#সংসার
পর্ব ৯
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
” আর কতোদিন এখানে থাকবে? বাসায় যাওয়ার দরকার না? ইরফান -আয়মানের কষ্ট হচ্ছে আমাদের ছাড়া।”
“আরও কিছুদিন থাকতে হবে। ওদের এই অবস্থায় ফেলে যাওয়া যায় না।”
” এখানে আমার আর থাকতে ভালো লাগছে না। সারাটাক্ষণ রাজের কথা মনে হয়। আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার মনেই হয়না রাজ নেই।” নাজমুল সাহেব কাঁদতে শুরু করলেন।
নিশাত শূন্য চোখে বড় করো বাঁধানো রাজের ছবির দিকে চেয়ে রইলেন। টকটকে লাল জমকালো লেহেঙ্গা পরা, কাঁধে একটা বাহারি ওড়না ঝুলছে,লম্বা চুল এক বেণী করা,মাঝের সিঁথিতে টিকলি, কানে ঝুমকা, গলায় লম্বা হার, হাতের প্রায় কনুই পর্যন্ত চুড়ি, টিপ,গাঢ় লিপস্টিক, মুখে চওড়া ফোকলা হাসি, উপরে দুইটা নিচে একটা দাঁত নেই। ফ্রেমের নিচের দিকে বুবুনের লেখা,
আমাদের সাজুনি বুড়ি, ফুলের কুঁড়ি,ছোট্ট পরী,
আর তো দেয়না দেখা অভিমানে,কি যে করি!
কোথা যে পাকনা বুড়ি গেলো চলে,
ফিরে এলে সারাটাক্ষণ রাখবো কোলে।
সোনার নূপুর পরিয়ে দিবো সোনার দু’পায়,
লক্ষী মেয়ে রাজেশ্বরী আয় ফিরে আয়।
নিশাতের দম আটকে আসে।চোখ জ্বালা করে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয় রাজের জন্য। কিন্তু তাঁর কান্নাকাটি করলে চলবে না। শোকে মুহ্যমান পরিবারে একজনকে অন্তত শক্ত থাকতে হয়। নিশাত সেই দাঁড় হীন,পালহীন নৌকার মাঝি।
তুতুনটা স্কুল থেকে ফিরলো। নিশাত ছুটে গেলেন। আদর করে চুমু দিলেন নাতিকে।
” স্কুলে আজ কি কি মজা করলে ভাইয়া? ”
“মজা করিনি।”
“টিফিন খেয়েছো ময়না? ”
“জ্বি।”
টিফিন বক্সে অর্ধেকের বেশি খাবার পড়ে আছে। প্রতিদিনই থাকে। অথচ দুই মাস আগেও তুতুন তার টিফিন চেটেপুটে খেতো। তিতিরকে বলতো,” আমাকে আরেকটু বেশি টিফিন দিও মা। ” মা-ও তেমনি। বড় বাক্স উপচে মজার মজার খাবার দিতো। নিশাত আড়ালে মেয়েকে বলতেন, ” অতো খাবার দিস না। ওবেসিটি কারোর জন্য ভালো না।”
“তুতুন তো ওবেজ না, মা। আর যেই ছোটাছুটি করে, ক্যালরি সব বার্ণট হয়ে যায়।”
শুধু এটুকু নয়, নিজের টিফিন খাওয়ার সময় বন্ধুদের টিফিন আইটেমের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতো বাচ্চাটা। যাদের খাবার পছন্দ হতো, তাদের কাছে যেয়ে কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষা চাইতো , ” আমাকে তোমার টিফিন থেকে অল্প একটু দিবে? আমারও পাস্তা খেতে ভালো লাগে।” প্রতিদিন একই ঘটনা। টিচারের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়ে তিতির আরও বড় টিফিন বক্স কিনেছিলো। তুতুনকে বলেছিলো, “বাবাই, তুমি খাবে আর বন্ধুদেরকেও দিবে। কি খেতে ইচ্ছা করে, স্কুল থেকে ফিরে এসে বলবে। সন্ধ্যায় আমি বা ময়না খালা সেটা বানিয়ে দিবো। কারোর কাছে টিফিন চেও না সোনা।”
টিফিন বক্সের সাইজ দেখে নাজমুল সাহেব একদিন মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন, ” এতো ছোটো বাক্স না দিয়ে ছেলেকে একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দে,তিতির। দেখি, আমিই বড় পাঁচ বাটির টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে আসবো। ” বাপের উপরে এতো মন খারাপ করেছিলো তিতির যে দুইদিন কথা বলেনি নাজমুল সাহেবের সাথে। ঘরের রুটি, মাছ,মাংস,সব্জি, ডাল,ফল,ডিম এগুলো কিন্তু জোর করে খাওয়ানো লাগতো তুতুনকে, শুধু টিফিনটা সোনামুখ করে খেতো বাচ্চাটা,রসিয়ে রসিয়ে, পাস্তা, চিকেন-চিংড়ি-সব্জি দেওয়া নুডলস, মাংসের কিমা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া পরোটা, শামি কাবাব, ফ্রায়েড রাইস এরকম মনের মতো খাবার। আর সেই ছেলে প্রায় দুই মাস ধরে টিফিন খায়না বললেই চলে। বাসায় তিন বেলা তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেন নিশাত, জোর জবরদস্তি করে সামান্য খাওয়াতে পারেন। অনেক শুকিয়ে গেছে বাচ্চাটা।
তুতুনের গোসল -খাওয়া শেষ হতে না হতে এলো লুম্বিনী। কোটরে ঢুকে যাওয়া ভাষাহীন দু’টি চোখ। রাজ চলে যাওয়ার সময় লুম্বিনীর সাজগোজের নেশাটা নিয়ে গেছে। স্কুলে যাওয়ার আগে, বিকেলে,রাতে ঘুমানোর আগে ওর চুল বেঁধে দেন নিশাত। লুম্বিনী ক্লান্ত গলায় প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়, ” বুবু, দুইদিকে দুইটা বেণি করে দাও। আর কিছু না।”
“আজকে একটু অন্য রকম ভাবে চুলটা বেঁধে দিই আমার লুম্বিনী সোনা?”
“না,না, শুধু দুইটা বেণী।”
“আচ্ছা, আজকে ফ্রেঞ্চ বেণী করে দিই। ”
“না, শুধু দুইটা বেণী,প্লিজ বুবু।”
রাজেশ্বরী মারা যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এতোটুকু সাজেনি লুম্বিনী।অথচ দুই বোনের কেশ সজ্জা করতে আগে বহু শ্রম আর সময় দিতে হতো। কতো ডিজাইনের চুল বাঁধা। আর বাহারি ক্লিপ,ছোট ছোট রঙিন বল দিয়ে মাথা ভরিয়ে রাখতো দু’জনে।
লুম্বিনীর গোসল,খাওয়া তদারক করেন নিশাত। পাখিও লুম্বিনীর থেকে বেশি খায়। সাজুনি বুড়ি লুম্বিনী তার গলার হার,কানের দুল, হাতের চূড়ি,পায়ের নূপুর আর পরে না, তিতলী -তমা -নোমান প্রায় প্রতিদিনই আসে, তিতলী আর তমা কতো চেষ্টা করে লুম্বিনীকে একটু সাজিয়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু ঐটুকু মেয়ে তার সিদ্ধান্তে অনড়। বুবুন দুই বোনকে কুটনি বুড়ি বলে ডাকতো, কারণ এদের অন্যতম পছন্দের কাজ ছিলো বাবার দুই পাশে বসে বুবুনের সারাদিনের কর্মকাণ্ডের ধারা বিবরণী দেওয়া,তাতে টুকটাক বানানো কথাও মিশে থাকতো,
“বাবা, ভাইয়া আজ সারাদিন , সারা সন্ধ্যা টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখেছে, তোমার কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে ওমনি টিভি বন্ধ করে পড়ার টেবিলে বসেছে।”
“ভাইয়া একদম পড়ে না। শুধু মোবাইলে গেমস খেলে। মা আজ অনেক বকেছে ভাইয়াকে।”
“ভাইয়া আজ মোবাইলে একটা মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলো। আমি মেয়েটার গলার স্বর শুনতে পেয়েছি। বাবা, আগেও ভাইয়া মেয়েটার সাথে কথা বলেছে।যখনই কথা বলে,তখনই খুব হাসে। আমরা ঢুকতে গেলে ঘাড় ধরে বের করে দেয়।আজ আমি ঘাড়ে খুব ব্যথা পেয়েছি। দেখো,ভালো করে দেখো, ঘাড়ে হালকা একটা দাগ। এই রাজ, বাবার চশমাটা দে না।”
কুটনি বুড়ি আর কুটনামি করেনা। কথাবার্তা বলেনা বললেই চলে। ঝিম মেরে থাকে সারাক্ষণ।
নাজমুল সাহেবকে ভাত খাওয়ার জন্য ডাক দিয়ে নিশাত তিতিরের ঘরে ঢুকলেন। তিতির ঘুমাচ্ছে। শুকিয়ে কাঠ। চোখের তলায় গাঢ় কালি।
“তিতির, মা ওঠো। একটু কিছু খেয়ে নিয়ে আবার ঘুমাও। তিতির, ওঠো মা।”
তিতির বহু কষ্টে চোখ মেলে,তারপরে আবার ঘুমিয়ে যায়।
ময়না খালা স্যুপের বাটি এনে নিশাতের হাতে দেন।
” তিতির, একটু তাকা। স্যুপটা মুখে নে তো মা। একটু হাঁ কর। মুখে নিয়ে শুয়ে থাকিস না। গিলে ফেল্। তিতির, এই তিতির।” বহু কষ্টে মেয়েকে আধা বাটিরও কম স্যুপ খাওয়ান নিশাত। জামাই-মেয়ে-নাতি-নাতনিদের অবস্থা দেখে নিশাতের পাগল পাগল লাগে।নিজের খাওয়া গোসলের সময় হয়না, রাজের জন্য প্রাণ খুলে কান্নারও সময় হয় না।
বুবুন কলেজ থেকে ফিরেছে। নিশাত ডাকলেন, “বাবু, হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি।খাইনি এখনো।”
“তুমি খেয়ে নাও বুবু। আমার খিদে নেই। ”
” আমি তোর জন্য ই বসে আছি বাবু। তুই না আসলে আমিও খাবোনা।”
বাধ্য হয়ে আরিয়ান ওরফে বুবুন খাবার টেবিলে আসে। প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করে।
“বাবু, তোরা সবাই এমন করলে চলবে? তুই বড় ছেলে।তোকে শক্ত হতে হবে ভাই। তোর বাপ-মা আধমরা হয়ে আছে। তুতুন বাচ্চা মানুষ, কিন্তু কেমন অস্বাভাবিক জীবন কাটছে তার। লুম্বিনীকে নিয়ে সবচেয়ে ভয়। যতো কষ্ট হোক, তোকে শক্ত হতে হবে। ভাত নাড়ছিস শুধু, মুখে তুলছিস না। খা।”
বুবুনের চোখ থেকে পানির বড় বড় ফোঁটা ভাতের উপরে পড়ছে। ওই রাতে তার খাটে শুয়ে রাজেশ্বরী গলা ফাটিয়ে কাঁদছিলো। সেই সাথে গড়াগড়ি। কান্না থামার পরে শীত লাগার কথা বলেছিলো। বেশ রাতে বুবুন পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে এসেছিলো রাজকে খাওয়ানোর জন্য। রাজ খায়নি।
“বমি লাগছে ভাইয়া, খাবো না।”
“খালি পেট বলে বমি লাগছে। খেলে বমি লাগবেনা।”
রাজ কিছুতেই খেলো না। বুবুন ওভেনে নুডুলস গরম করে নিয়ে আসলো, দুধ ভাত মাখিয়ে নিয়ে এলো,রাজ মুখই খুললোনা। তারপরে এলো জ্বর।
“এই ভাইয়া,আমার মাথায় ব্যাথা করছে।”
“আমার জ্বরের কথা খবরদার বাবা-মা’কে বলবিনা। ওদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই।”
” বেশি শীতে লাগছে ভাইয়া, গায়ে আরেকটা কাঁথা দিয়ে দে।”
“মাথায় অনেক ব্যথা। বাবা আমার মাথা দেওয়ালে বারবার ঠুকে দিয়েছে। ”
“খবরদার রাজ, একদম মিথ্যা বলবি না।আমি তখন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“এই বাসাতেই থাকবো না আমি। কালকেই চলে যাবো।”
“কোথায় যাবি? ”
“দেখি।কিন্তু এই বাসায় আর কোনোদিন আসবো না।সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি। ”
রাজ, তুই জেদি, কিন্তু এতো জেদি ! নিজের অবস্থানে অনড় রইলি। সত্যি সত্যি এই বাসা ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেলি। এখন কোথায় আছিস? কেমন আছিস?
বুবুন প্রতিদিনই বোনের কবরের কাছে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আসে। কথা বলে বোনের সাথে, “রাজ,এই রাজ। কেমন আছিস? মা গায়ে ওডোমোস লাগিয়ে দিতো প্রতিদিন, তাও মশার কামড় খেলি কেন? রাজ, একবার আমার কাছে একটু আয় না? ”
আরেকজন নিয়মিত ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে ছোট্ট কবরটার পাশে। কখনো মাঝরাতে, কখনো ভোর রাতে, ঝড় বৃষ্টি এলে তো অবশ্য ই।
“কোনো ভয় নেই মামনি। আমি তোমার পাশে বসে আছি।তুমি আরাম করে ঘুমাও। আল্লাহ তোমাকে নিশ্চয়ই অনেক ভালো রেখেছেন, তাই না মামনি? তুমি কি করো সারাদিন? আমি তোমার নূপুর কিনে এনেছি মা। তুমি আর লুম্বিনী যে ডিজাইন বলেছিলে, হুবহু সেটাই নিয়ে এসেছি মামনি। তুমি কি বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছো মামনি? চলে এসো রাজ।তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারছি না। সোনা মা, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। বাবাকে মাফ করে দাও ময়না, বাবা খুব অন্যায় করেছে, বাবাকে মাফ করে দাও।”
চলবে।