একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0
13

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#অন্তিম_পর্ব
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

হেমন্তের শেষ সময়। শীতের প্রকোপ শুরু হয়নি। আরও কিছুদিন সময় নিবে হয়তো এই প্রকোপ বাড়তে। কিন্তু যেই তান্ডব এই ছয়টা মাস শাহরিয়ারের জীবনে বয়ে গিয়েছে তা বোধহয় সে তার জীবনে কেটে যাওয়া এতগুলো বসন্তের কোনো ঋতুতে দেখেনি! ঋতুর পালাবদল আর জীবনের পালাবদলের ছন্দ এক হয় না মানুষের জীবনে। এই যেমন প্রচন্ড গরমেও জীবনে শীতলতা বয়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে হাড় কাঁপানো শীতেও তরতর করে ঘামতে পারে শরীর, মন, মস্তিষ্ক! বসন্তের সৌন্দর্য যেখানে প্রকৃতিতে ঢেউ খেলে সকলকে মাতিয়ে রাখার আয়োজনে মত্ত হয়, সেখানে জীবনে বয়ে যেতে পারে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়! শাহরিয়ারের সাথে ঠিক এমনটাই হচ্ছে। তার জীবনের টাইমিংটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না। সব কেমন উলোট-পালোট!

পুষ্পি, তার বউ; যাকে সে তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে পিক করে। যেই মেয়েটার হাসি তার জীবনে চাঁদের আলো বয়ে আনে, যেই মেয়েটার অস্থিরতা তাকে অস্থির করে তোলে, সেই মেয়েটার অসুস্থতা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। পুরুষ মানুষ নাকি কাঁদে না। কিন্তু এই ছয়মাসে শাহরিয়ার বহুবার কেঁদেছে। তবে যতটা সম্ভব আড়ালে!

বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার পরও যখন পুষ্পির তেমন কোনো বিশেষ রোগ ধরা পড়ছিল না তখন খানিক চিন্তিতই হয়ে পড়ল সকলে। বেশ কিছু টেস্ট করানোর পরে ধারণা করা হলো সম্ভবত ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত পুষ্পি। কিন্তু এত অল্প বয়সে এটা কেউ এক্সেপ্ট করতে পারছিল না। পরে যখন জানা গেল যে পুষ্পির মায়েরও এই একই সমস্যা ছিল। তখন জানানো হলো, অনেক সময় জিনগত কারনে এই সমস্যা সন্তানদের মাঝেও দেখা দিতে পারে। পুষ্পির ক্ষেত্রেও হয়তো জেনিটিক্যালি বিষয়টি ঘটেছে। এমনকি রিসেন্ট বেশকিছু গবেষণায় জানা গিয়েছে, এই রোগটা এখন ইয়াংদের ভেতরও দেখা দিচ্ছে। এছাড়া মানসিক অবসাদ সহ আরও নানাবিধ সমস্যাও পুষ্পি মাঝে দেখা দিচ্ছে। এবং শাহরিয়ারকে এও জানানো হয়, পুষ্পি কোনো কিছু নিয়ে বা কোনো বিষয় নিয়ে খুব প্রেশার ফিল করছে। মানসিকভাবে কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো খুব চিন্তিত যার ফলে তার মাঝে প্রতিক্রিয়াটা বেশিই দেখা দিচ্ছে। যেকোনো ভাবে ওকে রিল্যাক্স রাখতে পারলে এই সমস্যা অনেকটা সমাধান করা সম্ভব। ওকে জাস্ট ওর মতো থাকতে দিতে হবে, রিল্যাক্স থাকুক, যা ইচ্ছে করুক। এটা মেজর কোন ইশু না, আবার সামটাইমস খুবই ডেঞ্জারাস।
আহসান আরও বলে, তুই জাস্ট ওকে কিছুদিন অবজারভেশনে রাখ, নিজে দেখ, বুঝ। ইনশাআল্লাহ, ফি আমানিল্লাহ। সব হয়তো পুরোপুরি ঠিক হবে না, তবে এটা মেন্টেইন করা সম্ভব। মেডেসিন গুলো ঠিক মতো দিস, আর একটু খেয়াল রাখিস, দ্যাট’স এনাফ।

শাহরিয়ারের প্রথমে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো। পুষ্পি কী নিয়ে ডিপ্রেসড, যা সে জানে না! পরে বিষয়টি ও ওর নিজের মতো নরমালাইজ করে নিল। এছাড়া পুষ্পিকে স্বাভাবিক রাখতে হলে প্রথমে তার নিজেকে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। এছাড়া আহসান যেই ইন্সট্রাকশন গুলো দিয়েছিল, সেগুলো ওর জন্য মেজর কোনো ইশু ছিল না। পুষ্পি ওর এমনিতেই আদরের, যত্নের। এই যত্নের পরিধি আরও একটু বৃদ্ধি করাটা ওর জন্য বৃহৎ কোনো বিষয় নয়। সে যথাসাধ্য পালনও করছিল তার দ্বায়িত্ব। হঠাৎ হঠাৎ, অনেকদিন পর পর একটু অন্যরকম আচরণ করলেও তখন অব্দি ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক হিসেবেই নিচ্ছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে হঠাৎ একদিন যখন জানতে পারল ডিমেনশিয়ার প্রকোপের কারনেই পুষ্পির মা সুইসাইড করেছিল! তখন থেকে শাহরিয়ার আতঙ্কগ্রস্থ হতে আরম্ভ করল। এবং তার এই দুশ্চিন্তার মাত্রা বাড়ানোর জন্য পুষ্পির পরবর্তী দ্রুত পরিবর্তনই যথেষ্ট ছিল।
অফিসের কাজে একটু ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে শাহরিয়ার সময় দিতে পারছিল কম পুষ্পিকে। আর পুষ্পির সমস্যাটা আবার বৃদ্ধি পেতেও শুরু করে তখন। পুষ্পির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আমুল পরিবর্তন আসতে শুরু হলো। শান্ত-ধীরস্তির মেয়েটা হয়ে যেতে আরম্ভ করল অস্থির। কেমন যেন ছটফটে। সব কিছু যার মুখ বুঝে সহ্য করার ক্ষমতা ছিল, সে কিনা হয়ে উঠল রগচটা!

শাহরিয়ারের জন্য পুষ্পির এই আমুল পরিবর্তন ছিল তান্ডবের ন্যায়! তার ব্যস্ততার বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরে সে মাঝেমাঝেই ক্লাস অফ দিয়ে পুষ্পিকে সময়ও দিতে লাগল। কিন্তু এতে কিছুদিন ভালো থাকলেও এটা স্থায়ী সমাধান ছিল না। ডাক্তার তো দেখাতেই লাগল। কিন্তু এতেও বিপত্তি বাঁধল। পুষ্পি একদিন খুব ঝামেলা করল, “আপনার কি আমাকে পাগল মনে হচ্ছে বাসার সবার মতো? সত্যিটা বলে দিন না! দু’দিন পর পর হসপিটাল যেতে যেতে আমি ক্লান্ত। আমাকে পাগল প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন কেন আপনারা সবাই? কী করেছি আমি? কী ক্ষতি করেছি কার?”
শাহরিয়ার হতভম্ব হয়ে গেল। মানে পুষ্পি বাসার সবাইকে ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ভাবতে শুরু করেছে! শাহরিয়ার খুব শান্ত থেকে বলল, “ঠান্ডা হও। দেখ, তুমি যা চিন্তা করছো এমনটা কেউ ভাবছে না। ট্রাস্ট মি জান! এটা জাস্ট রেগুলার চেক-আপ। আমিও তো করাচ্ছি। করাচ্ছি না বলো?”
শাহরিয়ার যতই বুঝাক। পুষ্পি বুঝতে রাজি না। সে তার ভাবনাতেই অনড়। এরপর আহসানের সাজেশন অনুযায়ী, যখন যখন পুষ্পির মুড ভালো থাকতো, এবং সে নিজ ইচ্ছায় যেতে চাইতো তখন তখন নিয়ে যেত হসপিটাল।

এরপরের ঘটনাটা ছিল শাহরিয়ারের জন্য অপ্রত্যাশিত। অন্যান্য দিনের মতোই শাহরিয়ার ক্লাসে গেল। যাওয়ার আগে মা আর বোনকে বলে গেল পুষ্পির খেয়াল রাখতে। সাবেরী খাতুন বিকেলে পুষ্পির মাথায় তেল দিয়ে দিল। টুকটাক কথা বলল। পুষ্পির বিহেভিয়ার নরমাল-ই। কিন্তু মাঝে মাঝে কি যেন হয় মেয়েটার। হঠাৎ পুষ্পি বলল, “মা, রুমে যাই?”
সাবেরী খাতুন পুষ্পিকে স্বাভাবিক দেখে আর আপত্তি করলেন না।
শেষ বিকেলে শাহরিয়ার ঘরে প্রবেশ করেই জানতে চাইল, “পুষ্প কই?”
মুনমুন জবাব দিল, “রুমে।”
শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করলেন, “সব ঠিকঠাক?”
মুনমুন বলল, “হুম। সব ওকে। মা খানিকক্ষণ আগে তেল দিয়ে দিল চুলে।”
কিন্তু শাহরিয়ার রুমে প্রবেশ করে কিচ্ছু ‘ওকে’ দেখল না। পুষ্পি নিজে নিজের চুল কাটছে এলোমেলো ভাবে।
শাহরিয়ার ছুটে গিয়ে পুষ্পিকে আটকানোর চেষ্টা করলো। এতে ঘটলো হিতে-বিপরীত। পুষ্পি রেগে গেল। বলল, “আমি নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারি না কেন? এই চুল আমার বিরক্ত লাগছে।”
কেঁচি নিয়ে টানাটানির ফলে শাহরিয়ারের হাতও একটু কেঁটে গেল। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নাই। পুষ্পির চুলগুলো, পুষ্পির চাইতেও ছিল তার বেশি প্রিয়। কিন্তু কেবলই পুষ্পির মানসিক শান্তির কথা চিন্তা করে নিজেই বলল, “আমার কাছে দাও, আমি কেঁটে দেই। তুমি পার্ফেক্টলি পারছো না পুষ্প!”
পুষ্পির মেজাজ কিছুটা ঠিক হলো। শাহরিয়ার নিজে পুষ্পির কোমর সমান চুল গুলো কেঁটে কাঁধ অব্দি নিয়ে এলো। এই কাজটা করা তার জন্য কতটা কষ্টসাধ্য ছিল, তা কি কেউ ধারণা করতে পারবে? উঁহু, পারবে না!
পরবর্তীতে পুষ্পি নিজেই এই ঘটনা বেমালুম ভুলে গেল। কিন্তু খুব কষ্ট হলো, খুব! এত শখের চুলগুলো তার! কিন্তু সে এ ব্যাপারে কিছু জানতেও চায়নি কারো কাছে। কারণ তার অসুখের বিষয়ে ততদিনে তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল। শাহরিয়ার যখন ঘুমিয়ে গেল। পুষ্প চুপিচুপি কাঁদলো। জায়নামাজে কাঁদলো। এত কান্না, এত কষ্ট, আহহ!
সে ভাবলো, নির্ঘুম রাতের নির্জন অন্ধকারই কেবল এর সাক্ষী হয়ে রইল। অথচ পুষ্পি জানলো না, অন্যপাশের মানুষটাও তার নির্ঘুম রাতের সঙ্গী। তার সকল কিছুই যে, মানুষটারও ভীষণ শখের! এই মেয়েটার দুঃখ, এই মানুষটার চাইতে আর কাকে বেশি স্পর্শ করবে!

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর অন্য আরেকদিন, হঠাৎ পুষ্পির হাত থেকে পরে একটা কাঁচের সোপিস ভেঙে যায়। শাহরিয়ার তখন ওয়াশরুমে ছিল। বের হয়ে দেখতে পায়, পুষ্পির হাত রক্তাক্ত। নিচে পরে আছে ভাঙা রক্তাক্ত কাঁচ।
শাহরিয়ার আতংক নিয়ে জানতে চাইলো, “পুষ্প, কী হয়েছে? এ কি করেছো?”
পুষ্পি কেমন জড়সড় হয়ে বলল, “আমি কিছু করিনি!”
শাহরিয়ারের ভয় সেদিন আরও গাঢ় হলো। তার অনুপস্থিতিতে পুষ্পি যা কিছু করে ফেলতে পারে; এই ভয়টা আরও বৃদ্ধি পায়।
শাহরিয়ার ততদিনে বুঝে গিয়েছিল এই পরিস্থিতিতে পুষ্পিকে কিভাবে শান্ত করা যায়। সে পুষ্পিকে শান্ত করে, ড্রেসিং করায়। ওইদিনই সে রুম থেকে সকল কাঁচের জিনিস সরিয়ে ফেলে। কেন সরাচ্ছে, পুষ্পি জানতে চাইলে জানায়, রুমে এসব জিনিস থাকায় তার হিজিবিজি লাগছে। পুষ্পিও বুঝতে পেরে আর প্রশ্ন বাড়ায় না।

এবং শাহরিয়ারের ভয় এতটাই প্রকোপ আকার ধারণ করেছিল যে, একদিন যখন পুষ্পি শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিল। এর পরদিনই শাহরিয়ার রুমের ফ্যান খুলে এসি ফিট করে। আরেকদিন পুষ্পিকে ছুরি দিয়ে ফল কাঁটতে দেখে। পুষ্পি রেগে যায় যদি, সেজন্য সে পুষ্পিকে তখন কিছু বলে না। কিন্তু পরে ঘরের সমস্ত ছুরি বাহিরে ফেলে দেয়। যে জিনিস নিয়ে শাহরিয়ারের মনে ডাউট হতো সেই জিনিসই সে রুম থেকে সরিয়ে ফেলত।

তবে লক্ষনীয় ছিল যেই বিষয়টি তা হলো, পুষ্পির এই রোগটা পুষ্পির পাশাপাশি শাহরিয়ারের মাঝেও আমুল পরিবর্তন এনেছে। সে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্র করতে শিখে গিয়েছে। অথচ তার আক্ষেপ ছিল, সে তার মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না!
শাহরিয়ারের এই মেজাজ নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ মিলে তাঁর কলিগরা বাসায় আমন্ত্রিত হয়ে আসার পর। সেদিন তাদের সামনে পুষ্পি যখন সিনক্রিয়েট করলো, তখন সে খুব শান্ত মাথায় সামলে নিল পুরো বিষয়টা। শাহরিয়ারের কলিগদের রসিকতায় পুষ্পির মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। অবস্থার বেগতিক বুঝতে পেরে শাহরিয়ার দ্রুত পুষ্পিকে তাদের সামনে থেকে সরিয়ে আনল। এনে বুঝাল, “পুষ্প, মাই বিউটিফুল, প্লিজ ডোন্ট গেট এংরি! কুল ডাউন।”
পুষ্পি উল্টো আরও রেগে গেল, “শান্ত হবো মানে? অশান্ত হবার মতো কি করেছি আমি? বলুন আমায়?”
বাহির থেকে পুষ্পির চেঁচামেচি সব শোনা যাচ্ছিল। শাহরিয়ার যেকোনো ভাবে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে বলল, “ওকে ফাইন, মাই মিসটেক। কি চাও তুমি বলো? আমি তাই করবো।”
পুষ্পি বললো, “ওদের চলে যেতে বলুন।”
শাহরিয়ার তাই করলো। নিজের প্র্যাস্টিজ এর কথা একটিবারও ভাবলো না। কারণ তার প্রায়োরিটি পুষ্পি। হয়তো সবাই অগোচরে সমালোচনা করবে। বাট হি ডিডেন্ট কেয়ার!

সাবেরী খাতুন ছেলের এই অস্থিরতায় আহত হলো। মুনমুন তার ভাইয়ের এই ভিন্নরূপে ভিষণ অবাক হলো। কিন্তু এটুকু বুঝল, ভাবি তার ভাইয়ের কতখানি প্রিয়। উপরের কঠোর আবরণে লুকোনো নরম মনটার পুরোটাই যে পুষ্পির দখলে একটু বুঝতে আর বাকি থাকে না কারো।

সাবেরী খাতুন ছেলেকে ডেকে কাছে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলেন, “বাবা, তুই কি কিছু ভাবছিস বউমাকে নিয়ে? ডাক্তার কী বলছে রে?”
শাহরিয়ার মেকি হাসি দেয়। মায়ের হাত ধরে বলে, “দুশ্চিন্তা করো না মা। আমি সব সামলে নিব। ইট ইজেন্ট মেজর প্রবলেম।”
সাবেরী খাতুন করুন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “খুব ভালোবাসিস মেয়েটাকে, না?”
শাহরিয়ার খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। রুদ্ধশ্বাস কান্না গলায় আটকে রয়। তারপরও স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয়, “ও এমন একটা মেয়ে, ওকে ভালো না বেসে থাকা যায়? ইজ ইট পসিবল, মা? হাও ক্যান আই নট লাভ হার? টেল মি, মা?”
সাবেরী খাতুন কেঁদে ফেলে। শান্তনা দিয়ে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। একদম চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এই কথার পর শাহরিয়ারের মুখের যেই মলিন হাসি! তা শব্দে প্রকাশ করা দুরূহ ব্যাপার।

তাদের এই কনভারসেশন পুষ্পি শুনলো। সে ভেবেছিল, শাহরিয়ারের কাছে হয়তো সে ক্রমশ বিরক্তির কারণ হয়ে যাচ্ছে। আর এই ভাবনা মাথায় এলেই তার দুনিয়া উলোট-পালোট হয়ে যেত। আদতে তার সেই ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। এবং এটুকু বুঝল, আর যাইহোক শাহরিয়ারের কাছে তার চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট এই মূহুর্তে অন্য কিছু না। এবং এই ঘটনার পর, পুষ্পিও খুব করে নিজেকে আগলে রাখতে লাগলো। শাহরিয়ারের বন্ধু নিওরোলজিস্ট আহসানের থেকেও সে বিভিন্ন টিপস নিতে লাগল, কিভাবে নিজেই নিজেকে সামলে রাখতে পারে। কিভাবে কিভাবে যেন সে সত্যিই অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠতে আরম্ভ করলো।
অন্যদিকে আহসানের সাজেশন অনুযায়ী শাহরিয়ারের ওকে নিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরাঘুরি করার সীদ্ধান্ত নিল। খুব সুন্দর সুন্দর কিছু মূহুর্ত কাটাবে বলে ঠিক করল। সমুদ্র, পাহাড়, আকাশে, বাতাস অবাক হয়ে দেখবে নতুন ছন্দে প্রেমে মজা দুটি মনকে! জাগতিক সমগ্র দুশ্চিন্তা থেকে বেড়িয়ে পরার তীব্র ইচ্ছে জেঁকে বসে মনে।

(শেষাংশ)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লার সৃষ্ট প্রকৃতি এত সুন্দর! জগতের সকল দুশ্চিন্তা ভেনিস করে দেয়ার কী ভিষণ ক্ষমতা এই প্রকৃতির! কতদিন পর সময়গুলো স্বপ্নের মতো করে কেটে যাচ্ছে! পুষ্পি বিমোহিত হয়ে সমুদ্রের পানে চেয়ে রয়! সমুদ্রে উচ্ছ্বাস শব্দ তার মনে দোলা দিয়ে যায়। কোনো চিন্তা নাই, ভাবনা নাই, দুশ্চিন্তা নাই, অসুস্থতারও যেন ছুটি!
তারা সমুদ্রের থেকে খানিক দূরে বসে রয়। একটা নির্জন জায়গায়। এদিকটায় খুব একটা মানুষজনের আনাগোনা নাই।
শাহরিয়ার অবাক হয়ে লক্ষ্য করে পুষ্পির ছোট চুলেও নতুন করে মুগ্ধ হচ্ছে সে! শাড়ির সাথে কাঁধ সমান চুল! খুব করে মানিয়ে গিয়েছে তাকে! শাহরিয়ার অবচেতন মনেই, গালের কাছে চলে আসা ছোট চুলগুলো কানে গুঁজে দিতে দিতে বলে, “আমার বউ অপ্সরী! মাশাআল্লাহ!”

পুষ্পির আচরণে অনেক চেঞ্জ এলেও, প্রচন্ড খুশিতে কেঁদে ফেলার স্বভাবটা আজও বদলায়নি তার। পুষ্পি নিজেকে সামলাতে পারে না। ওই এলোমেলো ভাবেই জানতে চায়,“এত ভালো কেন বাসেন আমায়?”
শাহরিয়ার মৃদু হাসে। যেই হাসি সূর্যের আলোর মতো ঝিলমিল করে। সে সাধারণ ভঙ্গিতে জবাব দেয়, “তোমায় ভালো না বেসে থাকতে পারি না বলেই বাসি। তোমাকে আমি তোমার জন্য নয়, বরং নিজের জন্যই ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসায় আমার নিজের প্রয়োজনীয়তাই বেশি। তোমায় ভালো না বাসাটা অসম্ভব বলে বাসি!”

মেয়েটা তখন কাতর হয়ে বলে, “আপনার জীবনটাকে নষ্ট করে দিচ্ছি আমি! এত সুন্দর জীবন আপনার, এত ভালো মানুষ আপনি, এত ভালো স্বামী! আর আমি, আমি কিনা বিষিয়ে দিচ্ছি আপনাকে! ভালো মেয়ে হতে পারলাম না, ভালো বউও হতে পারলাম না। এত আফসোস হয় আমার! দেখুন আমার চোখের দিকে, অনুশোচনায় ভুগি আমি!”

শাহরিয়ার ওকে কাছে টেনে নেয়। গালে হাত রাখে। খুব সুন্দর করে বুঝায়, “পুষ্প? রোশনাই বুঝ? তুমি আমার জীবনের রোশনাই। জীবনকে যেই মূহুর্তে আমার কাছে পানসে মনে হচ্ছিল, কিচ্ছু চাওয়ার নাই, কিচ্ছু পাওয়ার নাই, অনুজ্জ্বল; অনূভুতিতে ভুগছিলাম, ঠিক সেই মূহুর্তে তুমি আমার জীবনে রোশনাই হয়ে এসেছো। একগুচ্ছ আলো। চোখ শীতল করা, মন শান্ত করা আলো। যে আলো আলোকিত করেছে আমার জীবনকে , মনকে, আর শানিত করেছে আমার অনুভূতিকে!”
এরপর পুষ্পি বেশ খানিকক্ষণ কিছু বলতে পারে না। প্রতিটি কথা ওর বুকে এসে বাঁধে; সুখের বাঁধন, ভালোবাসার বাঁধন।
এরপর পুষ্পি শাহরিয়ারের কাঁধে মাথা রাখে। পৃথিবীর সবচাইতে ভরসা যোগ্য কাঁধ। এমন যোগ্যতাই বা অর্জন করতে পারে ক’জন?
শক্ত করে শাহরিয়ারের হাত আঁকড়ে রাখে। তারপর খুব ধীর স্থীর ভাবে এতদিন জমিয়ে রাখা কথাগুলো বলতে শুরু করে, “আপনি জানেন, আমার মা, আমার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। আমি তখন ছোট। ওই বয়সে ভালোবাসা, ভালোবাসার দৃষ্টি অথবা আমার মায়ের সেই ভালোবাসা আকুতি কিংবা আক্ষেপ কিছু বোঝার বোধশক্তি হয়নি আমার। আমি কেবল জানতাম, আমি আমার মায়ের খুব নেউটা ছিলাম। সারাক্ষণ তার আঁচলের তলায়। আমি এই সব জেনেছি আমার মায়ের একটা পুরোনো ডায়রি পড়ে, বাকিটা অনুধাবন করেছি নিজের জীবন দিয়ে!

তিনি কখনো আমার বাবার চোখে তার জন্য ভালোবাসা ব্যাতিত অন্য কিছু সহ্য করতে পারতেন না। রাগ, ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা, দুঃখ, বিরক্তি কোনো কিছু না। খুব ভালোবাসতেন যে বাবাকে। একদম স্বামীর অনুগত বউ যাকে বলে!
সবাই বলে, আমি আমার মায়ের মতো হয়েছি। আচার-আচরণ, চলন-বলন সব! একদম কার্বন কপি যাকে বলে! এজন্য আমার নানু আমাকে সবসময় আগলে আগলে রাখতেন। তার আমাকে নিয়ে অনেক ভয় ছিল। পরিণতি না আবার আমার মায়ের মতোই হয়! সত্যিই আমি আমার মায়ের মতোই হলাম দেখুন। এমনকি তার সাইকোলজিক্যাল সমস্যাগুলোও আমার মাঝে বিরাজ করছে৷ এই এতশত মিলের মাঝেও একটা অমিল রয়ে গেল আশ্চর্যজনক ভাবে!
সে আমার বাবার চোখে তার জন্য ভালোবাসা ব্যাতিত অন্যকিছু দেখতে চাইতো না। অথচ তিনি আমার বাবার চোখে তার জন্য ভালোবাসা ব্যাতিত অন্য সব কিছুই দেখতে পেতেন। আমি আমার মাকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু কখনোই আমি আমার মায়ের মতো হতে চাইনি। এত নরম, ভঙ্গুর, দূর্বল! যাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া যায়! কিন্তু আল্লাহ আমাকে তার মতোই বানিয়েছেন। আর সে কারণেই আমার ভয় ছিল, তার মতোই ভালোসার কাঙাল হবো না তো! সত্যি বলতে হয়েছিও তাই।”

পুষ্পি খানিকক্ষণ চুপ করে রয়। তার চোখ টলমল করে! পুনরায় বলতে আরম্ভ করে, “আপনার চোখেও আমি ভালোবাসা ব্যাতিত অন্য কিছু সইতে পারি না। আমার ভয় হয়, আতংক কাজ করে। এই অসুস্থতা আমার ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। কেবলই মনে হয়েছে, আপনার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি না তো! আপনাকে হারিয়ে ফেলছি না তো! তাহলে বাঁচবো কেমন করে! কিন্তু এখন আমার আর আফসোস নাই, ভয় নাই, আতংক নাই! আপনাকে আমার আর হারানোর ভয় নাই! আমার ভাগ্য আমার মায়ের মতো নয়! আমি…..আমি ভাগ্য করে এমন স্বামী পেলাম, আল্লাহ আমায় এমন মানুষ দিল, যার চোখে আমার জন্য জল! সুখের জল, দুঃখের জল, ভালোবাসার জল। যে আমার কষ্টে, আমার চাইতেও বেশি বিচলিত হয়! যার সমস্ত চিন্তা জুড়ে কেবলই আমি! কী আশ্চর্য! যেই মানুষটা সবার কাছে কঠোর, সেই মানুষটাই কেবল আমার কাছে এলেই মোমের মতো গলে যায়! কত ভাগ্য আমার দেখুন! কী ভীষণ ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি আমি!”

শাহরিয়ার পুষ্পিকে আলিঙ্গন করে। তার মনের ভেতরটায় ওই সমুদ্রের উত্তাল স্রোতের মতোই ঢেউ খেলে যায়। উপর থেকে জুড়ে দেয়া সম্পর্কগুলো বোধহয় এমনই! সুখ-দুঃখ সব মিলেমিশে কেমন একাকার হয়ে যায়। শাহরিয়ার পুষ্পির কপালে ওষ্ঠস্পর্শ করে বলে, “এই ভাগ্যবতীর সাথে আল্লাহ আমার ভাগ্য জুড়েছে, কত ভাগ্যবান আমি, ভেবে দেখেছো? কেমন করে শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবে, তা ভাবলে দিশেহারা হয়ে যাই আমি, বিশ্বাস করো!”

পুষ্পির বাধভাঙ্গা চোখের জলে শাহরিয়ারের টিশার্ট ভিজে যায়। শাহরিয়ার দূরের সমুদ্রের দিকে চায়। এত সুন্দর সবকিছু আজ! আকাশ, সমুদ্র কিংবা পুষ্পির চোখের জল! বুকের ভেতর ধুকপুকে সুর জানান দেয়, জীবনে সুখ সাময়িক, কিন্তু এর প্রভাব সমগ্র জগৎ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে! জগৎ এর সামগ্রিক সৌন্দর্য-ই যেন ভাটা পড়ে যায়, আল্লাহ প্রদত্ত এই সুখের নিকট! এই সাময়িক সুখ উপলব্ধির জন্য হলেও বোধহয়, জীবনে দুঃখের ভীষণ প্রয়োজন রয়েছে!

সমুদ্রের মিষ্টি বাতাস এসে লাগে ওদের গায়। শাহরিয়ার বিভোর হয়ে ডাকে, “পুষ্প? আমার কপালে একটু হাত রাখবা, প্লিজ?”
পুষ্পি চোখ মুছে জানতে চায়, “কেন?”
শাহরিয়ার আগের সুরেই বলে, “আমার বোধহয় জ্বর এসেছে, দেখ না প্লিজ?”
পুষ্পি উতলা হয়ে কপালে হাত রাখে,“জ্বর! কই! কপাল তো খুব ঠান্ডা!”
শাহরিয়ার প্রতিত্তোর করে, “উঁহু! তুমি জান না। সুখের জ্বরের তাপমাত্রার ব্যাপারে তোমার ধারণা নাই। শরীর, মন শীতলতায় ভর করেই কঠিন অসুখ হয়! এই অনুভূতি তুমি জান না পুষ্প।”

তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে কি যে সুন্দর করে চায়! তার চেয়েও সুন্দর করে বর্ননা করে তার এই অদ্ভুত অসুস্থতার সুত্রপাতের কথা, “ছোট বেলায় একবার আমার সবচাইতে পছন্দের সাইকেলটা চুরি হয়ে গিয়েছিল। কি যে কষ্ট পেয়েছিলাম। টানা তিন দিন আমি কেঁদেছি কেবল। মা, খোঁটা দিত, ছিঃ ছেলে মানুষ কাঁদে? সেদিনও খুব মনকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, ছেলে মানুষ কাঁদে না, কিন্তু পারিনি বোঝাতে। কিংবা ছেলে মানুষের ভালোবাসা কতটা তীব্র হলে কাঁদে তা বোধহয় সেদিন তারাও অনুধাবন করতে পারেনি! এরপর হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমার সেই সাইকেল উঠোনে! কে যেন এসে রেখে গিয়েছে আবার! সেদিনও আমার এই সুখের জ্বর এসেছিল। আর এত বছর পর আবার এলো আজ! কিন্তু এই জ্বরের প্রখরতা সেই জ্বরের চাইতে সহস্রগুন বেশি, ট্রাস্ট মি পুষ্প!”
পুষ্পি ট্রাস্ট করে। না করে তার উপায়ও ছিল না৷ ঘুরাঘুরির সাতদিনের ভেতর সেন্টমার্টিন আসার আগের দুদিন আর ওই একদিন ছাড়া বাকি চারদিন রিসোর্টে শুয়ে কাটাতে হয়েছিল। এত জ্বর এলো শাহরিয়ারের। কেবল খানিক বাদে বাদে বলতো, “এই জ্বরে কষ্ট নেই পুষ্প, ট্রাস্ট মি! তুমি কি আমার কথা ট্রাস্ট করছো?”
পুষ্পির মুখে সেই পুরনো হাসি ফুটে ওঠে। শাহরিয়ার মুগ্ধ হয়ে দেখে। পুষ্পি মাথার পাশে বসে জানতে চায়, “এত অসাধারণ কেন আপনি?”

শাহরিয়ার খুব সাধারণ ভাবে জবাব দেয়, “তুমি হতে বাধ্য করেছো।”
পুষ্পি মুগ্ধ হয়ে চায়। শাহরিয়ারও চেয়ে রয়।
পুষ্প জানতে চায়, “কী দেখেন?”
“ভালোবাসা!”
“কোথায়!”
“তোমার চোখে!”
পুষ্পি চোখ সরিয়ে ফেলে। সে প্রথম দিনের মতোই লাজে রাঙা হয় মুখ। ইশশ! এ কি বন্ধ! সুখের বন্ধন, দুঃখের বন্ধন, মুগ্ধতার সাগরে সহস্র বছর একত্রে পারি দেয়ার বন্ধন! সুখ-দুঃখ পাশাপাশি রেখে একসাথে মোকাবিলা করার যাদুর বন্ধন! এ বাঁধন এত সহজে শেষ হওয়ার নয়!

(সমাপ্ত)