সংসার পর্ব-০৩

0
27

#সংসার
পর্ব ৩
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

তিতলী বিরক্তি মেশানো ব্যাকুল গলায় বললো,”মা, আল্লাহর ওয়াস্তে এবারে ক্ষ্যান্ত দাও। আমরা খেতে আসিনি। তোমাদের দেখতে এসেছি,গল্প করতে এসেছি।”

“দাঁড়া বাবা,এইতো হয়ে গেছে। ”

“এইতো হয়ে গেছে এই কথাটা হাজার বার শুনে ফেলেছি এরমধ্যে। এজন্য আসতে ইচ্ছা করেনা তোমাদের বাড়িতে। আপাও শুধু এ কারণেই আসতে চায়না।”

“আসিস যেন কতো! বাপের কাছে যেয়ে বস,আমি আসছি।”

তিতলী বিরক্ত মুখে বাবা-মায়ের শোয়ার ঘরে এসে বসলো। নাজমুল সাহেব ঝলমল করছেন ছোট মেয়েকে দেখে। তিতলী বাবার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। বাড়ির ছোট জামাই সাহেব আদনান ড্রইং রুমে বসে মোবাইল টিপছে। তিতলীর ছেলে অরণ্য আর মেয়ে অরণী লেগো নিয়ে বসে গেছে। একটার বয়স সাত, আরেকটা চার। ছুটির বিকেল।নোমান গেছে দাড়ি কামাতে। ছোট বোন আসবে সে জানে। দুপুর বারোটা থেকে “দাড়ি কাটতে যাচ্ছি, দাড়ি কাটতে যাচ্ছি ” বলে সেলুনের উদ্দেশ্যে শেষ পর্যন্ত বের হয়েছে বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। তিতলীরা আসার একটু আগে। তমা তার ঘরে ল্যাপটপে কাজ করছে। এক মিনিটের জন্য বের হয়ে ননদ -নন্দাইকে বললো,”কেমন আছো?” অরণ্য আর অরণীর চুল ঘেঁটে আদর করলো। তারপরে আবার নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। বড় ভাইপো গেছে এক বন্ধুর বাসায় পার্টিতে, আসতে রাত আটটা -নয়টা বাজবে। ছোট ভাইপো অরণ্য আর অরণীর সাথে খেলায় মেতে উঠেছে।

নিশাত ঘর্মাক্ত শরীরে বেডরুমে ঢুকলেন। মুখে চওড়া হাসি। ছোট মেয়েকে দেখার আনন্দে।

“ডাইনিং টেবিলে চল্। নাস্তাটা আগে খেয়ে নে।”

“একটু আগে ভাত খেয়েছি। পেটে এখন জায়গা নেই। ”

” সন্ধ্যা হয়ে আসছে, কখন খাবি তাহলে? দেরি করে খেলেতো রাতের খাবারেও দেরি হয়ে যাবে।”

“খাওয়া,খাওয়া,খাওয়া। আমি আর আপা কি খেতে আসি? আসি তোমাদের সাথে কিছুক্ষণ থাকার আশায়। তা না, চোখের সামনে দেখতে হয়, অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের খাবারের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছো। খুবই পেইনফুল। ”

“আরে, শুধু তোদের জন্য নাকি? আমরাও তো খাবো।”

“কি নাস্তা? ”

“কাবাব বানালাম কয়েকটা, আদনান কাবাব ভালোবাসে। নুডুলস, কাস্টার্ড, অরণী বুড়ির জন্য পুডিং। ”

“বাড়িতে তিন তিনজন কর্মচারী থাকতে তুমি করলে কেন? ওদের কাজ কি?”

“ওরাই করে, কিন্তু একটু দেখতে হয়। ঝাল-লবণ বা চিনির আন্দাজ জ্ঞান বেচারাদের কম। ”

” কাপ পিরিচ, প্লেট গ্লাস,রাতে খাওয়ার প্লেট সব দেখি সোকেস থেকে তুমি নামালে।এগুলোও ওরা পারে না? ”

“বলে রেখেছিলাম। ওদের মনে নেই। এতো মনে করিয়ে দেওয়ার চেয়ে নিজে করে ফেলাই ভালো।”

নাজমুল সাহেব মুখ খুললেন,” এরা হলো উজবুক। সেদিন মেহমানের জন্য চায়ের কাপ বের করেছে এক সেটের, পিরিচ আরেক সেটের। বোঝো অবস্থা। ”

তিতলী কঠিন গলায় বললো,”এমন হলে বিদায় করে দাও। এমনতো না এরা ছোট মানুষ। এমনওনা যে কাজের খুব চাপ। কাজে ফাঁকি দিবে, বেতনতো কম নেয়না। বাবুর্চি নাম নিয়ে নয় দশ হাজারে ঢুকে, তারপর দেখা যায় রান্না কিছুই পারেনা। মা, তোমার অপারেশন হয়েছে দুই মাস। মেজর অপারেশন। অথচ সারাক্ষণ দৌড়ের উপর থাকো।”

“দৌড়ের উপর থাকলেই শরীর ঠিক থাকে। কথা বাড়াস না।জামাই একা বসে আছে।”

তিতলী এবারে জ্বলে উঠলো,” জামাই একা বসে আছে কেন? নতুন জামাই? এসে পর্যন্ত মোবাইল টিপছে। অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ি, নিজ থেকে এসে কথা বলবে না? তাদের বাড়িতে ঝি খাটলাম কতো বছর! এক বছর হলো আলাদা হলাম। তো ওর বাবার বাড়িতে যেয়ে কি আমি ড্রইং রুমের এক কোণায় বসে থাকি? ঠিকইতো তার বাবা-মায়ের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে তাঁদের কি লাগবে না লাগবে তার তত্ত্ব তালাশ নিই। ও সেটা পারেনা? ”

নিশাত হালকা ধমক দিয়ে বললেন,” বেশি ফড়ফড় করিসনা তো তিতলী। কে কি করলো, তাতে আমাদের কি? আমরা আমাদের কর্তব্য করবো। তাছাড়া জামাই মানুষ, চট করে ভেতরে ঢুকতে লজ্জা পায়। চল্। তুমিও ওঠো।”

নাজমুল সাহেব আনন্দিত মুখে উঠলেন। মেয়ের সাথে নাস্তা খাবেন। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিলো, মানে তাদের বিয়ে শাদির আগ পর্যন্ত, ট্যুর বা অফিসে বেশি কাজ না থাকলে পাঁচজন একসাথে সন্ধ্যার নাস্তা করতেন,রাতের খাবার খেতেন। তুমুল গল্প আড্ডা হাসাহাসি হতো। নাজমুল সাহেব টেবিলের এক মাথায়, তাঁর বামে নিশাত, ডানে তিতলী,তিতলীর পাশে তিতির, টেবিলের অপর মাথায় নোমান। আহা! কি মধুর ছিলো দিনগুলো।

আদনান খুবই সপ্রতিভ, শ্বশুর শাশুড়িকে খুবই মান্যগণ্য করে কথা বলে। তবে নিশাত এখন বুঝে গেছেন, হাতেগোণা কয়েকজন অতি আপনজন ছাড়া কেউ কাউকে ভালোবাসে না। তাঁরা নিজেদের বাড়িতে থাকেন,ছেলেমেয়ে কারোর ওপর নির্ভরশীল না বরং এখনো নানাভাবে ছেলেমেয়ে, জামাই বউ সবার কাজে লাগেন, তাতেই কারো কারো চেনা চেহারা অচেনা লাগে। আর যাঁদের থাকতে হয় ছেলে বা মেয়ের বাড়িতে, তাঁদের বেশির ভাগের কি অবস্থা হয় ভাবলেও শিউরে ওঠেন তিনি।

তিতলী তার ভাবীর দরজায় টোকা দিলো,”ভাবী,নাস্তা খাবে,এসো।”

“আমি ফ্রুট সালাদ খেয়ে নিয়েছি, তুমি খেতে বসো।”

নাজমুল -নিশাত দু’জনেই সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তাঁদের দুটি কন্যা কতোদিন পরপর বাপ-মায়ের বাড়ি আসে একটু শান্তির আশায়, প্রিয়জনদের সাহচর্যের আশায়। কিন্তু তমা তার ঘর থেকে বের হয়না বললেই চলে। সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিস, সকাল থেকে রাত। বেশির ভাগ রাতেই নানা প্রোগ্রাম থাকে। দুই দিন ছুটি, তমা সাধারণত বাইরে বাইরে ছুটি কাটায়। আজকেও বের হবে একটু পরে, কোন কলিগের মেয়ের বার্থডে পার্টি। নোমান সেই যে দাড়ি কাটতে গেছে, এখনো ফেরার নাম নেই। অথচ সে জানে, বোন আসবে,ভগ্নিপতি আসবে। এটাও জানে,আপ্যায়নটা অসুস্থ মা’কে করতে হবে। যে সাহায্যকারীরা আছে, তাদের পেছনে লেগে না থাকলে হযবরল হবে। তাও ভালো,নাজমুল সাহেবের অসুস্থতাটা সবাই বুঝে। কিন্তু নিশাতেরও যে সমানুপাতিক হারে বয়স বাড়ছে, শরীর ও মন একটু বিশ্রাম চাচ্ছে, এটা সবাই বুঝেও বোঝে না।

বিয়ের পর হতে তমাকে কেউ কোনো কাজ করার কথা বলেনি। নিশাত কখনো ভাবেনই নি যে ছেলের বৌকে দিয়ে সংসারের কাজ করাবেন। তমা আসার আগে সংসার চলে নি? বৌকে নিজেদের দুই মেয়ের থেকেও অনেক বেশি আহলাদ দিতেন নিশাত। তমার আচার ব্যবহারও তখন স্বাভাবিক ছিলো। তারপর মোটামুটি দ্রুত ই নানারকম পরিবর্তন।

তমা যখন ননদদের বাসায় যায়,তখন তার প্রতি ননদদের আদর-যত্ন-সম্মান দেখে না? তাহলে ননদরা বেড়াতে এলে নিজেকে ঘরবন্দী রাখার মানে কি? অবশ্য তমা বহু বছর ধরেই সম্পূর্ণ নিজ মর্জিমতো চলে। চলুক, তবে একজন মানুষ যখন কোনো পরিবারের অংশ হয়, তখন পরস্পরের সুবিধা অসুবিধা খেয়াল করাও একটা বড় কর্তব্য।

নোমান আসলো। সাথে বোনের সম্মানে নতুন ধরণের একরকম খাবার, দুই ছেলে ও ভাগনে ভাগনিদের পছন্দের চিপস্,চকোলেট আরও টুকটাক জিনিস।

নোমানও ঢুকলো, তমাও বের হলো শাড়ি পরে সাজগোজ করে। তিতলী বললো,”কোথায় যাও ভাবী?”

“দাওয়াত আছে বন্ধুর বাসায়। আসি। মা,গেলাম।”

নিশাত চুপ করে রইলেন। দু”সপ্তাহ আগে তিতলীরা এসেছিলো,সেদিনও বাসায় ছিলোনা তমা। ওইবার দেখাই হয়নি। তার আগেরবার যখন ছোট মেয়ে জামাই এসেছিলো, বাসায় ছিলোনা তমা। আসলে, কোনো ছুটির দিনেই বাসায় থাকেনা মেয়েটা, কেউ আসবে জানলেও। এসব নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছা করেনা। তবে খারাপ লাগে।

বড় মেয়ে তিতিরের কথাই ঠিক বোধহয়। ও সবসময় বলে, ” মা, পরিবারের কাউকে কখনো ছাড় দিতে নেই। বাসার গার্জিয়ানদের উচিৎ সব সদস্যদের উপরে কিছুটা কন্ট্রোল থাকা। একটা সংসারে সবার কিছু না কিছু দায়িত্ব আছে।সেই দায়িত্ব যেন সে এড়াতে না পারে। এর অর্থ কিন্তু স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা নয়। গার্জিয়ানদের ইনফ্লুয়েন্স থাকলে সবার মঙ্গল। সবাই জানবে তার কর্তব্য কি, তার সীমারেখা কতোটুকু। ”

কথাগুলো মন্দ নয়। কিন্তু নাজমুল -নিশাত কাউকেই কিছু বলতে পারেন না। তমাকে তার স্বামীই যদি কিছু না বলে তো তাঁরা কি বলবেন?

চলবে।