শেহরোজ পর্ব-১১

0
376

#শেহরোজ — ১১
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

রমনা পার্ক, সকাল ৮ টা।
দৌড়াতে থাকা, ব্যায়াম করতে থাকা স্বাস্থ্য সচেতন নানা বয়সী কিছু মানুষের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করে ছুটছে এক বিশাল বপুর যুবক। কজন পুরুষের মাঝে ইতোমধ্যে তাকে ঘিরে আলোচনাও চলছে — যুবকটির ছয় ফিটের ওপরে দীর্ঘ উচ্চতা , শৌর্যশালী শরীর , তার দৌড়ানোর ক্ষিপ্রগতি দেখে।

এ যুবককে আগে কখনো দেখেনি তারা৷ কী পরিচয় তার? চুল দাড়ির ভঙ্গিমা দেখে তো মনে হয় না কোনো সামরিক পেশায় নিযুক্ত। অথচ মনে হয় চাঁচাছোলা চোয়ালের তার গম্ভীর মুখটা প্রভুত্বব্যঞ্জক ব্যক্তিত্ব বহন করছে। যে কেবল আদেশ প্রদানেই অভ্যস্ত এবং নেতৃত্ব বহনেই স্বীকৃত।

দৌড়ে এসে থামল যুবক লেকের কাছে। ঠিক সে সময়ই লম্বাচওড়া ভুড়ি নিয়ে এক মধ্যবয়সী লোক এসে দাঁড়াল যুবকের থেকে হাত তিনেক দূরত্বে। দু হাত সে এদিক ওদিক ছুঁড়ে ব্যায়াম করতে করতে তাকে লক্ষ করল কয়েক সেকেন্ড। তারপর গলায় নকল কাশি তুলল যুবকের মনোযোগ আকর্ষণেন জন্য৷ জুতার ফিতে বাঁধতে বসেছিল যুবক৷ বিচ্ছিরি এক কাশির আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকালে লোকটি হেসে “গুড মর্নিং” জানাল। বিনয়ী হেসে যুবকও জবাব দিলো। তখন জিজ্ঞেস করল লোকটি, “কী নাম তোমার?”

“শেহরোজ আহমাদ।” বলে দাঁড়িয়ে পড়ল শেহরোজ।

“চমৎকার নাম।”

“থ্যাঙ্কস।”

“আমি ইব্রাহীম খলীল। এখানে রোজই আসি। কিন্তু তোমাকে তো দেখিনি আগে৷ আজই দেখলাম। তাই একটু আলাপ করতে এলাম।”

“খুব ভালো করেছেন। আমি আমেরিকান প্রবাসী ছিলাম। মাস চারেকের মতো দেশে এসেছি।”

“ও আচ্ছা আচ্ছা। পড়াশোনা করতে ওখানে?”

“হ্যাঁ।”

“এখন কী করছ?”

“এখনো পড়াশোনায় করছি।”

“অ্যা!” বিভ্রান্ত হলো সে।

হাসল শেহরোজ, “আমার ফ্যামিলি এখানে সেটেল্ড হচ্ছে। বাকি পড়াশোনা তাই এখানেই করতে হচ্ছে আমাকে।”

“ওওও… কিন্তু তুমি তো হাইয়ার স্টাডি কমপ্লিট করে আসতে পারতে?”

“ভাগ্যে হলো না। কী আর করা!”

“আসলেই৷ ভাগ্যই বড়ো ব্যাপার। আমার ছেলেটা স্কলারশিপ নিয়ে গেছিল। আলহামদুলিল্লাহ কম্পিউটার সায়েন্সে ডক্টরেট নিয়ে ফিরেছে।”

“আলহামদুলিল্লাহ। ভালো জবহোল্ডার নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। দারুণ একটা জব পেয়েছে নামকরা সফটওয়্যার কোম্পানিতে।” বিগলিত হেসে বলতে বলতে হঠাৎই কাউকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “আরে ওই তো আমার ছেলে!”

শেহরোজ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে ঘুরল৷ শ্যাম বর্ণের সুঠাম দেহের একটি ছেলে দৌড়ে আসছে এদিকেই। লোকটি সেদিকে চেয়ে হাসতে হাসতে জানাল শেহরোজকে, “এই ছেলের পাল্লায় পড়েই আমাকে রোজ সকালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।”

ছেলেটি বাবার কাছে এসেই থামল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “তুমি দেখি আজ আমার আগে পৌঁছে গেছ এখানে।”

“হে হে। তোর আগে আজ ঘুম থেকে জেগেছি না?” বলে শেহরোজকে দেখিয়ে বলল, “ওর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। ওর নাম শেহরোজ।”

সৌজন্য রক্ষার্থে করমর্দনের জন্য হাত বাড়াল ছেলেটি, “আমি আকাশ। কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?” হাতটা ধরে মৃদু ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল শেহরোজ।

“জি, আলহামদুলিল্লাহ।”

“তো ঠিক আছে, শেহরোজ৷” বললেন মধ্যবয়সী, “আজ আসি তাহলে। আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ, ইনশা আল্লাহ আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

রমনা থেকে বেরিয়ে এলো শেহরোজও৷ আশেপাশে ভালোভাবে নজর বুলিয়ে বাইপাসে উঠল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সামনে ফাঁকা সিএনজি দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। চালক বসে বিড়ি টানছে। জিজ্ঞেস করল তাকে, “গুলিস্তান যাবেন নাকি, মামা?”

“যামু, মামা। উইডা পড়েন।”

“ভাড়া মিটমাট করেন আগে।”

“সকালের পথম প্যাসেঞ্জার পাইলাম, মামা। বেশি নিমু না, উডেন।”

ভেতরে ঢুকে পড়ল শেহরোজ। সিএনজি চলতে আরম্ভ করলে হাতের মধ্যে ভাঁজ করা ছোট্ট চিরকুটটা খুলল সে। তাতে বাংলাতে লেখা ,

“দক্ষিণের হাওয়ায়
তোমার কোলে কাটাই
তুমি ফিসফিস সুরে বলো
চলো শুক্রগ্রহে হারাই
আমি শুধাই – তা কোথায়?
তোমার উত্তর- বুকের সীমানায়”

চিরকুটের লেখাটা দেখেই গাল ফুলিয়ে বাতাস ছাড়ল শেহরোজ। চালক সিএনজির আয়নাতে দেখল ওর বিরক্তিকর অভিব্যক্তি। মিটিমিটি হাসল সে। তখনই পেছন থেকে এগিয়ে এলো শেহরোজের ডান হাত। সেই হাত থেকে চিরকুটটা নিলো চালক। শেহরোজ সিটে গা এলিয়ে বলল, “বি কেয়ারফুল, কর্নেল রাশিদ। ডিকোড করতে গিয়ে আবার অ্যাক্সিডেন্ট করে বোসেন না।”

“আব্বাজান, চার মাস ধরে আনা নেওয়া করছি প্যাসেঞ্জার। ফাস্ট ক্লাস সিএনজি ড্রাইভার এখন।”

জবাবে একটু হাসল শেহরোজ। কোনো কথা বলল না। রাশিদ সিএনজি চালানোর মাঝেই কবিতার লাইনগুলো পড়তে শুরু করল। ঠিক চার মিনিটের মাথায় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “পাঠোদ্ধার করে ফেলেছি, আব্বাজান।”

“কী করে ফেলেছেন?” উৎসুক হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলো শেহরোজ।

“ওহো স্যরি স্যরি, কঠিন বাংলা বলে দিয়েছি দেখি”, লাজুক হাসল রাশিদ। “বলছি ডিকোড করা শেষ।”

“শাবাশ, কর্নেল। জলদি বলুন।”

“দক্ষিণের হাওয়ায় থেকে ‘দক্ষিণ’। তোমার কোলে কাটাই থেকে ‘কোলে কাটাই’। অর্থাৎ কলকাতা। তুমি ফিসফিস সুরে বলো থেকে ‘ফিসফিস’। যেটা মূলত ফুসফুস। তাহলে পুরো কথা দাঁড়াল দক্ষিণ কলকাতা ফুসফুস৷ অরিজিনাল কথাটা হচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস। দক্ষিণ কলকাতার একটা কৃত্রিম হ্রদ হলো রবীন্দ্র সরোবর। যেটাকে ওখানের মানুষ দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস বলে। আর আমাদের ধানমন্ডিতে আছে একটা রবীন্দ্র সরোবর। কলকাতারটা দিয়ে ধানমন্ডিরটা বোঝানো হয়েছে। বুঝলেন আব্বাজান?”

প্রশংসার হাসি হাসল শেহরোজ, “দারুণ! তারপর?”

“চলো শুক্রগ্রহে হারাই থেকে ‘শুক্র’। মানে শুক্রবারের কথা বলেছে৷ সাবজেক্ট শুক্রবারে যায় আরকি। এরপরের দুটো লাইনে বোঝানো হয়েছে সাবজেক্টের ঠিকানা৷ তোমার উত্তর – বুকের সীমানায়৷ এর মানে রবীন্দ্র সরোবরের উত্তর দিকে বর্তমানে একটা ছোট্ট বইয়ের লাইব্রেরি হয়েছে, লাইব্রেরির পেছনেই একটা নতুন বাড়িও হয়েছে। ওটাই হচ্ছে আমাদের সাবজেক্টের মূল আবাস। খুব অভিনব কৌশলে ঠিকানাটা লিখেছে আকাশ।”

“হ্যাঁ, আর আপনিও খুব দ্রুত তার অর্থ বের করে নিলেন। ইউ অল আর ভেরি ট্যালেন্টেড।”

“এত ট্যালেন্টেড যে আমার চাকরিই নট হয়ে গেছে। হা হা হা।” হাসি শেষেই বলল রাশিদ, “আমি এত দ্রুত ক্যাচ করতে পেরেছি কারণ, গতরাতে ওদের ধানমন্ডিতে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম তো আমিই।”

শেহরোজ হাসল না রাশিদের সঙ্গে। উদাসীনের মতো বসে কিছু ভাবনায় ব্যস্ত হলো সে৷ তা লক্ষ করে রাশিদ বলল, “সাব্বিরের শিকারটাকে নিয়ে ভাবছেন? ওটা মরে গেলেও আমরা ওর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চয়ই ভুল ধারণা করিনি?”

“পরিচয় বুঝতে পেরে খুব বিশেষ কোনো উপকার হয়নি, কর্নেল।” থমথমে, আবেগশূন্য কণ্ঠে বলল শেহরোজ, “আপনারা ওকে পুরো ন্যাকেড করে রাখার পরও ও কোনো এক উপায়ে সুইসাইড করে নিতে পারবে। সেটা আপনারা ভাবতেই পারেননি। তাহলে বুঝতে পারছেন ওদের প্রতিটি এজেন্ট এবং যে কমান্ডার, তারা আপনাদের ভাবনার কতটা ওপরে? আমাদের পাঁচজনকে আরও বেশি একটিভ অ্যান্ড অ্যালার্ট হতে হবে। চার মাস সময় যতটা কমফোর্টেবলি ছিলাম, আগামী চারদিনে ততটাই একটিভ হতে হবে। টু ডেইজ… ইন টু ডেইজ আই উইল হান্ট ডাউন দ্য টার্গেট।”

মাথা নড করল রাশিদ৷ শেহরোজের মেজাজ বুঝতে পেরে আর কোনো কথা বলার সাহস হলো না তার। সে সময়ই বলে উঠল শেহরোজ, “আপনাদের ঘরের মধ্যে শত্রু বলেই পুরো সিস্টেমটাই এত ড্যামেজ আজ।”

“হ্যাঁ, ঘরশত্রু বিভিশন। এদের মতো অত্যন্ত লোভী শ্রেণীর মানুষগুলোই বড়ো বড়ো সেক্টরের মাথা৷ আপনার শিকার করা ওই এনএসআই-এর কর্মকর্তার মতো আরও বহু কর্মকর্তারা অবলীলায় নিজেদের বিক্রি করে দেয়৷ আসলে এ দেশের বড়ো একটা সংখ্যার মানুষের মাইন্ডসেট হলো গোলাম হয়ে থাকতে চাওয়া।”

কথা সেদিকে আর বাড়াল না শেহরোজ। কারণ, বাসার গলির মুখে পৌঁছে গেছে সিএনজি। ভাড়া মিটিয়ে রাশিদকে বিদায় দিয়ে গলিতে প্রবেশ করল সে। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ থেমে পড়ল ওর পা জোড়া।

মাথায় ছাইভর্তি ব্যাগ নিয়ে এক লোক “ছাই নিবেননি ছাই!” বলতে বলতে সে এগোচ্ছে সামনে। আরেক লোককে দেখল, ভ্যান ভর্তি সবজি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। এলাকায় সম্পূর্ণ নতুন আমদানি ঘটেছে এ দুটোর। খুব ভালোভাবে দুজনের আগাপাছতলা দেখে নিলো শেহরোজ। তারপর দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড প্যান্টের পকেট হাতড়ালো সিগারেট খোঁজার উদ্দেশ্যে। পেলেও আবার সিগারেট কেনার বাহানায় গলি থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় উঠল৷ দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে একটা ধরিয়ে টান দিতে দিতে আশেপাশে সাবধানী দৃষ্টি ঘুরাল কিছুক্ষণ। না, আর কাউকে সন্দেহজনক পেলো না এদিকে। রাস্তা পার হয়ে এপাশে চলে এসে কিছুদূর সামনে এগিয়ে একটু ফাঁকা পেয়ে থামল। কল করল তারপর বিশেষ একজনের কাছে৷ রিসিভ হতে সময় লাগল না৷ সরাসরি প্রসঙ্গে শেহরোজ বলতে শুরু করল, “আসসালামু আলাইকুম, ভাইজান। পেয়ারা তো গাছে আর রাখা যাচ্ছে না। পাখিতে এসে ঠুকাঠোকি শুরু করে দিয়েছে। পেড়ে ফেলা দরকার এখনই৷ কিন্তু পাড়ার পর রাখব কোথায়?”

“ভাই শায়েগান, খালি পড়ে থাকা ডুপ্লেক্স হাউজটাকে কাজে লাগিয়ে ফেলুন।” জানাল ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি।

“ঠিক আছে।” কলটা কেটে শেহরোজ মেসেজ দিলো সাব্বিরকে, “এদিকে এসে কিছু সবজি নিয়ো। ছাইও নিয়ো মাছ কাটার জন্য।”

শাজের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বাসার উদ্দেশ্যে এবার রওনা হলো সে। এতদিন আস্তেধীরে এগোচ্ছিল এই এজেন্টগুলো। কিন্তু গতরাতের পর ওদের বুঝতে আর বাকি নেই শাজের চারপাশে নিরাপত্তার জাল বিছানো হয়েছে। আর তাছাড়াও গাড়িতে থাকা ওই দুই এজেন্টের একজন বিপদ টের পাওয়া মাত্রই সঙ্কেত পাঠিয়ে দিয়েছিল — সেটা তো ওদের পাঁচজনেরও বুঝতে বাকি নেই৷ কে বা কারা শাজকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, এ ব্যাপারে তদন্ত না চালিয়ে তো আর বসে থাকবে না সরকারের ট্যাগ বয়ে চলা এই শত্রুপক্ষ।

এসব কারণেই গতরাতে আকাশ আর ইব্রাহীম খলিল ওদের শিকারের গুপ্ত ঠিকানার হদিস বের করার মতো ছোটো অপারেশনটাও চালিয়েছে খু্বই সাবধানে। বিশেষ করে আকাশকে অতি সাবধানে চলতে হচ্ছে এখন। এমনকি যে কোনো মুহূর্তে ট্র্যাক হওয়ার সম্ভাবনার কারণে নিজের ফোনের ক্ষেত্রেও তাকে রাখতে হচ্ছে সাবধানতা। কারণ, বছর দুই আগেও সে ছিল ডিজিএফআইয়ের অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা। সৎ, ন্যায়পরায়ণ আর অন্যায় কিছু হজম করতে না পারার কারণে একদিন বিশিষ্ট মহলের কালো তালিকাভুক্ত হয়ে পড়ল। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর এই দেশে শান্তিতে টিকে থাকায় তার মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভাগ্যিস তখন বড়ো ভাইটা কানাডা দ্রুত নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল! এখন সেই দেশের জন্যই তাকে ফিরতে হলো আবার।
***

কলাটা ছিলে মাত্রই কামড় বসালো শাজ। ওর সামনে তখন টেবিলের ওপর ধপাস করে একটা বক্স রাখল ঝুমা শেখ। রীতিমতো চমকেই উঠল সে। কারণ, কলা খাওয়ার ফাঁকে তার আবার নজর আর মনোযোগ ছিল শেহরোজের ঘরটার দরজাতে। এই লোককে দেখার আশাতেই আজ সকাল সকাল নাশতা খেতে ছুটে এসেছে সে৷

যথাসম্ভব সামলে উঠে শাজ বক্সটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী, ডার্লিং? আমার জন্য কি আজ টিফিন বানিয়েছ?”

“ওলেলে আমার খুকুমণি! সে ইশকুলে যাবে। তো টিফিন রেডি করা লাগবে না”, ব্যঙ্গ সুরে বলে উঠল ঝুমা।

মুখ গোঁজ করে রইল শাজ। ধমক বসালো তখন ঝুমা, “বক্স খুলে আমার কেকের মর্যাদা রক্ষা কর।”

“এটাতে কেক আছে মাইরি!” মুখটা ঝলমলিয়ে উঠল শাজের, “আগে বলবা না, বেটি?” বলতে বলতেই বক্সটা খুলল সে। খোলার পর কেকের ওপর নিজের ছবির বদলে ঝুমা শেখের বিখ্যাত হাসিমুখের ছবি চিপকানো দেখে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হতবুদ্ধি চোখদুটো তুলে সে দেখল, ব্লাশ মেখে লাল করা মুখটাতে দাঁত বের করে ঝুমা বেগম তারই দিকে তাকিয়ে হাসছে আর ভ্রু নাচাচ্ছে। যেন বলছে, “কেমন দিলাম রে আয়রেন বেটি?” কাষ্ঠহাসি হাসতে হাসতে শাজকে সে বলল, “বার্থডে গার্লের ছবিই যে সব সময় থাকবে কেকে ,এমন তো কথা নাই! বরং যে কষ্ট করে, চর্বি ঝরিয়ে কেক বানালো। মানুষের তো তাকেই চেনা দরকার, তাই না বল?”

ক্ষুধা পেটে বলেই এই মহিলার ইয়ারকি আর দন্তবিকাশ শাজ চুপচাপ হজম করে নিলো। নয়ত ঝগড়া বাঁধালে এই মহিলা তার হাতের ছিলা কলাটাও কেঁড়ে নিতে থামবে না। নীরবে চামচাটা নিয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কেকের একদম মাঝ বরাবর ঢুকিয়ে দিলো সে৷ ছবির দাঁত বের করে হাসির অংশটুকুই মুখে চালান দিতে দিতে বলল, “বার্থডে আমার, কেক তোমার। কোনো ব্যাপার না, ডার্লিং। সুপার ডেলিশাস… উমম্!” পরের চামচে ঝুমার নাকের অংশ তুলবে সে, ঘাড়ের ওপর থেকে তখনই একটা পুরুষ হাত চামচটা একটানে তার হাত থেকে নিয়ে কেকের প্রায় অর্ধেকই তুলে নিলো। প্রচণ্ড রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠবে শাজ, তখন পেছন থেকে হাতের সেই মালিক খেতে খেতে ওরই মতো করে বলে উঠল, “উমমম্! সুপার সুপার ডেলিশাস!”

নিজের ছবিটাকে অমনভাবে খুঁচিয়ে শাজকে খেতে দেখে রামধমক বসাতেই যাচ্ছিল ঝুমা। এর মাঝেই কোত্থেকে শেহরোজ এসে হামলে পড়েছে কেকের ওপর। দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে কাকে যে কী বলবে, তা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ল বলে আপাতত রান্নাঘরে চলে গেল সে।

পেছন মুড়ে শাজ ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে আছে শেহরোজের দিকে। ঢলঢলে ফ্রি সাইজের ছাই রঙা টিশার্ট আর কালো জগার্স পরনে ওর৷ ঘেমে টিশার্টের কোনো জায়গা শুকনো নেই। সকাল সকাল এই লোক তাহলে দৌড়াদৌড়ি করতে বের হয়!

শাজের ভাবনার মাঝেই তাকে ডিঙিয়ে পুরো বক্সটাই নিয়ে নিলো শেহরোজ। বড়ো বড়ো কয়েক চামচ মুখে পুরে কেকটা সাবাড় করে দিতে মাত্র দু’মিনিট সময় নিলো সে। খাওয়া শেষে মুচকি হেসে বলল শাজকে, “তুমি এমনিতেই এত মিষ্টি, শাজ! কেকটা খাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না তোমার।”

“হ্যাঁ? একটুও নেই?” চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে শেহরোজের হাত থেকে বক্সটা নিলো শাজ। ফাঁকা বক্স দেখে কটমট চোখে তাকাল ওর দিকে। চেঁচিয়ে ওঠার আগেই তার ঠোঁটে লেগে থাকা সামান্য চকলেট গুঁড়া হঠাৎ খুঁটে নিয়ে মুখে নিলো শেহরোজ। বিস্ময়ে তখন একটুখানি থমকালো শাজ। সেই চেহারাটা দেখে স্মিতহাস্যে চোখ মেরে সে চলে গেল নিজের ঘরে।

ফাঁকা বক্সটার দিকে তাকাল শাজ আবারও৷ সহসাই গতরাতের একটা কথা মনে এলো — “আমি খাবো, আমার না হওয়া বরও দেখা গেল কই থেকে উড়ে এসে কেকের মধ্যে হামলে পড়বে।” গতরাতে বলা তার এই কথাটির সঙ্গে শেহরোজের কেক খাওয়ার দৃশ্যটা কেমন মিলে গেল না?

নাশতার টেবিলে এসে হাজির হলো পিয়াল আর তার বাবা। শাজকে নিশ্চলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিয়ালের বাবা মতিন সাহেব ডাকলেন, “কীরে শাজ, তুই ওরকম দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বসে পড়।”

সম্বিৎ ফিরল শাজের। নিজের চেয়ারে এসে বসার পর মনে মনে নিজেকে পাগল, ছাগল বলে বকতে থাকল৷ ওই ঝুঁটিয়ালের কর্মকাণ্ডে তার মাথা আসলে খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ কীসের মাঝে কী উলটাপালটা ভাবছে যে আজকাল!

ঝুমা এলো গরম গরম চালের রুটি নিয়ে। শেহরোজকে না দেখে জিজ্ঞেস করল তিনজনের উদ্দেশ্যেই, “রোজ তো এখানেই ছিল৷ কোথায় গেল? ঘরে?”

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হলো না কারও। ঝটপট গোসল শেষে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে শেহরোজ। এসেই বসে পড়ল শাজের পাশের চেয়ারটাতেই। মনের টলমলানো অনুভূতির কারণে ঘাড় বাঁকিয়ে বা আড়চোখেও তাকাল না শাজ। যদি কিছু বুঝে ফেলে শেহরোজ?

ঝুমা সবার প্লেটে রুটি সমান সমান তুলে দিলেও শাজকে দিলো একটা। শাজ নাক কুঁচকে বলল, “এই একটাই বা কেন দিলে, আন্টি? চালের রুটি আমার পেটে সয় না। গমের রুটি করলে না কেন?”

পছন্দ না শেহরোজেরও। গমের রুটিতে অভ্যস্ত সে। শাজকে বলতে দেখে নিজেও জানাতে যাবে এ কথা আর তখনই ওর চোখ পড়ল ঝুমা আন্টির ওপর। নাকের পাটা ফুলে গেছে আন্টির। কোমরে হাত দিয়ে শাজের দিকে আগুন দৃষ্টি ছুঁড়ে আছে। তারপরই শাজকে বলে উঠল, “কাইল কাচ্চি রাইন্দা ফ্রিজে রাখছি। দাঁড়া!” চলে গেল সে ফ্রিজ থেকে কাচ্চির পাত্র আনতে।

মতিন সাহেব হতাশায় মাথা নাড়তে নাড়তে খেতে থাকলেন৷ পিয়াল খোশমেজাজে আছে অবশ্য। হঠাৎ তার চোখ গেল শেহরোজের দিকে৷ সে ছানাবড়া চোখে তার মাকে দেখছে বলে জিজ্ঞেস করল ওকে, “মাকে কী দেখো গুলির মতো চোখ করে?”

“কিছু না”, বিব্রত চেহারায় বলল শেহরোজ।

“ও দেখছে তোর মার জংলী বেশভূষা”, বলে উঠলেন মতিন।

“সত্যি নাকি, রোজ?” হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল পিয়াল।

“না… মানে কোথাও প্রোগ্রাম আছে আন্টির?”

জবাব দিলো শাজ, “কীসের প্রোগ্রাম? এই পাগল বেটির স্বভাবই এটা। ইদ এলে আমরা গোরুর গোশত যেমন তিন চারদিন ধরে খাই৷ সেরকম সে কোনো পার্টি বা প্রোগ্রামে গহনা পরলে তা কমপক্ষে তিন দিনের নিচে গা থেকে খুলবে না৷ সাজগোজও চলবে তার ততদিনই। শুধু ঘুমানো আর গোসলের সময়টুকু ছাড়া।”

আলমারিতে তুলে রাখা কোনো গহনাই বাদ পড়েনি — ঝুমার গলা ভর্তি সোনার হার, হাত ভর্তি চুরি, কানে বড়ো দুল আর মুখে ভারী প্রসাধনী। এসব দেখেই শেহরোজ বিস্মিত হয়ে আছে। জীবনে সে বহু অদ্ভুত দর্শনের মানুষ দেখেছে। মোটামুটি সবার কথায় মনে আছে ওর । তাদের সাথে আজ ঝুমা শেখের নামটাও যুক্ত হলো।

ঠান্ডা কাচ্চিই এনে ঝুমা ঠাস করে রাখল টেবিলে। বলল, “যার রুটি সয় না সে সাধের কাচ্চি গিলুক।”

“তাই বলে ঠান্ডা কাচ্চি খাবে?” মতিন সাহেব বললেন, “একটু গরম করে এনে দাও।”

“ওহোরে আমার জমিদার পালের কইন্যে আসিছে রে”, মুখ ভেংচি কাটল ঝুমা৷ “কাইল কুতায় আছিল এই পালের কইন্যে? পারবু না গরম করবার। হেতি গরম গিলবার চাইলে কইরে নিয়া আসুকগা।”

“হ্যাঁ, ঠিকই তো।” ঝুমা শেখকে সমর্থন করে শেহরোজ বলল শাজকে, “আন্টি কাল কত খাটাখাটুনি করে রান্নাবান্না করেছিলেন, তোমার বার্থডের জাঁকজমক আয়োজনও করেছিলেন। এখন আবার সকাল সকাল উঠে সবার জন্য নাশতাতে রুটি করেছেন৷ চুপচাপ খেয়ে নেওয়া উচিত, শাজ। আর নয়ত নিজের খাবার নিজে গরম করে খাও।”

“নিজেই গরম করে খাবো।” জেদি কণ্ঠে বলে শাজ কাচ্চির পাত্র নিয়ে উঠে গেল।

মিটমিট করে হাসল তখন শেহরোজ। কাচ্চিটা গরম করার কথা সরাসরি বলতে ওর লজ্জা লাগছিল কিনা! রাগিয়ে দিয়ে যদি নিজের চাহিদাও পূরণ করা যায় তবে ক্ষতি কী?

ওভেনে শাজ পাত্রটা ঢোকানো মাত্রই ঝুমা আবার চেঁচিয়ে উঠল, “ওভেন চালাইলি ক্যান, পাল কইন্যা? কারেন্টের বিল তুই দিবি?”

“ভালো ব্র্যান্ডেড মেকআপ প্রোডাক্টস মতিন জোয়ার্দারের বউকে যেন কে এনে দেয়?” চেঁচিয়ে বলল শাজও।

“ওহ, নাইস শট”, প্রশংসা করে উঠল পিয়াল।

“প্রথম ব্যাটেই ছক্কা!” হাসতে হাসতে বললেন মতিন সাহেব।

কারণ, ইতোমধ্যে চুপসে গেছে ঝুমা শেখের মুখখানি। ভালো প্রসাধনী পণ্য সম্পর্কে যে তার কোনো ধারণায় নেই! কিনতে গিয়ে টাকা দিয়ে বাজে পণ্যই কিনে আনে সে। তাই এ দায়িত্ব শাজকেই নিতে হয়েছে৷ বছরে যখন ইচ্ছা তখনই সে শাজের কাছে প্রসাধনীর বায়না ধরে। আর শাজও বিনাবাক্যে তাকে উপহার হিসেবে দিয়ে থাকে সেসব।

কাচ্চি নিয়ে চলে এলো শাজ টেবিলে। ঝুমার দিকে কঠিন এক চাউনি ছুঁড়ে বসল নিজের চেয়ারে৷ তার ওই চাউনিকে পাত্তা না দিয়ে ঝুমা বেগম ‘এখানের কাউকে চেনেই না’ এমন মুখভঙ্গি নিয়ে খাবার খেতে শুরু করল।

সবটাই শেহরোজ দেখল, শুনল আর মনে মনে ভীষণ উপভোগও করল৷ এটাও বুঝল, আপনজনদের হারিয়ে কোনো বিষণ্নতা আর হতাশা ছাড়াই শাজ কী করে দিব্যি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে! নিঃসন্দেহে এর সকল কৃতিত্ব ঝুমা শেখের। যে অতি সন্তর্পণে শাজকে ভালো রাখার, সব ভুলিয়ে রাখার দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছে নিখুঁত কৌশলে। শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল শেহরোজের তার প্রতি।

নিজের প্লেটে কাচ্চি তুলবে এর মাঝেই শেহরোজ ওর প্লেট এগিয়ে ধরল চামচের সামনে। শাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালে সে সরল হেসে বলল, “এত সুন্দর স্মেল আসছে তোমার বার্থডের কাচ্চি থেকে!”

“এই শাজ, ওর প্লেটে বেড়ে দে জলদি।” তাড়া দিয়ে উঠলেন মতিন সাহেব।

“কাচ্চিও কি চোখের পলকে মেরে দেবেন?” প্লেটে বেড়ে দিতে দিতে শাজ অনুচ্চ গলায় বলল শেহরোজকে।

“তুমি চাইলে দেবো”, একই কণ্ঠেই জানাল শেহরোজ।

“না, একদম চাই না। আমার ভাগের জিনিস কেউ দখল করুক, তা আমি মানতেই পারি না।”

“আর যদি কখনো এমন হয় যে, তোমাকেই দখল করে নিলাম?” ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল শেহরোজ , “মানবে না?”

কার কী অনুমান হলো আজকের পর্ব পড়ে?