#হিমাদ্রিণী – ৮
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
বসার ঘরে এক চাপা নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। মাশুকের বাবা, মা, ভাই, ভাবি সকলেই সেখানে, এক ধরনের অদৃশ্য শূন্যতা তাদের মাঝখানে। প্রত্যেকের চোখে প্রশ্নের ঝড়। মাশুক জানে, সামনে কঠিন মুহূর্ত আসছে। জবাবদিহিতার পালা শুরু হবে। কী প্রশ্ন আসতে পারে?কেমন প্রশ্ন আসতে পারে সবটাই মাশুকের জানা আছে। উত্তরও যেনো মুখস্ত।চারপাশের থমথমে পরিবেশ।মাশুক নীরবতা কাটিয়ে বলতে শুরু করলো,
-“ওর নাম হেমা।আমার পেশেন্ট। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।এক ভয়াবহ নির্মমতায় সে তার বাবা মাকে হারিয়ে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসেছে।একজন গার্জিয়ান ছিলো ওর।হেমার চাচা,খতিব সরোয়ার।আজ সেও তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।ওর এখন আপন বলতে কেউ নেই।যারা আছেন তারা ওর শত্রু।ওর এই অবস্থার পেছনে দায়ী।ওদের মধ্যে থাকলে হেমা শেষ হয়ে যাবে।তাই আমি ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি”
গম্ভীর পরিবেশে মাশুক গরগর করে সব বলে গেলো। প্রতিটি বাক্য যেন বাড়ির সবাইকে স্তব্ধ করে দিচ্ছিলো।কাউকে না জানিয়ে মাশুক এমন একটি কাজ করবে কেউ তা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। সবাই চুপচাপ কিছু সময় নিলো।যেনো কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। চারপাশে অস্বস্তির বাতাস ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎ মৃদুল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।কণ্ঠে তীব্র বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“তুই কি সত্যি পাগল হয়ে গেছিস?”
মাশুক ভাবলেশহীন জবাব দেয়, -“পাগল হইনি। সম্পূর্ণ জ্ঞানে আছি।”
মাশুকের এমন ছন্নছাড়া কথায় মৃদুল বলে উঠে,
-“আমরা সমাজে বসবাস করি মাশুক।এভাবেই তুই একটা মেয়েকে নিয়ে এলি? কোন অধিকারে?”
মুখ খুললো রিমাও।বললো,
-“তার মধ্যে মেয়েটা মানসিক ভারসাম্যহীন।কিসের ভিত্তিতে আমরা ওকে এখানে রাখবো?কেনো রাখবো?”
মাশুক স্বাভাবিকভাবেই জবাব দেয়, -“ওর সম্পুর্ন দায়িত্ব আমার। ভরণপোষণ,চিকিৎসা সবকিছুর।”
মৃদুল বললো, -“কেনো? তোর কি সম্পর্ক ওর সাথে?হুট করে একটা ভদ্র বাড়িতে মেয়ে নিয়ে উঠে গেলি।”
রিমা স্বামীর সাথে তাল মিলাচ্ছে।বললো,
-“আর সে যদি আমাদের ক্ষতি করে বসে?”
মাশুক রিমার দিকে তাকালো। তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। দৃঢ় বিশ্বাসী গলায় বললো,
-“কেউ ওর ক্ষতি না করলে, সেও কারো ক্ষতি করবে না।”
শান্তা বেগম এত সময় চুপ ছিলেন।দুই ছেলে আর ছেলের বউয়ের তর্ক বিতর্ক শুনলেন।একদফা হেমার অবুঝ মুখপানে তাকান।জহির সাহেব বরাবরই নির্লিপ্ত।ছোট ছেলের মত স্বল্পভাষী।বললেন,
-“এতটা বিশ্বাস তোর?তুই তো ডাক্তার,তুই ভালো করেই জানিস এই ধরনের রোগীরা আঘাত করতে পারে।”
মাশুকের যেনো কোনো কথা গায়ে স্পর্শ করেনা। মন, মস্তিষ্কেও না। অদ্ভুত তার চালচলন, বাচনভঙ্গি।অতি স্বাভাবিক এবং সাধারণ।মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-“হেমা আমার সাথে থাকলে অন্তত কাউকে আঘাত করবে না।আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।আর ও ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে যাবে আমি সেই গ্যারান্টিও দিচ্ছি।”
রিমা তাদের মধ্যে বলে, – “একটা মেয়ে যার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই,কোনো জানাশোনা নেই তাকে এভাবেই ঘরে রাখবো?তাও আবার একটা পাগল মেয়ে।”
অকস্মাৎ রেগে যায় মাশুক।চোখে মুখে কঠোর ভাবমূর্তি ধারণ করে বলে,
-“ও পাগল না ভাবি!”
-“তো কি ও?আর তুই এই মেয়ের জন্য রিমার সাথে রাগ দেখাচ্ছিস?” মৃদুল বলে উঠে।
-“থামো তোমরা! আমি বাবাকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি।বাকিটা বাবা বলুক।”
জহির সাহেব গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ঘরের সমস্ত দৃষ্টি এখন তার দিকে নিবদ্ধ।তিনিই প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
মাশুকের সাথে আগেই কথা হয়েছে তার।হেমার ব্যাপারটি তিনি জানেন। অনেক চিন্তা-ভাবনার পরই তিনি ছেলেকে অনুমতি দিয়েছেন। দৃঢ় কিন্তু শান্ত মনোভাব নিয়ে তিনি পরিস্থিতির ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। বাকিদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টির জবাবে বলেন,
-“মাশুক যা করেছে সেটি নিঃসন্দেহে ভালো কাজ বলে আমি মনে করি।একজন বেওয়ারিশ মেয়েকে আশ্রয় দিচ্ছে।তার দায়িত্ব গ্রহণ করছে।এতে আমি খারাপ কিছু দেখিনা।”
মৃদুল বললো, -“বাবা আপনিও ওর ভুল কাজের সাথে তাল মেলাচ্ছেন?”
-“মাশুক কোনো ভুল করেনি।এই মেয়েটি কোথায় যেতো? কার কাছে যেতো?মাশুক তাকে রক্ষা করতে পারবে জেনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সারাজীবন অপরাধবোধে ভুগতো।”
মাশুক বাবার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চাইলো।সে মাশুকের প্রতিচ্ছবি নয়,মাশুক তার প্রতিচ্ছবি।কখনো মন খুলে কথা হয়নি তারপরও কি দারুনভাবে বুঝেন তিনি। স্বস্তি পেলো মাশুক।জহির সাহেব বললেন,
-“মাশুক চাইছে বৈধভাবে ওর দায়িত্ব নিতে,অর্থাৎ বিয়ে করে।”
মৃদুল, রিমা এবং শান্তা বেগমের মাথায় যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। মাশুকের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি তারা মেনে নিতো হয়তো, কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই তাদের মুখে স্পষ্ট অসন্তোষ ফুটে উঠলো। বিস্ময় আর বিরোধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে তারা একে অপরের দিকে তাকালো।এমন সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই কল্পনায় আসেনি।
রিমা বলে উঠে, -“তুমি এই পাগলকে বিয়ে করবে?”
বরাবরের মতই শান্ত কণ্ঠে মাশুক রিমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
-“কেনো?উচিত নয়?”
-“একেবারেই না”
-“ঠিকই বলেছেন।আপনার মতে আমার বিয়েটা আপনার বোনের সাথে হলে উচিত হতো।কিন্তু দুর্ভাগ্য।সেটি আর এই জীবনে হচ্ছেনা”
মৃদুল বললো,
– “কিসব বলছিস?মুখ সামলে কথা বলিস।”
-“আমি যথেষ্ট নমনীয় ভাষায় বলেছি।কিন্তু ওনার বোন আমাকে যে পরিমাণ বিরক্ত করে,সেই হিসেবে আমার আরো কঠোর হওয়ার কথা।….তাছাড়া আপনারা কথা বাড়াবেন না।আমি সিদ্ধান্ত বাবা মায়ের উপর ছেড়ে দিয়েছি।”
শান্তা বেগম উৎকণ্ঠিত হয়ে বলেন,
-“জীবনটা নষ্ট করিস না নিজের।”
মাশুক মায়ের দিকে চেয়ে নরম গলায় বললো,
-“আমার উপর ভরসা রাখো মা।আমার জীবন নষ্ট হবেনা। বরং আরো সুন্দর হবে।তোমার কাছে একটা অনুরোধ করবো। মা-হীন এই মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে।ওকে একটু মায়ের ভালোবাসা দিতে পারবে?”
শান্তা বেগম হেমার দিকে তাকালেন।মায়াবী একটা মুখ।অবুঝ, নির্বোধ ভঙ্গি।মায়ের ভালোবাসা দিতে কোনো ক্ষতি নেই।কিন্তু ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না তিনি।মাশুক বললো,
-“ওর জন্য একজন নার্স আসবেন।যিনি ২৪/৭ ওর পাশে থাকবেন।ওকে গেস্টরুমে রাখার অনুমতি দাও মা।আমি জানি তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তিত।সেটা স্বাভাবিক…,কিন্তু আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি হেমাকে আমাদের মত স্বাভাবিক করে তুলবো।আর সেটা একটা বৈধ সম্পর্ক ব্যতীত সম্ভব না।তোমরা সমাজের কথা বলো,সমাজ কি সেটা মেনে নিবে?আমি বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মা।প্লিজ!”
ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক,নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারও অর্জন করেছে। ভিনদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানোর দিন থেকেই মায়ের কর্তৃত্ব যেনো ধীরে ধীরে হালকা হয়ে গেছে।তবু মা হিসেবে অধিকার তো রয়ে গেছে, সেই অধিকার খাটান তিনি মাঝেমধ্যে। কিন্তু কখনোই নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেন না।তবে মাশুকের আজকের সিদ্ধান্তে তার মনে এক ধরনের অম্ল ভাব, অসন্তোষ।
মাশুক শান্তা বেগমের দুহাত ধরে বললো,
-“কিছু সময় কাটাও ওর সাথে।বিয়ের পূর্বে হেমার বুঝতে হবে, বিয়ে আসলে কি? তা না হলে এই বিয়ে বৈধ হবেনা।ততদিন হেমাকে বুঝো, জানো।খুব আশা নিয়ে এখানে এসেছে ও।আমি ওকে আশ্বাস দিয়েছি এখানে বাবা মা আছে।”
শান্তা বেগম জবাব দিলেন না তেমন। ইশারায় বললেন যেনো খেতে আসে।মৃদুল রেগে আগুন হয়ে ঘরের দিকে চলে গেলো।জহির সাহেবও উঠে গেলেন সেখান থেকে।হেমা অনেক সময় চুপ থেকে মাশুকের শার্ট টেনে বললো,
-“এই আমারও কিন্তু ক্ষিদে পেয়েছে।”
মাশুক হেমার দিকে ফিরে তাকালো।বললো,
-“এক্ষুনি তোমাকে খেতে দিচ্ছি।”
-“ওকে”
-“হেমা?”
-“হুম?”
-“ভেরি গুড!”
হেমা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,
-“কেনো ভেরি গুড কেনো?”
-“যখন বড়রা কথা বলে তখন একদম চুপ থাকতে হয়,তাদের মধ্যে কথা বলতে হয়না।তুমি সেটা মনে রেখেছো।তাই ভেরি গুড। আগামীকাল দুটো আইসক্রিম পাবে।কিন্তু তার আগে আমার আরেকটা কথা শুনো,কিছুক্ষন পর একজন আন্টি আসবেন।তুমি তার সাথে ঘুমাবে ঠিক আছে?”
বাধ্য মেয়ের মত মাথা দোলালো হেমা।মাশুকের হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে যেনো।সে ছাড়া আর কারো কোনো অস্তিত্বই নেই।হেমা মিনমিন করে প্রশ্ন করলো,
-“উম..উম… বাবা মা কোথায়?”
-“আছে, চলো আমার সাথে”
____
সকালেই যেন এক এলাহী কারবার করে ফেলেছে মাশুক। হেমার ঘরের চেহারা পুরো বদলে গেছে। এক কার্টন ভর্তি বই, একটি ট্যাবলেট, আর তার দেখভালের জন্য একজন নার্স এনে হাজির করেছে। গতরাতেই সব দরকারি জিনিস অর্ডার করে রেখেছিল। আজ ডিউটিতে যাওয়ার আগে হেমার ঘরটা সুন্দরভাবে সাজিয়ে, সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে তবেই বের হলো। মাশুকের এই আয়োজন যেন হেমার নতুন জীবনের সূচনা।তার প্রতি এক অদৃশ্য যত্নের প্রকাশ।বিষয়গুলো ভালো চোখে দেখছে না রিমা এবং মৃদুল। শান্তা বেগম এখনও দ্বিধায়।
মাশুক বইগুলো বুক শেলফে গুছিয়ে নার্সের উদ্দেশ্যে বললো,
-“আপনি নাস্তা করে আসুন।”
নার্স চলে গেলেন।মাশুক এর অনুপস্থিতিতে সে থাকবেন এখানে।মাশুক দুপুর তিনটের সময় ফিরে আসে। নার্স বেরিয়ে যাওয়ার পর বিছানায় নির্লিপ্ত বসে পা দোলাতে থাকা হেমার সামনে পা ভাঁজ করে বসে পড়লো মাশুক।হেমা তাকিয়ে দেখলো মাশুকের পরিপাটি অবয়ব।চোখে চশমা,পরনে চেক শার্ট,হাতে কালো বেল্টের একটি ঘড়ি।বরাবরের মতই একটা সুন্দর ঘ্রাণ আসছে তার কাছ থেকে।হেমা ঠোঁটে ঠোঁট টিপে তাকালো মাশুকের দিকে।মাশুক প্রশ্ন করে,
-“রাতে ঘুম হয়েছে ঠিকমতো?”
হেমা মাথা দুলিয়ে বলে, -“হুম”
মাশুক আবারো প্রশ্ন করলো, -“এখানে এসে চুপচাপ হয়ে গেলে যে?নতুন বাড়ি পছন্দ হয়নি?”
হেমা বললো, -“হয়েছেতো! কিন্তু এখানে এত মানুষ কেনো?আমার এত মানুষ ভালো লাগেনা।ওই নার্স আন্টি….”
হেমার কথা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মাশুক উদ্বেগপূর্ণ গলায় জানতে চায়,
-“কি করেছে নার্স আন্টি?”
হেমা পিটপিট করে চোখের পলক ফেলে। কথাবার্তার বোকাসোকা সবসময়ের মত।বিগত একমাসে কিছুটা ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা এসেছে।বলে ফেললো তড়িৎ গতিতে,
-“না না কিছু করেনি…আমার মাথায় হাত বুলায়।আমার ভালো লাগেনা।”
-“আচ্ছা এই ব্যাপার! আমি মাথায় হাত বুলাতে না করবো ঠিক আছে?”
হেমার মুখে এক স্বস্তির ছায়া মিললো।নতুন জায়গায় হয়তো সে মানিয়ে নিতে পারছে না।তাই চুপচাপ।মাশুক উঠে পড়ে।হেমার দিকে চেয়ে বললো,
-“ক্ষিদে পেয়েছে?”
হেমা পেটে হাত রেখে করুণ চোখে তাকিয়ে বললো,
-“হুম”
আজ নাস্তার টেবিলে পাঁচজনের পরিবর্তে ছয়জনের উপস্থিতি। জহির সাহেব মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন, রিমা মৃদুলকে খাবার দিচ্ছে, আর শান্তা বেগম ব্যস্ত কিচেনে। মাশুক হেমার জন্য আস্তে করে একটা চেয়ার টেনে দেয়, যেনো সে স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারে। তারপর নিজেই কিচেনে চলে যায়। টেবিলের চারপাশে কারো মুখে কোনো কথা নেই।সবাই যারযার মত ব্যস্ত।মাশুক মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-“মা?”
শান্তা বেগম বলে উঠেন,
– “জানি কি বলতে এসেছিস।আমি নিষ্ঠুর নই। হেমাকে একজন বাবা মা-হীন নিঃস্ব মেয়ে হিসেবে আমি যত্ন করলেও,ছেলের বউ হিসেবে মানবো কিনা সেটা সময় বলবে।খেতে আয়, তোর দেরি হচ্ছে”
-“মা আরেকটা কথা”
-“আমি এটাও জানি।তোর অনুপস্থিতিতে ওর কোনো সমস্যা হবেনা। নিশ্চিন্তে থাক।”
মাশুক স্মিত হাসলো।এক্সট্রা একটি প্লেট নিয়ে চলে গেলো।হেমার পাশে বসে প্রশ্ন করলো,
-“কি খাবে বলো? ব্রেড,জ্যাম?নাকি পরোটা।আমার মা খুব ভালো পরোটা বানায়।চাইলে খেতে পারো।”
হেমা চোখ ঘুরালো সবার দিকে।মৃদুল উঠে চলে গেলো।তার সাথে সাথে রিমাও স্থান ত্যাগ করে। শান্তা বেগমের দিকে তাকালে তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে হাসি ফুটিয়ে একটি পরোটা হেমার প্লেটে দিয়ে দিলেন।হেমা ঠোঁট টিপে হাসে।সে খুশি মনে অল্প অল্প করে খেতে লাগলো।
মাশুক খাচ্ছে তার পাশে বসেই।জহির সাহেব বললেন,
-“ফিরবে কখন?”
-“প্রতিদিন যে সময় ফিরি। রূপা আপা হেমার সাথে আছে।চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
জহির সাহেব আর কোনো কথা বাড়ালেন না।মাশুক হেমার দিকে একগ্লাস জ্যুস এগিয়ে দিলো।নাস্তা শেষে হেমাকে ঘরে নিয়ে এসে একটি বই ওর হাতে ধরিয়ে দেয় আর বলে,
-“হেমা শোনো,আমি এখন কাজে যাবো।আমি ফেরার আগ অব্দি তুমি এই বইটি পড়বে কেমন?আমি এসে জানতে চাইবো তুমি কতটুকু পড়লে।আর এইযে ট্যাবলেট দেখছো?আমি ঠিক একঘন্টা পরপর তোমাকে ভিডিও কল করবো এটায়।তোমার কিছু লাগলে নার্স আন্টিকে বলবে।দেখো, ঘরের পাশে বারান্দায় দোলনা আছে।তোমার খুব প্রিয় তাই না? সেখানে বসবে।”
হেমা অসহায় দৃষ্টিতে মাশুকের দিকে চেয়ে বলে,
-“আমি একা থাকবো না।আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো।আমি একা থাকলে তোমাকে মিস করবো। আমার কষ্ট হবে।আমাকে নিয়ে চলো”
মাশুক বললো,- “আমাকে মিস করলে আমাকে কল করবে।”
-“না!”
-“আমার কথা শুনবে না?আমি যাবো আর ফিরে আসবো।এখানে তোমাকে কেউ বিরক্ত করবে না।ফেরার পথে তোমার জন্য আইসক্রিম আনবো কেমন?”
হেমার মন মানছে না।অপরিচিত জায়গা কেমন যেনো তার কাছে।অদ্ভুত, অস্বস্তিজনক।মাশুকের চলে যাওয়া মন মেনে নিতে চাইছে,আবার বাঁধাও প্রদান করছে।এমন পরিস্থিতিতে কি করবে হেমা বুঝতে উঠতে পারছে না।
মাশুক হেমার মুখের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো,
-“আসি আমি?”
-“চিপস আনলে যেতে দিবো।”
মাশুক হেসে বলে, -“ঠিক আছে।তুমি এবার দ্রুত বই পড়তে বসে পড়ো”
____
বাড়ির দিকটা ভালোভাবে সামলে নিয়ে মাশুক এখন ল্যাপটপে বসে হেমাকে নজরে রাখছে। সে প্রতিটি মুহূর্তে সতর্ক। ক্যাবিনের চেয়ারে পিঠ এলিয়ে রেখেছে। কিছু পেশেন্ট দেখার পর আধ ঘণ্টার বিরতিতে শান্তনু এসে হাজির। তার আগমনে এক ধরণের অস্থিরতা ভর করে মাশুকের মনে।কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা হবে এখন।মাশুক বললো,
-“বোস…কিছু জানতে পারলি?”
শান্তনু কিছু ফাইল মাশুকের সামনে রেখে বললো,
-“আসামীদের ফ্যামিলি ডিটেইলস জোগাড় করলাম।ওরা মুখ খুলছে না।বিকেলের দিকে যাবো এদের সাথে দেখা করতে।”
কেমন যেনো আশাহত দেখালো মাশুককে।সোজা হয়ে বসে ছিলো।আবারো পিঠ এলিয়ে দিলো চেয়ারে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ল্যাপটপ স্ক্রিনে।হেমা বই পড়ছে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে।শান্তনু কিছুটা কেশে বলে উঠলো,
-“একটু আধটু প্রেমে যেহেতু পড়েছিস বিয়ে করলেই পারিস।”
বিব্রত বোধ করলো মাশুক।এভাবে সরাসরি প্রশ্ন আশা করেনি।শান্তনু আবার বলে,
-“বিয়ে করছিস না কেনো?”
মাশুক নত গলায় বলে উঠে,
-“বিয়ে করতে দুই পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন হয়।নারী,পুরুষ উভয়ের বোধজ্ঞান থাকতে হয়।যেটা হেমার নেই।সে জানে না বিয়ে কি।আমি এখন যদি তাকে বিয়ে করি সেই বিয়ে গ্রহণযোগ্য হবেনা।”
-“তাহলে কি হেমার পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছিস?”
মাশুক প্রশ্নটিতে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।এক অজানা ভয় মনে হুট করেই চলে এসেছে।হেমা সুস্থ হলে যদি তাকে ভুলে যায়?যদি তাকে না চায়?মাশুক কিছু সময় নিয়ে বললো,
-“সেটাও সম্ভব হবেনা।একই বাড়িতে,একই ছাদের নিচে কোনো সম্পর্কহীন থাকা সম্ভব নয়।”
-“তো করবিটা কি?”
-“জানি না…”
-“আর কি কোনো উপায় নেই?”
মাশুকের চোখ জোড়া নুয়ে আছে।ভারী গলায় বললো,
-“ছিলো উপায়,এখন নেই।হেমার মত মানুষ যদি সম্মতি দিতে না পারে সেক্ষেত্রে তার পরিবারের সম্মতি দরকার হয়।এখনতো সেই রাস্তাও বন্ধ।….আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এখন আমার কাউন্সেলিং দরকার।”
শান্তনু হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।এক অদ্ভুত রহস্যজনক হাসি। মাশুক থ হয়ে শান্তনুর দিকে তাকিয়ে।এমন এক পরিস্থিতিতে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য ভারী হয়ে উঠেছে, সেখানে এই হাসি একেবারেই বেমানান। হাসি থামিয়ে শান্তনু বললো,
-“ দুদিন তোকে জ্বালাবো মাশুক!যেমন তুই বছরের পর বছর আমাকে জ্বালিয়েছিস! আমি ডাকলে আসিস নি, ফোন করলে রিসিভ করিস নি। আজ সময় আমার। এবার রিভেঞ্জ নেবো, ডক্টর মাশুক মৃধা।”
চলবে…