#হিমাদ্রিণী – ১৭
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
ইনজেকশনের প্রভাব গাঢ় হতে হতেই হেমা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল কালরাতে। মাশুক তাকে শান্ত হতে রেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়।কিন্তু পুরোটা রাত্রি গভীর নিদ্রায় কখনো বিড়বিড় করেছে, কখনোবা নিরব কান্নায় ভিজেছে তার মনন। শরীরজুড়ে জ্বরের কাঁপুনি উঠে আসে, আর গত রাতের আর্তনাদের ভার হেমার কোমল সত্তা মেনে নিতে পারেনি। চিন্তাগ্রস্ত মাশুক ক্যাবিনে বসে, তার মন দোদুল্যমান। একা বাড়িতে হেমাকে রাখা কি ঠিক হলো? মা আছেন ঠিকই, তবু কোথাও যেন অশান্তির ছায়া।
মাশুকের চোখ লাল হয়ে আছে। ঘুম হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও।সারারাত জলপট্টি দিয়েছে হেমাকে।সকালে ঔষধ খাইয়ে এসেছে। ফোন হাতে তুললো মাশুক। কল করলো মায়ের নাম্বারে।
-“হ্যালো… মা হেমা ঠিক আছে?”
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে শান্তা বেগম জবাব দিলেন,
-“হ্যাঁ ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না। আমি সারাক্ষন ওর আশেপাশেই আছি।”
-“জ্বর আছে এখন?”
-“অল্প”
মাশুক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পুরোপুরি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। নমনীয় গলায় জানতে চাইলো,
-“কি করছে এখন?”
শান্তা বেগম সামান্য হাসলেন। হেমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
-“কম্বল মুড়ি দিয়ে কার্টুন দেখছে।”
মাশুকের বিধ্বস্ত মুখে হাসি ফুটলো। বললো,
-“আজ আমার ফিরতে রাত হবে মা। থানায় যাবো,তারপর সেমিনারে। ওর খেয়াল রেখো। আমাকে খুঁজলে একটা বাহানা বানিয়ে দিও।”
শান্তা বেগম বললেন,
– “আমি আর তোর বাবা আছি। চিন্তা করিস না। সাবধানে যাস।”
একজন সাধারণ মানুষ কখনোই অস্বাভাবিকতার দিকে মত্ত হয় না, তবে মাশুক হয়েছে ব্যতিক্রমভাবে।খুঁজে পেয়েছে হেমার স্থির চঞ্চলতার ভাঁজে এক অদ্ভুত মাধুর্য। হৃদয়ে গাঢ় হয়ে জমে থাকা অনুরাগ যেন প্রতিটি শ্বাসে বইছে যেনো।
-“আমার সকল শখ-আহ্লাদ অব্যক্ত।আমার আত্মনিবেদন,আত্মত্যাগ,আমার অপেক্ষা বুঝবার মত তোমার স্থিতি হবে কবে?”
_____
-“আমার ভাইকে ছেড়ে দিন”
থানার গুমোট পরিবেশে একাকী ফরিদা বেগমের উপস্থিত। বহু প্রচেষ্টার পর অবশেষে শান্তনুর সাথে দেখা মিলেছে।অফ ডিউটিতে ছিলো শান্তনু। তাই চেয়েও দেখা করা সম্ভব হয়নি। দু’দিনের তার ভাইকে রিমান্ডের নাজেহাল অবস্থায় দেখে হয়তো আর সহ্য হয়নি। একলা মহিলা মানুষ সাহস নিয়েই থানার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়ে গেছে আপন তাগিদে।
শান্তনু ফরিদা বেগমের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“আপনার ভাই খুনের সাথে জড়িত, আর আপনি কি অবলীলায় না বলছেন আপনার ভাইকে ছেড়ে দিতে।”
ফরিদা বেগমের চোখের কোণে বিষন্নতার ছাপ। একবার চেয়ে দেখে শান্তনু বুঝে নেয় তার মনস্তাপের ক্ষীণ আভাস। নিঃশব্দে আড়াল থেকে ফোনের রেকর্ডিং চালু করে।
শান্তনু প্রশ্ন করে,
-“ কেনো ছেড়ে দিবো বলুনতো? একটা যুক্তি দেখান?”
সামনে থাকা পানির গ্লাস হাতে তুললেন ফরিদা বেগম। অর্ধেক গ্লাস পানি শেষ করে বললেন,
-“হেমার বাবার সাথে তার এবং আমার বিয়ের পূর্বে একটা সম্পর্ক ছিলো। তার সাথে বিয়ের কথা চলছিলো আমার।”
শান্তনুর চোখ চড়ক গাছ। বিস্ময়ের ছাপ কপালে। সোজা হয়ে বসলো সে। বললো,
-“হেমার বাবার সাথে?”
-“জ্বি, খায়রুল সরোয়ারের সাথে।”
রেকর্ডিং ওন করে ভালোই হয়েছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাগিদ দিয়েছিলো, সেটি কাজে দিচ্ছে। শান্তনু প্রখর মনোযোগ দিলো ফরিদা বেগমের দিকে। প্রশ্ন করলো,
-“এটাই কি কারণ তাকে খুন করার?”
ফরিদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
-“কিছুটা, আমার ভাই উন্মাদ। আমাকে সে কষ্টে দেখতে পারছিলেন না।”
শান্তনু কঠোর গলায় বলে উঠে,
– “স্পষ্ট স্টেটমেন্ট দিন। কথা প্যাঁচাবেন না।”
-“স্পষ্ট করেই বলছি…”
-“বলুন”
-“খায়রুল সরোয়ার আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে সে আমাকে তার ঘরের বউ করে তুলবেন।আমার পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক সেই সময়ের।সবাই জানতেন আমাদের বিয়ের কথা। আংটি পরিয়ে রাখা হয়েছিলো।কিন্তু সেটি আর বিয়ে অব্দি গড়ায়নি।”
শান্তনু জেরা করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলো,
-“কেনো?”
-“হেমার মা খায়রুল সরোয়ারের মামাতো বোন ছিলেন। হুট করেই তার বাবা মারা যায়। তাকে একা পেয়ে নির্যাতন করতো হেমার মায়ের নানী বাড়ির লোকজন। মৃত্যুর পূর্বে হেমার নানা খায়রুল সরোয়ারের কাছ থেকে কথা নেন যেনো তার মেয়েকে বিয়ে করা হয়। তার দায়িত্ব নেওয়া হয়। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে হেমার বাবা পড়ে গিয়েছিলেন চোরাবালিতে। তিনি বিয়েতে নারাজ হলে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়।”
শান্তনু বললো,
-“জোর করা হয়েছে আর বিয়ে করে ফেললেন? এত সহজ?”
-“সেই সময় সমাজটা এমন ছিলো না। হেমার মা’কে তার খালারা টাকার বিনিময়ে বিয়ের নামে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। নিষ্ঠুর অমানবিকভাবে তার মতো নিঃস্ব মেয়ের উপর অত্যাচার চলতো।”
শান্তনু হাসলো। অনেককিছু পরিষ্কার তার কাছে। হাসি পেলো তার ফরিদা বেগমের কথার ধরনে।বললো,
-“ অত্যাচার? নিষ্ঠুর? অমানবিক? আর আপনারা কি?”
বিব্রত বোধ করলেন ফরিদা বেগম। কিছু সময়ের বিরতি নিয়ে বললেন,
-“সময়ের সাথে মানুষের আক্রোশ,জেদ বৃদ্ধি পায়। দুঃখ মানুষকে মাঝেমধ্যে অমানুষ বানিয়ে ফেলে।”
গুরুত্ব দিলো না শান্তনু এসব কথার। পূনরায় জানতে চাইলো,
-“ খতিব সরোয়ারকে বিয়ে করেছেন কেনো? প্রতিশোধ নিতে?”
-“ জব্বার ভাই জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন তার সাথে। আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্যকে বিয়ে করার দায়ে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন তাদের পরিবারে। একজন নেইতো কি হয়েছে। তার বিনিময়ে অন্যজন, এটাই ভাইজানের চাওয়া ছিলো।”
শান্তনু চোয়াল শক্ত করে বললো, -“চাওয়া ছিলো না সেটি। আপনার,হেমার এবং খতিব সাহেবের জীবন নষ্ট করার ইচ্ছে ছিলো তার। বুঝেননি কেনো?”
ফরিদা বেগম জবাবে বললেন, -“ সেই সময় কি করবো বুঝে উঠতে পারিনি। দুঃখটুকু অনেক বেশি ছিলো।”
-“সেটি দুঃখের আদলে তৈরি হওয়া ক্রোধ,হিংস্রতা।”
ফরিদা বেগম কাতর কণ্ঠে বললেন, “আমি সেই সময় মেনে নিতে পারিনি। পাগলপ্রায় হয়েছিলাম। খায়রুল সাহেব আমার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন। সেই ক্ষমায় আমার মন গলেনি। আমার ভাই আমার এই অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেনি। ধীরেধীরে আক্রোশের মাত্রা বেড়েছে।”
-“আর হেমাকে বারবার ওর বাবা মায়ের বীভৎস মৃত্যুর দৃশ্য দেখানো?সেটি?”
অনুশোচনা এবং অপরাধবোধ ভুল সময়ে আসলে সেটি গ্রাহ্য করা হয়না। ফরিদা বেগমের উভয়েই এসেছে ভুল সময়ে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,
-“আমি করেছি”
-“আর এখন দয়ালু সাঁজছেন? আসলে আপনারা ভাই বোন একই রকম। দুজনেই অপরাধী, খুনী”
-“আমার ভাইকে ছেড়ে দিন। তার সংসার আছে। আমার আর অবশিষ্ট কিছু নেই!আমার স্বামী কোনোদিন ফিরবে না। আমার ছেলেও সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিশোধের শুরু আমার থেকে হয়েছে। আমাকেই নাহয় শাস্তি দিন।”
শান্তনু ফের হাসলো। এখানে আরও ঘটনা আছে। হেসে বললো,
-“শুধু আপনার সাথে প্রতারণাই কারণ নয়। আপনার ভাই সরোয়ার ব্রাদার্স দখল করতে চেয়েছিলেন। কারণ তার ব্যবসা এখন নিঃশেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। আপনার স্বামী মারা যাওয়ার সাথে সাথে হয়তো নিয়েও নিতেন। পারেননি আমাদের কারণে।এত বছর সংসার করেও নিজেকে স্থির করতে পারলেন না। এতদিন প্রতিশোধের আগুন পুষে রেখেছেন?…বোনের প্রতি প্রেম আর টাকার লালসা আপনাদের নৌকা ডোবালো। সাথে একটি নির্দোষ মেয়ের জীবন নষ্ট করলো।”
-“হেমা এখনতো ভালো আছে, তাহলে?”
-“আবার তাহলে জানতে চাইছেন মিসেস সরোয়ার?আপনি কি সাইকো?”
ফরিদা বেগম খানিক উত্তেজিত হয়ে বলেন,
-“আমার মাথা কাজ করতো না তখন। আমাকে ডাক্তার ঔষধ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। আমি অতীতের কথা ভেবে উন্মাদ হয়ে উঠতাম। আর সেই রাগ হেমার উপর দিয়ে তুলতাম। স্বীকার করছি আমি! স্বীকার করছি!”
জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছেন ফরিদা বেগম। অস্থির হয়ে উঠেছেন। শান্তনু বুঝতে পারলো হেমার চেয়ে বেশি মানসিক সমস্যা আছে এই মহিলার। ছোটোখাটো একটি বিষয় কতগুলো মানুষের জীবন নষ্ট করলো। শান্তনু মহিলা কনস্টেবল ডাকলো। বললো,
-“নিজেই আত্মসমর্পণ করেছে। নিয়ে যান ওনাকে।”
ফরিদা বেগম চমকে উঠেন হঠাৎ করে। হুট করেই মনে হলো কাজটা কি সে ঠিক করেছে? ভুল করলো নাতো কোনো। আবারো পাগল পাগল লাগছে তার। ছটফট শুরু করলেন দাঁড়িয়ে থেকেই। হুট করেই আওয়াজ করে কান্না শুরু করেন। শান্তনু বললো,
-“আর লাভ নেই… পাপ বাপকেও ছাড়েনা।”
_______
বাড়ি, থানা আর হাসপাতাল এই ত্রিকোণ জীবনের স্রোতে ভাসছে মাশুক।আচমকা থেমে যায়,মস্তিষ্কের তারে জড়িয়ে আসে সবকিছু। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পূনরায় শুরু থেকে শুরু করতে ইচ্ছে হয়। সেমিনারে যাওয়ার পূর্বে কিছু সময় একান্তে মেডিটেশন করেছে মাশুক। যেখানে যাচ্ছে সেখানে আরো ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।
আজ ‘লাইফ কেয়ার’ হাসপাতালে ক্যান্সার রোগীদের মনোবল দৃঢ় করার জন্য এই আয়োজন। রোগের বিষ শরীর থেকে মস্তিষ্কের স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ে, আস্তে আস্তে নিঃশেষ করে বেঁচে থাকার উদ্যম। প্রাণঘাতী রোগের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার ক্ষুদ্র আশা জাগাতে সাত জনের এক অভিজ্ঞ টিম হাজির হয়েছে। সাথে মাশুকও। রোগীদের চেকআপ, ফাইল স্টাডি এবং পরামর্শ শেষে একে একে বক্তব্য রাখছেন তারা।
মাশুক স্বল্পভাষী, আয়তনে ছোট অথচ গভীরে প্রখর। মৃদু কণ্ঠে স্পিচ রাখলো,
-“মন আর মস্তিষ্কের দৃঢ়তায় যদি একদিন বেশি বাঁচা যায়, তবে ক্ষতি কি? একদিন অতিরিক্ত এই পৃথিবীর মুখ দেখার শান্তি অমুল্য। আমি বলবো, শরীর আর মস্তিষ্ক একে অপরের সাথে সেতুবন্ধ। যখন এই ভাবনা ছেড়ে দিবেন যে আপনার কোনো রোগ রয়েছে, সেই দিনই রোগ ১০ শতাংশ সেরে যায়। মনকে রোগের চিন্তামুক্ত করুন, জীবনও মুক্তির পথে হাঁটবে। থ্যাঙ্ক ইউ।”
মাশুকের গম্ভীর সুরে বক্তব্য গোটা অডিটরিয়ামে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। ডক্টর মননের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো নীল শার্ট পরা সেই ব্যক্তির উপর। চঞ্চল মনে একবার চাইলো মঞ্চের দিকে, ভাবলো কিছু একটা। তখনই অতিথি কক্ষে লাঞ্চ ব্রেকের ডাক পড়ে। মনন চিন্তার স্রোত থামিয়ে সে চলে গেলো প্রস্তুতি দেখতে।
টুকটাক আলোচনা আর খাওয়া দাওয়া শেষে একে একে সকলেই বেরিয়ে পড়ে গেস্ট রুম থেকে। মাশুক তার ব্যাগ আর এপ্রোন হাতে ঝুলিয়ে এসে দাঁড়ায় ভাবনায় মগ্ন মননের দিকে। হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“আপনাকে বোধহয় চিনি, আর আপনি আমায় চিনবার চেষ্টা করছেন।”
মনন হাত এগিয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে। বলে,
-“ আর. বি কলেজ? ”
মাশুক মৃদু হেসে জবাব দিলো,
-“অষ্টম ব্যাচ”
মননের মস্তিষ্কে হঠাৎই স্মৃতির আলোড়ন জাগল। এই কারণে লোকটিকে এতটা পরিচিত লাগছিল! ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে স্মিত স্বরে বললো,
– “মাশুক মৃধা! আমার সামনের সিটেই সবসময় বসতে তুমি। ক্লাসে তোমার উপস্থিতিও শব্দহীন ছিলো। এতকাল পর তোমাকে চিনতে ভুল করলাম কেমন করে?”
মাশুক জবাব দেয়, -“আমি ভুল করিনি।”
মনন মাথা দুলিয়ে বললো,
– “সেটা করার কথাও নয়। তোমার অবজার্ভেশন পাওয়ার সেই সময় থেকেই অনেকটা হাই। পারফেক্ট প্রফেশন, যাচ্ছে তোমার সাথে।”
-“হুম”
দুজনেই হাঁটলো করিডোরের দিকে। আলাপ চলছে। মনন প্রশ্ন করে,
-“কি চলছে আজকাল জীবনে?”
-“চলছে.. হাসপাতাল,বাড়ি,সংসার আবার হাসপাতাল।”
মনন থামলো। মাশুকের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চাইলো,
-“সংসার?”
-“ইয়েস! আ’ম ম্যারিড।”
আশ্চর্যের কিছু নয়! বিয়ের জন্য আদর্শ সময় এবং বয়স।কলেজের দিনগুলোয় অনেকেই খেলতো অনুমানের খেলা, ‘কে হবে সবার আগে গাঁটছড়া বাঁধা মানুষ?’ সেই সময়টায় কোথাও কোনো চাপ ছিলোনা আর না-ই ব্যস্ততা! সব ছিল যেন নির্মল কৌতুকে ভরা, চিন্তাবিহীন এক মুক্ত জীবন।
মনন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চেয়েও আটকে গেলো। মাশুক বলে উঠে,
-“কিছু জানতে চাইছো?”
মনন বললো, – “থাক! ব্যক্তিগত প্রশ্ন।”
-“ব্যক্তিগত বিষয় আমিই প্রকাশ করেছি। কিছু প্রশ্ন করা যেতেই পারে।”
মনন হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বললো,
-“ একটা পেশেন্টকে ভিজিট করতে হবে আমার। কিছুক্ষণ লাগবে। ওকে ভিজিট করে না-হয় বাকি আলাপটা কন্টিনিউ করি। তুমিও আমার সাথে আসতে পারো। “
মাশুক সম্মতি দিলো। পেশেন্ট ভিজিট শেষে তেরো তলার সুবিশাল করিডোর পেরোচ্ছে দু’জন একসঙ্গে। মনন প্রশ্ন করলো,
-“তোমার ওয়াইফ আর তুমি কি একই প্রফেশনে?”
কিছুক্ষণের জন্য মাশুক গভীর নীরবতায় ডুবে রইল। পেশার প্রশ্নে চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ এনে একটুখানি হেসে বলল,
– “আমি ডাক্তার আর সে আমার ব্যক্তিগত পেশেন্ট”
মনন মাশুকের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
-“ঠাট্টা করলে?”
-“আমার মুখ দেখে মনে হয় ঠাট্টা করছি?”
-“হাসছো যে?”
-“হাসছি… হুম, অনেকদিন পর পুরোনো মানুষের দেখা পেয়ে ভালো লাগছে তাই। তাছাড়া আমি ঠাট্টা করিনি। আসলেই আমার স্ত্রী আমার পেশেন্ট।”
মননের কফি ঠান্ডা হওয়ার পর্যায়ে। খানিক আগ্রহ জাগলো তার মনে। কথাগুলো স্পষ্ট নয়। ঠিক আগের মতোই। মনন প্রশ্ন করে,
-“মানে?”
-“ মানে সহজ। আমার স্ত্রী হেমা আর পাঁচজন নারীর মতো নয়। শি ইজ ডিফারেন্ট… স্পেশাল…”
শেষ শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে কন্ঠস্বর নিচু হয়ে আসে মাশুকের। মনন শুনলো, কিন্তু সেখানে তেমন গুরুত্ব প্রয়োগ করলো না। যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। হেসে জবাব দিলো,
-“শি মাস্ট বি লাকি টু হ্যাভ ইউ।”
আলাপ ধীরে ধীরে গভীরতায় প্রবেশ করে, আর মাশুকের মনে হয় এই স্থান ও ব্যক্তিটি যেন তার নিঃশব্দ কথাগুলোর নিখুঁত শ্রোতা। একবার মনে হয়, যদি কিছুটা হলেও মনের গহন ভার লাঘব করা যায়? নিজের জীবনের বিশেষ গল্পটুকু অল্প শব্দে বলেছে মাশুক। মনন সবটা শুনে জবাব দিলো,
-“আশা করিনি তুমি নিজের ব্যাপারে এতটা শেয়ার করবে। আর তুমি যা করেছো খুব ভালো করেছো।”
মাশুক জবাব দিলো,
-“কথা বলার মানুষ খুঁজছিলাম। পেয়ে গেলাম, তাই বললাম”
তেরো তলার অসংখ্য ক্যাবিন পেরিয়ে হঠাৎ করেই ১৩০৭ নম্বর কেবিনের সামনে মননের কদম থেমে যায়। স্থির দৃষ্টিতে বন্ধ ক্যাবিনের দরজার দিকে চেয়ে রইলো। মোহর ক্যাবিন এটা,সেদিন বলেছিলো। মনে পড়লো সেদিনের তার রূঢ় ব্যবহারের কথা।মেয়েটিকে সেদিনের পর আর দেখা যায়নি।
মাশুক কিছুটা এগিয়েও থমকে দাঁড়ায় মননের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে অবশেষে ধীরস্বরে বলে ওঠে,
-“তেরো তলার এতগুলো ক্যাবিন পেরিয়ে এসে ঠিক ১৩০৭ নম্বরে থেমে যাওয়ার কি বিশেষ কোনো কারণ আছে, ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন?”
চলবে….