#সংসার
পর্ব ৫
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নাজমুল সাহেব মনে মনে শুধু স্মৃতিচারণ করেন। অন্য কাউকে পাশে বসিয়ে নিজের গল্প বলা যায়, তা তিনি করবেন না। অবশ্য গল্প করবেনই বা কার সাথে? সবাই ব্যস্ত। তাছাড়া নাজমুল সাহেবের কথা বলতে ভালো লাগে না।ক্লান্তি লাগে।
সুন্দর সোনালী শৈশবের কথা মনে পড়ে। বাপজী আর মায়ের নির্ভেজাল আদর,মমতা। বড় ভাইবোনদের স্নেহ। ছোট ভাইবোনদের আবদার। কাকডাকা ভোরে উঠে পড়তে বসা। তারপরে গোসল করে, ভাত খেয়ে প্রায় আট মাইল হেঁটে স্কুলে যাওয়া। টিফিন হিসেবে পকেটে নাড়ু,মুড়কি ইত্যাদি। টিফিন পিরিয়ডে নাজমুল সাহেব আর তাঁর ইমেডিয়েট বড় ভাইয়ের পেটে থাকতো গনগনে ক্ষুধা। এক ভাই স্কুলের টিউবওয়েল চাপতেন,আরেক ভাই আঁজলা ভরে পানি খেতেন। এরপর পেট ভরে পানি খাওয়া ভাইটি কল চাপতেন,তৃষ্ণার্ত ভাইটি প্রাণ ভরে পানি খেতেন।
একদিন পিওন এসে দুই ভাইকে ডাকলেন। হেডমাস্টার সাহেব দেখা করতে বলেছেন দু’জনকে। বাচ্চা দুটোর আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দুই ভাই ঢুকলেন হেডস্যারের ঘরে। স্যার তাঁদের নাম, ঠিকানা সব জেনে নিলেন। তারপরে হুকুম দিলেন,প্রতিদিন টিফিন পিরিওডে দুই ভাই যেন তাঁর বাড়িতে যেয়ে ভাত খায়।
ভয় ও দুশ্চিন্তায় দুই ভাই কাতর হয়ে পড়লেন। স্যারের বাসায় ভাত তাঁদের গলা দিয়ে নামবে না।এরচেয়ে উপোস ভালো। টিফিন পিরিয়ডে পানিটাও খেতে যান না। টিউবওয়েল হেডস্যারের বাসার কাছেই।
দুই তিনদিন পরে আবার পিওন এলেন আর ধরে নিয়ে গেলেন হেডস্যারের বাসায়। হেডস্যারের স্ত্রী জড়িয়ে ধরলেন বালক দু”জনকে। তিনি জানালা দিয়ে পানি দিয়ে পেট ভরানো বাচ্চা দুটোকে নিয়মিত দেখতে পেতেন। ছেলে দুটো সম্পর্কে স্বামীকে তিনিই জানান। কয়েক সন্তানের জননী এই মহিয়ষী মহিলা বালক দুটোকে একান্ত আপন করে নিলেন, তাঁদের সাথে ভাইবোন সম্পর্ক পাতালেন,যত্ন করে ভাত বেড়ে খাওয়ালেন এবং বলে দিলেন প্রতিদিন যেন বাচ্চারা টিফিন পিরিয়ডে তাঁর বাসায় এসে ভাত খেয়ে যায়।
বুবু ধনবান ছিলেন না,তথাকথিত শিক্ষিত ছিলেন না, নিঃসন্তান ছিলেন না,তবু দুটি অচেনা বাচ্চার ক্ষুধা তিনি অনুভব করেছিলেন, জোর করে তাদের নিজের বাড়িতে খেতে বাধ্য করেছিলেন। কতোটা মহানুভব, স্বশিক্ষিত হলে এমন করা যায়?
নাজমুল সাহেব ও তাঁর ভাই কৃতিত্বের সাথে স্কুল জীবন শেষ করলেন, মানিকজোড় দুই ভাই আলাদা হয়ে গেলেন লেখাপড়ার তাগিদে। খুবই কৃতিত্বের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সমাপ্ত করেন নাজমুল সাহেব। ফাইনাল পরীক্ষায় নবম হন। নিজ যোগ্যতায় ভালো চাকরি, তদবির ছাড়াই প্রমোশনের পর প্রমোশন, বিদেশে ট্রেইনিং, আরও প্রমোশন, অধিদপ্তরের শীর্ষ পদে পদায়ন, কাজের দক্ষতা ও সততার প্রশংসা, আল্লাহর উসিলা হয়ে কতো মানুষের কর্মসংস্থান, সম্মান,ভালোবাসা। এগুলো এখন শুধু স্মৃতি যা আনন্দ ও বেদনা দুটোই দেয়। রিটায়ারমেন্টের পরেও এই তিন চার বছর আগ পর্যন্ত জীবন গতিশীল, সুস্থ , সুন্দর ছিলো, বাড়িঘর ফাঁকা থাকতোনা,সবসময় গমগম করতো অতিথির আগমনে, নাতি নাতনিদের হৈ হৈ চিৎকারে। তারপর থেকে এই নিঃসঙ্গতা। ভয়াল কোভিডের কবলে পড়ে নিজেদের মারাত্মক অসুস্থতা, আত্মীয় স্বজনেরও একই অবস্থা, সন্তানদের ব্যস্ততা..জ্যামের অজুহাত,বাচ্চাকাচ্চার লেখাপড়ার অজুহাত, নিজেদের অফিস আদালতের অজুহাত। তাঁরা যেন আর কাজ করেন নি। তোমাদের এমন অফিস যে চব্বিশ ঘন্টাই কাজ করতে হয়। দুষ্ট নাতি নাতনিগুলোও এখন নানা,দাদা করে পিছন পিছন ঘোরেনা। শিশুরা বড়ই স্বার্থপর। আগে নানা,দাদা ছাড়া চলতো না, ” নানা,চাকিস খাবো, নানা, দুকানে নিয়ে চলো, দাদা,গাড়ি কিনি দাও, দাদা, বেলাতে নিয়ে চল, নানা, শিশু পার্কে নিয়ে চলো, নানা,নভোথিয়েটার যাবো, নানা ক্রিকেট বল লাগবে,” হাজার হাজার সীমাহীন আবদার। এখন তারাও ব্যস্ত মানুষ। কথা বলার সময় নেই। হাতে হাতে মোবাইল। নইলে নিজেদের মধ্যে খেলা। নানা বা দাদার সাথে একটু হাই হ্যালো।
নিশাত নিঃসন্দেহে অনেক ভালো একজন মানুষ। কিন্তু দুই তিন বছর ধরে নাজমুল সাহেবের সাথে নিশাতের আচরণ সমর্থন যোগ্য না। পুরো দাম্পত্য জীবন ভালো-মন্দে কেটেছে আর দশটা সাধারণ দম্পতির মতো। দু’জনেই সংগ্রাম করেছেন ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে, আত্মীয় স্বজনদের উপকার করতে। নাজমুল সাহেব অল্পে মেজাজ হারাতেন, হৈচৈ করতেন,এটা ঠিক। কিন্তু ভালোওতো কাউকে কম বাসেন নি। এখন এই সময়ে, নানা অসুখে ও বয়সের ভারে তিনি যখন জর্জরিত, তখন নিশাত তাঁর সারাজীবনের সমস্ত অভিযোগের ডালা খুলে বসেছেন। তাঁর এখন মনে পড়েনা নিশাতের সাথে তাঁর স্বাভাবিক কথাবার্তা, হাসি তামাশা শেষ কবে হয়েছে? নিশাতের অন্যতম অভিযোগ, নাজমুল সাহেব সারাজীবন নিশাতকে আর্থিক ভাবে বঞ্চিত করেছেন। দুর্ব্যবহার করেছেন। প্রাপ্য মর্যাদা দেন নি। স্বীকার করেন নাজমুল সাহেব। স্ত্রী কে হাতখরচ প্রতিমাসে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য ছিলো তাঁর, একদম গোড়া থেকে। সেটা তিনি করেন নি। নিশাতকে বলে দিয়েছিলেন,দরকার মতো টাকা নিয়ে খরচ করতে। নিশাত খরচ করতেন না,যদি বা করতেন নাজমুল সাহেব সেটার হিসাব নিতেন। এখন বুঝেন,এটা ঠিক হয়নি। তিতিরও বলছিলো ওইদিন, “বাবা, মা’কে সম্মানজনক হাতখরচ দেওয়া তোমার অবশ্য অবশ্যই উচিৎ ছিলো।” নাজমুল সাহেব স্বীকার করেন,ভুল করেছেন তিনি। অনেক ঈদ পার্বণ গিয়েছে, নিশাত কোনো শাড়ি নেন নি, নাজমুল সাহেবও সাধাসাধি করেন নি। নিশাতের তেমন ভালো শাড়ি ছিলোনা,গয়না অনেক দূরের কথা।ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা,খাওয়া-দাওয়া,চিকিৎসার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন থাকলেও তাদের বিলাসিতার কোনো সুযোগ ছিলো না। অবশ্য নিশাত ও ছেলেমেয়েরা কেউ বিলাসী মনোভাবাপন্ন নয়। সরকারি চাকরির বেতন, তা সে যতো উঁচু পদ হোক, খুবই সামান্য ছিলো। সেই টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া, সাংসারিক খরচ, বাচ্চাদের পড়ালেখা, মা-ভাই-বোনদের জন্য খরচ করা। এরই মধ্যে প্রাণপণে কিছুটা সঞ্চয়। সঞ্চয় করেছিলেন দেখে কখনো কারো গলগ্রহ হতে হয়নি, কারোর কাছে ঋণ করার দরকার পড়েনি, ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরেছেন, ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দিয়েছেন, মাথা গোঁজার ঠাঁই এই ফ্ল্যাটটি কিনতে পেরেছেন। মাথায়
সবসময় চিন্তা কাজ করেছে,তাঁর অবর্তমানে নিশাত যেন কোনোভাবে বিপদগ্রস্ত না হন, ছেলেমেয়েদের উপরে সামান্যতম নির্ভর করতে না হয়। আল্লাহর রহমতে তাঁকে বা নিশাতকে আল্লাহ ছাড়া কারোর ওপর নির্ভর করতে হয়না। ফ্ল্যাট ছাড়াও নিশাতের জন্য যথেষ্ট সঞ্চয় করেছেন নাজমুল সাহেব। তিনি নিজেওতো সারাজীবন বঞ্চিত করেছেন নিজেকে। স্ত্রী -সন্তান ছাড়া একটা ভালো খাবারও মুখে দেন নি,বিলাসিতা করেন নি। নিশাত অনেকবার গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন বিবাহিত জীবনে, তখন কি চিকিৎসায় সামান্যতম কার্পণ্য করেছেন নাজমুল সাহেব? করেন নি। বরং প্রতিবার স্ত্রীর সেবাযত্ন সাধ্যমতো করেছেন নাজমুল সাহেব নিজের হাতে। নিশাত তাঁর নিজের সমস্ত আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে এমন উদাহরণ বের করতে পারবেন? এমন কাউকে খুঁজে বের করতে পারবেন যিনি একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ মানব? পারবেন না। নিশাতের সবসময় খোঁচা মারা কথাবার্তা এখন নিতে পারছেন না নাজমুল সাহেব। সেবার খোঁটাও নিতে পারছেন না। মেয়েরাও মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে তর্কাতর্কি করে ফোনে,বুঝতে পারেন নাজমুল সাহেব। নিশাতের কথাবার্তা শোনেন,” আর তোমাদের বাপ যখন আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতো? তার মেজাজ কেমন ছিলো জানো না? এতো বাপ প্রীতি, বাপের কাছে এসে থাকো নইলে বাপকে নিজেদের কাছে নিয়ে যাও,আমি যখন এতো কষ্টে রেখেছি তোমাদের বাপকে। ”
নাজমুল সাহেব তাঁর মায়ের কথা ভাবেন। চির দুঃখিনী মা। ছোট্ট বেলাতেই পিতৃমাতৃহারা। বড় হয়েছেন ভাই ভাবীর কাছে। ভাই খুব ভালোবাসতেন। সেই ভাইও মারা যান অকালে। বাপজী ছেলেমেয়েদের প্রতি অতি স্নেহশীল হলেও মায়ের প্রতি এতোটুকু সহানুভূতিশীল ছিলেন না। মা’কে তিনি সংসার পরিচালনার যন্ত্র ছাড়া আর কিছু ভাবতেন না। ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য মা অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মা’কে সারাজীবন ভালো রাখার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন নাজমুল সাহেব । মায়ের হাতে মাসে মাসে টাকা গুঁজে দিতেন। মা নিজের জন্য কিছু খরচ করতেন না কিন্তু এর জন্য ওর জন্য সবসময় আবদার করতেন। মূলত তাঁর সব আবদার ছিলো মেয়ে আর মেয়ের ঘরের নাতি নাতনিদের জন্য। আজ মেয়ের টাকা দরকার, কাল জামাইয়ের জমি কেনার জন্য টাকা দরকার, বড় নাতনির বিয়ে হবে, তাই তাকে গলার ভারি নেকলেস দেওয়া মামাদের অবশ্য কর্তব্য। ভাগনেদের পড়ার খরচও মামাদের দিতে হবে। নিশাত বা বাচ্চাদের কিংবা স্বয়ং ছেলের সমস্যার কথা শামসুন্নাহার ভাবতেন না,তাঁর একটাই চিন্তা…. মেয়ে। ছেলের কথা ভাবনায় আসতো না কারণ ছেলেকে অনেক পড়ালেখা শিখিয়েছেন তিনি, সে অনেক বড় চাকরি করে, তাহলে অনেক টাকা বেতন পায়, বোনকে ঢেলে দিতে সমস্যা কোথায়? মা’কে না করতে পারতেন না নাজমুল সাহেব। সুতরাং আত্মত্যাগ তাঁদের দুই ভাই আর নিশাতকেই করতে হতো।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত শাশুড়িকে নিশাত নিজের হাতে গোসল করিয়ে দিতেন, মাছ বেছে,মাংস টুকরো করে, সবজি,ডাল সবকিছু দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। কিন্তু কোনো স্বীকৃতি জোটেনি শাশুড়ি বা স্বামীর কাছ থেকে যদিও স্বীকৃতির আশায় দিনের পর দিন এগুলো করেন নি নিশাত,মানবিকতার খাতিরে করেছেন।
শেষের দিকে মা অস্হির হয়ে পড়লেন গ্রামে যাওয়ার জন্য। সাত-আট ঘন্টার রাস্তা। ওখানে কে তোমাকে দেখবে, মা? উত্তর হলো,আমার মেয়ে দেখবে। মেয়ে তোমাকে দেখবে না মা, কতোবার ঢাকায় আসতে বললাম ওকে,আসলো না তো। এখানে আসেনি, গ্রামে নিশ্চয়ই আসবে। আমার কাছে থাকবে।
মেয়ের আশায় মা গেলেন। তিন মাসের মধ্যে একবারও মেয়ে এলো না। এই সমস্যা, ওই সমস্যা। তার সাত ছেলেমেয়েই তখন বড় হয়ে গেছে, যথেষ্ট বড়, তবু মেয়ে আসতে পারবে না। এতো বড় সংসার ফেলে রেখে আসা যায়?
মেয়েকে না দেখেই এক সন্ধ্যায় চোখ বুজলেন মা। এর থেকে ট্রাজেডি আর কি হতে পারে?
চলবে।