শেহরোজ পর্ব-১৬

0
336

#শেহরোজ — ১৬
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

“বাংলাদেশ আমার মায়ের মাদারল্যান্ড হতে পারে‚ কিন্তু আমার না। আমার মা তার দেশটাকে ভালোবাসে আর আমি তাকে। তাই জন্যই আমি ছুটে এসেছি এখানে। নয়তো এই দেশের সরকার স্বৈরাচার‚ না-কি অন্য দেশের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করছে এই সরকার‚ না-কি দেশটাকে অন্য দেশের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে সরকার‚ এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা থাকবে কেন?

তুমি কি দেখোনি তোমার চাচা আমাদের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্সের সহযোগিতা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অরগানাইজেশানের কল্যাণে নিজেকে পুরোপুরি ডেডিকেট করে দিয়েছে? তার মতো একজন জিনিয়াস সায়েন্টিস্ট কিছুদিনের মধ্যেই সারা পৃথিবীর কাছে পরিচিতি পেতে যাচ্ছিল তার তৈরি এক্সেপশোনাল ইলেকট্রনিক ডিভাইসটার জন্য— যদি সেটা আজ আমেরিকা প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিতো সে। কিন্তু সে কত বড়ো স্যাক্রিফাইজ করেছে ভাবতে পারছ‚ আইয়াজ? তার সম্পূর্ণ যুবক কালই সে পার করে দিয়েছে এই প্রোফেশনে। অর্থের চেয়েও বেশি চেয়েছিল সে খ্যাতি— একজন বাংলাদেশী সায়েন্টিস্ট হিসেবে। যাতে সারা বিশ্ব চিনতে পারে তাকে৷ কিন্তু এখন তাকে গোটা জীবন সকলের আড়ালে কাজ করে যেতে হবে কেবল আমাদের অর্গানাইজেশনের জন্য। তুমি কি তার চেয়ে বেশি স্যাক্রিফাইজ করেছো‚ বলো”‚ শেষ বেলায় সাব্বিরকে কড়া সুরে ধমকেই উঠল শেহরোজ। তারপরই আবার বলে চলল‚ “একবার ভাবো মেজরের কথা। কয়েক মাস আগে মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে সে। বুকে তার ভাইয়ের মৃত্যুর হাহাকার। ভাইয়ের ডেডবডিটা পর্যন্ত শেষবারের জন্য দেখতে পারেনি৷ নিজের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে তার এখনো৷ চাইলেই দেশের বাইরে চলে যেতে পারত সে কোনো এক উপায়ে। কিন্তু দেশপ্রেম তাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে‚ অপারেশন ‘হান্ট দ্য র‍্যাট’ তাকে আইরন ম্যানে পরিণত করেছে। এই হান্টার টিমে তার মতো আবেগশূন্য‚ পিছুটান শূন্য হয়তো আর কেউ নেই। বাকিরাও জানের কথা‚ পরিবারের কথা ভুলে দিন-রাত লেগে থাকছে কাজে৷ চাইলেও পরিবারের সঙ্গে একটাবার দেখা করার কথা চিন্তাতেও আনছে না।
কারও কন্ট্রিবিউশন কম নয় এই অপারেশনে। শুধু তুমি নিজের শক্ত মনোবলকে হারিয়ে ফেলছ তুচ্ছ ভাই আবেগের কাছে।”

“তুচ্ছ?” আহত চোখে তাকাল সাব্বির।

“হ্যাঁ তুচ্ছই”‚ শ্রাগ করে বলল শেহরোজ। “তুমি এ কথাতে দুঃখ পেলেও আমি এটাই বলব৷ এই অপারেশনের কাছে তোমার বোনের জন্য তোমার এসব কষ্ট‚ আবেগ আমার কাছে একদম তুচ্ছ। আচ্ছা একটা কাজ করো তুমি৷ শাজকে কল করো এখনই।”

হতবুদ্ধি দেখাল সাব্বিরকে। তার চেহারা দেখে শেহরোজ সোফায় গা এলিয়ে আরাম করে বসল‚ “উহুঁ‚ আমি একটুও মজা করছি না। তুমি যে বোনের জন্য আবেগে ভেসে যাচ্ছ সেই বোন বহু বছর পর তোমার ফোনকল পেয়ে কী বলে শুধু সেটা শুনতে চাই।”

“আপনি সত্যিই চাইছেন ওকে কল করি?” অবাক সাব্বির।

জবাবে চোখের ইশারায় শেহরোজ ফোনটা করতে বলল শাজকে। সাব্বির একটু দ্বিধায় পড়ল প্রথমে। দলপতি যে চটে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর কথা মতো এই কলটা এখন না করলে নিশ্চিত আরও চটে যাবে। আবার সত্য হলো‚ শাজের প্রতিক্রিয়া কী হয় তা জানার জন্য তার মনটাও কিছুটা ব্যাকুল। তাই কলটা করেই ফেলল শাজকে। কল হতে হতে কেটে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ধরল শাজ‚ “হ্যালো? কে?” স্ক্রিনে নাম্বারের বদলে ‘Private Number’ লেখা দেখে সে ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলেছে।

বোনের কণ্ঠ পেয়ে শেহরোজের ইশারায় কলটা উচ্চশব্দ করে দিলো সাব্বির। উত্তেজনায় কম্পিত গলায় বলল‚ “আমি আইয়াজ বলছি‚ শাজ।”

ঝুপ করে নীরবতা নেমে এলো ফোনের ওপাশে। কয়েক মুহূর্তের মৌনতা কাটিয়ে শাজ মিহি কণ্ঠে বলল‚ “আইয়াজ কে? এ নামে তো কাউকে চিনি না৷”

“আমি আইয়াজ ফারদিন‚ শাজ। তোর ভাইয়া।”

“ধুর ব্যাটা”‚ আচমকা বিশাল এক ধমক দিয়ে বসল শাজ। “আপনি আইয়াজ কিংবা ফাইয়াজ ফারদিন হোন। আমি এ নামে কাউকে চিনিই না। তাহলে ভাই হলেন কী করে?”

মেয়ে মানুষের নরম কণ্ঠে হঠাৎ এমন ধমকানি ঠিক কতটা অদ্ভুত আর বাজে শোনায়— তা আজ বুঝতে পারল সাব্বির নিজের বোনের কৃপায়৷ আঁড়চোখে শেহরোজকে দেখে নিলো একবার। মাথাটা সোফার গায়ে গড়িয়ে দিয়ে সে চোখ বুজে মুচকি মুচকি হাসছে। ছোটো করে শ্বাস ফেলল সাব্বির। শাজকে বলল‚ “আচ্ছা চিনতে হবে না৷ না চেনার মতোই কাজটা করেছি আমি। তবুও একবার দেখা করবি আমার সঙ্গে? যদি দেশে আসি?”

“আশ্চর্য!” তারস্বরে বলে উঠল শাজ‚ “চিনি না জানি না কে দেশে আসবে না বিদেশ আসবে তার সঙ্গে আমি দেখা করব কোন খুশিতে? কীসের ধান্দায় কল করেছেন‚ হ্যাঁ? কীসব প্রাইভেট ফ্রাইভেট আজগুবি নাম্বার থেকে কল করে ভাই বোন গীত ধরেছেন! ল্যাদাবাচ্চা পেয়েছেন আমাকে‚ যে যা বলবেন তাই শুনব? আমার বাসার সামনে আপনাকে পেলে গুলিস্তানের মলম বিক্রেতাদের ডেকে এমন মলম লাগাব যে সারাজীবনের জন্য শখ মিটে যাবে আমার সঙ্গে দেখা করার।” শেষে বাজখাঁই গলায় ধমক বসিয়ে দিলো‚ “ফোন রাখুন‚ ভণ্ড লোক! ফারদার আমার নাম্বারে কল এলে জায়গা মতো ইনফর্ম করব।” খট করেই কলটা কেটে দিলো শাজ।

‘জায়গা মতো ইনফর্ম করব’ বলতে যে সে চাচা খালিদকে বুঝিয়েছে তা বুঝতে অসু্বিধা হলো না সাব্বিরের। এও বুঝল‚ দেখা করতে গেলেই শাজ বড়োসড়ো ঝামেলা বাধিয়ে বসবে। সেই হুমকিই দিয়েছে তাকে। অবশ্য এমন ব্যবহারই তো তার প্রাপ্য।

চোখ বুজে রেখেই পাটা সামনের টি টেবিলে তুলে দিয়ে শেহরোজ বলতে থাকল‚ “আমাকে যখন ‘অপারেশন বাংলাদেশ’ ফাইলটা হাতে দেওয়া হয় সেই ফাইলটা খোলার আগেই খালিদ উসমান জানাতে শুরু করল তার ভাতিজির পার্সোনালিটি আর মেন্টালিটি কেমন৷ ডেয়ারডেভিল‚ অবস্টিনেট‚ শর্ট টেম্পারড‚ বাট ভেরি ইমোশনাল। ইমোশনাল শাজ এটা আমি আজকে সন্ধ্যার আগে বিশ্বাসই করতাম না। তোমার বোনের মাঝে থাকা ইমোশনটা আসলে বেরিয়ে আসে আনএক্সপেক্টেডলি। কিছুটা সে খামখেয়ালিও আছে। আরও যেটা আছে সেটা হলো খুব বেশি দ্বিধায় ভোগে সে। এবং একবার কারও প্রতি অফেন্ডেড হলে তাকে আর কোনোভাবেই ও বিশ্বাস‚ ভরসা করবে না‚ তাকে নিজের ধারেকাছেও টলারেট করবে না। গত চার মাসে দূর থেকে ওকে অবজার্ভ করে ওর সাইকোলজি যতটা না বুঝেছি‚ মাত্র তিন দিনেই তার চেয়ে বেশি বুঝেছি কাছাকাছি থেকে। এখন বলো‚ তুমি কতটা চেনো শাজকে? আমার থেকে কম না বেশি?”

মুখটা নুইয়ে সাব্বির দীর্ঘশ্বাস ফেলল‚ “ওর অস্তিত্ব যখন আম্মুর পেটে অনলি ফাইভ মান্থস‚ সে সময়ই কাকু আমাকে নিয়ে গেল ইউএস। আমি তখন বোনের আগমনের থেকে বেশি এক্সাইটেড ছিলাম অ্যাব্রোড গিয়ে নতুন স্কুলে কেমন পড়াশোনা হবে আমার‚ নতুন জায়গাতে কতটা ইনজয় করব। কত ছিলাম আমি? তের কি চৌদ্দ! ওর যখন তিন বছর হলো তখন আমার কাকুর সঙ্গে দেশে আসার কথা ছিল। কারণ‚ তখন আম্মু খুব অসুস্থ। কিন্তু আমার ফ্লাইটের দশ দিন আগেই শুনি আম্মু সুইসাইড করেছে আর যার জন্য দায়ী আব্বু। এমনকি শাজকেও দায়ী করলাম আমি৷ ওর জন্ম না হলে তো আম্মু পিপিডি-তে অ্যাটাকড হতো না। কাকু দেশে ছুটে এলো। কিন্তু আমার কষ্ট‚ রাগ‚ জেদের কারণে আমাকে নিয়ে আসতে পারল না। আম্মুকে মৃত দেখার সাহস আর সহ্যক্ষমতাও আমার ছিল না তখন। দেশেই আর ফিরলাম না আব্বু আর শাজের ওপর কঠিন রাগ থেকে। ওদের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। কতবার আব্বু ওকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল! আমি হয় ঘরের দরজা আটকে বসে থাকতাম আর নয়তো কোনো বন্ধুর বাসায় চলে যেতাম। বহু চেষ্টা করেছিল আব্বু আমাকে মানানোর। কিন্তু তখন আব্বু আমার কাছে আম্মুর খুনী ছাড়া আর কিছু ছিল না৷ শাজ তিন বছরের সময়টা পেরিয়ে যখন ছয় বছরে এলো‚ সেদিন কাকু একবার চেষ্টা করেছিল ওর সঙ্গে কলে কথা বলিয়ে দেওয়ার৷ ‘ভাইয়া‚ তুমি আসো না কেন’ শুধু এই কথাটুকুই শুনেছিলাম”‚ কথাটা বলতেই সাব্বিরের ভেজা দুচোখ ছাপিয়ে বড়ো বড়ো অশ্রু ফোঁটা পড়ল কোলের ওপর। “কোনো জবাব দিইনি‚ কখনো ওকে ভিডিয়ো চ্যাটে একটাবার দেখতে চাইনি। একটা সময় পর্যন্ত আব্বু আর ও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে গিয়েছিল আমাকে ফেরানোর জন্য। আর আমি আম্মুর মৃত্যুর জন্য বছরের পর বছর ওদের অপরাধী বানিয়ে নিজের জীবনটাকে ঠিকই গুছিয়েছি। ডু্বে থেকেছি পড়াশোনা‚ নানারকম অ্যাক্টিভিটিস‚ ফ্রেন্ডস আর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। আব্বু‚ শাজ‚ এদেরকে কখনো মনেই করতাম না। শাজ যখন ক্লাস সেভেন শেষ করল তারপর থেকেই ও আমাকে ফেরানোর চেষ্টা বন্ধ করে দিলো৷ কাকুকে কল করে আর কখনো বলত না আমার সঙ্গে কথা বলবে‚ আমাকে দেখবে। শুধু আব্বুই নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্লান্তিহীন চেষ্টাটা চালিয়ে গিয়েছিল। যেদিন কাকু এ দেশে থেকে কলে জানাল কত বড়ো গুপ্ত চক্রান্তে আব্বু নিখোঁজ হয়েছে‚ সেদিনই আব্বুর জন্য কেমন একটা ব্যথা অনুভব হলো বুকে৷ তাকে দেখার জন্য মন আনচান করতে থাকল আমার৷ শাজের কথাও মনে পড়ল। কত বড়ো হয়েছে ও? কেমন দেখতে হয়েছে? কেমন আছে ও একা? যে অস্থিরতা আমার পনেরো‚ ষোল বছরে হলো না তা ওই এক রাতে আমাকে গ্রাস করে ফেলল। আমি মরিয়া হয়ে দেশে ছুটে এলাম৷ কিন্তু শাজের কাছাকাছি পৌঁছতেই পারলাম না। আমি নানুবাড়িতে এসেছি শোনামাত্রই ও চলে যেত। আবার ঝুমা আন্টির বাসাতে এসেছি শুনলেও বেরিয়ে যেত ফ্ল্যাট থেকে। আমার মুখটাই ও দেখতে চাইছিল না৷ সেটা বুঝতে পেরে আমি আর বিরক্ত করিনি ওকে। যে কটা দিন ছিলাম সে কটা দিন এই বাসাতেই একা থাকতাম৷ কাকুকেও যখন বিপদে ফেলা হলো তখন চাইনি আম্মু‚ আব্বুর পর তাকেও হারিয়ে ফেলি৷ তাই তাকে লড়াইটা জোরপূর্বক থামাতে বলি আর জোর করে‚ ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করেই ফিরিয়ে নিয়ে যাই ইউএস। শাজ জন্মের পর আমাকে ঠিকঠাক না দেখার সুযোগ পেয়েছে আর না আমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। ওর প্রতি ভাই হিসেবে আমার টানটা সত্যিই এক সময় তুচ্ছ ছিল। মাঝেমধ্যে কাকু তার ফোন‚ ল্যাপটপ থেকে ওকে দেখাত আর ওর গল্প করত। এভাবেই যতটুকু চিনেছি আরকি! এই দুই বছরে ঝুমা আন্টি ফোনে কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে খুব— পারেনি। আপনি ঠিকই বলেছেন। একবার কারও প্রতি অফেন্ডেড হলে তাকে আর নিজের আশেপাশে সহ্যই করে না ও। ও খুব জেদিও; একদম যেন আমার মতোই। আপনি আর কাকু ওকে যা চেনেন‚ তার সিকিভাগও ওকে চিনি না আমি। শুধু জানি ওই আমার পৃথিবীতে একমাত্র আপন; আমার ছোট্ট বোন।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে একটুখানি মায়া হলো শেহরোজের। তবে সেটা সাব্বিরের জন্য নয়; ওমর ফারুক আর তার মেয়ে শাজের জন্য। তাই সাব্বিরের প্রতি কোমল হতে পারল না সে। রুক্ষস্বরেই বলল তাকে‚ “বেশিরভাগ অপারেশনে আমি সঙ্গে লেজুড় পছন্দ করি না। এবারও পছন্দ করিনি শুরুতে। কতটা বিরক্ত ছিলাম তোমাদের প্রতি‚ তা তো বুঝেছিলেই তোমাদের ট্রেনিং সময়ে। শুধু পছন্দ হয়েছিল একমাত্র মেজরকে। ভেবেছিলাম আমি আর সে-ই চালাব অপারেশনটা। কিন্তু এই দেশের প্রতি আকাশ‚ কর্নেল রাশিদ আর ইব্রাহীম ভাইয়ের সেন্টিমেন্টস অবহেলা করতে পারিনি৷ আর তোমাকে অ্যালাও করেছি কেবল তোমার এই সিক্রেট আইডেন্টিটির জন্য। তোমার চাচার পরামর্শে নয় কিন্তু৷ তাই তোমাকে লাস্ট টাইম ওয়ার্ন করছি‚ আইয়াজ। ফরগেট অল ইমোশনস অ্যান্ড ফোকাস অনলি ইয়োর গোল লাইক আ প্রফেশনাল হ্যাকার। এই অপারেশন সাকসেস না হওয়া পর্যন্ত শাজ তোমার বোন সেটা মাথাতেও আনতে পারবে না। আর স্বরূপে তো মনের ভুলেও কখনো বের হবে না। অর আই উইল ডিলিট ইউ ফ্রম মাই হান্টার টিম।”

“স্যরি‚ ভাই।” অপরাধী মুখ করে বলল সাব্বির‚ “আই উইল কন্ট্রোল মাই ইমোশনস।”
***

ধানমন্ডি
রবীন্দ্র সরোবর‚ রাত ১:৩০

ঘরটাকে মাঝারি আয়তনের হল ঘর বলা যায়। ঘরের মাঝ বরাবর বিশাল লম্বা একটি টেবিল৷ টেবিলের দু’পাশে দশটি দশটি করে মোট বিশটি চেয়ার পেতে রাখা। দক্ষিণের দেওয়ালে টাঙানো ছিয়াত্তর ইঞ্চি ফ্রেমলেস টিভ মনিটর। কোনো জানালা নেই ঘরটিতে। শুধু সিলিঙে লাগানো IP65 ডাউনলাইট। তবে এই মুহূর্তে ঘরটা আঁধার। টিভি মনিটর চালু করে রাখা। সেখানে জ্বলজ্বল করছে শাজের হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি। আর সেই ছবিটিকে কেন্দ্র করে আরও দুটো প্রোফাইল ছবি দেখা যাচ্ছে৷ যাদের একজন মেজর শেহনান আর অন্যজন সায়েন্টিস্ট খালিদ উসমান।

থমথমে চেহারায় পঞ্চাশোর্ধ এক পুরুষ ঘুমানোর পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে মনিটরের সামনে৷ আর বিশটি চেয়ারের আটটি দখল করে আছে আটজন উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ইনটেলিজেন্স অফিসার। তাদের মাঝে কেউ এনএসআই কর্মকর্তা আর কেউ সেনবাহিনীর কর্মকর্তা। তাদের সকলের চিফ এই পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি রমেশচন্দ্র। পিনপতন নীরব ঘরে তার হিমায়িত‚ ক্রোধান্বিত কণ্ঠ বেজে উঠল হঠাৎ৷ মেজর শেহনান আর খালিদ উসমানকে দেখাল সে‚ “এই দুজন কী করে‚ কীভাবে প্রোটেকশন দিচ্ছে এই মেয়েকে? সেটাই জানতে পারলে না কেউ?”

“স্যার।” অফিসার অনীশ বলল‚ “এখানে আমরা প্রথম ভুল করেছি এই মেয়ের কেসটাকে হালকাভাবে নিয়ে। দ্বিতীয় ভুল ছিল একে রাস্তার মাঝ থেকে তুলে নেওয়ার প্ল্যানটা। ওকে বখাটে বেশে ধাওয়াটা না করলে‚ আবার মরিয়া হয়ে সেদিন অ্যাটাকটা না করলে ওর রক্ষাকর্তারা সাবধান হয়ে যেত না। প্রথমে একটা মাস আমাদের ওয়েট করতে হলো চুপচাপ বসে থেকে। অথচ এর মাঝে কতরকম উপায়ে মেয়েটাকে তুলে আনা যেত! এখন তো পুরো কেসটাই জটিল হয়ে গেছে।”

“সেই কতরকম প্ল্যান আমরা ভাবিনি কেন তা কি জানেন না আপনি”‚ অফিসার দীপক বলে উঠল। “বখাটে বেশ ধরতে বলেছিলাম কারণ‚ যাতে সবাই মনে করে রাত-বিরেতে কোনো বখাটেরা তুলে নিয়ে গেছে মেয়েটাকে। কদিন পর কোথাও লাশটা ফেলে রাখলে কেউ পলিটিক ইস্যু বা ওর বাপের ইস্যুকে স্মরণ করবে না। বখাটেরা রেপ করে মেরে ফেলে গেছে এটাই ভাবত সবাই।”

“পেছনের ভুলচুক আমরা আর শুধরাতে পারব না”, বলল আরেক অফিসার সুব্রত। “কে আছে এই মেয়ের চারপাশে‚ সেটা আইডেন্টিফাই করতে হবে জলদি। আমাদের ছয়জন ইনটেলিজেন্স অফিসার গায়েব৷ একদম অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ওদের গাড়িটাকে পর্যন্ত ট্র্যাক করতে পারলাম না। তার মানে কত বড়ো মাপের খেলোয়াড় নামানো হয়েছে মাঠে! আর গতকাল দুপুরে যে কাউয়া কালাটা সজীবের সামনে থেকে মেয়েটাকে তুলে নিলো গাড়িতে‚ তাকে কেন ধরা গেল না?”

“পাবলিকের চোখের সামনে আপনি অ্যাকশনে নামতে বলছেন না-কি? তাও তো কিছুই পরোয়া না করে শুট করেছিলাম বাসটার্ডটাকে টার্গেট করে। বুলেটপ্রুফ কার হতে পারে‚ সেটা কি আপনারা কেউ কল্পনা করেছিলেন”‚ অফিসার সজীব স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাবার চেষ্টা করল।

“স্টপ”‚ ধমকে বসল রমেশচন্দ্র। গলা চড়িয়ে বলল সবাইকে‚ “পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্র ওয়ান উইক আলটিমেটাম দিয়েছে। এর মাঝে এই মেয়ের কেস ডিসমিস করতে বলেছে।” মেজরের ছবিটাকে আবারও দেখাল সে‚ “খালিদ উসমান আমেরিকাতে বসে এই রাসকেল মেজরের মাধ্যমে সবটা পরিচালনা করছে। সায়েন্টিস্ট আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু মেজর বাংলাদেশের মানচিত্রের ভেতরেই আছে। আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওরটি দিচ্ছি‚ ঢাকার মধ্যেই আছে সে৷ ওকে ধরার জন্য তোমাদেরকে আলটিমেটাম দিচ্ছি অনলি টু ডেইজ। এবং এই দুদিনের মধ্যেই শাজ ইরশানাকেও তুলে আনতে হবে যে কোনো উপায়ে। বড্ড বেশি সময় নিয়ে ফেলেছ তোমরা এই সামান্য মেয়েটার জন্য। শেইম অন ইউ!”

ঠিক এই মুহূর্তেই রবীন্দ্র সরোবরের উত্তর দিকে কালো হাইস কমিউটার নিয়ে দাঁড়াল মেজর শেহনান। পাশের সিটেই বসে আছে শান্ত শেহরোজ। কিন্তু দারুণ উত্তেজনায় যার রক্ত টগবগিয়ে ছুটে চলছে শিরা উপশিরায়। গাড়ির পেছন সিটে আছে আরও তিন শিকারী সাব্বির‚ আকাশ আর ইব্রাহীম।

#নোট__ কী মনে হয়? শিকার করে ফিরতে পারবে কি হান্টার টিম?