#আরেকবার_আবর্তন ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১১>
এইসবের পর আস্তে আস্তে চারটে দিন কেটে গেছে | পার্থ এখন জেলে | হ্যাঁ , ওর বাবা নিজের পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে অনেক চেষ্টা করেছিল ছেলেকে বাঁচানোর | কিন্তু শরৎ এর মধ্যে ওর একজন জার্নালিস্ট বন্ধুকে দিয়ে খবরটা মিডিয়ায় আউট করে দিয়েছে | নিউজ চ্যানেলে , কয়েকটা লিডিং নিউজ পেপারে পুরো ইন্সিডেন্টটা ভালোভাবে ছেপে ব্রেকিং নিউজ হয়ে বেরিয়েছে এই কদিনে | এরপর আর পার্থর বাবার কিছু করার ছিল না ! চোখের সামনে ছেলেকে এরেস্ট হতে দেখতে হয়েছিল ওনাকে | আসলে শিউলির মতন ভালো মেয়ে তো উনি ওনার ছেলের জন্য হাজার খুঁজেও পেতেন না ! মানে ওর ছেলের যা ক্যারেক্টার , যা স্বভাব , কোনো মেয়ের বাবাই বিয়ে দিতে রাজি হতো না ! আর রাজি হলেও বিয়ের পর ঠিক কোনো ঝামেলা , ডিভোর্স কেস এইসব হতো | একমাত্র শিউলির বাবাকে টাকার কথা বলে ব্ল্যাকমেল করে থামিয়ে রাখা যেত ! সেই ভয়ে এই মেয়েটাও মুখে কোনো কথা বলতো না কখনো | তাই জোর করেই এই বিয়েটা দেয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিলেন উনি | কিন্তু ভাবতে পারেনি কেউ হঠাৎ করে এসে ওনার খেলাটা এইভাবে উল্টে দিতে পারে ! যাইহোক , তবে এখন যখন ক্ষমতা দেখিয়ে আর কিছু করতে পারছিলেন না নিজের ছেলের জন্য লোকটা , তখন একবার শরতের কাছে , একবার শিউলিদের বাড়িতে এসে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টাও করে দেখেছেন দু তিনবার | কিন্তু তাতেও বরফ গলেনি কোনো | শিউলি তো সেইদিন ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ডদের ডেকে লোকটাকে বার করে দিয়েছিলো বাইরে | ওই শান্ত মেয়ের এরকম রাগী মূর্তি দেখে পার্থর বাবাও ঘাবড়ে গিয়েছিলো খুব | আর কথা বাড়ানোর সাহস করেনি এরপর | যাইহোক , এইসব ঘটনা চলার মধ্যেই শরৎ একদিন আগে ডিসচার্জ পেয়েছিলো হসপিটাল থেকে | এখন বাড়িতে কদিন কমপ্লিট রেস্ট | তারপর আবার জয়েন করতে পারবে হসপিটালে | তবে চুপচাপ বসে থাকার ছেলে তো ও নয় ! কাজ তো ওর জীবনে চাইই | অনেকটা অক্সিজেনের মতন | নইলে ঠিক বাঁচতে পারে না | তাই বসে বসে কতগুলো জার্নাল পড়ছিলো সেইদিন মন দিয়ে | তবে হঠাৎ পড়াটা থমকে গেছিলো দরজার দিকে চোখ চলে যাওয়ায় | শিউলি ওর সামনে দাঁড়িয়ে | এতদিন নিউইয়র্ক থেকে ফেরার পর এই প্রথম শিউলি এসেছে ওর ঘরে ! ভেবেই ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলো না যেন ! আসলে পুরোনো ঘটনাগুলো একটা অদ্ভুত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরী করে দিয়েছে ওদের মধ্যে | তাই সহজ হয় খুব সহজ ব্যাপার নয় ! এইসবই ভাবছিলো , তখন শিউলি নিজে থেকেই বলে উঠলো ,———– ” আসবো আমি ? বেশিক্ষন সময় নেবো না |”
কথাটা শুনেই শরতের সম্ভিত ফিরলো হঠাৎ | শিউলি যে ওকে নিয়ে কি ভাবে ! সেই শেষ দিনের ঘটনাটা মনে হয় আজও ভুলতে পারেনি মেয়েটা ! তাই একটু জোর দিয়েই ও বললো , ———
” এইভাবে বলছিস কেন ? আর জিজ্ঞেস করছিস কেন ? তোর যখন ইচ্ছা তুই এই ঘরে আসতেই পারিস | প্লিজ , এবার আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকিস না | ভেতরে আয় |”
কথাটা শুনে একটু জোর করেই আলতো হাসলো যেন শিউলি | তারপর কয়েক পা এগিয়ে এলো ওর ঘরে | শরৎ এই সময় বুঝতে পারছিলো না ঠিক কি বলবে ! তখন শিউলি একটা অন্য কথা বলে উঠলো , ————– ” আমি আসলে কিছু রান্না করে দিতে এসেছিলাম তোমাদের | মানে কাকুর তো আজ পেনশন তোলার দিন | ব্যাংকে গেছে | আর তোমাদের কাজের মাসিও আসেনি শুনলাম | তাই অল্প রান্না করে পাঠিয়েছি | খেয়ে নিও | আসলে কাকু থাকলে কাকুকেই বলে যেতাম | কিন্তু কাকু যেহেতু নেই , তাই তোমাকেই বলে গেলাম |”
শরৎ হঠাৎ এটা শুনে এবার আপনাআপনিই বলে ফেললো হঠাৎ , ——– ” যাক , ভাগ্যিস নেই |”
শিউলি কথাটার ঠিক মানে খুঁজে পেলো না ! তাই কিছু না বুঝেই বলে উঠলো , ———- ” কি ! কি বললে ?”
শরৎ এবার কথাটা ঘোরানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গে বললো , ———- ” না তো | কিছু বলিনি তো | যাইহোক , তুই বল , তুই ঠিক আছিস ? ওই পার্থর বাবা আর কিছু প্রব্লেম করেনি তো ?”
শিউলি দু সেকেন্ড সময় নিয়ে এবার উত্তর দিলো , ———— ” না , করেনি | তোমার জন্যই তো সব কিছু হলো | আমি চেষ্টা করবো যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে টাকাগুলো ফেরত দেয়ার | তোমার এতদিনের জমানো টাকা ! সব শেষ হয়ে গেলো এইভাবে ! ” ……….. কথাটা বলতে বলতেই সেইদিন শিউলির মুখটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো শরতের সামনে | শরৎ ব্যাপারটা বুঝে এবার একটু ভেবে হঠাৎ অদ্ভুত একটা কথা বলে উঠলো ওকে , ———— ” তুই দিন দিন এরকম আমার মতন হয়ে যাচ্ছিস কেন বল তো ? একচুয়ালি আমার থেকেও বেশি সিরিয়াস ! একটু হাসতে গেলে কি সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয় তোকে ? আর সব সময় এরকম একটা স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের মতন মুখ করে ঘুরিস কেন ! তোর সাথে কথা বলতে গেলেও আজকাল আমার ভয় লাগে | মনে হয় ভুল কিছু বলে দিলেই হয়তো রেগে যাবি |”
না , কথাটা শুনে এই মুহূর্তে শিউলি কিছুতেই রাগতে পারলো না ঠিক ! হুট্ করে কিছু না ভেবে হেসে ফেললো শরতের সামনে | অনেকদিন বাদে হয়তো এইভাবে হঠাৎ হেসে উঠলো ও ! আসলে পরিস্থিতি গুলোই মনে হয় এতটা সিরিয়াস গম্ভীর করে ফেলেছিলো ওকে ! তবে না , এরপর আর বেশি কথা বাড়ায়নি শিউলি | বেশি সহজ ও আর কারোর কাছেই হতে চায় না | নিজের আড়ালটাকে খুব শক্ত করে ধরে রাখতে শিখে গেছে এই কবছরে মেয়েটা | তাই কথা ঘুরিয়ে আলতো হেসে বললো , ——— ” খেয়ে নিও তুমি | আর ওষুধগুলোও মনে করে খেও | আসলাম |”
কথাটা শেষ করেই সেদিন শিউলি চলে যাচ্ছিলো শরতের ঘর থেকে , তবে থমকে গেলো আবার , হঠাৎ শরতের কথা শুনে , ————- ” আবার আসবি তো ? মানে কি বল তো ! ওই আমাদের রান্নার মাসি , ও আরো তিন চারদিন আসবে না কাজে | বিয়ে বাড়ি আছে তাই | আর আমার যা অবস্থা দেখতেই পাচ্ছিস ! কি করে রান্না করবো বল | আর বাবারও তো বয়স হয়েছে | হোম ডেলিভারি আছে ! কিন্তু বাইরের খাবার বাবার এই বয়সে খাওয়াটা কি ঠিক ! তাই তুই যদি ?”
কথাগুলো শরৎ এতটা ডিরেক্টলি বলেছিলো সেইদিন যে শিউলি দু সেকেন্ডের জন্য অবাক হয়ে গেছিলো আজ ! মানে ও তো আগেও কলেজে পড়ার সময় শরতের জন্য , ওর বাবার জন্য টুকটাক রান্না করে পাঠাতো | তখন তো চিরকাল ছেলেটা ,—— ” না না , করতে হবে না |” ” কি দরকার এইসব ! ” ” আমরা ম্যানেজ করে নেবো |” এইরকম লাইনগুলো বলেই ভদ্রতা করতো ওর সঙ্গে | কাজের মাসি আসুক কি না আসুক , কোনোদিনও ডিরেক্টলি এইভাবে রান্না করে আনতে বলেনি ওকে ! তাহলে হঠাৎ আজ কি হলো ! কথাটা ভাবতেই শরৎ আবার বলে উঠলো , ———— ” কি হলো ? চুপ কেন ? আসবি না ? মানে খাবার নিয়ে আসবি না ?”
না , এতো ডিরেক্ট এপ্রোচের পর চুপ থাকা যায় না আর | তাই শিউলি এবার ভদ্রতা করে বললো , ———- ” এ বাবা ! এইভাবে বলছো কেন ? আমি আসবো তো খাবার নিয়ে | তোমাদের যতদিন কাজের মাসি আসছে না আমি খাবার দিয়ে যাবো | কোনো চিন্তা নেই | ঠিক আছে | রেস্ট নাও | আসছি |”
কথাটা শেষ করেই এবার ও আর দাঁড়ালো না | অনেক ভদ্রতা হয়ে গেছে আজকের মতন | তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো শরতের ঘর থেকে | তবে এই মুহূর্তে শরতের মুখে কিন্তু অদ্ভুত একটা জয়ের হাসি | বেশ ভালোই একটা হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করে ফেলেছে আজ ! যাক , আবার শান্তি মনে |
আরেকবার আবর্তন (পঞ্চম পর্ব )
ঈপ্সিতা মিত্র
<১২>
এইসবের পরের দিন শিউলি ঠিক দুপুরে খাবার দিতে এসেছিলো শরৎদের বাড়ি | তবে আজ ওর বাবা আছে বাড়িতে | তাই শরতের সাথে দেখা হওয়ার কোনো টেনশন নেই ! আসলে কিছু লোক সময়ের ভিড়ে এতটাই দূরে চলে যায় যে তাদের সাথে কথা বলার অভ্যাসটাই শেষ হয়ে যায় | আর যেখানে আবার মন ভাঙার গল্প আছে ! সেখানে মুখোমুখি না হওয়াই ভালো | এইসব ভাবনার মধ্যেই শিউলি খাবারটা রান্নাঘরে রেখে ড্রইং রুমে এসে শরতের বাবাকে বলেছিলো ——- ” খাবারটা দিয়ে গেলাম | তোমাদের রাতেও হয়ে যাবে |”
কথাটা শুনে শরতের বাবা একটু ইতঃস্তত হয়ে বলেছিলো , ———– ” তুই সব সময় এরকম করিস কেন বল তো ? যতদিন শরৎ নিউইয়র্কে ছিল , ততদিনও রান্নার লোক না এলে খাবার দিয়ে যেতিস | বাইরের খাবার দু চারদিন খেলে কিছুই হয় না | বুঝলি |”
শরতের বাবার কথায় শিউলি এবার আলতো হেসেছিলো , তারপর কিছু কথা ভেবে বলেছিলো , ———- ” জানি কিছু হয় না | কিন্তু বাড়ির খাবার যখন আছেই তাহলে শুধু শুধু বাইরে থেকে খেতে যাবে কেন ! যাই হোক , শরৎ ভালো আছে তো এখন ? শরীর ঠিক আছে ওর ? ”
কথাটা শেষ করে শিউলি শরতের বাবার দিকে তাকিয়েছিলো উত্তরদের অপেক্ষায় | কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে সেই ছেলেটার গলার আওয়াজ ! ——— ” আমি কেমন আছি সেই খবরটা আমার কাছ থেকেও জানা যায় ! একই বাড়িতে থাকি আমি আর বাবা | ”
এই রে , শরৎ তো নিজের ঘরে ছিল ! কি করে বুঝলো ও এসেছে ! নিশ্চই ড্রইং রুম থেকে গলা পেয়েছে | তার মানে আবার না চাইতেও মুখোমুখি হতেই হবে ওর | কথাটা ভাবতে ভাবতেই শিউলি শরতের দিকে ঘুরে দেখলো এবার | তারপর একটু ভেবে বললো , ———– ” না , মানে ভাবছিলাম তুমি রেস্ট নিচ্ছ | তাই আর ডিস্টার্ব করিনি | কাকুকেই জিজ্ঞেস করছিলাম |”
কথাটা শুনে ওর শরৎ হালকা গম্ভীর ভাবেই উত্তর দিলো , ———— ” বুঝলাম | তুই ঘরে আয় | কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা আছে আমার |”
ইম্পরট্যান্ট কথা ! ওর সঙ্গে ! কি হলো আবার ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই সেইদিন শিউলি শরতের ঘরে গেছিলো | তবে ওকে বেশি অপেক্ষা না করিয়ে শরৎ একজনের ফোন নাম্বার ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো হঠাৎ | শিউলি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে খুব অবাক হয়েই তাকিয়েছিলো ওর দিকে ! তখন শরৎ নিজে থেকেই উত্তরটা দিয়েছিলো ,
———— ” এটা একজন ফিজিওথেরাপিস্ট এর নাম্বার | আমার চেনা | খুব ভালো হাত ওনার | অম্বরিশ মুখার্জী নাম | আমি কাকুর জন্য ওনার সাথে কথা বলেছি | তুই শুধু ফোন করে সপ্তাহে কোন দিন কখন আসবে , এটা কনফার্ম করে নিবি | ”
কথাটা শুনে শিউলি দু সেকেন্ড চুপ ছিল ! তারপর একটু ভেবে বললো , ———- ” আমি শুনেছি ওনার নাম আগে | বাবার যখন ঘটনাটা ঘটেছিলো তখন ফিজিওথেরাপিস্টদের খোঁজ নিতে গিয়ে | কিন্তু ওনার ফিজ তো অনেক ! আমরা এফোর্ট করতে পারবো না এখন অতটা আসলে !”
শরৎ এবার ওর কথাটা আর এগোতে দিলো না | নিজে থেকেই বলে উঠলো , ———- ” তোকে ফিজের কথা ভাবতে বলেছি আমি ! শুধু বলেছি ফোন করে ডেট আর টাইম কনফার্ম করে নিবি | বাকিটা আমি বুঝে নেবো |”
না , শিউলি এই কথাটার পর আর চুপ থাকলো না | কোনো সময় না নিয়েই বলে উঠলো , ———— ” সেটা হয় না আর | তুমি অলরেডি তোমার নিজের জমানো সব টাকা আমার বাবাকে দিয়েছো ধার শোধ করার জন্য | সেই টাকা আমি কবে ফেরত দিতে পারবো ঠিক নেই ! এরপর আর কোনো কিছু হেল্প নেয়া সম্ভব না আমাদের | আর তুমি এতো কেন করবে আমাদের জন্য ! প্লিজ , এসব নিয়ে ভেবো না | তুমি নিজের খেয়াল রাখো | আজ এই যে তোমার হাতে ফ্র্যাকচার , মাথায় চোট , সেইসবও তো আমাদের কারণেই ! এটা আমি কখনো ভুলতে পারবো না | তাই প্লিজ , আর কিছু কোরো না | আর আমি নিতে পারবো না |”
কথাটা শেষ হতেই শরৎ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো এই মুহূর্তে , ———– ” হয়েছে শেষ ? কমপ্লিট ? এবার আমি বলি | তুই হয়তো জানিস না , কিন্তু আমার মায়ের যখন ক্যান্সার ধরা পড়েছিল তখন আমার বাবার টাকার খুব দরকার হয়েছিল একটা সময়ে | কেমো থেরাপি , ট্রিটমেন্টের খরচ , সব কিছু একা সামলে উঠতে পারছিলো না ঠিক বাবা | সেই সময় কাকু তোর মায়ের গলার চেন বিক্রি করে টাকা এনে দিয়েছিলো বাবাকে | ঘটনাটা সেদিন বাবা না বললে আমিও জানতে পারতাম না ! আর শুধু কি তাই ! এই এতো বছরে তোদের বাড়ি থেকে ঠিক কতবার আমাদের জন্য খাবার এসেছে মনে রেখেছিস কখনো ! কতবার আমার জন্মদিনে কাকিমা নিজে মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছে আমার নামে সেই হিসেব করেছিস একবারও ? কত সরস্বতী পুজোয় তুই নিজের বাড়ির পুজো ছেড়ে আমাদের বাড়ি এসেছিস পুজোর জোগাড় করে দিতে , লক্ষী পুজোয় আমাদের বাড়ি ভোগ রান্না করতে , যাতে মায়ের শুরু করা পুজো এই বাড়িতে বন্ধ না হয় কখনো , সেইসবও তো মনে রাখিসনি কোনোদিন ! আর যদি এতো কিছুর হিসেব তোরা না রাখিস , তাহলে আমাকে রাখতে বলছিস কেন ? ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেছিলো সেদিন শরৎ | আর শিউলি কেমন নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে ! কিছুতেই কোনো কথা বলে উঠতে পারছিলো না ঠিক | তখন শরৎ ওকে আলতো হেসে আবার বলেছিলো , ————- ” নাম্বারটায় কল করে কথা বলে নিস্ | আর বেশি কিছু ভাবতে হবে না |”
না , শিউলি এরপর আর কোনো উত্তর দেয়নি ওকে | ঠিক উত্তর খুঁজে পায়নি দেয়ার মতন আসলে | সত্যি হয়তো এরপর আর হিসাব করা চলে না | আর হিসাব করলেও শরৎ সেটা শুনবে না | তাই চুপচাপ নাম্বারটা নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলো | তবে আজ এই মুহূর্তে হঠাৎ একটা কথা মনে হচ্ছে খুব ওর | তিন বছর আগে শরৎকে যেরকম মনে হয়েছিল একদিন ! কঠিন , ইমোশোনলেস একটা মানুষ ! আজ সেই ভাবনাটাকে ভুল মনে হচ্ছে কেমন ! আজ মনে হচ্ছে শরৎও মন থেকে ভাবতে জানে | বিনা কারণে , কোনো হিসেব ছাড়াই , অনেক কিছু ফেরত দিতে জানে |
সেইদিন রাতে এরপর একটা কল এসেছিলো শিউলির কাছে , শরতের নাম্বার থেকে | আরেকবার একটু অবাক হয়েছিল ও ! শরৎ আবার ফোন করতে যাবে কেন ওকে ! শরীর ঠিক আছে তো ! কথাটা ভেবেই ও ফোনটা ধরেছিলো | তবে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওপার থেকে একটা প্রশ্ন এসেছিলো ,
———- ” তুই কল করেছিলিস তো ফিজিওথেরাপিস্ট কে ? কনফার্ম করেছিস তো ডেট আর টাইম ?”
শিউলির কাছে এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছিল | তার মানে শিউলি সকালে চুপচাপ নাম্বারটা নিয়ে চলে আসায় শরৎ ঠিক কনভেন্স হয়নি | তাই কল করে জানতে চাইছে ! সত্যি , ওর বাবাকে নিয়ে কেউ এতটা ভাবে ! ভেবেই খুব অদ্ভুত লাগছিলো ওর | যাইহোক , সেইদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই উত্তর দিয়েছিলো , ——— ” করেছি কল | সোম আর বুধবার আসবেন উনি | সকাল এগারোটার সময় | ”
উত্তরটা শুনে শরৎ যে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এবার , সেটা শিউলি ফোনের এপার থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলো এখন | তবে এরপর আর একটু অবাক করে দিয়ে শরৎ ওকে অন্য একটা কথা বলে উঠলো হঠাৎ , ———— ” যাইহোক , তোর রান্না খুব ভালো হয়েছে | স্পেশালি পেঁয়াজ পোস্তটা | একচুয়ালি তুই তো প্রথম থেকেই ভালো রান্না করিস !”
শিউলি এবার সত্যি কি বলবে বুঝতে পারলো না ! তিন বছর আগেও তো কত রান্না করে নিয়ে গেছে শরতের জন্য | কোনোদিনও তো ফোন করে নিজে থেকে এইসব বলেনি ! নিউইয়র্কে থেকে কি করে এতো সুনাম করতে শিখে গেলো ছেলেটা ! আগের আর এখনকার শরতের মধ্যে এতো তফাৎ কি করে হলো ! কথাগুলো মনে এসে আনমনেই ভিড় করলো ওর | শরৎ মনে হয় এই নিঃস্তব্ধতার মানে বুঝতে পেরেছিলো সেইদিন | তাই নিজে থেকে উত্তর দিয়েছিলো , ———– ” কি ভাবছিস ? এইরকম ভাবে তিন বছর আগে কখনো বলিনি , আর আজ হঠাৎ কেন বলছি ! আসলে তিন বছর একা থেকে বুঝেছি ,যে কেউ যখন মন থেকে কিছু করে দেয় ,সেটা কতটা ইম্পরট্যান্ট হয় | ওখানে তো এরকম অনেক সময়েই হয়েছে , যখন কাজের চাপ , বা শরীর খারাপ , রান্না করতে ইচ্ছে করছে না , তখন সারাদিন একটা বার্গার খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি | তাই হয়তো আজকাল পেঁয়াজ পোস্তর ইম্পর্টেন্সটা বুঝতে পারি |”
শিউলি এইরকম একটা উত্তর শুনেও কেমন নিরুত্তর ছিল ওই মুহূর্তে | শরৎ যে ওকে ঠিক কি বোঝাতে চাইছে ফিরে আসার পর থেকে , সেটা কিছুতেই যেন মেলাতে পারছে না ঠিক | আর তিন বছর আগের ছেলেটার থেকে এই ছেলেটাকে কেমন অন্যরকম , নতুন লাগছে ওর | যেই কনসার্ন , যেই কথাগুলো শিউলি অনেকদিন আগে শুনতে চাইতো , আজকাল সেইসব কথাগুলোই শরৎ নিজে থেকে বলে দেয় ওর কাছে | তিন বছর আগের ভাবনাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেয় নিজেকে | কিন্তু শিউলি তো একসেপ্ট করে নিয়েছে | তিন বছর আগের সেই পুরোনো শরৎকে | যে ওকে একটা দুর্গাপুজোর সন্ধ্যেতে একা ছাদে রেখে চলে গিয়েছিলো মুখ ঘুরিয়ে | যে ওকে তারপর আর চিনেও চেনেনি ! ওর কাছে তো সেই দিনগুলোই সত্যি | অতীতটাই সত্যি | সেই যন্ত্রনাগুলোকে ভুলে কাউকে কি আর নতুনভাবে চেনা সম্ভব ! প্রশ্নগুলো না চাইতেও মনে এসে ভিড় করেছিল আজ ওর | তবে শিউলি এইসবের কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি সেইদিনও | নিজের পুরোনো আর নতুনের মাঝে একা হয়ে বসেছিল তাই চুপচাপ, অনেকক্ষন |
চলবে।