মন একে এক দুই পর্ব-২০+২১

0
7

#মন_একে_এক_দুই
#পর্বঃ২০(নৌকোমাঝি)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

হাঁটার মাঝেই আকসাদ প্রাহীর দিক হালকা ঝুঁকে কানে ফিসফিস করে বললো,

– ‘আমাদের চেনাজানার প্রথম ধাপ কিন্তু শুরু মিস প্রাহী!’

দেখতে দেখতে কিভাবে যেন পনেরো থেকে আঠারো দিন কেঁটে গেলো! আকসাদের দুষ্টু আর প্রাহীর মিষ্টি হাসি গুঞ্জনের মাঝে দিনগুলো কিভাবে যেন কেঁটে গেছে! ভালো সময়গুলো মনে হয় তাড়াতাড়িই চলে যায়! ভাবনার মাঝে প্রাহী মুচকি হেসে চুলগুলো হাতখোপা করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিচে নেমে টেবিলে পাউরুটি দেখতেই রান্নাঘরের দিক গেলো। মা বসিয়ে মনে হয় ঘরে গেছে! চা প্রায়ই হয়ে এসেছে! নিজের জন্য এক কাপ চা নিয়ে প্রাহী চায়ের পাতিলটা চুলোয় বসিয়ে হালকা আঁচে রেখে দিলো। টেবিলে বসে পাউরুটি চা দিয়ে ভিজিয়ে খেতে লাগলো। খাওয়া শেষে টেবিল ছেড়ে উঠতেই দেখলো ওর মা সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে! ওকে দেখতেই নিচে নেমে এলো।

– ‘ভার্সিটি যাচ্ছিস!’

– ‘হ্যাঁ!’

– ‘কিছু খাসনি তো! দ্বারা আমি…।’

প্রাহী টেবিলে ইশারা করে বললো,
– ‘খেয়েছি! পাউরুটি আর চা!’

প্রাহীর মা ওর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘শুধু পাউরুটি আর চা! ভাজি দিয়ে একটা রুটি খেয়ে যা!’

প্রাহী যেতে যেতে বললো,
– ‘পেট ভরে গেছে মা! ভাজি রেখে দিও দুপুরে এসে খাব না হয়! আসছি কেমন!’

প্রাহীর মা হালকা মাথা নেড়ে বললেন,
– ‘সাবধানে যাস!’

ভার্সিটি আসতেই দেখলো তুলি,রাতুল ওরা কেউ আশেপাশে নেই! হাতঘড়ি চেক করে দেখলো ক্লাসের সময়ও হয়ে গেছে! প্রাহী ক্লাস রুমের দিক পা চালালো। রুমে যেতেই দেখলো ওরা সবকটা ক্লাসেই আছে! এক একজনের চেহারার সিরিয়াস ভাব! বিশেষ করে রাতুল আর তুলির মুখে! কিছু হয়েছে নাকি! প্রাহী ওদের পাশেই একটা বেঞ্চিতে বসে ব্যাগটা রেখে রাতুলকে খোঁচা মেরে বললো,
– ‘কিছু হয়েছে!’

রাতুল হতাশার সহিত মাথা নাড়ালো। তুলিও তেমন কিছু বলছে না! প্রাহী এবার সামনে বসা তন্নিকে একবার হালকা আওয়াজে ডেকে বললো,
– ‘কি হয়েছে! এই দুটো এমন মুখ করে আছে যে!’

তন্নি একবার পিছন ফিরে রাতুল আর তুলির দিক তাকিয়ে হেসে ফেললো। প্রাহীর দিক ফিরে বললো,
– ‘ফাইনালের ডেইট দিয়ে দিয়েছে! এজন্য বোধহয়!’

প্রাহী হালকা চমকে বললো,
– ‘ডেইট দিয়ে দিয়েছে! কখন!’

তন্নি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘মিটিং হয়েছে শুনলাম এই নিয়ে! সিনিয়র ভাইয়াদের পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে! এখন উনাদের পর পরই তো আমাদের এক্সাম শুরু হবে এবার! উনারা বললো আজই নাকি পরীক্ষার নোটিশ টাঙিয়ে দিতে পারে! যদি আজ নোটিশ টাঙানো হয় পরীক্ষা শুরু হবে পাঁচ থেকে ছয়দিন পরেই হয়তো!’

প্রাহী মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘বুঝলাম! তাছাড়া এই মাসের মাঝে বা শেষের দিকেই তো পরীক্ষা হয়ে যাবার কথা ছিলো!’

তন্নি প্রাহীর কথায় স্বায় জানাতেই পাশ থেকে রাতুল বেজার কন্ঠে বললো,
– ‘এখন এত কিছু বলে লাভ আছে! আমরা তো কিছুই পারিনা! রেজাল্ট তো এবার ভালো হবেনা মনে হয়!’

তুলি রাতুলের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ভালো রেজাল্ট! পাশই তো করবোনা মনে হচ্ছে!’

তন্নি রাতুল ওর তুলির দিক তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ‘হাতে সময় আছে এখনও এক সপ্তাহের মতো পড়লে পারবে! চিন্তা করো না!’

রাতুল তন্নির দিক তাকিয়ে মুখে প্লাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– ‘আপনার আর কি চিন্তা আপু! আপনে তো এইবারও ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে টপার হইবেন!’

– ‘কে টপার হবে!’
শোয়াইবের কথায় সবাই ওর দিক তাকালো। শোয়াইব ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বেঞ্চে বসে ওদের দিক তাকিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে!’

রাতুল হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘পায়নি তবে পাবে!’

শোয়াইব রাতুলের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কে!’

রাতুল তন্নির দিক ইশারা করতেই শোয়াইব সেদিক তাকালো। তন্নি শোয়াইবের দিক তাকিয়ে সামনে ফিরলো। শোয়াইব ভ্রু উঁচিয়ে রাতুলকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কাহিনি কী!’

প্রাহী কলমের ক্যাপ খুলে বলে উঠলো,
– ‘ফাইনালের ডেট নাকি দিয়ে দিবে আজ! তা নিয়েই এদের মুখ বেজার!’

শোয়াইব প্রাহীর দিক তাকিয়ে ‘ওহ্’ বলে সামনে তাকালো। তন্নি মাথা নিচু করে রয়েছে হয়তো কিছু লিখছে বা পড়ছে! স্যার ক্লাসে।আসতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। প্রাহীর থেকে কলম নিয়ে শোয়াইব খাতা বের করলো! ক্লাসে স্যার ঢুকতেই সবাই সেদিকে তাকিয়ে মন দিলো।

তন্নি লাইব্রেরিতে এসেছে। ফাইনাল এক্সামের নোটিশ দিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। কর্ণারের একটা টেবিলে বসে ম্যাথ সোলভ্ করছিলো ও। একটা জায়গায় আটকাতেই কলম নিয়ে খুঁটাখুঁটি করে পাশে তাকাতেই দেখলো ওদের ক্লাসমেট রবি একটা টেবিলে বসছে! তন্নি ওকে দেখতেই আস্তে ডাক দিলো,

– ‘এই রবি!’

রবি তন্নির দিক তাকাতেই ব্যাগটা চেয়ারে রেখে ওর দিক এগিয়ে এলো।

– ‘বলো!’

তন্নি খাতার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘এই ম্যাথটা পারো! এখানে এই ইন্টিগ্রেশন টা কিভাবে করেছে!’

রবি মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ…।’

– ‘এখানে ইন্টিগ্রেশন না ফার্স্টে ডিফারেন্সিয়েশন করতে হবে।’

আচমকা কথায় তন্নি আর রবি পাশ ফিরে দেখলো শোয়াইব কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। এগিয়ে এসে তন্নির পাশে সিটে বসে খাতাটা নিয়ে ম্যাথটা সোলভ্ করে দিলো। রবি হালকা হেসে তন্নির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘হয়ে গেছে সলভ! তাহলে আমি যাই!’
বলেই রবি নিজের বন্ধুদের সাথে যেয়ে বসলো।

শোয়াইব সেদিক তাকিয়ে তন্নির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘বুঝা হয়েছে!’

তন্নি মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘হু! ধন্যবাদ!’

শোয়াইব ওর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘আর কোনো প্রব্লেম আছে!’

তন্নি হালকা কন্ঠে বললো,
– ‘হু আর দুইটা ম্যাথে!’

– ‘দেখাও!’

তন্নি প্রব্লেম দুটো দেখিয়ে দিলে শোয়াইব সেগুলো আস্তে আস্তে ওকে বোঝাতে থাকলো! তন্নি বোঝা অবস্থায় একবার শোয়াইব এর দিক তাকালো। ভরা চোখ, চাপ দাড়ি, খাড়া নাক সহ উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারার ছেলেটাকে বেশ সুন্দর লাগছে! লিখতে লিখতে কিছু চুল কপালের সামনে এসে পড়েছে যা আরও সুন্দর লাগছে! তন্নি খেয়াল করলো শোয়াইবের গা থেকে একটা পারফিউমের গন্ধ আসছে! চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণটা আরও একটু অনুভব করে চোখ খুলতেই দেখলো শোয়াইব ওর দিক তাকিয়ে! ইশ্! ছেলেটা এখন কি ভাববে ওকে! তন্নি দ্রুত চোখ নামিয়ে আবার খাতার দিক তাকালো। শোয়াইব হাতে কলম নিয়ে চুপ করে বসে আছে! কিছু লিখছে না! তন্নি চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো শোয়াইব ওর দিক তাকিয়ে আছে! তন্নি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতেই শোয়াইব বলে উঠলো,

– ‘কি হয়েছে!’

তন্নি হালকা কন্ঠে বললো,
– ‘কিছুনা দেখছিলাম!’

– ‘আচ্ছা!’

তন্নি মাথা নাড়ালো। শোয়াইব মাথাটা হেলে ওর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তা দেখে কি বুঝলে!’

তন্নি খাতার দিক চোখ রেখেই বললো,
– ‘একটু কঠিন!’

– ‘আমাকে বোঝা কঠিন!’

শোয়াইবের নিরব কন্ঠে তন্নি চোখ তুলে ওর দিক তাকালো। ছেলেটা ওর দিকেই চেয়ে! কি স্নিগ্ধ সেই চাহনী! তন্নি গলা ভিজিয়ে বললো,
– ‘ম্যাথের কথা বলছিলাম!’

শোয়াইব এখনও স্থির! তন্নি শোয়াইবের দিক আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘লিখুন না!’

শোয়াইব ধীরে ম্যাথটা করতে লাগলো। একটা জায়গায় থেমে তন্নির দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘ম্যাথ এর মতো এতো জটিল কিন্তু আমি নই!’

তন্নি মাথা নেড়ে বললো,
– ‘সহজ?’

শোয়াইব মাথা দুলালো।

– ‘আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাচ্ছেন বলুন তো!’

শোয়াইব কলম নাড়িয়ে বললো,
– ‘যেটা আপনি বুঝতে চান ম্যাডাম!’

শোয়াইন ম্যাথ কর‍তে লাগলো। তন্নি মুচকি হেসে ওর দিক তাকিয়ে খাতায় মন দিলো। খাতায় মন দিয়েও পুরোপুরি মন দিতে পারছে না! কিছুক্ষণ পর পর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠছে! শোয়াইবের ঠোঁটের কোণে ভাজ পড়ছে! এমনটা হচ্ছে কেন!

প্রাহী রেডি হচ্ছে। আকসাদ বলেছে বিকেলের দিক কোথায় জানি যাবে। চুলে বেণী কর‍তে করতে প্রাহী আয়নার দিক তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এইকয়দিনে আকসাদের সাথে ও বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। একজন আরেকজনকে একটু একটু করে চিনেছে,জেনেছে! যদিও এর জন্য আকসাদই দায়ী! আকসাদ নিজে থেকে না এগোলে প্রাহী হয়তো কখনই ওর সাথে সেভাবে সহজ হতে পারতো না! তারপরও যখন আকসাদ সামনে থাকে তখন মাঝেমধ্যে নাড়াচাড়া করতেও যেন ও ভুলে যায়! চুল বাঁধা শেষে ঘড়ি দেখে প্রাহী ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগোতেই দেখলো আকসাদ দাঁড়িয়ে! কালো ট্রাউজার আর স্কাই ব্লু টি-শার্ট পড়নে! মাথার চুলগুলো অগোছালো অবস্থায় একপাশে ফেলে রাখা। তাও ছেলেটাকে কি সুন্দর লাগছে! হরিণ এর মতো বড় বড় চোখগুলো দিয়ে আকসাদ ওর দিক তাকিয়ে আছে! প্রাহী চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে আকসাদের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো।

আকসাদ প্রাহীর দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো! পরণে সাদা পায়জামার সেট। জরজেট ওড়ণা দুপাশে ফেলে রাখা। কোমড় অব্ধি লম্বা চুলগুলো বেণী করে একপাশে ফেলে রেখেছে। কি স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে! অথচ চোখে কাজল ছাড়া মুখে তেমন কিছুই নেই! ইচ্ছে করছে ওই ছোট্ট মুখটা দু’হাতের ভাজে নিয়ে অনবরত তাকিয়ে থাকতে! প্রাহীর সাথে চোখ মিলতেই আকসাদ হেসে বললো,
– ‘রেডি! চলুন তাহলে!’

প্রাহী অবাক হয়ে বললো,
– ‘কোথায়!’

আকসাদ প্রাহীর হাতের দুটো নরম আঙুল নিজের হাতের ভাজে নিয়ে বললো,
– ‘চলুনই না আগে!’

প্রাহী আকসাদের সাথে সাথে চললো শুধু। দীঘির পাড়ে আসতেই প্রাহীকে নিয়ে আকসাদ থামলো।

– ‘এখানে!’

আকসাদ সামনে ইশারা করে বললো,
– ‘হুম! ওটাতে চড়বো আজ!’

প্রাহী সামনে তাকাতেই দেখলো একটা বড় নৌকো পাড়ে রাখা! প্রাহী আকসাদের দিক একবার তাকিয়ে বললো,
– ‘নৌকায় চড়বেন!’

আকসাদ মাথা নাড়ালো। প্রাহী আকসাদের দিক চেয়ে বললো,
– ‘আমার নৌকায় একটু ভয়…।’

আকসাদ প্রাহীর আঙুলে হালকা চাপ দিয়ে বললো,
– ‘ভয় কিসের প্রাহী! আমি আছি তো!’

প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে আস্তে মাথা দুলালো। আকসাদ ওকে নিয়ে ধীরে ধীরে নৌকায় উঠলো। প্রাহী মাঝ বরাবর ভালোভাবে বসে পাশে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো! আকসাদ বৈঠা হাতে নিচ্ছে যে!

– ‘আপনি বৈঠা হাতে নিচ্ছেন যে! মাঝি কোথায়!’

আকসাদ ভালোভাবে বসে বললো,
– ‘আজকে আপনার আর এই নৌকোর মাঝি হচ্ছি আমি!’

আকসাদের কথায় একটু লাজুক হাসলেও কিছু একটা ভেবে প্রাহী অসহায় দৃষ্টিতে আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘কিন্তু…আপনি নৌকা চালাতে জানেন! পরে যদি মাঝপথে যেয়ে আটকে যান!’

আকসাদ হেসে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘প্রাহী রিলেক্স! কিছু হবেনা! আমি নৌকা চালাতে পারি! কানাডাতে আমি বোট রাইড করেছি!’

আকসাদ নৌকা চালাতে চালাতে বললো,
– ‘আর যদি থেমেও যাই মাঝপথে তাতে ক্ষতির কি! দুজনে না হয় একসাথেই আটাকালাম! সমস্যা আছে তাতে!’

প্রাহী মৃদু হেসে দীঘির পানির দিক তাকালো। গুনগুন করতে করতে আকসাদের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘গান গাইতে পারেন!’

– ‘হু পারি! একটু আধটু!’

প্রাহী হাটু ভাঁজ করে তাতে হাত জড়িয়ে বললো,
– ‘তাহলে শুনান!’

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে গভীর কন্ঠে বললো,
নাও ছাড়িয়া আজীবন গান গাইতে রাজি!
শুধু বানিয়ে নিন জীবনের মাঝি!

প্রাহী হাঁটুতে ভাজ করে রাখা হাতটা আরও জড়িয়ে ধরে স্বচ্ছ পানির দিক তাকালো। আকসাদ তা দেখে হেসে নৌকা চালাতে চালাতে কিছু একটা দেখে প্রাহীকে হুট করে,,,

চলবে,,,

#মন_একে_একে_দুই
#পর্বঃ২১(স্নিগ্ধ মূহুর্ত)
#লেখনীতেঃ-#ফেরদৌসী_নবনী

আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে গভীর কন্ঠে বললো,
“নাও ছাড়িয়া আজীবন গান গাইতে রাজি!
শুধু বানিয়ে নিন জীবনের মাঝি!”

প্রাহী হাঁটুতে ভাজ করে রাখা হাতটা আরও জড়িয়ে ধরে স্বচ্ছ পানির দিক তাকালো। আকসাদ নৌকা চালাতে চালাতে কিছু একটা দেখে প্রাহীকে হুট করে বলে উঠলো,
– ‘এটা ওই ফুলটা না!’

প্রাহী আকসাদের ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখলো পানির এক সাইড বরাবর অনেকগুলো শাপলা! ফুলগুলোর দিক চেয়ে প্রাহীর মনটা ভালো লাগলেও সেদিনের কথা মাথায় আসতেই মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে গেলো! একটু বোকামির জন্য কি একটা বিপদ হতে যাচ্ছিলো! আকসাদ যদি সময়মতো না আসতো তাহলে তো!
আকসাদ প্রাহীর দিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘মুখের হাসি মিলালো যে! মন খারাপ হয়ে গেলো হুট করে!’

প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
– ‘আকসাদ!’

– ‘হু! প্রাহী বলুন!’

প্রাহী ছোটো ছোটো কন্ঠে বললো,
– ‘ওইদিন আরেকটু হলেই হয়তো জনমানবহীন জায়গায় পানিতে ডুবে যেতাম। যদি না সময়মতো আপনি আসতেন তো! ধন্যবাদ দিলেও কম হয়ে যাবে! আচ্ছা আকসাদ! কিভাবে কিভাবে আপনি ওখানে এলেন বলুন তো! হুটহাট এর আগে অনেক দেখা হয়েছে তা না হয় মানলাম! কিন্তু সেদিনও আপনি কিভাবে আমায় এই অবস্থায়!’

থেমে প্রাহী আবারও বললো,
– ‘সবটাই কি অনাকাঙ্ক্ষিত!’

আকসাদ বৈঠাটা নৌকার এক পাশে রেখে প্রাহী যেখানে বসেছে তার থেকে হালকা দূরত্বে বসলো। পুকুর থেকে এঁকে এঁকে শাপলা তুলতে তুলতে বললো,
– ‘আপনি এখন ঠিক আছেন! এইযে আমার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন এটাই কি অনেক! আর থ্যাংকস টু উপরওয়ালা যে আপনার নিকট সময়মতো পৌঁছেছিলাম! তবুও আরেকটু আগে পৌঁছালে হয়তো আপনার এত টাও সাফার করা লাগতো না!’

আকসাদ এবার একটা শাপলা ফুল হাতে নিয়ে প্রাহীর চোখে চোখ রেখে বললো,
– ‘কিছু কিছু প্রশ্ন বা অবাকতার সঠিক ব্যখা এখনও নিজেই খুঁজে পায়নি!আপনায় আর কি বলব বলুন! তাই অনাকাঙ্ক্ষিত বা কি এগুলো না হয় আপাতত থাকুক! আপনার ঠিক, ভালো থাকাটাই ইম্পর্ট্যান্ট আর কিছুনা!’

প্রাহীর কানে শাপলা গুজে দিতেই প্রাহী চমকে সেখানে হাত দিয়ে খুলে আনতে গেলেই আকসাদ বাঁধা দিয়ে বললো,
– ‘খুলবেন না! মানাচ্ছে!’

প্রাহী লাজে আর আকসাদের দিক না তাকিয়ে নৌকোয় গুচ্ছ আকারে থাকা শাপলাগুলোর দিক তাকিয়ে রইলো! আড়চোখে চেয়ে বুঝলো আকসাদের নজর ওতেই আবদ্ধ! হালকা বাতাসে দীঘির পানির তালে তালে নৌকোটাও দুলছে! তার সাথে দু’টো মানুষের মনে অনুভূতিগুলোও দোল খেয়ে যাচ্ছে! একজনের চোখে মুগ্ধতার মোহ তো আরেকজনের চোখে মুখ লাজে আনত অবস্থায়! বিকেলের আলোটাও আস্তে আস্তে মিইয়ে আসছে। আবছা সেই আলোয় আকুল চোখের ভাষা হালকা বুঝার চেষ্টা জাগলো প্রাহীর মনে! আখিজোড়া মেলালো ওই হরিণ চোখের মানবের দিক! চোখের ভাষা পড়বে কি! ওই দুটো চোখ যেন ওকে বশে এনে ফেলেছে! দুজন দুজনের নিকট কখন চলে এসেছে কারোরই সেই টের নেই! প্রাহীর চোখমুখে আকসাদের গভীর নিশ্বাস পড়তেই প্রাহী চোখজোড়া হালকা নড়ে উঠলো। দুজনের নাক ছুই ছুই! পশ্চিমা দিক হতে মেঘের ডাক পড়তেই আকসাদ আর প্রাহীর যেন হুঁশ এলো! প্রাহী সোজা হয়ে বসে ওড়নার কোণা চেপে ধরলো! আকসাদ এখনও আগের অবস্থাতেই! কোনো নড়চড় নেই! প্রাহী আকসাদের দিক ফিরে মিনমিনে কন্ঠে বলে উঠলো,
– ‘এবার চলুন! বৃষ্টি পড়বে হয়তো!’

আকসাদ সোজা গলায় বললো,
– ‘পড়ুক!’

– ‘হ্যাঁ!’

প্রাহীর বেকুব চেহারার দিক তাকিয়ে আকসাদ হেসে বললো,
– ‘মাঝ দীঘিতে আপনি আর আমি! মাথায় বৃষ্টি বয়ে বাড়ি যাব! অসুবিধে কি!’

প্রাহী ভ্রু তুলে বললো,
– ‘অসুবিধে কি মানে! জ্বর টর আসলে!’

– ‘না আসবে না! আর বৃষ্টি আসতেও দেরী আছে বোধহয়।’

প্রাহী আকাশের দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘তারপরও!’

– ‘তারপরও কিছুনা! আস্তে আস্তে চলে যাব!’

আকসাদের কথার বিপরীতে প্রাহী আর কিছু বললো না! চুপচাপ বসে রইলো। আকসাদ নৌকা নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে! তীরে যেয়ে ঠেকতেই প্রাহী ধীরে ধীরে নেমে এলো। সাথে আকসাদও। মেইন রোডে৷ উঠতেই এক লোককে দেখে আকসাদ উনার সাথে একসাইড হয়ে কিছু কথা বললো। প্রাহী আকসাদের থেকে হালকা পিছনে দাঁড়িয়ে৷ কথা শেষে আকসাদ প্রাহীর দিক ফিরে বললো,

– ‘একটু দাঁড়ান!’

প্রাহী একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো কথামতো। কিছুক্ষণ আকসাদ হাতে একগুচ্ছ শাপলা নিয়ে এলো। সেগুলো প্রাহীর হাতে দিয়ে বললো,

– ‘নিন!

প্রাহী শাপলাগুলো লতাগুলো সহ হাতে নিয়ে দু’গাল হেসে আকসাদের দিক তাকালো।

– ‘আচ্ছা হুট করে আপনি শাপলা তুললেন যে!’

আকসাদ চুলগুলো পিছনে নিয়ে বললো,
– ‘যার জন্য একগাদা পানি খেলেন তাকে আজ সেই বিশাল দীঘি হতে তুলে নিয়ে এলাম! রান্না করে খাবেন!’

প্রাহী আলতো হেসে বললো,
– ‘আচ্ছা!’

– ‘আর আমাকেও টেস্ট করাবেন!’

প্রাহী আকসাদের দিক তাকিয়ে মাথা নেড়ে হেসে বললো,
– ‘ওকে!’

শাপলা গুলো একসাথে নিয়ে গুছিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাহী আকসাদকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘ওই লোকটা কে তখন যে কথা বললেন!’

– ‘ওহ্! উনি! উনি আসলে আসল মাঝি! মানে যে নৌকোয় আমরা চড়লাম ওটা উনার ছিলো! ভাডায় নিয়েছিলাম। ওটাই মিটিয়ে এলাম!’

প্রাহী মুচকি হেসে বললো,
– ‘ভাড়া নিয়েছিলেন! বাহ্!’

আকসাদ প্রাহীর সাথে হেসে উঠলো। বাড়ির কাছে আসতেই প্রাহী আকসাদের দিক তাকালো। আকসাদও প্রাহীর দিক তাকিয়ে!

– ‘আস্তে আস্তে মনের সংশয়ের গিটগুলো কি খুলছে প্রাহী! এভাবেই একটু সময় দিন বাকি গিটগুলোও খুলে যাবে তখনও যদি আর কোনো প্রশ্ন থাকে আমিই তার সমাধান দিয়ে দিব!

আকসাদের শান্ত কন্ঠে প্রাহী কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ! কি…।’

আকসাদের ফোন বেজে উঠায় দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে প্রাহীর দিক তাকিয়ে বললো,

– ‘প্রাহী আমার আর্জেন্ট এখন একটু যেতে হবে! আপনি সাবধানে বাসায় যান! পরে না হয় দেখা হবে কেমন!’

প্রাহী মাথা নাড়তেই আকসাদ ফোন হাতে নিয়েই দ্রুত হেঁটে চললো। যতদূর আকসাদকে দেখা যায় ততদূর ওকে দেখতে থাকলো! চোখের বাইরে চলে যেতেই প্রাহী ধীর পায়ে বাড়ির দিক এগোলো। বাসা নিরব! মা আর বাবা মনে হয় আপাতত ঘুমে! শাপলাগুলো কিচেনের এক সাইডে রেখে প্রাহী আলতো পায়ে নিজের রুমের দিক এগোলো। রুম এসে আয়নায় দিক তাকাতেই কানের শাপলার দিক নজরে পড়তেই ঠোঁটের কোণে হাসি চলে এলো ওর! আজকের দিনটা একদম মনে থেকে যাবার মতো! শুধু আজকের দিন নয় বিগত দিনগুলো প্রত্যেকটা প্রাহীর মনে গেঁথে আছে! প্রত্যেকটা মুহুর্ত কি স্নিগ্ধ ছিলো! কানের শাপলা ফুলটা হাতে নিয়ে তা স্বযত্নে ফুলদানিতে রেখে ফ্রেশ হতে চললো!

দুপুরের দিক আকসাদ বাড়ির ভিতর যেতেই আকসাদ দেখলো বাড়ির বাইরে অনেকগুলো জুতো! এতো জুতো! কেউ এসেছে নাকি! বাড়ির ভিতর ঢুকতেই দেখলো কিছু অপরিচিত মুখ! গেস্ট বোধহয়! আকসাদ আপাতত সেদিক না তাকিয়ে রুমের দিক চললো। সকাল সকাল কাজে বেরিয়েছিলো ও। বেশ টায়ার্ড লাগছে! ফ্রেশ হতে হবে নইলে হবেনা।

একটা লম্বা শাওয়ার এর পর নিচে আকসাদ নামতেই দেখলো টেবিলে খাবার সাজানো। আকসাদের মা ছেলেকে দেখে খাবারের টেবিলে বসতে বললেন। আকসাদ টেবিলে বসতেই ওর মা প্লেটে খাবার বেডে দিতেই ও চুপচাপ খেতে লাগলো।

– ‘এটা শাপলার তরকারি তুই খাবি!’

আকসাদ ওর মার দিক তাকিয়ে বললো,
– ‘শাপলার তরকারি!’

আকসাদের মা মাথা নেড়ে বললেন,
– ‘হ্যাঁ! শিমলার বান্ধবী প্রাহী দিয়ে গেছে! চিংড়ি দিয়ে রান্না করেছে মজা হয়েছে অনেক! তুই খাবি! তোর তো চিংড়ি বেশ পছন্দ!’

আকসাদ মাথা হেলে বললো,
– ‘হু! দাও!’

আকসাদের মা বেড়ে দেওয়ার সাথে সাথেই ও মুখে দিতেই ওর ভ্রু জোড়া হালকা কুঁচকে এলো! এত মজা! দীঘি বা ডোবার এক কোনে পানির নিচের এই শাপলার এত স্বাদের! বাহ্! প্রাহী রেঁধেছে নাকি! খেতে খেতে আশপাশ দেখলো আকসাদ। প্লেটে নজর দিয়ে খাবারটা শেষ করলো আকসাদ।

– ‘আরেকটু দিব!’

মায়ের দিক আকসাদ মাথা নেড়ে বললো,
– ‘না আপাতত পেট ভরে গেছে! রাতে খাব না হয়!’

হাত ধুঁয়ে আকসাদ নিজের রুমের দিক যাওয়ার পথে শিমলার সাথে দেখা হতেই ওকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘এই শিমলা! তোর ফ্রেন্ড মানে প্রাহী এসেছিলো!’

শিমলা শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘হু!’

– ‘কোথায়! আই মিন উনার রান্নাটা মজা হয়েছে একটা থ্যাংকস তো প্রাপ্য রাইট! কোথায় উনি!’

শিমলা শান্ত কন্ঠেই যেতে যেতে বললো,
– ‘নেই! চলে গেছে।’

আকসাদ কিছুটা অবাক হলো! শিমলার যাওয়ার দিক তাকিয়ে ভাবছে চলে গেছে! প্রাহী না দেখা করেই চলে গেলো! স্ট্রেঞ্জ! আকসাদ ঘরে আসতেই দেখলো,,,

চলবে,,,