#হিমাদ্রিণী – ২১
লেখনীতে – আয্যাহ সূচনা
‘অনুরাগ’ যেন এক অমোঘ মনোব্যাধি।গ্রাস করে,কখনও সর্বনাশ করে। পৃথিবীতে থাকা প্রতিটি জীবের মাঝেই হয়তো প্রতিফলিত হয় এই অনুরাগের। যার সঠিক নিরাময় মনে হয়না আজ অব্দি কোনো মনোচিকিৎসকের সাধ্যের মধ্যে পড়েছে। হাসি,কান্না,বিষাদ সবকিছু আছে এতে। এক অনিশ্চিত অনুভূতি।কখনও গাঢ়,আবার কখনও ক্ষীণ। মাতোয়ারা করতে সর্বদা প্রস্তুত আবার দিশেহারা বিষন্নতায় ঢেকে ফেলে।
তিনদিনের বিরতি শেষে মাশুকের সর্বদা বিরস থাকা মুখে সামান্য হাসি উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছে। কঠিন আবরণে থাকা থাকতো এই মুখমণ্ডল। অজান্তেই মানুষ তাকে রাগী হিসেবে আখ্যা দিতো। এখন ভিন্ন পুরোপুরি। প্রতিদিনকার মতোই তার চেম্বারে প্রবেশ করল এক নিয়মিত রোগী। মাশুকের চেহারায় অন্যরকম জ্যোতি দেখে প্রশ্ন করেই বসলো,
-“স্যার, আপনাকে আজকাল বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে।”
প্রেসক্রিপশন নতুন করে লিখছিলো মাশুক। এই রোগী দীর্ঘদিন বিষন্নতায় ভুগছিলো। উন্নতি হয়েছে ব্যাপক। পূর্বের সমস্ত ঔষধ বাতিল করে নতুন ঔষধ লিখলো, পরিমাণও কমিয়ে এনেছে। তার প্রশ্নের জবাবে চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটো তুলে স্বাভাবিক স্বরেই প্রশ্ন করে,
-“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
রোগীটি বললো, -“দুঃখিত,আপনি কিছু মনে করছেন নাতো?”
মাশুক প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দেয়। চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো,
-“নাহ কিছু মনে করিনি। আপনি আপনার মনের কথা বলুন। এভাবে চেপে রাখলে আবার আগের পর্যায়ে চলে যাবেন। মনে যা আছে বলে ফেলবেন।”
তিনি হাসি মুখেই প্রশ্ন করেন, -“বিশেষ কোনো কারণ আছে স্যার?”
মাশুক খানিক নড়েচড়ে বসে। বিশেষ কারণ অবশ্যই,সেটি বিশেষ মানুষও বটে। তবে পেশেন্টের সাথে কি এত আলাপ করা যায়। অগত্যা মাশুক বললো,
-“ এইযে আপনি নিজের পাশাপাশি অন্যের মুখ পড়তে পারছেন, কি সাঙ্ঘাতিক পরিবর্তন আপনার মাঝে লক্ষ্য করেছেন? অথচ মাস দেড়েক আগে আপনি নিজেকেই বুঝতে পারছিলেন না। মনের মাঝে কথা জমতে থাকলে, সেটি শোনার কেউ না থাকলে আরো চাপ বাড়ে। পরিণতি এই সমস্ত মানসিক রোগ। তাই বলুন”
মাশুকের কথার বিপরীতে সে মুচকি হাসলো। কথা সত্য,এতটাই ডুবে ছিলো বিষন্নতায় নিজেকে অচেনা মনে হতো। মাশুক বলে,
-“কারণ অবশ্যই আছে। আর হ্যাঁ পূর্বে এই কারণটা ছিলো না বলেই হয়তো আমার মুখে বিনা কারণে আঁধার দেখতে পেতেন। ধন্যবাদ ওই কারণকে, আজকাল আমাকে উৎফুল্ল দেখে আমার পেশেন্টরাও খুশি।”
-“ভীষণ স্যার, আপনার মত একজন মানুষের মুখে গম্ভীরতা মানায় না।”
মাশুক নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠে, -“আমাদেরকে গিরগিটির মত রূপ বদলাতে হয়। মনের রোগ যখন মাথায় চড়ে বসে তখন আমাদের বাধ্য হয়ে কঠোর হতে হয়। এটাও চিকিৎসার একটা অংশ বলতে পারেন। আপনাকে বোঝাতে গিয়ে বারবার আমি রুড বিহেভ করেছি, তার জন্য ক্ষমা চাইছি।”
হন্তদন্ত গলায় জবাব এলো, -“এভাবে বলবেন না স্যার! আপনার রাগটাই বোধহয় আমাকে ওই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছে। আপনি বারবার আমাকে আয়না দেখিয়েছেন।”
-“জীবন মূল্যবান, আপনি জীবনের প্রতি অন্যায় অবিচার করার অধিকার রাখেন না। সবকিছু দাড়ি পাল্লায় মাপা যায় না। জীবনের মূল্য আদায় সম্ভব নয় আপনার আমার মত মানুষের দ্বারা। তাই এসব বিষন্নতা থেকে দূরে রাখুন নিজেকে। সুস্থ থাকুন।”
হেমা ও মাশুক ফিরে এসেছে বিশ দিন হলো। দুজনের একসঙ্গে কাটানো সময় খুব বেশি ছিল না, মাশুক তার কাজের প্রতি উদাসীন হতে পারে না। দীর্ঘ সময়ের জন্য কোথাও যাওয়াও দায়, কখন কোথায় ডাক পড়ে বলা যায় না। তবে যতটুকু সময় তারা একাকী কাটিয়েছে, তাতে মাশুক তার সাধ্যমতো হেমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সেই দুটো দিন যেনো তাদের জীবনে জাদুমন্ত্রী মতো কাজ করেছে। এখন হেমার পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। মেয়েটি প্রতিনিয়ত মাশুকের বুকে আশা জাগিয়ে যাচ্ছে। একটি সুস্থ সংসারের, যেখানে মাশুকের না বলা কথাগুলোও ফেলবে তার হিমাদ্রিণী।
মাশুক শান্তনুর নাম্বারে কল করলো এবং বললো,
-“ আজ লয়ারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট,মনে আছে?”
শান্তনু ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বলে, -“আসামীদের পক্ষেও লয়ার আছে।সিরিয়াসলি? আমি অবাক হচ্ছি শুধু!”
-“হুম! মনে হচ্ছে খতিব সাহেবের ছেলে হায়ার করেছে।”
-“ওই পুঁচকে?”
-“হতে পারে। যাই হোক, লয়ার হায়ার করুক আর জাজ। সবকিছুর প্রমাণ আছে,আর কি চাই?”
মানিব্যাগ থেকে লয়ারের কার্ড বের করলো মাশুক। এখানে এড্রেস আছে। এড্রেস নোট করে মানিব্যাগের এককোণে হেমার ছবি দেখে অর্ধ চাঁদের মত বাঁকা হাসলো। বৃদ্ধাঙ্গুল ছোঁয়ায় ছবিতে। বিড়বিড় করে বলে উঠে,
-“দীর্ঘশ্বাস আমার….”
_____
সন্ধ্যার ঝুম বৃষ্টির শব্দ এতটাই জোরালো যে হেমার মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে একটি উপন্যাস পড়ছে। বড় বড় চোখে একবার জানালার কাঁচে আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর দিকে তাকালো। হেমার আসলে বৃষ্টির পরের সময়টাই বেশি ভালো লাগে। সে ভাবলো, বৃষ্টি শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে।টিভিতে গান হচ্ছে, ‘ এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনাতো মন….’ ।আপাতত প্রিয় গান শুনতে শুনতে বইয়ের পাতা ওলটানো যাক।
দরজায় এসে দাঁড়ালো খায়রুল সরোয়ার। বললেন,
-“ব্যস্ত?”
হেমা চোখ তুলে চায়। বলে,
-“বাবাই? কখন এলে?”
খায়রুল সরোয়ার হাঁটু গুঁজে বসে বললেন,
-“মাত্রই এলাম। তুমি কি ব্যস্ত আম্মা?”
হেমা বই বন্ধ করে। কান থেকে হেডফোন সরিয়ে বাবার দিকে ঘুরে বসলো। এই মানুষটার জন্য তার সব ব্যস্ততা নিষিদ্ধ। জানা নেই পৃথিবীতে এতটা কেউ তার বাবা মাকে ভালোবাসে কিনা? হেমার কাছে মনে হয় তার ভালোবাসা সবার ঊর্ধ্বে। বাবার প্রশ্নের জবাবে বলে উঠে,
-“ হ্যাঁ ব্যস্ত, কিন্ত তোমার জন্য ব্যস্ততাকে ছুটি দিলাম।”
খায়রুল সরোয়ার সময় নিলেন না। দ্রুত মেয়ের কপালে চুমু খান। বলেন,
-“তুমি এমনেই আমার জান। এসব কথা বলে আরো ভালোবাসা গাঢ় করো। বিয়ে দিলে কি করে বাঁচবো আমি?”
হেমা জবাব দিলো, -“বাবাই আমি আর তোমার মেয়ে জামাই মিলে একটা ঘর বানাবো,ওকে? সেখানে তিনটা ঘর থাকবে। একটা আমাদের, একটা আমার বাবা মায়ের আরেকটা তার বাবা মায়ের। এবার হলো তো?”
খায়রুল সরোয়ার শব্দ করে হাসেন। বলেন, -“ভালো আইডিয়া!”
বাবা মেয়ের হাসির ঝংকার ঘর পেরিয়ে বেরোলো। নাসিমা বেগম পাকোড়া ভাজতে ভাজতে হঠাৎ হেমার ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে তাকালেন।বৃষ্টির মিষ্টি সন্ধ্যায় তিনি স্বামীর আবদার রাখতে এই বিশেষ আয়োজন করছেন। পাকোড়া ভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এক হাত থেকে পাকোড়া তুলে পাশে রেখে খিচুড়ির হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখলেন সব ঠিক আছে কিনা। বৃষ্টির দিনে এমন খাবারের আয়োজন শুধু স্বামীর খুশির জন্যই নয়, এতে হেমাও আনন্দ পাবে। ঘরভর্তি এই উষ্ণ পরিবেশে যেন পরিবারের সকলের মুখে হাসি দেখতে কোন গিন্নীর না ভালো লাগে?
টিস্যু পেপার দিয়ে ভালোভাবে অতিরিক্ত তেল ঝরিয়ে নিয়ে নাসিমা বেগম এগোলেন হেমার ঘরের দিকে।বললেন,
-“পাকোড়া ভেজেছি,দ্রুত এসো।”
হেমা একলাফে কার্পেটের উপরে এসে বসে। সাথে ধীরেসুস্থে উঠে এলেন খায়রুল সরোয়ারও। দুয়েক পিস পাকোড়া আর তিনজনের আড্ডা। তার মাঝেই ফোন বাজলো। খায়রুল সরোয়ারের মুখে চিন্তার ছাপ এসে পড়ে। বিরক্ত হয়ে বললেন,
-“লোকটাকে বুঝিয়ে আর পারলাম না!”
হেমা প্রশ্ন করলো, -“কি হয়েছে বাবা?”
খায়রুল সরোয়ার জবাব দিলেন, -“নাহ কিছুনা। তুমি খাও”
বলে হেমার মুখে পাকোড়া পুরে দিলেন। তেরো বছর বয়সী মেয়েটা তার। দুরন্ত চঞ্চল। হাসি এই দুই ঠোঁটে লেগেই থাকে। খায়রুল সরোয়ার দেখলেন,হাসলেন আনমনে। একবার ঋণের বোঝা নামলে মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন। এবার স্কুল বন্ধের পরও যে কোথাও যেতে পারলো না। মন খারাপ করেছে ভীষণ। তবুও মুখ ফুটে বলেনি। মেয়েরা বুঝি অল্প বয়স থেকেই এত বুঝদার হয়? বাবার মুখের দিকে চেয়ে এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে ঘুরবার পরিকল্পনাও মাটি চাপা দিয়েছে।
হুট করেই খায়রুল সরোয়ার বলেন, -“ এবার গ্রীষ্মে নয় শীতে ঘুরতে যাবো কেমন?”
হেমা ঠোঁট কামড়ে উচ্ছ্বাসভরা নেত্রে তাকালো। এইতো মন বলছিলো,সব বন্ধুরা ঘুরতে গেলো শুধু সেই একা রয়ে গেছে। ইচ্ছেটার কথা বাবা জানলো কি করে,
-“বাবাই তুমি কি মন পড়তে জানো?”
খায়রুল সরোয়ার প্রশ্ন করলেন, -“ কেনো মা?”
-“গ্রীষ্মের ছুটিতে ঘুরতে না যাওয়ার কারণে মাত্রই তো মন খারাপ হতে যাচ্ছিলো। আর তুমি শীতে ঘুরতে যাওয়ার কথা বললে।”
বারবার কেনো আজ এই আহ্লাদী মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে? প্রতিদিন দেখে। রাতে এসেও দেখে যায়। আজ এই দৃষ্টিতে অন্যদিনের চেয়ে বেশি মায়া কাজ করছে। ভাবছেন, এর বিয়ের পর কি হবে? লোকটা ভালো রাখবে তাকে? যত্ন নিবে? অবহেলায় ফেলে রাখবে নাতো তার এই প্রিয় ফুলকে। কে জানে?
দরজায় বিকট করাঘাত পড়লো। বৃষ্টির আওয়াজের সাথে মিশে হেমার ঘর অব্দি এসেছে। তিনজনই একে অপরের দিকে চাইলো। খায়রুল সরোয়ার দুজনকে বসতে বলে উঠে গেলেন। দরজা না খুলেই প্রশ্ন করলেন,
-“কে?”
অপরপাশ থেকে জবাব এলো, -“ মিটার চেক করতে এসেছি দরজা খুলেন।”
সন্দেহ হলো খায়রুল সরোয়ারের। এই ঝুম বৃষ্টিতে,রাতের বেলায় মিটার চেক? ভেবে চিন্তে দরজা খুললেন। সাথে সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে পেছনে জমিনে লুটিয়ে পড়েন। সামনেই পাঁচ ছয়জন লোক। হাতে ছু রি আর হকিস্টিক। আঘাত করলো পাঁজরে একজন। সময়টুকু দিলো না। নাসিমা বেগম আন্দাজ করে ফেলেন সাথে সাথে। লাইট নিভিয়ে বিস্ময়ের সাথে থম মেরে থাকা হেমাকে আলমারির ভেতরে তুলে ঠেলে দিলেন। উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,
-“খারাপ লোকেরা এসেছে। বের হবি না! একদম বের হবি না। যত যাই হোক। হেমা মনে থাকে যেনো!”
-“মা! মা! ওরা বাবাকে মেরেছে! আমার বাবাকে মেরেছে।”
-“হেমা! এখানে থাক মা। দোহায় লাগে। তুই বের হলে তোকেও মেরে ফেলবে।”
হেমা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলে উঠে নাসিমা বেগমের হাত ধরে, -“মা, মা তুমি যেও না। তোমাকেও মারবে ওরা।”
নাসিমা সরোয়ার মেয়ের গালে হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন,
-“তোর বাবাকে বাঁচাতে যাবো।হাত ছেড়ে এখানে চুপচাপ থাক। বের হবি না। তোকে তোর বাবার দিব্যি।”
বাহিরে চেঁচামেচির আওয়াজ। ভরকিত চোখে চাইলো হেমা। নাসিমা সরোয়ারও। ফিরে কান্নারত চোখে মেয়ের ভীত মুখের দিকে চেয়ে বললেন,
-“তুই থাক,তুই বেঁচে থাক। আমাদের মত তোকে যেনো আঘাত পেতে না হয়। লড়াই করে হলেও বেঁচে থাক!”
হাত ছাড়িয়ে চলে গেলেন নাসিমা বেগম। হেমার গলার স্বর আটকে এলো। ডাকতে চাইলো,
-“ম.. মা”
ঘরের বাতি বন্ধ হতে দেখে একজন ঘরে এলো।নাসিমা বেগমের চুল টানতে টানতে ডাইনিং টেবিলে ছুঁড়ে দিলো। হেমার বের হতে চায় তখনই ছু। রির আঘাত খায়রুল সরোয়ারের পেটে ঢুকতে দেখে। রক্ত দেখে নিঃশ্বাস আটকে গেলো হেমার। চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু শব্দ বেরোলো না। নিজের গলা চেপে ধরলো। হাত পা অবশ। পুরোনো রোগ ঝেঁকে বসেছে। অতিরিক্ত ভয় পেলে সে সম্পুর্ণ জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। পরপরই ছু রি চললো নাসিমা বেগমের উপর।একজনের দেহ নিথর,আরেকজন মৃদু কাপছেন। কয়েকজন পাষন্ড ঘুরাফেরা করছে পুরো বাড়ি জুড়ে। চুলোয় বসানো খিচুড়ি পুড়ে যাচ্ছে। ঘরের জমিনে অর্ধ খাওয়া পাকোড়াগুলো। সাদা জমিনে রক্ত,শুধুই রক্ত। সাথেসাথে হেমার নিঃশ্বাস ক্ষীণ হয়ে উঠে,অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
দম আটকে ছিলো এতটা সময়। রসগোল্লার ন্যায় চোখজোড়া খোলা। নিঃশ্বাস আটকে আছে, হাত পা আসাড়। কয়েক সেকেন্ড পেরোয়,কয়েক মিনিট। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাসের ঝাপটা পড়তেই নিঃশ্বাস ছেড়ে দেয় হেমা। পেটের দিকে এক পুরুষালি হাত দেখলো। চোখ ঘুরিয়ে মাশুকের ঘুমন্ত মুখ। আরো কিছুক্ষন চেয়ে রইলো এই নীরব ঘনিষ্ঠ মুখে।
আওড়ায়, -“স্বপ্ন… ওই খারাপ স্বপ্নটা…”
বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝে গণ্ডগোল আর হচ্ছেনা। এতদিন যা অস্পষ্ট ভাসতো, সেই অস্পষ্টতা কেটে গেছে। আবারও সেদিনের মতো সব পরিষ্কার। যা দেখেছে, যা সহ্য করেছে। নিঃশেষ করা হয়েছে তার বাবা-মা’কে তার চোখের সামনে। কিছুই করতে পারেনি হেমা।
ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতটায়। দিনের আলো ফুটেছে। দেয়ালে টাঙানো সাদা কালো ঘড়িটাও স্পষ্ট। হেমা যেখানেই তাকাচ্ছে সেখানেই চোখ স্থির হয়ে যাচ্ছে কিছু সময়ের জন্য। ফের কিছু সময় অতিবাহিত করে মাশুকের দিকে তাকালো। আপনাআপনি হাত চলে গেলো তার গালে। ধীরে ধীরে কয়েকবার হাত বুলায়,
-“কি আদুরে লাগছে তোমায়…”
বলে ঠোঁট চেপে নেয়। ঢোক গিলে বড় বড় দৃষ্টিতে চেয়ে। লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেললো। উঠে দাঁড়ায়।একবার দরজার দিকে চেয়ে আরেকবার মাশুকের দিকে চোখ যায়। কদম এগিয়েও ফিরিয়ে নিলো হেমা। সামান্য ঝুকলো মাশুকের দিকে। আবেশে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় গালে। বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন এই মানুষটাকে চেনে হেমা। খুব খুব চেনে। স্বপ্নে যা এসেছিলো সেটি তার অতীত, আর এই মানুষটা তার বর্তমান। আজ হিসাবে গরমিল হয়নি। অসুবিধে হয়নি বুঝতে। পাগলামো করতে ইচ্ছে হয়নি। নিজের মাঝে এক অদ্ভুত শক্তির উৎস পেলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে খুব ভালোমতই বুঝলো হেমা।
ভারি নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে কদম ফেলে বাহিরে। নিজের ঘর পেরিয়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো। অতীত,বর্তমানের অংকতো মিললো, কিন্তু ভবিষ্যৎ?
-“আর কোনো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতে যে ঘুরতে যাওয়া হলো না…”
চলবে….