#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ০২ (শুভ্র গোলাপ)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
রাস্তা ভালোই নিরব। এই অবস্থা দেখে শিমলা প্রাহীকে বললো,
– ‘রাস্তা তো বেশ অন্ধকার তুই যাবি কিভাবে! তোকে কেউ দিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো। আপার বিয়ে উপলক্ষে আমার এখন বাড়িতে থাকাটা জরুরী। নয়ন ভাইওটাও ব্যস্ত। তাহলে তোকে দিয়ে আসবে কে!’
প্রিয়ন্তী শাড়ির আঁচল টা কাঁধে এনে হালকা হেসে বললো,
– ‘অসুবিধে নেই। হেডলাইটের আলোয় দিব্যি…।’
ওদের কথার মাঝেই ক্ষানিকটা দূর হতে কেউ হালকা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আমি দিয়ে আসছি।’
ভারী কন্ঠস্বর শুনে ওরা দুই বান্ধবী হালকা পিছন ফিরে তাকালো। দেখলো আকসাদ পরনে খাকি প্যান্টের পকেটে একহাত গুজে আর অন্যহাতে গাড়ির চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই প্রাহী বড় বড় চোখে সামনে তাকিয়ে রইলো! এই লোক এখানে কেন! তখনকার মাঝপথে থেমে যাওয়া অদ্ভুত কথাবার্তাগুলো পুনরায় আবার বলতে চলে এলো নাকি! প্রাহী অনুভূতিহীন চোখে একবার শিমলার দিক তাকাচ্ছে তো আরেকবার হালকা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা ‘আকসাদ’ নামক বিচিত্র ব্যাক্তিটিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে৷ এই লোক যদি এখন শিমলার সামনেও তখনকার মতো ওমন অস্বাভাবিক কথাবার্তা শুরু করে দেয় তখন কি হবে! ভেবেই প্রাহীর হাতের তালু ঘামাতে লাগলো। কি একটা গোলমেলে পরিস্থিতির মধ্যে ফেঁসে গেলো ও!
এদিকে শিমলাও আকসাদ কে এখানে দেখে কিছুটা অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে। কারণ বাংলাদেশে আসার পর এই ছেলে সহজে ঘর থেকে বের হয়নি এই কয়দিনে। আজ একদম এভাবে রেডি হয়ে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে হাজির! কোনো কাজ আছে কি আকসাদ ভাই এর!
এভাবে দুই কিশোরীকে নিজের দিক এমন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আকসাদ ভরা কন্ঠে শিমলার দিক তাকিয়ে হালকা আওয়াজে বললো,
– ‘তোদের জেনারেটর এর ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে। আপাতত ব্যাটারি ম্যানেজ করতে না পারলে বাড়িভর্তি এতগুলো মানুষ রাতে কারেন্ট না থাকলে বেশ ভোগান্তিতে পড়ে যাবে। তাই মা বললো আপাতত আমাকে বাজার হতে জেনারেটর এর ব্যাটারি টা নিয়ে আসতে। কাকাবাবু আর নয়ন মিলে বিয়ে বাড়ির দিকটা সামলাতে ব্যস্ত। সেই বিধায় আমি যাচ্ছি। আর তোর বান্ধবীও যেহেতু ওদিকেই যাচ্ছিস তাই ভাবলাম ড্রপ করে দিয়ে যাই!’
আকসাদের কথায় শিমলা হালকা হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ কেন নয়! বাজারের একটু আগেই প্রাহীদের বাড়ি। ওকে একটু নামিয়ে দিয়ে গেলে বরং ভালোই হয়। বেশ রাত হয়ে গেছে কি না!’
আকসাদ আড়চোখে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘হুম।’
প্রাহী না বলতে যাবে তার আগেই শিমলা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– ‘আকসাদ ভাইয়ের সাথে চলে যা। গাড়ি নিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবি!’
প্রাহী ফট করে শিমলার কথার প্রেক্ষিতে বলে উঠলো,
– ‘তাহলে তুইও সাথে চল!’
ওর এহেন কথায় আকসাদ আর শিমলা দুজনেই হালকা ভ্রু কুঁচকে ওর দিক তাকিয়ে রইলো। দু’জনের এমন চকিত দৃষ্টি দেখে প্রাহী হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
– ‘না মানে এইটুকুনের পথই তো! তুই একটু সাথে গেলে ভালো লাগতো আর কি!’ বলে থেমে আকসাদের দিকে একবার দৃষ্টি তাক করে শিমলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ‘আর তাছাড়া উনি তো এখানে নতুন। বাজারের রাস্তা যদি ভুলবশত উনি ভুলে যায় তাহলে তো আবার আরেক সমস্যা। এমনিতেই রাত হয়ে যাচ্ছে। দোকানপাটও বন্ধ করে দিবে কিছুক্ষণ পর। তাই তুই সাথে গেলে উনারও একটু সুবিধা হলো। পথ ভুলে গেলেও তখন কোনো চিন্তা থাকবে না। তুই তো সব চিনিসই। সেজন্যই বললাম আর কি যদি তুই একটু সাথে যেতিস!’
প্রাহীর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শিমলা বলে উঠলো,
– ‘আচ্ছা বেশ আমিও যাচ্ছি তাহলে।’
শিমলার কথায় প্রাহী একটু দম ছেড়ে সামনে তাকাতেই দেখলো আকসাদ ওর দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে! প্রাহী সাথেসাথে চোখ সরিয়ে ফেললো।
ফাঁকা রাস্তায় মিডিয়াম স্পীডেই এগিয়ে চলছে হালকা ধূসর বর্ণের গাড়িটি। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দক্ষহাতেই ড্রাইভ করে যাচ্ছে আকসাদ। প্রাহী পিছনের দিকটায় বসেছে। আর শিমলা আকসাদের পাশেই ড্রাইভিং সিটে বসেছে। ও ইচ্ছে করেই আকসাদের পাশে বসেনি। এই বিদেশী বানর এর কাছ থেকে যত দূর থাকা যায় ততোই ভালো! তাই ও আগেভাগেই পিছনের সিটে বসে পড়েছে। আর এসব কিছু আকসাদ নিরব দৃষ্টিতে অবলোকন করছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে ও সামনে গাড়ির ফ্রন্ট মিরোরের দিক তাকাতেই দেখলো আকসাদ ওর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ড্রাইভ করছে। তার মানে কি এতক্ষণ এই লোক এতক্ষণ ওকে দেখছিল!
বাড়ির সামনে আসতেই প্রাহী দ্রুত গেইট খুলে বেরিয়ে এলো। শিমলা গাড়ির ভিতর থেকেই বলে উঠলো,
– ‘আরে আস্তে এত তাড়াহুড়োর কি আছে? এসেই তো পড়েছিস! আস্তে ধীরে যা!’
আরসাল ড্রাইভিং সিটে হাত রাখেই প্রাহীর দিক তাকিয়ে হুট করে বলে উঠলো,
– ‘তোর বান্ধবীর মনে হয় টয়লেট পেয়েছে। এজন্য এভাবে ছুটে চলছে।’
আকসাদের আকস্মিক এমন কথায় শিমলা কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। প্রাহী আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো। প্রাহীর এহেন দৃষ্টিতে বাকা হেসে আকসাদ ওকে বেশ সাবলীলভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
– ‘তাই না? মিস প্রা…হী!’ বলে প্রাহীর দিক তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো।
প্রাহী জোড়পূর্বক ভাবে হেসে উত্তর দিলো,
– ‘তেমন কিছু নয়!’ বলেই কটমট দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আকসাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
শিমলা হাসি থামিয়ে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘প্রাহী রাগ করিস না। আকসাদ ভাই মাঝে মধ্যেই এমন রসিকতা করে থাকে। সিরিয়াসলি নিস না কেমন!’
প্রাহী আকসাদের দিক একটা কঠিন দৃষ্টি দিয়ে শিমলার দিক তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
– ‘অসুবিধে নেই। কাজ শেষে সাবধানে বাড়ি ফিরিস! আমি আসি এখন!’ বলেই ও সামনে এগোতে থাকলো। এতক্ষণ ভেবেছে আকসাদ নামের মানুষটা একটু অদ্ভুত ধাঁচের। কিন্তু এখন ও দেখছে এই লোক আস্ত একটা বেয়াদব। এই বেয়াদব লোকটার সামনে ও আর এক মুহুর্তও থাকবে না! ভেবেই গটগট পায়ে বাড়ির দিক যেতে লাগলো। পিছন থেকে চাপা হাসির আওয়াজ শুনে ওর রাগ আরও বাড়তে থাকলো। গটগট পায়ে ও হেঁটে যেতে লাগলো।
দোতলা বিশিষ্ট প্রাহীদের বাড়িটা সামনে উঠানের মতো মোটামুটি খালি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। আশেপাশে ফুল আর কিছু শাক-সবজির বাগান রয়েছে। যার দেখাশোনা প্রাহীরা সবাই মিলেই করে। মূলত পৈত্রিকসূত্রানুসারে ওর দাদার তরফ হতে প্রাহীর বাবা বাড়িটা পেয়েছে। প্রাহীর বাবারা এক ভাই এক বোন। প্রাহীর ফুপু ঢাকায় থাকেন। উনাদের নিজেদের বাড়ি আছে ওখানে। প্রাহীদেরও ঢাকায় নিজেদের ফ্ল্যাট রয়েছে। কিন্তু প্রাহীর বাবা একটু প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। শহরের এত কোলাহল উনার পছন্দ নয়। তাই উনি প্রাহীদের নিয়ে খুলনায় টাউনের দিক থাকেন। প্রাহীরা এক ভাই এক বোন। প্রাহীর বড় ভাই এবার জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স শেষ করলো। মাস্টার্সে ভর্তি হবে কিন্তু এখন আপাতত ছুটিতে বাড়ি এসেছে।
বাড়ির মেইন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে সেটা বন্ধ করে দিলো প্রাহী। ভিতরে ঢুকতেই দেখলো বসার রুমে ওর বাবা বসে গরম দুধ খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে। প্রাহী নিরবে জুতোজোড়া খুলে ভিতরে ঢুকতে যাবে তখনই দেখলো ওর ভাই নক্ষত্র হাতে হেলমেট নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামছে। প্রাহীকে দেখেই সিড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লো। দ্রুত পায়ে ওর কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কি রে এতো দেরী কেন!’
– ‘গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান, সাথে আপাকে হলুদ লাগানো সব মিলিয়ে দেরী হয়ে গেছে আসলে। তার মধ্যে কাকীমা আবার না খাইয়ে আসতে দিচ্ছিল না।’ বলেই প্রাহী ছোটো একটা শ্বাস ফেললো।
নক্ষত্র কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বললো,
– ‘তো ফোন দিয়ে জানাবিনা যে লেট হবে! বাবা আর আমি তোর জন্য টেনশন করছিলাম তো!’
– ‘ফোনে চার্জ ছিলোনা আসলে।’
নক্ষত্র ভ্রু কুঁচকে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘সিরিয়াসলি? আর কারো ফোন ছিলনা! শিমলা বা কাকীমার ফোন থেকেও তো বলতে পারতি যে দেরী হতে পারে! এতোটা ইরিসপন্সিবল কিভাবে হোস তুই!’
প্রাহী মাথা নত করে একবার ওর বাবার দিকে তাকালো। যিনি কিনা এখনও পেপার পড়ে যাচ্ছে। বাবা কি রাগ করলো! সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ও নক্ষত্রের দিক অনুশোচনামূলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– ‘বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান। তার মধ্যে সবাই এতো ব্যস্ত ছিল। হাসি ঠাট্টার মাঝে আর জানানো হয়নি। তাও চেষ্টা করেছিলাম দ্রুত ফিরার।’
নক্ষত্র ওকে কিছুটা ভেঙিয়ে বলে উঠলো,
– ‘চেষ্টা করেছিলাম দ্রুত ফিরার! তুই কি একাই গেছিস নাকি অনুষ্ঠানে! আর কোনো হাসি ঠাট্টা কেউ করেনি! সব একাই তুই করেছিস নাকি!’
প্রাহী বেশ বিরক্ত হলো এবার। ইশ্ নিজে যখন ঢাকা থেকে বাড়ি আসার পর বাইরে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যায় তখন রাত দুইটায়ও তার কোনো দেখা মিলেনা! প্রাহী উল্টো আরও মিথ্যা বলে বাবা মাকে যে ভাই বাসায়ই আছে ঘুমোচ্ছে। সবসময় ওকে সাপোর্ট দেয়! যেহেতু অনেক দিন পর পর বাসায় আসে। বন্ধু বান্ধবদের সাথে বের হতেই পারে। কিন্তু এখন! ওর বেলায় যতো ঠনঠন! বাবা সামনে না থাকলে দুমদাম এর পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়ে ও রুমে চলে যেত। এত জেরা করার কোনো মানে আছে!
প্রাহী কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর বাবা নজরুল ইসলাম আলতো পায়ে মেয়ের কাছ ঘেষে দাঁড়ালেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে তিনি নরম কন্ঠে বলে উঠলেন,
– ‘দেশের পরিস্থিতি ভালো না আম্মা। রাতে বিরাতে বাহিরে থাকলে আমার একটু টেনশন হয়। কয়েকদিন আগেই আন্দোলন গেল। কয়েকটা দিন আপাতত একটু নিরাপদ থাকা ভালো। বাহিরে গেলেও বিকাল বা সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাসায় থাকার চেষ্টা করবে কেমন?’
প্রাহী ধীরভাবে মাথা নাড়িয়ে বাবার দিক তাকিয়ে আলতো হাসলো। নজরুল ইসলাম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– ‘যাও ফ্রেশ হও। হালকা পাতলা কিছু খাওয়ার লাগলে খেয়ে শুয়ে পড়ো।’
নক্ষত্র ভ্রুঁ কুঁচকে বাবার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ও আবার কি খাবে এখন!’ বলে প্রাহীর পেটের দিক আঙুল দিয়ে ইশারা করে আবার বললো,
– ‘দেখছোনা তিন প্লেট কাচ্চি খেয়ে পেটটা কেমন ফুলিয়ে রেখেছে!’
নজরুল ইসলাম বিরক্ত হয়ে ছেলের দিক তাকিয়ে বলে উঠলেন,
– ‘চুপ যা তুই। আম্মা তুমি যাও ফ্রেশ হও।’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে এগোতে নিবে তার আগেই নক্ষত্রের হাতে বাইকের হেলমেট দেখে বললো,
– ‘তোর হাতে হেলমেট যে! কোথাও যাচ্ছিলি?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কোথায়?’
নক্ষত্র এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠলো,
– ‘বাড়ির একটা বান্দর বাইরে গিয়ে বাসায় আসতে ভুলে গিয়েছিলো। ওটাকে আনতে যাচ্ছিলাম!’
প্রাহী এবার আর সহ্য করতে না পেরে নক্ষত্রের হাতের কব্জি বরাবর জোড়ে একটা খামচি কেঁটে সিড়ি বেয়ে দৌড়াতে লাগলো। নক্ষত্র পাল্টা মাইর দিতে যাবে তার আগেই ওর বাবা ওর গেঞ্জির হাতা ধরে ওকে আটকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘অনেক হয়েছে! যা বাইরে যেয়ে মেইন গেইটে তালা ঝুলিয়ে আয়। শিগগির যাবি।’ বলে উনি আবার সোফায় যেয়ে পেপার হাতে নিয়ে বসলেন।
নক্ষত্র গেইটের চাবি নিয়ে যেতে যেতে উপরের দিক তাকিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
– ‘বান্দর না তুই হলি একটা জঙ্গলি হায়েনা। এই তোকে কি কাচ্চিতে মাংস দেয়নি নাকি! যে তুই আমার হাতের মাংসে এভাবে আচড় কাটলি!
নজরুল সাহেব বিস্মিত দৃষ্টিতে ছেলে মেয়ের দিক তাকিয়ে রইলেন। সমবয়সী না হয়েও এরা একটা আরেকটাকে মানেনা! সমবয়সী হলে কি করতো!
রুমে এসে প্রাহী দেখলো ওর মা ওর পড়ার টেবিলটা গুছাচ্ছে। প্রাহীকে দেখে উনি বলে উঠলেন,
– ‘কিরে এতো দেরী? সব ঠিক আছে তো ওদিকে?’
প্রাহীকে একটা শ্বাস ফেলে কাঁধ থেকে ব্যাগটা রাখতে রাখতে বললো,
– ‘হ্যাঁ মা সব ঠিক আছে ওদিকে। শুধু তুমি যাওনি বলে শিমলার মা মানে কাকীমা অনেক চটে আছে তোমার উপর।’
প্রাহীর মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– ‘কিভাবে যেতাম! তোর বাবার প্রেশার তো আজ দুপুরের পরেও কমছিলো না। তাই আমি আর নক্ষত্র বাসায়ই থাকলাম। কাল একবার যাব দেখি শিমলাদের বাড়িতে। একটু সাহায্য করে দিয়ে আসব। যতোই হোক বিয়ে বাড়ির অনেক কাজ। হাতে হাতে সাহায্য বরংচ করলে একটু উপকার হয়। তাইনা!
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে কানের দুলগুলো খুলতে লাগলো। প্রাহীর মা এসে মেয়ের গলার চেইন, শাড়ির সেফটিপিন গুলো আস্তে ধীরে খুলে দিতে দিতে বললো,
– ‘কালকে তুই আমার সাথে যাবি!’
– ‘আমার তো কাল একটু ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। যদি যাই তাহলে ওখান থেকে শিমলাদের বাড়ি চলে যাব না হয়!’
– ‘আচ্ছা বেশ। নক্ষত্র চিল্লাচিল্লি করছিল যে! কিছু হয়েছে?’
প্রাহী এবার প্রচন্ডভাবে বিরক্তমাখা দৃষ্টি নিয়ে বললো,
– ‘কি আবার হবে? তোমার ছেলে বেশি বাড়াবাড়ি করে। আসতে না আসতেই জেরা শুরু। বেশি বাড়াবাড়ি যাকে বলে!’
প্রাহীর মা গালভর্তি হেসে বললেন,
– ‘তোর জন্য টেনশন হচ্ছিল বলেই এমন করেছে। আচ্ছা বাদ দে, শাড়িটা খুলে কিছু নরম কাপড় পড়ে আয়। আমি মাথা আছড়ে দিচ্ছি!’
প্রাহী মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
মেকআপ তুলে ফ্রেশ হয়ে হালকা নীল রঙের সুতি ঢিলেঢালা পাজামা সেট পড়ে রুমে আসলো। মুখ ধোঁয়ার পর বেশ ফ্রেশ লাগছে ওকে। প্রাহীর মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মেয়েটা তার মতো ধবধবে গায়ের রং পায়নি। বাবার মতো মিষ্টি গায়ের রং পেয়েছে। তাতে কি হয়েছে? বড় বড় চোখ, খাড়া নাক, টসটসে গাল পাতলা ঠোঁট সব মিলিয়ে তার মেয়ের ছোট গোলগাল মুখটা যেন স্নিগ্ধতায় ভরপুর। যে কেউ একবার ওর দিক হালকা মনোযোগ দিয়ে তাকালে মায়ায় পড়তে বাধ্য হবে! উনার ছেলে নক্ষত্র যতোটা না চঞ্চল প্রাহী ঠিক ততোটাই শান্ত। কিন্তু একবার যদি রেগে তাহলে খবর আছে। শান্ত মানুষদের রাগ থাকে বেশি! চঞ্চল আর বাউণ্ডুলে একটা ছেলে এবং এই শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল রূপের মেয়েটাকে উনি গর্ভে ধারণ করেছেন! ভাবতেই কেমন যেন একটা হালকা শীতল স্রোত উনার সিড়দারা বেয়ে নেমে যায়। আল্লাহ উনার ছেলেমেয়েদুটোকে সবসময় ভালো রাখুক!
প্রাহী চিরুনি হাতে নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসলে। ওর মা মাথা আছড়ে দিল। মায়ের হাতের ছোঁয়ায় প্রাহীর ঘুম চলে আসলো। মেয়েকে ঢুলতে দেখে প্রাহীর মা হেসে বললেন,
– ‘ঘুমে ঢুলছিস তুই! নে শুয়ে পড়। আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছি!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে শুয়ে পড়লো।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে প্রাহী হাতমুখ ধুঁয়ে নামায পড়ে নিল। এখন বাজে সাতটা সবাই হয়তো নামায পড়ে আবার ঘুমিয়েছে! ও নিচে গিয়ে কড়া করে চা বানিয়ে মগভর্তি চা নিয়ে উপরে আসলো। বারান্দায় বসে এক হাতে চা আর পাউরুটি খাচ্ছে অন্য হাতে শিমলাকে ফোন দিচ্ছে। না এই মেয়ের কোনো খবরই নেই! এখনও ঘুম মনে হয়! প্রাহী আজ ভার্সিটি যাবে। আন্দোলনের জন্য এতোদিন ভার্সিটি ওফ ছিল। এখন খুলেছে। তাই ও ভাবলো আজকে যেয়ে কিছু নোটস আর ক্লাসগুলো করবে। কখন না কখন পরীক্ষা দিয়ে দেয় ভার্সিটি থেকে! তখন আবার প্রেশার হয়ে যাবে ওর জন্য!
প্রাহী চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবলো। এই আন্দোলনের জন্য কত মানুষই না মারে গেছে! কত মায়ের কোল হারিয়েছে, কত বোনের ভাই হারিয়েছে,কত নারীর স্বামী হারিয়েছে! ওর নিজের দুইটা ফ্রেন্ডও অনেকবাজে ভাবে আহত হয়েছে। এখনও ভালোভাবে হাঁটতে পারেনা! আল্লাহ যাতে আর কখনও এমন দিন কাউকে না দেখায়। ও বাসায় একটু দেরীতে ফিরলে ওর বাবা মা চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়! আর সেখানে সন্তানহারা মায়েদের কি অবস্থা! উনাদের ছেলেমেয়ে কি আর নিজ নীড়ে ফিরবে! ভাবতেই ওর বুকটা ভারী হয়ে আসলো! চা টা শেষ করে ও রুমের দিক চলে গেলো।
হালকা বেগুনি রঙের একটা থ্রিপিস পড়ে, চুলগুলোকে বেনী করে একপাশ ফেলে, চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপবাম লাগিয়ে ও ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। আশেপাশে রিকশা বা টমটম দেখছে না ও। নক্ষত্র ঘুমে এখনও। নইলে ওকে বললে বাইকে করে ওকে দিয়ে আসত। কিছুদূর হাঁটার পর ওর ওড়নায় হালকা টান পড়তেই ও চমকে পিছনে ফিরে তাকালো। দেখলো ছয় থেকে সাত বছর বয়সী একটা ছেলে মুচকি হেসে হাতে শুভ্র রাঙা একটা গোলাপ ফুল ওর দিক এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাহী কিছু বলতে যাবে তার আগেই,,,
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ০৩ (হাসিঠাট্টা!)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
কিছুদূর হাঁটার পর ওর ওড়নায় হালকা টান পড়তেই প্রাহী চমকে পিছনে ফিরে তাকালো। দেখলো ছয় থেকে সাত বছর বয়সী একটা ছেলে মুচকি হেসে হাতে শুভ্র রাঙা একটা গোলাপ ফুল ওর দিক এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাহী কিছুটা অবাক হয়ে ছেলেটার দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর মাথা নুইয়ে এক হাত দিয়ে কাঁধের ব্যাগ টা ধরে আরেক হাত দ্বারা ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কিছু বলবে?’
ছেলেটা হালকা মাথা নাড়ালো। প্রাহী কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটা ওর হাতে শুভ্র রাঙা গোলাপ ফুলটা গুঁজে এক দৌড়ে চলে গেল।
– ‘আরেহহহ্!’ বলে প্রাহী ধরতে যেয়েও ধরতে পারলোনা ছেলেটাকে। ও একবার হাতের মুঠোয় থাকা গোলাপ ফুলটার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার পিচ্চি ছেলেটার দৌড়ে যাওয়ার দিক তাকাচ্ছে। একদম তাজা শুভ্র গোলাপ! মনে হয় এখনই কোনো বাগান হতে তুলে আনা হয়েছে। প্রাহী ফুলটা নাকের সামনে ধরলো। বেশ মিষ্টি একটা সুবাস! ওর গোলাপ বেশ পছন্দ!প্রাহীদের বাড়ির বাগানে একটা লাল গোলাপের চারা আছে। বেশ লাল গোলাপ ফুল ওখানে। আজ হুট করে সাদা গোলাপ দেখে ওর বেশ ভালো লাগলো। ও ফুলটার দিক তাকিয়ে গালভর্তি হাসলো। চোখ বন্ধ করে আবারও ফুলটার সুবাস নিয়ে ব্যাগের সাইড পকেটে ফুলটাকে যত্ন করে রেখে দিলো।
ইট,পাথরে মোড়ানো সোজা রাস্তা। তার পাশেই মাটির তৈরি পথ। যেখানে সারি সারি নারিকেল গাছ সহ বিভিন্ন গাছ দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছগুলোর পাশ ঘেষে ছোটো,বড় ছেলেমেয়েগুলো কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে হেঁটে চলেছে। ছেলেমেয়েগুলোর কেউ কেউ স্কুলের কিংবা কলেজের বা মাদ্রাসার! হালকা মিষ্টি রোদ। যার আলতো তাপে শরীর মন দুটোই বেশ সতেজ লাগছে। এর মাঝেই আশেপাশের মানুষজন যে যার যার মতোন করে নিজ গন্তব্যে ছুটি চলেছে। টমটম গাড়িতে বসে প্রাহী শহরের অকৃত্রিম এই সৌন্দর্যগুলো বেশ দারুণভাবে উপভোগ করছে। ঝিরিঝিরি হালকা শান্ত বাতাসে ওর সামনের চুলগুলো এলোমেলোভাবে মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে। আলতো হাতে চুলগুলো কানে গুজে প্রাহী চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো। বাতাসের মাঝে মিশে থাকা মাটির গন্ধ, ফসলের ক্ষেতের ঢেউ খেলানো, সবুজ অরণ্যের আড়ালে থাকা কিছু ফুলের সুবাস এক অন্যরকম মাতাল আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। শ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে বাতাসের একটা মিষ্টি গন্ধ টের পেতেই প্রাহীর মনটা জুড়িয়ে গেল! ও এখন বুঝতে পারে কেন ওর বাবা খুলনার এই শহর ছেড়ে ঢাকা শহরে যেয়ে থাকতে চান না। আগে যখন প্রাহী ডিসেম্বরের ছুটিতে ঢাকায় ফুপুদের বাসায় বেড়াতে যেত। তখন ভাবতো কেন যে বাবা ঢাকায় পুরোপুরিভাবে চলে আসতে চায়না! এত সুন্দর শহর ছেড়ে কেন যে ওরা ওই মফস্বল শহরে পড়ে আছে কে জানে! কিন্তু এখন ও বুঝে বাবার এখানে থাকার কারণটা। কেনই বা বুঝবে না! সবাই যখন যার যার কাজ শেষে মন খারাপ বা ক্লান্তি নিয়ে নিজ গৃহে ফিরতে যায় তখন চারপাশের এই অবর্ননীয় সৌন্দর্যের ভীড়ে সবার সেই ক্লান্তির বা মন খারাপের রেশটুকু মুছে যায়! দিনশেষে কে না চায় নিজেকে প্রকৃতির ভীড়ে হারাতে! চোখ খুলে প্রাহী আশেপাশটা মুচকি হেসে দেখতে লাগলো। শহরের এদিকটায় তেমন একটা টিনের বা মাটির ঘর দেখা যায়না। তবুও ইট পাথরের গড়ে তোলা দালানের ভীড়ে কিছু মাটির ঘর, খড়ের গম্বুজ, শান বাঁধানো ঘাটলা উঁকি দিয়ে আছে! যেন তারা বলছে ‘ওহ শোনো! এই ইট কংক্রিটের আড়ালেও আমাদের খুঁজে পাবে যুগের পর যুগ!’
ভার্সিটির সামনে এসে থামতেই প্রাহী টমটম গাড়ী থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে সামনে এগোলো। ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢুকে শহীদ মিনারের চত্বরের কাছটায় যেয়ে বসলো। কতদিন পর ভার্সিটি এসেছে ও! আন্দোলনের জন্য আজ প্রায় একটা মাস পর ভার্সিটি এলো সবাই। তাও আশপাশটায় মানুষ একটু কম। পরিস্থিতি যেহেতু এখন একটু স্বাভাবিক! হয়তো আস্তে আস্তে এখন সবাই আসবে। কিছুক্ষণ বসে এদিক সেদিক তাকাতেই দেখলো শোয়াইব ক্রাচ হাতে নিয়ে তাতে এক পায়ে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ওর কাছে আসছে। প্রাহী এক দৃষ্টিতে সেদিক তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা আন্দোলনে যেয়ে বাম পায়ে গুলি খেয়ে ফিরেছে। সবাই ভেবেছিলো ওর বাম পা টা হয়তো ওর হারাতে হবে বা প্যারালাইজড হয়ে যাবে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ! সেরকম কিছুই হয়নি। হাঁটতে যে পারছে এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।
শোয়াইব ওর কাছে এসে দাঁড়াতেই প্রাহী ওর হাত থেকে ক্রাচ টা নিয়ে ওকে বসতে সাহায্য করলো। বসার পর প্রাহী ওকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘এই অবস্থায় আসতে গেলি কেন! পা টাতো এখনও বোধহয় ঠিক হয়নি!’
শোয়াইব কাঁধ থেকে ব্যাগ টা হাঁটুর উপর রাখতে রাখতে বললো,
– ‘আর কত এভাবে ঘরে থাকা যায়! তাছাড়া ভার্সিটিও যেহেতু খুলে দিয়েছে পরীক্ষার ডেইটও দিয়ে দিবে। তাই ভাবলাম একটু আসি। ক্লাস শেষে আড্ডা মাড্ডা দিয়ে গেলে ভালো লাগত।’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
– ‘তাও কথা! কিন্তু তুই একাই! বাকিরা কোথায়?’
– ‘রাতুল আর তুলি আজকে আসেনি। রাতুল ওর বড় বোনের বাসায় গিয়েছে ঢাকায়। শুনলাম কাল আসবে। আর তুলির মায়ের শরীরটা ভালোনা। আন্টিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। তাই আজ আর আসতে পারেনি। নেক্সট ক্লাস থেকে ভার্সিটিতে আসবে শুনলাম। যাই হোক তোর সাথে শিমলাকে দেখছি না! ও আসেনি?’
প্রাহী এক গাল হেসে বললো,
– ‘ও কিভাবে আসবে! আপার বিয়ে না! তাও কল দিয়েছিলাম সকালে ধরেনি হয়তো ঘুম বা কাজে ব্যস্ত ছিলো!’
শোয়াইব প্রাহীর কথায় ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
– ‘ওহ হ্যাঁ! ওর বড় বোনের তো বিয়ে। যাই হোক কালকে হলুদ ছিলোনা!’
– ‘হ্যাঁ। তোরা আসলি না যে?’
শোয়াইব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– ‘কিভাবে আসতাম! এই পা নিয়ে! ইচ্ছা করেনা এটাকে হেচড়িয়ে কোথাও যেতে। তবুও বিয়েতে থাকবো এটা শিউর থাক। একটা সময় আপার কাছে পড়েছি যাওয়াটা আবশ্যক। রাতুল আর তুলিও যাবে বলেছে।’
প্রাহী মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘অবশ্যই অবশ্যই! আসিস মজা হবে!’
শোয়াইব মুচকি হেসে বললো,
– ‘হুম আসব। আজকে কি সব ক্লাস করবি?’
– ‘হ্যাঁ, ভাবছি আজ সব ক্লাসই করবো। তাছাড়া তন্নির থেকে কিছু নোটস ও নিতে হবে। সামনে পরীক্ষা দিয়ে দিলে পরে প্রেশারে পড়ে যাব।’
– ‘তা তো অবশ্যই! আমিও ভাবছি ক্লাসগুলো করব। কিন্তু প্রথম ক্লাসটা হচ্ছে আলীকত স্যারের। উনার পড়া তো কিছুই বুঝিনা! স্লাইড দেখে একনাগাড়ে রিডিং পড়িয়ে যায়। সেই নিজেদেরই পরে বুঝেশুনে পড়তে হয়। এভাবে রিডিং পড়ালে কে বুঝে ভাই!’
প্রাহী হালকা হেসে বললো,
– ‘উনার পড়া বুঝাটা একটু কঠিন। আচ্ছা চল যেয়ে দেখি কি অবস্থা!’
শোয়াইব মাথা নাড়ালো। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর দুইজন মিলে ক্লাসে চলে গেলো।
ম্যাথ ক্লাসে প্রাহীর বেশ ঘুম পাচ্ছে। পড়া না বুঝলে ওর ঘুম পায়। শোয়াইব বলেছিল আলিকত স্যারের ক্লাস টা না করে বাকিক্লাস গুলো করতে। ও শুনেনি ভেবেছে এতদিন পর প্রথম ভার্সিটির ক্লাস। তাই সবার ক্লাসেই এটেন্ড থাকবে। কিন্তু এখন দেখছে ও ক্লাসে এসে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। আলীকত স্যার স্লাইড দেখে ম্যাথ রিডিং পড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকে না বুঝে প্রশ্ন করলে উনি বুঝিয়ে দিচ্ছেনা তেমন নয়! ঠিকই উনি বুঝিয়ে দিচ্ছে। তারপরও অনেকেই উনার পড়া বুঝতে পারছেন না। আসলে অনেকেই থাকে এমন যারা নিজেরা বুঝলেও অন্যদের ভালোভাবে বুঝাতে চেয়েও বুঝিয়ে উঠতে পারেনা। আবার অনেকেই আছে নিজেরাও ভালো বোঝে অন্যদেরও অত্যন্ত ভালোভাবেই বোঝায়। শোয়াইব প্রাহীর পিছনে বসেছে। প্রাহী হাই তুলে পিছন ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে ওকে বললো,
– ‘ঘুম ধরেছে অনেক! চা পান করবি?’
শোয়াইব হাতঘড়ির দিক ইশারা করে বললো,
– ‘ক্লাসটা শেষ হোক! ক্যান্টিনে যেয়ে খাব নে!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে আবার সামনে ফিরে স্যারের ‘ম্যাথ’ রিডিং পড়ায় মন দিলো।
প্রথম ক্লাস শেষে ব্রেক টাইমে প্রাহী আর শোয়াইব মিলে ক্যান্টিনে বসে চা পান করে হালকা পাতলা নাস্তাও সেড়ে নিলো। ওদের আরও দু’টো ক্লাস আছে আজকে! ব্রেক টাইম আছে আরও প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো। প্রাহী কিছু একটা ভেবে শোয়াইব কে বলে উঠলো,
– ‘চল লাইব্রেরিতে যাই!’
শোয়াইব চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে বললো,
– ‘হঠাৎ লাইব্রেরিতে কেন?’
– ‘আরে চল। কাজ আছে একটু!’
চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে শোয়াইব ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
– ‘আচ্ছা চল।’
বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত নিরিবিলি লাইব্রেরির এক কোনে বইয়ের ভাঁজে মুখ গুজে রয়েছে এক তরুণী। নাম তার তন্নি। খুলনা ইউনিভার্সিটিতে এবার সেকেন্ড ইয়ারে অধ্যয়নরত অবস্থায় রয়েছে তন্নি। বইয়ের পাতা উল্টাতে যাবে তার আগেই কারো ধীর কন্ঠস্বর শুনে তন্নি চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ তুলে তাকালো। দেখলো ওর সামনে প্রাহী হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই শান্তভাবে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শোয়াইব। শোয়াইব এর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রাহীর দিক তাকিয়ে তন্নি বলে উঠলো,
– ‘আরে প্রাহী যে! এসো বসো?’ বলে পাশের চেয়ারটা এগিয়ে দিলো।
প্রাহী মুচকি হেসে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– ‘কেমন আছো! অনেকদিন পর দেখা হলো তাইনা?’
তন্নি মিষ্টি হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! আন্দোলনের পর থেকে তো আর দেখা হয়নি!’
– ‘হ্যাঁ। অনেকদিন পর ভার্সিটি আসা হয়েছে সবার।’ বলেই প্রাহী পাশে তাকিয়ে দেখলো শোয়াইব এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ও ভ্রু কুঁচকে শোয়াইবের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কি ব্যপার দাঁড়িয়ে আছিস কেন! এখানে বোস?’ বলে প্রাহী পাশের একটা চেয়ার শোয়াইব এর জন্য টেনে দিলো। শোয়াইব আস্তে ধীরে সেখানে বসতে বসতে বললো,
– ‘হুম।’
প্রাহী তন্নির দিক ফিরে সহজ কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘তন্নি একটা হেল্প লাগতো!’
তন্নি মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ বলো!’
প্রাহী ব্যাগ থেকে থেকে খাতা বের করতে করতে বললো,
– ‘আসলে এতগুলো দিন ভার্সিটি ওফ ছিলো। আবার ভার্সিটি বন্ধের আগের ক্লাসগুলো তেমন করতে পারিনি। তাই অনেক টপিক এর নোট আমি করতে পারিনি। তোমার কাছে সেই নোটগুলো আছে! আমি একটু তাহলে আমার খাতায় তুলে নিতাম!’
তন্নি দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো,
– হ্যাঁ অবশ্যই! আগের টপিকের নোটগুলো আমার কাছে আছে। তুমি চাইলে ওগুলো নিতে পারো। আর আজকের টপিকগুলোর নোট বাসায় যেয়ে করব। তুমি তাহলে আপাতত আগের নোটগুলো নাও!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে ওর থেকে নোটগুলো তুলে দিতে লাগলো। পাশাপাশি তন্নি প্রাহীকে বুঝিয়ে দিতে লাগলো কোন টপিকের নোট কোনগুলো। তন্নির কেন জানি মনে হলো কেউ ওর দিকে সূক্ষ্মভাবে তাকিয়ে আছে। প্রাহীকে পড়া বুঝানোর মাঝেই ও মাথা তুলে দেখলো সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। আর শোয়াইব হাঁটুর উপর ফোন রেখে চালিয়ে যাচ্ছে। ও আবারও চশমাটা ঠিক করে মাথা নিচু করে প্রাহীকে নোটগুলো বুঝিয়ে দিতে লাগলো।
নোটগুলো নিয়ে প্রাহী খাতাটা ব্যাগে রাখতে রাখতে তন্নির দিক কৃতজ্ঞাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– ‘ধন্যবাদ তন্নি! নোটগুলো না নিলে বেশ বিপদে পড়ে যেতাম!’
তন্নি হালকা হেসে বললো,
– ‘ধন্যবাদ দেওয়া লাগবে না! আমরা আমরাই তো তাইনা!’
প্রাহী হালকা হেসে ওর দিক তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা ভীষণ ভালো। অনেক মিশুক! ছোটো খাড়া নাক, টানা টানা চোখ যা মোটা চশমার আড়ালে আবৃত, পাতলা ঠোঁট সব মিলিয়ে গোলগাল চেহারার মেয়েটাকে ওর বেশ ভালো লাগে! দেখতে যেমন পড়াশোনাতেও মাশাল্লাহ! ওদের ক্লাসের টপ স্টুডেন্টদের মাঝে একজন হলো তন্নি। যেই আলীকত স্যার এর ক্লাসের পড়া ওরা কেউ বোঝেনা সেই আলীকত স্যারের ক্লাসের টপ স্টুডেন্ট হচ্ছে তন্নি। মেয়েটা বেশ মেধাবী! ছোটো গোলগাল চেহারায় সবসময় বড় চশমা পড়ে থাকে মেয়েটা। প্রাহী মাঝেমধ্যে ভাবে পড়তে পড়তে মনে হয় মেয়েটার চোখগুলোর পাওয়ারও গেছে হারিয়ে!
– ‘ওটা কি?’
তন্নির প্রশ্নে প্রাহী ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এলো। দেখলো তন্নি আর শোয়াইব ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রাহী তন্নির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কোনটা কি?’
তন্নি হাতের ইশারা দিয়ে বললো,
– ‘ঐ যে তোমার ব্যাগের পাশে!’
প্রাহী ব্যাগটা নাড়াতেই দেখলো শুভ্র গোলাপ ফুলটা ব্যাগ থেকে বেড়িয়ে টেবিলের এক সাইডে পড়ে আছে। প্রাহী দ্রুত ফুলটা হাতে নিলো। তন্নির দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘এটার কথা বলছো! এইটাতো সাদা গোলাপ!’
তন্নি মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘তা তো বুঝলাম! কিন্তু তোমার ব্যাগে যে! কোথাও থেকে নিয়েছ? নাকি কিনেছো?’
প্রাহী সাথে সাথে বলে উঠলো,
– ‘না না কিনিনি। একজন দিয়েছে!’
ওর এই কথা বলার সাথে সাথে তন্নি এবং শোয়াইব ওর দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ওদের এরূপ চাহনী দেখে প্রাহী হালকা হেসে বললো,
– ‘আরে একটা ছোট বাচ্চা দিয়েছে।’ বলেই সকালের ঘটনা দু’জনকে বলতে লাগলো ও। সবটা শুনে তন্নি হুট করে প্রশ্ন করে উঠলো,
– ‘সবই বুঝলাম! কিন্তু ফুলটাকি আদৌও ওই বাচ্চা ছেলেটা নিজ থেকে তোমাকে দিয়েছে! নাকি কেউ ওর মাধ্যমে তোমাকে দিয়েছে!’
তন্নির এই প্রশ্ন শুনে প্রাহী ফুলটার দিক তাকিয়ে আবারও খানিকটা ভাবনায় বিভোর হয়ে উঠলো। আসলেই তো! ফুলটাকি আসলেই ছেলেটা ওকে দিয়েছে! বাচ্চা ছেলেটাকে ও কখনও আগে দেখেনি। চেনা জানাহীন একটা ছেলে এভাবে সাত সকালে ফুল দিতে আসবে! আবার কেই বা ওকে এই শুভ্র গোলাপ দিবে! তেমন বিশেষ কেউও তো ওর জীবনে নেই তাহলে!
প্রাহীকে আবারও চুপ থাকতে দেখে তন্নি ওর হাতের উপর হাত রেখে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
– ‘এই প্রাহী! কি ভাবছো?’
প্রাহী চমকে উঠে বললো,
– ‘না না কিছুনা। আসলে বুঝতে পারছিনা কে এই গোলাপটা দিলো…’
প্রাহীকে থামিয়ে তন্নি বলে উঠলো,
– ‘আচ্ছা ব্যাপার না। এটা নিয়ে এত চিন্তার কি আছে! যেই ই দিকনা কেন ফুলই তো দিয়েছে! আর তাছাড়া গোলাপটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে!’ বলেই তন্নি মুচকি হাসলো। হাসলে তন্নির বাম গালে টোল পড়ে। যা দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। হাসতে হাসতে পাশে তাকিয়ে দেখলো শোয়াইব এক নাগাড়ে ফোনের দিক তাকিয়ে আছে। তন্নি তাকাতেই ও একবার তন্নির দিক তাকিয়ে আবার ফোনে মন দিলো। তন্নি সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো প্রাহী গোলাপটা ব্যাগে ভরে রাখছে। ও প্রাহীকে বলে উঠলো,
– ‘ব্যাগে রাখছো যে?’
ফুলটা ব্যাগে রাখতে রাখতে প্রাহী বলে উঠলো,
– ‘আপাতত ব্যাগে রাখছি! বাসায় যেয়ে আলাদা ছোটো ফুলদানিতে পানি ভরে রেখে দিব না হয়।’
– ‘ব্যাগে রেখো না। ফুলটা নষ্ট হয়ে যাবে!’
প্রাহী ব্যাগ থেকে ফুলটা আবারও বের করে বললো,
– ‘তাহলে কি করবো?’
তন্নি মুচকি হেসে বললো,
– ‘ফুলটা কানের পাশে চুলের ভাজে গুজো। তাহলেই তো হয়!’
প্রাহী কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ! এখানে এভাবে!’
– ‘কিছু হবেনা৷ অন্য সবার মতো তো আর কৃত্রিম জিনিস দিয়ে নিজেকে সাজাচ্ছ না! একটা ফুল চুলের ভাজে গুজবে অসুবিধে কি?’
তন্নির কথায় প্রাহী মাথা নাড়ালো। এমন না যে কানের মাথায় ফুল গুজাটা ওর পছন্দ না! বাসায় থাকলে প্রায় সময়ই বাগান হতে ফুল নিয়ে ও কানে গুজে। এটা ওর বেশ ভালো লাগে। প্রাহী শুভ্র গোলাপটাকে কানের পাশে চুলের ভাজে আলতোভাবে গুজে হালকা হাসলো। তন্নি আর শোয়াইব ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। তন্নি এক গালভর্তি হেসে বললো,
– ‘ একদম ফুলটায় বেশ মানিয়েছে তোমায়! আচ্ছা বলোতো! যে তোমাকে এই ফুলটা দিয়েছে সে কি জানতো যে এই ফুলটায় তোমায় এত মিষ্টি লাগবে!’
প্রাহী তিন্নির কথায় খিলখিল করে হেসে বললো,
– ‘কি জানি!’
প্রাহীর দেখাদেখি তিন্নিও হেসে ফেললো। ওদের হাসি দেখে শোয়াইব আশেপাশে তাকিয়ে ফোনটা টেবিলে রেখে বললো,
– ‘হিসসস্! আস্তে এটা লাইব্রেরী!’
প্রাহীরা হাসি থামিয়েও আবার হাসতে লাগলো। শোয়াইব ওদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। এভাবেই টুকটাক গল্প করতে লাগলো ওরা। হুট করে প্রাহী,,,
চলবে।