#সংসার
পর্ব ২
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
আবারও সেই একই ঘটনা। তিতির আসিফকে একটা ঘটনা বলতে যাচ্ছিলো, দুই লাইন বলতে না বলতেই আসিফ ছেলেমেয়েদের সাথে অন্য কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তিতির গম্ভীর হয়ে গেলো। বিয়ের এতো বছর হয়ে গেলো, আসিফের এই বদ অভ্যাসের পরিবর্তন হলো না। কথার মাঝখানে কথা। মাঝখানেও ঠিক না,কথার শুরুতেই কথা। বাধ্য হয়ে তিতিরের থেমে যাওয়া। আসিফকে অনেক বুঝিয়েছে তিতির, লাভ হয়নি। এক সময়ের অতি ছটফটে, চঞ্চল, অনেকটা বাচাল ই, অল্পে হাসা অল্পে কাঁদা মেয়েটা এখন চুপচাপ, কিছুটা উদাস। সেই চাপল্য, সেই প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেলো!
বিয়ের প্রথম হতেই সে বুঝে ফেলেছিলো, তার অতি কথা আসিফ পছন্দ করেনা। এটা নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করে। অথচ তিতিরের খুব গল্প করতে ইচ্ছা করতো।। কিন্তু আসিফের চাপা বিরক্তি, উদাসীনতায় আস্তে আস্তে তিতির চুপচাপ হয়ে গেলো। ভালো হয়েছে, বাচালতা তো ভালো জিনিস নয়। আসিফ কিন্তু সমানে বকবক করে তিতিরের কাছে। বেশির ভাগ জায়গায় সে শান্ত,চুপচাপ, গম্ভীর। ব্যাতিক্রম শুধু তিতিরের কাছে। ব্যক্তিত্ববান স্বামীই চেয়েছিলো তিতির, চটুল কোনো ব্যক্তি নয়। কিন্তু যতোদিন গেছে, তিতির ততো বুঝেছে, আসিফের মধ্যে ব্যক্তিত্ব বলে তেমন কিছু নেই। তিতিরের সাথে তার গল্প মানে নিজের প্রশংসা, কোন্ মেয়ের চরিত্র সুবিধার না, কোন্ ডাক্তারের সাথে কোন্ নার্সের মাখামাখি ইত্যাদি।
বিয়ে নিয়ে তিতিরের খুব সুন্দর স্বপ্ন ছিলো। বোকা মেয়েটা। তার স্বপ্ন ছিলো,স্বামী প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন হবে। শ্বশুরবাড়ির সদস্যরাও। ওদের সাথে খুব মিলেমিশে থাকবে তিতির। খুব ভালোবাসবে। তিতিরকেও ওরা চোখে হারাবে। হারাবে না কেন? তিতির সবাইকে আন্তরিক ভাবে ভালোবাসতে পারে, কারোর ভুল ত্রুটি সহজে তার চোখে পড়ে না, মানুষের সাথে তার মেলামেশায় আন্তরিকতার কোনো অভাব থাকেনা। সে মিষ্টভাষী। তাকে ভালো না বাসার কি আছে?
বাস্তব সে রকম হলো না। তিতিরের বিয়ের সময় প্রচুর গ্যাঞ্জাম হলো ছেলেপক্ষের কারণে। আসিফরা অনেক ভাইবোন। তাদের কয়েকজনের মিথ্যাচারে আর গোলমাল বাধানোর আজন্ম স্বভাবে অনেক কিছু জটিল হয়ে গেলো। তিতির শ্বশুর বাড়িতে যেয়ে দিশাহারা হয়ে গেলো। সে যে পরিবেশে বড় হয়েছে,তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র এখানে। অবশ্য একেক পরিবার একেক রকম হবে,এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে এতোটা বৈপরিত্য! চিন্তা ভাবনা,আচার আচরণ সবকিছুতেই। তিতিরের শ্বশুর যদি রিকশাচালক হতেন, তবু তিতির তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সবাইকে মাথায় তুলে রাখতো যদি তাঁদের আচার ব্যবহার স্বাভাবিক সুন্দর হতো। তিতিরের মায়ের নামে মিথ্যা দোষারোপ তার মনে গভীর আঘাত হানলো। নিশাত নাকি গায়ে হলুদে খারাপ ব্যবহার করেছেন তিতিরের ননদদের সাথে। খাবার দেওয়া হয়নি ঠিকমতো। পরে অবশ্য ভিডিওতে সব মিথ্যা ধরা পড়ে যায়। তিতির তবু সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চায়, সবাইকে সম্মান করে,আদর যত্ন করে। এটাও বুঝতে পারে, তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। শুধু ভঙ্গ হয়নি,চুরমার হয়ে গেছে। তিতির সুন্দর নয়,আসিফ হ্যান্ডসাম। বহুদিন যাবৎ তিতিরকে শুনতে হয়েছে , ” আপনার বাপ একটা জামাই পাইছে বটে। অল স্কোয়্যার। লাখে এমন ছেলে পাওয়া যায় না। আপনার বাপ ভালো লাভ করছে।” এ কি অদ্ভুত কথা। তিতির সুন্দর অসুন্দর কোনোটাই নয়, আসিফ হ্যান্ডসাম, তাই বলে কি এমন করে কথা বলতে হবে? এটা তো প্রেমের বিয়ে নয়।তোমরা বারবার দেখেশুনে তারপরে ছেলেকে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছো। অসুন্দর মেয়েকে নিলে কেন? কেউ জবরদস্তি করেনি। মেয়ে হবু চিকিৎসক আর মেয়ের বাপ অনেক বড় অফিসার বলে? সদ্য বিবাহিতার সামনে তার রূপ নিয়ে কটু কথা বলা হলো। তিতির নাকি বেঁটে। তাই এনগেজমেন্টের আগ মুহূর্তে বোন যেয়ে ভাইয়ের কানে কানে বলেছে,”আংটি পরাবি কিনা দেখ্। মেয়েতো বাঁইট্টা। ” দেবর এই তথ্য দিয়েছে ভাবিকে। শাশুড়ি কথায় কথায় বৌকে বেঁটে বলতেন।একদিন বলে বসলেন,”তোমার চেহারা আমার ভালো লাগে না।” তিতির নীরব রইলো। কি বলার আছে তার? বৌকে চুপচাপ দেখে শাশুড়ি আবার মুখ খুলেন, “তোমার আম্মার চেহারাও আমার ভালো লাগে না। তোমার আব্বার চেহারা অবশ্য ভালো।” তিতির হতবাক। তার চোখে জীবনে কাউকে অসুন্দর লাগেনি আর আজকে নিজের মা সম্পর্কে এই কথা শুনতে হচ্ছে। সে শাশুড়িকে বললো,”আমার মা’কে সবাই খুব সুন্দর বলে। বাবার চাকরির সূত্রে আমরা যখন যেখানে গিয়েছি, সবাই বলতো,এমনকি বাচ্চাদের দলও বলতো, মা-চাচীদের মধ্যে আমার মা সবচেয়ে সুন্দর। ”
“কি জানি! আমার ভাল্লাগে না।”
উনার ভালো লাগতো উনার নিজের আর পুত্র কন্যাদের চেহারা।
বৌ বাঁইট্টা, সুন্দর না, চুল নাই,দাঁত সুন্দর না, রান্নাবান্না কাজকর্ম পারে না।
স্বয়ং আসিফ গল্পচ্ছলে বলতো তিতিরকে,” তোমাকে দেখার পর দুলাভাই বলেছেন,এই মেয়েকে বিয়ে করবে কি? মেয়ের মাথার অর্ধেকতো ফাঁকা, চুল নাই। ” কিংবা, “ভাগ্নিজামাই বলেছিলো, মামা, প্লিজ, আগেই এখানে হ্যাঁ বলেন না, আমি আর একজন মাত্র মেয়ে দেখাবো, তাকে পছন্দ না হলে তখন এখানে হ্যাঁ বলেন। ”
সদ্য বিয়ে হওয়া, বাবা-মা-ভাই-বোনের পরম আদরের এক মায়াবতী তরুণী বিয়ের পর হতে শুধু এগুলোই শুনে যাচ্ছিলো। আসিফের কোন্ স্যার নিজের মেয়ের জন্য মনে মনে আসিফকে নির্বাচন করেছিলেন,কোন্ ব্যবসায়ী আসিফকে ব্ল্যাংক চেক দিতে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়েকে বিয়ে করার জন্য, এসব শুনতে শুনতে কান-মন ঝালাপালা।
জীবনে বড় ছন্দপতন হয়েছিলো তিতিরের। ভেতরটা এলোমেলো, ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল। থাকতো সে হোষ্টেলে। সুযোগ পেলে বাপের বাড়ি ঢাকায় চলে যেতো।শ্বশুরবাড়ি তার কাছে বড় আতংকময় ছিলো।
খুব জটিল আসিফ আর তার পরিবার। এবং বেশির ভাগই মিথ্যাবাদী। মিথ্যাকে ওরা মিথ্যা মনে করে কিনা এটা নিয়েই তিতিরের সন্দেহ আছে।
তবে আসিফের কাছে তিতির কৃতজ্ঞ, বাবা-মা-ভাই -বোনদের হাতে সে স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়নি। তাঁরা উল্টাপাল্টা কাজ করলে বা কথা বললে আসিফ ভদ্র ভাবে সরাসরি প্রতিবাদ করেছে। নিজের বাড়ির লোকজনের ঝালমশলা মাখা ব্যবহার ও কথা থেকে তিতিরকে আড়াল করেছে।
টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। সময়ের সাথে সাথে তিতির নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে আসিফের সাথে সুখে দুঃখে সংসার করতে লাগলো। আসিফের ভালো গুণ বেশি ছিলো। মানুষের স্বভাবের পরিবর্তন হয়। যে কারণেই হোক,তিতিরের শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে। শ্বশুর শাশুড়িরও হয়েছিলো। তিতির বরং মনে মনে নিজেকে দোষ দেয়, সে যদি আরেকটু সহিষ্ণু, আরেকটু বুঝদার হতো। সে যদি শান্তভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো, তার ব্যক্তিত্ব যদি দৃঢ় হতো, তাহলেতো কেউ তাকে ঘাঁটানোর সাহস পেতো না। মাঝে সাঝে শ্বশুর শাশুড়ি মায়াও করেছেন খুব, তিতির যদি তাঁদের আরও সেবা যত্ন করতো,তাঁদেরকে নিজের কাছেই রেখে দিতো! নিঃস্বার্থ ভাবে সেটা চেয়েছিলও তিতির, কিন্তু গ্রামের বাড়ি ছেড়ে উনারা ঢাকা শহরে থাকতে চান নি। আর মরে গেলেও তিতির গ্রামের বাড়ি যেয়ে বাস করতো না। শ্বশুর বাড়ি তার কাছে আতংককর ছিলো, সে একজন চিকিৎসক ছিলো, তার চাকরি বাকরির দরকার ছিলো, সে সন্তানের মা হয়েছিল , বাচ্চার পরিচর্যার জন্য সে ও আসিফ সম্পূর্ণ ভাবে নিশাত ও নাজমুল সাহেবের উপরে নির্ভরশীল ছিলো। আসিফের বাবা-মা নাতিকে ভালোবাসতেন কিন্তু তাকে দেখেশুনে রাখার ইচ্ছা বা শক্তি তাঁদের ছিলোনা। আরিয়ান নানা-নানি -মামা-খালার আদরে বড় হতে থাকলো।আসিফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হওয়ার জন্য লড়াই করছিলো, তিতির একটা ক্লিনিকে চাকরি করে অল্প কিছু কামাই করছিলো। আরিয়ানের দুধ কেনার সামর্থ্য তাদের ছিলো না।আসিফের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের শেষ পর্যায়ে জন্ম নিলো জমজ কন্যা রাজেশ্বরী আর লুম্বিনী। সবশেষে আরহাম। ডাক্তারি আর চার সন্তানকে নিয়ে ভালোই কেটে যায় তিতিরের দিনগুলো। আসিফের সাথে তার সম্পর্ক ভালো বা মন্দ কিছুই না। গতানুগতিক, হয়তো আর দশটা দম্পতির মতো। রূপকথার রাজ্য থেকে অনেক আগেই বের হয়ে এসেছে তিতির।
চলবে।