শেহরোজ পর্ব-১৯+২০

0
364

#শেহরোজ – ১৯
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

“পেট ভরেছে?” শাজকে টেনে তুলে দাঁড় করাল শেহরোজ।

খুক খুক করে কাশছে শাজ। হাঁপাচ্ছেও বেশ। সত্যিই পানি খেয়ে ফেলেছে অনেক। সাঁতার তেমন জানা নেই বলেই ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমন অবস্থার পর শেহরোজের বিকারশূন্য চেহারা দেখে আর প্রশ্নটা শুনে রাগে মাথা এলোমেলো হয়ে গেল ওর৷ তেড়েমেরে মারতে উদ্যত হলো সে‚ “খচ্চর বুলডগ! আপনার কত বড়ো…” শেহরোজের ইস্পাত-দৃঢ় বুকটার সঙ্গে গিয়ে বাড়ি খেতেই কথা থেমে গেল। ওর মুষ্টিবদ্ধ হাতটা শূন্য সেকেন্ডের মাঝে শেহরোজ খপ করে হাতের মুঠোতে চেপে ধরেই এক ঝটকায় ওকে নিজের কাছে টেনে এনেছে।

“সাহসের সাইজ তো তুমি দেখোইনি‚ মাই রোজিয়েট।”

“রোজিয়েট কে?” তেতে উঠল শাজ।

“হোয়াট আ ম্যাডেন্ড অ্যারোমা”‚ শাজের কথার জবাব না দিয়ে হঠাৎ ওর কাঁধের কাছে হাতটা নাড়াল শেহরোজ—ওর শরীরের ঘ্রাণ বাতাসে টেনে আনার জন্য। “পানিতে ভেজার পরও এত স্ট্রং স্মেইল কেন তোমার পারফিউমের? তোমার এই রোজ স্মেইল পারফিউমটার নামটা কী বলো তো আমাকে? আগেও যতবার পেয়েছি ইট হ্যাজ অলওয়েজ ফ্যাসিনেটেড মি। ইজ ইট পিয়োর রোজ অ্যারোমা?”

“ইটস নট আ পারফিউম স্মেইল”‚ শেহরোজকে ধাক্কা দিয়ে বলল শাজ। “ইটস মাই বডিস অওন ফ্রেগ্রেন্স।”

“রিয়্যালি?” অকস্মাৎ এগিয়ে এসেই শাজের গলার পাশে নাক ডুবাল শেহরোজ। চোখ বুজে লম্বা করে শাজের শরীরের সুবাসটুকু টেনে নিলো।

স্তম্ভিত শাজ মুহূর্ত মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়ায় দেখাতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত পর শেহরোজ নিজেই সরে এলো আর ওকে বলে বসল‚ “তুমি দেখি দারুণ রাগের সঙ্গে দারুণ মিথ্যাও জাহির করতে পারো! এটা হতেই পারে না তোমার নিজস্ব সুবাস। আমার মায়ের শরীরের ঘ্রাণও মিষ্টি৷ বাট দিজ ফ্রেগ্রেন্স ইজ কমপ্লিটলি ডিফ্রেন্ট। কোনো মানুষের নিজস্ব সুবাস এমনটা হয় না।”

“তাই বলে আপনি এভাবে এসে…” রাগ‚ লজ্জায় গলা বুজে এলো শাজের। সেই সুযোগে শেহরোজ আরও অপ্রস্তুত করতে জিজ্ঞেস করল‚ “আমি এভাবে এসে কী?”

সে কথার জবাবই দিলো না শাজ। অত্যন্ত রেগে বলল‚ “অভদ্র লোক! আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব মানুষের শরীর শুঁকে বেড়িয়েছেন!”

একটু হাসল শেহরোজ। “সব মানুষের শরীর শোঁকার সুুযোগ না হলেও বেশ কিছু ফ্লুজির শরীর তো শুঁকতেই হয়েছে”‚ উত্তরটা ঠোঁটের ডগায় চলেই এসেছিল প্রায়৷ কিন্তু মুখ থেকে বের হতে দিলো না।

“আপনার জানার বাইরেও অনেক কিছু থাকতে পারে‚ বুঝেছেন? এটা আমার শরীরের নিজস্ব সুবাস। বিশ্বাস করলে করুন‚ না করলে নাই।”

“আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু কারণ তো থাকবে তার৷ কেন তোমার শরীরের স্মেইল রোজ স্মেইল হলো? অন্য কোনো ফুলের সুবাসও তো হতে পারত।”

“পারত।” রাগ নিয়েই তাচ্ছল্যপূর্ণ হেসে জবাব দিলো শাজ‚ “যদি আমার মা আমাকে পেটে রেখে রাক্ষসের মতো কাশ্মীরের রোজ গুলকান্দের বদলে অন্য কোনো ফুলের গুলকান্দ খেত তাহলে হতে পারত।”

“গুলকান্দ?” প্রশ্ন চোখে তাকাল শেহরোজ‚ “হোয়াটস দ্যাট?”

“সুইট।” তীক্ষ্ণ সুরে বলেই শাজ উঠে পড়ল।

শেহরোজও উঠে এলো পুল থেকে। ছাদের লাইট সে জ্বালাতেই শাজ পুলের আশেপাশে তোয়ালে খুঁজল। না পেয়ে জিজ্ঞেস করল শুষ্ক গলায়‚ “টাওয়াল নেই এখানে?”

নীরবে মাথা নাড়ল শেহরোজ৷ দৃষ্টিজোড়া হঠাৎ তার থমকে পড়ল শাজের ভেজা শরীরে। শাজ তা খেয়াল না করে বরং তোয়ালে না পেয়ে আবারও রেগে উঠল‚ “এখন তাহলে ভেজা গায়ে ঘরে যেতে হবে? অসহ্য! আর কক্ষনো যদি আমার পুলে নামেন আমি আপনার…” ওই অবদিই থেমে গেল সে—হঠাৎ শেহরোজকে এগিয়ে আসতে দেখে৷ ভাবল‚ এবার ধাক্কা মেরে ওকে পুলে ফেলবে বোধ হয়৷ তাই দ্রুত দুপা পিছিয়েও এলো আর বলল‚ “এটা আমার বাড়ি কিন্তু!”

এসে থামল শেহরোজ শাজের খুব কাছে। “আর যদি”‚ প্রগাঢ় চাউনিতে ওকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতেই বলল সে ঘন স্বরে‚ “তুমিই আমার হও‚ তাহলে?”

“হবো না… কখনোই না”‚ শেহরোজের চোখে চেয়ে অকপটে বলে দিলো শাজ।

নীরবে শুনলও শেহরোজ। কিন্তু শাজের কথার বদলে মনোনিবেশ ঘটাল সে শাজের মাঝে৷ চারটা মাস হলো এই মেয়েটির আশেপাশে সে৷ কাছাকাছি আসা হয়তো চারটা দিন। চার মাস চারদিন পর আজ প্রথম সে আবিষ্কার করল এবং আশ্চর্য হলো—শাজ ওকে রীতিমতো আকৃষ্ট করছে! ওর মাঝারি কপাল‚ ছোটো কালো ভ্রু‚ ত্রিভুজাকৃতি মুখ‚ গভীর উপবিষ্ট তৃণমনি চোখ‚ সামান্য খাঁড়া নাক‚ শক্তিশালী চোয়াল‚ হালকা পুরু ঠোঁট‚ ছোটো তীক্ষ্ণ চিবুক‚ আকর্ষণীয় গলা ও ঘাড়‚ সবই আজ খুঁটে খুঁটে দেখছে সে। এমনকি ভেজা সাদা শার্টের কারণে ভেসে ওঠা শাজের মাঝারি আকৃতির উরোজও তাকে প্রলুব্ধ করছে বেশ। এই যে নাকের ডগায় রাগ নিয়েও তাকে উলটোপালটা কথা শুনিয়ে যাচ্ছে! শুনতে তাও সুন্দর লাগছে৷ কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে ওর শরীরে গোলাপের এই নিখাদ সুবাস… এই একমাত্র সুবাস তার মন আর মস্তিষ্ককে সম্মোহন করতে চাইছে যেন। তার মনে হচ্ছে কোনো গুলকান্দ নয়‚ গোলাপের সমুদ্রে ডুবে থাকে শাজ। কথাটা ভাবতেই সম্মোহিতের মতোই ওর আরও কাছে এলো। “ওহ মাই রোজ বে”‚ ডেকে উঠল মৃদুস্বরে। “ইফ আই ওয়ান্ট ইউ টু বি মাইন”‚ একটু থেমে ওর ঠোঁটের কোনে আঙুল ছোঁয়াল‚ “দেন ইউ উইল বি।”

বীরদর্প কণ্ঠে হঠাৎ হঠাৎ এই একেকটি সম্বোধন শাজের পেটের মাঝে কেমন পানির বুদ্বুদের মতো শিরশিরে অনুভূতিগুলো উছলায়‚ বুকের বাঁয়ে ধাক্কা দেয়। ভাবায়‚ সম্বোধনগুলোতে কি শেহরোজ অনুভূতি মেশায়? না-কি ছল করেই কেবল ডাকে ওকে?

ঠোঁটের কোনা থেকে শাজ সরিয়ে দিলো শেহরোজের হাতটা। তার দুর্ভেদ্য দু চোখে অনিমেষ চেয়ে ভাবনায় বুঁদ হলো—কয়েকটা দিনে প্রত্যক্ষ‚ পরোক্ষ‚ সবভাবেই শেহরোজ প্রণয় প্রস্তাব রাখছে ওর কাছে৷ কখনো মনে হচ্ছে সে আসক্ত ওর প্রতি‚ কখনোবা মনে হচ্ছে পুরোটাই তার ছলনা। বিশ্বাসটুকু ও গত দু বছরে কারও প্রতিই ঠিকঠাক করে উঠতে পারছে না৷ রনি আর অয়নের প্রতি না ছিল কোনো অনুভূতি আর না ছিল বিশ্বাস‚ ভরসা। কিন্তু কাছে থাকা এই ছেলেটি রাতদিন নিজের ভাবনাতে ওকে মশগুল রাখছে৷ তবুও তাকে নির্দিষ্ট একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ছকে ফেলতে পারছে না৷ বিভ্রান্ত হচ্ছে নিজের ভাবাবেগ নিয়েও৷ মাত্র চারদিনে শেহরোজকে ঘিরে যে মন উচাটন করা অনুভূতি হয়‚ তা কারও জন্য হয়নি কখনো৷ ইচ্ছা হয়েছিল তাকে বিশ্বাস আর ভরসা করার‚ যে ইচ্ছাও কারও জন্যই জন্মায়নি। অথচ গতকালের পর থেকে এই ইচ্ছাও উবে গেছে আর তারপর থেকেই মনে একরত্তি শান্তিটুকুও নেই৷ কারণ‚ যে অনুভূতি ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মন আকাশে তাও যদি হারিয়ে যেত তাহলে এমন ছটফটানির মাঝে দিন কাটাতে হত না। যেভাবে রনি আর অয়নকে দূর করতে পেরেছিল মন থেকে‚ সেভাবেই তবে দূর করতে পারত শেহরোজকেও।

এ মুহূর্তে আর বুঝল না শেহরোজ শাজের ভাবনাগুলো৷ কারণ‚ তার খেয়ালই নেই শাজের অভিব্যক্তির দিকে৷ বিনা মেঘে হঠাৎ বৃষ্টির মতো তার হৃৎ জমিন যে মাদক অনুভূতি ভিজিয়ে তুলছে‚ তাতে সে পিছলে গিয়ে কুপোকাত। বিনা অনুমতিতেই ছুঁতে মন চাইছে শাজকে‚ পেতে ইচ্ছা করছে নিবিড়ভাবে ওকে। দ্বিতীয়বার ছোঁয়ার লোভকে মানাতে না পেরে এবার তাই আঙুল ছোঁয়াল শাজের অধরে৷ অপলক দেখল সেই ওষ্ঠাধর; লিপগ্লস মাখা ভেজা ঠোঁটদুটি সুন্দর। আকৃষ্যমাণ শেহরোজ তখন ভাবনায় মগ্ন শাজের কানেকানে ফিসফিস করল‚ “ইয়োর লাশাস লিপস উফ্…! ক্যান আই বাইট অ্যান্ড সাক ইয়োর লিপস জেন্টলি?”

মুহূর্তেই জবাব পেলো শেহরোজ খুব অন্যন্য উপায়ে। কোনো বলিষ্ঠ হাতের ঘুষিটা হলে নাকটা নির্ঘাত ভর্তা হয়ে যেত তার। মুষ্টি পাকানো হাতটা ওভাবেই পাকিয়ে রেখে কটমট চোখে তাকে একবার দেখে নিয়ে শাজ চলে এলো ঘরে। ব্যথাটা বেশি না হলেও কমও না। তবে ঠিকই আছে‚ কাজে দিয়েছে শাজের ওষুধটা৷ দিবাস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসেছে বেচারা। নাকের ডগা ডলতে ডলতে ফিরে এলো ঘরে। বাথরুমের দরজা খুলতে না খুলতেই আবার চিকন কণ্ঠের চিৎকার কান ধরিয়ে দিলো তার।

“আবার বাথরুমে এসেছেন আপনি? শিক্ষা হয়নি?”

তোয়ালে হাতে দাঁড়ানো লাস্যময়ী শাজের নজরকাঁড়া অঙ্গে শেষবারের মতো নজর দিয়ে শেহরোজ ঠান্ডা গলায় বলল‚ “একটা হেলদি অ্যামাউন্ট পে করে আমি পুরো বাড়িটা রেন্ট করেছি‚ শাজ। যেখানে এই মুহূর্তে উড়ে এসে জুড়ে বসছ তুমি৷ আমি আমার ঘরের বাথরুমে আবার‚ বারবার‚ শনিবার‚ রবিবার‚ সব বারেই আসতে পারব। উইথআউট পারমিশন তুমি আমার টাওয়াল ব্যবহার করছ কেন?”

শেষ কথাটা শোনা মাত্রই শাজ তোয়ালেটা তার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিলো আর কাটকাট সুরে বলল‚ “এই রুম আপনাকে দিচ্ছি না আমি। আপনার হেলদি অ্যামাউন্ট থেকে অর্ধেক ফিরিয়ে আনহেলদি করে নিন। অর্থাৎ এই বাড়িতেই থাকব আমি আজ থেকে৷ আপনার জন্য বরাদ্দ করছি নিচের গেস্টরুমটা। গেস্টরুম টু ডাইনিং অ্যান্ড ড্রয়িংরুম আপনার জন্য স্বাধীন। গো টু দ্য গেস্টরুম রাইট নাও।”

“অ্যাকচুয়ালি যার যে মেডিসিন কাজে দেয়”‚ হতাশ ভঙ্গিতে মাথাটা দোলাল শেহরোজ। “তাকে সেটাই অফার করা উচিত”‚ বলেই বাথরুমে ঢুকে পড়ল সে৷ দরজাটা আটকে দেবে তক্ষুনি শাজ চেঁচিয়ে উঠল‚ “মেরে ফেলব কিন্তু‚ শেহরোজ!”

“বের হও তবে! বেরিয়ে সোজা নিজের ঘরে ঢুকবে। তারপর ফ্রেশ হয়ে আবার আসবে পুল সাইডে। কথা বলার আছে।”

শাজের কেমন অদ্ভুত লাগছে আজ শেহরোজকে৷ তার ফ্লার্টিং আর সব সময়ের রসিকতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে আজকের ব্যবহারে অনেক ফারাক। চেহারার মুচকি মুচকি হাসি‚ দুষ্টু চাহনি উধাও তার৷ বরং তার গম্ভীর‚ শান্ত চেহারা আর কথাবার্তায় মনেই হচ্ছে না সে কাল পর্যন্তও ওর সঙ্গে হাসিমজা করেছে‚ ওর পিছু পিছু ঘুরেছে‚ ওকে আবেগপ্রবণ শায়েরী উৎসর্গ করেছে—যেন এখনের এই রূপটিই তার স্বরূপ।

“কী হলো?” নিজের দিকে শাজকে ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে শেহরোজ রগড় করে বলল‚ “এবার কি তোমার মতো কিছু ভেবে আমিও শাউট করব?”

“লুসিফার!” গালিটা দিয়েই শাজ বেরিয়ে পড়ল। ঘর থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে শেহরোজের নির্দেশ বাণী শুনল‚ “টেন মিনিটস বাদে আমার সামনে আসবে আবার।”

“আসছে জমিদার রামপাল আমার”‚ বিদ্রুপ গলায় বলে উঠল শাজ দরজার মুখে দাঁড়িয়েই। “আমার বাড়ি‚ আমার ঘর আর হুকুম দেয় ভাড়াটিয়া কোথাকার!”

ফিরে তাকাল শেহরোজ। পূর্বের মুচকি হাসিটা হঠাৎ ফিরল তার‚ “সো মেক মি ইয়োর ম্যান। তাহলে রেন্টার থেকে সোজা বাড়ির অওনার হয়ে যাব।”

চলবে।

#শেহরোজ – ২০
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
***

মাথা মুছতে মুছতে শাজ বাথরুম থেকে বের হতেই চিৎকার করে উঠল বুস্তানি‚ “কলিং ইউ‚ বেবি! কলিং ইউ।”

নতুন বাসাতে আসার পর থেকে পাখিটা শুধু ওর বিছানা জুড়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে বিছানাটা সে দখল করে নিয়েছে তা শাজকে বোঝাতে চাইছে সে৷ কয়েক পল পাখিটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে শাজ বসল এসে ওর কাছেই৷ সঙ্গে সঙ্গেই বুস্তানি হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে ছুটে এলো‚ দাঁড়াল শাজের গা ঘেঁষে। ও যে ভীষণ মিশতে চাইছে শাজের সঙ্গে তা শাজ বুঝতে পারছে বেশ। কিন্তু ভেতরকার অশান্তি আর কষ্টের জন্য শৈশবের স্বপ্নের কাকাতুয়াকে পাওয়ার আনন্দটা কেমন ফিকে হয়ে আছে। তাই তো তেমন কথাও শেখাতে মন চায়নি ওকে। কিন্তু এখন যেভাবে কাছে ঘেঁষে আছে তা দেখে আর পারল না চুপটি করে থাকতে৷ বুস্তানিকে চমকে দিয়ে সুরেলা এক শিস বাজাল সে আর অনামিকা আঙুলে ওর মাথায় আলতো ঘষতে থাকল৷ আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল বুস্তানি। মাথাটা এলিয়ে রাখল একটু সময় শাজের আঙুলের সাথে। কিন্তু শাজের শিস শুনে আর সেও চুপচাপ থাকতে পারল না। খুশিতে মাথার ঝুঁটি প্রসারিত হলো আর এবার শাজকে চমকে দিয়ে নিজের শেখা এক চমৎকার মিউজিক বাজাতে শুরু করল৷ মুগ্ধ হয়ে শাজ শুনল সুরটা। জিজ্ঞেস করল‚ “কে ছিল রে তোর মালিক? কী কী শিখেছিস তার থেকে?”

বুস্তানি বোঝেনি শাজের বাংলা কথা৷ সে মুখ ঝাঁকিয়ে আপনমনে মিউজিক করতে থাকল। এর মাঝে হঠাৎ ফোন কেঁপে উঠল শাজের—কল এসেছে কারও৷ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল‚ নাম্বারটা অচেনা। তখনো তাহলে কল এসেছিল বলেই বুস্তানি ‘কলিং ইউ’ বলছিল?

গতকাল আইয়াজের ফোন আসার পর থেকে কোনো অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলেই সে ভেবে বসছে ওর ভাইটা বোধ হয় দেশে এসেছে সত্যিই৷ রাগ করে যা-ই বলুক‚ ভাইকে কতদিন দেখে না! বছর দুই আগে সামনে পেয়েও তীব্র রাগে মুখটাতে তাকায়নি৷ বুকটার মাঝে ভাইয়ের জন্য কষ্ট বয় খুব৷ ওর অন্তরিন্দ্রিয় আজ-কাল কী একটা খারাপ সঙ্কেত দেয়—মনে হয় খুব শীঘ্রই ওর আত্মাটাও ওকে ত্যাগ করে ছেড়ে যাবে ওকে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে। ভেতরে ভেতরে সে নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুতও করে নিচ্ছে একটু একটু করে৷ কে জানে সামনে কী হয়! যদি ভাইটা সত্যিই একবার সামনে এসে দাঁড়ায় এরই মধ্যে তবে রাগ দেখালেও খুব বেশি বকবে না।

ছোটো এক প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ফোনটা কানে ঠেকাল আর অমনিই ওপাশ থেকে ভেসে এলো আবেদন‚ “ডার্লিং‚ প্লিজ কাম টু দ্য পুল সাইড। আই অ্যাম হিয়ার ফর ইউ।”

শেহরোজ! প্রেমিকের মতো অমন করে ডাকতে শুনে শাজ কিঞ্চিৎ অবাকই হলো প্রথমে। তারপরই খেঁকিয়ে উঠল‚ “ডার্লিং মানে কী? কে ডার্লিং‚ হুঁ?”

“ওহো শেরি! কে আবার? তুমি! আসবে না?”

“না”‚ ধমকে বলল শাজ।

“তবে কি তোমার বেডরুমে ডাকছ? সেটাও ভালো। ইন ফ্যাক্ট বেশি ভালো। কিছু স্পেশাল মোমেন্টস ক্রিয়েট করব দুজন মিলে।”

“খবরদার আমার বেডরুমে আসবেন না”‚ বিদ্যুৎ বেগে দাঁড়িয়ে পড়ল শাজ। “নয়তো আমি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলব।”

“দেন কাম টু দ্য পুল সাইড ইন টু মিনিটস।” যেন গম্ভীর আদেশে বলল শেহরোজ‚ “আই রিপিট ফর দ্য লাস্ট টাইম‚ জাস্ট টু মিনিটস।”

অবাক চোখে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে থাকল শাজ৷ বলা শেষেই খট করে কলটা কেটে দিয়েছে শেহরোজ৷ এমন গুরুগম্ভীর সুরে ওকে আদেশ করার সাহস আসে কোথার থেকে এই লোকের? কেন আদেশ করবে ওকে? দুদিন সে খোলাখুলি কথা বলেছে বলে নিজেকে লোকটা ওর কাছের মানুষের মতো ভেবে নিয়েছে মনে হয়। তাহলে তো তার জায়গাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয়!

বিছানার ওপর থেকে ওড়নাটা গায়ে মেলে চলে এলো ভাইয়ের ঘর দখল করে নেওয়া দৈত্যটার কাছে। ছাদে পৌঁছেই দেখল‚ পুলের পাশে বসে আছে শেহরোজ। বাহ্! এর মাঝে দুটো চেয়ার পাতাও হয়ে গেছে?

থপথপ পা ফেলে আসার শব্দ শুনে শেহরোজ পেছন ফিরে তাকাল আর মুহূর্তেই মুগ্ধতা ছেয়ে ধরল তাকে৷ আজই প্রথম দেখল মেয়েটিকে সেলোয়ার-কামিজে। শুভ্রতার মাঝে মাঝে লাল রঙা ফুলের নকশা তোলা জামাতে। আচ্ছা জামাটা সুন্দর বলেই কি ওকেও বেশি ভালো লাগছে দেখতে? না‚ ঠিক তা না। শেহরোজ ধরতে পারল এই লাস্যময়ীর দেহাকৃতিই মনোরম। যেজন্য ওকে সবরকম পোশাকেই মানিয়ে যায়৷

অদ্ভুত দাম্ভিকতার সঙ্গে শাজ হেঁটে এসে বিনা অনুমতিতেই বসল শেহরোজের মুখোমুখি চেয়ারে৷ ওড়নাও আজ সাধারণভাবে সে বুকের ওপর মেলে রেখেছে বলে গলাটা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে। গলায় ঝুলছে হীরার ছোটো একটি পেন্ডেট। নীলাভ আলো ছড়াচ্ছে হীরার মাঝখান থেকে। গলার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর সারা শরীরেই চোখ বুলিয়ে নিলো শেহরোজ। মধু বাদামী রঙা ভেজা চুলগুলো কাঁধ আর পিঠের মাঝ অবধি ছড়িয়ে রাখা। বেশ সুন্দর শ্যাম্পুর ঘ্রাণটাও। কিন্তু এই ঘ্রাণকে অবজ্ঞা করে বাতাসে ভেসে আসা গোলাপের হালকা সুবাসটুকু শাজের অগোচরে বুক ভরে টেনে নিলো সে।

সত্যটা হলো‚ শাজকে পুরোদস্তুরই নতুনভাবে দেখার সুযোগ পাচ্ছে শেহরোজ একই ঘরে থাকতে পারার জন্য। এবং বুঝতে পারছে‚ সামনে মেয়েটিকে সে আরও নতুন নতুনভাবে আবিষ্কার করারও সুযোগ পেতে চলেছে৷ এবং এটা উপভোগ্য লাগছে তার এখন থেকেই। বিড়বিড়িয়ে স্বগতোক্তি করে সে‚ “এবারের অনুভূতি আমার কেমন অন্যরকম। সামথিং স্পেশাল।”

“কী বললেন”‚ ভ্রু কুঁচকে ভারী সুরে জিজ্ঞেস করে উঠল শাজ।

“পারফেক্ট”‚ চোরা নজরে শাজের দেহাবয়ব আরেকবার দেখে নিয়ে জবাবটা দিলো শেহরোজ। তারপর নির্বিকার ঢঙে চুমুক দিলো চায়ের মগে।

“কী পারফেক্ট?”

“এখানের সবকিছুই।”

হঠাৎ শাজ লক্ষ করল শেহরোজ কালো চা পান করছে। আর সেটা দেখেই কেমন অদ্ভুত কিছু দেখার ভঙ্গিমায় তাকাল সে শেহরোজের দিকে‚ “আচ্ছা আপনি কি তুর্কি কোনো অ্যাক্টরকে ফলো করেন?”

“পিয়ার্স ব্রসনান।” সরল চোখে চেয়ে জানাল শেহরোজ‚ “টিনএজ গণ্ডিতে তাকে ফলো করতাম।”

“কিন্তু সে তো আইরিশ অ্যাক্টর। আমি তুর্কি অ্যাক্টর ক্যান ইয়ামানের কথা জিজ্ঞেস করছি।”

“কেন জিজ্ঞেস করছ তার কথা?”

“আপনার বডি স্ট্রাকচার‚ দাড়ি-গোঁফ আর”‚ ইশারায় শেহরোজের চুলকে দেখাল শাজ‚ “ঝুঁটি স্টাইল প্রথম দেখাতে ক্যান ইয়ামানকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।”

ফিচেল হাসল শেহরোজ‚ “এজন্যই কি তাহলে তার ছবির মাঝে তুর্কিশ স্টাইলে ‘Şehroz’ লিখে রেখেছিলে?”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল শাজ‚ “আমার তুর্কি কিছু হিরোদের প্রতি একটু দুু্র্বলতা আছে।”

“তাই? আর চায়ে?” বলে এগিয়ে দিলো দ্বিতীয় মগ। চেয়ারের পায়ার কাছে থার্মস কফি মগটা রাখা ছিল।

“যদিও কালো চা আমার পছন্দ নয়”‚ তবু চাটা গ্রহণ করল শাজ। মগের ঢাকনাটা খুলে এক চুমুক দিতেই বুঝল চায়ের স্বাদ আর ঘ্রাণটাও একটু ভিন্ন‚ “চাটা কি আপনি আমেরিকা থেকেই এনেছেন?”

“না।” চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে জানাল শেহরোজ‚ “ইরান থেকে।”

“ইরানিদের প্রধান চা কালো চা। আর তুর্কিদেরও পছন্দ বেশি এটাই। আপনিও কি কালো চাতে অভ্যস্ত?”

“চা হলে কালো চাতেই।”

“এটাও ক্যান ইয়ামানের বৈশিষ্ট্য। আমি এবার সত্যিই কনফিউজড হচ্ছি৷ এতগুলো বৈশিষ্ট্য কী করে মিলছে?”

মনে মনে হাসল শেহরোজ আর ভাবল‚ “মিলছে তো এজন্যই যে তোমার উইকনেস আছে তার প্রতি৷” শাজের অধিকাংশ পছন্দ‚ অপছন্দ সে জেনেশুনেই নিজেকে পরিবর্তন করেছে আর তারপরই শাজের সামনে এসেছে৷ চার মাস হলো নিজের চুল‚ দাড়ি আর গোঁফের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তার। ওদেরকে স্বাধীনভাবে বাড়তে দিয়েছে। পরিকল্পনার অংশ মোতাবেক জরুরি ছিল শাজকে আকৃষ্ট করাটা৷ যে পরিকল্পনাটি এখনো চলমান।

“আপনি সত্যিই তেমন চেনেন না এই অ্যাক্টরকে”‚ সন্দেহ গলায় জিজ্ঞেস করল শাজ।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল শেহরোজ‚ “চিনি না তো। হতেই পারে এটা তোমার মনের ভুল৷ অ্যাক্টরের প্রতি তুমি বোধ হয় খুব অবসেসড। তাই আমার মাঝে তাকে খুঁজে নিয়েছ।”

“মোটেও অবসেসড নই”‚ প্রতিবাদ করল শাজ মুহূর্তেই। “হলেও আপনার মাঝে তাকে খুঁজে নেব কেন? আপনি কি তার মতো দেখতে? আপনার মতো গুণ্ডামার্কা না তার চেহারা।”

“আচ্ছ”‚ মাথা ওপর-নিচ দুলাল শেহরোজ। “এত বাজে দেখতে আমি! আমার তো কনফিডেন্স কমতে শুরু করেছে”‚ কপট আহত সুরে বলল।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিটিমিটি হাসল শাজ। মেয়েদের মনের ভাষা ভাগ্যিস সহজে টের পায় না ছেলেরা! আদতে ওই তুর্কি হিরোর সৌন্দর্য তো এই সুন্দর দৈত্যের কাছে হার মেনে যায়। নয়ত কি আর প্রথম দর্শনেই থমকে যায় সে? কোনা চোখে তাকাল শাজ। শেহরোজ ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই একটু বিব্রত হয়ে পড়ল৷ শেহরোজ হঠাৎ শান্ত স্বরে স্বীকারোক্তি দিলো তখন‚ “ইরা মির্জার সঙ্গে আমি কোনো কমিটমেন্টে যাইনি‚ শাজ৷ পাবলিকলি একটা মেয়ে ওভাবে প্রপোজ করে বসায় মোটামুটি সবাই চাইছিল যেন অ্যাক্সেপ্ট করি। তবে সবার চাওয়াতে আমি গোলাপটা নিইনি৷ মেয়ে বলেই সবার সামনে রিজেক্ট না করে আড়ালে করেছি। যাতে সে সবার কাছে উপহাস্য না হয়।”

ছলাৎ করে উঠল বুকের বাঁ পাশে শাজের৷ আকস্মিক এই স্বীকারোক্তির মানে কী? চায়ের মগটা ঠোঁটের কাছ থেকে নামিয়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। রাগের বশে গতকাল কী না কী বলে দিয়েছিল। যে কথার মূল সারাংশই ছিল‚ কেন শেহরোজ ওর কথা না ভেবে ইরাকে গ্রহণ করল? তার মানে মনের অগোচরেই সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলেছে? ইস! লজ্জায় শক্তভাবে বুজে ফেলল চোখদুটো।

“তুমি চাও তো কল করি ইরাকে আর এ ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি তোমার সামনে?”

“না না।” তড়িঘড়ি গলায় বারণ করে শাজ অপ্রস্তুত হয়ে বলল‚ “কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আসলে কাল রাগের মাথায় উলটো পালটা বলে ফেলেছিলাম। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি৷”

“রাগের মাথায় মানুষ সত্য কথায় বলে বেশি। তুমি আমাকে আসলেই উইমেনাইজার ভাবো।”

“আরে নাহ!” কী যে বলে কথাটাকে ঘোরাবে শাজ! তা ভেবে না পেয়ে মনের কথাটাই বলে দিলো সে‚ “আপনি ক্যাজুয়াল ডেটিংকে প্রায়োরিটি দেওয়া মানুষ। এটা আমার ধারণা বা বিশ্বাস বলতে পারেন।”

“আর সেটা ভুল নয়”‚ অকপটেই স্বীকার করল শেহরোজ। “আই হ্যাভ গট আনফেটারড ফ্রিডম। আই ওয়াজ ডিসিপ্লিনড আনটিল আই ওয়াজ সিক্সটিন।” এটুকু বলে চুপ হয়ে গেল শেহরোজ৷ শাজের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চাঁদের আলোয় ঝিকিমিকি করা পুলের পানিতে চেয়ে কথা বলল আবার‚ “আমার আব্বু মারা যান যখন আমি টুয়েলভ আর আম্মা সিক্সটিন-এ। আফটার অ্যাডাল্টহুড যে সকল মেয়ে আমার জীবনে এসেছে‚ তারা কখনো ধরে রাখতে পারেনি আমাকে আর আমিও পারিনি তাদেরকে।”

“কেন”‚ ফিসফিসানির মতো শোনাল শাজের কণ্ঠ।

“বিকজ দে ডিজার্ভ সামওয়ান বেটার দ্যান মি।”

“অদ্ভুত! এমনটা কেন?”

“শাজ।” শেহরোজ বিব্রতস্বরে বলল‚ “ডিজকমফোর্ট লাগছে এই বিষয়ে কথা বলতে। প্লিজ!”

কথাগুলো দ্বারা শেহরোজকে বিচার করা যাচ্ছিল বটে। এমন স্বভাবের পুরুষদের প্রেমিক হিসেবে মানালেও আদর্শ জীবনসঙ্গিনী রূপে বিশ্বস্ত হতে পারে না বলেই মনে করে শাজ৷ কিন্তু তবুও কিছু একটা ভিন্নতা উপলব্ধি করছিল শাজ শেহরোজের মাঝে। কথাগুলো বলার সময় তার চোখের তারায় কেমন উদাসীনতা‚ শূন্যতা কিংবা তার থেকেও বেশি একাকিত্বের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল ও৷ আরও কি ভিন্ন কিছু ছিল এই কথাগুলোর মাঝে? থাকলেই বা সেটা কী—তা আপাতত মাথায় আসছে না শাজের৷ তবে সেই ভিন্নতার কারণেই শেহরোজকে ‘উইমেনাইজার’ অথবা ‘প্লে বয়’ ট্যাগদুটো দিতে একটু অস্বস্তি বোধই হচ্ছে ওর। “ঠিক আছে”‚ জানিয়ে শাজ জিজ্ঞেস করল‚ “আপনার দাদা-দাদীকে নিয়ে আসবেন না এখানে?”

“না। তারা আর শহরমুখী হতে চাইছে না৷ আমাকেই ফিরতে হবে তাদের কাছে৷”

“তাদের রেখে একা থাকতে আপনার ভালো লাগে?”

প্রশ্নটা শুনে শেহরোজ তাকাল। কোমল‚ আদুরে চোখে-মুখে বেদনাটুকু আড়াল করতে পারেনি শাজ৷ নিশ্চয়ই বাবা-মা‚ ভাইকে মনে পড়ছে? বলল‚ “তুমি জানো‚ শাজ৷ একা থাকাটা ভালো লাগার নয়।”

কয়েক পল শাজ তাকিয়ে রইল শেহরোজের মায়া দৃষ্টিতে। হ্যাঁ‚ এ মুহূর্তে তার চোখের ভাষাতে সেই পাথুরে কঠিন‚ নির্দয়তা অনুভব হচ্ছে না৷ কিন্তু নিজের চোখদুটো টাটিয়ে ওঠায় ঠোঁট চেপে চিবুকটা মিশিয়ে ফেলল বুকের সাথে৷ তবু পারল না নোনাপানিকে বাধ সাধতে৷ দু-তিন ফোঁটা অশ্রুকণা গিয়ে পড়ল চায়ের মাঝেই৷

ওকে কাঁদতে দেখেও শেহরোজ কিছু বলল না। সান্ত্বনা দেওয়ার সময় নয় এখন। সে অপেক্ষায় আছে শাজের মনে জমানো সকল কথা শোনার জন্য।

মিনিটখানিক পর শাজ কান্নাটুকু সামলে বলতে শুরু করল‚ “আব্বু নিজের পেশার কারণে খুব বেশি সময় পেত না আমাদের জন্য৷ আম্মুও মানিয়ে নিয়েছিল৷ কিন্তু বিপত্তি ঘটল আমাকে জন্ম দেওয়ার পরই৷ আসলে আব্বু আম্মুর বিয়েটা আম্মুর পরিবারের অমতে হয়েছিল তো। সেটা আমার ভাইয়া জন্মানোর পর কিছুটা ঠিকঠাক হলেও আমার নানা আর মামারা আব্বুর যে কোনো ব্যাপারে দোষ-ত্রুটি খুঁজে পেতই‚ অপমানও করে বসত মামারা সুযোগ পেলে৷ যে কারণে আব্বু খুব একটা যাতায়াত করত না নানাবাড়িতে৷ তাই পরবর্তীতে আম্মুও যেত না একদম। আমি জন্ম নেওয়ার সময়টাতে আম্মু তাই পুরোপুরি একা ছিল। নানি আসতে চাইলেও মামারা তাকে আসতে দেয়নি জেদ ধরে যে‚ কেন আম্মু আসবে না তাদের কাছে? এই পারিবারিক দ্বন্দ‚ আব্বুকে কাছে পেতে ইচ্ছে করলেও না পাওয়া‚ মনের কষ্টগুলো না বলতে পারা‚ সব মিলিয়ে সে মুহূর্তে আম্মু খুব ডিপ্রেশনে ভোগে। এ অবস্থার মাঝেই আমার জন্ম। তারপর যত সময় যায় ততই আম্মু খুব ভয়াবহভাবে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়৷ ব্যাপারটা শুরুতে কেউ টের পায়নি। আব্বু ছুটিতে বাড়ি ফিরলে আব্বুর সঙ্গে ছোটো-বড়ো যে কোনো বিষয়ে ঝগড়াঝাটি শুরু করে আম্মু৷ তবে আব্বু সব সময়ই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু দেখা গেল আব্বুর ছুটি শেষ হলেই আম্মু আবার সিন ক্রিয়েট করত নানান কথাবার্তায়। আর এর মাঝে নানাবাড়ির মানুষগুলোর উলটো পালটা কথাবার্তা‚ ব্যবহার নাকি চলছিলই। যে কারণে আব্বুর প্রতি আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল আম্মু৷ আব্বুকে পর্যাপ্ত সময় কাছে না পাওয়া‚ বাড়ি ফিরলেও আবার ঝুট-ঝামেলা শুরু আব্বুর সঙ্গে‚ আব্বুও ঠিকমতো আম্মুকে না বুঝতে পেরে রিয়্যাক্ট করে ফেলা‚ বাবার বাড়ির মানুষকেও পাশে না পাওয়া আর এর সঙ্গে আমার বিরক্ত সহ্য না করতে পারা। সব মিলিয়ে আম্মুর অসুখটা সাংঘাতিক পর্যায়ে চলে যায়৷ যেদিন আম্মু সুইসাইড করল সেদিন সকালে আব্বুর সঙ্গে আম্মুর সব থেকে বড়ো ঝামেলা হয়েছিল৷ আম্মু কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলেছিল‚ ‘তুমি হয় আমাকে বেছে নেবে আর নয়তো তোমার সেনা জীবনকে। আমাকে না বেছে নিলে আমি চলে যাব আমার বাবার কাছে।’ আব্বুও তখন রাগের মাথায় জবাব দিয়েছিল‚ ‘তুমি মূলত সেটাই চাইছ। আর শুধু শুধু আমার কর্মজীবনকে বাহানা বানাচ্ছ। আমার কাছে আমার সেনাজীবনই আগে‚ এই দেশের প্রতি আমার দায়িত্বটাই ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তোমার যাওয়ার হলে যেতে পারো৷ কিন্তু আমার মেয়েকে নিতে পারবে না।’ এ কথা শেষেই আব্বু বেরিয়ে যায় সিলেটের উদ্দেশ্যে। আর ওই কথায় আম্মুকে কতটা আঘাত করেছিল তা এখন বুঝতে পারি। হয়ত সুস্থ থাকলে যতই কষ্ট পাক সুইসাইড করার মতো চিন্তায় করত না৷ আমি আম্মুকে একেবারে হারিয়ে ফেলেছি তা নিশ্চিত হয়েছিলাম নানাবাড়ি থাকার সময়। আব্বুকে আম্মুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে‚ কাকু আর ফুপুদের সাথে ঝগড়া করে মামারা আমাকে জোর করে আর জেদ করেই নিয়ে গিয়েছিল। অথচ আমার খেয়াল রাখার বেলায় কেবল নানি ছাড়া আর কেউ ছিল না৷ সে বুড়ি মানুষ বলে খুব একটা পারতও না আমাকে যত্ন করতে। না খেতে চাইলে আম্মুর মতো কেউ গল্প শুনিয়ে‚ ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে‚ আমার পিছু পিছু দৌড়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করত না। ওভাবেই না খেয়ে দিন কাটাতাম। রাতের বেলা খুব খিদে পেলে নানির হাতে কয়েক লোকমা খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। মামা-মামিরা তাদের ছেলে-মেয়ে আর আমার মাঝে যে ভেদাভেদটা করত‚ তা যেদিন বুঝলাম সেদিনই উপলব্ধি করলাম আম্মু আর ফিরবে না—আব্বুর কাছেই আমি থাকতে চাই। তারপরই আমি আব্বুর কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করি‚ কান্নাকাটি করি। আর তা দেখেই নানাভাই একদিন আব্বু আর কাকুকে ডেকে আমাকে তুলে দিয়েছিল তাদের হাতে।”

“সবার মতো তুমি তখন মনে করতে না তোমার আব্বুর জন্যই তোমার আম্মু সুইসাইড করেছিল?”

“না‚ তখন আমি অবুঝ৷ তিন বছর বয়সে ওসব বিচার করার মতো বুঝজ্ঞান তো আমার ছিল না৷ আর যখন বোঝার বয়স হলো তখন তো দেখতাম আব্বু বাড়ি ফিরলে রাতের বেলা সবাই ঘুমালে সে একা একা আম্মুর শোবার জায়গায় বসে কাঁদত আর আম্মুর ছবির সঙ্গে কথা বলত‚ বারবার সেদিনের জন্য খালি ক্ষমা চাইত‚ নিজের অপারগতা স্বীকার করত আর নিজের মৃত্যু কামনা করত নৃশংস উপায়ে। যেন মৃত্যুর সময় আম্মুর ওই কষ্টটা সেও অনুভব করতে পারে। আম্মু চলে যাওয়ার পর আমার প্রতি আব্বুর টান আর ভালোবাসাও মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়৷ ছুটি পেলেই আমাকে নিয়ে আমেরিকা ছুটত। দেশের ভেতরও অনেক জায়গায় ঘুরেছি আব্বুর সঙ্গে৷”

“কিন্তু তিন বছর”‚ সন্দিগ্ধ শেহরোজ। “তোমার আম্মু তোমার আব্বুর ওই কথার কারণে সুইসাইড করে। তাদের সেই কনভার্সেশন তুমি শুনেছিলে অত ছোটো সময়ে। সেটা তোমার এখনো মনে থাকল‚ শাজ?”

“থাকবে না?” বিষাদপূর্ণ হাসল শাজ‚ “আমার মনে ছিল বলেই তো যখন সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আব্বু আম্মুর ঝগড়ার কথা আর আমি তখন অবুঝ হয়ে এই কনভার্সেশন‚ ওইদিনের পুরো পরিস্থিতি তাদের জানিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা জেনেই তারা আব্বুকে দোষারোপ করতে পেরেছিল। এমনকি…” একটু কাঁপল শাজের গলা‚ “আমার ভাইও আব্বুকে আম্মুর খুনী বলে অভিযুক্ত করে গেল সব সময়।”

শেহরোজের চেহারাতে হঠাৎ চিন্তার ছায়া নামল। ঠোঁট কামড়ে কী এক ভাবনায় পড়ল সে৷ এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো‚ আজ রাতেই খালিদ উসমানের সঙ্গে কথা বলতে হবে তার।

চলবে।