#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_১৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
কুয়াশাচ্ছন্ন হেমন্তের বিকেলে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল শাহরিয়ার সদস্যরা। লঞ্চঘাট অব্দি যাওয়ার জন্য একটা মাইক্রো ভাড়া করা হলো।
পুষ্পি চুপিসারে এক ফাঁকে শাহরিয়ারকে বলল, “আমি কখনো লঞ্চে উঠিনি। আমার ভয় লাগছে।”
শাহরিয়ার মৃদু হেসে বলল, “কোনো ভয় নেই। আছি তো আমি৷ খুব মজা পাবে, দেখো।”
পুষ্পি যে আশ্বস্ত হয়েছে, তার প্রতিচ্ছবি সমস্ত মুখে ফুটে উঠল।
সামনের সিটেই শাফিন আর মুনমুন ননস্টপ ঝগড়া করে যাচ্ছে। মুনমুন লঞ্চঘাট যাওয়ার আগেই বার কয়েক বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছে। শাফিনের সাথে কোনোমতেই বনিবনা হচ্ছে না।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। এবং তারা লঞ্চঘাট যাওয়ার আগেই মাগরিবের আযান পরে গেল। গাড়িটা একপাশে থামিয়ে ছেলেরা জামাতে নামাজ আদায় করতে গেল। আর মেয়েরা মাইক্রোতেই পড়ে নিলো।
লঞ্চঘাট পৌঁছেই শাহরিয়ার প্রথমে দুইটা কেবিন নিলো। একটা ডাবল, একটা সিঙ্গেল। সবাইকে ভেতরে বসিয়ে দিয়ে কিছু খাবার-দাবার কিনল শাহরিয়ার। লঞ্চের ভেতরেই সব পাওয়া যায়। ছাড়ার আগ দিয়ে কেবিনে গেল শাহরিয়ার।
শাহরিয়ার যেতেই পুষ্পি বলল, “আপনি কোথায় ছিলেন? খুব সুন্দর লঞ্চটা। আমায় একটু ঘুরিয়ে দেখান।”
শাহরিয়ার বলল, “দেখাবো, আরেকটু পর।”
সকলে তখন একত্রেই ছিল। মুনমুন বলল, “ভাইয়া আমাকেও নিও সাথে।”
শাফিন ফোড়ন কেটে বলল, “চলো আমি তোমাদের ঘুরিয়ে দেখাই।”
মুনমুন বলল, “কক্ষনো না। তোমার সাথে কে কোথায় যায়? আমি কিছুতেই যাব না ”
শাফিন উল্টো পাট নিয়ে বলল, “হাহ্! তোরে ঘুরায় দেখাইতে যেন আমি বইসা আছি? আমি তো আমার পেয়ারি ভাবীজানরে কইলাম।”
অন্যদিকে আবার সাবেরী খাতুন আর হাসনাত সাহেবও তুর কালাম বাঁধিয়ে ফেলেছে। তুলকালামের সূত্রপাত পান খাওয়া নিয়ে। সাবেরী খাতুনের পানের পিক কিঞ্চিৎ এসে লেগেছে হাসনাত সাহেবের পাঞ্জাবিতে। হাসনাত সাহেব বলে ফেললেন,”বেকুবের মতো কাজকারবার তোমার। দিলা আমার পাঞ্জাবীটা নষ্ট করে। পটে পিক ফেলবা, তাও ঠিকঠাক পারো না।”
বরাবরের মতোই সাবেরী খাতুন রেগে আগুন৷ তিনি বললেন, “কি বললেন আপনে? বেকুব কইলেন আমারে? সামান্য একটু পানের পিক সহ্য হয় না এখন আপনার। আগে তো আমার পান খাওয়া ঠোঁটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকতেন! আর এখন…!”
বলেই গুনগুন করে কান্না করতে শুরু করল। বেচারা হাসনাত সাহেব আর শাহরিয়ার ছাড়া সকলে মিটিমিটি হাসতে লাগল। সাবেরী খাতুন পুনরায় বিলাপ করতে লাগল, “হায় খোদা! এ কেমন মানুষের সাথে এতগুলো বছর কাটায় দিচ্ছি। আমার মরন হয় না কেন!”
হাসনাত সাহেব পড়লেন ফ্যাসাদে। তিনি অসহায় মুখে বলল, “ওই দেখো! এখানে আবার মরন-টরন এলো কোত্থেকে! আচ্ছা আমার ভুল হইছে, নেও পাঞ্জাবীতে আরো পিক ফেলো।”
শাহরিয়ার বিরক্ত হয়ে বলল, “যেখানে যায়, সেখানেই ঝগড়া! এই সবাই বেড়িয়ে আয়, ওনারা ঝগড়া করুক।”
হাসনাত সাহেব বললেন, “আমার কি দোষ! তোমার মা….”
পুরো কথা শেষ করার আগেই সাবেরী খাতুন বলে উঠলেন, “হ্যাঁ। দোষ তো সর্বদা আমারই।”
তাদের ঝগড়া চলমান।
শাহরিয়ারের কথা মোতাবেক সবাই বেড়িয়ে আসে। ভেতর থেকে সাবেরী খাতুনের কান্না বাড়ে বৈ কমে না।
পুষ্পি আস্তে আস্তে শাহরিয়ারকে বলে, “একটা ব্যপার লক্ষ্য করেছেন? প্রত্যেকবার বাবা প্রথমে উস্কে দেয়। এরপর মা যখন রেগে যায় তখন নিজে চুপ হয়ে যায়।” বলেই ফিক করে হেসে দেয়।
শাহরিয়ার আড়চোখে চেয়ে বলে, “ও! নিজে মেয়ে তো তাই মায়ের সাপোর্ট করছো, তাই না? পুরুষ মানুষ যে কত অসহায় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আমার বাপ আর আমি।”
বাপ অব্দি ঠিক ছিল। কিন্তু শাহরিয়ার নিজেকেও যখন আসামি হিসেবে উপস্থাপন করল তখনই বাধল ব্যাঘাত। পুষ্পি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, “আপনি মানে! তার মানে আপনি আমার কাছে অসহায়? আপনি কি বোঝাতে চাইলেন আমি আপনার সাথে ঝগড়াঝাটি করি?”
শাহরিয়ার বলল, “সত্য কথা বললে তো এখন আবার রাগ করবা। তার চাইতে উত্তম চুপ থাকা।”
হিতে বিপরীত বলে একটা কথা আছে না? পুষ্পির বেলাতে ঘটল সেটা। পুষ্পি সাবেরী খাতুনের মতো কাঁদল-কাটল না ঠিক। তবে গাল ফুলিয়ে রইল।
কি ভাবছেন? শাহরিয়ার রাগ ভাঙাতে তোষামোদ করেছে? মোটেও না। বরং সে পুষ্পির এই মুখ ফুলিয়ে রাখাটাই বেশি ইনজয় করছিল। তাই তো নিরবে মুখ টিপে হাসল। তার পুষ্পির এই অভিমানী স্বভাবটাই বেশি ভালো লাগে। আদুরে লাগে, আহ্লাদী লাগে।
মুনমুন আর শাফিন অনেক আগেই শাহরিয়ারদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু মধ্যখানে শাফিনকেও ফাঁকি দিয়ে মুনমুন আলাদা হয়ে গেল। তার মাথায় কানটুপি, কানে ইয়ারফোন, গলায় স্কার্ফ, পরনে ভারি শীতের পোশাক। হুহু করা শীত এসে চোখেমুখে লাগছে। বন্ধুবান্ধব ছাড়া এই সুন্দর ভ্রমণ সে পুরোপুরি আমোদের সহিত উপভোগ করতে পারছে না। পরপর দুবার ডায়েল করলো মিয়াদের নাম্বারে। কল রিসিভ করেই ওপাশ থেকে কিশোর কন্ঠে ভেসে এলো, “হ্যালো, জান!”
মুনমুন বলল, “হুম। কী করিস? কল রিসিভ করতে লেইট কেন?”
ওপাশ থেকে ভেসে আসে, “মিস করি তোরে। কল দেখে আবেগে দিশেহারা হয়ে গেছিলাম তো তাই।”
কথায় স্পষ্ট দুষ্টুমি।
মুনমুন নখ খুঁটতে খুৃঁটতে বলে,”ফাইজলামি করিস? আবার ইনবক্সে কারো সাথে ফ্লার্টিং করছিস না তো?”
মিয়াদ কাতর স্বরে ভালো মানুষের মতো করে কয়, “এই না! কসম!”
মুনমুন বলে, “আচ্ছা বাদ দে। আমি সিরিয়াসলি তোদের মিস করছি। স্পেশ্যালি তোকে। তোরা সবাই থাকলে কত্ত মজা হতো।”
মিয়াদ বলতে লাগে, “ব্যাপার না। ইনজয় ইউর….”
“এখানে কি করিস তুই একা একা?” শাফিনের কন্ঠ শুনে মুনমুন চমকে গিয়ে দ্রুত কল কেটে দাঁড়ায়।
মুনমুন বলে, “কই! কিছু না তো। ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলি।”
শাফিন নিশ্চিত রহস্য খুঁজে পায়। ভ্রু নাড়িয়ে বলে, “বিশেষ ফ্রেন্ড? এই তুই প্রেম-ট্রেম করতেছিস নাকি রে?”
শাফিনের এমন সোজাসাপ্টা প্রশ্নে মুনমুন আরো ঘাবড়ে যায়। সে বলে, “ফালতু কথা বলবা না তো। আমার পারসোনাল ব্যপারে কথা বলবা না।”
শাফিন মুনমুনের মাথায় চাটি মেরে বলে, “লিলিপুট একটা! কথায় না পারলে এহনও ম্যা ম্যা কইরা কান্দে! তোর আবার কিয়ের পারসোনাল ম্যাটার রে? চল, নিচে চল।”
মুনমুন শুধু পারে না শাফিনকে ধাক্কা মেরে লঞ্চ থেকে নিচে ফেলে দেয়। বিড়বিড় করে বলে, “অসহ্য একটা।”
.
লঞ্চের ছাদে এসে পুষ্পির মনটাই ভালো হয়ে গিয়েছে। এত শান্তি লাগছে! যদিও প্রথমে একটু ভয় লেগেছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ভয় কেটে যায়। ছাদে অনেক মানুষ নিচে বিছানা করে কেউ কেউ বসে আছে, শুয়ে আছে, দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্পির পরনে সোয়েটার, শাল, কানটুপি সবই আছে, তাও ফিনফিনে ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। গারো অন্ধকার আর কুয়াশায় বেশি দূরের কিচ্ছু দেখা যায় না। পুষ্পি বলে, “হুহ্ ….ঠান্ডা অনেক তাই না?”
শাহরিয়ার হাসে৷ নিজের দুহাত একত্রে সংঘর্ষ করে গরম করে। তারপর তা পুষ্পির গালে রেখে বলে, “হুম। অনেক ঠান্ডা। চল এবার।”
পুষ্পি আবদার করার মতো করে বলে, “উম…আরেকটু থাকি। ভালো লাগছে।”
কুমকুমে শীতের রাত, মনোরম পরিবেশ।
শাহরিয়ার শক্ত করে পুষ্পির হাত ধরে থাকে৷
দূরে তাকাতেই দেখতে পায় একজোড়া বৃদ্ধ জুটি। বৃদ্ধটির বয়স আনুমানিক আশি, আর বৃদ্ধার ষাটোর্ধ। শুভ্র চুল, কুঁচকানো চামড়া অথচ অমলিন প্রণয়। বৃদ্ধ কাঁপাকাঁপা হাতে পরম যত্নে বাদাম ভেঙে দিচ্ছে আর বৃদ্ধা অল্পসংখ্যক দাঁতের সাহায্যে তা খাচ্ছে। একটা বাদাম ভাঙতে তার মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে, তাও যেন সে খুব আমোদিত এই কাজ করতে পেরে। বৃদ্ধা খুব জোর করছে, কাঁপাকাঁপা গলায় বলছে, ”আমারে দেন। আমি পারুম তো।”
বৃদ্ধ কি আর সে কথা শোনে?
পুষ্পি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে বলে, “কি সুন্দর, না?”
শাহরিয়ার প্রবল আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে, “হুম। একদিন তুমি আর আমি।”
পুষ্পি তাচ্ছিল্যের সহিত বলে, “ইশশ!”
শাহরিয়ার মুখ বাঁকিয়ে হাসে। কিছুটা ছন্দ করে বলে, “কুয়াশা ভরা রাতের আকাশ সাক্ষী রেখে কই, তোমার সাথেই এই জীবনে বৃদ্ধ হতে চাই।”
এটুকু বলেই নিজে নিজের সুনাম করে বলল, “বাহ! সুন্দর ছন্দ বানিয়েছি তো! তোমার থ্রুতে কবি হয়ে যাচ্ছি বোধহয় দিন দিন।”
পুষ্পি মুখে হাত রেখে কিটকিট করে হাসে।
হঠাৎ তখনই নিচ থেকে চেঁচামেচি ভেসে আসে। অর্থাৎ লঞ্চের দোতলায় কিছু একটা হয়েছে। ঘটনা কি দেখতে দুজন নিচে চলে আসে। এসেই দেখতে পায় ঢালায় অনেক মানুষ শুয়ে-বসে আছে। তাদের মাঝে মধ্যবয়সী একজন বিলাপ করে কাঁদছে আরেকজন কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছে।
শাহরিয়ার আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞেস করে যা জানতে পারে তার সারাংশ হলো, মধ্যবয়সী লোকটার গৃহপালিত হাঁস পানিতে ঝাপ দিয়েছে। যার জন্য কিঞ্চিৎ দ্বায়ী কাঁচুমাচু মুখ করে বসে থাকা মধ্যবয়সী রমনী। কারণ হাঁসের কষ্ট হচ্ছে ভেবে সে পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। বেচারা একদিকে বকাঝকা করছে অন্যদিকে আর্তনাদ করে কাঁদছে। ব্যাপারটা কারো কারো কাছে হাস্যকর ঠেকলেও পুষ্পি নরম মন স্পর্শ করলো ঘটনাটি। সে বলল, “মানুষ তার প্রিয় জিনিস নিয়ে কত আবেগপ্রবণ, তাই না? হোক তা সামান্য, অসামান্য যা কিছু!”
শাহরিয়ারের মন ছুঁল পুষ্পির কথাটি। সে বরাবরের মতোই তার কমন কাজটি করল। পুষ্পির মাথায় হাত রেখে বলল, “হুম।”
অন্যপাশেই এক জোড়া কপোত-কপোতী দেখা গেল। লাজুক রমনী, পরনে তার লাল রঙের শাড়ি, ঠোঁটে গাড় লিপস্টিক, হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে! তার পাশেই ইতস্তত মুখ করে রাখা এক যুবক। যুবকটি মৃদুমন্দ হেসে হেসে রমনীকে কিছু বলছে বোধহয়, আর রমনী তা নতজানু হয়ে শুনছে আর লাজুক হাসছে।
পুষ্পি এই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখে। আর শাহরিয়ার দেখে পুষ্পিকে। সাধারণ জিনিসগুলোও যেন মেয়েটার চোখে অসাধারণ ঠেকে। সকল কিছুই সে মুগ্ধচিত্যে দেখে। আর তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা এক চিলতে হাসি তার সাথের পুরুষটাকে বিমোহিত করে।
কত বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর সকল মুগ্ধ হওয়ার গল্প!
কেবিনে ফিরে যাওয়ার পথে শেষবারের মতো আশেপাশে তাকাতেই দেখল, একজন শেষ বয়সী বৃদ্ধা লঞ্চের একেবারে কিনার ঘেঁষে বসে গুনগুন করে গান গাচ্ছে। দাঁত নেই তাও কুটকুট করে পান খাচ্ছে। পানের পিকে ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল হয়ে আছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে। এত মায়া লাগল পুষ্পির। তার নানুর কথা মনে পড়ে যায়। চোখ ছলছল হয়।
পুষ্পি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “নানু, আপনার সাথে কেউ নেই?”
বৃদ্ধা আনমনা হয়ে বলল, “এই দুইন্নাইতে কেউ কারোর না গো। সব খালি মোহ-মায়া! এই দ্যাহ, আমারে! এককালে সব আছিল, এহন কেউ নাই। সব য্যান হাওয়া হইয়া উইড়া গ্যাছে। এইডাই হইলো মোহ-মায়ার খেলা।”
বলেই কিটকিট করে হাসে। আর গুন গুন করে গায়, “আইজ আমি একা, নাই সহ-সহায়….হু..হু…হু”
পুষ্পির মন ‘মন-খারাপে’ আচ্ছন্ন হলো।
শীতের এই রাতটা পুষ্পির জন্য স্বরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। একটা জার্নিতে সে অনেক অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। কত ধরনের মানুষের বসবাস এই ধরায়! কত কত মায়ার মানুষ! কত প্রেম-প্রণয় মানব মনে। কত ক্ষুদ্র মানুষের চাওয়া-পাওয়া। এবং কত দুর্বিষহ পরিস্থিতি আর অপ্রাপ্তি নিয়েও বিনা অভিযোগে মানুষ বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকার তাগিদে….!
(চলবে)….