#হিমাদ্রিণী – ৪
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
মাশুক দু’হাত আলাদাভাবে মুষ্ঠিবদ্ধ করে রেখেছে। চশমার আড়ালের বিস্মিত চোখ দুটো থমকে এখনো।গলা শুষ্ক মরুভূমি।নড়াচড়া করার তিল পরিমাণ সুযোগ নেই।কারণ তার প্রশস্ত বুকে আশ্রয় নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হেমা। কিন্তু তাকে ঘুমোতে দেওয়া তো উচিত নয়, তাকে উঠতে হবে। তবুও, তাকে ডাকতে গিয়ে মাশুকের গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হয় না।অন্যদিকে হেমা বিড়বিড় করে বললো,
“বাবা…মা…”
প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ চুম্বকের মতো।একটি অনিবার্য আকর্ষণ, যা বৈধ সম্পর্কের বাইরে নেতিবাচক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু হেমার ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার সবকিছু যেন হিতাহিত জ্ঞানহীন, এক অনন্ত শূন্যতায় ভেসে যাওয়া আচরণ। অথচ এই অবুঝ প্রয়াস মাশুককে অসহায় আর অস্থির করে তুলছে।
ঢোক গিলে গলা ভেজায় মাশুক।খতিব সাহেব তাদের এভাবে দেখলে বিষয়টা মন্দ দেখাবে।হেমার দুই বাহু চেপে তাকে তুললো।বাহু ঝাঁকিয়ে ডাকলো,
“হেমা?শুনছো?…. দেখো এখন তুমি যদি ঘুম থেকে না উঠো তাহলে আমি চলে যাবো।আর ফিরবো না।”
দ্বিতীয়দফা ঘুম থেকে উঠে আবারো একই অবস্থা। মাশুকের দিকে চেয়ে আছে হেমা। চিনতে পারলো না সাথে সাথে। ঘাড় বাঁকানো,কপাল কুঁচকে মুখ স্ক্যান করছে।মাশুক বুঝতে পেরে শীতল দৃষ্টি ও কণ্ঠে শুধায়,
“চিনেছো?”
“তুমি?”
“হুম আমি?কে আমি?”
হেমা মাশুকের পরনে সাদা এ্যাপ্রোনটা দেখে কিছুটা নিঃশব্দ রয়।মনে করতে চাইছে,আগে কি ছিলো সেটা?এতটুকু মনে আছে মানুষটিকে সে বেশ কয়েকদিন যাবত দেখছে।এতকিছু ভাবতে ভাবতে মাশুকের করা প্রশ্নটিই ভুলে গেলো।মাশুক নীরবে তার জবাবের আশায়।কিন্তু বেশিক্ষণ ধৈর্য টিকে নি।পূনরায় প্রশ্ন করে,
“হেমা আমাকে চিনতে পেরেছো?”
হেমা কিছু আঁচ করতে না পেরেও অলস জবাব দিলো, “হুম”
“না তুমি আমাকে চেনোনি”
“তুমিতো প্রতিদিন আসো তাই না?”
“হ্যাঁ আসি।কি নাম আমার?”
হেমা মাথা চুলকায়।একবার নিচে আবার উপরে চায়।হুট করে বলে উঠলো,
“মা..মা? মাশরুম!”
সশব্দে হেসে উঠলো মাশুক।কি অদ্ভুত!মাথা নুইয়ে হাতের আঙুলের সাহায্যে কপাল চেপে হেসেই চলেছে।বোকা বনে গেলো হেমা।আহাম্মকের মত হা করে চেয়ে রইলো।মাশুক খানিক সময় বাদে ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলে।বলে,
“ঠিক বলেছো…মাশরুম স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী,মাশুক মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। বুঝলে?”
“কি?”
“কিছু না।দ্রুত উঠো।ফ্রেশ হও।”
হেমা মিনমিনে স্বরে বলে, “ঘুমোবো।”
“নো! আর তুমি এত বেলা করে উঠো কেনো?এটা ঘুমোনোর সময়?”
হেমা এত ভারী কথা মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারছে না।মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বললো,
“উফ! কি বলছো তুমি অসভ্য ছেলে?”
“বলেছি এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো যাবেনা।”
“বেলা কখন হয়?”
বিগত কিছুদিন ধরে হেমার সঙ্গে থেকে মাশুকের কাছে তার অস্বাভাবিক কথাগুলোও যেন স্বাভাবিক ঠেকছে। সে তো আগেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এমন পরিবেশে।এদের নিয়েই তার কর্মজীবন।তাছাড়াও মেয়েটি সারাদিন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। ভেতরে বসে থেকে সে কী করেই বুঝবে কখন সকাল হয়েছে, কখন বেলা গড়িয়েছে? এ নিয়ে মাশুকের ভাবনা নেই।কিন্তু একটাই প্রশ্ন রয়েই গেলো।রাতে এত দ্রুত ঘুমিয়ে কীভাবে এত দেরি পর্যন্ত স্থায়ী হয়? এমন দীর্ঘ ঘুম কি আদৌ স্বাভাবিক?
হেমাকে বেসিন এর সামনে ব্রাশ দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো।তখনই ফরিদা বেগম মাশুকের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। দুপুরের সময়।মাশুক আর আহ্লাদ করে বললো না, ‘এসবের কি দরকার ছিলো?’ তার আনতে ইচ্ছে হয়েছে সে এনেছে।কিন্তু মাশুক ধীর গলায় ফরিদা বেগমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“রাতে কি হেমা ঘুম থেকে জেগে উঠে?”
ফরিদা বেগম অপ্রস্তুত হয়েই জবাব দিলেন, “নাতো”
“আপনারা কি করে জানেন সে জেগে উঠেনা?”
ফরিদা বেগম মাশুকের কথার ধরনও নিতে পারেনা।কেমন যেনো একরোখা তার আচরণ।তারপরও বললেন,
“রুমে ক্যামেরা লাগানো।ওর চাচা প্রায়ই উঠে উঠে দেখেন।”
ক্যামেরাতে অবশ্যই তার বুকে মাথা পেতে শুয়ে থাকাটাও রেকর্ড হয়েছে।ভীষণ লজ্জাজনক!কিন্তু কথা বাড়ালো না মাশুক।যদি এই ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হয় তাহলেই জবাব দিবে।ফরিদা বেগম চলে যেতে চাইলে মাশুক আবার বলে উঠে,
“খতিব সাহেবকে বলবেন আমাকে ক্যামেরার একসেসটা দিতে।”
ফরিদা বেগম মাথা দুলিয়ে জবাব দেয়, “জ্বি.. আপনার আর হেমার জন্য খাবার এনেছি। দুপুরের সময় খেয়ে নিবেন।আর পারলে হেমাকে….”
“আমি আছি ওকে টেক কেয়ার করার জন্য।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
ফরিদা বেগম চলে গেলেন।এই লোকের সাথে যত কম কথা বলা যায় তত মঙ্গল। বেলাগাম মুখ।মনে হয় যেনো কোন জনমের শত্রুতা।নয়তো হেমার এমন অবস্থার পেছনে যেনো তারা দায়ী।দুইদিনের ডাক্তারের দরদ উতলে পড়ছে।
মার খেয়েছে, চুল বেঁধে দিয়েছে, এমনকি বুকে ঘুমানোর আশ্রয়ও দিয়েছে তাকে। খাবার খাইয়ে দেওয়াটাও এখন আর তেমন বড় কিছু মনে হলো না।নিঃশব্দে হেমার পাশে বসে দুই লোকমা খাবার তার মুখে তুলে দেয়।
তারপরেই মাশুকের ভেতরের ডাক্তারি মন যেন জেগে ওঠে। হেমার সামনে প্লেট এগিয়ে দিয়ে দৃঢ় অথচ কোমল কণ্ঠে বলে,
“এবার তুমি নিজে নিজে খাবে। আমি যেমন করে তোমাকে খাইয়ে দিয়েছি, ঠিক সেইভাবে। নাও, শুরু করো।”
হেমা কিছুক্ষণ মাশুকের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।যেন সে বুঝতে চাইছে আদৌ পারবে কি না। মাশুকের কণ্ঠে থাকা কর্তৃত্ব আর স্নেহের মিশেল তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য করে প্লেটে হাত বাড়াতে।একটু একটু করে খেতে শুরু করলো। মাশুকের মন হুট করে বলে উঠলো,
“তুমি বুঝো,আবার বুঝো না”
অস্ট্রেলিয়ায় থাকাকালীন মাশুক ভেবেছিলো,মানসিক রোগীদের জন্য একটা বই প্রয়োজন।যা সহজ ভাষায় তাদের ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝিয়ে দেবে? যা পড়ে তারা নিজেদের ভিতরের জটিলতা একটু হলেও সহজভাবে দেখতে পাবে?বাজারে বই আছে।তবে মনমত না।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ।তারপরই তৈরি হলো ‘Good and Bad’ নামক পঞ্চাশ পৃষ্ঠার এক বই। মাশুক এবং তার দশজন সহপাঠী মিলে এই বইয়ে তুলে ধরেছে তাদের মতামত, জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা, এবং ভালো-মন্দের সংজ্ঞা। চিত্রগুলোও যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।বইটি সহপাঠীদের ভাষায় অনূদিত হয়।মাশুকের কপিটা বাংলায়, তার নিজের মাতৃভাষায়।
হেমাকে নিয়ে এলো ছাদে।একটি ম্যাট বিছিয়ে বসলো।বইটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো,
“পড়তে পারো?”
হেমা রোদে বারবার নাক কুঁচকে নিচ্ছে।ভালো লাগছে না তার রৌদ্রের ঝলকানি।চোখে এসে বিধছে।গায়ে উত্তপ্ত অনুভব করছে। হেমা পড়তে জানে।কিন্তু সেটা মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারেনা।মাশুকের সাথে সে অনেকটা স্বাভাবিক থাকে।আর এই স্বাভাবিক আচরণ মাশুকের আরেক চিন্তার কারণ।সেসব বিষয় পাশে সরিয়ে হেমার দিকে বইটি এগিয়ে দিলো।বললো,
“পড়ো”
তপ্ত রোদে মাশুক আরো একটু এগিয়ে বসলো হেমার পাশে। বই খুলে চাইলো তার দিকে।বললো,
“এখানে কি লিখা?…এখানে লিখা আছে কাউকে আঘাত করা?”
হেমা ফ্যাকাশে মুখে বললো, “ব্যা…ব্যাড।”
“হ্যাঁ। তুমি যদি কাউকে আঘাত করো তাহলে কি হবে?”
হেমা অবোধ নজর তুলে চাইলো মাশুকের দিকে।মাশুক আগে থেকেই চেয়ে আছে।চোখে চোখ রেখে হেমা প্রশ্ন করলো,
“কি হবে?”
“দেখো এখানে লিখা আছে।”
বইয়ের পাতায় চোখ রাখে হেমা। পৃষ্ঠাগুলো ধীরে ধীরে উল্টে যায় তার আঙুলের নিচে, আর সে টেনে টেনে পড়ছে।কেনো কাউকে আঘাত করা খারাপ। মাশুক খেয়াল করছিলো তার পড়ার ভঙ্গি। জড়তা আছে, টান ধরে পড়ে। প্রতিটি শব্দ যেন তার মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে, তবু একাগ্রতার অভাব নেই।
বইয়ে লেখা ছিলো, “কাউকে আঘাত করা মানে শুধু তার শরীরে নয়, তার হৃদয়ে আঘাত করা। আঘাত দিলে মানুষ কষ্ট পায়, আর কষ্ট পেলে কান্না আসে। কান্না মানুষের ভেতরের দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। আঘাত শুধু শরীরেই ক্ষত তৈরি করে না, মনেও করে। আর সেই ক্ষত সহজে ভোলে না।”
সবগুলো পয়েন্ট পড়ার পর হেমার মাথায় শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। হঠাৎ করেই সে বলে উঠলো,
“আঘাত পেলে কান্না আসে?”
“হ্যাঁ”
হুট করে শান্ত হেমা অস্থির হয়ে উঠলো।কেমন যেনো এক ছটফটে ভাব এলো তার মাঝে।মাশুকের শার্ট টেনে কাতর গলায় বললো,
“ওই! ওই খারাপ লোকগুলো আমার বাবা মা’কে আঘাত করছে।আম…আমার বাবা..মা কান্না করছে।ওদের কান্না থামাও।থামাও বলছি! থামাও! বাবা মা কাঁদছে”
বলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে।হাত কচলাচ্ছে।মাথা এদিক- ওদিক ঘুরাচ্ছে বারবার।মাশুক খেয়াল করলো হেমার হাতপা কাঁপছে।মাটিতে হাত খামচে ধরছে আবার ছেড়ে আশ্রয় খুঁজছে।মাশুক এক মুহুর্ত দেরি করলো না।হিতের বিপরীত কান্ড ঘটিয়ে হেমাকে শক্ত করে বুকে জরিয়ে নেয়।মাথায় হাত চেপে বললো,
“কিচ্ছু হয়নি….কিচ্ছু হয়নি হেমা!”
“আমার মা..বাবা”
“তারা আছে হেমা।তারা ভালো আছে। তুমি বিশ্বাস করো না আমার কথা?দেখি মুখ তোলো।”
হেমা মুখ তুলবে না।মাশুকের শার্ট খামচে ধরে ধড়ফড় করছে।মাশুক অশান্ত হয়ে উঠলো।অদ্ভুত এক অনুভূতি! তার মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করছে।মনে হলো তাকে ছেড়ে দিলেই হয়তো বিশাল বিপদ ঘটবে। একহাতে হেমাকে আঁকড়ে রেখে অন্যহাত থুতনিতে ঠেকিয়ে মুখ তুললো আকাশের দিকে।বললো,
“দেখো..সেখানে সৃষ্টিকর্তার বসবাস।তোমার বাবা মা সৃষ্টিকর্তার কাছে আছেন।তারা হাসছিলেন এতসময়।কিন্তু এখন?তোমাকে এভাবে দেখে তাদের মন খারাপ। কেঁদে ফেলবেন হেমা।তুমি শান্ত হও দ্রুত।তুমি চাও তোমার বাবা মা কাঁদুক?”
হেমা সরে গেলো।আকাশের দিকে চাইলো। মাশুকের হাতটা সেভাবেই রয়ে গেছে।একরাশ শূন্যতা বয়ে গেলো হৃদয়ে।কি যেনো চলে গেলো চিত্তের কাছ থেকে।নিজের এমন অদ্ভুত চিন্তায় নিজের উপর বিরক্ত হয় মাশুক। ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে আবার বললো,
“দেখেছো তাদের?”
মাশুক চুপ করে কিছুক্ষণ হেমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। হেমা নিষ্পলক আকাশের দিকে চেয়ে।দেখার চেষ্টা করছে।যেনো মেঘ ভেদ করে ফুটে উঠবে তার বাবা মায়ের মুখদ্বয়।
মাশুক আকুল হয়ে ডাকলো, “হেমা”
হেমা সেখানে ভ্রুক্ষেপ করেনি।যেনো শুনেইনি তার কথা।সে তার দুনিয়ায় মগ্ন।হুট করে মাশুকের মস্তিষ্ক তাড়না দিতে শুরু করলো, এভাবেই কি ভুলে যাবে তাকে হেমা?সুস্থ হলে তার আর প্রয়োজন পড়বে না?
____
খতিব সাহেবের চোখে এমন একটি দৃশ্য ধরা পড়লো যেটি লজ্জাজনক।মাশুকের বুকে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে হেমা।তিনি সেকেলের মানুষ, যেখানে নারী-পুরুষের সম্পর্কের সীমারেখা স্পষ্ট। আর সেখানেই এই ঘটনাটি তার মনে এক ধরনের লজ্জা আর অস্বস্তি জাগিয়ে তুললো।যদিও মাশুক আর হেমার অবস্থার পিছনে যুক্তির যোগ-বিয়োগ আছে, তবু তার মনের দ্বন্দ্ব মুছে ফেলা সহজ নয়। পুরোনো রীতির গাঁথা মন যে এই দৃশ্যকে সহজভাবে মেনে নিতে পারবে না, সেটি স্বাভাবিক।
“দেখুন ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত।আপনার মনে দ্বন্দ্ব থাকলে বলুন আমি হেমার কেসটা অন্য কাউকে দিয়ে দেবো।”
মাশুক সোজা বাক্যে কথাগুলো বললো।খতিব সাহেব কপালে হাত ঘষে বললেন,
“না…আমি আসলে”
“রিল্যাক্স মিস্টার খতিব।আপনি জানেন হেমার কন্ডিশন।সে অসুস্থ আর আমি সম্পূর্ণ হিতাহিত জ্ঞানে আছি।আমার তরফ থেকে চিন্তার কারণ নেই।কিন্তু বিশ্বাস নড়বড়ে হওয়া স্বাভাবিক।”
“না না!আপনি হেমার কেসটা অন্য কাউকে দিবেন না।”
মাশুকের স্বভাব চিরকালই সোজাসাপ্টা।কথার গাঁথুনি আর দীর্ঘ বর্ণনার কুহেলিকায় সে কখনো মজে না। তার কাছে জগতে সবটা নিট এন্ড ক্লিন।হ্যাঁ মানে হ্যাঁ, না মানেই না। কিন্তু,তবে এসব শব্দ তার জীবনে কোনো স্থান পায়নি কখনোই।তবু বাস্তবতার কঠোরতায় কখনো কখনো তাকে এমন এক অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হয়, যেখানে সাদা-কালোর সহজ সমীকরণ মুছে গিয়ে ধূসরতার গভীর ছায়া এসে পড়ে।
মাশুক এসব চিন্তা পাশে রাখলো।খতিব সাহেবের দিকে চেয়ে বললো,
“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে চাই”
খতিব সাহেব সাবলীল ভঙ্গিতে অনুমতি দিয়ে বলেন,
“জ্বি অবশ্যই।”
“হেমার বাবা মায়ের খুনি কি ধরা পড়েছিলো?”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের চোখ তাদের পেশায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। এই চোখের সাথে মস্তিষ্কের নিবিড় সংযোগ। যা তাদেরকে অন্যের প্রতিক্রিয়া মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে ধারণা করতে সাহায্য করে। এটি যেন এক বিশেষ দক্ষতা, যার মাধ্যমে তারা মানুষকে দ্রুত স্ক্যান করে।
এমন পরিস্থিতিতে খতিব সাহেবকেও এক গভীর দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হতে দেখা গেল।মাশুক ফের প্রশ্ন করে,
“বলুন?”
খতিব সাহেব বললেন, “তারা শাস্তি পেয়েছে।”
“কি রকমের শাস্তি?”
“তারা মোট পাঁচজন ছিলো।দুইজন সবকিছুর মূলে।তারাই মূলত ভাই আর ভাবীকে আঘাত করতে শুরু করে। বাকিরা তাদের হাত,মুখ চেপে ছিলো।”
“কিভাবে জানলেন? জবানবন্দির মাধ্যমে?”
খতিব সাহেব স্বাভাবিকভাবেই জবাব দেন, “হ্যাঁ।আমি কেস করেছিলাম।তারপর তারা ধরা পরে।দুজন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী আর বাকি তিনজন যাজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছে।”
মাশুক তর্জনী আঙ্গুল ঠোঁটের উপরের অংশে ঠেকিয়ে দেখছে খতিব সাহেবকে।কি ভয়াবহ অস্থিরতা তার মধ্যে। আশ্চর্য! সে কি ভয় পাচ্ছে? মাশুক সোজা হয়ে বসে প্রশ্ন করে,
“এত সহজে?কেস কতদিন চলেছে?”
“চার বছর…”
“চার বছর কেস লড়ছিলেন তাই হেমার দিকে খেয়াল দিতে পারেননি তাই না?”
খতিব সাহেব কথাগুলো চোখ নামিয়ে বলছেন।মুখের ভঙ্গি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়।এবার হতাশ গলায় বললেন,
“এটাও একটা কারণ আর বাকিটা আমার গাফলতি।”
“আর আপনার স্ত্রী?”
“সে হেমার সেবা করতে করতে হয়রান।”
“সেটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছি।আপনার এবং তার বয়স হয়েছে।এই বয়সটাতে কমবেশি এমন হয়ে থাকে।”
“হুম…”
“আপনার ছেলে মেয়ে নেই?”
“আছে।একটা ছেলে আছে।কানাডায় পড়ালেখা করে।”
“বাহ! আচ্ছা আপনি আমাকে হেমার ঘরের ক্যামেরা একসেস দিবেন।”
খতিব সাহেব চোখ তুলে তাকালেন।প্রশ্ন করলেন,
“কিভাবে দেয়?”
মাশুক আশ্চর্য হলো। ক্যামেরা লাগানো ঘরে।প্রতিদিন হেমাকে চেক করছে।আর সে জানেই না ক্যামেরা একসেস কিভাবে দেয়? অদ্ভুত!
“আপনাকে ক্যামেরা কন্ট্রোল করা কে শিখিয়েছে।”
“আমার ছেলে ফাহিম। ও এসে আমার ঘরে এই টিভিতে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।”
“আচ্ছা আচ্ছা!…. ওকে কল করুন।বলুন ক্যামেরা একসেস লাগবে আমার।”
মাশুক ক্যামেরার পুরো নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরেছে। আসার পরপরই ফাহিমকে সেই তালিকা থেকে আউট করে দিলো।এখন খতিব সাহেব এবং সে ছাড়া হেমাকে কেউ দেখতে পারবে না।পুরোনো একটি মনিটর সংযোগ করলো এবং সংযোগ হতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো হেমার গভীর ঘুমন্ত চেহারা।মাশুক এক হাতে সাদা তোয়ালে দিয়ে নিজের ভেজা চুল মুছছে।আর অন্যদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। হেমার নিস্তব্ধ শ্বাসের প্রতিটি ছোটখাটো নড়াচড়া যেন তার মনকে শীতল করলো। আলগোছে হেসে ঘরের লাইট নিভিয়ে নেয়।
ডান দিকে শুধু একটি মনিটর জ্বলজ্বল করছে।পুরো রুম অন্ধকার।মাশুক ঠিক সেদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে।হেমার প্রতিটি নড়চড় পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।হুট করে মনে পড়লো আজ দুপুরের ঘটনা।শক্ত করে ঠোঁট কামড়ে ধরে মাশুক।এই শূন্য অনুভূতির কারণ জানা নেই।শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হয়তো তুমি একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে, নতুন জীবনের আলোয় পথ চলবে। অতীতের ক্ষত ভুলে যাবে।এরপর?”
ঘুমিয়ে পড়লো মাশুক।ঘুমের মাঝে মস্তিষ্ক গীত গাইছে।অর্ধ ঘুমে অদ্ভুত,অদৃশ্য, অচেনা কন্ঠ তাকে জবাব দিলো,
“মাশুক দূর হতে দাঁড়িয়ে দেখবে, অতীত হয়ে।”
চলবে…