#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ০৮ (নিজস্ব ফুল)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
-‘নো নিড প্রাহী!’
বলেই হালকা ঝুঁকে আকসাদ ওর মুখে হালকা একটা ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। প্রাহী শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! মেরুদণ্ড দিয়ে যেন এক ঠান্ডা শিহরণ বয়ে চললো!
বিছানায় বসে প্রাহী নিজের মেহেদী রাঙা হাতজোড়ার দিক তাকিয়ে আছে। নিঁখুত ডিজাইনের মধ্যে ছোটো লাভ শেইপের মাঝে নিজের নামের প্রথম অক্ষরটার উপর আঙুল বুলিয়ে জানালার ফাঁকে বিকেলের দীপ্ত আলোয় রেঙে উঠা প্রকৃতির দিক তাকালো। আলোর রেখার দিক তাকিয়েই ভাবনায় নিঁখোজ হলো প্রাহী।
মেহেদী অনুষ্ঠানের স্টেজে বিয়ের কনে তথা রুমি আপার হাতে মনোযোগ সহকারে মেহেদী পড়িয়ে দিতে লাগলো প্রাহী। ওর মেহেদীর পড়ানোর হাত ভালো। টানা দেড় ঘন্টা পর মেহেদী পড়ানো শেষে আপার দিক তাকিয়ে হালকা হেসে ও স্টেজ থেকে নেমে এলো। স্টেজের একপাশেই শিমলা,তন্নি,সানজিদা সহ আরও অনেকেই মেহেদী পড়ছে। একটানা মেহেদী পড়ানোর দরূন ওর ঘাড় টা বেশ ব্যথা করছে। ভেবেছিলো আপাকে মেহেদী পডানোর পর এক হাতে নিজে মেহেদী পড়বে আর অন্য হাতে কাউকে দিয়ে মেহেদী পড়াবে। কিন্তু এখন আর ইচ্ছা করছে না কেন জানি!
– ‘এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যে! মেহেদী পড়বেন না?’
পিছন ফিরে দেখলো আকসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ধীর কন্ঠে প্রাহী বলে উঠলো,
– ‘হু! দেখি পড়বো।’
আকসাদ হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘এদিকটায় আসুন!’
প্রাহী ভ্রুকুটি করে বললো,
– ‘কেন?’
– ‘আসুন!’
বলেই আকসাদ সামনে এগোতে লাগলো। অগত্যা তার পিছু পিছু প্রাহীও চললো! হালকা কোলাহলবিহীন জায়গায় একটা চেয়ারে প্রাহীকে বসতে বলে আকসাদ কোথায় জানি গেল! খানিকবাদে একটা মেয়েকে সাথে নিয়ে এসে ওকে ইশারা করে বললো,
– ‘উনি আপনাকে মেহেদী পড়িয়ে দিবে।’
প্রাহী অবাক দৃষ্টিতে আকসাদের দিক তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আকসাদ বলে উঠলো,
– ‘মেহেদী পড়ে নিন প্রাহী! নাহলে আজ আর আপনার মেহেদী পড়া হবে না! অলরেডি সবাই মেহেদী পড়ে ফেলেছে!’
প্রাহী আর কিছু বললো না। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি চেয়ার টেনে এনে ওর হাতে ধরে মেহেদী পড়ানো শুরু করলো। পাশেই আকসাদ একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। নিপুণভাবে মেহেদী পড়ানো শেষে হাতের তালুতে ছোট্ট লাভ শেইপে কিছু লেখার আগে প্রাহীর দিক তাকিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কারো নাম লিখবো আপু?’
প্রাহীর বলার আগেই পাশ থেকে শান্ত কন্ঠে আকসাদ বলে উঠলো,
– ‘আপাতত উনার নামই লিখুন! একসময় না হয় এখানে আরও একজনের নাম সংযুক্ত হবে!’
প্রাহী চমকিত দৃষ্টিতে মাথা তুলতেই দেখলো একজোড়া শান্ত চোখ ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! ঠোঁটে তার বাকা হাসি। প্রাহী জলদি চোখ সরিয়ে ফেললো। মেহেদী পডানো মেয়েটি ওর নাম জিজ্ঞেস করে হাতের মাঝে ‘প্রাহী’ লিখে দিলো। মেহেদী দেওয়া শেষে মেয়েটি মাতা তুলে ওর দিক মুচকি হেসে আকসাদের দিক ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘ভাইয়াটা কি আপনার ফি’য়োন্সে বুঝি আপু?’
প্রাহী হালকা কেঁপে উঠে সাথে সাথেই মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘না না।’
– ‘তাহলে কি আপনার বয়ফ্রেন্ড!’
প্রাহী তব্ধা খেয়ে আবারও বলে উঠলো,
– ‘না! সেরকম কিছুই না!’
পাশ থেকে আকসাদ হালকা শব্দে হেসে বললো,
– ‘সেরকম কিছু না আবার অনেক কিছুই তাই না মিস প্রাহী!’
প্রাহী ছোটো ছোটো চোখে আকসাদের দিক তাকিয়ে রইলো! বলছে কি এই লোক!
আকসাদ হাসি বজায় রেখেই প্রাহীর দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে মেহেদী পড়ানো মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ‘থ্যাংকস্!’
মেয়েটি আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘ধন্যবাদ দেয়ার প্রয়োজন নেই! আমাকে আনা হয়েছেই মেহেদী পড়ানোর জন্য! আসি তাহলে!’
মেয়েটি যাওয়ার পর প্রাহী সাথে সাথে আকসাদের দিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আপনি তখন কি বললেন!’
আকসাদ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
– ‘কখন কি বললাম!’
– ‘ওইযে কিছুনা আবার অনেক কিছু! এটার মানে কি!’
আকসাদ আলতো হেসে বললো,
– ‘এটার মানে হলো!’
প্রাহী ভ্র কুঁচকে বললো,
– ‘কি?’
আকসাদ প্রাহীর দিক হালকা এগিয়ে এসে বললো,
– ‘বারবার চমকালে আপনায় দারুণ লাগে মিস প্রাহী!’
প্রাহী বিস্মিত দৃষ্টিতে আকসাদের দিক তাকিয়ে রইলো! আকসাদ তা দেখে ঠোঁটের কোণে আলতো হেসে বললো,
– ‘আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবেন মিস প্রাহী!’
বলে প্রাহীর মেহেদী পড়ানো হাতজোড়ার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আপনার হাতে মেহেদী মানিয়েছে!’
প্রাহী হাতজোড়ার দিক চেয়ে দেখলো আসলেই! ডিজাইন টা সুন্দর হয়েছে!
– ‘মেহেদীর রঙে আরও মানাবে!’
আকসাদের কথায় প্রাহী ওর দিক তাকালো। কি নিবিড়ভাবে ওই চোখজোড়া ওর হাতের দিক তাকিয়ে আছে!
– ‘ঘুমাবি না!’
মায়ের কথায় প্রাহী ভাবনার ভুবন হতে বেড়িয়ে এলো। দেখলো ওর মা হাতে শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাহী বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
– ‘এখন আর ঘুমাবো না। সন্ধ্যায় বিয়ের অনুষ্ঠান। একবারে রাতেই ঘুমাব!’
প্রাহীর মা দেয়াল ঘড়ির দিক তাকিয়ে বলে উঠলেন,
– ‘সময় আছে তো! এক ঘন্টা ঘুমিয়ে নে! রাতে সেভাবে ঘুম হয়নি!আবার সকালে ভার্সিটি গিয়েছিস! ঘুমা একটু। ভালো লাগবে।’
প্রাহী একবার ওর মার দিকে তাকিয়ে বিছানায় যেয়ে বসলো। ঘুমানো দরকার! কিন্তু এখন ঘুমালে উঠতে পারবে তো ঠিকমতো!
– ‘চিন্তা করিস না! আমি ডেকে দেব ক্ষন!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখজোড়া বন্ধ করতেই নিদ্রায় তলিয়ে গেলো।
বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান। চারপাশে মানুষে গিজগিজ করছে। প্রাহী এদিক সেদিক তাকিয়ে শিমলাকে খুঁজছে! রাতুল ওদেরকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না! সব গেল কই! দূর থেকে দেখলো শোয়াইব একটা চেয়ারে বসে ফোন টিপছে। প্রাহী সেদিকেই এগিয়ে গেলো।
– ‘তুই কখন এলি?’
কারো কন্ঠস্বর পেয়ে শোয়াইব ফোন থেকে চোখ তুলে দেখলো ওর সামনে প্রাহী দাঁড়িয়ে আছে।
– ‘আধ ঘন্টা হলো এসেছি। তুই কি মাত্র এলি?’
– ‘হ্যাঁ। রাতুল তুলি ওদের কোথাও দেখছি না! ওরা আসেনি!’
বলে প্রাহী আশপাশ তাকাতে থাকলো।
– ‘এসেছে। এতক্ষণ এখানেই ছিলো। বিয়ের কনে দেখতে গিয়েছে। চলে আসবে!’
প্রাহী ‘ওহ্’ বলে সামনে তাকাতেই দেখলো তন্নি শাড়ির কুঁচি ধরে কমিউনিটি সেন্টার এর গেইট দিয়ে এগিয়ে আসছে। প্রাহী হালকা ভ্রু কুঁচকে সেদিক তাকিয়ে এগিয়ে গেলো।
– ‘আরে তন্নি তুমি এখানে!’
কারোর আওয়াজে পাশ ফিরে দেখলো প্রাহী ওর দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাঁকিয়ে আছে। তন্নি ওকে দেখে হেসে বললো,
– ‘আরে প্রাহী! কেমন আছো?’
প্রাহী হেসেই বললো,
– ‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ! তোমার কি অবস্থা!’
– ‘আছি আলহামদুলিল্লাহ! তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল!’
– ‘হ্যাঁ! তোমাকে দেখে ভাবছিলাম আসলেই তুমিই এসেছ কিনা!
তন্নি হালকা হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ আমিই এসেছি! আসলে শিমলার বাবা আর আমার বাবা অফিসিয়ালি বন্ধু। আংকেল আমাদের ইনভাইট করেছিলো। তাই বাবার সাথে এসেছি!’
প্রাহী মুচকি হেসে বললো,
– ‘তাই নাকি এটাতো ভালো কথা! যাই হোক তোমাকে সুন্দর লাগছে!’
– ‘তোমাকেও!’
প্রাহী হেসে বললো,
– আচ্ছা! চলো ওদিকটা যাই!’
বলেই তন্নিকে নিয়ে সামনে এগলো প্রাহী।
ঝনঝন কথার আওয়াজ কানে বাজতেই শোয়াইব সামনে তাকাতেই ও একটু চমকালো। প্রাহী আর তন্নি কথা বলতে বলতে এইদিকেই এগিয়ে আসছে! শোয়াইব নিজেকে স্বাভাবিক করে বসে রইলো।
– ‘শোয়াইব দেখ তন্নি! শিমলার বাবা নাকি ওর বাবা নাকি বন্ধু! তাই ও আর ওর বাবা এসেছে!’
প্রাহীর কথায় শোয়াইব কিছুক্ষণ তন্নির দিক তাকিয়ে থাকলো। তন্নি আজ হালকা হলুদ রাঙা একটা শাড়ি পড়েছে। কাঁধ সমান চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। চোখে চশমা, হালকা সাজ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। শোয়াইব সাথে সাথে নজর সরিয়ে বললো,
– ‘ওহ্।’
– ‘তন্নি চলো আপাকে দেখতে যাই! আমি এখনও দেখিনি আপাকে।’
প্রাহীর কথায় তন্নি মাথা নাড়িয়ে ওর সাথে চললো। যেতে যেতে আড়চোখে একবার শোয়াইবের দিক তাকালো। ওর পড়নে হালকা নীল পাঞ্জাবি। চুলগুলো গুছালো। চেয়ারের পাশেই ক্রাচ রাখা। তন্নির চোখে শোয়াইবের চোখ পড়তেই ও চোখ নামিয়ে প্রাহীর সাথে হাঁটতে লাগলো।
ফোনে কথা বলা অবস্থায় আকসাদ পাশ ফিরে তাকাতেই কিছুক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে রইলো! ওফ হোয়াইট শাড়ি পরিহিত এক রমণী আলতো পায়ে সিড়ি দিয়ে উঠে চলেছে। আকসাদ ফোন কেটে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে চললো।
– ‘মিস প্রাহী!’
হুট করে কারো আওয়াজে পা থামিয়ে প্রাহী পিছন ফিরতেই ওর চোখদুটো সামনের লোকটার দিক আটকে গেলো! হালকা মেরুন পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় লোকটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে!
– ‘মিস প্রাহীইইই!’
আকসাদের ডাকে প্রাহী নিজেকে স্বাভাবিক করে সামনে তাকিয়ে বললো,
– ‘জ্বী বলুন!’
আকসাদ বাঁকা হেসে বললো,
– ‘কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন বলুন তো!’
প্রাহী কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেলো। ইশ্! লোকটা নিশ্চয়ই ওকে কি না কি ভাবছে! আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে মুচকি হেসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তন্নির দিক ইশারা করে বললো,
– ‘আপনার ফ্রেন্ড!’
প্রাহী মাথা নাড়াতেই আকসাদ তন্নির দিক তাকিয়ে হেসে বললো,
– ‘হাই আমি আকসাদ!’
তন্নি ইতস্তত হেসে বললো,
– ‘হ্যালো! আমি তন্নি। আপনাকে তো চিনলাম না! আপনি!’
আকসাদ এক গাল হেসে বললো,
– ‘শিমলাকে চিনেন নিশ্চয়ই! আমি ওর কাজিন।’
তন্নি মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘তাই নাকি! নাইস টু মিট ইউ!’
– ‘ইউ টু!’
বলে আকসাদ প্রাহীর দিক আড়চোখে তাকিয়ে তন্নিকে জিজ্ঞেস করলো
– ‘তা কোথাও যাচ্ছিলেন!’
তন্নি হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ! বিয়ের কনেকে দেখতে যাচ্ছিলাম।’
– ‘আচ্ছা! যান তাহলে!’
তন্নি মুচকি হেসে মাথা নেড়ে প্রাহীকে নিয়ে চললোন। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তন্নি প্রাহীকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আচ্ছা লোকটা কি বিদেশী!’
প্রাহী ধীর কন্ঠে বললো,
– ‘হ্যাঁ!’
– ‘তাই ভাবছিলাম! দেখে বাঙালি মনে হয়না। লোকটা বেশ হ্যান্ডসাম আছে কি বলো?’
প্রাহী তন্নির কথায় জবাব না দিয়ে আস্তে করে একবার পিছন ফিরে তাকালো। দেখলো আকসাদের সূক্ষ্ম দৃষ্টি ওর দিকেই! প্রাহী ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো আকসাদ আজকেও ওরই পছন্দ করে দেওয়া সিল্কের পাঞ্জাবিটা পড়েছে!
গাঢ় লাল বেনারসি গায়ে রুমি আপাকে একদম টুকটুকে ‘লাল বউ’ লাগছে। মাথায় বড় খোপার উপর লাল শিফনের দোপাট্টা, গায়ে ভারী গহনা, ভারী সাজ,সব মিলিয়ে অতুলনীয় লাগছে! বিয়ের এই দিনটায় প্রত্যেকটা মেয়েকেই হয়তো তার নিজস্ব রূপরেখা হতে কয়েকগুণ বেশি লাবণ্য লাগে! এছাড়াও তখন একটা মেয়ের চেহারায় বাহারী সাজের আড়ালে চাপাকষ্ট,ভয় শোভা পায়! আপনজন ছেড়ে চলে নতুন একটা জায়গা চলে যাওয়ার শোক ও ভীতি তখন আরও বেশি করে একটা মেয়েকে আঁকড়ে ধরে! যেটা আপার চোখেমুখে এখন প্রকাশ পাচ্ছে! প্রাহী একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আপার দিক তাকিয়ে ওর চোখের কোণ ভিজে উঠলো। আর কখনও যখন তখন এই বাড়িতে এসে আপাকে দেখবে না! আর হয়তো কখনও কেউ বলবে না, ‘আজকে থেকে যা রাতে ছাদে যেয়ে আড্ডা দিব!’ প্রাহী,শিমলা ওরা যখন ছোটো ছিল তখন রুমি ওদের পড়াতো। প্রতিদিন আপার কাছে পড়তে আসা, বকা খাওয়া আবার আদুরে আলাপ জুড়ে দেওয়া ছিলো ওদের নিত্যদিনের কাজ! সবসময় বড় বোনের মতো ওকে শাসন, স্নেহ করায় প্রাহী প্রায় সময় শিমলাদের বাড়ি চলে আসতো! আর আজ থেকে আপা যখন থাকবে না তখন এই বাড়িতে এলে ওর কেমন লাগবে তখন!
দূর হতে শিমলার দিক নজর দিলো প্রাহী। মেয়েটা আজ তেমনভাবে বড় বোনের আশেপাশে ঘেষছে না! কেনই বা আসবে! আসলেই দু’বোন নিজেদের আবেগ,কষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না! শিমলার চেহারা টা থেকে থেকে লাল হয়ে উঠছে! প্রাহী নিঃশব্দে ওর পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘এভাবে মনমরা হয়ে থাকলে আপা কষ্ট পাবে আরও বেশি! একটু শান্ত হো!’
পাশ হতে তুলিও তাল মিলিয়ে বললো,
– ‘ঠিক! তুই একটু স্ট্রং থাক আপাতত! নইলে আপা নিজেকে আর সামলাতে পারবে না! বিয়ের সাজসজ্জা সব নষ্ট হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান শেষ হতে এখনও অনেক সময় বাকী।’
শিমলা মাথা নাড়িয়ে প্রাহীর দিক ঘুরে বললো,
– ‘বাইরে যাই চল! তোদের বড় কাকীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই!’
বলেই প্রাহী, তুলি আর তন্নিকে নিয়ে শিমলা বাহিরে চললো।
বাহারী আলোকসজ্জিত সেন্টারের একপাশে সোফায় বসে প্রাহীর মা, শিমলার মামী আরও অনেক আত্নীয়রা গল্প করছে।
– ‘বড় কাকী এরা আমার বান্ধবী!’
শিমলার উৎফুল্ল কন্ঠে সুদর্শন এক মহিলা মাথা তুলে ওর দিক তাকালো। প্রাহী ওরা কিছুটা অবাকে হয়ে সেইদিক চেয়ে থাকলো। কেউ বলবে না ওদের সামনে বসা এই অসাধারণ দেখতে মানবীটি শিমলার কাকী! ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, মাথায় পাকা চুলের তেমন দেখা নেই, গায়ে দামী জামদানী শাড়ি, গলায় হাতে পায়ে গুটি কয়েক স্বর্ণ যা কিনা জ্বলজ্বল করছে ফর্সা শরীরের চামড়ার সাথে মিশে! দেখলে মনে হবে কোনো তরুণীই হয়তো ওদের সামনে বসা!
– ‘ও হচ্ছে প্রাহী, ও তুলি আর ও তন্মি। আমরা সবাই একই ভার্সিটিতে পড়ি।।’
সুদর্শন সেই মহিলা ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। প্রাহীরা সালাম দিতেই উনি সালামের জবাব দিয়ে ওদের দিক তাকিয়ে স্পষ্ট বাংলায় ভাষায় বলে উঠলো,
– ‘কেমন আছো তোমরা?’
তুলি কিছুটা অবাক বললো,
– ‘আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি কেমন আছেন আন্টি!’
– ‘আমিও ভালো আছি! আলহামদুলিল্লাহ!’
তন্নি মুচকি হেসে বললো,
– ‘আপনি তো বেশ ভালো বাংলা পারেন আন্টি!’
শিমলার বড় কাকী হালকা হেসে বললেন,
– ‘বাঙালি পুরুষ বিয়ে করেছি! বাংলা তো জানতেই হবে তাইনা!’
তন্নি হেসে মাথা নাড়ালো। শিমলার বড় কাকী সবার সাথে কথা বলা অবস্থাতেই প্রাহীর দিক তাকালো। প্রাহী ঠোঁটে হাসি রেখে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। শিমলার বড় কাকী প্রাহীর সামনে যেয়ে ওর থুতনিতে হাত রেখে বললো,
– ‘তুমিই প্রাহী!’
প্রাহী নরম হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘জ্বী!’
শিমলার কাকী বেশ কিছুক্ষণ প্রাহীর দিক তাকিয়ে রইলেন। প্রাহী আজ ওফ হোয়াইট জামদানী শাড়ী, সাথে মেরুণ রঙের ব্লাউজ পড়েছে। আঁচল টা ছেড়ে দেওয়া। গোলগাল মুখ,চোখে মোটা করে কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক, কোমড় সমান চুলগুলো খোপা করা। সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর লাগছে ওকে! প্রাহীর থেকে নজর সরিয়ে সামনে কারোর দিক তাকিয়ে চোখের ইশারায় উনি মুচকি হাসলেন। প্রাহী কি মনে করে পিছন ফিরে তাকালো! কেউ তো নেই! তাহলে!
– ‘বেশ মিষ্টি লাগছে তোমাকে!’
শিমলার বড় কাকীর কথায় প্রাহী হালকা লজ্জা পেলো।
– ‘আপনাকেও বেশ সুন্দর লাগছে আন্টি!’
শিমলার বড় কাকী হালকা হাসলেন। পাশ থেকে তুলি শিমলাকে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– ‘উনিই কি তোর আকসাদ ভাইয়ের মা!’
– ‘হ্যাঁ! আর পাশে যে মেয়েটা বসে আছে ওটা আকসাদ ভাইয়ের বোন!’
শিমলাদের কথায় প্রাহী আকসাদের বোন আর মায়ের দিক তাকিয়ে ভাবলো, তার মানে ও ঠিকই ছিলো! ওর মা সেদিন উনার কথাই বলেছিলেন! কারণ আকসাদের সাথে শিমলার বড় কাকীর চেহারায় বেশ মিল। বিশেষ করে চোখ দুটো! আকসাদ উনার মায়ের মতোই ডাগর ডাগর চোখ পেয়েছে! আকসাদের বোনটাও আকসাদের মতোই অনেকটা! প্রাহী পিটপিট দৃষ্টিতে ওর থুতনী ছেড়ে মাথায় নরমভাবে হাত রাখা শিমলার বড় কাকীর দিক তাকিয়ে রইলো!
ওয়াশরুমে এসে নিজের শাড়ির কুঁচি টা ঠিক করছে প্রাহী। বারবার কুঁচি ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। মা মনে হয় কুঁচির জায়গাটায় সেফটিপিন তেমন দেয়নি! কোনোরকম কুঁচিটা ঠিক করে বাহিরে এসে করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগলো প্রাহী। হুট করে ও দাঁড়িয়ে পড়লো! কেন জানিনা ওর মনে হচ্ছে ওর পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! ঘাড়ে কারো গরম নিঃশ্বাস পড়তেই ও শিউরে উঠলো। পিছনে ফিরে দেখতে যাবে তার আগেই কেউ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
– ‘চুলগুলো খুলে দিন মিস প্রাহী!’
প্রাহী কেঁপে উঠলো। কোনো রকম একটা ঢোক গিলে পিছনে না তাকিয়েই বললো,
– ‘কেন!’
পিছন থেকে উত্তর এলো,
– ‘দরকার আছে তাই!’
প্রাহী ফের বলে উঠলো,
– ‘কিন্তু…।’
মুখের কথা আর বেড়োনোর আগেই টের পেলো খোপা করা ওর খোপায় বন্দি চুলগুলো ঝড়ঝড় করে কোমড় বেয়ে নেমে এসেছে। প্রাহী চোখ বন্ধ করে শাড়ির আঁচলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে একটা শ্বাস নিয়ে কাঁপাকাঁপা চোখে সামনে তাকিয়ে দেখলো আকসাদ ওর দিক তাকিয়ে আছে। কি গভীর সেই চাহনী! গলাটা কোনো রকম ভিজিয়ে ও আকসাদের দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘এরকমটা কেন করলেন!’
আকসাদ সহজভাবেই বললো,
– ‘কি করলাম মিস প্রাহী!’
– ‘চুলগুলো এভাবে…’
আকসাদ শান্ত কন্ঠে ওকে থামিয়ে বলে উঠলো,
– ‘ আপনার খোলা পিঠের ঠিক মাঝ বরাবর কুচকুচে গোলাকার কালো চিহ্ন টা বেশ স্পষ্টভাবে দেখা দিচ্ছিলো। তাই ওটার উপর আপাতত একটা আবরণ দিয়ে দিলাম।’
প্রাহী লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। ব্লাউজের গলা পিঠের দিকটায় একটু বড় ছিলো বিধায় ও ঢিলেঢালা ভাবে খোপা করে খোপাটাকে একটু নিচে নামিয়ে দিয়েছিলো। তারপরও কিভাবে এই লোক!
আকসাদ প্রাহীর দিক ঝুকে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
– ‘নিজস্ব ফুল একাংশের দিকেও কেউ নজর আবদ্ধ করুক তা আমি চাইনা!’
প্রাহী থমকে রইলো। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আকসাদ প্রাহীর দিক আরও একবার গভীর দৃষ্টি দিয়ে চলে গেলো। পিছনে ফেলে গুলো স্তম্ভিত প্রাহীকে। ওর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা!
মনে মনে নিজে কোনোরকম আওড়ালো, ‘নিজস্ব ফুল!’
শিমলা ওর বোনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। এখন থেকে একলা ঘরে ঘুমোতে হবে! বোনকে আর জড়িয়ে গল্প করতে করতে পারবেনা! যখন তখন রুমে ঢুকে দেখবে ওর রুমটা খালি! ভাবতেই শিমলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শিমলার চাচারা কোনো রকম ওর থেকে রুমিকে ছাড়িয়ে গাড়িতে বসাতে চাইলো। তার আগেই শিমলার মা আবারও রুমিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। শিমলা তা দেখে ফোঁপাতে লাগলো।
– ‘বোনের শ্বশুর বাড়ির রাস্তা এখানে থেকে ৪০/৪৫ মিনিটের দূরত্ব! যখনই মনে পড়বে চলে যাবি দরকার হলে থেকে আসবি! তাও এভাবে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছিস কেন!’
নক্ষত্রের কথায় শিমলা একবার ওর দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘বোনের শ্বশুর বাড়ি যখন তখন এভাবে যাওয়া যায় নাকি! কি সব বলছেন!’
নক্ষত্র স্থির কন্ঠে বললো,
– ‘যা বলছি ভেবেই বলছি! আর যাওয়া যাবে না কেন! আজব! বোনের বাড়িতে বোন যেতেই পারে! এভাবে কাঁদিস না। আপা এমনেই কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল। শ্বশুর বাড়ি যেয়েও কিছু নিয়ম ওখানে পালন করতে হবে! সেজন্য হলেও একটু মানসিক প্রস্তুতি থাকা দরকার! তা না করে উল্টো আরও তোরা কেঁদে কেঁটে আপাকে হাইপার করে তুলছিস! অনেক হয়েছে যা যেয়ে আন্টি আংকেল কে সামলা! আপাকে গাড়িতে তোলে দিবি। আয় আমার সাথে!’
শিমলা কিছুক্ষণ নক্ষত্রের দিক তাকিয়ে চোখ মুখে ওর সাথে এগোলো।
শিমলা, চাচা, চাচীকে আপাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে প্রাহীর নিজেরও চোখের জল গড়িয়ে গাল ভিজে উঠছে! আকসাদ প্রাহীর পাশে দাঁড়িয়ে কোমল কন্ঠে বললো,
– ‘কাঁদবেন না মিস প্রাহী!’
প্রাহী পাশ ফিরে দেখলো একজোড়া চোখ ওর দিক আকুলভাবে তাকিয়ে আছে। প্রাহী ওই চোখজোড়ার দিক নিবিড়ভাবে চেয়ে রইলো!
চলবে,,,
#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ০৯ (আদুরে)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী
– ‘কাঁদবেন না মিস প্রাহী!’
প্রাহী পাশ ফিরে দেখলো একজোড়া চোখ ওর দিক আকুলভাবে তাকিয়ে আছে। প্রাহী ওই চোখজোড়ার দিক নিবিড়ভাবে চেয়ে রইলো! গভীর ওই চোখজোড়ার ভাষা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও ও নজর সড়ালো না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাহী দেখলো ৯ টা বাজে প্রায়। ভোরে কোনোরকম একটু উঠেছিলো নামায পড়ার জন্য। অতঃপর নামায টা পড়েই আবার ঘুম দিয়েছিলো। দেরী হয়ে গেছে আজ। তার মধ্যে ভার্সিটি যেতে হবে! আড়মোড় ভেঙে কিছুক্ষণ বিছানার মধ্যেই বসে রইলো। আস্তেধীরে উঠে ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে ফোনটা হাতে নিলো। রাতে অনুষ্ঠান থেকে আসার পর শোয়ার আগে শিমলাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলো ও। কিন্তু ওর কোনো রিপ্লাই নেই! প্রাহী ভাবলো মেয়েটা হয়তো ঘুমে! স্বাভাবিক! বিয়ের বাড়ির কাজের চাপ, তারমধ্যে সন্ধ্যার পর থেকে বোনের জন্য কেঁদেছে, বোনের শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়ার শোক সব মিলিয়ে ওরা সবাই হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে! থাক মেয়েটা না হয় একটু বিশ্রাম নিক আজকের দিনটা। পরে একবার কল করে নিবে ওকে! ভেবেই হালকা একটা শ্বাস ফেলে প্রাহী রেডি হয়ে নিলো। হালকা হলুদের মধ্যে নরমাল একটা সুতির জামা পড়ে ওড়না টা কাঁধে নিয়ে নিলো। চুলগুলো হাতখোপা করে ব্যাগ টা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলো।
প্রাহীর মা টেবিলে নাস্তা দিচ্ছে। নিচে এসে বাবাকে খুঁজলো। পেলো না! হয়তো এখনও ঘুমে! চেয়ার টেনে টেবিলে বসে একগ্লাস পানি পানি পান করতে করতে দেখলো ওর মা হাতে চা নিয়ে এদিকে আসছে।
প্রাহীর মা চা টা টেবিলে রেখেই বললো,
– ‘ভার্সিটি যাবি?’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আচ্ছা নাস্তা খেয়ে যা। দাঁড়া রুটি দেই তোকে। কি দিয়ে খাবি! আলুভাজি নাকি ডিম পোস!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে চা টা হাতে নিতে নিতে বললো,
– ‘এতকিছু খাওয়ার সময় নেই মা। শুধু দুটো রুটি দাও চা দিয়ে ভিজিয়েই খেয়ে নিব।’
প্রাহীর মা কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। প্রাহী চায়ের কাপে হালকা চুমুক দিচ্ছে। দরজা চাপানোর আওয়াজে পিছন ফিরে দেখলো ওর বাবা হাতে পেপার নিয়ে ঘরে ঢুকছে। প্রাহীর বাবা ওর দিক তাকিয়ে মুচকি হেসে ওর পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– ‘ক্লাস আছে নাকি আম্মা!’
প্রাহী আলতো হেসে মাথা নাড়ালো। ওর বাবা পেপার টেবিলের উপর রাখতে গেলেই প্রাহী বললো,
– ‘এখানে পেপার রেখো না বাবা! টেবিল টা ভিজা। মা একটু আগেই মুছেছে। পেপার টা ভিজে যাবে নাহলে। আমাকে দাও পেপার টা সোফায় রেখে আসি! ওখানে যেয়ে না হয় পড়ো!’
প্রাহীর বাবা পেপারটা ভাঁজ করে বললো,
– ‘না থাক! একবারে নাস্তা সেড়ে চা খেতে খেতে পড়বো।’
এই বলে উনি প্রাহীর সাথে কথা বলতে লাগলেন। বাবা মেয়ের টুকটাক কথা বলার মাঝেই প্রাহীর মা এক প্লেটে রুটি আর একটু ভাজি এনে প্রাহীর সামনে রাখতে রাখতে বললো,
– ‘শুকনো রুটি না খেয়ে একটু ভাজি দিয়ে খা! ভালো লাগবে!’
তারপর প্রাহীর বাবার দিক তাকিয়ে বললেন,
– ‘তুমি কি খাবে! ডিম পোস…।’
প্রাহীর বাবা কথার মাঝেই বললেন,
– ‘ভাজি দিয়েই খাব। শেষে চায়ের সাথে দুটো বিস্কিট দিও!’
প্রাহীর মা হটপট থেকে প্রাহীর বাবাকে রুটি দিয়ে ভাজি আনতে রান্নাঘর গেলেন। প্রাহীর বাবা হুট করে প্রাহীর দিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘চা দিয়েই রুটি খাচ্ছ যে! ভাজি খাবে না!’
প্রাহী খেতে খেতেই উত্তর দিলো,
– ‘না বাবা। দেরী হয়ে যাবে। আজ থাক।’
প্রাহীর বাবা ওর হাত থেকে রুটি নিতে নিতে বললেন,
– ‘ আম্মা আমি খাইয়ে দেই। দেরী হবে না।’
প্রাহীর বাবা রুটি ছিড়ে ভাজিসহ ওর মুখের সামনে ধরতেই ও খেয়ে নিলো। না করলো না! কেন জানি বাবার হাতে তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে যায় ওর!
কোনোরকম খেয়ে চা টা শেষ করে চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললো,
– ‘আসছি বাবা।’
– ‘ভাড়া লাগবে আম্মা!’
প্রাহী কাঁধে ব্যাগ নিতে নিতে বললো,
– ‘না বাবা। আছে আমার কাছে। হয়ে যাবে।’
বলে বের হতে নিলেই প্রাহীর বাবা ওর মাকে দেখে বললো,
– ‘তোমার ছেলে কি ঘুমে!’
প্রাহীর মা টেবিলে ভাজির বাটিটা রাখতে রাখতে বললেন,
– ‘মনে তো হয় ঘুমে!’
প্রাহীর বাবা গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
– ‘ও উঠলে তো মেয়েটাকে একটু দিয়ে আসতে পারতো! এতো কুঁড়ে হয়েছে ও!’
প্রাহী জুতো পড়তে পড়তে বললো,
– ‘অসুবিধা নেই বাবা। বেশি দূরের পথ তো না!’
প্রাহীর বাবা ওর দিক তাকিয়ে বললেন,
– ‘সাবধানে যেয়ো আম্মা!’
প্রাহী আলতো হেসে বেরিয়ে এলো।
টমটমের আসায় না থেকে দেরী হবে বিধায় কোনোরকম রিক্সা নিলো প্রাহী। পৌছোতেই রিক্সা থেকে নেমে থেকে ভাড়া দিয়ে ভার্সিটির ভিতর চললো। যেয়ে দেখলো তুলি, রাতুল শহীদ মিনারের চত্ত্বরে বসে আছে। ওদের কাছে যেতেই প্রশ্ন করলো,
– ‘ক্লাসে যাচ্ছিস না যে! ক্লাস না শুরু হয়ে গেছে!’
তুলি দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
– ‘হ্যাঁ এখন যাব! তুই আর শোয়াইব আসছিস না দেখে এখানে বসেছিলাম আমরা। কথা বলতে বলতে সময় কিভাবে চলে গেলো টের পাইনি। শিমলা আসবে না!’
প্রাহী মাথা দুলিয়ে বললো,
– ‘না মনে হয়। ও অনেক টায়ার্ড। তাই ভাবলাম রেস্ট নিক না হয়!’
রাতুল ব্যাগ কাঁধে তুলে বললো,
– ‘হ্যাঁ সেটাই। মন টন খারাপ। বাসায় থেকে বিশ্রাম নিক তাও ভালো।
প্রাহী রাতুলের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘হু। শোয়াইব আসবে না!’
তন্নি ফোন দেখে বললো,
– ‘আসবে! দেরী হবে বললো।
রাতুল যেতে যেতে বললো,
– ‘পা চালা। ক্লাসে যেতে হবে এখন!’
ক্লাস শুরুর কিছুক্ষণ পরেই শোয়াইব ক্লাসে ঢুকলো। কোনোরকম একটা সিটে যেয়ে বসে কলম বের করে সামনের মেয়েটাকে খাতা দিয়ে হালকা খুঁচিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘তুলি প্রথম দিকের লেকচার গুলো একটু দে।’
– ‘আমি তুলি নই তন্নি।’
হালকাভাবে পিছন ফিরে বললো তন্নি।
শোয়াইব কিছুক্ষণ ওর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আ’ম সরি। পিছন থেকে ভেবেছিলাম তুলি।’
– ‘ইটস্ ওকে। লেকচার কি লাগবে!’
– ‘হ্যাঁ।’
তন্নি একটু ধীর কন্ঠে বললো,
– ‘ক্লাস শেষে দেই! তখন সব লিখে নিতে পারবেন।’
শোয়াইব মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘ওকে!’
তারপর মাথা ঘুড়ে দেখলো তুলি প্রাহী ওরা সবাই পিছনের দিক বসেছে বিধায় ও খেয়াল করতে পারেনি তখন। সামনে তাকিয়ে ক্লাসে মনোযোগ দিলো।
দুটো ক্লাস ক্যানসেল হয়েছে। তাই প্রাহীরা কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে বসে চা অর্ডার করলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রাতুল বললো,
– ‘একটা ক্লাস হবে জানলে আসতাম না!’
শোয়াইব তন্নির খাতা থেকে নোট তুলতে তুলতে বললো,
– ‘এসে ভালো করেছিস। লস তো হয়নি। সামনে প্রেজেন্টেশন এখন রোজ আসাটা জরুরী!’
তুলি মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘তাও কথা। আচ্ছা এখন উঠি। আগেভাগে যেহেতু ছুটি পেয়েছি সেক্ষেতে বাসায় যেয়ে একটু প্রয়োজনীয় কাজ সেড়ে ফেলি।’
রাতুল চায়ের কাপটা রেখে বললো,
– ‘আমিও যাব। চল বেড়োই!’
তুলি শোয়াইব আর প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তোরা যাবি না!’
শোয়াইব নোট খাতা গুছিয়ে বললো,
– ‘তন্নিকে নোট খাতা দিয়ে আসতে হবে। তোরা যা অসুবিধা নেই। প্রাহী কি আমার সাথে যাবি!’
প্রাহী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বললো,
– ‘তুই ভালোমতো নোট কর। তাড়াতাড়ির কিছু নেই। আমি চলে যেতে পারব।’
– ‘শিউর!’
– ‘হুম!’
রাতুল আর তন্নি কিছু পথ ওর সাথে হেঁটে বাড়ির রাস্তা অনুযায়ী চলে গেলো। ওরা চলে গেলে প্রাহী ভাবলো আজ হেঁটেই বাড়ি যাবে। হেঁটে যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না! ও ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলো। ফোন বেজে উঠলে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলো মা ফোন দিয়েছে। সামনে রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চিতে বসে কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলে ফোনটা ব্যাগে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে একটু পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো। আকসাদ! প্যান্টের পকেটে হাত রেখে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে! এই লোক এই সময় এখানে!
– ‘হাই মিস প্রাহী!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘আপনি এখানে!’
আকসাদ হালকা হেসে বললো,
– ‘হ্যাঁ হাঁটতে বের হয়েছিলাম একটু!’
– ‘ওহ্ আচ্ছা।’
আকসাদ মাথার চুলগুলো উপরে তুলতে তুলতে বললো,
– ‘হু৷ আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন মিস প্রাহী!’
প্রাহী চোখ পিটপিট করে উত্তর দিলো,
– ‘বাসায় যাচ্ছিলাম!’
আকসাদ চটপটে কন্ঠে বললো,
– ‘তাহলে চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই!’
প্রাহী দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘না না। আপনি হাঁটুন। আমি যেতে পারব।’
আকসাদ হেসে বললো,
– ‘আমি তো হাঁটছিই! আপনার সাথে আপনার বাড়ি পর্যন্ত গেলেও আমার হাঁটা হয়ে যাবে!’
– ‘কিন্তু…।’
– ‘চলুন প্রাহী!’
অগত্যা প্রাহী হাঁটতে লাগলো। আকসাদও সাথে সাথে হেঁটে চললো নীরবে। প্রাহী লম্বায় আকসাদের কাঁধের চেয়ে একটু নিচু। আকসাদ তা দেখে মুচকি হাসলো।
– ‘তা আপনার ফিউচার প্ল্যান কি প্রাহী!’
আকসাদের প্রশ্নে প্রাহী কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো,
– ‘এখনও সেভাবে ভাবিনি।’
আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ও আপনি বিবিএ তে তাইনা!’
প্রাহী কিছুটা চমকে বললো,
– ‘হ্যাঁ আপনি কিভাবে…।’
আকসাদ হাত দিয়ে চুলগুলো পিছনে নিয়ে বললো,
– ‘গেস করছিলাম আর কি!’
প্রাহী আর কিছু বললো না। এভাবেই টুকটাক কথা বলতে বলতে দুজন এগোতে থাকলো। প্রাহী একটা ভ্যান গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে টমেটো আরও কিছু সবজি কিনতে থাকলো। দামাদামি করে সবজি কিনার পর ব্যাগ টা হাতে নিয়ে হাঁটতে গেলেই আকসাদ ওর থেকে ব্যাগ টা নিয়ে বললো,
– ‘আমি নিচ্ছি।’
প্রাহী আকসাদের থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে বললো,
– ‘আমি পারব! আমাকে দিন প্লিজ!’
আকসাদ হাঁটতে হাঁটতে বললো,
– ‘আপনার বাড়ির সামনে গেলেই ব্যাগ দিয়ে দিব। এখন চলুন।’
প্রাহী অসহায় চোখে একবার আকসাদের দিক তাকিয়ে হাঁটতে থাকলো।
– ‘আপনি এত দামাদামি করলেন যে সবজি কিনার সময়!’
প্রাহী অবাক হয়ে বললো,
– ‘তো করবো না! ৩০ টাকার জিনিস ৫০ টাকায় কে কিনতে যাবে!!’
আকসাদ হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ তাও কথা। আমি ভেবেছিলাম আপনি কিপটামি করছেন কি না!’
প্রাহী বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘আমি কিপটামি কখন করলাম! ন্যায্য দামে সবজি কিনতে চেয়েছি এটাকে কিপটামি বলে!’
আকসাদ দ্রুত মাথা নেড়ে বললো,
– ‘না আমি তো শুধু ভেবেছিলাম আর কি। বাট আপনি তো দেখছি বেশ ইকোনমিক! আই লাইক দ্যাট!’
প্রাহী হালকা লজ্জা পেয়ে হাসলেও ওকে কিপটা ভাবায় আবার মুখটা ফুলিয়ে রইলো। আকসাদ তা দেখে বললো,
– ‘এভাবে মুখ ফুলাবেন না মিস প্রাহী!’
প্রাহী আড়চোখে চেয়ে বললো,
– ‘কেন!’
আকসাদ আলতো কন্ঠে বললো,
– ‘বেশ আদুরে লাগে যে তাই!’
প্রাহী একদম চুপ হয়ে গেলো। আর কিছু বললো না। তা দেখে আকসাদ আলতো হেসে বললো,
– ‘সকালে নাস্তা করেছেন! কিছু খাবেন!’
প্রাহী দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘না আমি খেয়েই বের হয়েছি।’
আকসাদ মাথা নাড়িয়ে প্রাহীর দিক তাকালো। মেয়েটা নিচের দিক তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তা দেখে আকসাদ হাসলো। খোপা করা চুল, যার কিছু অংশ মুখের সামনে এসে কপালটায় পড়ে আছে। আকসাদের ধ্যান ভাঙলো প্রাহীর কথায়।
– ‘আর একটু এগোলেই আমার বাড়ি। আমাকে এখন ব্যাগ গুলো দিন!’
– ‘কেন বাড়ি পর্যন্ত গেলে কোনো সমস্যা!’
প্রাহী ইতস্তত কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘আসলে বাবা বাসায় তাই…!’
আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,
– ‘আচ্ছা নিন!’
প্রাহী ব্যাগগুলো নিয়ে সামনে হাঁটতে যেয়ে আবার পিছন ফিরে আকসাদের দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘ধন্যবাদ!’
– ‘ঠিক কোন কারণে!’
প্রাহী হাতের ব্যাগ ইশারা করে বললো,
– ‘এইযে আমাকে সাহায্য করলেন বাসা পর্যন্ত ব্যাগ টা নিয়ে…’
আকসাদ হালকা আওয়াজে হেসে বললো,
– ‘এটার জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে না! বাসায় যান তাহলে! যেয়ে রেস্ট নিবেন!’
প্রাহী মাথা নাড়িয়ে সামনে এগিয়ে চললো। সামনে ফিরে কি মনে করে যেন মুচকি হাসলো। আকসাদ পিছন হতে প্রাহীর দিক তাকিয়ে প্রাহীর এলোমেলো ওড়না, ঢিলেঢালা খোপার দিক তাকিয়ে থাকলো। চোখের আড়াল হতেই ও সামনে ফিরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
‘মন তোমার সাথে মিলতে চায়
অনুভূতিরা সব তোমায় জেঁকে ধরতে চায়।’
চলবে,,,