#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
বসার ঘরে বসে আছে সাকিন, আয়ান ও আতিক চৌধুরী। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে ঘরে। অনিমা রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত। তবে এদিকে কী কথাবার্তা হয় সেটা শোনার জন্য কান খাড়া করে আছে। সাকিন এমন এক কথা বললো সবাই খুশি হওয়ার বদলে চুপ হয়ে গেছে। কথাটা যদিও স্বাভাবিক কিন্তু আয়ান কিংবা আতিক কেউ হজম করতে পারছে না। নীরবতা ভাঙল সাকিন। বেশ সিরিয়াস মুখ করে বসে আছে সে। আর তার এই সিরিয়াসনেস কারোর সহ্য হচ্ছে না।
” তোমরা এমন মুখ করে বসে আছো মনে হচ্ছে আমি খুন করব বলেছি। ”
” খুন করবি শুনলেও অবাক হতাম না। কিন্তু অবাক হচ্ছি তুই সিরিয়াসলি কথা বলছিস,তাও বিয়ের কথা! কীভাবে যে বিষয়টা হজম করবো সেটা ভেবেই চুপ করে আছি ভাই। ”
আয়ান এতটুকু বলে থামলো। আয়ানের বাবা বললেন,
” সত্যি বলছিস তো বাবা? সত্যি করবি বিয়ে? না-কি বিয়ের দিন ট্যুরে চলে যাবি? ”
” বড়ো আব্বু! তোমরা আমাকে এতটা কেয়ারলেস মনে করো? পাখিও সেইম কথা বললো। ”
” পাখি? তা কোন পাখি আমার এই বাউণ্ডুলে ভাইটাকে বশ করলো? ”
আয়ান ঠোঁট টিপে হাসছে। সাকিন কটমট চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ফের আতিক চৌধুরীর দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
” আমি সত্যি বলছি বড়ো আব্বু। তুমি প্লিজ পাখির বাবা-মায়ের সাথে কথা বলো। ”
এবার আয়ানও বেশ গম্ভীর হয়ে বসলো। আতিক চৌধুরী আগ্রহ নিয়ে শুধালো,
” পাখির বাসা কোথায়? ”
” নওগাঁ। তবে লেখাপড়ার জন্য ঢাকা থাকে ও। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পাখি। বড়ো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। নিজের জেদে এখনো লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। ”
” বেশ বুঝলাম। তুমি ওর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে এসো। আর তার আগে আজকে ডিনারের জন্য ইনভাইট করো। আমরাও কথা বলি পাখির সাথে। অনিমার সাথে না হয় রাতে থেকে যাবে। ”
চাচার কথা বেশ মনে ধরল সাকিনের। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
” ঠিক আছে বড়ো আব্বু। ”
” আলোচনা শেষ হলো তোমাদের? চলো চলো নাস্তা করে নিবে। ”
অনিমা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বসার ঘরে প্রবেশ করেছে। আয়ান একটু দুষ্টমি করে বলে,
” পাউরুটি আর জ্যাম নাকি? ”
অনিমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাকিন বলে উঠল,
” জি না ভাইয়া। আমার ভাবি এখন অলরাউন্ডার, সবকিছু রান্না করতে পারে। মানুষ চেষ্টা করলে সবকিছু শিখতে পারে, বুঝলে? ”
” হ্যাঁ, হ্যাঁ। চল এখন। খাওয়াদাওয়া শেষে বাজারেও যেতে হবে। দুপুরে কী কী রান্না হবে সেটা ঠিক করে রাখো অনিমা। ”
আয়ান অর্ধেক কথা সাকিনকে বলে বাকি অর্ধেক অনিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল। অনিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলো।
ঘড়িতে সময় বেলা বারোটা। ক্যাম্পাসের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সাকিন ও পাখি। হুট করে ডেকে পাঠাল ছেলেটা। কিন্তু কী বলবে সেটা না বলে এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পাখি যদিও বিরক্ত হচ্ছে না। ভালবাসার মানুষের ওপর কখনো বিরক্তি আসে না। যদি আসে তবে সেখানে পুরোপুরি ভালোবাসা থাকে না।
” কী হয়েছে সাকিন? কিছু বলবে না? তাকিয়ে থাকবে শুধু? ”
” হ্যাঁ বলছি। বাসায় বলেছি তোমার কথা। ”
” সত্যি! ”
পাখি রীতিমতো লাফিয়ে উঠল। সাকিন পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসল।
” শান্ত হয়ে শোনো। ”
” হ্যাঁ শুনছি, বলো। ”
” তোমার বাড়ির ঠিকানা চেয়েছে বড়ো আব্বু। আর আজকে রাতের খাওয়াদাওয়ায় তোমাকে দাওয়াত করতে বলেছেন। তুমি যাবে তো? ”
” অবশ্যই যাবো! ”
খুশিতে সবার সামনেই সাকিনকে জড়িয়ে ধরল পাখি। সাকিন বাঁধা দিলো না। বরং নিজেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো তাকে।
” গুড গার্ল। আমি বিকেলে তোমাকে নিতে আসবো। শাড়ি পরে রেডি থেকো। ”
” কোন রঙের শাড়ি? কালো না-কি নীলটা? ”
” আমি অনলাইনে অর্ডার করেছি। দুপুরের দিকে বাসায় দিয়ে আসবে। সেটা পরেই রেডি থেকো। ”
পাখি খুশিতে কী যে করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে তার অগোছালো প্রেমিকটা এতো গোছালো হলো কীভাবে? যেহেতু এটা পাখির ভার্সিটির ক্যাম্পাস তাই ওর সমস্যা হতে পেরে ভেবে সাকিন পাখিকে বাহুডোর থেকে আলগা করে দিলো।
” ঠিক আছে। ”
” আসছি এখন। আর হ্যাঁ টিপ দিও কপালে। ”
পাখি মুচকি হাসলো। সাকিন হাত দিয়ে ইশারা করে টাটা বলে চলে আসলো। সেদিন সাকিনের এক পরিচিত বড়ো ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষের বিয়ে হয়ে গেছে। সেই বড়ো ভাইও সাকিনের মতোই বাউণ্ডুলে স্বভাবের। সেজন্য তার প্রেমিকা বিরক্ত হয়ে নিজের ইচ্ছায় অন্য জায়গায় বিয়ে করে নিয়েছে। সেই খবর পেয়ে ভাইটার খুব বাজে অবস্থা এখন। এই ঘটনা ঘটাতে সাকিনের মনে একপ্রকার ভয় ঢুকে গেছে। যদি পাখিও কোনোদিন অভিমানে তাকে ছেড়ে চলে যায়? সাকিন এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তার পাশে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পাখিকে সে কোনোমতেই হারাতে পারবে না।
” কী হচ্ছে? ”
” যা দেখছ। ”
” দিনদুপুরে এভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন কেনো? ”
” কেনো দিনদুপুরে কি বউকে জড়িয়ে ধরা অপরাধ? না-কি এখানে কেউ আছে!”
আয়ান মুখ গোমড়া করে বললো। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে নিজেদের রুমে শুয়ে আছে দু’জন। কালি পূজা উপলক্ষে ভার্সিটি অফ আজ।
” এতো যুক্তি! পেশায় যে শিক্ষক সেটা কথা কার্যে বুঝিয়ে দিচ্ছেন একেবারে। ”
” ছাত্রী ছাত্রীর মতো থাকো। এতো প্রশ্ন কেন করো? স্যার যা করবে চুপচাপ শুধু দেখবে। ”
আয়ানের চোখেমুখে দুষ্টমির ছাপ স্পষ্ট। অনিমা মুচকি হাসলো।
” স্যার হয়েছেন তো বাসায় কী? স্যারগিরি দেখাবেন ক্লাসে, এখানে না। এখন আমি আপনার বউ, ছাত্রী নই। ”
অনিমার কথা শেষ হতেই আয়ান ওর ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। সহসাই কেঁপে উঠল অনিমা।
” এই তো লাইনে এসেছ। যেহেতু তুমি আমার বউ, সুতরাং বউকে জড়াতে, আদর করতে কোনো সমস্যা থাকার কথা না। ”
” আপনি খুব অভদ্র। ”
আয়ান কনুইতে ভর দিয়ে শুয়ে অন্য হাতের একটা আঙুল অনিমার কপালে ছুঁইয়ে নিচের দিকে নামাতে নামাতে ঠোঁট পর্যন্ত এসে হেসে বললো,
” অভদ্র হয়েছি আমি তোমারই প্রেমেতে তাই।
কাছে এসো, এসো না। ”
অনিমা হাসতে লাগলো আয়ানের পাগলামি দেখে। গম্ভীর লোকটা কেমন বাচ্চাদের মতো করে আজকাল। ভালোবাসা আসলেই ম্যাজিক! যার জীবনে এই ম্যাজিক হয় সে আকাশপাতাল বদলে যায় ।
রাত নেমেছে শহরের বুকে। দিনের কোলাহল থেমে গেছে, কিন্তু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো এখনো পথগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে এলেও, মাঝে মাঝে হর্নের শব্দ আর গাড়ির হেডলাইটের ঝলকানি যেন নীরবতাকে ছেদ করে চলে যাচ্ছে। ফুটপাতের চায়ের দোকানে কিছু লোক গল্পে মশগুল, আর রাতের আকাশের নিচে ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন তাদের আলাপের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। শহরের কোনো গলিতে হয়তো কেউ হেঁটে যাচ্ছে একা, ব্যস্ত দিনের শেষে ক্লান্তি মুছে ফেলার জন্য এই রাতটাই তার সঙ্গী। শহরের উঁচু উঁচু ভবনগুলোতে ছোট ছোট আলো জ্বলে আছে, জানালার ভেতর দিয়ে দেখা যায় কিছু মানুষের একান্ত সময়।
পাখি আসার জন্য চৌধুরী বাড়িতে আজ এক রাজকীয় আয়োজন করা হয়েছে। গরম ধোঁয়া উঠা সুগন্ধী পোলাও, সাথে মসলা আর কেশরের গন্ধ এক হয়ে এক অনন্য স্বাদ তৈরি করেছে। সঙ্গে আছে মসলাদার গরুর রেজালা, মাংসের প্রতিটি টুকরোই নরম আর রসালো। এছাড়া কষা খাসির মাংসও রাখা হয়েছে, যার ঝাল আর মশলার স্বাদ মুখে লেগে থাকবে অনেকক্ষণ। এছাড়াও সঙ্গে আছে বিভিন্ন ভাজা: মুচমুচে আলু ভাজা, ফিশ ফ্রাই, আর খাস্তা পরোটাও । এছাড়া আছে শষা, লেবুর টুকরো দিয়ে সাজানো সালাদ। শাকসবজির মধ্যে আছে ফুলকপি, মটরশুঁটি আর গাজরের মিক্সড ভেজিটেবল। শেষে ডেজার্ট হিসেবে রসমালাই, আর পায়েস রাখা হয়েছে, যা খাওয়াদাওয়ায় পরিপূর্ণতা এনে দেবে। একা হাতে এতসব অনিমা কীভাবে রান্না করেছে সেই ভেবে অবাক হয়েছে আয়ানসহ বাকিরাও। মেয়েটা সেই আসরের নামাজ শেষে রান্নাঘরে ঢুকেছে আর বের হলো মাত্র। ঘড়িতে এখন সময় রাত দশটা! এতক্ষণ কাজকর্ম করে বেশ ক্লান্ত সে। বাঙালি মেয়েরা অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে খুব মনোযোগী। সাকিন এখনো পাখিকে নিয়ে বাসায় আসেনি। হঠাৎ করে পাখির একজন রুমমেট অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে হসপিটালে গেছে পাখি। সাকিনও আছে সাথে। আয়ান মিনিট পাঁচেক আগে কল করেছিল, বলেছে রাস্তায় আছে ওরা। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
চলবে,