প্রিয় সুখ-৪৯(অন্তিম শেষ খন্ড)
হাফসা আলম
.
হলুদ একটি শিফনের শাড়ি পরে দাড়িয়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে নীহারিকা ইতস্তত করে বলল,’ মিতু আপুরা আমার সব ড্রেস নিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না। রুমে শুধু এই শাড়ি আর আর!’ নীহারিকা চুপ করে গেল। আর যা ছিলো তা সে বলতে চাইছে না। বিমুগ্ধ দেখলো পিছনে তার বদমাইশ বন্ধুরা উঁকি দিচ্ছে। সে দ্রুত নীহারিকাকে সহ ভিতরে প্রবেশ করলো। ভিতরের অবস্থা দেখে সে আরও চমকেছে। হলুদ ফুলে সাজিয়ে রেখেছে সমস্ত রুম। কার পছন্দের রং হলুদ? নীহারিকা বিমুগ্ধ কারই নয়। অর্পন! হ্যা ওরই তো প্রিয় রং এটি। বিমুগ্ধ দ্রুত ফোন করে বলল,’ এই তোর আর কোন কাজ ছিল না? আমার বাসর ঘর তুই নিজের পছন্দে সাজালি কেন?’
‘ তো কি করব? আমি বিয়ে করতে পারিনি এখনো তাই ভাবলাম বন্ধুর মাধ্যমে শখ পূরণ করি। ওই যে হয় না এক ভাইয়ের ইচ্ছে থাকে ডাক্তার হবে। কিন্তু অনেক সমস্যার কারণে হতে পারে না। তখন ছোট ভাইকে ডাক্তার তৈরি করে।’
‘ তোর কি জীবনে বাসর হবে না? যে আমার মাধ্যমে শখ পুরুণ করতে হবে?’
‘ তাও তো ঠিক। আমি এটা কি করলাম?’ অর্পন ভাবতে বসলো।
‘ ইডিয়েট।’ ফোনটি কেঁটে দিয়েছে সে।
দৃষ্টজোড়ায় অবাকতা। ওয়াশরুম থেকে বের হতে না হতেই এসব করেছে কারা? হলুদ ফুলের একটি রাজ্য তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। বিমুগ্ধ ফিরে তাকালো। পাশে দাড়িয়ে সে। তার হলুদ শাড়ি বেশ চঞ্চল। উড়ছে, গলে পরছে, মিশে যাচ্ছে। বিমুগ্ধের চোখে মুগ্ধতা নয়। তার কয়েক ধাপ উপরে কি যেন আছে! নিজেকে সংযত করে আড়চোখে একবার একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা নীহারিকাকে সে বলল,’ এসব কিছুই করতে বলিনি আমি। বিশ্বাস করো।’
‘ করেছি।’ নীহারিকা চোখ ফিরিয়েছে। এসে ছুঁয়েছে বিমুগ্ধের সুদর্শন রোদে পোড়া মুখশ্রীতে। হঠাৎ করেই নীহারিকার মনে হলো তার শরীর কাঁপছে। নতুন এক অনুভূতি ছেঁয়ে যাচ্ছে সব জুড়ে। ঠিক সেদিনের মত। সেই সময়ের মত। যখন এই পুরুষের ঠোঁট ছিলো তার গলার ভাজে। একঝাঁক প্রজাপতির দল উড়ে এসে বুকে চেপে বসেছে যেন। নিজের ভিতরের লজ্জারা একটু একটু করে বের হয়ে আসছে। বুক কাঁপছে ধড়াস ধড়াস করে। বিমুগ্ধের চোখ তখনও তার মাঝে, কখনো শাড়ির আঁচল, কখনো মুখশ্রী ঘুরে বেড়াচ্ছে অবিরাম। শুকিয়ে আসা গলায় সে একটু সরে দাড়ালো। বিমুগ্ধ সব দেখছে। নীহারিকার মনে হলো আজ তার ভিতরের সব গোপন কথা জেনে নিচ্ছে সে। পড়ে নিচ্ছে নিজ ইচ্ছেতে। বিমুগ্ধ আরও আরও সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। নীহারিকার চোখ ফ্লোরে। দুজনে দাড়িয়ে আছে দুপ্রান্তে। আচমকা খুব কাছে এসে বিমুগ্ধ জড়িয়ে ধরলো নীহারিকার নরম শরীর। খুব নম্র গলায় বলল,’ আমি দুঃখিত।’
‘ এটাতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই।’ খুব সূক্ষ্ম গলার স্বর। বিমুগ্ধ মৃদূ হাসলো। বলল,’ আমি এসবের জন্য দুঃখিত নই। তোমাকে ওভাবে বকার জন্য দুঃখিত।’
নীহারিকা কথা বলছে না। তার ভিতর বাহির সব ঝড়ের ঢুলে পরা গাছের মত দুলছে। বিমুগ্ধ কি টের পাচ্ছে? হ্যা পাচ্ছে। একটু একটু করে সে বলল,’ তোমাকে আজকে হলুদ বসন্তের সৌন্দর্য্যে ডুবে থাকা হলুদ পাতার মত লাগছে। যার হিমেল হওয়ায় ঝড়ে পরার কথা মাটির মত আমার হৃদয়ে।’
নীহারিকা চুপ। তার সকল বাক্য কেড়ে নিয়েছে যেন জাদু বলে। শুধু বিমুগ্ধ তার ভারী নিঃশ্বাস, হৃদয়ের তুমুল আন্দোলন শুনতে পাচ্ছে। আরও একটু জড়িয়ে নিলো সে নীহারিকাকে। ভেজা চুল গুলোতে লম্বা শ্বাস পড়ছে। নিঃশ্বাসের তোপের মুখে উড়ছে মৃদূ মৃদূ। নীহারিকার মনে হলো তার পায়ের নিচটা খালি। একদম শূন্য। বিমুগ্ধ তাকে জড়িয়ে ধরে বারান্দার কাঁচের সামনে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল,’ আজকে তুমি চোখ বন্ধ করে রাখার শপথ নিয়েছ তাহলে। ভালো। একদম খুলবে না। আজ আমার চোখে তুমি এই জগতের অসম্ভব সৌন্দর্য্য দেখবে। দেখবে দূর আকাশে ভেসে বেড়ানো চাঁদ। দেখবে ধূসর সমুদ্র। দেখবে সবুজ প্রকৃতির নিচে বিছানো চোরাবালি, আর আর দেখবে আমাকে। শুধু আমাকে।’
নীহারিকার ঘাড়ে তার ঠান্ডা থুতনী। থরথর করে ঝড়ো হাওয়ার মত কম্পন শরীরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে রমনী।
‘ আমার কাছে এই দিনটি বিশেষ হয় তো একটু। কিন্তু খুব বিশেষ খুব আনন্দের, খুব পাগলামী অনুভূতিতে ঘিরে রাখা দিন কোনটি জানো?’ বিমুগ্ধের খোঁচা দাড়িতে ডুবে যাচ্ছে সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি রূপ লাবন্যের রানী মসৃণ অস্তিত্ব। হঠাৎ নীহারিকার জমে যাওয়া শরীর অনুভব করলো বিমুগ্ধের হাত কাঁপছে। কাঁপছে তার ঠোঁট, হয় তো অস্তিত্বও। তার জড়িয়ে রাখা হাত গভীর। গভীর তার অনুভূতি। ফিসফিসে শব্দ গুচ্ছ একত্রিত হয়ে বলছে,’ যেদিন তুমি আমার হয়েছ। সেই দিন, সেই সকাল, সময়, ঘন্টা আমার মৃত্যুর শেষ সময়ও মনে থাকবে।’
‘ জন্ম আমার যেমন তেমন মরতে আমি তোমার সাথেই চাই রাগেশ্বরী।’ কন্ঠস্বর সমুদ্রের গর্জনের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো নীহারিকা। একটু দূরের সমুদ্রের মিহি সুর শুনতে পাচ্ছে সে। গভীর আবেশিত তার নজর, ক্রমান্বয়ে কাঁপছে শরীর। যেন একটি ধান শীষ। বিমুগ্ধের গলায় কথার ঝুম,’ মানব হৃদয় রোজ রোজ হারে ভালোবাসার লিলা খেলায়। ঠিক যেমন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের কাছে হার মানছে চোরাবালি। সেই স্রোতের মহা কলরবের মত আমার হৃদয়ও হেরেছে তোমার মোহনীয় মোহনায়। এই জলোচ্ছ্বাস আমার। আমার হৃদয়ের। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো সেই শব্দ? সেই উচ্ছ্বাস? সেই জলোচ্ছ্বাস?’
নীহারিকার কাছ থেকে জবাব এলো না। তার মাথা নত। সমুদ্রের উত্তপ্ততা দেখছে সে। কিন্তু সমস্তটা জুড়ে বিমুগ্ধের নেশাল সুর। বিমুগ্ধ তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বুকে একটি হাত চেপে দূর সমুদ্রে তাকালো। নীহারিকার চোখ দুটিও সেদিকে।
‘ এই সমুদ্রের চাইতেও ভয়াবহ ঢেউ, উত্তপ্ততা, তুফান বইছে আমার মাঝে। তুমি কি তা অনুভব করছ?’ বিমুগ্ধের কন্ঠ নিভে আসছে। নীহারিকার সমস্ত কায়া দুলছে। বিমুগ্ধ তাকে জগতের সবচেয়ে পবিত্র, সুন্দর অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে বলল,’ চলো তোমাকেও অনুভব করিয়ে দি আমার উষ্ণতার সাথে।’
সেই কন্ঠ, সুরের সাথে নীহারিকা আবিষ্কার করলো স্বপ্নীল একটি জগৎ তখন ভাসছে সমস্ত রজনী জুড়ে।
_____________
ভোরের সমুদ্র একটু ঠান্ডা। বাতাসের শীতলতা পরিবেশে। দূর থেকে ভসে উঠা ঢেউ গুলো আস্তে আস্তে ছোট হয়ে তীরে আঁচড়ে পরছে। গভীর ঘুমটি আরও একটু প্রশান্তিময়। সাদা কম্ফোর্টারটি ভালো করে শরীরে প্যাঁচিয়ে নিয়েছে নীহারিকা। শব্দ গুলো ধীরে ধীরে বাড়ছে। চোখ দুটি খুলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বড্ড কষ্টের সাথে খুলে নীহারিকা হতভম্ব! তখনও ভোর হবে হবে। দূরের সূর্য উঠেনি। দিনের আঁধার কাঁটতে শুরু করেছে। সে এখানে কি করছে? ভাবতে ভাবতে চোখ দুটি পাশে চলে গেল।
একটি ওভার সাইজ প্যান্ট পরনে, হালকা আকাশী ঢোলা কটন শার্ট। চোখে রৌদচশমা, হাত একটি নীহারিকার মাথার পিছনে। একটি নিজের মাথার পিছনে। সে চোখের দৃষ্টি মেলে রেখেছে না কি বন্ধ নীহারিকা ধরতে পারলো না। অথচ তার মাথা গরম হচ্ছে!
‘ আমরা এখানে কি করছি? এসব কি পাগলামী বিমুগ্ধ?’
দুটি চেয়ার একত্রিত করে রাখা। সেখানে শুয়ে আছে তারা। মানুষজন নেই বললেই চলে। সকালের এই সময় সমুদ্রে আসা কখনো ঠিক নয়। প্রতিবছর অনেক মানুষ পাগলামী করতে গিয়ে মৃত্যুর শিকার হয়। বিমুগ্ধের এসবে যায় আসে না। সে আসলে ঘুমিয়ে ছিলো। চশমাটা সরিয়ে বলল,’ কেন সুন্দর তো লাগছে।’
‘ তাই বলে এভাবে ভোরবেলা সমুদ্র তীরে শুয়ে থাকবো?’
‘ থাকবো। কারণ আমরা সূর্য উঠা উপভোগ করবো।’
বিমুগ্ধের কন্ঠ ভারী কোমল। নীহারিকার ওড়না সরে গেছে। সেটি ভালো করে মাথায় দিয়ে খুব আদর আদর চোখে তাকিয়ে বলল,’ ওই যে দেখো সূর্য পৃথিবীতে চলে এসেছে। এখন এই জগৎ আলোকিত হবে। ঠিক আমার জীবনের মত।’
নীহারিকার রাগ বরফ! মুগ্ধ চোখে সূর্যের লাল কিরণ দেখলো সে।, ‘ সম্পর্কের শুরু সব সময় এমন সুন্দর হয়। তারপর যে কি হয়! ধীরে ধীরে সৌন্দর্য বিলিন হয়ে ভর করে বিরক্তি, তিক্ততা।’ বিমুগ্ধের ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিলো সে। এই সুন্দর পরিবেশে নিজস্ব পুরুষটির বাহু জড়িয়ে ধরণীর রূপ দেখতে ব্যস্ত তার চোখ।
বিমুগ্ধ চশমাটা পুনরায় পরে নিয়ে বলল,’ সম্পর্কে রাগ থাকবে, কষ্ট থাকবে, বিরক্তি থাকবে, ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, মায়া, অভিমান, নোনাজল, মাঝে মাঝে ঘৃণাও থাকবে। শুধু বিশেষ যেটি প্রয়োজন তা হলো এক সাথে থাকা। যদি এসব কিছুকে সঙ্গে নিয়েও আমরা ভালো থাকতে পারি সেটিই প্রকৃত সুখ সন্ধি। ভালোবাসা কখনো বিলিন হয় না রাগেশ্বরী। ভালোবাসার মানুষ গুলো হারিয়ে যায়। কারণ তারা শুধু ভালোবাসার সৌন্দর্য নিয়ে বাঁচতে চায়। তার কুৎসিত দিক গুলো ভুলে। তা তো সম্ভব নয়। পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস হচ্ছে মুদ্রার মত। তার দুটি করে দিক থাকে। ভালোবাসারও আছে। আমাদের শুধু ভালোবাসাকে সবরূপে গ্রহন করতে হবে। কারণ প্রকৃত ভালোবাসায় সব থাকে। চলতে চলতে দিন শেষে যা থাকে সেটি যদি হয় শান্তি তাহলেই বুঝবে তোমার ভালোবাসা সত্য, চিরন্তর সত্য!’
নীহারিকা তাকিয়ে রইলো বিমুগ্ধের দিকে। তাকে বুকে নিয়ে শুভ্র রঙ্গা সকালটায় সে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ দুটি বন্ধ। অথচ কথা বলছে। আলতো একটু ঝুঁকে খুব গোপনে চুলে হাত বুলিয়ে ফিসফিসে গলায় নীহারিকা বলল,’ বর্তমানের এই ভালোবাসা প্রচন্ড শান্তির।’
‘ তাহলে চলো দুজনে মিলে ভবিষ্যৎ প্রশান্তি করার দোয়া করি।’
নীহারিকা চমকে সরে যেতে চাইলো। বিমুগ্ধ চেপে ধরে বলল,’ চলো ঘুমিয়ে পরি। ভবিষ্যৎ নিয়ে আল্লাহ ভাববে। আমরা বর্তমান ইনজয় করি, প্রতিটি নিঃশ্বাস উপভোগ করি।’
বিমুগ্ধের বিকে মাথা ঠেকিয়ে নীহারিকা উপভোগ করছে, কাছের সমুদ্র, দূরের আকাশ, বুকের নরম শব্দ..’
…
ঝলমলে কড়া রোদ মাথায়। রোদের তেজ আজ একটু বেশি। সমুদ্র পাড়ে মানুষের হিড়িক। মিতু আপুর পাগলামী সমুদ্রের ঢেউয়ের চেয়েও বেশি ছিল। লাফঝাপ করে এক প্রকার পাগল করে দিয়েছে সকলকে। টেনে টেনে সবাইকে সমুদ্র স্নান করতে বাধ্য করেছেন তিনি। শুধু নাফিস উদ্দিনকে ভয় পান বলে তার ধারে কাছে ঘেষেনি। বিমুগ্ধকে উস্কে দিয়েছে। ফলস্বরূপ বিমুগ্ধ তার মত অতিভদ্র লোকটিকেও সমুদ্রের নোনাজল খাইয়ে ছেড়েছে। বেচারার অবস্থা মোটামুটি খারাপ। নাক জ্বলে যাচ্ছে। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলাতে না পেরে তিনি ডুবতে বসেছিলেন। নীহারিকা খুব রেগেছে বিমুগ্ধের উপরে। প্রচন্ড ক্রোধ ছিল কন্ঠে,’ আপনার জন্য বাবা মরতে মরতে বেঁচেছে। আপনার সমস্যা কি?’
একটু ভাবুক হয়ে বিমুগ্ধ চুপ করে রইল। যেন চিন্তা করে বলবে তার সমস্যা,’ ভাবছি বয়স তো হয়ে গেছে, আর বেঁচে থেকে কি হবে বলো? দেশের জনসংখ্যা কমাতে চাইছি।’
‘ ফাইজলামি করেন? এধরনের কাজ দ্বিতীয়বার করলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।’
‘ কি খারাপ হবে শুনি?’ বলেই বিমুগ্ধ তাকে নিয়ে সমুদ্রের অনেক গভীরে চলে গেছে।
ভয়ে নীহারিকার দম বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। অথচ সে দেখল তার বাবা সমুদ্রকে রোমাঞ্চিত নয়নে উপভোগ করতে করতে চিৎকার করে বলল,’ সবাই এদিকে এসো, অনেক ভালো লাগবে।’
‘ বাবা তুমি ঠিক আছ?’ দূর থেকে নীহারিকার কন্ঠ।
উচ্ছ্বাসিত গলায় তিনি বলল,‘ একদম একদম। আরে তাযিন হাত ধরে রেখেছে সমস্যা নেই।’
চোখ দুটি গভীর হলো। বাবাকে দেখতে দেখতে একবার তাকাল বিমুগ্ধের দিকে। তার চোখে ছিল মুগ্ধতা।
.
বিকেল তখনও হয়ে উঠেনি। সমুদ্র পাড়ে রাত দিন সব আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। সকলে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছে। পর পরি সবাই আবার বের হয়েছে। এবার বের হওয়ার কারণ নীহারিকা। সে স্ট্রিট মার্কেট গুলো দেখবে। তাই মিতু আপু আর ফাবিহাকে নিয়ে বের হতে চেয়ে ছিল কিন্তু তাকে দেখে সকলে দল বেঁধে বের হয়েছে। সারি সারি দোকান পাট। বিভিন্ন জিনিসে ভর্তি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস সামুক ঝিনুকের তৈরি জুয়েলারি। নীহারিকার একটি কানের দুল পছন্দ হয়েছে। সে সেটি দেখতে ব্যস্ত। মিতু আপু দৌড়ে আসল। হাত থেকে খপ করে দুলটি নিয়ে বলল,’ এটা নিশ্চয়ই আমার জন্য তাই না!’ তার চোখ দুটি খুশি।
নীহারিকা বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল,’ মোটেও না।’ হাত থেকে সেটি নিয়ে নিয়েছে সে।
‘ আরে তুই তো বাহিরে এসব পরিস না আমিই নিব এটা।’
‘ আরে অন্য গুলো দেখো আরও সুন্দর সুন্দর।’
‘ না না এটাই নিব।’ বাচ্চাদের মত আবদার করে বসল মিতু আপু। মাথা দুলাল নীহারিকা। এই মেয়ের কিছুই হবে না। সে তার ডান হাতের আয়নাটা কেড়ে নিয়ে বলল,’ তাহলে এটা আমার।’
‘ আয়না দিয়ে তুই কি করবি? এসব তো তুই পছন্দ করিস না।’ অবাক হয়ে জানতে চাইল মিতু আপু। তার জানা মতে নীহারিকা আয়না খুব কম দেখে। হেসে ফেলল নীহারিকা। পিছনে একটু ঘুরল। বিমুগ্ধ দূরের একটি ডাবের ভ্যানের সামনে ইফতি শান্তর সাথে ডাব খাচ্ছে। তবে তার দুটি স্নিগ্ধ চোখের দৃষ্টি নীহারিকার দিকে। তাকে দেখতে দেখতে নীহারিকা বলল,’ আমি আমার সোহারকে দেখব।’ ঘুরিয়ে আয়নাটি বিমুগ্ধের দিকে এমন ভাবে রাখল সূর্য
রশ্মি সেটিতে ভর করে একদম বিমুগ্ধের চোখে। হঠাৎ হওয়ায় চোখের উপরে হাত বিমুগ্ধের। নীহারিকা হেসে ফেলল শব্দ করে। কিছু সামনের দাঁত দৃশ্যমান। বিমুগ্ধ রেগে যাওয়ার অভিনয় করে বলল,’ এটা কি হলো?’
নীহারিকা তার কানের কাছে নিম্ন গলায় বলল,’ একটু প্রেম হল, একটু দৃষ্টি বিনিময় হল, একটু দুষ্টুমি হল।’
বিমুগ্ধ তার পাশে আরও একটু চেপে দাড়িয়ে বলল,’ একটু একটু তে তো কাজ হবে না রাগেশ্বরী, আমার অনেক অনেক চাই।’
‘ আমি এখন রাগ কম করছি তাই এই নামে ডাকবেন না।’ ঝিনুকের উপরে নাম লিখতে দিয়ে নীহারিকা তাকে বলল,’ নীহারিকা লিখুন।’
‘ না রাগেশ্বরী লিখবেন। আমার স্ত্রীর খুব রাগ।’
বিমুগ্ধ তাকে বলল। লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। নীহারিকা সত্যি রেগে গেছে। তার চোখ দুটি কঠিন। বিমুগ্ধ হো হো করে হেসে বলল,’ তোমাকে রাগানো খুব সহজ।’ একটু থেমে লোকটিকে টাকা দিল সে। নিজের নামেরটা দেখিয়ে বলল,’ ওই যে নীল শার্ট এটি তার। টাকা সে দিবে। এই শাহিন ভাই আপনাকে উনি ডাকছে কি জন্য যেন?’
শাহিন ভাই ছুটে আসলেন ঠিক। কিন্তু নীহারিকাকে নিয়ে বিমুগ্ধ ভেগেছে। নীহারিকা হাসতে হাসতে বলল,’ বেচারাকে মিতু আপু এমনেতেই শেষ করে দিচ্ছে, আপনি এটা না করলেও পারতেন।’
‘ এমন শালা শালি থাকলে একটু প্যারা নেওয়া উচিৎ। তা না হলে জীবনটা বোরিং হয়ে যাবে।
দোকানের ভিতরে হাঁটছে তারা। নীহারিকা এটা সেটা কিনছে। বিমুগ্ধ দেখছে তার কাজ। হঠাৎ বিমুগ্ধ কিছু মনে পরার মত করে বলল,’ আচ্ছা তোমার পাসপোর্ট করা আছে?’
‘ হ্যা একবার করা হয়েছিল। কিন্তু মেয়াদ নেই হয় তো। কেন?’ হাতের শালটি রাখল। পূর্ন মনযোগ বিমুগ্ধের দিকে।
‘ আমি চাইছি আমেরিকায় ফিরে যেতে। এখানে অনেক বছর কাঁটিয়েছি। পরিবেশ ওতটা ভালো লাগেনি আমার। বাবারা থাকবে। আমি আর আঞ্জুম ফিরে যাব।’
মুখটা থমথমে করে নীহারিকা বলল,’ ওহ।’
‘ শুধু ওহ! তোমার কাগজ পত্র দিবে ঢাকায় ফিরে। তুমিও যাচ্ছ।’ বিমুগ্ধ হালকা গোলাপী সাদার মিশ্রণে একটি শাল পছন্দ করেছে।
‘ আমি কেন যাব?’
‘ মানে কি? তুমি আমার সাথে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক।’
‘ না এটা স্বাভাবিক নয়। আমি আমার দেশে থাকব। আমার নিজের দেশে। যেখানে আমি জন্মেছি।’
‘ দেশ প্রেম! ভালো। কিন্তু সুযোগ আসলে কোন বাঙ্গালীই দেশে থাকতে চাইবে না। সেখানে আমি তো আধা আমেরিকান।’
‘ তাই তো বলছি আপনি যেতে পারেন।’ নীহারিকার দুটি চোখে তীব্র ক্ষোভ। বিমুগ্ধ সে সব দেখতে দেখতে বলল,’ কিন্তু আমি কেন আমার স্ত্রীকে রেখে যাব? সে তো আমার।’
‘ তাহলে দেশে থাকুন।’
‘ কেন?’
‘ কারণ আপনি আমার হাজবেন্ড। সব সময় আপনাদের ইচ্ছেতে সব হবে কেন? মাঝে মাঝে আমাদের ইচ্ছেতেও কিছু হওয়া উঁচিৎ।’ নীহারিকা বিমুগ্ধের শার্টের বোতাম গুলো লাগিয়ে দিচ্ছে। বিমুগ্ধ আড়চোখে দেখছে।
‘ তুমি সত্যি দেশের বাহিরে যেতে চাও না?’ বিমুগ্ধর গলায় সিরিয়াস ভাব। নীহারিকা একটু থেমে নিচে তাকাল। কথা খুঁজে বলল,’ যেতে চাই। কিন্তু ঘুরতে। সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবো কিন্তু দিন শেষে আমার দেশেই থাকব। অন্যের দেশে পরগাছার মত সম্মান বিহিন আমার থাকতে ভালো লাগবে না। যতই বট বৃক্ষ নিজেকে দেওয়ালের সাথে জুড়ে রাখুক দিন শেষে সে আগাছা। সে কখনো দেয়ালের নিজের অংশ হতে পারবে না। আর সেই জীবন কখনো সম্মানের নয় আমার চোখে।’
‘ তার মানে তুমি ঘুরতে যাবে বিদেশে?’
‘ অবশ্যয়। এই সমগ্র পৃথিবীর সৌন্দর্য না হোক একটু সৌন্দর্য তো দেখেই মরব।’
‘ ঠিক আছে আমরা সামনের মাসে সুইজারল্যান্ড যাব।’ বিমুগ্ধের মুখে হাসি। নীহারিকা বিস্মৃত গলায় বলল,’ এই না আমেরিকায় চলে যাচ্ছিলেন?’
‘ আমি তো ভেবিছি তুমি দেশের বাহিরেই যেত চাও না তাই এসব বলেছি। আমার কাছে একটি হানিমুন টিকেট আছে।’ চোখ মেরে বলল বিমুগ্ধ। নীহারিকা অবাক হয়ে তার দুষ্টুমিষ্টি হাসি দেখল কিছু সময়।
.
বিকেল প্রায় কাছাকাছি। অবসর সময় কি করবে ভাবতে ভাবতে সকলে খেলার আয়োজন করেছে। হোটেলের সামনেই খোলা বিচ। মানুষজন এই দিকে অনেক কম। বালির উপরে দুটি দল বিভক্ত হয়েছে। কাবাডি খেলা হবে। নীহারিকা বরবারই এসব থেকে দূরে। সে রেফারি হবে ঠিক করেছে। বিমুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,’ তুমি রেফারি? তার মান নিশ্চিত তোমার বাবার দল জিতে যাবে।’
‘ দেখুন আমি চিটিং করি না।’
‘ তোমাকে দেখলেই তো চিটার চিটার ফিল আসে। এই দেখ কিভাবে তাকিয়ে আছ! হ্যা হ্যা এই লুকটাই চিটারদের হয়।’
‘ আপনাকে দেখতে পাক্কা চোর মনে হয়। তাই তো আমাকে মানতে পারছেন না। চোরামি ধরব যে।’
‘ হা হা এটা খেলতে আবার চুরি করতে হয়?’ বিমুগ্ধ এমন ভাবে হাসল যেন খুব মজার কথা।
‘ বাংলাদেশিদের তো করতে হয় না কিন্তু আমেরিকার বান্দরদের করতে হবে। তারা আর যাই হোক হাডুডু খেলে না। কি বলো সবাই?’
সবাই এক যোগে চিৎকার করে বলল,’ হ্যা হ্যা।’
শান্ত প্রতিবাদ করে বলল,’ আমি কিন্তু ভালোই পারি।’
‘ তাহলে চলুন শুরু করুন।’
বিমুগ্ধের দলে শান্ত, মুহিব, ইফতি, মিতু আপু, নবীন উদ্দিন, রৌদ্রমুখি
অন্যদিকে নাফিস উদ্দিনকে ধরে বেধে নামানো হয়েছে। তিনি বেশ বিরক্ত এসে। তার দলে শাহিন ভাই, প্রিয়ম, ফাবিহা, আঞ্জুম, অর্পন, মিতু আপুর ছোট ভাই।
নীহারিকা এবং দাদামশাই রেফারি। নীহারিকা ফিসফিস করে বলল,’ তুমি কার দলে?’
‘ আমি নিরপেক্ষ। দুই দলেই আমার ছেলে আছে।’ গম্ভীর হয়ে বললেন তিনি। নীহারিকা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,’ কিন্তু জিতবে তো একদল।’
‘ সেটা অবশ্যয় খেলার উপরে নির্ভর করে।’
খেলা শুরু হতে হতেই বাদ পরেছে ফাবিহা। তারপর থেকে খেলা দম নেওয়া দেওয়ার মত অবস্থায় নেই। সবাই হামলে পরেছে। কোন সময় যে নিজেদের বয়স ভুলে নাফিস উদ্দিন এবং তার ভাই এই খেলার প্রান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে কেউ বুঝতেই পারল না। সকলে হই হই করে উঠেছে। বিমুগ্ধ যে এতো ভালো খেলতে পারে নীহারিকা ভাবতেও পারেনি। সে হা করে শুধু তার দৌড় দেখল। এক বারে সে ফাবিহা, আঞ্জুম, মিতু আপুর ছোট ভাইকে আউট করে ফেলেছে। নীহারিকা আউট দিতে দিতে বলল,’ আপনি তো একটা দানব।’
বিমুগ্ধ হো হো করে হাসল ডাকাতের মত,’ পরের বার তোমার বাবা যাবে মাই ডিয়ার ওয়াইফি।’
নীহারিকার চোখ তীক্ষ্ন হয়ে আসল। সত্যি সত্যি সে নাফিস উদ্দিন সহ সকলকে আউট করে ছেড়েছে। নীহারিকা এটা দেখে খুব ক্ষিপ্ত। খুব দ্রুত খেলা শেষ হওয়ায় সবাই ফুটবল খেলায় নেমেছে। নাফিস উদ্দিন হঠাৎ করে যৌবনে পৌছে গেছেন। তিনিও খেলায় অংশ নিলেন। এবারেও দুটি দলে বিভক্ত । রেফারি নীহারিকা এবার ভয়াবহ কাজ করেছে। বিমুগ্ধের পর পর দুটি গোলকে সে ফাউল ঘোষণা করে নাফিস উদ্দিনের টিমকে জিতিয়ে দিয়েছে। এতে বিমুগ্ধ যে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হবে স্বাভাবিক। পা দুলিয়ে সে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। বিমুগ্ধ তেড়ে এসে বলল,’ এটা তুমি ইচ্ছে করে করেছ তাই না? আমি জানতাম তুমি চিটার।’
‘ ও হো হো দাড়ান চিটারের কি আছে ফুটবল খেলা দেখেননি কখনো, বিপক্ষ দলের আগে গোল এরিয়ায় ঢুকে গোল দিলে সেটি ফাউল হয়। আর্জেন্টিনার কত গোল যে এভাবে ফাউল হয়েছে হুহ।’
‘ ওহ রেইলি? কিন্তু আমার জানা মতে এটি ব্রাজিলের সাথে হয় সব সময়।’
‘ ওহ মাই গড আপনি ব্রাজিল? ওই দাদা নানাদের সম্পদ খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে যারা ওদের দলে?’ নীহারিকা এবার প্রান খুলে হাসতে শুরু করেছে। বিমুগ্ধের চোখ দুটি ছোট হয়ে আসল। মুখ হয়ে উঠল রক্তিম। খেলায় ঘেমে নেয়ে শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।
‘ আমাদের দাদা নানারা এতই বড়লোক যে আমাদের কিছু করতেই হয় না। আমাদের সাথে এসে দাড়ানোরও কারো যোগ্যতা হয়নি। আগে কাছাকাছি তো আসো।’
নীহারিকা হঠাৎ বিমুগ্ধের শরীরে সাথে লেগে দাড়িয়ে বলল,’ এই যে খুব কাছে। এবার বলুন দাদা নানাকে নিয়ে আর কতদিন চলবে? আমরা তো তাও নিজেরাই কিছু করছি। আপনারা কবে করবেন?’
বিমুগ্ধ ঠান্ডো হলো। নীহারিকা তার খুব কাছে। এই নারী তার রাগের সকল উত্তেজনাকে আয়ত্বে নিয়ে নিতে পারে। শান্ত হয়ে আসছে ধিরে ধিরে তার হেরে যাওয়া মুখটি। সে একটু নরম গলায় বলল,’ করব করব। আগে দাদানানাদের গুলো শেষ তো হোক। তারাই এত কামিয়েছে যে তোমাদের মত প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসেও সে সবের কাছেও যেতে পারছ না। এক মেসি দিয়ে তোমরা কত দূর যেতে পারবে দেখব।’
‘ আমাদের সবাই একএকজন মেসি। তাকে নিয়ে কোন তর্কবিতর্ক হবে না।’
‘ মেসি তোমার পছন্দের?’ বিমুগ্ধ চোখ দুটি নেমে এসেছে নীহারিকার মুখে। চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে সে আবার বলল,’ এটা যেন না হয়। আমি ছাড়া পৃথিবীর কোন পুরুষ তোমার এতো পছন্দের হতে পারে না যা নিয়ে তর্ক করা যাবে না।’
‘ কিন্তু সে তো সত্যি আমার পছন্দের।’ নীহারিকার ঠোঁটে জ্বালাময়ি হাসি। বিমুগ্ধ তাকে একপ্রকার চেপে ধরে বলল,’ এখন থেকে আর পছন্দ করতে পারবে না।’
তারা অনেকটা সমুদ্রের কাছে। নীহারিকা বিমুগ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনার চেয়ে বেশি পছন্দের না।’
‘ পছন্দোই হতে পারবে না। তোমার সকল পছন্দ, ভালো লাগা, ভালোবাসা, সকল প্রকার অনুভূতি শুধু আমি হতে চাই।’ গলাটা ঘোলা হয়ে আসছে। গভীর হয়ে আসছে শব্দ গুচ্ছ। নীহারিকা সেই চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। তারা খোলা বাতাসের দোল খেয়ে হাঁটছে। দুজনের হাত একুই রেখায় মিলিত। দূর থেকে নাফিস উদ্দিন দেখছে বিমুগ্ধ তার মেয়ের পায়ের জুতো জোড়া হাতে নিয়ে তাকে উপভোগ করাচ্ছে খালি পায়ে বালির উপরে দাড়িয়ে থাকার আনন্দ। উপভোগ করাচ্ছে সমুদ্রের তীরে সঙ্গীর হাতে হাত রেখে হাঁটা, নেচে ঘুরে বেরান। নীহারিকার ঠোঁটের সেই হাসি সেই স্নিগ্ধতা তার হৃদয় শীতল করে তুলল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ ভবিষ্যৎ তো জানি না কিন্তু বর্তমানে তাযিন আমার মেয়ের জন্য আমার চেয়েও বেশি নিরাপদ, বেশি চিন্তাশীল, বেশি যত্নবান, বেশি ভালোবাসাময় পুরুষ।’
আফিয়া স্বামীর হাতের উপরে হাত রেখে বলল,’ আপনি আমার চোখে সবার উপরে।’
হাত ঘুরিয়ে নৃত্যে মত্ত। সূর্য তখন ঢুলে পড়েছে। মানুষজনের উচ্ছ্বাস। বিমুগ্ধ জানতে চাইল,’ তুমি কখন আমার প্রেমে পড়েছ নীহারিকা।’
চোখ বন্ধ করে নীহারিকা বলল,’ সেটা বলা খুব প্রয়োজন?’
‘ না। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে। মানুষ কৌতুহল প্রিয়।’
‘ বৃষ্টিতে ভিঁজতে থাকা আপনার প্রেমে পড়েছিলাম।’ নীহারিকা কোমল গলায় বলল। বিমুগ্ধ ভ্রু জোড়া বেঁকেছে,’ কবে? কিছুদিন আগে? না কি কিছু মাস আগে?’
নীহারিকা বিমুগ্ধের বুকে হাত রেখে বলল,’ কিছু বছর আগে। যখন প্রথম আপনাকে বৃষ্টির সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে দেখেছি অনুভব করেছি এই জগতের সবচেয়ে সুন্দর বিষয় কারো ভিতরের সত্ত্বার প্রেমে পড়া।’ নীহারিকর চোখে রহস্য। বিমুগ্ধ আর সে এখন সমুদ্রের দিকে ফিরে আছে। চোখ দুটি বন্ধ। বিমুগ্ধ মাতাল সুরে বলল,’ তুমি খুব রহস্যময়ী।’
‘ জগতের সকল নারীই রহস্যময়ী। কারণ সকলের হৃদয়ে কোন না কোন কথা গোপনে বৃদ্ধিপায় বয়সের সাথে। ঠিক যেমন আমার হৃদয়ের প্রেম ভালোবাসা শুধু আমার হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে গোপনে।’
‘ ভালোবাসাকে তুমি কিভাবে ব্যাখ্যা কর?’ বিমুগ্ধ তার দিকে ফিরেছে। এলোমেলো বেরিয়ে আসা চুল গুলো মুখ থেকে সরিয়ে দিচ্ছে সে। নীহারিকা দূর থেকে বলছে এমন গলায় বলল,’ আগে ভালোবাসা অন্যরকম ছিল। মনে হত গোপনেই সুন্দর। কিন্তু যখন থেকে বিয়ে নামক বন্ধন আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে আমার মনে হচ্ছে এই জগতে আপনার চেয়ে বেশি ভালো কাউকে বাসা সম্ভব নয়। আমার সবকিছু কেমন মোহ আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে আপনার মাঝে। এই ভালোবাসাটা ভিন্ন। একদম আলাদা।’ তার দুটি গালে লজ্জা নেই। আছে প্রেমের উষ্ণতা। বিমুগ্ধ তাদের নিজের হাতের আজলে বন্দি করে বলল,’ হ্যা এই ভালোবাসা ধরিত্রীর সবচেয়ে আলাদা। ভালোবাসারও ভাগ হয়। সময়ে সময়ে রূপ পরিবর্তন করে। তাদেরও সত্ত্বা আছে। সেই সত্ত্বায় ভর করে তারা মানুষের মনকে এক এক সময় এক এক রকমে রূপ দেয়। তার সবচেয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর রূপ সে বিয়ে নামক বন্ধনে জড়িয়ে পরার পরে সামনে নিয়ে আসে। আমাদের এই ভালোবাসার যাত্র মাত্র শুরু।’
নীহারিকা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখল বিমুগ্ধকে। তার হঠাৎ করে মনে হচ্ছে বিমুগ্ধ অত্যন্ত সুন্দর। এই জগতের সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ। পিছন ফিরে সে নিজের পরিবারকে চিৎকার করে বলল,’ সকলে ছুটে আসো ছবি তুলব সূর্যের সাথে।’
দৌড়ে দৌড়ে আসতে শুরু করেছে সবাই। ক্যামেরা ম্যান ঠিক করা হয়েছে। রৌদ্রমূখী বলল,’ আমি ছবি তুলে দিব।’
‘ না। তুমি আমাদের সাথে দাড়াবে।’ আফিয়া একটু গম্ভীর হয়ে বলল। সে আনন্দে আত্তহারা হয়ে আঞ্জুমের সাথে দাড়াল। তাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। আঞ্জুম অবশ্য
তার বড়। ফ্রেন্ডশীপে বড় ছোট হয় না।
নীহারিকা তাকিয়ে দেখল সকলকে। দেখল তার পরিবারকে। সকলে আনন্দ করছে। উল্লাস করছে। দেখল তার বাবাকে। যে তার ভাইয়ের সাথে গম্ভীর হয়ে কথা বলছে। সবকিছুকে ছাপিয়ে সে দেখল তার দাদামশাই খুব খুশি। তার দুটি চোখ জ্লজল করছে। জীবন আসলে কি? জীবন আসলে অল্প সময়ের ছোট গল্প। এই গল্পে দুঃখ থাকবে সুখ থাকবে, আনন্দ থাকবে বেদনা থাকবে। যদি সারাজনম সুখে যায় তাও জীবন নয় যদি সারাজনম দুঃখে যায় তাও জীবন নয়। জীবন মানে হাসি কান্না আনন্দ বেদনা। সবকিছুকে ছাপিয়ে নীহারিকা তার জীবনের মানে বের করেছে। পরিবারের সকল মানুষের সাথে দুই একটি সুন্দর সময় উপভোগ করার মাঝে যেই সুখ, যেই আনন্দ, যেই ভালোবাসায় ডুবে থাকা যায় সেটিই প্রকৃত প্রিয় সুখ। এই সুখ স্মৃতির পাতায় আজীবন বন্দি থাকে। ঠিক লাফিয়ে উঠে সূর্যের সাথে তোলা ছবির মত। যেখানে দেখা যাচ্ছে দুটি ছেলে তাদের বয়স্ক বাবাকে ধরে রেখেছে। বোনেরা জড়িয়ে রেখেছে বোনদের। কাজিনরা হাসছে প্রান খুলে। আর আর ভালোবাসার মানুষদের হাত ভালোবাসার মানুষের হাতে বন্দি। দিনশেষে এই স্মৃতিই প্রিয় সুখ। যে সুখ ক্রয়করা যায় না অর্জন করে নিতে হয়। যেই সুখ সকল সুখকে ছাপিয়ে স্মৃতির পাতায় জমা থাকে। জীবন কি এখানেই আনন্দ ঘন মুহূর্তে শেষ? না। বড্ড দুঃখের সময়ও আসবে জীবনে। কিন্তু তখন তাদের স্মৃতির পাতায় উঠে আসবে এসব দৃশ্য। এটিই প্রিয় সুখ। সকল সুখের ঊর্ধ্বে প্রিয়দের নিয়ে কাটানো প্রিয় সুখ।
বিমুগ্ধ নেশাজড়ানো চোখে তার প্রিয় নারীকে দেখতে দেখতে বলল,’ তুমি কি জান তুমি আমার জীবনের প্রিয় সুখ। যাকে আমার যখন মনে পড়বে দেখতে পারব, পড়তে পারব, ভালোবাসতে পারব। তুমি সমস্তটাই আমার জীবনের স্মৃতির মত প্রিয় সুখ। যা আমি আর্জন করেছি। যা সৃষ্টিকর্তা দান করেছে। যে প্রিয় সুখে সন্ধান মানুষ কখনো কখনো পাবে সেই প্রিয় সুখকে আমি নিজের জীবনে জড়িয়ে জীবনকে প্রিয় সুখে ভর্তি করেছি রাগেশ্বরী। এই সুখ আমার!’ নীহারিকার দুটি হাতে সে চুমু খেয়েছে। সেই দৃশ্যটি পরিবারের সাথে ছবি বন্দি হয়েছে। প্রিয় সুখদেরও মাঝে মাঝে বন্দি করা যায় আলেখ্যে।
..
সমাপ্ত।