#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পঞ্চম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
পুষ্পি বিয়ের পর এতদিনে প্রাণচ্ছল এক তরুনী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু শায়লা বেগমের মৃত্যুর পর পুনরায় কেমন যেন নিশ্চুপ, প্রাণহীন হয়ে গেল। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। কেউ এসে কথা বললেও প্রতিত্তুর না করে, বিনাবাক্য ব্যয়ে সব শুনে যায়।
শাহরিয়ার খুব করে আগলে রাখার চেষ্টা করে। আগে যেখানে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরত, আজকাল সেখানে বিকেলেই ফিরে আসে। নানান হাস্যরস যুক্ত কথায় পুষ্পির মন ভালো করার বৃথা চেষ্টা করে। পুষ্পির কবিতা ভীষণ পছন্দ। শাহরিয়ার মেয়েটার পছন্দ অত্যাধিক প্রাধান্য দেয়। সে পুষ্পির পাশে বসে কবিতা আবৃতি করে। বইটা বন্ধ করে পুষ্পির কাছে ঝুঁকে বলে, “আমি যদি জীবনানন্দ হতাম, ‘নাটোরের বনলতা সেন’ এর মতো ‘হৃদয়ে নিমজ্জিত পুষ্প’ নামে একটা কাব্য রচনা করে ফেলতাম। কিংবা যদি হতাম কোনো বিখ্যাত লেখক বা গল্পকার, তোমার অশ্রুস্নাত চোখে মজে ‘পুষ্পাক্ষী’ নামক গ্রন্থ রচনা করে ইতিহাস গড়ে ফেলতাম। কী আফসোস, কী আফসোস! এদিকে তাকাও তো পুষ্প! অন্তত একটু ওই চোখে চেয়ে আফসোস-আক্ষেপ ঘুচাই!”
পুষ্পির মন বোধহয় গলে অশ্রু হয়ে যায়। শাহরিয়ারের কাঁধে মাথা রেখে হুহু করে কেঁদে ওঠে।
শাহরিয়ার আদর করে বলে, “কেঁদো না প্লিজ। প্রিয়তমার মেঘাচ্ছন্ন মুখশ্রী আর নিতে পারছি না।”
তারপর জীবনানন্দের একটা কবিতা আবৃতি করে,
“তোমার চুলে যে রোদ- মেঘের মতো চুল
তোমার চোখে যে রোদ- সেও যে মেঘের মতো চোখ
কেমন বৃষ্টি ঝরে- মধুর বৃষ্টি ঝরে
ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে- রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ!”
পৃথিবীর বুকে ছোট্ট একটা ঘর, ভরসা করা কাঁধ, আর….আর শান্তনার বাণী যেন! এমন নজরকাঁড়া মুগ্ধতায় ভেসে যাক মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বিষন্ন রমনীর বিষন্নতা।
পুরোদমে বৈশাখী তান্ডব শুরু হয়েছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। সেই মাঝরাত থেকে বরষণ শুরু হয়েছে এখন অব্দি চলছে। শেষ রাতের পরে মেয়েটা ঘুমিয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠেছে। শাহরিয়ার নিজেও ঘুমায়নি। অনবরত শান্তনা দিয়ে গিয়েছে। শান্ত করে গিয়েছে। বুঝিয়েছে, এই পৃথিবীতে ও একা না। কেউ একজন আছে ওর। বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে বলেছে, “আমি আছি তো। আছি না আমি? কিসের এত দুঃখ? আমি থাকতে কোনো দুঃখ নাই, কোনো দুঃখ নাই।”
পুষ্পি বাধভাঙা অশ্রুযুগলে চেয়ে, রুদ্ধ কন্ঠস্বরে বলেছে, “আমি নানুকে কখনোই বলিনি তাকে আমি কত ভালোবাসি। সে আমার জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”
শাহরিয়ার ভীষণ ভাবে অনুভব করে ওর কষ্ট। কিন্তু তাও আর এই দুঃখিনী বউয়ের দুঃখ আর সহ্য হচ্ছে না তার। বলে, “আমাকে বাসো না ভালো?”
পুষ্পি বাহুডোরে আবদ্ধ থেকেই, চুপ করে থাকে। শাহরিয়ার পুনরায় বলে,
“আমি তোমাকে অত্যাধিক ভালোবাসি, পুষ্প। তোমার কান্না, তোমার কষ্ট আমায় পিড়া দিচ্ছে। কেঁদো না আর। তোমার এই সদ্য প্রেমে পড়া স্বামীর কষ্ট হচ্ছে, তা নিয়ে দেখি তোমার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই! তার যন্ত্রণা লাঘবেও কোনোরূপ ভাবান্তর নেই তোমার! এত নিষ্ঠুর হলে কি হয়? একটু সদয় হও প্রিয়তমা আমার।”
পুষ্পি কান্নার মাঝেই হেসে ফেলে। এমন পাগল মানুষ! এমন করে বললে কি কেউ বেদনাচ্ছন্ন থাকতে পারে? পারে না তো। পুষ্পিও পারেনি। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। দুজন একসাথে তাহাজ্জুদ এর নামাজ আদায় করে। তারপর শুতে আসে।
শাহরিয়ার পুষ্পির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, পুষ্পি ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটাও যেন ক্রমশ পাগল স্বামীর সংস্পর্শে পাগল হওয়ার পর্যায়ের চলে এসেছে। সে চোখ মেলে চায়। শাহরিয়ার পুষ্পির দিকেই চেয়েছিল। পুষ্পিকে তাকাতে দেখে আতংকিত হয়ে বলে, “না না প্লিজ! পুনরায় কাঁদিয়া-কাটিয়া জগৎ ভাসাইবেন না যেন। অনুগ্রহ করিয়া খানিক নিদ্রা যাপন করুন।”
পুষ্পি ফিক করে হেসে ফেলে। সে নিশ্চিত হয়ে যায়, এই মানুষটার সামনে বিষন্ন থাকা সম্ভব নয়।
পুষ্পি তার মুগ্ধ করা কথার বানে ফেলে শাহরিয়ারকে। শান্ত কন্ঠে বলে, “আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। আমি বৃষ্টিতে ভিজবো। আপনি না করবেন না প্লিজ।”
মেয়েটা এমন করে বলল যে, শাহরিয়ার কিছুতেই অমত প্রকাশ করতে পারছে না। অথচ এটা একটা অমত প্রকাশ করার মতোই আবদার। শাহরিয়ার খুব অসহায় মানুষের মতো করে বলে, “পুষ্প? আমি বোধহয় আমার বাকি জীবনটাতে কখনোই তোমার কোনো বাক্য অগ্রাহ্য করতে পারব না। তুমি তোমার স্বামীকে একটু সমবেদনা জানাও তো। সে তার বাকিটা জীবন বোধহয় একজন অসহায় বউ-পাগল পুরুষ মানুষ হয়ে কাটিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। সো স্যাড ফর মি, সো স্যাড ফর ইউর স্বামী!”
পুষ্পি আর অবাক হয় না, তার স্বামীর এই অতি-অদ্ভুত কথায়। বরং শাহরিয়ারের আচরণে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিচ্ছে। সে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চায়। টেনে টেনে বলে, “যাহা বলিব, তাহা করিতেই বাধ্য থাকিবেন?”
শাহরিয়ার এবার পুরোপুরি নিজ ফর্মে চলে আসে৷ পাল্টা প্রতিত্তুর করে, “জি। আপনি সঠিক ধরিয়াছেন। আপনি চাহিলে আপনাকে উদাহরণ স্বরূপ বুঝাইতে পারি। ধরুন, আপনি যদি কখনো আপনার এই মধুর কন্ঠস্বরে আমার নিকট আসিয়া বলেন, ‘ওহে আমার প্রাণের স্বামী? এই বিষ মিশ্রিত খাদ্যটুকু গ্রহণ করিয়া, আমার মন-বাসনা পূরণ করুন।’
বিশ্বাস করুন প্রাণের বধূ? আমি আপনার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না। বিনাবাক্যব্যয়ে তাহা গলাধঃকরণ করিতে দু’বার ভাবিব না।”
পুষ্পি অনেকদিন পর খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে। বলে, “তার মানে কি আমার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে?”
শাহরিয়ার বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, “নিশ্চয়ই জনাবা। চলুন আপনার অদ্ভুত আবদার পূরণ করি।”
বৃষ্টি ভেজা রাতটা ‘মন খারাপ’ থেকে ‘মন ভালোতে’ বদলে গেল এক নিমিষেই।
পুষ্পি এক ছুটে ছাদে চলে এলো। তুমুল বর্ষণে ভেসে যাচ্ছে শহরটা। শাড়ির আঁচলটা এক পাশে উঠিয়ে আকাশের দিকে চাইল পুষ্প। টাপুর-টুপুর বৃষ্টিকণা তার ঝলমলে অঙ্গ ভেজাতে এক মূহুর্ত দেরি করল না।
শাহরিয়ার তখন হেলান দিয়ে ছাদের দরজায় দাঁড়ান। চোখে তার কাতর মুগ্ধতা! বুকের ভেতর তুমুল ঝড়! ঝড়ের বেগ এত দ্রুত বাড়তে লাগল যে, তার মনে হলো তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! মেয়েটাকে তার বৃষ্টি ভেজা জীবন্ত ফুল মনে হতে লাগল। যার পুরো আবরণে মুগ্ধতা বৈ কিচ্ছু নেই।
পুষ্পি হাতের ইশারায় শাহরিয়ারকে ডাকল। শাহরিয়ার বিপরীতে মৃদু হাসল। এই হাসি অন্য কিছু প্রকাশ করতে চাইছে কি? চাইছে বোধহয়। কিন্তু….কি তা?
পুষ্পি শাহরিয়ারের কাছে এলো। ওই ঝুমঝুম বৃষ্টির আওয়াজের মাঝেই চুপচুপ ভেজা রমনী তার স্বামীকে বলল, “ভিজবেন না? আসুন….”
বলেই শাহরিয়ারের হাত টেনে ছাদের মাঝে চলে এলো।
ভিজে গেল শাহরিয়ারও। তার কন্ঠে কোনো আওয়াজ আসছে না যেন! এ কেমন প্রেম হয়ে আবির্ভূত হলো মেয়েটি! এ কেমন নির্জীব হয়ে যাওয়া প্রেম!
মেয়েটার কপাল জুড়ে অবাধ্য কেশ। গোলাপি শাড়িটা লেপ্টে রইল সমস্ত শরীরে!
শাহরিয়ার এক হাতে পুষ্পির এক হাত ধরে। অন্য হাত দিয়ে কপাল আর গাল জুড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো সরায়। পুষ্পি শাহরিয়ারের দিকে চায়। মানুষটা এমন অদ্ভুত ঠান্ডা হয়ে গেল কেন?
শাহরিয়ার পুষ্পির কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু আওয়াজে কয়, “সুন্দরীতমা! তুমি বৃষ্টির চেয়ে সুন্দর। আমি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না নিজের উপর।”
এরপর দুঃখ-সুখের রাতটা ভেসে গেল এক তুমুল বর্ষণে। সেই সাথে ভেসে গেল শহরের একটা কোনে তৈরী হওয়া যুগলবন্দীর প্রেমকাব্য। এটাকে ভালোবাসার রাত হিসেবে আখ্যায়িত করলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে কি?
.
শাহরিয়ারের যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল নয়টা বাজে। দশটায় তার ক্লাস আছে৷ সে দ্রুত ঘুম থেকে উঠে বসে। দেরি হয়ে গিয়েছে আজ। পুষ্পিকে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই লক্ষ্য করে পুষ্পি তখনও ঘুমাচ্ছে! শাহরিয়ার প্রথমে কিঞ্চিত বিস্মিত হলো। পরক্ষণেই ভাবলো, সারারাত ঘুম হয়নি মেয়েটার, ঘুমাক একটু।
ভাবতে ভাবতেই মাথায় হাত রাখল। এবং আরেক দফা চমকে উঠল। শিওরে উঠল শরীর! প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুরে যাচ্ছে। জ্বর চলে এসেছে মেয়েটার! বৃষ্টিতে ভিজার এফেক্ট?
শাহরিয়ার দ্রুত কাউকে ফোন করল। এবং কলেজ যাওয়া ক্যান্সেল করল। প্রিন্সিপালকে কল করেছে সম্ভবত।
ফোন রেখে পুনরায় পুষ্পির মাথায় হাত রেখে নিচু স্বরে ডাকল, “পুষ্প! এই পুষ্প! শুনতে পাচ্ছ?”
পুষ্পি মৃদু আওয়াজ করল ঠিক, তবে কিছু বলতে পারল না। শাহরিয়ার প্রচন্ড অপরাধ বোধে ভুগলো। অতখানি সময় ধরে ভেজা ঠিক হয়নি। বলাবাহুল্য পুষ্পির অন্যায় আবদার প্রশ্রয় দেয়াটাও অনুচিত ছিল। এখন কী করবে ও?
শাহরিয়ার দিশেহারা হয়ে মাকে ডাকল, “মা? ও মা!”
সাবেরী খাতুন ছুটে এলো। -“কিরে বাপ?”
শাহরিয়ার বিচলিত হয়ে বলে, “নরম কিছু তৈরি করে দাও তো মা। একটু ফলটলও কেটে দিবা মা? পুষ্পর ভীষণ জ্বর।”
সাবেরী খাতুনও বিচলিত হয়ে যায়। ছুটে এসে পুষ্পিকে পরক্ষণ করে। সত্যিই খুব জ্বর। তিনি বলেন, “এক্ষুনি নিয়ে আসছি আমি। তুই একটু মাথায় পানি দে ওর। ইশশ! কেমন করে জ্বর বাধাল আবার!”
শাহরিয়ার ততক্ষণে একটা বোলে পানি নিয়ে নিয়েছে। মাকে বলে, “তুমি দ্রুত কিছু নিয়ে আসো মা, আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।”
সাবেরী খাতুন যেতেই শাহরিয়ার পানি নিয়ে পুষ্পির কাছে আসে। শরীরে ভারি কাথা দিয়ে গালে হাত রাখে। দুঃসময় যেন পিছুই ছাড়ছে না মেয়েটার!
পুষ্পির কিঞ্চিৎ চেনতা ফিরে আসে তখন।
শাহরিয়ার আলতো স্বরে বলে, “বেশি খারাপ লাগছে? আই এম স্যরি!”
পুষ্পি নিভুনিভু চোখ মেলে চায়। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে, “আপনি অস্থির হবেন না। আমি…আমি ঠিক আছি।”
শাহরিয়ারের এই কথাটা একদমই ভালো লাগেনি। মাথায় পানি দিতে দিতে বলে, “কিচ্ছু ঠিক নেই। একদম কথা বলবে না পুষ্প। চুপ করে থাকো প্লিজ।”
পুষ্পির কিছু বলার শক্তিও নেই। শরীরটা কেমন গুলিয়ে আসছে। তাও বলে, “আপনার তো কলেজ আছে!”
শাহরিয়ার পুষ্পির চুলে হাত বুলায়। উষ্ণ কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। কন্ঠে দরদ ঢেলে বলে, “চুপ! এই মূহুর্তে তোমার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই।”
(চলবে)……