হিমাদ্রিণী পর্ব-০১

0
9

#হিমাদ্রিণী – ১
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা

-“ডক্টর মাশুক মৃধা?”

জ্বরের প্রকোপে শরীর অবসন্ন। তবুও ঔষধটি নেওয়ার সময় মেলেনি। কাজের ভারে চাপা পড়ে সেটুকুও অসম্ভব হয়ে উঠেছে মাশুকের জন্য। আজকাল মানুষ যেন স্বেচ্ছায় পাগল সাঁজতে চায়। বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখার কল্পনাও সে করেনি। ওভারথিংকিংকে মানসিক ব্যাধির মোড়কে জড়িয়ে ছুটে চলে আসে মানসিক ডাক্তারের কাছে।আর চিকিৎসার পরিবর্তে ঔষধের দাবি করে। মেডিটেশন করতে বললেই যেন অভিযোগ ওঠে।ক’জনকে বোঝাবে?সব রোগের ঔষধ হয় না।সামনে বসা বয়স্ক ভদ্রলোকটিকেও এখন বিরক্ত লাগছে।কারণ জানা,সেও হয়তো বলবে ‘আমার কিছুই ভালো লাগে না।’

মাশুক চোখের চশমা খুলে রেখে সবিনয়ের সাথে জবাব দেয়,

-“জ্বি… কি সমস্যা আপনার?একে একে বলুন।”

কথাটা কেমন যেনো রূঢ় শোনালো।মাশুকের নিজের কাছেও। বেয়াদবের মত একটা আচরণ।নিজের কথায় নিজে কপাল কুঁচকে নেয়।নিজেকে শুধরে আগেভাগেই বলে উঠলো,

-“দুঃখিত।আপনার সমস্যাগুলো একে একে খুলে বলুন দয়া করে”

সামনে বসা মানুষটি বুঝে উঠতে পারলো না হুট করেই কেনো কথার ধাঁচ বদলে যায় ডাক্তারের।সেই বিষয়ে মাথা ঘামায়নি তেমন একটা খতিব সরোয়ার সাহেব।পড়নে পাতলা আরামদায়ক ফতুয়া আর সাদা পায়জামা পরে খুব সাধাসিধে ভঙ্গিতে এসেছেন।দেখে বোঝার উপায় নেই একটি আস্ত পোশাক কারখানার মালিক সে। বিনয়ী হেসে মাশুকের দিকে দুটো ফাইল এগিয়ে দিলেন।বললেন,

-“ সমস্যাটা আমার না ডক্টর।আমার ভাতিজির।”

মাশুক ফাইলজোড়া নিলো।পূনরায় চশমা চোখে দেয়।চেয়ারে হেলান দিয়ে নজর বুলালো।প্রশ্ন করলো,

-“যার সমস্যা তাকে আনলে ভালো হতো।”

হতাশ মুখখানা দৃষ্টিগোচর হয় মাশুকের।চশমার আড়াল থেকে ভালোভাবেই মুখের ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে নিলো।একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে তার চোখ গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে।মাশুক ধরেই নিলো যার সমস্যা নিয়ে এখানে আসা তাকে হয়তো কোনো কারণবশত নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

একগ্লাস পানি ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে মাশুক বললো,

-“আমি একবার রিপোর্টগুলো দেখে নিচ্ছি।”

-“জ্বি অবশ্যই”

Complex PTSD অর্থাৎ কমপ্লেক্স পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার।কপালে ভাঁজ পড়ল মাশুকের।অবস্থা ভয়াবহ।এটি সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী ও পুনরাবৃত্তিমূলক ট্রমার কারণে ঘটে থাকে।হতে পারে সেটি মানসিক নির্যাতন,শারীরিক নির্যাতন, অতীত কোনো ভয়াবহ স্মৃতি ইত্যাদি।স্বল্প মেয়াদী পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার থেকে ধীরে ধীরে কমপ্লেক্সের দিকে এগোয়।আর ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে গভীরভাবে আঘাত করে।ফাইলটি উল্টে-পাল্টে দেখে রেখে দিলো।প্রশ্ন করলো,

-“শুরু থেকে তার বিষয়ে জানতে চাই…”

খতিব সরোয়ারের মুখে যেন কালো মেঘ নেমে এলো।বিষাদের এক ঘন আবরণ আচ্ছন্ন করেছে তার চেহারা।অতীতের ক্ষত আবারও কালের কঙ্কালসার ছায়ায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।যেগুলো বলা মানেই আত্মার ক্ষরণ।সেগুলো আবারও জিভের ডগায় তুলে আনতে হবে। তবে ডাক্তারদের কাছে কিছু গোপন করার অধিকার নেই। এক দীর্ঘশ্বাসের ভারে তিনি বলিরেখা ভরা ঠোঁট খুললেন,

-“আজ থেকে দশ বছর পূর্বে আমার বড় ভাই এবং ভাবিকে তাদেরই বাড়িতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।নিজের চোখে বাবা মায়ের এরূপ মৃত্যু সহ্য করতে পারেনি আমার ভাতিজি।তখন থেকেই তার মানসিক অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যেতে থাকে।”

মাশুক চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,

-“তখন আপনার ভাতিজি কোথায় ছিলো?”

খতিব সাহেব মাথা নুইয়ে বললেন,

-“তাকে স্টোর রুমের কাবার্ডে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।সেখান থেকে সরাসরি ডাইনিং রুম দেখা যায়।আর….”

বলতে বলতে খতিব সরোয়ারের বক্ষের গহীন থেকে নিঃশ্বাস যেন আটকে এলো।কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে গেলো।অশান্ত ঢেউ এসে ভর করছে তার ওপর। সেই সময়ের বিভীষিকা,ভয়াবহতা যেন শীতল বরফের মতো জমে আছে স্মৃতির গভীরে। ভাতিজির কণ্ঠে শোনা সেই শোকগাথা তাকে এমন এক চরম অস্থিরতায় নিপতিত করেছিল।যে কারণে নিদ্রা তার চোখে সারা সপ্তাখানেক আসেনি।

-“রিল্যাক্স মিস্টার…?”

-“খতিব…খতিব সরোয়ার”

-“জ্বি মিস্টার খতিব সরোয়ার।আপনি শান্ত হন।পানি খান এবং লম্বা নিঃশ্বাস নিন।আপনার শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে বোধহয়।”

মাশুক খতিব সাহেবকে দু’এক মুহূর্ত সময় দিলো।যেন আবেগের চাপ একটু প্রশমিত হয়। বয়সের সাথে সাথে অনুভূতির এমন ঝাঁক সামলানো তার পক্ষে এখন কঠিন।কিছু সময় পর মাশুক শুধায়,

-“ঘটনা দশ বছর পূর্বের।ধীরেধীরে তার মানসিক অবস্থা অবনতির দিকে ।আপনারা তখন কেনো কোনো চিকিৎসা করাননি?আমি দেখছি রিপোর্টগুলো বিগত দুয়েক বছরের”

-“আমরা আগের যুগের মানুষ ডাক্তার।অতশত মানসিক সমস্যা সম্পর্কে আমাদের ধ্যান ধারণা নেই।আমরা ভেবেই নিয়েছিলাম বাবা মায়ের বিয়োগ মেয়েটিকে নিশ্চুপ করে দিয়েছে।একা একা থাকতো।সময় মতো খেতো।আবার বই পড়তো।এভাবেই দুয়েক বছর কেটে যায়।ধীরেধীরে সে একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করে আমাদের সাথে।হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলো পড়ালেখা করবে না।আমরা ওকে বুঝাই।কিন্তু সেদিন সে বিরাট কান্ড ঘটায়।ফুলদানি নিজের মাথার কাছে এনে বলতে শুরু করে তার সিদ্ধান্ত মেনে না নিলে নিজের মাথায় ফুলদানি দিয়ে আঘাত করবে।ধীরেধীরে ওর চুপচাপ থাকার স্বভাব রাগে পরিণত হয়। আমরা সেটিও মেনে নিয়েছি।কারণ ওর বাবা আর ও ছোটবেলা থেকেই ভীষণ জেদি ছিলো। স্বাভাবিক আর বাবা মায়ের মৃত্যুর ধাক্কা হিসেবেই গুরুত্ব না দিয়ে আমরা ভুল করেছি। আজ এই পরিণাম।আমার ভাতিজি পরিপূর্ণ রূপে পাগল।”

এলোমেলো পলক ফেললো মাশুক।পাগল শব্দটা তার পছন্দ হয়নি।নরম গলায় বলে,

-“পাগল একটা অসম্মানজনক টার্ম মিস্টার খতিব।মানসিক সমস্যা কোনো অন্যায় নয়।তার প্রয়োজন এখন সু চিকিৎসা।”

-“তার জন্যই আপনার কাছে আসা।আপনি দেশের বাহির থেকে ডিগ্রি অর্জন করে এসেছেন।আপনার নিশ্চয়ই এই বিষয়ে ভালো অভিজ্ঞতা আছে।আমার ভাতিজিকে সুস্থ করে তুলুন ডাক্তার।”

মাশুক দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে ডেস্কের ওপর রাখে।তার মুখাবয়বে সর্বদাই এক কঠোর গাম্ভীর্য ছায়া ফেলে।যদিও অনেকবার সেই গম্ভীর প্রাচীর ভাঙতে চেয়েছিল,কিন্তু পারেনি। অন্তর্মুখী স্বভাবের অন্তরালে বন্দী।খতিব সাহেবের কথার উত্তরে বলে,

-“এটাই আমার কাজ।তার পূর্বে আপনার ভাতিজির সাথে আমার দেখা করতে হবে।”

-“অবশ্যই…কিন্তু বিষয়টা সহজ হবেনা।আসলে আমার একটা প্রস্তাব ছিলো।”

-“জ্বি বলুন”

-“আমি আমার ভাতিজির জন্য ফুল টাইম ডাক্তার চাই।যেনো সে সারাক্ষণ তার সাথে থাকে।তাকে আবারো আগের মত স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে।তার জন্য যে মূল্য দিতে হবে আমি দিবো।”

জ্বরের ঘোরে হুটহাট রাগ চড়ে।মূল্য বলতে কি বুঝিয়েছেন খতিব সাহেব সেটা ভালোভাবেই বোধগম্য হয়েছে মাশুকের।চোখ নামিয়ে বললো,

-“অর্থের বিনিময়ে সুস্থতা,সম্মান এবং অর্জন কিনে নেওয়া যায় না”

_

আসবাবহীন শূন্য কক্ষের ধুলো জমা জমিনে নিস্তেজ পড়ে আছে এক নারীর দেহ।চোখদুটো ফ্যানের অনন্ত ঘূর্ণির দিকে নিবদ্ধ।নিষ্পলক,যেন কোনো ইন্দ্রজালে গভীরে ডুবে থাকা। পাঁচ মিনিট ধরে সে নিজের চোখকে যন্ত্রণার সাগরে নিমজ্জিত করছে। হঠাৎ করেই এক প্রচণ্ড তীব্রতায় লাফিয়ে উঠে বেহুদা হাসিতে ফেটে পড়ল। সেই হাসির প্রতিধ্বনি ঘরের দেয়ালে দেয়ালে আছড়ে পড়তে থাকে।এক বিভ্রান্তিকর গুঞ্জনে ভরে ওঠে পরিবেশ। মেয়েটি মাতালের মতো ঢুলতে ঢুলতে হাত দুটো ছড়িয়ে দিলো শূন্যে। যেন অসীমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে। ঠিক তখনই দরজায় এক আঘাত —এক মুহূর্তেই সমস্ত হাসির আবেগ উবে গেল।মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ল রক্তিম রাগের আগুন।

-“হেমা… মা দরজাটা খোলো।আমি তোমার ছোট বাবা”

জমিন কাঁপিয়ে একজোড়া পা দরজার দিকে আসে।দরজা খোলার পূর্বে ভেতর থেকেই দুয়েকবার দরজায় করাঘাত করলো হাত দিয়ে।ব্যথা পেয়েছে।তারপরও অনুশোচনা হলো না।তারপর দরজা খুলে দাঁড়ায়।

শুকনো মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে চাইলো হেমা।ঠোঁট উল্টে রেখেছে।খতিব সাহেব হাসি মুখে দাঁড়িয়ে।পরপর নজর গেলো পাশে কালচে খয়েরী রঙের পোশাকে দাঁড়ানো পুরুষের দিকে।তার মুখ, পরিধেয় বস্ত্র সবটাই হেমার চোখে অপ্রয়োজনীয়।খতিব সাহেবের কাছ থেকে মনোযোগ সরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো তার বরাবর।দুহাত পেছনে বেঁধে চেয়ে রয় নিষ্পলক।মাশুক তার গম্ভীর ভঙ্গি থেকে সরে আসে।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“হ্যালো হেমা।কেমন আছো?”

বাচ্চাদের সুরে প্রশ্ন আসে, -“তুমি কে?”

মাশুক মুখের হাসি বজায় রেখে বলে,

– “আমি?…আমি মাশুক।”

হেমা হ্যান্ডশেক এর জন্য এগিয়ে রাখা হাতটার দিকে চাইলো।চেয়ে রইলো কিছুক্ষন।তারপর চোখের মণি তুলে দৃষ্টি রাখলো মাশুকের পেটের দিকে।ভাবলো হয়তো কিছু। আচমকা সজোরে ঘুষি দিয়ে বসে সেখানে।আঘাত আর বিস্ময়ে থম মেরে যায় মাশুক!কপালে পাঁচ আঙ্গুল ঘষে।খতিব সাহেব এগিয়ে এসে হেমাকে দূরে সরিয়ে নেন।বলেন,

-“মা? এভাবে কাউকে মারতে হয়না। জানো ও কে?তোমার নতুন বন্ধু।দেখলে না হ্যান্ডশেক করতে চেয়েছে।এসো হ্যান্ডশেক করো।সরি বলো ওকে।”

-“বলবো না!বলবো না! বলবো না! ও আমার বন্ধু না।আমি জানি ছোট বাবা ও আমার কাছ থেকে আমার লাল অ্যালবাম নিতে এসেছে আমি ওকে দিবো না।ওকে সরিয়ে নাও।….এই ছেলে যাও এখান থেকে।”

বলে আবারো তেড়ে এলো হেমা।আঘাত করার পূর্বেই মাশুক তার হাতজোড়া সামলে নেয়।মুখে অনিচ্ছাকৃত হাসি ফুটিয়ে বললো,

-“হেমা আমি তোমার অ্যালবাম নিবো না।আমি তোমার সাথে গল্প করতে এসেছি।করবে গল্প?”

হাত ছেড়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে মাশুক। হেমা আবার তার হাত টেনে ধরলো।তাকে নিয়ে ঘরের ভিতরে আসলো।চিৎকার করে চাচীকে আদেশ করেছে দুটো বড় কুশন যেনো দেওয়া হয় তাদের জন্য।ফরিদা বেগমও এক ডাকেই নিয়ে এলো।জমিনে কুশন পেতেছে হেমা।একটায় নিজে বসলো। অন্যটা দেখিয়ে বললো,

-“এই ছেলে বসো”

যেনো কঠোর গলায় আদেশ ছুড়লো। রিপোর্টে দেখেছে মেয়েটির বয়স তেইশ।তার চিকিৎসার জন্য আগেও দুইজন ডাক্তার এসেছে।তবে বেশিদিন টিকে নি।ডাক্তার তবে মানুষতো?প্রতিটি মানুষের ধৈর্যের সীমা আছে। সাইকিয়াট্রিস্টদের ধৈর্য একটু বেশীই থাকতে হয় কিন্তু মাঝেমধ্যে তাদেরও নিজেদের পাগল মনে হতে শুরু করে।মাসে মাসে নিয়মমাফিক কাউন্সেলিং করতে হয় তাদেরও।ডাক্তারের মস্তিষ্কই যদি ঠিক মত কাজ না করে তাহলে সে মানুষের মানসিক অবস্থা সবল করবে কি করে?

মাশুক পা ভাঁজ করে বসলো হেমার কথা মোতাবেক।বিশেষ খেয়াল রেখেছে মুখের হাসির। সরতে দিচ্ছে না ঠোঁটের কোণ থেকে।মেয়েটির অবস্থা যেমন আশা করেছিলো তার চেয়েও ভয়াবহ। মাশুকের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে হেমা।মাশুক প্রশ্ন করলো,

-“আচ্ছা হেমা?তোমার কি করতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?”

হেমা চটপট উত্তর দেয়,

– “কাগজ কাটতে”

-“ওহ!… আর?”

হেমা হাত ছড়িয়ে বললো,

-“দেয়ালে আঁচড় কাটতে”

হেমার কথাবার্তা স্পষ্ট।সে বুঝে।কিছুটা হলেও বুঝে।একেবারে মানসিক অবস্থার অধঃপতন ঘটেনি।মাশুক তাকে পরীক্ষা করতে প্রশ্ন করলো,

-“আচ্ছা হেমা তুমি আমাকে একটা কথার উত্তর দিতে পারবে?তুমিতো ভীষণ বুদ্ধিমতি মেয়ে। বলোতো কাগজ কাটা আর দেয়ালে আঁচড় দেওয়া কি ভালো কাজ?”

হেমা দ্রুত গতিতে মাথা উপর নিচ দোলায়।বলে,

– “হুম, হুম”

মাশুক চিন্তিত গলায় জবাব দেয়,

-“আচ্ছা…”

-“গল্প করো!…নাহয় আমি তোমায় আবার মারবো।এবার জোরে মারবো বলে দিলাম।তারপর আমার বাবা মায়ের মত শরীর থেকে রক্ত বের হবে তোমার।তখন ভালো লাগবে।”

হাসলো হেমা।অবাক করা হাসি।দুঃখের কথা বলতে গিয়ে হাসছে।খারাপ কাজকে ভালো বলছে।নতুন কিছুই না এটি মাশুকের জন্য।কয়েকবার পলক ফেললো। মাশুককে চুপ থাকতে দেখে হেমা তার হাতে ধাক্কা দিয়ে মলিন সুরে বললো,

-“এই ছেলে তুমি গল্প করবে না?”

অপ্রস্তুত মাশুক জবাব দিলো,

– “হ্যাঁ করবো তো।তুমি আমার কথার জবাব দেবে?”

-“হুম”

-“গুড…বলো তোমার প্রিয় রং কি?”

-“লাল… রক্ত আমার পছন্দ, হেহে!”

-“লাল কিন্তু গোলাপের রং হয় হেমা। তুমি রক্ত কেনো পছন্দ করো।রক্ত ভালো জিনিস না।”

এতক্ষণ তার হ্যাঁ – তে হ্যাঁ মিলাচ্ছিলো মাশুক তাই শান্ত হয়ে থেকেছে হেমা। তার কথার বিপরীতে কথা বলাতে অগ্নি ধারণ করলো চক্ষু।পুরো মুখটা কুঁচকে ফেলেছে। জোরে মাশুকের হাতে আঘাত করে।ঘড়ির উপর লেগেছে যার কারণে ব্যাথাটা বেশি অনুভব হলো। ফুঁসতে ফুঁসতে হেমা বললো,

-“রক্ত ভালো!রক্ত ভালো! গোলাপ আমি চিনি না।সেটা কি?”

বলে হাত খামচে ধরলো মাশুকের। প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলেও মাশুক শান্ত থাকে।বলে,

-“আমি ব্যাথা পাচ্ছি হেমা।”

হুট করেই হাতটা আলগা হয়ে আসে।মায়া হলো বোধহয়।হুট করে হেমা প্রশ্ন করলো,

-“এই তোমার হাত গরম কেনো?তোমার কি জ্বর হয়েছে?”

-“হুম”

-“তোমায় আমি জ্বরের মাঝে ব্যাথা দিয়েছি?”

-“হ্যাঁ”

ঠোঁট উল্টে গেলো হেমার।এক অপরাধবোধ ফুটে উঠলো মুখে। চোখজোড়া গোলাকৃতি ধারণ করে।আবারো ডাগর ডাগর আঁখিতে চাইলো মাশুকের দিকে। অকস্মাৎ হাত এগিয়ে দেয় তার মুখে।শীতল হাতের আঙুলের সাহায্যে তার সারা চেহারায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

-“তোমার জ্বর সেরে যাবে এখন”

স্তব্ধ হয়ে রইলো মাশুক।হাজার হোক মেয়ে মানুষ।যদিও সে তার হিতাহিত জ্ঞানে নেই।এই আজগুবি কান্ড কারখানা তাকে বিব্রত করছে।আগে বড় দুটো কেস হ্যান্ডেল করেছে।কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।

-“এই তোমার কি গোলাপ পছন্দ?”

-“হুম”

-“তোমার পছন্দ আমাকে দেখাবে?”

-“অবশ্যই দেখাবো।কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে”

-“কি শর্ত?”

মাশুক তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-“আমি তোমার বন্ধু।তাই তুমি আমাকে আঘাত করতে পারবে না।আমি তোমায় তোমার পছন্দের খাবার কিনে দিবো।ঘুরতে নিয়ে যাবো।তার বিনিময়ে আমার কথা শুনতে হবে।”

কথাগুলো গুরুত্ব পেলো না হেমার কাছে।মাশুক বুঝতে পারলো তার মুখ দেখে।সে মাশুকের হাতের উষ্ণতা পরিমাপ করে বলে,

-“এই তোমাকে জ্বরের ঔষধ দেই?”

-“না লাগবে না”

-“তুমি আজ আমাদের বাসায় থাকবে?”

-“তুমি চাও আমি থাকি?”

-“তোমার কি বাবা মা আছে?”

-“হ্যাঁ আছে”

আরো একবার হাসলো হেমা।চওড়া হাসি।খুব উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,

-“আমার নেই…”

চলবে…