#সংসার
পর্ব ৪২
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নোমান, ইরফান,আয়মান চলে এলো দেশে। তিনজনেরই দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। পরিস্কার রাস্তাঘাট, দূষণমুক্ত পরিবেশ, উন্নত জীবনোপকরণ কিছুই ভালো লাগছেনা। নোমান প্রচণ্ড অনুতপ্ত। সব বাবা-মা সন্তানের মঙ্গলের জন্য ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু নাজমুল-নিশাত আর সবার চেয়ে আরও বেশি। এই বয়স ও শারীরিক অবস্হায়ও সন্তানদের কল্যাণে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তারা। অবস্থার খাতিরে নোমানের জন্য সবচেয়ে বেশি সময়,অর্থ, শ্রম দিয়েছেন নাজমুল-নিশাত, তিতির-তিতলীর থেকে বেশ অনেকটাই বেশি। আমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিবারে ছেলেরা বাপ-মায়ের দেখভাল করে, মেয়েরা নয়।কিন্তু তিতির-তিতলী বাপ-মা, ভাই,ভাইপো সবার দেখাশোনা করেছে, প্রত্যেকের প্রত্যেকটি অসময়ে পাশে থেকেছে।তমা যা সাপোর্ট পেয়েছে শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে, এমন খুব কম মেয়ে পায় ।ইরফান,আয়মান দাদা-দাদি -ফুপুদের কোলে মানুষ। আর নোমান কিনা তমার প্রলোভনে পা দিয়ে নিজের অসুস্থ , বৃদ্ধ বাবা-মা’কে ফেলে দিব্যি নিজের আর ছেলেদের সুভবিষ্যতের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে এলো? কেন, দেশে ভাগ্নে আরিয়ান ওরফে বুবুন ভালোভাবে মানুষ হয়নি? বাকিগুলোতো ছোট,ছোট। সুহৃদ, সদা শুভাকাঙ্ক্ষী একান্ত আপনজনের চেয়ে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সুখ,শান্তি বেশি হয়ে গেলো?
তমার সাথে ঝগড়া হয়েছে অনেক।তমার বাবা-মা জামাইকে কথা শুনাতে এলে নোমান বলে বসলো, ” আপনারা দেশে ইরফান -আয়মানের বেড়ে ওঠা নিয়ে সামান্য সাহায্য করেননি।এখন ওদের নিয়ে এতো মাথা ব্যথা কেন আপনাদের? ওদের সিদ্ধান্ত ওদের নিতে দিন। আর আমি দেশে ফিরে যাবো, আমার নিতান্ত আপন মানুষগুলোর কাছে। ”
“পৃথিবীতে তমা তোমার সবচেয়ে আপনজন, আর তোমার ছেলেরা। তোমার বাবা-মা অথর্ব নন। বাংলাদেশের সবচেয়ে ন্যাস্টি জিনিস হলো,একটু বয়স হতেই বাপ-মা ছেলেদের ঘাড়ে চেপে বসে। মনে করে, অনেক করে ফেলেছি ছেলের জন্য। এবারে ছেলে আমাদের দেখবে, আমার মেয়ে জামাইদের নাইওর নিয়ে আসবে, ভাগ্নে পালবে, ভাগ্নির বিয়ে দিবে,ছোট ভাই থাকলে তারা বেকার বসে থাকবে, তাদেরকেও টানতে হবে।ডিজগাস্টিং চিন্তাভাবনা। ”
“সম্ভবত আপনাদের বাবা-মায়েরা এমন ছিলেন। থাকলেও দোষ দিবোনা।তাঁরা আগের যুগের মানুষ। তাঁদের অনেক ভুল, অনেক সঠিক ধারণা ছিলো। কিন্তু আমার বাবা-মা’কে খুব ভালো করে চেনেন আপনারা। তাঁরা আমাদের উপর নির্ভর করেননি, আমরা তাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিলাম।আমার ছেলেরা সম্পূর্ণ তাঁদের কাছে মানুষ। আপনার মেয়ে অফিস, ক্যারিয়ার, পার্টি,আমোদ,প্রমোদ , দু’দিন পরপর বিদেশ যাওয়া এসব আরাম করে করতে পেরেছে আমার বাবা-মায়ের জন্য। ”
“ওহ্, আমার মেয়ের ক্যারিয়ার তাহলে তোমার ফ্যামিলি গড়ে দিয়েছে? তাকে লেখাপড়ার খরচ কী তোমার বাপ-মা যুগিয়েছিলেন? ”
” টাকা দেওয়া থেকেও অনেক কষ্টকর শিশু পালন, খুঁটিয়ে নাটিয়ে অন্যের সুযোগ সুবিধা দেখা, মানুষকে সাহায্য করা। আপনারা টাকার বাইরে কিছু বুঝবেননা।”
তমা ইরফান -আয়মানকে অনেক মারলো, বকলো, বুঝালো, কাঁদলো, লাভ হলোনা। দুই ভাই নাকি দাদা দাদিকে ছেড়ে বাঁচতে পারবেনা।
নোমান দুই ছেলে নিয়ে ফিরে এলো। কিন্তু চলে গেলো বুবুন। এমএসসির জন্য অনেক আগে থেকেই সে কানাডার আলবার্টায় আবেদন করে রেখেছিলো, ফুল স্কলারশিপসহ সেখানে সে পড়ার চান্স পেলো। এ পর্যন্ত বাবা-মায়ের সাথে একদিনও দেখা করেনি। বাবা-মা আসার খবর পেলে নানার বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। একবার তিতির তিন রাত টানা ছিলো বাবার বাড়িতে ছেলেকে ধরার আশায়, ছেলে কোনোভাবে খবর পেয়ে বাসায় আসেনি।হোস্টেলে ছিলো।তার একই কথা, এতো নোংরা চরিত্রের বাবা আর মেরুদণ্ডহীন, পরনির্ভরশীল, এঁটো খাওয়া মায়ের মুখ সে দেখবেনা। নানা-নানি বা খালার বাসায় লুম্বিনী, তুতুনকে ডাকিয়ে এনে বুবুন সময় কাটিয়েছে , এমনকি কয়েকদফা তার মনোবাসনা পূর্ণ করতে ময়না খালা, আমেনাও এসেছে, বুবুন ভাইবোনদের বুকে জড়িয়ে ধরেছে, চুমু খেয়েছে, অনেক আদর করেছে, উপহার দিয়েছে, ময়না খালার গলা জড়িয়ে ধরেছে, কিন্তু বাবা-মায়ের সাথে কোনোভাবে দেখা করেনি। লুম্বিনী, তুতুন কতো কেঁদেছে ভাইয়াকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, লাভ হয়নি।
আসিফ বলেছে তিতিরকে, ” বরং আমি চলে যাই তিতির।বাইরে সেটল করি।তবু বুবুন ফিরে আসুক। ”
“তাতেও বুবুন ফিরবেনা। এই অসম্ভব জেদি ছেলেকে আমি চিনি। তুমি চলে গেলে লুম্বিনীর এপিলেপ্সি, অন্যান্য আরও সমস্যা অনেক বেড়ে যায়। তুতুনেরও সিভিয়ার ডিপ্রেশন হয়। খায়না, পড়ালেখা কাজকর্ম মাথায় ঢুকেনা। ”
“বুবুনেরও নার্ভের প্রবলেম।”
“মা-বাবা রেগুলেরলি ওকে ডাক্তার দেখায়। মা নিজের হাতে প্রতি বেলা ওষুধ খাওয়ায়। ডাক্তার ভাই নিজে মাঝে মধ্যে মায়ের বাসায় যান। ইকবাল ভাইকেও দেখানো হচ্ছে। সাইকিয়াট্রিস্ট হিসাবে উনি তো খুব ভালো।”
” আমি কি করবো, তিতির? আমার ছেলে আমাকে এতো ঘেন্না করে?”
তিতির জবাব দেয়না। ছেলের প্রতি তার গাঢ় অভিমান। আমি কি করেছি বুবুন যে আমার সাথে এমন করছিস? আমি শখ করে তোর বাবার সাথে সংসার করছিনা। তোদের জন্যই করছি। আমি তোর বাপকে ডিভোর্স দিলেও তুই বাবাহীন সংসারে থাকতে পারতিস না। ডিভোর্সি বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে মেনে নিতে পারতিস না। তোর বাকি দুই ভাইবোন মানসিক ভাবে পুরো পঙ্গু হয়ে পড়তো। আমিও কষ্ট পেতামরে বুবুন। মনে হতো, তোর বাবা ঠিকমতো খাচ্ছে? নিজের চেকআপ করাচ্ছে? প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছে? আমাকে তোরা মানুষ ভাবিসনা বুবুন।আমার যে সুখ-দুঃখ, অভিমান-অপমান, ভয়-লজ্জা, কষ্ট দুঃখ, ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা, একটু শান্তিতে নিশ্চিন্তে থাকার ইচ্ছা আছে, এগুলো তোরা ভাবিসইনা। একজন মানুষ একবার অপরাধ করলেই তাকে লাথি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে হয়না বুবুন, কারণ আমিতো মানুষটার আলোকিত অনেক দিক দেখেছি। সেখানে একটা সুযোগ তাকে দেওয়াই যায়। তোরা আমাকে শ্রদ্ধা করতে শিখিসনি, তাহলে আমার সিদ্ধান্তের উপরে ভরসা থাকতো তোদের। বুবুন, আমি এখন কী চাই,জানিস? তোকে আর দেখতে যাবোনা।তুই আসলে ভালো, না আসলে কিছু করার নেই। কিন্তু আল্লাহর কাছে আবেদন থাকবে, তোর যখন আমাকে দেখার ইচ্ছা হবে, তখন যেন আমাকে আর দেখতে না পাস। আজ তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে বলেছি, আমি তোকে দেখতে যাবো, যদি না থাকিস বাসায়, পালাস, তাহলে আর কোনদিন যেন কষ্ট করে মায়ের পোড়া,অসুন্দর মুখ তোকে দেখতে না হয়।
তিতির মনে মনে আরও অনেক কথা বলে। আজকাল লুম্বিনী, তুতুন অতোটা মা,মা করেনা। লুম্বিনী ভালো ছাত্রী। পড়াশোনায় অনেক সময় দেয়। রাঁধতে ভালোবাসে। কাজেই রান্নাঘরেও সুযোগ পেলেই ঘুটুরমুটুর করে।আর বাপের সাথে রাজ্যের গল্প। সেই আগের মতো। বাপ মেয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। গল্পের বিষয়বস্তু অনেক।বুবুন, আদনান খালুর মায়ের মেন্টালিটি, খালুর ডোমিনেটিং টেন্ডেন্সি,তিতলী আম্মুর অসম্ভব সুন্দর এবং শক্ত পারসোনালিটি, লুম্বিনী বাবার মতো সার্জন হতে চায়, বাবার করা প্রতিদিনের অপারেশনের বর্ণনা শুনে, আসিফ ডামি কিনে দিয়েছে মেয়েকে, ডিসেক্টিং বক্স কিনে দিয়েছে, নানা ভিডিও দেখায় মেয়েকে,বাবা-মেয়ের গল্প চলতেই থাকে। তুতুন স্কুল থেকে ফিরে অরণ্য -অরণীর সাথে খেলে স্যারের কাছে পড়তে বসে,তারপরে বাপের কোল ঘেঁষে বসা। অরণ্য -অরণীকে দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে এসে ওদের গোসল খাওয়া দেখভাল করে তিতির।বাচ্চা দুটো ঘুমে ঢলতে থাকে। বিকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে তুতুনের সাথে খেলে।তিতলীর দারুণ ব্যস্ততা। উঁচু পোস্ট, ছেলেমেয়ে, প্রচণ্ড ব্যস্ততা। বাবা-মা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। ফোন করলে বা গেলে খুব সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা।
আর এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে মনের মধ্যে রাজ অবাধ বিচরণ করতে থাকে। দুষ্ট রাজ, মিষ্টি রাজ।নবজাতক রাজ, হামা দেওয়া রাজ, টলমলে পায়ে হাঁটতে থাকা রাজ, সাজুনি বুড়ি রাজ, আর চিরঘুমে ঘুমিয়ে থাকা রাজ। তিতিরের দমবন্ধ হয়ে আসে, অসহ্য বেদনায় সে ছটফট করতে থাকে, গলা টনটন করে যন্ত্রণায়, কিন্তু চোখে কিছুতেই পানি আসেনা। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত একজন কোমলমতী মেয়ে, স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা আর দ্বিতীয় বিয়ে, কোর্ট কাছারি, থানা পুলিশ, একজন বিদ্রোহী ছেলে আর এক মৃতা মেয়ের মায়ের কি দারুণ মানসিক যন্ত্রণা, এটা তেমন ভাবে কেউ ভাবেওনা।
তিতির বুবুনকে দেখার জন্য বাবা-মায়ের বাড়ি যায়। বুবুন যথারীতি বাড়িতে নেই। মা আসবেন,তাই সদর্পে চলে গেছে বন্ধুর বাড়ি। অনেক রাত পর্যন্ত বসে থেকে তিতির ফিরে আসে।
নানা-নানির কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে কানাডায় চলে যায় বুবুন। বাপের টাকা নিবেনা। নানা-নানির টাকা শোধ করে দেবে। ভোরের ফ্লাইট। আগের বিকেলে ইরফান,আয়মান, তুতুন,লুম্বিনী, অরণ্য, অরণী সবাইকে নিয়ে অনেক জায়গায় বেড়ালো বুবুন।
ইরফান তার বড় ফুপুকে বলে,”তিতির পাখি, তুমি আজ আমাদের বাসায় চলে আসো, রাতে থেকে যাও। ভোররাতে আমরা যখন এয়ারপোর্টে রওনা হবো, ভাইয়াতো তখন তোমার কাছ থেকে পালাতে পারবেনা। ”
তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই সেই বুবুন যে মা ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতোনা। সে কতোদিন হলো মায়ের সাথে দেখা করেনি, কথা বলেনি। কি দরকার তাকে জ্বালানোর?
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৪৩
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
বুবুন কানাডায় চলে গেছে চৌদ্দ দিন হলো। আসিফ খুব বিমর্ষ থাকে।বারবার অপমানিত হলেও ছেলেকে ফোন করে। লুম্বিনী কাঁদে। ভাইয়ের সাথে প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা হয়। তবু কাঁদে। তুতুন ভাইয়াকে মিস করে খুব। ভিডিও কলে কথা বলার সময় সে প্রতিদিন একবার গলা ছেড়ে কাঁদে।বুবুন ডেইলি নানা-বুবুকে ফোন দেয়, ইরফান -আয়মান-অরণ্য -অরণীকে ফোন দেয়, তার তিতলী আম্মুকে ফোন দেয়, মামাকে দেয় মাঝেমধ্যে, বন্ধুরা মিলে গ্রুপ চ্যাট করে। শুধু বাবা -মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখেনা বুবুন।আসলে নাজলী মেয়েটা ফটোগুলো না দেখালে আর খুবই অশ্লীল কিছু না শোনালে এতো রাগ, ঘৃণা হয়তো হতোনা বুবুনের।বুবুন নিজেও বুঝে সেটা।
কিন্তু মা’কে কেন অসহ্য লাগছে এতো, এই প্রশ্ন বুবুন করেছে বারবার, কিন্তু মস্তিষ্ক তাকে কোন উত্তর দেয়নি। মা যদি বীরদর্পে লোকটাকে ডিভোর্স দিতো, লোকটাকে দিয়ে সাত বছর জেলের ঘানি ঘুরাতো, কোন হাসপাতালে জয়েন করে সেই টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতো, বুবুনতো আর্থিক ভাবে অবশ্যই হাল ধরতো, লোকটার বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ছোট একটা বাসা ভাড়া করে থাকতো, লোকটার ভাইবোনগুলোর মুখে থুথু দিয়ে আসতো, তাহলে সেই মা’কে শ্রদ্ধা করে, ভালোবেসে মাথায় তুলে রাখতো বুবুন। তা না, মহিলা সিংহের মতো লাফ দিয়ে ব্যাঙের মতো চিৎ হয়ে পড়লো। স্বামীর ওপর মামলা তুলে নিলো, ঘটা করে বাড়িতে বরণ করে নিলো বুবুনের তীব্র আপত্তি ও বিদ্রোহ স্বত্বেও। কেন? গায়ে ডিভোর্সির তকমা থাকবেনা, খুব অল্প মানুষই কেলেঙ্কারির খবরটা জানেনা,কাজেই সুদর্শন দেশবরেণ্য সার্জনের গৌরবান্বিত স্ত্রীর সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে রাখবে, নিজেকে ঘরে বাইরে খাটতে হবেনা, রক্ত পানি করে টাকা উপার্জন করে লুম্বিনী -তুতুনকে পড়াতে হবেনা, দিব্যি সার্জন সাহেবের অফুরন্ত টাকায় দিন কাটানো যাবে, বিলো স্ট্যান্ডার্ড মহিলা। ঐ লোকের টাকায় ভাত খেতে কষ্ট বা অপমান হবেনা? রাগে, ঘৃণায় আর দেশে রেখে আসা প্রিয় মানুষগুলোর জন্য কষ্টে বুবুন গোপনে কাঁদে। একজন ডাক্তার মহিলা, তার মধ্যে কোনোদিন স্মার্টনেস দেখেনি বুবুন। আলাভোলা। দামি পোশাক কিনবেনা, পরবেনা, সাজবেনা। মাথার অতি পাতলা চুলের জন্য আসিফ হেয়ার ইমপ্ল্যান্ট করতে বলেছিলো তিতিরকে।অনেক জোরাজোরি করেছিলো। তিতির রাজি হয়নি। মুখের দাগ দূর করার জন্য মহিলাকে থাইল্যান্ডে নিয়ে লেজার থেরাপির জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছিলো। থেরাপিতে কাজ হয়নি অবশ্য। মুখোর দাগ থেকেই গেছে। পার্টি বা কোনো অনুষ্ঠান হলে তাকে পার্লারে যেতে বলা হতো।সে যেতোনা। তো লম্পট চরিত্রের লোক সুন্দরী তরুণীকে পেলে এই বুড়োটে মহিলাকে মাথায় তুলে রাখবে নাকি? লোকটার পদস্খলনের ব্যাপারে মহিলাটারও দায় আছে।
ঠিক একই কথা বললেন নিশাত তাঁর বড় মেয়েকে, ” তিতির, তুমি ভালো ভালো সালোয়ার কামিজ, শাড়ি বাদ দিয়ে পুরানো, রংচটা জিনিস পরে থাকো কেন? ”
“এটা রংচটা নাতো।”
“আহামরি সুন্দরও না। ভালো শাড়ি, সালোয়ার কামিজ পরিপাটি করে পরে থাকবে। মুখের দাগগুলো তো মেকআপ করে ঢাকা যায়। হালকা লিপস্টিক, পাউডার দিয়ে রাখবে।চুলও এতো পাতলা, কানিজ আলমাসে যেয়ে উনার কাছ থেকে পরামর্শ নাও কিসে চুলের ভলিউম বেশি মনে হবে। প্রতি সপ্তাহে হেয়ার ট্রিটমেন্ট, ফেসিয়াল করাও।তোমার টাকার তো অভাব নেই। অরনামেন্টগুলো আলমারিতে বন্ধ করে রাখার জন্য না। ওগুলো ইউজ করো। ”
“আমি তো সবসময় পরিস্কার থাকি মা।”
“পরিচ্ছন্নতার কথা হচ্ছেনা। গ্রুমিং এর কথা হচ্ছে। ”
“কেন? ”
“কেন, বুঝোনা? তুমি একটু ঠিকঠাক থাকলে আসিফ এমন কাজ করতোনা।প্রত্যেক স্বামী কাজ সেরে বাড়ি ফিরে হাসিখুশি , টিপটপ বৌকে দেখতে চায়।”
” আমি সুন্দর না, দেখেশুনেইতো আসিফ বিয়ে করেছে। মা, আমি যখন ওর এম এস কোর্সের সময় সারাদিন খেটে বাসায় আসতাম, ও আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য অধীর থাকতোনাতো। খালি গা, লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত তোলা। এধরনের কথা আগে কখবো বলোনিতো মা। এখন কেন? ”
” এখন এইজন্য যে , সংসারের এতো অশান্তি আর সহ্য করতে পারছিনা।আসিফ এমন কাণ্ড করলো, আমার বুবুন রাগ করে চলে গেলো, তুমি তোমার মতোই থাকলে আবারও অঘটন ঘটবে। আর লেখাপড়া শিখিয়েছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। দয়া করে ঘরে বসে ডিম না পেড়ে কোন হাসপাতালে জয়েন করো, অ্যাট লিস্ট, চেম্বার করো।”
“অরণ্য -অরণীর কি হবে তাহলে? তিতলী আমার ভরসায় চাকরিতে ঢুকেছে।”
” ওরা ড্রাইভারের সাথে চলে আসবে তোমার বাড়িতে। লুম্বিনী, তুতুন, অরণ্য, অরণী সবাই বড় হয়েছে। তাদের গার্ড অফ অনার দিয়ে আনা নেওয়া করতে হবেনা।বুবুনকে নিয়েও তো মাতামাডি করতে । বুবুন খাবে কিনা ঠিকমতো, বুবুনের পেট ভরেনি, বুবুন লেখাপড়া করছে কিনা, গাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো কিনা, আরও কতো কি! এখন তো ছেলের মুখ দেখোনি বছর খানেক।ও কী খায়, কেমন আছে, জানো কিছু? ”
জানে তিতির। বুবুনোর বিষয়ে সে জানবেনা? লুম্বিনী বা তুতুন যখন ভিডিও কলে ভাইয়ের সাথে কথা বলে, এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে তিতির ছেলের গলা শুনতে থাকে। মুখখানা দেখার জন্য প্রাণপাখি ছটফট করতে থাকে। কিন্তু লুম্বিনী , তুতুন, বাকি সবাই তিতিরকে খুব করে সাবধান করে দিয়েছে, ভিডিও কলে যখন বুবুন কথা বলে, কোনভাবে যেন টের না পায় তিতির বা আসিফ আশেপাশে আছে।তাহলে ও নাকি আর ফোন করবেনা।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৪৪
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
আদনানের মা স্ট্রোক করলেন। হেমোরেজিক স্ট্রোক। তাঁর বেঁচে যাওয়া মিরাকল। ভেন্টিলেটর থেকে ফিরে আসা অল্প ভাগ্যবানদের তিনি একজন। তিতলী চূড়ান্ত যত্ন করলো শাশুড়ির। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় বোনের বাসায় এসে মুখে কিছু গুঁজে, বাচ্চাদের আদর করে, কাউন্সেল করে হাসপাতালে দৌড় । শাশুড়িকে যখন কেবিনে আনা হলো, এক রাতে তিতলী, অপর রাতে আদনান থাকতো। আদনানের ভাই সব মিলে সাত -আট রাত ছিলো, এর বেশি থাকা তার সম্ভব না। দিনে মাথা আউলানো থাকে। আয় উপার্জনতো করা দরকার। তিতলীর জা হাসপাতালে প্রতিদিন আসে বটে, তবে ঘন্টা খানিকের জন্য। ও নাকি শাশুড়ির কাছে খুব থাকতে চায়, কিন্তু হাসপাতালের গন্ধ তার সহ্য হয়না।গা গুলায়, বমি আসে। প্রতিদিন এক ঘন্টা শাশুড়িকে সার্ভিস দেওয়া সে বৈধ করে ফেলেছে।অফিস থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যায়। আফরা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। তাই প্রথম কয়েকদিন হাউমাউ করে মায়ের জন্য কাঁদলেও
এখন সে হাত-পা ঝাড়া। খালা শাশুড়িরা, মামি শাশুড়িরা দল বেঁধে সন্ধ্যায় হাসপাতালে আসেন, খানিকক্ষণ রোগির মাথায় হাত বুলান, মুখটা করুণ করে রাখেন, তারপরে শুরু হয় ক্যান্টিন থেকে চা -সিঙাড়া এনে ম্যারাথন আড্ডা। আদনান না পেরে বলে ফেলেছে, ” তোমরা দিনে এসে থাকো।সন্ধ্যার পর থেকে আমি বা তিতলী থাকি, তখন তোমাদের কষ্ট করার দরকার নেই। ”
“কষ্ট কিসের বাবা? ঘরে বসে থাকতে পারিনা, তোর মায়ের জন্য বুক ধড়ফড় করতে থাকে। না এসে পারি? এই একটু স্যুপ, জাউভাত এনে ওকে একটু খাওয়াই, এতেও শান্তি। ”
উনারা বাটিতে স্যুপ বা জাউ আনেন ঠিকই, কিন্তু খাওয়াননা। খাওয়াতে হয় আদনান বা তিতলীকে। উনাদের খাওয়াতে ভয় লাগে, রোগীর গলায় যদি আটকে যায়। আর এতো ছোট বাটিতে খাবার আনেন, একবার মনে হয়না আদনান বা তিতলী রাতে থাকবে, ওদের জন্যও কিছু খাবার আনি।
মনের দুঃখে তিতলীকে বলে ফেলেছিলো আদনান কথাটা।তিতলী বলেছে, “এতো হিসাব নিকাশ করতে যেওনা। তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করো। কে কি করলো দেখার দরকার কি? ”
“তুমি এতো করছো তিতলী, তুমিতো মা’কে ঘেন্না করতে।”
“ঘেন্না নয়, অপছন্দ করতাম। উনার স্বভাব, কথাবার্তার ধরণ সব তুমি জানো। আমার উপরে যে মানসিক অত্যাচার তোমরা সবাই মিলে করেছো, বিশেষ করে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় , কোনো ভালো ফ্যামিলিতে এমন হয়না। উনি প্রায় আমার খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিতেন।আমার বেতনটাও নিতেন, আমাকে দিয়ে ঘর ঝাড়ু, বাথরুম পরিস্কারও করাতেন অপশন থাকা স্বত্বেও। কিছুতেই কাজের লোক রাখতেননা আমাকে দিয়ে কাজ করাবেন বলে। তোমরা সবাই ছিলে ঠুঁঠো জগন্নাথ। তোমরা সবাই অন্যায় করেছো আমার উপরে, কিন্তু তোমার মায়ের কোন তুলনা নেই। কেন অপছন্দ করবোনা তাঁকে? তোমার ভাই,বোন, ভাইবৌকে? তোমার আরও কিছু আত্মীয়কে? যারা এতো অন্যায় করে, এতোটা স্বার্থপর, মিথ্যাবাদী, কুচুটে হয়, তাদের পছন্দ করা যায়? রক্তের সম্পর্ক থাকলে তাও মায়া আসে, তোমাদের সাথেতো আমার রক্তের সম্পর্কও নাই।”
“তাহলে মায়ের জন্য এতো করছো কেন? ”
“আমার বিবেকের অর্ডার। উনি একজন মানুষ তো। ভালো না লাগলেও উনি আমার ফ্যামিলি মেম্বার। আফটার অল, আমার হাসব্যান্ডের মা।তুমি আর আমি ছাড়া তাঁর যত্ন আত্তি করার কেউ নেই। আমি একজন অসহায় মানুষের সেবা করছি। সেবা করাটা আমাদের স্বভাব। আমার বাবা-মা নিজেরা মানুষের সেবা করতেন, আমাদেরকেও এই শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া শিখিনি।”
” বাচ্চাদের কষ্ট হচ্ছে। ”
“বাচ্চারা অনেক ভালো আছে খালার কাছে।”
“অরণীকে নিয়ে ভয় হয়, তোমার দুলাভাইয়ের যা চরিত্র। ”
” আমার দুলাভাইকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তোমার বাবাকে নিয়ে টেনশন করো। He is perverted, I’m sure now. উনার থেকে অরণী কেন, আমিও নিরাপদ না। ”
“খবরদার! এতো জঘন্য মিথ্যাবাদী তুমি! ”
” গলা নামিয়ে কথা বলো। প্রমাণ ছাড়া আমি কথা বলিনা। কাজের মেয়েরা সবাই একঘরে দরজা বন্ধ করে ঘুমায়। তাও তাদের ভয় যায়না।চূড়ান্ত কিছু করেননা উনি। এই একটু যেখানে সেখানে ছুঁয়ে দেওয়া, লুঙ্গি পরে বিশেষ কায়দায় শোয়া বসা যেন সব চিচিং ফাঁক অবস্থায় থাকে, এইসব টুকটাক আর কি। অরণীকে দিয়ে তিনি তাঁর গোপনাঙ্গ ধরিয়েছেন গত সোমবারে, তোমাকে বলেছি আমি? তোমার মায়ের এমন অবস্থায় তোমাকে বাড়তি চাপ দিতে চাইনি । আমি তোমাকে বুঝি, কিন্তু তুমি আমাকে বুঝোনা। কোন কটু কথা বলতে চাইনি এই কন্ডিশনে। কিন্তু আদনান, তুমি আমার মেজাজটা খিঁচড়ে দিয়েছো। বলতে বাধ্য হচ্ছি, খুবই জঘন্য পরিবার তোমাদের। তোমার বাবার ব্যাপারে আমি সন্দিহান ছিলাম অনেক, কিন্তু আমার অনুমানকে তুমি পাত্তাও দাওনি। তোমার বাবা বিকৃত মস্তিষ্ক, তোমার মায়ের বদগুণের সীমা নেই , তোমার ভাইবোন দুটো অতিরিক্ত স্বার্থপর, লোভী, মিথ্যাবাদী, একটা গোটা পরিবার এতো খারাপ কি করে হয়? ”
“আর একটা কথা বললে থাপড়ে দাঁত ফেলে দিবো।”
” এখন স্বাভাবিক নেই তুমি। অবশ্য তুমি কখনোই স্বাভাবিক না। এবারের মতো মাফ করলাম। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। ”
” ইউ বিচ, আমার মায়ের তোর সেবার দরকার নেই। তুই আমার বাড়ি থেকে বের হ। আর কোনদিন তোর চেহারা আমি দেখতে চাইনা। বে জন্মা, রাস্তার মহিলা। কতো বড় সাহস, বানিয়ে বানিয়ে এতো নোংরা কথা বলে।”
ঠিক ঐ সময়ে তিতলীর বেডরুমে ছুটে এসেছিলো কমলা, জাপ্টে ধরেছিলো তিতলীকে, ” বড় ভাবী, উনি খুব নোংরা কথা বলতেছেন। ইশারা ইঙ্গিত করতেছেন। ভাবী, আমারে বাঁচান। বাড়ি পাঠায় দেন।”
আদনান ঝড়ের বেগে তার বাবার ঘরে ঢুকলোএই সময়ে আদনান -তিতলীর বাসায় থাকার কথা নয়। অরণ্য -অরণী তাদের বাক্স পেটরাসহ খালার বাসায়। প্রৌঢ় একেবারেই প্রস্তুত ছিলেননা ছেলের মুখোমুখি হওয়ার। আদনান ঘরে ঢুকে ছিটকে বের হয়ে এলো, দৌড়ে ঢুকলো নিজের ঘরে। তিতলীর পা জড়িয়ে বললো, “আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করো প্লিজ। ”
তিতলী ফোন করলো আদনানের অফিসের অতি বিশ্বস্ত পিওন আজমলকে। অনুরোধ করলো দুই তিনটা রাত এখানে থাকতে। এর মধ্যে পুরুষ গৃহকর্মী খুঁজতে হবে। ওহ্, জীবনটা এতো জটিল কেন? সে তো কারোর ক্ষতি করেনি, তাহলে কেন তার জীবনে কালো মেঘেরই ঘনঘটা?
আদনান খুব ঘামছিলো। তিতলীর মন ভালেবাসা আর মমতায় ভরে গেলো।এমন বিকৃত চরিত্রের বাবা, নিকৃষ্ট স্বভাবের মা-ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন, আদনানের কষ্ট তো তিতলীর থেকেও বেশি। তিতলী অনেক যত্ন করে আদনানের ঘাম মুছিয়ে দিলো সারা শরীরের, কাপড় পাল্টে দিলো, প্রেশার মাপলো, প্রেশার অনেক বেশি। ওষুধ খাইয়ে তিতলী আদনানের মাথায় হাত বুলাতে থাকলো, নরম স্বরে বললো, ” আমি সব সময় তোমার পাশে থাকবো আদনান। তোমাকে ফেলে কোথাও যাবোনা।”
” তিতলী, আল্লাহ কেন আমাকে এমন ফ্যামিলিতে দিলেন? আমি সব জানি, সব বুঝি। কিন্তু তবু আমি তাদের খুব বেশি ভালোবাসি। তাদের ফেলতে পারিনা।”
“এটাই স্বাভাবিক , আদনান। বাপ-মা-ভাই-বোনের উপরে ভালোবাসা থাকাটাই খুব স্বাভাবিক। এটা অপরাধ নয়।”
“বিশ্বাস করো, আমি এদের মতো না। আমার মধ্যে নোংরামি নেই তিতলী।”
“আমি জানি, তুমি এদের মতো নও। কিন্তু তুমিও দায় এড়াতে পারোনা আদনান। বাবা-মা -ভাই-বোনদের অন্যায়গুলো, শুধু আমার সাথে করা অন্যায় নয়, যে কোন অন্যায় তুমি ভদ্র ভাবে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারতে, তাদের বুঝাতে পারতে, একবারে না হলে একশোবার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারতে, ছোট ভাইবোনগুলোকে শাসন করতে পারতে, তুমি কোনোটাই করোনি। তাদের তালে তাল দিয়ে গেছো। আমাকে বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে না, একজন ইঞ্জিনিয়ার না, তোমার প্রেমিকা ও বৌ না, এমনকি মানুষওনা, আমাকে রোবটের মতো ডিল করেছো তুমি। আমি বাড়ির বৌ, তাই সবার সব অনাচার সহ্য করতে হবে আমাকে। আমাকেই স্যাক্রিফাইস করতে হবে সবটুকু। এগুলো তোমার অপরাধ নয় আদনান? এখন ঘুমাও। আজমল তোমার বাবার ঘরে থাকবে। মেয়েরা খেয়ে নিয়ে টেবিলে খাবার দিয়ে ওদের ঘরে চলে যেয়ে দরজা লক করে রাখবে। তাছাড়া আফরাকে ফোন করে এখানে এসে আজ থাকতে বলবো।আশা করি, মেয়ের সাথে তিনি অনাচার করেননা। ”
” আমি সত্যি আজ রাত জাগতে পারবোনা তিতলী। সারা রাত মা খুব ডাকাডাকি করেন। তুমি কাল সারারাত জেগেছো,আজ অফিসে ডিউটি করেছো, এখন আবার হাসপাতালে যাবে? না,না, আমি বরং আরিজকে ফোন করি। ও আজ রাতে থাকুক।”
আদনানের ছোট ভাই জানালো, ওর খুব মাথাব্যথা , জ্বর আসলো বলে। ওর বৌ বাপের বাড়িতে, বাবার শরীর নাকি খুবই খারাপ।
আফরা ফোনে তিতলীকে বললো, ” এ কি! সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চললো, তোমাদের দু’জনের একজনও যাওনি ! মায়ের এই অবস্থায়.. আমাকে বললেওতো পারতে। আমিই না হয় যেয়ে থাকতাম।”
তিতলী চট করে সিদ্ধান্ত বদলালো, বললো, ” তুমিই আজ হাসপাতালে থাকবে। তোমার মায়ের খবর নিয়েছিলে সন্ধ্যায় বা আজ সারাদিন? কে কে আছে ওখানে? ”
“আমিতো জানিই এই সময় তুমি বা বড় ভাইয়া থাকো।”
” তুমি, তোমার বর, তোমার ছোট ভাইয়া, ছোট ভাবি, তোমাদের থাকতে ইচ্ছা করেনা মায়ের কাছে? দেড় মাসে একদিনও থাকোনি তুমি, তোমার মায়ের অতি আদরের একমাত্র মেয়ে। আজ যাও। আজ আমাদের সমস্যা আছে। তোমার বড় ভাইয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
” ভাইয়া অসুস্থ, তাহলে তুমি যাও।আমি কেন? ”
“তুমি না কেন? ”
” তোমার বিবেক নেই ? আমি প্রেগন্যান্ট। আমি কিভাবে হাসপাতালে থাকবো? ”
” অরণ্য -অরণীকে পেটে নিয়ে এহেন কোনো কাজ নেই যা আমি তোমাদের বাড়িতে করিনি। রান্না,বাজার, ঘর ঝাড়া, ফার্নিচার মোছা, হাঁড়ি পাতিল মাজা, তোমাকে দফায় দফায় চা, কফি বানিয়ে দেওয়া। তোমার প্লেট, কাপ, গ্লাস সব আমাকে দিয়ে মাজিয়ে নিতেন তোমার মা। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় গৃহিণীরা দুনিয়ার সব কাজ করে, কর্মজীবীরা দিন রাত খাটে, পেটে বাচ্চা নিয়ে মেয়েরা ইট ভাঙে, বুয়ার কাজ করে, তুমি কোথাকার নবাবজাদী যে তুমি কিছুই করতে পারবেনা? মা তো তোমার, আমার না। দেড়টা মাস আমি বা আদনান থেকেছি, সামনেও থাকবো, কিন্তু আজ তুমি বা তোমার ছোটো ভাই থাকবে। আজ আমরা কেউ যাবোনা। ”
চলবে।