এক পশলা প্রেম পর্ব-১৪

0
178

#এক_পশলা_প্রেম
#পর্ব_১৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

ক্যালেন্ডারের পাতায় আজকের দিনটি শুক্রবার। সাকিন ও পাখির বিয়ের দিন! সকাল থেকে চৌধুরী বাড়িতে বিয়ের ধুম লেগেছে। লোকজন যাওয়া-আসা করছে, পুরোদমে রান্নাবান্না ও বাকিসব কাজকর্ম চলছে। অনিমার ওপর অনেক কাজের দায়িত্ব। বাড়ির বড়ো বউ বলে কথা! তাছাড়া এ বাড়িতে তো আর কোন নারী সদস্য নেই। সেজন্য সবদিকেই ওকে নজর দিতে হচ্ছে। একটু পর আসরের আজান দিবে। আসরের নামাজের পরেই বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে বলে জানিয়েছে আয়ান। অনিমা বাড়িতেই আছে। বরযাত্রী কিছুক্ষণ আগে কনের বাড়িতে পৌঁছেছে।

” কী হয়েছে? নার্ভাস লাগছে? ”

লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বসে আছে পাখি। পাশেই পর বান্ধবী রূপসা, রিয়া বসে আছে।

” না রূপসা। কেমন অন্য রকম লাগছে। সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মধ্যে সাকিনের বউ হয়ে যাবো? এ বাড়িটা আমার থাকবে না রে? ”

পাখির মন খারাপ লাগছে আবার অন্য রকম অনুভূতির সাক্ষী হচ্ছে। একদিকে ভালোবাসার মানুষকে চিরতরে নিজের করে পাওয়া আবার অন্য দিকে বাবা-মাকে ছেড়ে আজীবনের জন্য শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়া!

” আরে পাগলি মন খারাপ করিস না। দেখ বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হবে তাই না? তাছাড়া তোর বর তোকে খুব ভালোবাসে। জাস্ট বলবি বাবার বাড়ি আসবি আর নিয়ে আসবে। ”

রূপসার কথায় মুচকি হাসলো পাখি। সাথে রিয়াও হাসছে। সাকিন মনভোলা, উদাসীন হতে পারে তবে পাখিকে ভালোবাসে অনেক। এ বিষয় পাখির কোনো সংশয় নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুভবিবাহ সম্পন্ন হলো। দুই পরিবারের সবাই বেশ খুশি। যেহেতু ঢাকা থেকে পাখিদের বাড়ির দূরত্ব অনেকটা সেজন্য সন্ধ্যার আগেই নতুন বউকে নিয়ে রওনা হয়েছে আয়ানরা।

নতুন দম্পতির সঙ্গে আয়ান ও অনিমাকেও ঘুরতে যেতে বলছেন আতিক চৌধুরী। যেহেতু আয়ানের ভার্সিটিতে ছুটিছাটা কম এখন সেজন্য আপাতত ঢাকা থেকে কাছেপিঠে কোথাও থেকে ঘুরে আসবে বলে জানিয়েছে আয়ান। পরে সাকিন ও পাখিকে দূরে কোথাও ঘোরার জন্য পাঠাবে আবার। সাকিন অবশ্য বেজায় খুশি। এমনিতেই সে ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। বসার ঘরে আলোচনা সভা বসেছে। দুই ভাই মিলে বিভিন্ন বিষয় কথাবার্তা বলছে। অনিমা আর পাখি রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছে। পাখিও খুব ভালো রান্নাবান্না করতে পারে। নতুন নতুন অনেক রান্নাও জানে। অনিমার আজকাল বেশ সুবিধা হয় সেজন্য। পাখির থেকে মাঝে মধ্যে রান্না শিখবে বলে ঠিক করেছে।

” এই যে তুই সারাক্ষণ গেমস খেলতে থাকিস এতে কোন উপকারটা হচ্ছে আমাদের? না একটু বল ভাই। ”

সাকিন সোজা হয়ে বসলো। মুখখানা বেশ সিরিয়াস করে ফেলেছে। ফ্রি ফায়ার গেমস নিয়ে কিছু বললে তার মুখচোখ এমনই হয়। আয়ান মূলত ওকে ক্ষ্যাপানোর জন্যই এসব বলছে।

” ঠিকই বলেছো ভাইয়া। এজন্য আস্তে আস্তে গেমস খেলা কমিয়ে ফেলবো। এমনিতেও অফিসে জয়েন করলে তো গেমস খেলার সময় হবে না। ”

সাকিনের গম্ভীর গলায় বলা কথাগুলো শুনে আয়ানের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কী বলছে এই ছেলে? সত্যি সবকিছু? অসম্ভব! সাকিন বলছে গেমস খেলা কমাবে? আয়ান একটু ভেবে নিলো সবটা। শেষে যা বুঝলো, বউ হলো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য জিনিস। এ জিনিস ঘরে আসলে পুরুষ মানুষ আকাশপাতাল বদলে যায়।

” বিশ্বাস কর ভাই, এমন সিরিয়াস কথা এ জীবনে আর কখনো শুনিনি আমি। জয় পাখির জয়! ”

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আয়ানের উচ্চস্বরে বলা কথায় দুই ঝা নড়েচড়ে উঠলো। কান খাড়া করে সবটা শুনে ওঁরাও হাসতে লাগলো। সাকিন মিটিমিটি হাসছে।

” ঠিকই বলেছো। যেমন অনিমা ভাবির জয়? তোমার মতো গম্ভীর লোকটাকে কেমন সামাজিক করে তুললো! আগে তো মুখখানা হপ করে রাখতে। ”

” তুই কি বলতে চাচ্ছিস আমি অসামাজিক ছিলাম? ”
নিজের জিহ্বায় কামড় দিয়ে কানে হাত দিয়ে আমতা আমতা করছে সাকিন। আয়ান ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।

” আরে না ভাইয়া। আমি তো ছোটো, ভুলে ভুলভাল কথা বলে ফেলেছি। ”

সাকিন কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ফের বলতে লাগলো,

” ভাবি ভাবি? হলো তোমাদের পকোড়া ভাজা? ”

সাকিন আয়ানকে একা বসিয়ে রেখে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। ছোটো ভাই চলে যেতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো আয়ান।

আগামীকাল সিলেটের জাফলং যাচ্ছে অনিমা,আয়ান ও পাখি, সাকিন। জাফলং মূলত মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং এটি তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এখানে পাহাড়, ঝর্ণা, নদী এবং বালু-পাথরের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। ঢাকা থেকে যদিও প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে তবুও আশেপাশে এর থেকে ভালো জায়গা নেই বলেই ধারণা অনিমার। সেজন্য জাফলং যাওয়াই ফাইনাল হয়েছে।

” শরীর কি খারাপ লাগছে? এতো অল্প খেলে যে!”

পাশাপাশি শুয়ে আছে অনিমা ও আয়ান। আয়ান শুধালো। অনিমা পাশ ফিরে শুয়ে মুচকি হেসে বললো,

” এতো খেয়াল? বাহ! আমার বর তো ইদানীং খুব কেয়ারিং হয়ে যাচ্ছে। ”

” কথা ঘুরিও না। বলো কিছু হয়েছে? ”

” আরে এমনি খাইনি। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে আজকাল। ”

” ঔষধ এনেছ? ”

” এমনি সেড়ে যাবে। ”

” বেশি বুঝো। কালকে ঔষধ কিনে নিবো। ”

অনিমা আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আয়ান সুযোগে জড়িয়ে ধরেছে ওকে।

” ঠিক আছে। ”

” না মানে বলছিলাম…..”

আয়ান এতটুকু বলে হালকা কেশে উঠলো। অনিমা মাথা উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ” কী? ”

” বলছিলাম যে একটু আদর করি? ”

আয়ান হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালো একটুখানি! অনিমা ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,

” একটু? ”

” বউয়ের যতটুকু আদর লাগবে ঠিক ততটুকু। ”

” উমমম….. আপাতত আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। ”

” বেশ। এসো তাহলে। আদর পরে হবে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমিয়ে যাও। সকাল সকাল আবার উঠতে হবে। ”

অনিমা আয়ানের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আয়ানও মাথায় কিস করলো ওর। মানুষটা খুব বোঝে। কখনো কোনো বিষয় রাগ করেনি৷

” ঠিক আছে। শুভ রাত্রি। ”
” শুভ রাত্রি। ”

ভোরের আলো আস্তে আস্তে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে, যেন সোনালি রঙের পর্দা পুরো পৃথিবীটাকে ঢেকে দিয়েছে। আকাশের পূর্ব দিগন্ত থেকে সূর্যধ্বনি ভেসে আসছে, ছোট ছোট মেঘের টুকরো রোদের আলোর সাথে মিশে গোলাপি আভা সৃষ্টি করেছে।

অনিমা, আয়ান, পাখি, আর সাকিন চারজন নিজেদের গাড়িতে চেপে ঢাকা থেকে সিলেটের দিকে রওনা দিয়েছে। দিনের এই প্রথম ভাগের স্নিগ্ধতা আর রাস্তার নিরবতা তাদের মনটাকে শান্ত করে তুলেছে। এ যাত্রা তাদের কাছে শুধু একটা ভ্রমণ নয়, এটা যেন কিছুদিনের জন্য শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তির একটা পথ। আয়ান গুনগুন করে গান গাচ্ছে, পাখি জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে, সাকিন পুরো ভ্রমণের রুট এবং সময় সম্পর্কে হিসেব করে চলেছে, আর অনিমা তো এমনিই প্রকৃতির সাথে হারিয়ে গিয়েছে।

রাস্তার মোড় ঘুরতেই তারা অনুভব করছে সিলেটের পথের প্রকৃতির ভিন্নতা। এই ভ্রমণ শুধু সিলেট পৌঁছানোর জন্যই নয়, বরং প্রতিটা মাইল পাড়ি দেওয়ার মধ্যেই যেন তাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হচ্ছে।

গাড়ি চলতে চলতে সকাল আরও এগিয়ে যায়। তারা শহরের কোলাহল থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে । রাস্তার ধুলোমাখা পথ, চারপাশে সবুজের মেলা, আর মাঝেমধ্যে পাখির কিচিরমিচির—সবকিছু মিলে যেন এক সুরের ভেলায় ভাসছে তারা। আয়ান হালকা মৃদু সুরে গান গাইতে শুরু করেছে। অনিমা ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। লোকটা গানও গাইতে পারে! পাখি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হালকা হাওয়ার স্পর্শ অনুভব করছে।

একটু পরেই তাদের সামনে একটা নদীর বাঁক দেখা গেলো। নদীর ওপর দুপুরের সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে, চারপাশে এক অপার্থিব সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে। নদীর তীর ধরে শীতকালীন কুয়াশা এখনও একটু একটু ভেসে আছে। সাকিন গাড়ি থামায়, সবাই মিলে একটু বিরতি নেয়। সকাল থেকে আয়ানই গাড়ি ড্রাইভ করেছে, সাকিন ঘন্টাখানেক হলো ড্রাইভিং সিটে বসেছে। সবাই গাড়ি থেকে নেমেছে। অনিমা চারপাশের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বলে,

“কী সুন্দর চারপাশটা! স্বপ্নের মতো একেবারে । এখানেই থেমে থাকতে ইচ্ছে করছে ।”

” তাহলে এখানেই থাকো। ”

আয়ান এ কথা বলে সামনে এগিয়ে গেলো। অনিমা মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান সবাইকে একটা হালকা খাবার খেতে বললো। সেইমতো গাড়ি থেকে নামার পর তারা তৃপ্তির সাথে কিছু স্ন্যাকস খেলো। কিছুক্ষন পর তারা আবার রওনা দেয়, সিলেটের পথে একের পর এক সৌন্দর্যকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে। অনিমা, আয়ান, পাখি, আর সাকিন—চারজনই জানে, এই ভ্রমণ শুধু গন্তব্যের জন্য নয়, বরং প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগের জন্য।

চলবে,