#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#চতুর্থ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
চৈত্রের শেষ সময়। মাঝেমধ্যেই বৈশাখী তান্ডবের আগমনী বার্তা দিতে একেবারে ভুল করে না প্রকৃতি। সুন্দর পরিবেশ হুট করেই হুহু করে কেঁদে ফেলে যেন! জীবনটাও যেন এমনই! কখন ঠিক কোন পরিস্থিতিতে মনটা এমন হুহু করা বিষন্নতায় ছেঁয়ে যাবে, কেউ জানে না।
পুষ্পির বিয়ের একমাস কেটে গিয়েছে। এই একমাসে কত কত পরিবর্তন যে এসেছে মেয়েটার মাঝে। সে নিজেও বোধহয় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলে চমকে যাবে। ওর এই এত এত পরিবর্তনের জন্যে অবশ্য তার ‘লাজ ভেঙে দেয়া’ মানুষটা অনেকাংশে দ্বায়ী।
যে মেয়েটা আগে দশ কথায় রা করত না, সে আজকাল অনেক কথাই বলতে জানে। চুপ করে থাকার বিপরীতে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার আপ্রাণ প্রয়াসও চলছে। শাহরিয়ারের ঠোঁটকাটা কথার জবাবে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে শিখেছে। যে মানুষটা আগে সামান্য হাত ধরলে কেঁপে উঠত, আজকাল তার স্পর্শে ভরসা খুঁজে পায়। মনেহয় পৃথিবীতে কেউ একজন আছে ভরসা করার, আস্থা রাখার মতো মানুষ। যাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায়। যার একটা আবদারে মিথ্যে হয়ে যায় অন্য সব অনিচ্ছার দেয়াল! যে ভালোবেসে ডাকলে নিজেকে বড়ো সৌভাগ্যবতী বলে বোধহয়। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে জীবনের সব অপ্রাপ্তি।
পুষ্পি প্রায়শই ঘুমন্ত শাহরিয়ারের দিকে চেয়ে ভাবে, মানুষটা কত প্রাণবন্ত! কেমন করে একটা মানুষকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে!
পুষ্পি অভিভূত হবেই না কেন? সে তার ভালোলাগার কথাগুলো, মুগ্ধতার কথাগুলো, দুঃখের কথাগুলো কি সহজ ভাবেই না স্বীকার করে।
কী সহজ তার অভিব্যক্তি, কি স্বচ্ছ তার সীকারক্তি।
পুষ্পি যে কথা বলতে চায় না সে কথা জোর করে বলায়। পুষ্পির হাত ধরে রাখে শক্ত করে। পুষ্পি বলে, “উহ্! হাত ছাড়ুন।”
শাহরিয়ার বলে, “উহু, ছাড়ব না। আগে বলো, ভালোবাসি স্বামী।”
পুষ্পি থ হয়ে যায়! এ লোক কি পাগল? পুষ্পি মুখের উপর রিজেক্ট করে বলে, “আপনার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলো।”
শাহরিয়ার দুঃখী হয়ে বলে, “তুমি এমন নিষ্ঠুর! আর তোমায় আমি আমার সহজ-সরল বউ ভাবতাম! তুমি জানো, অন্য কোনো মেয়েকে ‘ভালোবাসি’ বললে, তারা আমায় ‘ভালোবাসি স্কোয়ার’ বলবে?”
পুষ্পির খুব হাসি পায়। হাসি চেপে বলে, “তাতে আমার কি!”
শাহরিয়ার অষ্টম আশ্চর্য হওয়ার মতো করে বলে, “তোমার কি মানে? তোমারই তো সব হওয়া উচিৎ। তোমার স্বামীকে অন্য মেয়েরা ‘ভালোবাসী স্কোয়ার’ বলবে, তোমার তো হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়ার কথা! বোকা মেয়ে!”
পরক্ষণেই দুঃখ করে বলে, ” হায় আল্লাহ! কি বোকা বউ আমার! অনুগ্রহ করে একটু বুদ্ধি দাও তারে।”
পুষ্পি কুটকুট করে হাসে।
শাহরিয়ার সকাল বেলা কলেজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়, কলেজ টাইম শেষে দুটো টিউশনি করিয়ে ফেরে সন্ধ্যার পর। ইংলিশ লেকচারার সে। মানুষটা এত পড়ার পোকা, সারাক্ষণ বই হাতে বসে থাকাই যেন তার অন্যতম প্রিয় কাজ। বাড়িতে তার একটা ছোটখাটো লাইব্রেরীও আছে তার। কত কত বই সেখানে। পুষ্পি একদিন দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, এত বই। আর দ্বিতীয় শখ হচ্ছে পুষ্পিকে জ্বালান।
পুষ্পির অবশ্য এসব ইংরেজি-ফিংরেজি একদমই পছন্দ না। তার পছন্দ বাংলা। সে এডমিশনও নিয়েছে বাংলার উপর। শাহরিয়ার মাঝেমধ্যেই সেই সুবাদে আহ্লাদ করে ডাকে, “বাঙালী বউ আমার! দেখি দেখি, এদিক এসে পড়, আওয়াজ করে পড়, আমি একটু শুনি!”
পুষ্পি উপর উপর খুব বিরক্ত দেখালেও আদতে তার ভালো লাগে। মানুষটা যখন ‘বউ’ বলে ডাকে, সুন্দর সুন্দর বিশেষনে বিশেষিত করে তখন খুব আহ্লাদী হয়ে ওঠে সে।
পুষ্পি এখনো ক্লাস করা শুরু করেনি। ক্লাস তেমন ভাবে শুরু হয়নি তার। সে সারাক্ষণ বাসায় থাকে। ঘরদোর সব পরিপাটি করে রাখে, রান্নাবান্না করে। শাশুড়ীকে কিচ্ছু করতে দেয় না।
সাবেরী খাতুন খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে বলে, “কেমন পাগলী মেয়ে দেখ! একটু তো কিছু করতে দে আমায়! এমন অলস হয়ে থাকতে কি ভালো লাগে?”
পুষ্পি শাসন করার মতন করে বলে, “মা! আপনি খুবই ছোট মানুষের মত জালাচ্ছেন। আপনার ছেলেকে আমি নালিশ করবো। আমার কথা তো শুনছেন না।”
সাবেরী খাতুন ভয় পাবে তো দূর, বরং হাসতে হাসতে নিশ্বাস বন্ধ করার উপক্রম করে ফেলে।
পুষ্পি এই একমাসে অন্তত হাজারবার বিস্মিত হয়েছে। এই ছোট্ট পরিবারটার প্রত্যেকটা মানুষ কি সাংঘাতিক মায়ার! মাঝেমাঝেই মনেহয় ও বোধহয় কোনো কল্পরাজ্যে বসবাস করছে। এমনও কি হয় নাকি?
পুষ্পি ভাবনার দেয়াল থেকে বেড়িয়ে এসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে বিষন্ন বৃষ্টিকণা ছোঁয়ার প্রয়াস।
মানুষটা এই বৃষ্টির মাঝে সেই সকাল বেলা বেড়িয়ে গেছে। কেন যেন আজ তার মনটা ক্ষণে ক্ষণে অশনী বার্তায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।
পুষ্পি নিচে নেমে আসে রান্নার কাজ শুরু করতে। শাহরিয়ার না থাকলে রুমটাতে তার একটুও ভালো লাগে না।
সারাদিন ধরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দুপুরে এসে খানিক খান্ত হলো। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে পুষ্পি রুমে এসে বসল। তারপর জামাকাপড় গোছাতে লাগল। নানুটা তার অসুস্থ। পুষ্পির বিষন্ন মন দেখে শাহরিয়ার নিজেই কাল রাতে বলেছিল, আজ রেডি হয়ে থাকতে, বিকালে কলেজ শেষে এসে নিয়ে যাবে।
আহ্লাদে ভরে ওঠে পুষ্পির মন। মানুষটা এত বোঝে! কতদিন পর দেখবে নানুকে! নানু নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে তাকে দেখে। আনন্দে কেঁদে ফেলবে নিশ্চিত। ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে মেয়েটার।
তার একটু পরই শাহরিয়ার এসে উপস্থিত। দুপুর গড়াতে অনেক দেরী তখনও। তাঁকে আশ্চর্য ঠান্ডা দেখাচ্ছিল। এই ঠান্ডা পতিবেশেও খুব বেশি ঘামছিল। পুষ্পি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। এই অসময়ে কখনও আসে না মানুষটা।
মেয়েটা আস্তে করে বলল, “আপনি এই সময়ে আসলেন যে? আজ এত দ্রুত! আপনি না বললেন বিকেলে আসবেন?”
মানুষটা মলিন হাসল। খুব ধীর কন্ঠে ডাকল, “পুষ্প! একটু কাছে আসবা? একটু কাছে আসো তো।”
পুষ্পির ভ্রু কুঁচকে এলো। কাছে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
মানুষটা পুষ্পিকে বাহুডোরে বেঁধে নিল। আলতো করে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “তুমি কি জানো, তুমি যে খুব শক্ত মনের একটা মেয়ে? আমি তোমাকে দেখে ইন্সপায়ারড হই। এই লক্ষী মেয়েটা জীবনের সব পরিস্থিতি মেনে নিতে জানে। জীবনে অনেক বড়ো বড়ো দুঃখ পেরিয়ে এসেছে সে। এখনও যদি কোনো দুঃখ এসে তোমায় মলিন করে দিতে চায়, তুমি তখনও খুব স্ট্রং থাকবে, আমি জানি তা। আমি কি ঠিক বলছি, পুষ্প?”
পুষ্পি মুখ তুলে মানুষটার দিকে চাইল। এমন অদ্ভুত কথা বলছে কেন আজ হঠাৎ? সে পূর্বের প্রশ্নই পুনরায় করল,”কি হয়েছে, বলুন না!”
মানুষটা একদম দ্বায়িত্ববান পুরুষ মানুষদের মতো পুনরায় মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে বলল, “কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। ঝটপট রেডি হয়ে নাও তো।”
পুষ্পি সব ভুলে খুশি হয়ে যায়। আনন্দিত মনে বলে, “এক্ষুনি যাবেন নানুবাড়ি?”
শাহরিয়ার অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে, “হ্যাঁ। দুই মিনিটে রেডি হয়ে নাও, আমার সুন্দরী বউ।”
পুষ্পি হাসিখুশি মনে রেডি হতে লাগে। শাহরিয়ারের জন্য এত এত ভালোবাসা জন্মায় মনে। এত ভালো কেন মানুষটা! এত কেন বোঝে তাকে!
জীবনে দুঃখ-কষ্ট তো সবারই আসে, কিন্তু সেই মূহুর্তে ভরসা দেয়ার মতো মানুষ জীবনে ক’জন পায়? ক’জন এমন দ্বায়িত্ববান মানুষ পায় যে জীবনের সব কষ্ট ভেনিস করে দিতে শিখায় সুপার হিরোর মতো! গর্ভে ভরে ওঠে পুষ্পির বুকটা।
ওঁরা যখন পুষ্পির নানু বাড়ি পৌছায় তখন দুপুরের পর হালকা উঁকি মারা সূর্যটা, আড়ালে লুকিয়ে পড়তে ব্যাস্ত। কিন্তু বাড়ির সন্নিকটে যেতেই পুষ্পির মনটা কু ডেকে ওঠে! এত ভিড় কেন এখানে! পুষ্পির গলা ভার হয়ে আসে। ধুকপুক বুকে, অসহায় চোখে শাহরিয়ারের দিকে চায়।
শাহরিয়ার মৃদু স্বরে বলল, “আমি জানি তুমি সব স্বাভাবিক ভাবেই নিবে। ভেঙে পড়বে না। পুষ্প, ইউ আর আ স্ট্রং গার্ল, ইউ ক্যান হ্যান্ডেল ইট। আই নো, আই নো।”
পুষ্প ঢোক গিলে। বাড়ির ভেতর থেকে করুন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। পুষ্পির আর বুঝতে বাকি থাকে না কি হয়ে গিয়েছে। সে বুকের ভেতরের শূন্যতা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। জোড়ে জোড়ে দুবার শ্বাস নিয়ে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারার ক্ষমতা রাখে না।
পুষ্পিকে তার খালা দেখতে পেয়ে বাহিরে ছুটে আসে। ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। বারবার করে বলতে লাগে, “মা আর নাই রে পুষ্পি, মা আর নাই!”
পুষ্পি একেবারেই নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এমনকি কাঁদতেও পারছে না। ওর মনে হলো, ও বোধহয় এই পৃথিবীতেই নাই! ওর দেহটাও ওর সাথে নাই। এরপর আর কিছুই আর তার আয়ত্তে রইলো না। না মন, না মস্তিষ্ক। সেন্স হারালো ওখানেই।
পুষ্পিকে ভেতরে নিয়ে গেল সবাই মিলে।
শাহরিয়ার বাহিরেই রইল। কি হবে ভাবতেই পারছিল না। সেই পরিস্থিতিটা সামাল দিতে গিয়ে নিজেই ঘাবড়ে যেতে লাগল। পুষ্পির দুশ্চিন্তায় পাগলপ্রায় হয়ে গেল। সে তো জানে এই মানুষটা পুষ্পির কতখানি প্রিয় ছিল পুষ্পির, কি ছিল পুষ্পির জীবনে, কত প্রখর ছিল পুষ্পির জীবনে তার ভূমিকা। মানুষটা বাড়ির ভেতরের দিকে চায়। কী অবস্থা মেয়েটার? জ্ঞান কি ফিরেছে? মেয়েটার কষ্ট তাকে বিমূঢ় করে দিচ্ছে। মনটা বিষাদে ছেঁয়ে যাচ্ছে। মাথা ধরে যাচ্ছে প্রচন্ড চিন্তায়! পরক্ষণেই ভাবে, “একটুও ভেঙে পড়তে দেবে না সে মেয়েটাকে। নিশ্চয়ই আগলে রাখবে সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। কেবল আল্লাহ সহায় হলেই চলবে।”
(চলবে)…….