#হিমাদ্রিণী – ৭
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
সকালটা যেন শোকের কালো চাদর মেলে ধরল।মাশুক নিঃস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমার্জেন্সির বাইরে। সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।খতিব সরোয়ারকে আর ফেরানো গেলো না। প্রতিবার একটু সুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলেই নতুন করে স্ট্রোক আঘাত হেনেছে। পরপর তিনবারের আঘাতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় তার মস্তিষ্কে।ভোর ছয়টার নিস্তব্ধতায় তিনি জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ডক্টর জিয়াউর রহমান মাশুকের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“সরি..”
-“উনি শেষবার কিছু বলেছেন?বলার চেষ্টা করেছেন?”
-“হ্যাঁ.. হেমা এবং ‘ মা,মা’ উচ্চারণ করছিলেন।এরপরই ওনার তৃতীয়বার স্ট্রোক হয়।আর কিছু বলতে পারেননি।”
প্রথম শব্দ হেমা এবং দ্বিতীয় শব্দ নিশ্চয়ই মাশুক।
মাশুকের শরীর অবশ হয়ে এলো। এ কেমন অনিশ্চয়তার যাত্রা? জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে? হেমার একমাত্র অভিভাবক আর বেঁচে নেই। খতিব সাহেব কোনো অপরাধে জড়িত ছিলেন কিনা, সে উত্তর অজানা। তবে তার মৃত্যু যেন মাশুকের সমস্ত পৃথিবীকে নি:শব্দ এক সাগরের গভীরে ডুবিয়ে দিয়েছে।এক অসীম শূন্যতার মাঝে, যেখানে সবকিছুই ধোঁয়াশার মতো।
মাশুক প্রশ্ন করলো, -“নিয়ে যেতে পারবে কখন?”
ডক্টর জিয়াউর রহমান জবাব দেন, -“কিছু ফর্মালিটি পূরণ করেই।”
ফরিদা বেগমের কণ্ঠে শোকের হাহাকার যেনো সমগ্র করিডোর জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। স্বামীর মৃত্যুশোক তাকে একেবারে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। শোকের ভারে দেহ নিঃশেষ।তার কান্নায় অশ্রুর স্রোত থামার নাম নিচ্ছে না। অন্যদিকে জব্বার সাহেব ক্রমাগত ফোনে চেষ্টা করছেন ভাগ্নে ফাহিমের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও কোনো সাড়া মিলছে না। বাবার মৃত্যুসংবাদ তার কানে পৌঁছানো অতীব জরুরি।
এই সংবাদে শান্তনু ছুটে এলো।সকাল দশটায় তার সাক্ষাত করতে হবে সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের সাথে।তার আগেই হাসপাতালের বিষয়টা মিটমাট হোক।
শান্তনু এসেই প্রশ্ন করলো মাশুককে, -“এখন?”
-“জবাব দিতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।”
মাশুক এর এমন কথায় শান্তনু আর কথা বাড়ালো না। খতিব সাহেবকে দ্রুত বের করার ব্যবস্থা করা হলো।তার আগে হেমাকে নিয়ে আসা হয়েছে।হুট করেই ক্যাবিনের বাহিরে হেমাকে দেখে ভড়কে উঠে মাশুক।এগিয়ে এসে নার্সকে রাগী গলায় বললো,
-“ওকে এখানে এনেছেন কেনো?”
-“স্যার উনি ছটফট করছিলেন।কথা শুনছিলেন না,আপনাকে খুঁজছিলেন। আরেকটু হলে নিজেকে আঘাত করে বসতো।”
মাশুক হেমার দিকে তাকিয়ে গভীর বিস্ময় নিয়ে।এতটা সময় ধরে যে ছটফট করছিলো, এখন তাকে দেখে সেই কষ্টের কোনো চিহ্নই বোঝা যায় না। হেমার ফ্যাকাশে, নির্লিপ্ত মুখে যেনো এক অদ্ভুত স্থবিরতা নেমে এসেছে। চোখে সমুদ্রের গভীরতা।যেনো সবকিছু গিলে ফেলতে পারে। মাশুকের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই এক খানি নির্মল হাসির ঝলক ফুটে উঠলো তার মুখে। সেই হাসিতে যেনো মুক্তোর ঝরনা ঝরে।মাশুকের হৃদয়ে সেই মুহূর্তে এক শীতল প্রশান্তি এনে দিয়েছে কয়েক সেকেন্ডের জন্য।হেমা পাখির মতো ফুরুৎ করে এসে দাঁড়ায় মাশুকের সামনে।
উচ্চতার পার্থক্যে মুখ তুলে চেয়ে জিজ্ঞাসা ছুড়লো,
-“আমি এখানে কেনো?এটাতো আমার বাড়ি না।”
হেমা কি তবে ভুলে গেলো? গতরাতের প্রতিটি ক্ষত,প্রতিটি ঘটনা কি মুছে গেলো তার স্মৃতির পাতা থেকে?
মুছে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। যে ঘটনা প্রতিনিয়ত তার জীবনে ঘটছে, এবং প্রতিদিনের মতোই সে ভুলে যাচ্ছে, সেই অতীত ঘটনাবলী আজও তার মনে ধরা দেবে কেনো? প্রতিটি দিনই তার জন্য এক নতুন ভ্রমণ।যেখানে স্মৃতির কোনো চিহ্ন নেই।কেবল আজকের দিনটুকুই সত্য।
মাশুক গভীর নেত্রপাত করে বলে,
-“আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি…জানো এখানে আমি কাজ করি।আমার কাজের জায়গা ঘুরে দেখবে?”
হেমা উৎসুক ভঙ্গিতে মাথা দোলায় এবং বলে,
-“হ্যাঁ দেখবো।”
-“তার আগে চলো তোমার চাচ্চুর সাথে দেখা করে আসি।”
হেমার কথাটি একেবারেই মনঃপূত হলো না। মুখের ভাঁজে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। নাক-মুখ কুঁচকে নিয়ে অসহায় এক অভিব্যক্তি ঝরে পড়লো তার চেহারায়। দেখা করতে চায় না সে, একদমই চায় না। মাশুকের দিকে চোখ তুলে না তাকিয়েই, মাথা না বোধক ভঙ্গিতে ধীরেধীরে দুলিয়ে নিজের অনীহা প্রকাশ করলো।
মাশুক খানিক এগিয়ে এসে বলে,
-“আজ দেখা করে নাও।আর যেতে হবে না।”
হেমা বিড়বিড় করে বললো, -“যেতে চাই না।”
-“আমার কথা রাখবে না হেমা?প্লিজ?একবার?…শেষবার?”
মনের গভীরে ইচ্ছার লেশমাত্র না থাকলেও মাশুকের হাত ধরে চুপচাপ এগিয়ে গেলো হেমা। মাশুকের ইশারায় সাদা কাপড় সরিয়ে নেওয়া হলো খতিব সাহেবের নিথর দেহ থেকে। বেডে শুয়ে আছেন,যেন কেবল ঘুমিয়ে পড়েছেন।স্থির, নিঃশব্দ। এক নিঃশ্বাসে শেষ হয়েছে তার জীবনের অধ্যায়।আর এখন চলছে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি। মাশুকের চোখে অদ্ভুত জ্বলন্ত আগুনের আঁচ পেয়ে জব্বার সাহেব নিশ্চুপ। ফরিদা বেগম নির্লিপ্তভাবে বারান্দায় বসে আছেন।যেনো শোকে মূক হয়ে গেছেন।
হেমা কিছুই বুঝলো না।স্বাভাবিকভাবে চেয়ে রইলো খতিব সাহেবের দিকে।মাশুক বললো,
-“যাও চাচ্চুর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে এসো।”
-“উম! যাবো না।”
মাশুক হেমার দিকে চেয়ে বললো,
-“হেমা”
-“এমন করো কেনো তুমি?”
-“যাও হেমা।তোমার চাচ্চু অসুস্থ।একটু আদর দিবে না?”
হেমার মনে যেনো হঠাৎ করেই এক মায়া জন্ম নিলো। মাশুকের হাতের আলতো স্পর্শ ছেড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো খতিব সাহেবের নিথর দেহের কাছে। পরিবেশটা ভারী আর থমথমে।নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো যেন কোনো শোকের অতলান্তে ডুবে আছে। খতিব সাহেবের থেমে যাওয়া নিঃশ্বাসকে অনুভব করার ক্ষমতা হেমার নেই। তবু চাচার কপালে মমতার হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বললো,
-“তুমি ঠিক হয়ে যাবে, চাচ্চু। চিন্তা করো না, হ্যাঁ?”
মাশুক চোখ বুঁজে ঝোড়ো নিঃশ্বাস ফেলে।অদ্ভুত অনুভূতি তার মাঝে।দুঃখের হিসাব নিকাশ মেলাতে পারছে না।হেমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো মাশুক।তাকে বুঝিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তার ক্যাবিনে রেখে পূনরায় ফিরে আসে। শান্তনু মাশুকের হাত টেনে ধরে প্রশ্ন করলো,
-“কি করবি ভেবেছিস?”
-“হুম”
-“কি?”
মোবাইলে কিছু একটা দেখতে দেখতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে মাশুক বলে,
-“হেমা তাকেই মনে রাখে, যে সর্বদা তার আশপাশে তার সুখ হয়ে বিচরণ করে। আর দুঃখ সব ভুলে যায়। আমি চাই, হেমা আমাকে মনে রাখুক।”
মাশুক ফোনে একটি বিষয় খুঁজে বের করতে ব্যস্ত।যদিও এই সম্পর্কে মাশুক আগেই জানে, কিন্তু বিস্তারিত জানতে গুগলের দ্বারস্থ হয়েছে। শান্তনু মাশুকের মতলব কিছুটা আঁচ করতে পারলেও,নীরব থাকলো।কিছুক্ষণ পর, অবশেষে, জিজ্ঞাসা করার তাগিদে বাধ্য হয়ে সে প্রশ্নটি তুললো,
-“তুই কি…”
-“হ্যাঁ! …. ২০১৮ মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা রোগী তার মত প্রকাশ করতে পারবে।সে কার সাথে?এবং কোথায় থাকতে চায়?সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।”
-“হেমাকে তুই নিয়ে যাবি?”
মাশুক ফোন পকেটে গুঁজে।শান্তনুর দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
-“আমার চেয়ে বেস্ট অপশন হেমার জন্য এখন নেই।তার সাথে যা ঘটেছে সেটার পুনরাবৃত্তি হবেনা,কি গ্যারান্টি?আমার কাছে প্রমাণ আছে আর তোর কাছে ক্ষমতা।”
এমন অবস্থায় আদালতের অনুমতি নিতে হয়।আদালতের অনুমতি নেওয়া কোনোভাবে সম্ভব না হলে পরিস্থিতি সাপেক্ষে পুলিশ সেখানে অনুমতি প্রদান করতে পারবে।তবে সেটি শুধুই সাময়িক সময়ের জন্য।
-“এখানে জটিলতা আছে মাশুক।”
-“আর হেমার প্রাণ ঝুঁকি।তুই সব জানিস শান্তনু।কিভাবে ওকে এক রুমে বন্দী করে বাজে স্মৃতিগুলো তার সামনে তুলে ধরা হচ্ছিলো।এটা কি যথেষ্ট নয়?”
মাশুকের কথাকে তাচ্ছিল্য করার সামর্থ্য নেই কারো। কীভাবে বারবার মেয়েটির সামনে ভয়াবহ স্মৃতিরগুলো তুলে ধরা হচ্ছিলো?আপন মানুষের এই নিষ্ঠুরতা অতিক্রম্য! হাতে সময় মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। এখনই থানার উদ্দেশ্যে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে অনুমতি গ্রহণের জন্য, কিন্তু তার পূর্বে হেমার সম্মতি অবশ্যই আবশ্যক।
মাশুক জব্বার সাহেব এবং ফরিদা বেগমকে হেমার ক্যাবিনে ডেকে আনলো।সময় অপচয় না করে সরাসরি বললো,
-“আমি হেমাকে আমার সাথে নিতে চাচ্ছি।”
ফরিদা বেগম চুপ হয়ে আছেন।জব্বার সাহেব প্রশ্ন করেন,
-“সাথে নিতে চাচ্ছেন মানে?”
-“আমি ওর চিকিৎসা এবং দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছি।আপনাদের ওখানে সে নিরাপদ না।ওর শেষ গার্জিয়ান ছিলো ওর চাচা।সে এখন পৃথিবীতে নেই।”
জব্বার সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠেন,
-“ওর চাচী আছে না?আপনি কে? আপনাকে কেনো দিবো ঘরের মেয়ে?কোন অধিকারে?”
মাশুক রাশভারী কণ্ঠে বললো,
-“আওয়াজ নামিয়ে কথা বলুন।এখানে শোকের পরিবেশ তাই আমি বেশি কিছু বলছি না।আপনাদের চাপ দিচ্ছি না। শোক কাটান তারপর অনেক হিসেব নিকেশ বাকি।”
-“হুমকি দিচ্ছেন?”
-“নাহ বাস্তবতার আয়না তুলে ধরছি সামনে।তাছাড়া হেমা অনুমতি দিলে আইনি প্রক্রিয়াতেই ওর দায়িত্বভার গ্রহণ করবো।আইন চেনেনতো নাকি?”
জব্বার সাহেব কথা বাড়ালেন না।শুধু বললেন,
-“নেন অনুমতি নেন।এভাবেই ঘরের মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার কোন আইন আছে,আমরাও দেখবো।”
মাশুক শান্তনুকে একটি সূক্ষ্ম ইশারা করে বললো, হেমার উক্তিগুলো যেন প্রমাণ হিসেবে রেকর্ড করা হয়;এতে তার জন্য যথেষ্ট সহজতর হবে। ধীরে ধীরে পা ফেলতে ফেলতে সে হেমার সম্মুখে এসে বসল। ঠোঁটের কোণে একটি জোরপূর্বক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো,
-“হেমা?”
আনমনে শূন্যে চেয়ে থাকা হেমার হুশ ফিরলো। মাশুককে দেখে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে তার।বলে,
-“গল্প শোনাবে?”
-“হ্যাঁ।কিন্তু আমার কথার উত্তর দিতে হবে তার আগে।”
-“উফ! আবার? আচ্ছা আচ্ছা দিবো,তাহলে কিন্তু আইসক্রিম খাওয়াতে হবে?”
-“চকলেট আইসক্রিম সব দিবো।তার আগে আমাকে একটা কথা বলো, তোমার কাকে বেশি ভালো লাগে আমাকে?নাকি তোমার চাচীকে?”
চাচীর কথা শুনে হাস্যোজ্জ্বল মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে যায় হেমার।মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
-“এই চাচীটা আমাকে বিরক্ত করে।খুব খুব বিরক্ত করে।আমার তোমাকে অনেক ভালো লাগে।তুমি ভালো চাচীটা খারাপ।”
-“আর কি করে চাচী?”
মাশুক খুব সাবধানে জানতে চাইছে।যদি কোনো ক্লু পায়?কিন্তু হেমা চোখের মণি এদিক-ওদিক ঘোরালো।কি যেনো ভাবছে?কিছুসময় বাদে বললো,
-“ভুলে গেছিতো!”
মাশুক দৃষ্টি নামালো কিছুক্ষণের জন্য।ফের হেমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
-“তোমাকে যদি আমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাই থাকবে?সেখানে আমিও থাকবো।তোমাকে একা ফেলে যাবো না।প্রতিদিন গল্প শোনাবো, আইসক্রিম কিনে দিবো।থাকবে? নাকি তোমার চাচীর কাছে তোমাকে রেখে আমি হারিয়ে যাবো?”
হেমার মুখটা আতঙ্কিত হয়ে উঠে।একটু বিরতি নিয়ে মাশুক ফের বললো,
-“আমি চলে গেলে আর কখনও আসবো না হেমা।”
এবারে ভরকে উঠলো হেমা।অস্থিরতা ঘিরে ধরলো তাকে।এগিয়ে এসে মাশুকের শার্টের হাতা টেনে ধরে। কাঁদো কাঁদো অবস্থা তার ইতিমধ্যে।বললো,
-“তুমি যাবে না। যাবেনা না।তোমার বাবা মায়ের কাছে যাবো আমি।আমি চাচীর কাছে থাকবো না। চাচী ভালো না।তুমি এখানে থাকো?”
কথার ধরন এলোমেলো।গুছিয়ে বলতে পারছে না হেমা।মাশুক যা চাচ্ছিলো সেটিই হয়েছে।জব্বার সাহেব কিছু বলবেন বলে এগিয়ে আসলে শান্তনু বলে,
-“বডি নিয়ে বাড়ি যান মিস্টার জব্বার।আপনাদের সাথে আমার দুজন কনস্টেবল থাকবে।আপনারা কেউ শহর ছেড়ে যেতে পারবেন না।আপনাদের হাতে কাগজ পৌঁছে যাবে।কেস নাম্বার ৯০১ রি ওপেন হচ্ছে।”
মাশুক হেমার দিকে চেয়ে বললো,
-“কাঁদে না।তোমাকে তোমার নতুন বাড়িতে নিয়ে যাবো,কেমন?এখন একটু ঘুমাও?”
হেমা বিশ্বাস করতে পারলো না মাশুকের কথায়। শার্ট আর শক্ত করে খামচে ধরে কাতর গলায় জানতে চাইলো,
-“আমাকে ছেড়ে যাবেনাতো?”
মাশুকের অন্তরে এক আঘাত হানলো প্রশ্নটি। কতোটা গভীরতা মেশানো এই প্রশ্নে হিসেব করতে পারছে না।আপনাআপনি বলে উঠলো,
-“যাবো না। আয় প্রমিস”
______
মাশুক নিজের ক্যাবিনে এসে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো।গতকাল পুরো রাত এবং দিন সে বাহিরে। শরীর ও মনের উপর ভর করা ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলা প্রয়োজন। হেমা তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে থাকতে চায় না, তবুও অনেক বুঝিয়ে ‘Good and Bad’ বইটি তার হাতে দিয়ে এসেছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগীরা আসতে শুরু করবে। আজ সংখ্যা কম, মাত্র তেরোজন।
দুপুরে খতিব সাহেবের জানাজা।এক অদৃশ্য টান যেন তাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়। আজ কাউন্সেলিং পিরিয়ডে মাশুক অন্য কাউকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবস্থা করেছে।মনের গভীর তাগিদে এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে,ভালোমন্দ যাই হোক যিনি আর এই পৃথিবীতে নেই, তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধার বিনিময় অন্তত মনুষ্যত্বের তাগিদে করা উচিত।
রোগী দেখার ফাঁকে মাশুক শান্তনুকে কল করে জানতে চাইলো,
-“আপডেট কি?”
শান্তনু অন্যপাশ থেকে জবাব দিলো,
-“দেখা হয়েছে কিন্তু তারা মুখ খুলছে না।তারা কিছু না বললে কেস রিওপেন করা সম্ভব হবেনা।”
মাশুক চিন্তিত হলো।বললো, -“ওদের কি কোনো চাপে রাখা হয়েছে?
-“আমারও তাই মনে হচ্ছে মাশুক।”
-“তদন্ত কর,সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের বাড়ির মানুষের সাথে কথা বল। নিশ্চয়ই কিছু পাবি।”
শান্তনু বললো,
-“সেদিকেই এগোচ্ছি।তার আগে অনুমতিপত্র এনে দিতে হবে,নাহয় হেমাকে নিয়ে যেতে পারবি না।”
-“আসছিস তাহলে?”
-“হ্যাঁ বিকেলের মধ্যে চলে আসবো।তখন বিস্তারিত আলাপ হবে।”
খতিব সাহেবের জানাজা শেষে চুপচাপ বেরিয়ে এলো মাশুক আর শান্তনু। জব্বার সাহেব অনেক চেষ্টা করেও এইসব থামাতে পারেননি। পরিস্থিতির সামনে বাধ্য হয়ে হেমার দরকারি কাগজপত্র আর কিছু কাপড় নিয়ে রওনা হয় তারা। থানায় গিয়ে হেমার দায়িত্ব আর নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় সই-সাবুদ সম্পন্ন করে, সাময়িক অনুমতির ভিত্তিতে দায়িত্ব গ্রহণ করলো মাশুক। যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে তারা হাসপাতালে ফিরেছে। হেমাকে ঘুমন্ত দেখে একটু স্বস্তি পেল দু’জনেই, নাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারতো।
হেমার কিছু ব্লাড টেস্ট করানো হয়েছে সকালেই।রিপোর্ট আসবে আগামীকাল।শান্তনু মাশুকের আলোচনার এক পর্যায়ে হেমা ঘুম থেকে উঠলো।মাশুকের সাথে আরো একজনকে দেখে চেয়ে রইলো।শান্তনু হেমার দিকে চেয়ে হাত এগিয়ে দেয়,
-“হ্যালো হেমা”
হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে রাখা হাতটির দিকে চেয়ে আছে হেমা।সাথে মাশুকও। অন্তরাত্মা কোনোভাবেই চাইছে না হেমা হাত মেলাক। হিংসেমীপূর্ণ এক মনোভাব।হেমা মাশুকের অব্যক্ত কামনা না জেনেই হাত গুটিয়ে রাখে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শান্তনুর দিকে চেয়ে বলে,
-“তুমি কে?”
-“আমি শান্তনু”
হেমা হুট করে বলে উঠে, -“তো আমি কি করবো?”
মাশুক স্মিত হাসলো।শান্তনু হেসে মাশুকের দিকে চেয়ে বললো,
-“সি ইজ কিউট”
মাশুকের মুখের হাসি বিলীন হয় মুহূর্তেই।তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলো না।শুধু বললো,
-“হুম”
হেমা দুজনকে দেখে কিছুই বুঝতে পারছে না। বেড থেকে পা নামিয়ে নেয়।দুহাত একত্রে মুষ্ঠিবদ্ধ করে বলে,
-“আমি এখানে থাকবো না।”
মাশুক প্রশ্ন করে, -“তাহলে কোথায় থাকবে?”
-“আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও।এই জায়গা ভালো না। বিশ্রী গন্ধ এখানে।”
ফিনাইলের তীব্র গন্ধ যেন হেমার নাসারন্ধ্রে বিদ্ধ হচ্ছিল। তবে সে অদ্ভুতভাবে শান্ত। মাশুক তার স্থিরতা দেখে সন্তুষ্ট। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, হেমার ব্যাগ হাতে নিয়ে হালকা স্বরে বললো,
-“চলো, তোমার নতুন ঠিকানায় যাই।”
শব্দগুলো বাতাসে মিশে গেলেও,হেমার জন্য সেই শব্দে যেন নতুন জীবনের আমন্ত্রণ লুকানো ছিল।গাড়ির পাশের সিটটা সবসময়ই এক শূন্যতার প্রতীক।সচরাচর কেউ বসে না সেখানে। আজ হেমা সেখানে বসেছে।নীরব, স্থির। মাশুক হেমার সিটবেল্ট ঠিক করে দিলো মাশুক। গাড়ি চললো তার বাড়ির দিকে। প্রতিটি মুহূর্তে পুরোনো চিন্তার জায়গা নিচ্ছিলো নতুন চিন্তা। হেমাকে দেখে তার পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী হবে? তারা কীভাবে নেবে এই মেয়েটিকে, যার জীবনে শান্তি নেই, কিন্তু যার বেঁচে থাকা একটি গভীর রহস্যময় ভার বহন করছে?
পুরো রাস্তায় হেমা নির্লিপ্ত ছিলো।জানালার বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখেছে চারিদিক।বাড়িতে এসেই মাশুকের হাত চেপে ধরলো।বললো,
-“এটা আমার নতুন বাড়ি?”
-“হ্যাঁ”
-“এখানে তোমার বাবা মা আছে?”
-“হ্যাঁ”
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েই উপরে চলে এলো মাশুক এবং হেমা।দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে হেমার হাতটা ছেড়ে দেয় মাশুক।বাড়ির কারো নজরে পড়লে বিষয়টা এমনিই অস্বস্তিজনক, তখন আরো খারাপ দেখাবে।
দরজা খুললেন শান্তা বেগম।ছেলেকে দেখে খুশি হওয়ার পরিবর্তে মেয়েটিকে দেখে চুপ হয়ে গেলেন।মাশুক হেমার লাগেজ তুলে ঘরে ঢুকলো মায়ের জিজ্ঞাসু চোখ এড়িয়ে।হেমা কেমন যেনো গুটিয়ে যায়। মাশুক হেমাকে সোফায় বসতে বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সব বলবো…. বাবাকে ডাকো,আর ভাইয়া ভাবিকেও।”
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। রিচেক দেওয়ার সময় পাইনি]