চমকে উঠলো।
…
চলবে…
প্রিয় সুখ-৪৮(অন্তিম প্রথম খন্ড)
হাফসা আলম
.
‘ আপনি এতো রাতে আমার রুমে কি করছেন? আর রুম তো লক করা?’
নীহারিকা হুড়াহুড়ি করে উঠে দরজার কাছে গেল। দরজা সত্যি বন্ধ। বিমুগ্ধ কিভাবে আসলো? নীহারিকা দেখলো দক্ষিণের জানালা হাট করে খোলা। থালার মত চাঁদ উঁকি দিচ্ছে সাদা পর্দা ভেদ করে। চাঁদের মৃদূ আলো এসে উজ্জ্বল করে তুলছে তার মুখ। সেই মুখশ্রীতে চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা ধরফরিয়ে উঠলো নীহারিকার। সর্বোচ্চ নিন্ম স্বরে বলল,’ কি করছেন এখানে? এতো রাতে তাও? বাবা রাতে আমার রুমে আসে মাঝে মাঝে। ওহহ আপনি কথা বলছেন না কেন? বাবা দেখলে কিন্তু খুব রেগে যাবে। এমনেই প্রচুর রেগে আছে। এই।’
বিমুগ্ধের শার্ট ধরে টান দিলো সে। ঝুপ করে বাস্তবে ফিরে আসার মত করে উঠলো বিমুগ্ধ। বেশ হতচকিত গলায় বলল,’ কি হয়েছে? এমন টানা হ্যাচরা করছ কেন?’
‘ দ্রুত বলুন কেন এসেছেন?’ নীহারিকা দরজার দিকে তাকাচ্ছে বার বার। বিমুগ্ধ হঠাৎ উঠে দাড়িয়ে গেলো। তার দিকে এগিয়ে আসছে।
‘ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আর এগিয়ে আসছেন কেন এভাবে? সেখানে থেকেও কথা বলা যায়।’
বিমুগ্ধ খুব কাছে। যতটা কাছে আসলে একে উপরের শরীরে বাস করা ঘ্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়। তীব্র পুরুষদিপ্ত কড়া সুবাস নীহারিকার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য
যথেষ্ট। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা তাকে সম্পূর্ণ বরফে জমিয়ে দেওয়ার মত একটি শিহরিত কান্ড ঘটিয়েছে বিমুগ্ধে। খোলা গলায় নিজের উগ্র ঠোঁটের কিছু মাতাল মাতাল স্পর্শে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অগ্নিশীখা জ্বালিয়ে দিয়েছে। কানের কাছে দুটি ঠোঁট নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,’ এই শিহরণই কি যথেষ্ট নয় তোমার কাছে আসার জন্য রাগেশ্বরী!’
কাঁপতে থাকা তার শরীরটি নিজের দুটি হাতের ভাজে বন্দি করে নিলো বিমুগ্ধ। নীহারিকা এতোটা নাস্তানাবুদ কি কখনো হয়েছিলো আগে? না। এটি প্রথম। মনে হলো নদীর শান্ত পানির বুকে সুনামির ঢেউ, বাতাসের স্নিগ্ধতার পিঠে ধূলিকণার ঝড়। বৃষ্টির বুক চিড়ে ঝরঝরে হাওয়া। নীহারিকা ভেসে যাওয়ার মত অনুভূতিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ওড়না বিহীন নিজেকে সে অবিষ্কার করেছে বিমুগ্ধের বুকে। সেই বিমুগ্ধ কখনো অচেনা অজানা ছিলো, কখনো অপছন্দ, কখনো ভালো লাগা ছিলো। এখন এখন সে কি? এখন সে পবিত্র অধিকারের স্বত্বাধিকারী। অনুভূতির উত্তাল সাগরে ডুবে যেতে যেতে বিমুগ্ধ বলল,’ চলো বাহিরে যাবো।’
নীহারিকার সকল অনুভূতি উড়েছে হাওয়ায়। সে দৌড়ে ওড়না গায়ে দিয়ে লাল দুটি গাল নিচু করে নিলো। বিমুগ্ধ হেসে ফেলল। জোড়ে জোড়ে। চোখ রাঙ্গীয়ে তার শরীরে বালিশ ছুড়ে মারলো নীহারিকা। বিমুগ্ধ দ্রুত সেটি ধরে নিয়ে বলল,’ আস্তে তোমার হিটলার বাবা জেগে যাবে।’
‘ আপনাকে আমিই ধরিয়ে দিবো। বা…’ চিৎকার করার আগেই বিমুগ্ধ মুখটি চেপে ধরে বলল,’ এমন ভাব করছ যেন আমি প্রেম করতে এসেছি। বউয়ের কাছে আসতেই পারে হাজবেন্ড। এতো চিৎকার করলে লোকে তোমাকে লজ্জা দিবে।’
‘ সরুন প্লিজ। দম বন্ধ হয়ে আসছে।’ নীহারিকা দুরে সরে দাড়ালো। বিমুগ্ধ আবার হাসছে। রাগে চোখ মুখ তখন নীহারিকার রক্তিম। বিমুগ্ধ তার অনুমতির পরোয়া না করে একটি আকাশী রঙ্গের সাদা সুতোর লাখনৌ কাজের কুর্তি বের করে বলল,’ দশ মিনিট সময়। এক, দুই, তিন…’
বিরক্ত হয়ে নীহারিকা ওয়াসরুমে ঢুকলো। নিজের চুল ঠিক করে মাথায় ওড়ানা প্যাচিয়ে বের হয়ে বলল,’ সাজিয়ে গুছিয়ে মারতে নিচ্ছেন না কি?’
‘ হ্যা তোমাকে পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দিবো।’ বিমুগ্ধ তার ছোট চুলে হাত বুলিয়ে আয়নায় দেখছে নিজেকে।
‘ এটা ঢাকা শহর। পাহাড় পাওয়া যাবে না। আপনি বরং নদী থেকে ফেলে দিন।’
‘ এটা তুমি ভালো বলেছ। আমরা এখন বুড়িগঙ্গায় যাচ্ছি।’
‘ ছিঃ ওখানে মানুষ যায়? পরিবেশ কি জঘন্য।’
‘ যেখানে মানুষ যায় না সেখানেই আমি যাই। চলো চলো।’
বিমুগ্ধের তাড়া। নীহারিকা হতবাক গলায় বলল,’ আপনি কি সত্যি আমাকে নিয়ে রাত সাড়ে তিনটায় বের হবেন?’
‘ অবশ্যয়।’ একদম শিউর কন্ঠ।
‘ বাবা খুব রেগে যাবে জানতে পারলে!’ ভয় ভয় গলায় নীহারিকা বলল। বিমুগ্ধ তার হাতটি নিজের মুঠতে নিয়ে চুপি সারে বের হচ্ছে। খুবই নিম্ন আওয়াজ করে। পায়ের জুতোজোড়া তার হাতে। বৃদ্ধা আঙ্গুলে ভর করে করে হাঁটছে সে। নিজের বাড়িতে নীহারিকার নিজেকে চোর মনে হচ্ছে। কৌশলে ঘরের মেইন দরজা খুলতে মৃদূ শব্দ হলো। নীহারিকা কাঁপতে কাঁপতে থ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। তার ধারণা বাবা এখনই আসবে। বিমুগ্ধ এবং তার আবার শুরু হবে ঝগড়া। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। বিমুগ্ধ তাকে নিয়ে এক দৌড় দিলো গেটের দিকে। রাস্তায় এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ তোমার বাবা আমার লাইফ জাহান্নাম করে তুলছে।’
বড্ড রাগ হলো নীহারিকার। সাথে শ্বাস নিতে কষ্ট। বিমুগ্ধ তার মুখ দু হাতে তুলে বলল,’ ধীরে ধীরে শ্বাস নেও। একদম রিল্যাক্স।’
বেশ সময় পেরিয়ে নীহারিকা ক্ষেপে বিমুগ্ধের শার্ট মচড়ে বলল,’ ধরা খেলে কি হতো? আপনি এতো বেশি ডেসপারেট কেন? এতো অগোছালো পাগলামী না করলে হয় না? ওফ।’
বিমুগ্ধ জুতো পড়তে পড়তে বলল,’ ধরা পড়লে তোমার বাবার পা ধরে বলতাম প্লিজ গিভ মি মাই ওয়াইফ স্যার। প্লিজ।’
নীহারিকা তার নাটকিয় ভঙ্গী দেখে হেসে ফেলল। রাগ রাগ ব্যপারটা গায়েব হয়েছে। ভেজা রাস্তার বুক চিরে তারা হাঁটতে শুরু করলো। পরিবেশ তখন অন্ধারের কাছে বন্দি। ছাদ থেকে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে নাফিস উদ্দিন হাসছেন। সাথে দীর্ঘ এক ক্লান্তি তার বুক থেকে মেনেছে। শব্দ পেয়েই তিনি উঠে পড়েছিলেন। কিন্তু নিচে বিমুগ্ধকে দেখে তিনি ছাদে চলে এসেছেন। ছেলেটার যখন যা মন চায় তাই করে। সম্পূর্ণ আপন মনের অধিকারী এই ছেলেটির এই ভালোবাসা চিরজীবন থাকবে তো? এই ভয়টা উনার রোজ হয়। হয় তো বাবা ঘটিত আবেগ!
_______
নির্ঝর রাত হাতরে দুই ঘন্টা ধরে হাঁটে হেঁটে বিমুগ্ধ সত্যি নীহারিকাকে বুড়িগঙ্গার ধারে নিয়ে এসেছে। আকাশ পুনরায় মেঘলা হচ্ছে। চাঁদের বুকে উড়ছে মেঘ। বিমুগ্ধের গলাটা মাঝ পথে গাম্ভীর্যে ঢাকা পড়েছে।
‘ জাওয়াদ কাল তোমার ভার্সিটিতে কেন এসেছে নীহারিকা?’
নিস্তব্ধ রাতে এমন গম্ভীর গলা শরীর ঠান্ডা করে দিতে যথেষ্ট। নীহারিকা চমকে গেল হঠাৎ কথায়। মাঝ রাস্তায় পা দুটি থেমেছে।
‘ মনে কি? আপনি আমাকে এভাবে নজরে নজরে রাখছেন না কি? এসব আমি পছন্দ করি না বিমুগ্ধ।’
‘ আমিও জাওয়াদকে তোমার আশেপাশে পছন্দ করি না।’ বিমুগ্ধের কন্ঠে কি এক তীব্র মনস্তাপ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নীহারিকা তাকিয়ে থাকল তার দিকে। বিমুগ্ধ যে এতো পজেসিভ হয়ে যাবে সে জানতো না। তাহলে আগেই বলে দিত। তার রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেল সে। বিমুগ্ধ যে রেগে গেলে উদ্ভট কাজ করে সে জানে। তাই নম্র স্বরে বলল,’ উনি আমাকে গিফট দিতে এসেছিল। বিয়ের দিন না কি দেওয়া হয়নি।’
রাগটা পুরুষমুখটিতে ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। চোখ দুটি স্তব্ধ হয়ে আছে রাস্তায়। হাঁটার গতিও কমেছে,’ তোমার জন্য পছন্দ করে কেনা বিয়ের গয়না?’
মনে মনে চমকে গেলো নীহারিকা। তবে মুখে বলল,’ হ্যা। কিন্তু আমি সেটি গ্রহণ করিনি। ফলে এতো রেগে যাওয়ার কিছু হয়নি।’
‘ তার তোমার কাছে আসাই আমি পছন্দ করি না।’
‘ ওফ জেলাস!’
‘ হ্যা আমি জেলাস। এবং তোমার বিষয়ে সব সময় জেলাস থাকবো।’
‘ এই মাঝ রাতে আপনি আমাকে বকা দেওয়ার জন্য, ঝগড়া করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছেন?’
বিমুগ্ধ কথা বলছে না। তার মুখ থমথমে, কঠিন হয়ে উঠেছে। নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ কেন এতো পাগলামী করনে আপনি? এত অবুঝ তো আপনি নন। আমি উনার প্রতি কখনোই ইন্টারেস্টেড ছিলাম না, আর হবও না।’
শক্ত চোখ মুখে ল্যাম্পপোস্টের আলোর ভীরে নীহারিকার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বিমুগ্ধ বলল,’ বিকজ আই লাভ ইউ, বিকজ আই রেইলি লাভ ইউ। দিস ইজ হোয়াই আই এম সো ম্যাড!’
নীহারিকা হেসে ফেলল। প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে বিমুগ্ধের হাত ধরে দৌড়ে ছুটে গেলো নদীর ধারে। বৃষ্টি তখন তালগোল পাকিয়ে ঝড়ে পড়তে শুরু করেছে। চাঁদটির দেখা নেই। অন্ধকার রজনীকে ছাপিয়ে নীহারিকা বিমুগ্ধকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসে নারী কন্ঠে বলল,’ এই জন্যেই আপনি আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ পুরুষ।’
বিমুগ্ধ মনে মনে গলে যাচ্ছে। তার শরীর উষ্ণ হয়ে উঠছে। নরম হয়ে আসছে রাগ। তবুও আরও একটু রাগ দেখিয়ে সরে আসতে চাইল। নিজ থেকে দেওয়া এই আবেগ নতুন। নীহারিকার হাত বিমুগ্ধের পিঠে বলল,’ আপনাকে একটি গোপন কথা বলি?’
ততক্ষণে বিমুগ্ধ বরফ থেকে পানিতে রূপ নিয়েছে। বৃষ্টি ভিঁজিয়ে দিচ্ছে তার শরীরের সাথে মনকে। এটা স্বপ্ন! একটি রূপকথার স্বপ্ন। যা সে কখনো দেখেনি। অথচ তার জীবনে এসেছে। নীহারিকার রূপ নিয়ে এসেছে।
নীহারিকা বাহির থেকে খুব কঠিন, শক্ত একজন নারী সত্ত্বা। যে কখনো নিজেকে প্রকাশ করে না। তার ভালো লাগা ভালোবাসা সকল কিছু নিজের ভিতরে। যে কখনো নিজের কান্না কাউকে দেখাতে চায় না। হাসি হেসেছে মেপে মেপে। অদ্ভুৎ রাগ নিয়ে সব সময় ঘুরে বেরিয়েছে। সেই মেয়েটি একজন পুরুষের কাছে নিজেকে বদলে দিয়ে রিনঝিনে গলায় বলল,’ কেউ যদি আপনাকে অসম্ভব গভীর ভালোবাসে তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে?’
বৃষ্টির সাথে বেসে আসছে নদীর হাওয়া। শীতল হয়ে উঠছে শরীর। বিমুগ্ধ শুধু জড়িয়ে ধরে রেখে বলল,’ এই জগতের একজন নারী ব্যতিত আমি কারো গভীর ভালোবাসা অনুভব করতে চাই না।’
নীহারিকা আবেসিত রূদ্ধ গলায় বিমুগ্ধের বুকে নিজের গাল, মুখ চেপে ধরে বলল,’ যদি সেই একজন নারী আপনাকে বলে বিমুগ্ধ তোমাকে আমি অসম্ভব অসম্ভব অসম্ভব ভালোবেসেছি, ভালোবাসি, ভালোবেসে যাবো। তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে?’
চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেলো বিমুগ্ধের। ছট করে সে নীহারিকাকে বুক থেকে সরিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু নীহারিকা জমে রইলো শক্ত করে ধরে। বহু চেষ্টায়ও বিমুগ্ধ সরাতে পারলো না তাকে। অথচ তার বক্ষ তুমুল বেগে ধুক পুক ধুক পুক করে চলেছে। নিজেকে চরম আবেগে ভাসিয়ে দিয়ে বিমুগ্ধ নীহারিকাকে সেভাবেই তুলে ঘুরতে ঘুরতে বলল,’ আমি পাগল হয়ে যাবো সেই অনুভূতিতে ভেসে! দম বন্ধ হয়ে আসবে ভালো লাগায়। এক অমৃত সুখে আমার ভিতর বাহির সবকিছু জ্যোৎস্নার চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।’
কিছু সময়ের নিরবতা। বিমুগ্ধ বৃষ্টির তালে নদীর পারে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলল,’ সেই নারীকে বলে দিও তার এই ভালোবাসার ঋণ বিমুগ্ধ ইহকাল, পরকাল কোন কালেই শোধ করবে না। কারণ সে চায় ঋণ ফেরত পাওয়ার জন্য সেই নারী সব সময় তার হৃদয়ে বন্দি থাকুক। ভালোবাসার সুখ অনুভূতি হয়ে।’
___________
নবীন উদ্দিন চায়ের নীল ফ্লাক্স হাতে নীহারিকার সিটে বসে পড়েছেন। একে একে বাস ভর্তি সকলে যখন উঠল এই দৃশ্য সবার আগে আহত করেছে তার একমাত্র পুত্র বিমুগ্ধকে। সে রেগে তাকাল বাবার দিকে। এতে নবীন উদ্দিনের কিছুই যায় আসে না। তিনি একটি চিকেন লেগ পিস এবং কাপের উপরে ওয়ান টাইম স্ট্র দিয়ে নীহারিকাকে বললেন,’ চা এবং চিকেন ফ্রাই খেতে খেতে জার্নি ইনজয় করি কি বলো মা?’
নীহারিকা খুব খুশি। আনন্দে হেলেদুলে বলল,’ অবশ্যয় অবশ্যয়।’
নাফিস উদ্দিন উঠে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি তার বড় বোনের সাথে এক প্রকার কোলাকোলি করে বসে আছে। তার সামনে প্রিয়ম বসেছে শান্তর সাথে। মুখটা বড্ড বেজার শান্তর। এটা তাদের বন্ধুদের ট্যুর ছিল। কিন্তু নীহারিকাকে সঙ্গে নেওয়ার প্রবল লোভ তাদের ডুবিয়ে দিল সিনিয়র সিটিজেন সাথে। কি আর করার! যখন এই প্রস্তাব বাড়িতে রাখা হয়েছে তখন একে একে মিতু আপু, ফাবিহা, প্রিয়ম, এমন কি আফিয়া বিলকিস এবং তার বড় বোনও খুশিতে নেচে নেচে নিজেদের যাওয়ার কথা প্রকাশ করেছে। সবচেয়ে বেশি বিষ্ময় কর বিষয় দাদামশায়ের উল্লাস। শান্ত তো মুখের উপরে বলে দিয়েছিলো,’ আরে বুড়ো বয়সের লেহাজ করুন। দুই পা তো কবরে। আশেপাশের পার্কে ঘুরুন তো বুড়ো।’
তিনি তেড়ে উঠে নিজের বাঁকা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শান্তর অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। তাই বেঁচারা সেই দিন থেকে মুখ ঝুলিয়ে আছে। বিমুগ্ধ এবং অর্পন তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। তা না হলে জীবনেও এই তামাশার পরিবারের সাথে সে কোথাও ঘুরতে যেত না। হায় কপাল!
অনেক অনেক বছর পরে আজ নীহারিকার দাদা নানার পরিবার এক সাথে একত্রে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। এটি খুব সুন্দর একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে জীবনে। নীহারিকা দূরের গাছপালার সারির দিকে তাকিয়ে ভাবতে বসলো, জীবন আসলে কি? কতটুকু? এই জীবনে আমরা কি চাই? কি পেয়ে খুশি থাকি? টাকা কি সব? না কি ভালোবাসা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ হয়? আসলে এই জীবনের মূল বিষয় বস্তু কি? বহু খুজেও নীহারিকা কখনো জীবন নিয়ে সঠিক কোন উত্তর পায়নি।তুবুও সে খুজে চলেছে। যদি কিছু পাওয়া যায় সেই আশায়!
নাফিস উদ্দিন বসেছে আঞ্জুমের পাশে। এই মেয়ে আবার দুনিয়ার উগ্র। সে কিছুক্ষণ পর পর ইন্টারনেটে কি সব ছাড়ছে। নাফিস উদ্দিনকে এই ভরা গরমে একটি কান টুপি পড়িয়ে দিয়ে বলল,’ চলো ছবি তলি ছোট বাবা।’
সে হেলে পড়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুৎ সব অঙ্গ ভঙ্গ করে ছবি তুলতে শুরু করেছে। নীহারিকা ভয়ে ভয়ে আছে। বাবা কখন না জানি তাকে একটি রাম ধমক দেয়! বিমুগ্ধ বসেছে শাহিন ভাইয়ের পাশে। এই বাসে কোন জুটি এক সাথে বসেনি। মিতু আপু বসেছে ফাবিহার সাথে। তিশা বহু কষ্টে উড়ে এসে বসেছে রৌদ্রমূখীর পাশে। জীবনে প্রথম রৌদ্রমূখী বাসে জার্নি করছে। সে কখনো বাসে উঠেনি। হাস্যকর হলেও এটি তার জীবনের বাস্তবতা। সব সময় টাকার উপরে বড় হওয়া সে সাধারণ জীবন কি জানার উদ্দেশ্যেই নিজের আত্মসম্মান ভুলে এই পরিবারে বার বার চলে আসে। তার খুব ভালো লাগে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিনে মিতু আপু আর ফাবিহা তাকে সাদরে ডেকে নিয়ে আসে। এভাবেই কিভাবে যেন সে পরিবারের মানুষ হয়ে গেছে। কাল রাতে যখন সে পেডিকিউর করছিল তখন তার ফোন নিয়ে হাজির হয় তার মেইড। যখনই ফাবিহার নাম্বার দেখলো সকল কিছু বাদ দিয়ে সে সেটি রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে কেউ বলল,’ কালকে সকাল ছয়টায় তিনদিনের জামা কাপড় সহ তুমি আমাদের বাসায় চলে আসবে। তা না হলে জলনিধি দেখা মিস।’
তারপর টু টু টু। সে জানে এটি নীহারিকা। তার সবচেয়ে প্রিয় একজন নারী। যে অলীক সেই সুন্দর সুখ অনুভূতির মত। যে বাতাসের মত। সব কিছু শীতল করে। কিন্তু তাকে দেখা যায় না। ছোঁয়া যায় না। সে সত্যি এই জগতের অন্যরকম এক নারী। রৌদ্রমূখীর জীবনে তার মায়ের পরে সবচেয়ে প্রিয় নারী নীহারিকা নামক অদ্ভুৎ রাগী রমনী।
শাহিন ভাই একটু পর পর আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে বিমুগ্ধকে। একটা পর্যায়ে বিরক্ত গলায় সে বলল,’ সমস্যা কি?’
‘ কোন ভাবে মিতুয়ার সাথে বসার ব্যবস্থা করে দেও প্লিজ।’
শাহিন ভাইয়ের চোখে আকুতি। বিমুগ্ধ মাথায় হাত দিয়ে বলল,’ এই জীবনে আপনার মত বেহায়া পুরুষ আমি দুটো দেখিনি।’
‘ দুটো মিতুয়া তো জগতে নেই যে দুটো শাহিন হবে।’ লাজুক লাজুক গলায় বললেন তিনি। বিমুগ্ধ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,’ তাও ঠিক। কিন্তু মিতুয়া আসবে না। এই জার্নি আমার সাথেই করতে হবে আপনাকে।’
‘ তোমাকে কোথায় আমি বিদেশ পাঠাতে চেয়েছিলাম। আর তুমি কি না বাংলাদেশের বিখ্যাত হানিমুন স্পর্ট যাচ্ছ? কেন ভাই? কেন?’
‘ কারণ আপনার শালীর বাপ তাকে একা কোথাও পাঠাবে না আমার সাথে। তার ধরনা আমি তার মেয়েকে কাঁচা গিলে নিব।’ দাঁতে দাঁত পিষে পিছনে বসা নাফিস উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। নাফিস উদ্দিমও কড়া গলায় বললেন,’ আমার মেয়েকে নিয়ে কোন আলোচনা করবে না তুমি ফাজিল।’
‘ আচ্ছা। আমার বউকে নিয়ে তো আলোচনা করতেই পারি ছোট বাবা?’ বিমুগ্ধের গলায় দুষ্টুমি। নাফিস উদ্দিন রেগে তাকিয়ে রইলেন।
আঞ্জুম জিভ বের করে ছবি তুলছে। নাফিস উদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন,’ এসব আবার কি?’
‘ আরে ছোট বাবা ছবি তোলার অঙ্গভঙ্গি ছবি সুন্দর করে।’
‘ তাই বলে তুমি এক হাত জিহ্বা বের করে ছবি তুলবে?’ অবাক হয়ে বললেন তিনি। আঞ্জুম একটু থমকেছে। পরপরই হেসে বলল,’ চলো এক সাথে টিকটক করি। আমি নতুন আইডি খুলেছি। বেশ মজার জিনিস।’
‘ আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ এসব কি বলছ তুমি?’ লাফিয়ে উঠার মত করে বললেন নাফিস উদ্দিন। আঞ্জুম হো হো করে ডাকাতের মত হাসলো। সত্যি সত্যি সে নাফিস উদ্দিনকে নিয়ে টিকটক করতে শুরু করেছে। গান,
Papa kehte hain
Bara naam karega…
গানের তালে তালে সে হাত নাচাচ্ছে। নাফিস উদ্দিন বহু শুনেছে এটার নাম। আজ প্রথম এই অ্যাপ এবং এর কাজ দেখে তিনি থ মেরে তাকিয়ে রইলেন। কি পাগলামী ! কি পাগলামী! এই জেনারেশন তো এক একটা মানসিক রোগী!
‘ আঞ্জুম মা আমার দেখা হয়ে গেছে এবার এসব বন্ধ করো।’
আঞ্জুম হো হো করে আবার হাসতে শুরু করেছে। তার মানসিক অবস্থা সত্যি ভালো না। বিমুগ্ধ তাই বোনকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে যেতে চায়। সমুদ্র খুব প্রিয় তার। নাফিস উদ্দিনের কি হলো কে জানি। উনি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিছু বললেন না। আঞ্জুম কোন বাঁধা ছাড়াই তার কাঁধে মাথা রেখে বলল,’He is my little father. very angry man. But he’s a little better. Just a spoonful.’
নাফিস উদ্দিন অবাক হয়ে দেখলেন তাকে। মেয়েটি সেকেন্ডে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর তাকে খারাপ বলল না কি ভালো!
‘ খারাপের মাঝে ভালো বলেছে।’ বিমুগ্ধ সামনে থেকে মাথা ঘুরিয়ে বলল। নাফিস উদ্দিন রেগে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। বিমুগ্ধ তার সাথে দুষ্টুমি করার একটি সুযোগও মিস করে না।
___________
অতিমাত্রায় যানজটকে পার করে বারো ঘন্টার জার্নি শেষে তারা ঝাউবনের শহরে এসে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা হয়েছে। চারপাশে অন্ধকার ছাপিয়ে হাজারো লাইটের হলুদ সাদা আলোতে শহরটি আলোকিত। জমজমাট একটি শহর এই সমুদ্র সৈকত। হাজারো মানুষের ভীর। নাফিস উদ্দিন অবাক হয়ে সব দেখছেন। তিনি এবং তার পরিবার কেউ কখনো এই স্থানে আসেননি। খুব একটা ঘুরাঘুরি পছন্দ নয় উনার। সাথে ছেলে মেয়েদেরও তেমন একটা কোথাও যেতে দিতে চান না তিনি। এবার বাবা এমন ভাবে বলল, বয়স্ক মানুষ কোন দিন কি হয়ে যায় এই ভয়ে এতো দূরের পথে উনি এসেছেন। তা না হলে সারা জীবন আফসোস বয়ে বেড়াতে হতো। এসে অবশ্য ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগা যাকে বলে। কিন্তু মুখটা করে রেখেছে বিরক্তিকর।
মিতু আপুর চুল গুলো সব গোল্লা হয়ে গেছে গাড়ির বাতাসে। সেসব ঠিক করতে করতে সমুদ্রের গর্জন তার কানে আসল। পাগলের মত তিনি ছুঁটতে শুরু করেছিলেন বালির পথে। শাহিন ভাই বহু কষ্টে বউকে নিজের হাতে বন্দি করে বলল,’ এখন না। পরে যেও। আগে হোটেলে যাবো।’
মিতু আপুর বাচ্চা সুলভ কথা,’ না না এখনই যাবো। ওফ আমার বুকের ভিতরটা উথালপাথাল করছে। কি সুন্দর বাতাস। আল্লাহ!’
আবেগে পাগল হয়ে যাচ্ছেন তিনি। তারা কখনো এসব দেখেননি। রৌদ্রমূখী একটু অবাক হয়ে বলল,’ সমুদ্র তোমার এতো প্রিয় মিতু আপু?’
‘ প্রিয় কি না কিভাবে বলবো আমি তো জীবনেও আসিনি।’ চোখ দুটি উনার গহিন সমুদ্রে। যা দেখা যাচ্ছে না খুব একটা। কিন্তু মানুষের ঢল চোখে পড়ছে।
‘ কি বলো কখনো আসনি? এমন মানুষও বাংলাদেশে আছে!’
‘ হ্যা আছে। এই যে আমরা পুরো এক গুষ্ঠি। সবার তো তোমার বাপের মত আলগা টাকা নেই যে ঘুরে বেড়াবে।’ প্রিয়মের কন্ঠ শুনা গেল। রৌদ্রমূখী তেড়ে গিয়ে বলল,’ সব সময় তুমি আমার কথায় নাক না গলালে হচ্ছে না?’
‘ না হচ্ছে না। তুমি যেভাবে আমাদের পরিবারে উড়ে এসে জুড়ে বসছ মন চাচ্ছে সমুদ্রে ডুবিয়ে দি। অসহ্য মেয়ে।’
নীহারিকা এদের দুজনের মাঝে দাড়িয়ে বলল,’ যে কোন স্থানে শুরু হয়ে যাও কেন তোমরা?’
‘ এই প্রিয়ম ঝগড়া বন্ধ।’ ভাইকে চোখ রাঙ্গিয়ে সরিয়ে নিয়ে আসল সে। শান্ত সকলের উদ্দেশ্যে বলল,’ হোটেল বুক করে রেখেছি আগেই। সবাই চলুন।’
‘ হোটেল থেকে সমুদ্র দেখা যায় তাযিন ভাইয়া?’ ফাবিহার উচ্ছাসিত কন্ঠস্বর। বিমুগ্ধ মৃদূ হেসে বলল,’ হ্যা।’
ইফতি ফাবিহার খুশি দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল,’ তুমি সমুদ্র এত পছন্দ করো আমাকে কখনো বলোনি কেন?’
‘ আপনি কখনো জানতে চাননি তাই। আর সমুদ্র এখনো আমার পছন্দের নয়। কারণ তাকে এখনো সরাসরি আমি দেখিনি, ছুঁই নি। শুধু অনুভব করছি।’
‘ ঠিক আমি যেভাবে ভালোবাসা অনুভব করি তেমন?’ ফিসফিসে গলাটা ফাবিহার কান ভেদ করে হৃদয়ে পৌঁছেছে কি? তার কালো সুন্দর চোখ দুটি ঘুরে একবার ইফতির দুটি চোখে নিবন্ধ হয়েই সরে গেল।
_____
হোটেলে ঢুকতেই বিশাল খোলা এড়িয়া। সোফা রয়েছে বিভিন্ন কোনে। চাবি বুঝে নেওয়া, পরিচয়, এনআইডি চ্যাক করাতে গেছে কয়েকজন। বাকিরা সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। সাদা কালো পোশাকের একজন স্টাফ তাদের ওয়েলকাম ড্রিংস সার্ভ করছে। মিতু আপু বেশ মূক গলা বলল,’ এরা দেখছি ফ্রিতে জুসও দেয়।’
প্রিয়ম হেসে ফেলে বলল,’ বোকা এটা ফ্রিতে না আপু। টাকা নিয়ে নিবে সুদে আসলে। হোটেল হচ্ছে বিজনেসের বেশ বড় একটি মাধ্যম। আর লাভ ছাড়া বিজনেস হয় না।’
‘ তা ঠিক বলেছিস।’ মিতু আপু সবার আগে টেস্ট করলেন। পেঁপের সরবত। খেয়ে নাক মুখ একটু বিকৃত করলেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তার ভালো লেগেছে এবং শাহিন ভাইয়েরটাও তিনি শেষ করে নিয়েছেন। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,’ আমি, নীহু, ফাবু, এক রুমে ঘুমাবো।’
আঞ্জুম ভিডিও করতে করতে ব্যস্ত গলায় বলল,’ আমাকেও নেও। কাজিন হই।’
‘ রুম বড় হলে রৌদ্রমূখী আর তিশা আপুকেও নিবো।’
তিশা হতবাক গলায় বলল,’ তো জামাই নিয়ে এসেছ কেন? একা আসলেই পারতে।’
শাহিন ভাই এবার দুঃখ প্রকাশের সাথি পেয়ে বললেন,’ সেই তো। আমাকে নিয়ে এসেছ কেন? আমার ভাগের জুস খেতে শুধু?’
‘ আরে বাপরে সব সময় তো আপনার সাথেই থাকি। আমি চাই এই সমুদ্র বিলাশ আমরা কাজিনরা এক সাথে করবো। ছোট বেলার স্বপ্ন এটা।’
‘ তাই বলে রাতে ঘুমাতে হবে কেন এক সাথে? তখন কি সমুদ্রে ভাসবে তোমরা?’ শাহিন ভাই এবার খুব রেগেছেন। ইফতি তাকে বসিয়ে রাখতে পারছে না। ভাগ্যিস বড়রা নেই। এই লোকের তো ইজ্জত নাই তাদেরও থাকতো না।
‘ মিতুয়া এটা আমাদের বিয়ের পরে প্রথম ট্যুর তুমি নষ্ট করতে চাইছ কেন?’ অসহায় গলায় বললেন শাহিন ভাই। মিতু আপুর অবুঝ গলা,’ সেটাই তো বলছি। এই ট্যুর আমি কিছুতেই মিস করতে চাই না। তাই কাজিনদের সাথে সারা রাত গল্প করে কাঁটিয়ে দিবো।’
‘ বলদ বউ তুমি ভুলে যাচ্ছো কেন আজ তাযিন এবং নীহারিকার ফাস্ট নাইট।’ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন শাহিন ভাই। কথাটা কানে পৌছাতেই আনারের শরবত নীহারিকার নাকে উঠে গেল। সে ক্রমাগত কাশতে শুরু করেছে। কাশতে কাশতে শ্বাসটান শুরু। বিমুগ্ধ তখন রিসিপশনে ছিলো। সে দৌড়ে এসে নীহারিকার হ্যান্ড ব্যাগ চ্যাক করে দেখলো ইনহেলার নেই। প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বলল,’ ইনহেলার কোথায়? কোন ব্যাগে?’
নীহারিকার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। পানি পড়ছে চোখের কোন বেয়ে গালে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুক চেপে সে শ্বাস নিতে চাইল। কিন্তু পারছে না। নিঃশ্বাসের সাথে প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে। সকলে শুনছে। বিমুগ্ধ সহ সকলে তন্ন তন্ন করে প্রতিটি ব্যাগ দেখলো। না পেয়ে বিমুগ্ধ পাগলের মত ছুটে ফার্মেসি কোথায় জিজ্ঞেস করলো স্টাফকে। সকলে বেশ ঘাবড়ে গেছে। নীহারিকা তখন ফ্লোরে শুয়ে পড়েছে। নাফিস উদ্দিন মেয়ের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে আবেগে কান্নার মত অবস্থা হয়েছে।
এই গলি সেই গলি দৌড়ে দৌড়ে বিমুগ্ধ ঘামে ভিজে জবজবে শরীর নিয়ে হাজির হয়েছে। কোথায় কোন পাথরে পা লেগে তার পায়ে কেঁটেও। সেই রক্ত সাদা টাইলস ছুঁয়েছে। নীহারিকা যখন শান্ত, স্নিগ্ধ স্বাভাবিক নিঃশ্বাস ফেলল তখন বিমুগ্ধ খুব রেগে চিৎকার করে বলল,’ মরার খুব শখ হয়েছে? তুমি কি করে এটা ভুলে যেতে পারো? তোমাকে আমি বাসে উঠার সময়ও বলেছি। ফোনে মেসেজ করেছি। তুমি এটা কিভাবে করতে পারো? কিভাবে?’ রেগে সে গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছে। নীহারিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার লাল রক্তিম মুখ চোখের দিকে। বিমুগ্ধ খুব একটা রাগ করে না। কিন্তু করলে তা কত ভয়ংকর সেটা বুঝা যাচ্ছে। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে। ছুটে এসেছে ম্যানেজার। শাহিন ভাই তাদের সামলে নিচ্ছে। নাফিস উদ্দিন এই প্রথম হয় তো বিমুগ্ধের কাঁধে হাত রেখে নিজের মেয়ের ভুল শিকার করে বলল,’ ও ভুল করেছে। উদাসীনতার জন্য ওকে আমি বকবো। কিন্তু প্লিজ আমার সামনে আমার মেয়েকে শাসন করবে না।’
‘ আর তুমি প্লিজ তোমার ছেলের পা ব্যান্ডেজ করার ব্যবস্থা করো।’ নবীন উদ্দিন সে কথাকে একটুও পাত্তা না দিয়ে নীহারিকার পাশে বসে বলল,’ পরের বার থেকে আমি মনে করিয়ে দিবো তোমাকে। এখন ভালো লাগছে?’
নীহারিকা শুধু মাথা দোলাল। সে এখনো বিমুগ্ধের দেওয়া ধমক ভুলতে পারছে না। নাফিস উদ্দিন বিরক্ত হয়ে বিমুগ্ধের পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। পায়ে ইটের আঘাত লেগেছে। তাই চামড়া ছেড়েছে। তখনও বিমুগ্ধ তাকিয়ে ছিল নীহারিকার দিকে রাগে রাগান্বিত চোখে। সকলে উঠে একে একে রুমে চলে যাচ্ছিলো। শাহিন ভাই বড়ই দুঃখ করে বলল,’ শালিকা আমি তো বুঝিনি তুমি এতো বড় শক্ট হবে যে নিশ্বাস টিশ্বাস বন্ধ করে নিবে।’
‘ আপনি তো কথাই বলবেন না শাহিন ভাই। আজকে আমি মিতু আপুর সাথেই ঘুমাবো। এটা আপনার শাস্তি।’
রাগে গজ গজ করে বলল নীহারিকা। শাহিন ভাইয়ের অসহায় মুখটাকে মোটেও পাত্তা দিলো না।
__________
অম্বুধির ঢেউ হয়ে উঠেছে অশান্ত। ঠান্ড বাতাসে সবকিছু শীতল। শান্তদের রুমটি বেশ বড়। দু পাশে দুটি বিশাল বেড। দুজন করে চারজন থাকা সম্ভব। প্রিয়ম, শান্ত, অর্পন এবং মুহিব থাকবে। সকলে বেশ ক্লান্ত। জীর্ণকায় হয়ে এসেছে শরীর। এত লম্বা সফর বাকিরা বহুবার করলেও প্রিয়মের এই প্রথম। যেহেতু সে খুব একটা ঘুরাফেরা করে না তাই সে ক্লান্ত বেশি। বিছানার এক কোনে লম্বা হয়ে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়েছে সে।
বিমুগ্ধ তাদের রুমটি কব্জা করেছে। সে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে আছে । শান্ত বিয়ারের বোতলটি বের করে টেবিলে রেখে বলল,’ সমুদ্র দেখতে দেখতে খাওয়ার মজাই আলাদা।’
একটু দূরেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। ঢেউয়ের উঁচুনিচু আছড়ে পরার দৃশ্য দেখতে দেখতে তারা কিছু সময় নিজেদের স্টুডেন্ট লাইফ নিয়ে কথা বলল। প্রিয় ক্যাম্পাস, দুষ্টমিষ্টি ঘটনা হঠাৎ স্মৃতিচারণ করে বসলো। তাদের ছেলে রূপে মেয়ে বন্ধুটিকে নিয়ে হাসলো কিছু সময়। পাগলের মত ছুঁটে এসেছে বিদেশ থেকে যে। আর একজন বাচ্চার জন্য আসতে পারেনি তা নিয়ে তার সে কি দুঃখ। বিমুগ্ধ অবশ্য
নিরব। একদম শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে তার সমস্তটা জুড়ে। শান্ত এক গ্লাস ড্রিংস তৈরি করে দিয়ে বলল,’ এখানে সুন্দর একটি বার আছে যাবি? চল।’
অর্পন গ্লাসটা সরিয়ে বলল,’ একে এসব খাইয়ে বিপদে ফেলছিস কেন? এমনেই বেচারা নার্ভাস।’
হো হো করে হেসে মুহিব বলল,’ তোর মত পোলাও নার্ভাস হয়?’
বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বিমুগ্ধ বলল,’ তোরা কোন গন্ডগোল করেছিস রুমে?’
‘ আরে না। আমরা তো বেশ ভালো করেই জানি তোর শ্বশুরমশাই এই জীবনে নানা হতে চায় না।’ অর্পনের হাস্যকর গলা।
‘ নীহারিকার জন্য অন্য রুম নেওয়া দরকার ছিল। তোদের কে বলেছে এতো ফাইজলামি করতে?’ রেগে বলল বিমুগ্ধ। শান্তর চোখ মুখে অসহ্য বিরক্তি ভর করেছে। সে এখন প্রায় মাতাল,’ আব্বে হালারপুত তুই কি সারা জীবন বউরে তার বাপের বাড়ির মত চিড়িয়াখানায় রাখার জন্য বিয়ে করছস? কত ঢং দেখমু তোমার। আমি জানি আমেরিকায় তুমি কি ছিলা বেটা। এখন আসছ সাধু হইতে।’
‘ কি ছিলাম? মাঝে মাঝে বারে পার্টনারের সাথে নেচেছি। কয়েকটি ডেটে গেছি। যা টিকেনি দুই দিন। এমন তো না যে আমি সেখানে মধুচন্দ্রিমা করেছি।’ গরম চোখ দুটি দিয়ে বিমুগ্ধ শান্তকে ঝলসে দিলো।
‘ আরে চিল এতো ভয় পাইলে হয়! বাদ দে যা রুমে যা।’
‘ আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না।’ অর্পনের হাতটি কাধ থেকে সরিয়ে দিলো বিমুগ্ধ। তারপর উঠে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে বসে পড়ে বলল,’ আমার সত্যি ভয় করছে। দেখা গেল তোরা উদ্ভট কিছু করে রেখেছিস রুমে। নীহারিকা এসব দেখে রেগে আগুন হয়ে গেল। এমনেতেই তার পূর্বের রাগ আছে আমার উপরে। যেভাবে চিৎকার করেছি!
সকলে মিলে তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে বলল,’ যা ভিতরে শালা। গো ম্যান। তোমার শ্বশুর আশা করি মেয়ে এবং মেয়ের জামাইয়ের ফাস্ট নাইটে এসে বসে থাকবে না।’
তারা পায়ের জুতো খুলে ধুম ধুম করে দরজায় বাড়ি দিলো। বিমুগ্ধ কিছু বলার সময়ও পেলো না। সে হতবম্ভের মত দাড়িয়ে রইলো। তারপর! তারপরের ঘটনা একদম অবাস্তব একটি দৃশ্য। একজন নারী দরজা খুলেছে। বিমুগ্ধ তখন তেড়ে তাদের ধরতে চাচ্ছিলো। কিন্তু এই দৃশ্যে তার পা জমে গেছে। থমকেছে হৃদয়। দুরু দুরু বুকটা বলে উঠছে এটি খোয়াব, স্বপ্ন। শুধুই তার অলীক কল্পনা।
…
চলবে…
ভুলত্রুটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন। নিশ্চুয়ই ক্ষমা একটি মহান গুন। 🕊️