#শেহরোজ – ১৭
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***
“সাব্বির?” আদেশ দিলো শেহরোজ‚ “কাজ শুরু করো তোমার।”
ল্যাপটপ কোলের ওপর নিয়ে বসে থাকা সাব্বির ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে৷ শেহরোজের নির্দেশে জবাব দিলো‚ “মাত্র দুই মিনিট‚ শায়েগান।”
ঝড়ের গতিতে ল্যাপটপের কিবোর্ডে আঙুল চালাল সাব্বির। পাশে বসে আকাশ দেখল‚ কীসব একগাদা কোড লিখল সে। তারপর দু মিনিটের মাঝেই সে জানাল‚ “ডান!”
লাইব্রেরির ভেতর থাকা সিকিউরিটি ক্যামেরাসহ লাইব্রেরির পেছনের বাড়িটার সকল ক্যামেরা হ্যাক করে নিয়েছে সে। এখন সে ক্যামেরাগুলোকে নিজের ইচ্ছামতো মুভমেন্ট করাতে পারবে।
“আমাদের প্ল্যানটাকে কি আবার রিপিট করতে হবে?” জিজ্ঞেস করল শেহরোজ।
আকাশ বলল‚ “রমেশচন্দ্রকে সহজে কব্জা করতে পারলে তো আর কারও জান কবজ করতে হবে না‚ তাই না?”
শেহরোজ কিছু বলার আগেই ইব্রাহীম একটু হেসে উঠল। তিরস্কার সুরে বলল‚ “ব্যাটা‚ তুমি কবজ না করতে চাইলেও তারা ঠিকই সুযোগ খুঁজবে তোমার জানটাকে কবজ করার।”
“অপারেশনের লক্ষ্যটাকে সবাই মাথায় রাখবে”‚ গম্ভীরস্বরে নির্দেশ দিলো শেহরোজ। “ভিসিকে সহজে ধরা গেলে তো ভালো৷ আর সহজ না হলে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই তাকে ধরতে হবে।”
মেজর শেহনানের অভিব্যক্তি নির্বিকার ছিল। শেহরোজের কথাটা শুনে বলল‚ “রমেশচন্দ্রকে হালকাভাবে নিয়ো না।”
“আপাতত কোনোভাবেই নিচ্ছি না”‚ মুচকি হেসে বলল শেহরোজ৷ “আগে মুখোমুখি তো হই।”
“ক্যাপ্টেন?” শেহরোজকে জিজ্ঞেস করল ইব্রাহীম‚ “সাব্বিরের কি গাড়িতে একা থাকাটা সেইফ হবে?”
“আরে গাড়ির মধ্যে আমার আর কী হবে?” সাব্বির আশ্বস্ত করল সবাইকে‚ “টেনশন নিয়েন না আপনারা।”
“আপনি কী বলেন‚ বস?” শেহরোজের জবাবের আশায় রইল ইব্রাহীম।
“ড্রোন কন্ট্রোল‚ সিকিউরিটি ক্যামেরা কন্ট্রোল‚ এগুলোর জন্য তার চেয়ে বেশি যোগ্য আর কেউ নয়। ওর জন্য গাড়িই সেইফ।” জানাল শেহরোজ‚ “কিন্তু আপনাকে কিংবা আকাশকে ভেতরে একা এগোতে দিতে রাজি নই আমি। এজন্য সাব্বিরকে একাই থাকতে হবে।”
পাঁচজনের মাঝে পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার সমাপ্তি টেনে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল শেহরোজ। মাথা আর মুখ পুরোটাতেই কালো মুখোশে ঢাকা সবার। পরনে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট‚ পায়ে আর্মি কমব্যাট বুট। পাঁচজন সদস্যের এই অপারেশনে মেজর শেহনান বাদে শেহরোজ বয়সে বাকিদের চেয়ে ছোটো হলেও সে-ই সিনিয়র এজেন্ট। এসপিওনাজ জগতে আজ অবধি যত মিশনে তাকে নামতে হয়েছে— তার তালিকা মুখে বলেও শেষ হবে না৷ এই মিশনে আপাতত ওর মতো ডেমোলিশন এক্সপার্ট‚ ফায়ারআর্ম এক্সপার্ট এবং ফ্রি হ্যান্ড কমব্যাট এক্সপার্ট আর কেউ নয়। তবে কাছাকাছি পর্যায়ে আছে মেজর শেহনান। যে কয়েক মাস আগেই প্যারা কমান্ডো ট্রেনিং শেষ করেছিল। আর বাকি তিনজন দীর্ঘদিন অবসর জীবন কাটানোর ফলে ওদের দুজন থেকে সব কিছুতেই বেশ পিছিয়ে।
তাই ওরা দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক দলে ইব্রাহীম আর শেহরোজ‚ অন্য দলে শেহনান আর আকাশ। দুই দলের নেতৃত্বে শেহরোজ আর শেহনান।
লাইব্রেরিটা হচ্ছে জনসাধারণের চোখে একটি ধোঁকা এই বাড়িটার। সকল অফিসার বই পড়ার অছিলাতে এই লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে। তারপর লাইব্রেরির পেছনে গুপ্ত পথ দিয়ে ঢুকে পড়ে বাড়িটাতে। বাড়িটার মধ্যে চলে এনএসআই অফিসারসহ সেনাবাহিনীর ইনটেলিজেন্স অফিসারদের প্রশিক্ষণ‚ সরকারের স্বার্থ জড়িত নানানরকম আলোচনাসভা। তবে আরও একটি তথ্য মেজর শেহনান পেয়েছে। সরকারের জন্য হুমকি বা বিপজ্জনক হতে পারে এমন ব্যক্তিদের গুম করা হয় এখানেই— তাদের জন্য ‘টর্চার সেল’ তৈরিও আছে এখানেই। তথ্যটা কতটুকু সত্য তা জানা নেই। সেই সত্যতা যাচাই করা আর ভার্সিটির ভিসি রূপী স্পাই এজেন্ট রমেশচন্দ্রকে শিকার করাই মূল উদ্দেশ্য এই অপারেশনের।
লাইব্রেরির দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝুলানো৷ তালা খোলা শেহরোজসহ বাকি তিনজনের কারও জন্যই কোনো ঘটনা নয়৷ পিনের সাহায্যে তালাটা শব্দ না করেই খোলা যায়। কিন্তু ওরা জানে‚ ভেতর থেকেও দরজাটা বন্ধ৷ তাই শেহরোজ ইশারায় বাকিদের দু পাশে সরে যেতে বলে দরজার দুটো স্থানে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে শব্দহীন বিস্ফোরণ ঘটে দরজার ওই স্থানই শুধু ভাঙল৷ সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিন সদস্য অস্ত্র তাক করল দরজার দিকে—ওপাশে কেউ যাতে হামলা করার আগেই ওরা হামলা চালাতে পারে৷ ভাঙা অংশের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে শেহরোজ দুটো ছিটকিনি খুলে ফেলল। কোনো বাঁধা আসলো না ভেতরে ঢোকার সময়। অন্ধকার লাইব্রেরির মাঝে ঢুকেই চোখে সবাই নাইট ভিশন পরে নিলো। সামনে এগোতেই লাইব্রেরিয়ানের চেয়ারে বসা একটি কালো কুচকুচে যুবককে বসে বসেই ঘুমে ঢুলতে দেখল শেহরোজ৷ আর তার সামনে টেবিলের ওপর পিসি যন্ত্রপাতি। সিকিউরিটি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা যাচ্ছে কম্পিউটারে।
ছেলেটাকে এভাবে ঘুমাতে দেখে ইব্রাহীম ফিসফিসিয়ে বলে উঠল‚ “আহাম্মকটাকে এক্কেরে ঘুমিয়ে যেতে বারণ করেছে কে?”
তার রসিকতার কোনো জবাব দিলো না কেউ। শেহরোজ ছেলেটার সামনে গিয়ে পকেট থেকে ছোট্ট একটা বোতল বের করে স্প্রে করে দিলো তার নাকের কাছে৷ ঢুলতে থাকা ছেলেটা এবার ঘুমের মাঝেই চেয়ার থেকে এক পাশ হয়ে মেঝেতে পড়ল কাটা কলাগাছের মতো৷ জ্ঞানশূন্য থাকবে সে অন্তত ঘণ্টা দুই।
এরপর খুব সতর্কতার সাথে চারজন অস্ত্র নিয়ে চারদিকে নজর বুলাতে বুলাতে লাইব্রেরির শেষ সীমানায় এসে পৌঁছল। তারপর পেছন দরজাটাও একইভাবেই খুলে ফেলল ওরা৷ আর তখনই স্পাই ইয়ারপিসে সাব্বিরের কথা শুনতে পেলো সবাই‚ “কমপক্ষে ছজন টহল দিচ্ছে বাড়ির চারপাশ জুড়ে৷”
বাড়ির মাথার ওপর সাব্বিরের ড্রোন ক্যামেরা উড়তে আরম্ভ করেছে৷ পাহারাদার চিহ্নিত করা শেষ তার। এরপর যেটা ঘটল সেটা কেবল নয় মিনিটের একটি একপাক্ষিক লড়াই৷
লাইব্রেরির পেছন দরজা দিয়ে ওরা প্রবেশ করল মূল আস্তানার পেছন দিকে৷ অর্থাৎ বাড়িটার পেছনে। তারপর চলল সাব্বিরের নির্দেশনা মোতাবেক ছজন শত্রুকে ধরাশায়ী করার ছোট্ট অপারেশন। ছজন পাহারাদার ওদের চারজনের উপস্থিতি বোঝার আগেই বিভৎস মারে জ্ঞানশূন্য হলো কেউ৷ আর কেউ হলো শেহরোজের কাছে থাকা ক্লোরোফর্ম স্প্রে-তে।
এরপর শেহনান বাদে ওরা তিনজন বেরেটা পিস্তল হাতে নিয়ে চলে এলো বিশাল এরিয়ার ডুপ্লেক্স বাড়ির মূল ফটকের সামনে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শেহরোজ আবারও এক্সপ্লোসিভ লাগাল দরজাতে। অপেক্ষা করল শেহনানের জন্য৷ ঠিক তিন মিনিটের মাঝে সারা বাড়ি ডুবে গেল অন্ধকারে৷ শর্ট সার্কিটের ব্যবস্থা করে ফিরে এসেছে শেহনান। তারপরই এক্সপ্লোসিভ ফাটাল শেহরোজ। ভাঙা দরজা দিয়ে প্রবেশ করল একে একে খুব সতর্কতার সাথে। ওদের মাথার ওপর দিয়ে ঢুকল ড্রোন ক্যামেরাটাও৷ সাব্বির গাড়িতে বসে রিমোটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করছে ওটাকে৷
বেশ বড়ো ড্রয়িংরুমের মাঝে এসে দাঁড়াল হান্টার টিম৷ চারপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে শেহরোজ নির্দেশ দিলো শেহনানকে‚ “আমাকে কভার করবে তুমি।” আকাশ আর ইব্রাহীমকে জানাল‚ “টার্গেট ওপরেই আছে৷ তোমরা পজিশন নিয়ে থেকো।” তারপর সাব্বিরকে ডাকল‚ জিজ্ঞেস করল‚ “কিছু নজরে পড়ছে না?”
“এখনো না।”
ড্রোন পৌঁছে গেছে ওপরতলাতে৷ যতগুলো খোলা ঘর আছে‚ সবখানে ঢু মারছে ওটা৷ শেহরোজের অপেক্ষার পালা শেষ হলো ওপর থেকে গুলির আওয়াজ শুনে৷ মেঝেতে ঝুপ করে কিছু একটা পড়ার আওয়াজও শুনল ওরা৷ ড্রোনের গুনগুন আওয়াজ পেয়েছিল হলরুমে থাকা সকলে৷ ড্রোনটা হলরুমের কাছাকাছি আসতেই একজন অফিসার সেটাকে লক্ষ করে গুলি করে বসেছে। তখনই সাব্বির চেঁচিয়ে উঠল‚ “ড্রোনে শুট করেছে‚ ভাই। ওপর থেকে অ্যাটাক…” কথাটা সম্পূর্ণ করারও সুযোগ পেলো না সে—ওপরতলা থেকে নিচে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ আরম্ভ হয়ে গেল মুহূর্তেই। দৌড়ে চারজন চারদিকে ছুটে কভার নিলো সোফার পেছনে। নাইট ভিশন গ্লাসের দৌলতে দেখতে পেলো শত্রুদের অবস্থান আর তাদের হাতে থাকা টর্চ লাইট। তা দেখেই শেহরোজ মৃদুস্বরে সাবধান করল সঙ্গীদের‚ “লাইট থেকে চোখ বাঁচিয়ো।”
স্পাই ইয়ারপিসে প্রত্যেকে শুনে আরও সাবধান হলো৷ নাইট ভিশন চোখে থাকা অবস্থায় চোখে আলো এসে পড়লে সাময়িক সময়ের জন্য অন্ধ হয়ে যেতে পারে তারা।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে শত্রুরা ওদের অবস্থান কেবল আন্দাজ করে গুলি ছুঁড়ছে। কিন্তু ওদেরকে দেখতে না পাওয়ার ফলে নিচে নেমে যাওয়ার সাহস করছে না কেউ। হান্টার টিমের বেরেটা পিস্তল থেকেও বিরতিহীন গুলি শুরু হলো৷ একদম প্রথম আক্রমণেই চারজনের লাশ পড়ল। বুকে ক্রল করে করে ওরা সামনে এগোলো। তারপর সামনেটা ফাঁকা দেখেই উঠে পড়ল। সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে চলে এসে শেহরোজকে কভার দিতে দিতে এগোলো শেহনান। একইভাবে ইব্রাহীমকেও কভার দিয়ে অন্যদিকে এগোলো আকাশ।
পিস্তলটা দুহাতে ধরে নিঃশব্দে এগোলো শেহরোজ মাস্টার বেডরুমের দিকে৷ অন্ধকারটা এমন যে চোখ সয়ে যায় না। নেহাৎ নাইট ভিশনের কারণে হান্টার টিম সবটাই দেখছে। ঘরে ঢুকে শেহরোজ আবিষ্কার করল কোনো মাস্টার বেডরুম নয়৷ এটা হলঘরের মতো বিশাল। আর একটু আগেও এখানে কিছু মানুষের উপস্থিতি ছিল৷ কানটা খাঁড়া করল সে। শুনতে চেষ্টা করল কিছু একটা—নিঃশ্বাসে শব্দ। কিন্তু সামনে কেউ নেই৷ বিড়াল পায়ে নিঃশ্বাসের শব্দকে অনুসরণ করল সে৷ পিছু পিছু শেহনানও এলো। ইশারায় শেহরোজ তাকে টেবিলের নিচে দেখাল৷ জবাবে বাঁকা হাসল শেহনান। দুজন টেবিলের দুদিকে পজিশন নিয়ে তারপর আচমকা নিচু হয়ে বসে পড়ল একই সঙ্গে। পেলো দুজন শিকারকে। সজীব আর দীপক। ভীত ইদুরের মতো কাঁপছে তারা পিস্তল হাতে বসে৷ হঠাৎ দীপক শেহনানের উপস্থিতি টের পেলো কী করে যেন— টর্চের আলো শেহনানের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে এক মুহূর্ত ব্যয় করল না সে৷ তার দেখাদেখি সজীবও একইদিকে আক্রমণ চালাল৷ কিন্তু ওদের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। দীপকের কপালের মাঝ বরাবর টিপ পরিয়ে দিয়েছে শেহরোজ৷ উষ্ণ রক্ত ছিটকে সজীবের চোখে-মুখে লাগল। দীপকের লাশটা ঢলে পড়ল তার গায়ের ওপর৷ ব্যাপারটা কী হয়েছে তা বুঝে উঠতেই তার কানের ভেতর এসে প্রবেশ করল শেহনানের ছোঁড়া বুলেট।
হলঘর ফাঁকা‚ আর কোনো শিকার এখানে নেই৷ দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে শেহরোজ ডাকল আকাশ আর ইব্রাহীমকে‚ “বয়েজ‚ তোমাদের কোনো আওয়াজ নেই কেন?”
“ইব্রাহীম ভাই একটার ভবলীলা সাঙ্গ করেছে। এ মুহূর্তে আমরা আসল টার্গেটের মুখোমুখি হতে চলেছি।” বলল আকাশ।
“তোমাদের পজিশন বলো ফাস্ট!” আদেশ করল শেহরোজ।
“একদম কর্নারের ঘরটা‚ ভাই। ওখানেই শব্দ পাচ্ছি। দুজন আছে ঘরে।”
“এগিয়ো না।” বলতে বলতে শেহরোজ শেহনানকে নিয়ে ছুটল সেদিকে। আর হঠাৎ তার মাঝেই গোলাগুলির আওয়াজ শুনল ওরা৷ তা শুনে জিজ্ঞেস করে উঠল শেহনান‚ “ঠিক আছো তোমরা।”
“ওরা এলোপাথাড়ি শুট করতে করতে এগোচ্ছে”‚ জানাল ইব্রাহীম।
শেহরোজ নির্দেশ করল‚ “নিচে চলে যান‚ ইব্রাহীম ভাই। আমি আর মেজর…” বলার মাঝপথেই শুনতে পেলো আকাশের আর্তনাদ।
“আকাশ কাঁধে গুলি খেয়েছে”‚ উত্তেজিত স্বরে অবগত করল ইব্রাহীম।
শেহরোজ শুনতে পেয়ে একই নির্দেশ দিলো‚ “তাকে নিয়ে নিচে চলে যান। কোনো শুট করবেন না। রমেশচন্দ্রকে জীবিত প্রয়োজন কিন্তু।”
কিন্তু ইব্রাহীম শিকারকে এত কাছাকাছি পেয়ে কেন যেন পিছু হটে পালাতে চাইলো না৷ সে সামনে দেখতে পেলো দুজন প্রায় একই শারীরিক কাঠামোর ব্যক্তিকে৷ অদ্ভুতভাবে তারাও মুখ ঢেকে ফেলেছে৷ যার জন্য সে সহজে চিনতে পারল না রমেশচন্দ্রকে৷ তবে রমেশচন্দ্রের উচ্চতার কথা মাথায় রেখে পালটা আক্রামণ চালাল সে৷ যেহেতু সে শত্রুর অবস্থান দেখছে‚ তাই টার্গেটদের গুলিবিদ্ধ করতে সফল। দুজনের শরীরেরই বুলেট ঢুকেছে৷ কেবল রমেশচন্দ্রের হাত আর পা লক্ষ করে গুলি করেছে সে—যাতে মরে না যায়। কিন্তু গুলি খেয়ে দুজনই ছুটে গেল কর্নারের ঘরটির আগের ঘরে।
আহত আকাশ কাঁধ চেপে ধরে করিডরে বসে আছে৷ ব্যথায় মাথা ঝিমঝিম করছে তার৷ বুলেটের শক্তিটা প্রচণ্ড। মনে হচ্ছে কাঁধ থেকে হাতটা ছিঁড়ে পড়ছে। শেহরোজ আর শেহনান তার কাছে পৌঁছতেই ইব্রাহীম এসে জানাল‚ “দুজনই আহত। কর্নারের আগের ঘরটাই ঢুকেছে।”
“আকাশকে নিয়ে নেমে যান জলদি”‚ বলল শেহরোজ। “ওর অবস্থা আরও খারাপ হলে বের হতে ঝামেলা হবে।”
“ভাই।” সাব্বিরের আতঙ্কিত গলা এলো আকস্মিক৷ প্রত্যেকে ইয়ারপিসে শুনল‚ “দুটো এলিয়ন আসছে ছুটে। রমেশচন্দ্র ওর ফোর্সকে ইনফর্ম করেছে নিশ্চয়ই।”
কথাটা শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি করল না শেহরোজ। রমেশচন্দ্রের খোঁজে ঘরটাই সাবধানে ঢুকে পড়ল সে। ভেবেছিল গুলি ছুটে আসবে কিংবা টর্চের আলো৷ কিন্তু ঘরের মাঝ বরাবর চোখ পড়তেই একটা লাশ দেখল পড়ে থাকতে। চারপাশে আর কোথাও দ্বিতীয়জনকে পেলো না৷ জানালাতে চোখ আটকালো ওর৷ লাশটাকে টপকে ছুটে এলো জানালার কাছে৷ কোনো সন্দেহ নেই দ্বিতীয়জন এদিক থেকেই পালিয়েছে। তাহলে লাশটা কার? ফিরে এসে লাশটার মুখ দেখে আবিষ্কার করল‚ রমেশচন্দ্র নয় সে৷ মুহূর্তেই রাগে‚ হতাশায় চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে উঠল ওর। ঘর থেকে বের হতেই শেহনানের মুখোমুখি হলো শেহরোজ। “পালিয়েছে”‚ জানাল শেহনানকে।
জবাব দিলো শেহনান‚ “তাহলে এক্ষুনি এখান থেকে বের হতে হবে৷ সাব্বির রিস্কে আছে।”
“কোনো টর্চার সেল নেই এখানে‚ রাইট?”
“না নেই। এই ব্যাপারে তবে আমার ভাইকে মিথ্যে ইনফরমেশন দিয়েছিল। ট্র্যাপে ফেলার জন্যই আরকি।”
“না থাকলেও জায়গাটাকে আর আড়ালে রাখার সুযোগ দেবো না৷”
সহমত দিলো শেহনানও‚ “জনসম্মুখে আর সাংবাদিকদের নজরে চলে আসে যাতে সে ব্যবস্থায় করা দরকার।”
ইব্রাহীম আকাশকে নিয়ে ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে। এদিকে শেহরোজ আর শেহনান কিছু জায়গা নির্বাচন করে কাঁধের হ্যাভারস্যাক থেকে এক্সপ্লোসিভ ফিট করল। এর মাঝেই সাব্বির শঙ্কিত গলায় জানাল‚ “লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়েছে গাড়িদুটো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ নামছে না গাড়ি থেকে।”
“রমেশচন্দ্রের সেইফলি আসার অপেক্ষায়”‚ জবাব দিলো শেহরোজ।
“ওকে ধরতে পারেননি?”
“না। চাইলেও আজ আর ধরতে পারব না ওকে।” মেজাজের সঙ্গে বলেই শেহরোজ নির্দেশ দিলো ইব্রাহীমকে‚ “আকাশকে নিয়ে বাড়ির সামনের দিকে চলে যান।”
তাই করল ইব্রাহীম। এরপর শেহরোজ আর শেহনান নিরাপদে সরে এসে প্রথমে বিস্ফোরণ ঘটাল লাইব্রেরির পেছনে৷ ভয়াবহ আওয়াজ হলো বিস্ফোরকের৷ একইভাবে বাড়ির আরও দুদিকে ঘটল বিস্ফোরণ। উত্তেজিত সাব্বির এর মাঝে জানাল‚ “রমেশচন্দ্রকে দেখেছি। একটা গাড়িতে উঠে পড়েছে। কিন্তু কীভাবে‚ কোনদিক থেকে ওই বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলো বুঝতে পারলাম না।”
আস্তানার আরও কত গুপ্ত পথ আছে তা জানা নেই হান্টার টিমের৷ তবে এক্সপ্লোসিভের কারণে রমেশচন্দ্রের বাহিনী বাড়িতে প্রবেশের সুযোগ‚ সাহস‚ কোনোটাই পেলো না। আর ঠিক এই সুযোগেই শেহরোজ ওর সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ির ডান পাশের উঁচু বাউন্ডারি টপকে। কিন্তু বাউন্ডারির ওপাশে কোনো বিপদ আছে কি-না তা ওদের জানা নেই।
সাব্বির গাড়িটাকে টেনে নিরাপদ স্থানে পিছিয়ে এনেছে৷ কারণ‚ বিস্ফোরণের আওয়াজ আশেপাশে থাকা যেসব সাধারণ মানুষের কানে গেছে‚ তারা চিৎকার চেঁচামেচি আর এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে। এতে অবশ্য লাভই হয়েছে ওর টিমের জন্য। শেহরোজ আর বাকিরা কারও মুখোমুখি হয়ে পড়লেও তারা ভাববে বোমা বিস্ফোরণের ভয়ে পালাচ্ছে। কিন্তু তবুও ভয় থেকেই যায়। রমেশচন্দ্রের বাহিনী কি এই অতর্কিত হামলার রহস্য উদ্ঘাটন না করেই কেটে পড়বে?
চলবে।
#শেহরোজ – ১৮
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***
দুটো এলিয়নেই এনএসআই-এর ইনটেলিজেন্স অফিসার। রমেশচন্দ্রকে আহত অবস্থাতে পেয়েই তাকে নিয়ে দুজন অফিসার বিদায় নিলো। বাদ বাকি সকলে বিস্ফোরণ শেষ হলেই ছড়িয়ে পড়ল বাড়ির চারপাশে।
বাউন্ডারি টপকে ইব্রাহীম আকাশকে নিয়ে দৌড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে শেহরোজ আর শেহনানের থেকে। তাই অফিসারদের নজরে পড়ে গেল ওরা দুজনই। মুহূর্তেই শুরু হলো ওদের লক্ষ করে গোলাগুলি।
ইব্রাহীম পৌঁছে গেছে গাড়ির কাছে৷ আকাশকে ভেতরে তুলেই পিছু ফিরে দেখল রাস্তার পাশ দিয়ে ছুটে আসছে তাদের টিমের সব থেকে যোগ্য দুই সদস্য। আর ওদের পেছন পেছন চারজন ইনটেলিজেন্স—গুলি ছুঁড়ছে লাগাতার। সাব্বির ইঞ্জিন চালু করে তাগিদ দিলো‚ “দাঁড়িয়ে থেকেন না‚ ইব্রাহীম ভাই। জলদি উঠে পড়ুন৷”
ভেতরে চলে এলো ইব্রাহীম। দরজা খুলে রাখল গাড়ির। সাব্বির স্টিয়ারিং হুইল ধরে প্রস্তুত হয়ে থাকল গাড়ি ছাড়ার। কিন্তু তাদের অপেক্ষার মাঝে আচমকা শেহনানের আর্তনাদ কানে এসে পৌঁছল। পায়ে গুলি খেয়েছে শেহনান। তা দেখতে পেয়েই ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তাদের৷ আকাশ জ্ঞান হারায়নি এখনো৷ ইব্রাহীমের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে নেতিয়ে আছে সে। নিজের ব্যথার মাঝেই চিন্তিত‚ শঙ্কিত সুরে জিজ্ঞেস করল ইব্রাহীমকে‚ “ওরা দুজন কি ধরা পড়ে গেল‚ ভাই?”
কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না ইব্রাহীম। শেহনান থেমে না পড়লেও গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। ওদের থেকে মাত্র দশ হাত দূরত্বে ইনটেলিজেন্স বাহিনী৷ ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনায় বেশি। কিন্তু সেটা তো হতে দেওয়া চলবে না।
শেহরোজ আর শেহনানের উচ্চতা আর স্বাস্থ্য প্রায় কাছাকাছিই। সামান্য বেশি হবে শেহরোজ শেহনানের থেকে৷ শেহনানের অবস্থা দেখে সে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটল। আর সে সময়ই গাড়ির দরজার মুখে বসে ইব্রাহীম গুলি আরম্ভ করল অফিসারদের লক্ষ করে৷ শেহনানের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল তাতে। ইব্রাহীমের দেখাদেখি সাব্বিরও হাত গুটিয়ে বসে রইল না৷ আচমকা সামনে থেকে গুলি ছুটে আসতে দেখে অফিসারগুলো থমকে গিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো৷
পৌঁছে গেল শেহরোজ। গাড়িতে বসা মাত্রই সাব্বির ছেড়ে দিলো গাড়িটা। শেহরোজ বসেছে সাব্বিরের পাশে৷ পেছনের সবাইকে শেহরোজ বলল‚ “যতটা সম্ভব সিটে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করবে।”
ফাঁকা সড়কে কালো হাইস কমিউটারের পেছনে ধেয়ে আসছে সাদা এলিয়ন। হাইসের দু পাশ দিয়ে কয়েকটা বুলেট বাতাসে শিস কেটে চলে গেল এদিক সেদিক। সাব্বিরের ড্রাইভিং দক্ষতা বরাবরই প্রশংসনীয়। গুলিগুলো যেন গাড়ির চাকাতে না এসে লাগে তার জন্য ডানে বামে বাউলি কেটে চলার চেষ্টা করছে। ফাঁকা সড়ক বিধায় ইচ্ছামতো চালাতে পারছে সে। তার এঁকেবেঁকে চলার কারণে ওরা ঠিকঠাক গুলি লাগাতে পারছে না গাড়িতে। কিন্তু এভাবেই বা কতক্ষণ? পিছু না ছাড়াতে পারলে মুশকিল৷ ম্যাগাজিনে গুলি ভরা হতেই কাজে নেমে পড়ল শেহরোজ। ঝুঁকি নিয়ে জানালার বাইরে শরীর অর্ধেক বের করে শুরু করল পালটা আক্রমণ। প্রথম বুলেটটাই এলিয়নের উইন্ডশিল্ড ভেঙে চৌচির করে দিলো। ওতেই হলো কাম তামাম। গাড়ির ড্রাইভার চমকে গিয়ে যেন থমকে পড়েছে৷ এবং গতি কমতে শুরু করেছে গাড়িটার। কেউ মরেছে কিনা তা বোঝার চেষ্টাও করল না শেহরোজ আর আক্রমণও থামাল না। পরপর আরও তিনটা বুলেট ছুঁড়ল সে। সামনের চাকার একটাতে গিয়ে আঘাত লাগল৷ পঞ্চম গুলিটা মাপঝোঁক করে পৌঁছে দিলো সে সামনের দ্বিতীয় চাকাটাই৷
এনএসআই কর্মকর্তাদের চিন্তাভাবনা করতে আসলে দেরি হয়ে গিয়েছিল বলেই পরিণতি ভালো হলো না তাদের৷ তারা ধারণা করেনি সামনের গাড়ি থেকে আক্রমণ এলেও এভাবে আসবে বা কেউ এভাবে ঝুঁকি নিয়ে গুলি ছুঁড়বে। তাদের এই ভাবতে না পারার সুযোগটাই দারুণ কাজে লাগাতে পেরেছে শেহরোজ।
নিশ্চিন্তে ভেতরে এসে বসল সে। সাব্বিরও আরামে ছুটতে থাকল গন্তব্যের পথে। আকাশ‚ ইব্রাহীম আনন্দিত হলেও শেহনান নাখোশ। বলে উঠল‚ “অপারেশন সাকসেস হলো না আমাদের৷ আজকের মতো সুযোগ আর পাবো না রমেশকে ধরার জন্য।”
এই ব্যাপারটা নিয়েই শেহরোজের মাথা গরম হয়ে আছে। “আমি তখন নিষেধ করেছিলাম গুলি ছুঁড়তে”‚ মুখোশটা একটানে খুলে রক্ষস্বরে বলল ও৷ “আমি কমান্ডো অ্যাটাক করতে চেয়েছিলাম।”
“কমান্ডো অ্যাটাক কী?” জিজ্ঞেস করে বসল সাব্বির। এমন কিছু তো তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি!
“সবকিছু অন্ধকার করে দিয়ে নক-আউট গ্যাস ছড়িয়ে হোস্টেজ সিচুয়েশনে চূড়ান্ত আক্রমণ চালায় স্পেশাল ফোর্স”‚ ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতেই জবাব দিলো শেহনান। “একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ ছড়াত ঘরটাই। ওই গন্ধ নাকে যাওয়া মাত্রই সেন্স হারাত রমেশ। গোলাগুলির প্রয়োজন পড়ত না‚ সে পালাতেও পারত না।”
সাব্বির মাথা দুলাল—বুঝতে পেরেছে ভঙ্গিতে। পরিকল্পনাটা আলোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু এটাকেই কমান্ডো অ্যাটাক বলে তা সে বোঝেনি৷ ওদিকে পেছনে বসা ইব্রাহীম জিভে কামড় দিলো৷ এই পরিকল্পনার কথা তার মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল। ভীষণ লজ্জা আর অপরাধবোধও জাগল মনে৷ আজকের অপারেশন ব্যর্থ হলো একমাত্র তার কারণেই। শেহরোজের মুখপানে তাকাল আড়চোখে। দাড়িভর্তি মুখটার কঠিন গম্ভীরতা দেখেই বুঝে গেল কী সাংঘাতিক রেগে আছে সে। নিশ্চয়ই এও ভাবছে—অপদার্থ যোদ্ধা তার টিমের সদস্যগুলো! এবং এ ভাবনা আসলেই সত্য৷ এসপিওনাজ দুনিয়ার একজন দুর্ধর্ষ স্পাই এজেন্টের কাছে তার মতো অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা অযোগ্যই। এবার আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করছে ইব্রাহীম‚ কেন শেহরোজ একা এই মিশনের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল আর কেন ওদের প্রতি চরমভাবে বিরক্ত ছিল শুরুতে!
***
বেলা ৫:৩০ টা।
মাথার ওপর ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে। থমথমে চেহারায় ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছে শাজ টেবিলের এক প্রান্তে৷ আর অন্য প্রান্তে বসে মোচড়ামুচড়ি করছে ওর দুই ছাত্র-ছাত্রী। সাথে অঙ্কও কষছে।
সেই দুপুরে শাজ ঢুকেছে মিনা আন্টির বাসায়। সে আর ওর ছাত্র-ছাত্রীও একইভাবে বসে আছে এক নাগাড়ে তিন ঘণ্টা। বলা ভালো বসতে থাকতে বাধ্য হয়েছে ওরা৷ কারণ হলো—গত এক মাস সে পড়াতে আসতে পারেনি। তাই জঘন্য বদমেজাজি মিনা আন্টি এক মাসের পড়া ছেলে-মেয়েকে বসিয়ে আজ একদিনেই ওর থেকে আদায় করিয়ে নিতে চায়। কোনোভাবেই সে ওকে সন্ধ্যা ছটার আগে এখান থেকে বের হতে দেবে না। চুপচাপ মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো গতিও নেই। নয়ত তার হেঁড়েকন্ঠশ্রী ওর কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবে।
কিন্তু এ মুহূর্তে মিনা আন্টির থেকেও রাগটা কাজ করছে বেশি ওর নিজের চাচার ওপর। একটু আগেই কল করেছিলেন ওকে খালিদ উসমান। তার কলের অপেক্ষায় ছিল শাজ সকাল থেকে৷ তিনি মূলত এতখানিই ব্যস্ত থাকেন নিজের পেশাতে—তাকে কল করা মাত্রই ফোনের ওপাশে পাওয়া মুশকিল৷ অথচ ঝুমা শেখ তাকে যখন তখন কী করে ফোনে পায় কে জানে!
চাচার সঙ্গে কথা বলেছে শাজ দক্ষিণখানের বাড়িটির ব্যাপারে। শেহরোজকে কেন তিনি বাড়ি ভাড়া দিতে গেলেন তা সে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন খালিদ সাহেব‚ “ঝুমার রিকুয়েস্টে রাজি হতে বাধ্য হলাম‚ আম্মু। সেদিন হঠাৎ ফোন করেই ভাই…ও ভাই করে উঠে এমনভাবে রিকুয়েস্ট শুরু করল ওই ছেলের জন্য! তুই তো জানিস ওর নাটুকে স্বভাব। আমি পাছে বললাম ছেলের খোঁজ খবর না নিয়ে আর তোর পারমিশন না নিয়ে রাজি হতে পারছি না। তো ছেলের যা ব্যাকগ্রাউন্ড জানাল তাতে মনে হলো ভালো সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। আমি সময় চেয়ে ওর ভার্সিটিতে ওর ব্যাপারে খবরও নিতে পাঠিয়েছিলাম। বছর দুই ধরে মানুষ বিশ্বাস করা তো মুশকিল৷ কিন্তু ওই ছেলের ব্যাপারে বেশ ভালো রিপোর্টই পেলাম।”
“সে বাকিংহাম প্যালেসের প্রিন্স উইলিয়াম হোক”‚ দাঁত চেপে কটমটিয়ে বলে উঠল শাজ। “তাও তোমার রাজি হওয়া উচিত হয়নি‚ কাকু। কীভাবে পারলে আমার ইমোশনকে হার্ট করতে?”
“আহা সোনা! রাগ কোরো না‚ বাচ্চা। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করেই রাজি হয়েছি৷ মূলত রাজি হতে বাধ্য করেছ তুমিই। ঝুমা বলল সেদিন কারা যেন তোমার ওপর অ্যাটাক করেছিল‚ তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে চাইছিল তারা। আমি এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলেছি আমার পরিচিত কিছু লোককে। তারা যতদিন না এ ব্যাপারে কোনো ভালো খবর দিতে পারছে‚ ততদিন আমি তোমার বাইরে বের একা যাতায়াত অ্যালাও করছি না। তাছাড়া তুমি হুটহাট একা একা ওই বাড়িতে গিয়েও থাকছ আজ-কাল৷ আমি আগেই বলেছিলাম ওখানে থাকতে হলে তোমাকে তোমার দাদী আর কেয়ারটেকার মঞ্জুরকে নিয়ে থাকতে হবে৷ কিন্তু তুমি সেটা মানছ না৷ ওখানে তুমি একা গিয়ে এক সপ্তাহ কেন‚ তোমাকে একদিন থাকতে দিতেও রাজি না আমি। আবার তুমি তোমার দাদীকে নিয়ে থাকতেও চাইছো না। তাই চিন্তা করলাম তোমার ওখানে একা থাকাটা বন্ধ করতে হলে ঝুমার কথামতো ভাড়া দিয়ে দেওয়ায় ভালো। আর আরেকটা নির্দেশনা তোমার জন্য। আপাতত ভার্সিটি যাওয়াটা বন্ধ রাখতে হবে তোমাকে৷ পড়াশোনা থেকে জীবনের মূল্য বেশি। এই বিপদ না কাটা পর্যন্ত তুমি কোথাও বের হতে পারবে না একা একা।”
এইতো! এরপরই চাচার সঙ্গে শাজ পনেরো মিনিট যাবৎ তর্কবিতর্ক করে এক অদ্ভুত হুমকি দিয়ে চাচার সিদ্ধান্তের কাছে হার মানে। ওর হুমকি—শেহরোজ ওই বাসাতে থাকলে সেও গিয়ে থাকতে শুরু করবে ওখানেই৷ তখন চাচা কী করে শেহরোজকে ওর সঙ্গে একই ছাদের তলায় সহ্য করেন সেটাই দেখবে সে। কিন্তু এই হুমকির চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার হলো—খালিদ উসমান এ কথাগুলো শুনেও কোনো তোয়াক্কাই করেননি। আর তাতেই জেদটা আরও বেশি চেপে গেছে শাজের মনে। ওই বাড়িতে সে শেহরোজকে কখনোই মানবে না। উচ্ছেদ করিয়েই ছাড়বে সে শেহরোজকে। কঠিন এই জেদ থেকেই শাজ দখল করতে ছুটবে নিজের বাড়িকে—এ কথা খালিদ সাহেব ভালোই জানেন।
মাঝেমধ্যেই শহরের বাইরে সম্পূর্ণ একা সময় কাটানোর হুজুগ চাপে ওর। যেহেতু ঢাকার বাইরে কোথাও একা যাওয়ার অনুমতি‚ সুযোগ‚ কোনোটাই নেই। তাই যখন মন চায় তখনই সে চলে যায় দক্ষিণখানে নিজের একাকী পড়ে থাকা বাড়িটাতে। তারপর যে কদিন ইচ্ছা হয় সে কদিন একার মতো একা কাটায় ওখানে৷
তবে শাজের হুমকিকে তোয়াক্কা না করার কারণ‚ খালিদ উসমান নিজেই চান শাজ ওই বাড়িতেই থাকতে শুরু করুক। সেখানে কেবল শেহরোজই তো থাকছে না৷ আড়ালে সাব্বির ওরফে শাজের একমাত্র ভাই আইয়াজও থাকছে।
গুলিস্তানে শাজ আর এখন নিরাপদ নয় এবং ওখানে নিরাপত্তার বেষ্টনী দেওয়াও সম্ভব নয় ওকে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে এসবের কোনো কথায় আপাতত ওকে বুঝতে বা জানতে দেওয়াও চলবে না৷ বরং শেহরোজের পরিচয় জানলেই বিচ্ছিরিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে শাজ৷
শেহরোজকে অবিশ্বাস তো করবেই—খালিদ উসমান আর আইয়াজকেও ভুল বুঝবে ও। আইয়াজকে তো শাজ রীতিমতো পরই ভাবে। কারণ‚ বাংলাদেশের চেয়েও পরদেশ আমেরিকাকেই আপন মানে আইয়াজ।
এবং খালিদ সাহেব যথেষ্ট জানেন ভাতিজির রাগ‚ অভিমান আর জেদ কেমন। যে সত্য মেয়েটা তাকেও জানাতে ভরসা পায়নি—তা উদ্ঘাটন করতেই ভিনদেশী স্পাই এজেন্টকে পাঠিয়েছেন তিনি। এ কথা জানা মাত্রই যে শাজ রাগে-দুঃখে সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলবে।
ঠিক সন্ধ্যা ছটাতেই শাজ মুক্তি পেলো দজ্জাল মহিলা মিনার থেকে৷ বাসা থেকে বের হওয়ার পর রাস্তায় এসে উঠতেই ওর চলা থেমে গেল সামনে এক সিএনজি চালককে দেখে। “এটা সেদিনের সেই লোকটাই তো! বাহ্‚ আবার দেখা হয়ে গেল?” মনে মনে বলে সে এগিয়ে এলো সিএনজির কাছে‚ “আসসালামু আলাইকুম‚ মামা। চিনেছেন আমাকে?”
কর্নেল রাশিদ কপট চমকানোর ভঙ্গিতে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত শাজের মুখপানে চেয়ে চিনতে চেষ্টা করার নাটকটাও করলেন নিখুঁতভাবে। তারপর হঠাৎ ফিক করে হেসে বললেন‚ “আম্মাজান আপনে? ওয়ালাইকুমসসালাম। ভালা আছেননি? আসেন আসেন উইডা পড়েন। দ্যাকছেন আল্লাহই আবার আমাগো মুলাকাত করাইয়া দিলো?”
শাজ মুচকি হেসে উঠে পড়ল ভেতরে৷ “ঠিকই বলেছেন। আজকে গুলিস্তান চলেন।”
“আইচ্ছা। আইজক্যা কিন্তু আপনের সেদিনের বাড়তি ট্যাহা ফেরত দিমু।”
না করতে গিয়েও করল না শাজ কর্নেলের গলায় জেদ বুঝতে পেরে। জবাবে হাসল শুধু৷
পরমুহূর্তে বাসায় পৌঁছেই সে তাড়া দিলো দাদীকে—জামা-কাপড় গোছগাছ করে নেওয়ার জন্য৷ ইতোমধ্যে আয়শা খাতুনকে খালিদ সাহেব রাজি করিয়ে নিয়েছেন শাজ বাসায় ফেরার পূর্বেই৷ তাই কোনো কথা বাড়ালেন না বৃদ্ধা৷ একদম রাত আটটার মাঝে জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে শাজ বেরিয়ে পড়ল বাসা থেকে। ঝুমা শেখকে কোনো প্রকার বিদায় জানিয়ে এলো না সে‚ কেবল মহিলা শেহরোজের পক্ষে থাকার জন্য। তবে সে জানে‚ মহিলা রণচণ্ডী হয়ে কালকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে দক্ষিণখানের বাড়িতে।
খয়েরী রঙা হ্যাচব্যাক গাড়ির বুটে সমস্ত জিনিস নিজেই তুলে দিয়ে শাজ বসল গিয়ে ড্রাইভিং সিটে। আজ গাড়ি চালাবে সে-ই। কারও কোনো সাহায্য নেবে না৷ পাশের সিটে দাদী কোলে বুস্তানকে নিয়ে বসেছেন। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে ওর হ্যাচব্যাক রাস্তায় ওঠা মাত্রই পেছন পেছন চলতে শুরু করল সাদা টয়োটা৷ এবং চালকের স্থানে আইয়াজ আর তার পাশেই বসা কর্নেল রাশিদ।
***
নক্ষত্রনিবাসের বেসমেন্টটা মোটামুটি বড়োই। যেখানে পাঁচজন পুরুষ আরামেই থাকতে পারছে‚ ঘুমাতে পারছে। যেমন এ মুহূর্তে বিছানায় চিৎপটাং হয়ে আছে আহত আকাশ। আর তার ড্রেসিং বদলে দিচ্ছে মেডিক ইব্রাহীম। ভোররাতে ব্যর্থ মিশন থেকে ফিরেছে ওরা সবাই৷ তারপর গুলিবিদ্ধ শেহনান আর আকাশের গুলিগুলোকে ইব্রাহীম বের করে ফেলার পর পালাক্রমে ওদের সেবাশুশ্রূষা করেছে সবাই মিলেই। তবে ওদেরকে মুগ্ধ করে হান্টার টিমের মেজাজি কমান্ডার শেহরোজই বেশি পাশে থেকেছে আহত সঙ্গীদের। এজন্য বাকি সবার ঘুম পরিপূর্ণ হলেও তার ঘুমটা ঠিকঠাক হয়নি৷
বিকাল চারটার দিকে শেহরোজ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। এখন বাজে রাত দশটা প্রায়৷ বালিশের পাশে রাখা ফোনটা হঠাৎ ভাইব্রেট করে ওঠে তার। গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকলেও বিছানা কেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঝট করে চোখ মেলল সে—সহজাত অভ্যাস। সাব্বির কল করছে। বিরক্তি নিয়ে ফোন কানে ঠেকাল‚ “বলো কতদূর?”
“আর মাত্র সাত-আট মিনিট‚ ভাই৷ ইব্রাহীম ভাই রেডি আছে তো?”
“বেসমেন্টের ঘরে মনে হয়। ডাকছি আমি।”
সাব্বির ফোন কাটলে বিছানা ছাড়ল শেহরোজ। ইব্রাহীমকে কল করতে করতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখদুটো রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে তার। অপারেশন সফল হয়নি আবার ঘুমটাও ঠিকঠাক হয়নি বলে মেজাজটা বেশ খিটমিট হয়ে আছে। ইব্রাহীম ফোন রিসিভ করলে তাকে বলল‚ “শাজ বাসার কাছাকাছিই। আপনি রেডি?”
“চুলে তেল লাগানো শেষ হলেই রেডি‚ ক্যাপ্টেন।”
“ওয়ান মিনিট বরাদ্দ”‚ বলেই ফোনটা কেটে সে ঘরের স্লাইডিং ডোর খুলে চলে এলো ছোটো সুইমিংপুলটার কাছে।
উন্মুক্ত গা‚ পরনে কেবল হাফ প্যান্ট‚ আর সব সময়ের ঝুঁটি বাঁধা চুলগুলো খোলা। হিমেল হাওয়ায় তা উড়ছে এলোমেলো। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে শেহরোজ মুখ তুলে চেয়ে আছে আকাশপানে। আজ বিশাল এক চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রুপালী আলোয় চিকচিক করছে পুলের পানি। এ বাড়ির চারপাশে বেশ উঁচু করেই পাঁচিল তুলে দেওয়া। তাই নিজের সীমানার মাঝে ওমর সাহেব গাছ লাগিয়েছেন স্বাধীনভাবে। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই চোখে পড়ে দেবদারু‚ নিম‚ সুপারি‚ নারিকেল‚ কৃষ্ণচূড়া‚ কাঁঠাল‚ লিচু আর আম গাছও। শহরের কাছাকাছি এমন সবুজ প্রকৃতির মাঝে এই নক্ষত্রনিবাস যেন সত্যিই স্বপ্নমহল। লম্বা করে শ্বাস টেনে নিলো শেহরোজ। মনটা একটু ভালো লাগছে। পুরোপুরি ভালো করার জন্য সাঁতরানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। নিমিষেই ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলের মাঝে।
ওদিকে‚ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শাজ বিরতিহীন কলিংবেল চাপতে শুরু করল। তা দেখে দাদী ধমকে উঠলেন‚ “এই ছেড়ি‚ থামেক! কেয়াটিকার আসব তো না-কি?”
কথাটা শাজ কানেই তুলল না। গাড়ি থেকে নামার পরই ওর মনে হয়েছে বিরাট এক ভুল করে ফেলেছে সে আরও দ্রুত না এসে। তখন থেকেই বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছে‚ “আমার পুল… আমার পুল!” শেহরোজ এ বাসার কোন ঘরটি দখল করেছে—মূলত এই চিন্তাতেই ও অস্থির।
দরজাটা খুলে ওদের সামনে দাঁড়াল ইব্রাহীম। পরনে তার চেক লুঙ্গি আর হাফ হাতা হলুদ গেঞ্জি৷ চুলে মাখা একগাদা সরিষা তেল৷ তা আবার পরিপাটি করে এক পাশে সিঁথি কাটা‚ তার ওপর দেওয়া মাথায় টুপি। দুপুর থেকে পান চিবুতে চিবুতে মোটামুটি একটা লালচে রং এনেছে ঠোঁটে আর দাঁতে। এমনকি এ মুহূর্তেও তার মুখের ভেতর পান গোঁজা। সেটা গালের এক পাশে জমা করে লম্বা এক সালাম দিলো আয়শা খাতুনকে‚ “কিমুন আছেন‚ ও খালা? আমি বাবর। চিনবের ফারছেননি?”
কানে কম শুনলেও চোখে ঠিকঠাকই দেখেন বৃদ্ধা। তাই মোটেও চিনলেন না ইব্রাহীমকে‚ চেনার কথাও না৷ তবুও তার দুর্বল স্মৃতিশক্তির সুযোগ নিয়ে ইব্রাহীম গড়গড় করে মিথ্যা আরম্ভ করল‚ “আমি আফনের গিরামেরই ছাওয়াল‚ খালা। খালিদ ভাই কইছিল মঞ্জুর ভাইরে থাকপার। মঞ্জুর ভাই ব্যবসা ধরিছে তো৷ তাই হেতে আমারে এহানে কামে লাগায় দেছে।” বলা শেষেই দন্তবিকাশ হাসি দিলো সে৷ আর সেই হাসি দেখে শাজ বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল‚ “বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বায়োডাটা দিচ্ছেন আপনি?”
অর্ধেক বের করা জিভ কেটে কানে ধরল ইব্রাহীম। জলদি দুজনের মালপত্র ভেতরে আনা শুরু করলে শাজ স্কার্ট হালকা তুলে ধরে ছুটল ওর ভাইয়ের ঘরটাই৷ যে ঘরটা আইয়াজের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন ওমর সাহেব৷
“আমার পুল! ইয়া আল্লাহ‚ আমার পুল কি সহিসালামত আছে?” বলতে বলতেই আইয়াজের ঘরে ঢুকল শাজ। এক সেকেন্ড দাঁড়াল না স্লাইডিং ডোর খোলা দেখতে পেয়ে। দৌড়ে বেরিয়ে এলো সে ছাদে৷ আইয়াজের ঘরটা ছাদের সঙ্গেই সংযুক্ত। আর ছাদেই ছোটো পুলের ব্যবস্থা করেছেন ওমর ছেলে-মেয়ে আর সব থেকে বেশি বউয়ের শখকে মাথায় রেখে৷ বউ না থাকলেও ছেলে-মেয়ে তো আছে। এই ভেবেই বড়ো ভাইয়ের থেকেও অর্থ সাহায্য নিয়ে বাড়িটাকে স্বপ্নের মতোই বানিয়েছেন তিনি।
ছাদের আলো নেভানো থাকলেও চাঁদের আলোয় শাজ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে—গৌর বর্ণের কোনো এক পুরুষ পুলের এপাশ থেকে ওপাশ কী দারুণ ভঙ্গিতে সাঁতরে চলেছে। মুগ্ধই হলো সে৷ এত ভালো সাঁতার সে জানে না বলেই কি? উহুঁ‚ ভেজা শেহরোজকে চিনতে ওর অসুবিধা হয়নি৷ এমন পেশীবহুল বলিষ্ঠ শরীরের পুরুষকে খোলা বেশে দেখে প্রেমে পড়ার আগ মুহূর্তে নারী মন যেমন মুগ্ধ হয়‚ সেও হয়েছে তাই। কী এক আবেশে ডুবে অজান্তেই মন্থর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল সে পুলের পাড়ে। নির্নিমেষ দেখল কিছুক্ষণ শেহরোজকে। তারপর দেখল পূর্ণ নক্ষত্ররাজকে আর ঝিরঝিরে বাতাসে দোল খাওয়া প্রকৃতিকে। শেহরোজের কাছাকাছি এলেই বুকের ভেতর কেন যে ডামাডোল শুরু হয়! সেই ডামাডোলে সব কিছুই ওলট-পালট হয়ে যেতে চায়।
মুখে অকস্মাৎ পানির ঝাপটা এসে লাগল শাজের আর অমনি ছিটকে বেরিয়ে এলো সে এলোমেলো অনুভূতির কল্পজগত থেকে।
“হচ্ছেটা কী‚ হুঁ? কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে এভাবে দেখছ আমাকে?” হাত পানির ওপর দু পাশে মেলে দাঁড়িয়ে পড়েছে শেহরোজ।
তার অমন সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে শাজ বিব্রত হলো‚ “দেখছি মানে? কীভাবে দেখছি?”
“দ্য ওয়ে নটি গার্লস লুক উইথ নটি আইস।”
অপ্রতিভ শাজ ব্যাপারটাকে চাপা দিতে দ্রুত গম্ভীর হলো। “আমার পুলে আপনি কী করছেন সেটা বলুন”‚ রূঢ়তার সঙ্গে বলে উঠল। “বাড়ি ভাড়া পেয়েছেন বলে বাড়ির যেখানে খুশি সেখানে প্রবেশাধিকার আপনাকে দিচ্ছি না‚ বুঝেছেন? ফার্স্ট টাইম ছাড় দিলাম। সেকেন্ড টাইম ভুল রিপিট হলে তখনই বেরিয়ে যেতে হবে কিন্তু।”
শান্ত‚ নির্বিকার চেহারায় শেহরোজ কয়েক পল শাজকে দেখে হঠাৎ এগিয়ে এলো ‚ যেখানে শাজ দাঁড়ানো। জিজ্ঞেস করল‚ “বেরিয়ে যেতে হবে? কোথায় বেরিয়ে যেতে হবে?”
“কোথায় আবার? এ বাড়ির বাইরে।” শেষ কথাটা কিন্তু সম্পূর্ণ বলার সুযোগ পেলো না শাজ৷ তার আগেই নাকে-মুখে গলগলিয়ে পানি ঢুকতে আরম্ভ করল ওর৷ পাশেই শেহরোজ দাঁড়িয়ে ওর নাকানিচুবানি খাওয়া দেখতে থাকল চুপচাপ৷ কথাটা শেষ করার আগেই ওর পা টেনে ধরে পানিতে ফেলে দিয়েছে সে। মেজাজটা ঠিকঠাক হয়নি তার এখনো৷
#চলবে।