প্রেমের তাজমহল_২ পর্ব-২+৩

0
19

#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব২+৩
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

সকাল সকাল আনায়া রেডি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাস্ত হাতে চিরুনি চালাচ্ছে চুলের ভাঁজে। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে কোনোরকমে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ছুটলো নিচে। নিচে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে আশরাফ খান, আয়ান আর আবির। আনায়া যেয়ে ধপাস করে আবিরের পাশে বসে পড়লো। আবির আনায়ার চুল টেনে ধরে বলল,
“কি সমস্যা? আসতে ধীরে ভদ্র ভাবে বসতে পারিস না?”

“ভাইয়া চুল ছাড়ো। লাগছে”

আবির কথা না বাড়িয়ে চুল ছেড়ে দিলো। আশরাফ সাহেব এক মনে খাবার খাচ্ছিলেন শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকালেন। আয়ানের কোলে বসা নাদিরাও খাওয়া বাদ দিয়ে তাকালো আনায়ার দিকে। আনায়া সেগুলো খেয়াল না করে হাক ছাড়লো খাবারের জন্য। আশালতা বেগম মেয়ের খাবার দিয়ে গেলেন। আনায়া খাবার খাচ্ছে এমন সময় আশরাফ সাহেব কাশি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি ভাবলে আনায়া?”

আনায়া তার বাবার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন বিষয়ে?”

“বিয়ের বিষয়ে?”

আনায়া খেতে খেতে জবাব দিলো,
“আমি এখন বিয়ে করবো না বাবা”

“অর্ণবকে পছন্দ হয়নি?”

আনায়া এবার গম্ভীর হলো কিছুটা। মুখে গম্ভীর্য বজায় রেখেই বলল,
“তুমি তো জানো বাবা রাজনীতি করা ছেলে আমার একদম পছন্দ না”

“রাজনীতি করা সবাই এক হয়না মা! ছেলেটা এর আগেও আবিরের সাথে কয়েকবার বাড়িতে এসেছে। তার কোনো খারাপ দিক লক্ষ্য করেছো?”

আনায়া ভাবলো তবে খারাপ কিছুই পেলো না। তাই মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল।
“তাহলে সমস্যা কোথায়?”

“বাবা ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে তখন সে বাড়িতে আসতো। কিন্তু এখন কথাটা সারাজীবনের। তুমি যাকে বিয়ে করতে বলবে আমি তাকেই বিয়ে করবো তবে ওই এমপিকে বাদে”

আশরাফ সাহেব হতশার নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মেয়ে তার নাছোড় বান্দা বুঝিয়েও লাভ নেই। এবার মুখ খুলল আবির।
“বনু অর্ণব যথেষ্ট ভালো ছেলে। প্রায় অনেক বছরের ফ্রেন্ডশীপ আমাদের। স্কুল, কলেজ,ভার্সিটি শেষ করে এখন দুজন কর্ম জীবনে আছি। ওকে এই পর্যন্ত কোনো মেয়ের সাথে ভালো করে মিশতেই দেখিনি। সব চেয়ে বড় কথা সবাই তো..”

আনায়া আবিরকে থামিয়ে দিলো।
“হয়েছে ভাইয়া বন্ধুর হয়ে আর সাফাই গাইতে হবে না। তোমার বন্ধু কতটা সাধু সেটা আমার কালই বোঝা হয়ে গিয়েছে”

বলে উঠে দাঁড়ালো আনায়া। মেজাজ বিগড়ে গেছে তার। উঠে সদর দরজার দিকে হাঁটা দিলো। ভাবতে লাগলো কাল বিকেলের ঘটনা। অর্ণব নিচে যাওয়ার পর ও আর নিচে যায়নি। নিজের রুমেই ছিলো। হটাৎ কি মনে করে ব্যালকনিতে গেল। অর্ণবরা তখন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। হুট্ করে অর্ণব ওপরের দিকে তাকালো। চোখচোখি হলো দুজনের। আনায়া চোখ সরিয়ে নিবে তার পূর্বেই অর্ণব ঠোঁট গোল করে কিসে দেওয়ার ভঙ্গিমা করলো। আনায়া ভরকে গেলে খানিকটা। অর্ণব হেসে চলে গেলে। আনায়া মনে মনে অর্ণবকে বকা দিতে ভুললো না। এই অ*সভ্য এমপি নাকি আবার ভালো! এটাও তাকে বিশ্বাস করতে হবে!

আনায়া গেটের বাহিরে বেরিয়ে দেখলো অর্ষা দাঁড়িয়ে আছে। আনায়াকে একা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে তুই একা যে?”

“আর কারো সাথে থাকার কথা ছিলো নাকি?”

অর্ষা খানিকটা আমতা আমতা করলো। আনায়া ওর অবস্থা দেখে হেসে দিলো। অর্ষাযর গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া খাচ্ছে। থাক এখন দেখতে না পেলে রাতে এসে দেখে যাস”

অর্ষা কোমরে হাতে গুঁজে বলল,
“আমার কি ঠেকা পড়েছে নাকি তোর ভাইকে দেখার? সামনে পড়লে দেখবো নাহয় নাই”

“হুম দেখাই যায় সব। কার ঠেকা পড়েছে আর কার না। এখন চল দেরি হয়ে যাচ্ছে”

অর্ষা রিকশা ডাকতেই দুজনে উঠে বসলো। এমনি প্রতিদিন আবির আনায়া আর অর্ষাকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসে। আজকে আনায়া রেগে চলে আসায় আবিরকে ফেলেই চলে এসেছে। রিকশা চলা শুরু করলো আপন গন্তব্যে।

আবির বেরিয়ে এসে বনুকে খুজলো। বাড়ির বাহিরে এসে না পেয়ে বুঝলো আনায়া রাগ করে চলে গেছে। আবিরও বেশি না ভেবে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

রিকশা এসে ভার্সিটির সামনে থামতেই ওরা নেমে গেল। ভাড়া মিটিয়ে ঢুকলো ভার্সিটির ভিতরে। এই নিয়ে সপ্তাহ খানেক হবে আনায়া ভার্সিটি এসেছে। তেমন কাউকেই চিনে না। অর্ষার হাত ধরে মাঠ পেরিয়ে নিজ ডিপার্টমেন্ট এর দিকে যেতে নিবে এমন সময় কেউ ডেকে উঠলো,
“এইযে নীল পরি, এদিকে এসো”

আনায়া নিজের দিকে ভালো করে খেয়াল করলো। ওর গাঁয়ে নীল রঙের চুড়িদার। আনায়া থেমে গেলে অর্ষা ফিসফিস করে বলল,
“থামিস না চল, এরা সিনিয়র। পড়ে দেখা যাবে রেগ দিবে”

অর্ষা কথা শুনে আনায়া ফের এগোতে নিলে ছেলে গুলো আবার ডেকে উঠলো। আনায়া পিছু ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
“আমাকে বলছেন?”

“হ্যাঁ নীল পরী তোমাকেই বলছি। এদিকে এসো দেখি, এদিকে সিনিয়র ভাইয়ারা বসে আছে তাদের সাথেও একটু পরিচিত হয়ে যাও”

আনায়া বুঝতে পারলো এরা রেগিং দেওয়া জন্যই ডাকছে। আনায়া অর্ষার দিকে তাকালো। বেচারি শুকনো ঢোক গিলে ভীতু চোখে আনায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আনায়া শক্ত হাতে অর্ষার হাত চেপে
ছেলেগুলোর সামনে এগিয়ে গেল। হেসে বলল,
“কিছু বলবেন ভাইয়া? আসলে আমাদের ক্লাস ছিলো তো, ক্লাসে যাবো”

“নীল পরী গান জানো?”

“না”

“তাহলে তো হলো না পরী”

অর্ষা বলল,
“ভাইয়া এবার আমরা যাই। ক্লাসে দেরি হচ্ছে”

ছেলে গুলোর মাঝে এক শব্দ করে হেসে বলল,
“এতো তাড়া কিসের পরী? আগে ভাইয়াদের সাথে পরিচয় হও তারপর নাহয় যেয়ো”

অর্ষা আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। ছেলেটা এবার হাক ছেড়ে ডাকলো,
“এই নিশান কই তুই? এদিকে আয়। দেখে যা আকাশ থেকে নীল রঙের পরী নেমে এসেছে ধরণীতে”

বলে কেমন করে যেন হাসলো। আনায়ার এদের মতলব ভালো লাগছে না। ও পারছে না ছেলেগুলোকে কিছু বলতে। সবে কয়েকদিন হলো ভার্সিটি জয়েন করেছে এখনই কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না। তাই চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছে। আনায়ার ভাবনার মাঝেই আগমন ঘটলো নিশানের। ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে এলো। আনায়ার আশেপাশে ঘুরে ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলো,
“মামা এ তো সত্যিই নীল পরী! দিল খুশ হো গায়া। ইচ্ছে করছে পরীটাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখি, যেন কেউ দেখতে না পারে”

কথা গুলো বলে জঘন্য রকমের হাসি দিলো। আনায়ার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে জুতা খুলে নিশানের মুখে মারতে। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আনায়ার চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে পারলে চোখ দিয়েই ও নিশান কে ভস্ম করে দিতো। আনায়া রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কিছু বলতে যাবে তার আগে অর্ষা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া আমাদের ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে আমরা গেলাম। পড়ে সময় করে পরিচিত হয়ে যাবো”

বলে কোনো রকমে মুখে হাসি ফুটিয়ে চলে এলো। আনায়া শেষবার আশার আগে নিশানের দিকে রক্তিম দৃষ্টি ফেলতে ভুললো না। আনায়ারা চলে গেলে নিশান সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিয়ে পাশে থাকা এক ছেলেকে বলল,
“পরীর ডিটেলস বের কর। পরীটারে হেব্বি ভাল্লাগছে”

ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় জানালো। আনায়া ক্লাসে এসেও রাগে ফোঁসফোঁস করছে। অর্ষা কোনো মতে ওকে শান্ত করলো।

অপর দিকে অর্ণব সারাদিন ব্যাস্ততার মাঝে ছিলো। রাত নয়টা নাগাদ বাড়ি এসে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলো। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবী সুঠাম দেহের সাথে লেপ্টে আছে। গরমে নাজেহাল অবস্থা বেচারার। পাঞ্জাবীর বোতাম গুলো একে একে খুলে ফেলল। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। হটাৎ মাথায় এলো আনায়া নামক রমণীর কথা। সারাদিনের ব্যস্ততায় খবর নেওয়া হয়নি। মেয়েটা কি রাজি হলো? নাকি নাকোচ করে দিলো! ভাবতে ভাবতে পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়ে ফোন বের করে ডায়াল করলো আনায়ার নাম্বারে।

পড়তে বসেছে আনায়া। বরাবরই মেয়েটা মেধাবী ছাত্রী। পড়া নিয়ে সিরিয়াস। যেখানে ভার্সিটিতে উঠে ছেলেমেয়েরা পড়া বাদ দিয়ে আড্ডা দেয় সেখানে ও সপ্তাহ খানেক ক্লাস করেই বই খাতা নিয়ে বসে পড়েছে। পাশে রাখা ফোন বাজতে দেখে সেদিকে তাকালো। স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে কেটে দিলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলে সব সময় এমনটাই করে। আবার ফোন বেজে উঠলো। আনায়া এবারও কেটে দিলো। তিন বারের মাথায় ভাবলো হয়তো পরিচিত কেউ নতুন নাম্বার দিয়ে কল দিয়েছে। সেই ভেবে কল রিসিভ করে সালাম দিতেই অপর পাশ থেকে ভেসে এলো ধমকের সুর,
“কি সমস্যা? ফোন রিসিভ না করে বারবার কেটে দিচ্ছিলে কেন?”

আনায়ার মেজাজ চোটে গেল। চিনে না জানে না ফোন দিয়ে ঝাড়ি দেওয়া হচ্ছে!
“কে আপনি ভাই? চিনেন না জানেন না একটা মেয়েকে ফোন দিয়ে রাত বিরেতে ঝাড়ছেন?”

“ভাই না তোমার ভবিষ্যত জামাই বলছি মেয়ে। আমার বউ আমি যখন ইচ্ছে ফোন দিতেই পারি”

আনায়ার বুঝতে দেরি হলো না ফোন দেওয়া মানুষটা যে অর্ণব।
“এক মিনিট, এক মিনিট! আপনার বউ কে?”

“কেন? তুমি”

“আপনার আর আমার বিয়ে হলো কবে যে বউ বউ করছেন?”

“বিয়ে হয়নি তবে হতে কতক্ষন?”

“জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে থাকুন মিস্টার। এই জীবনে আমি আপনাকে বিয়ে করছি না”

“দেখা যাবে কে কাকে বিয়ে করে আর না। এখন জলদি করে নাম্বার টা ‘জামাই’ নামে সেভ করে নেও তো। চাইলে জান, প্রাণ, কলিজাও দিতে পারো আই ডোন্ট মাইন্ড”

“আপনি আপনার বাজে বকা বন্ধ করবেন? পড়ছি ডিসটার্ব করবেন না। রাখছি”

কথাগুলো বলেই আনায়া ফট করে কল কেটে দিলো। পড়ার সময় ডিসটার্ব জিনিস টা ওর মোটেও পছন্দ না। কিন্তু ভাবনার বিষয় এই যে ওর নাম্বার এই লোক কোথায় পেল? অপর দিকে অর্ণব আনায়ার কাণ্ডে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইল। অতঃপর কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

#চলবে?

#প্রেমের_তাজমহল_২
#পর্ব৩
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

রাতের নিকষ কালো আঁধার কাটিয়ে চারপাশ আলোকিত হচ্ছে সূর্যের আলোয়। সূর্যের আলো এসে আনায়ার মুখে পড়তেই বেচারির ঘুম ছুটে গেছে। পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলো টেবিলে। কাল রাতে অর্ণবের কল কেটে পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে সে খেয়াল নেই। পুরো শরীর কেমন ম্যাচম্যাচ করছে। টেবিলে বইয়ের ওপর মাথা রেখে ঘুমানোর জন্য ঘাড়ও ব্যাথা করছে। আনায়া উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নিচে নামলো। এখন এক কাপ কফি না হলেই নয়! কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। আনায়া কফি বানিয়ে নিয়ে রুমে চলে এলো। হাতে গরম ধোয়া ওঠা কফি তার সাথে মনোরম সকাল। স্নিগ্ধ সকাল উপভোগ করতে করতে কফি শেষ করলো।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে তাপমাত্রা। আনায়া অর্ষা দুজন ক্যান্টিনে বসে খাবার খাচ্ছে সাথে গল্প করছে। ওদের সাথে যোগ দিলো ওদের নতুন দুই বান্ধবী রাইহা, দিয়া।

নিশান ক্যান্টিনে ঢুকলো। চারপাশে খেয়াল করতেই চোখ পড়লো আনায়ার ওপর। সেদিকে এগিয়ে যেতে নিবে তার আগেই পাশ থেকে কেউ একজন তাকে ডেকে বসলো। আনায়া নিশানের নাম শুনে চকিতে ঘুরে তাকালো। ভাবলো এই বুঝি অ*সভ্যটা ওদের দিকে আসছে। নিশানকে দেখলেই কেন যেন ওর গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। লোকটার চোখের চাওনি বড্ড বাজে। কাল যখন নিশান আনায়ার চারপাশে ঘুরে ওকে পর্যবেক্ষণ করছিলো আনায়ার পুরো শরীর তখন রাগে জ্বলছিল। ইচ্ছে করছিলো লোকটার চোখে মরিচ গুঁড়ো ডলে দিতে। আনায়া কোনো মতো তখন তার রাগ সামলে রেখেছিলো। নিশান চলে গেল অন্য দিকে। আনায়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো। খাওয়া শেষ করে ক্লাসে ফিরলো।

আবির গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। আনায়াদের বাড়ি দিয়ে ফের অফিসে যাবে সে। আবির ড্রাইভ করতে গিয়ে অকস্মাৎ তার চোখ আটকালো রাস্তার পাশে ফুচকার স্টলে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমণীর ওপর। মেয়েটা এক মনে পাশে দাঁড়ানো বন্ধুবান্ধব দের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। বাকি খেয়াল যেন সে ভুলেই বসেছে! আবিরের মেজাজ মুহূর্তেই বিগড়ে গেল। মেয়েটা দিন দিন তার কথা শুনছে না। অবাধ্যতা করছে। আজকে খালি একবার তাকে বাগে পাক। অতঃপর দেখাবে মজা। আবির না দাড়িয়ে সাঁই করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

—–

ভার্সিটি নতুন বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে কেটে যাচ্ছে আনায়ার দিনগুলো। সেদিনের পর থেকে নিশান আনায়ার সামনে পড়েনি। আনায়া সব সময় এড়িয়ে চলেছে। তাড়াহুড়ো করে ভার্সিটিতে ঢুকতো আবার ক্লাস শেষ হলেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে যেত। এই নিয়েই কেটে গেল দুটো দিন।

শুক্রবার দিন হওয়ায় আনায়া বাসায় আছে। ড্রয়িং রুমে বসে বসে টিভি দেখছে। একের পর এক চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছে। মন মতো কিছুই পাচ্ছে না। এমন সময় পাশে এসে বসলো আবির। ওর হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে খেলার চ্যানেল দিলো। আনায়া ফুসে উঠে বলল,
“ভাইয়া রিমোট নিলে কেন? রিমোট দেও মুভি দেখবো”

“ল্যাপটপে গিয়ে দেখ। এখন আমি খেলা দেখবো”

আনায়া আবিরের হাত থেকে রিমোট কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু নাগাল পাচ্ছে না।
“তুমি তোমার ফোনে খেলা দেখো। আমায় রিমোট দেও”

“টিভিতে খেলা দেখার মজাই আলাদা। তুই যেয়ে রুমে শুয়ে শুয়ে মুভি দেখ। আর নাহয় পরে দেখিস”

“মোটেও না। আমি টিভিতেই মুভি দেখবো তাও আবার এখনই”

রিমোট নিয়ে দুই ভাই-বোন মা*রামা*রি করছে। আশালতা বেগম রান্না ঘর থেকে খাবার এনে টেবিলে রাখছেন। দুজন কে মা*রামা*রি করতে দেখেও কিছু বললেন না। কারণ এদের বলেও লাভ নেই। এই দুজন শুধরানোর মতো না। আবির হাতে রিমোট নিয়ে উঁচু করে ধরে রেখেছে। ৫ ফিট ৯ইঞ্চি আবিরের নাগাল পাচ্ছে না ৫ফিট ৪ ইঞ্চি আনায়া। লাফিয়েও নাগাল না পেয়ে হতাশ হলো। তবে ওর হতাশা বেশিক্ষন টিকলো না। কি যেন ভেবে হটাৎ করে আবিরের চুল ধরে টান দিলো। বেচারা আবির চুলে ব্যাথা পেয়ে নিচু হতেই আনায়া ছো মে*রে রিমোট নিয়ে দৌড় যাকে বলে। ওর নাগাল আর পায় কে। আনায়ার পিছু ছুটলো আবির। দুই ভাই বোন ড্রয়িং রুম জুড়ে ছুটোছুটি করছে। আশালতা বেগম এদের দেখে কপাল চাপাড়ানোর মতো অবস্থা তার। মেয়ে দুদিন পর বিয়ে দিবে, দামড়া ছেলে মেয়ে গুলো নাকি এমন বাচ্চাদের মতো ছুটোছুটি করছে এগুলো মানা যায়! রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে নীলিমা বলল,
“এই তোরা দুই টম এন্ড জেরি থামবি? নাকি মাইর লাগাবো দুটোকে?”

আনায়া অভিযোগের সুরে বলে উঠলো,
“ভাবি দেখোনা আমি মুভি দেখবো ভাইয়া আমায় দেখতে দিচ্ছে না”

আবির বলে উঠলো,
“তুই যে আমায় খেলা দেখতে দিচ্ছিস না সেই বেলায়?”

নীলিমা নিজেও কপাল চাপড়ালো। ও কাদের বলতে এসেছে। যারা কিনা সুযোগ পেলেই একজন আরেকজনের পিছু লাগে তাঁদের? আনায়া আর আবির ছুটোছুটি করছে এমন সময় নীলিমার চোখ পড়লো সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা হওয়া অর্ষার দিকে।
“আরে অর্ষা তুমি? কখন এলে?”

নীলিমার কথায় আনায়া আবির থেমে গেল। ওরা থেমে গেলেও অর্ষার হাসি থামার নাম নিচ্ছে না। আনয়া, আবির, নীলিমাকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্ষা কিছুটা লজ্জা পেল। হাসি থামিয়ে বলল,
“সরি!”

“আরে সমস্যা নেই। তুমি ভিতরে এসো”

নীলিমার কথায় অর্ষা ভিতরে এলো। নীলিমা কুশল বিনিময় করে চলে গেল রান্না ঘরে। অর্ষা আবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছেন আবির ভাই?”

আবির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি?”

“হুম ভালো”

আবির সৌজন্যে মূলক হাসি দিলো। অর্ষা তাকিয়ে আছে আবিরের হাসির দিকে। আবিবের কাছে একটু অস্বস্থি লাগছে। বাহিরের মানুষের সামনে হুট্ করে এমন পরিস্থিতিতে পড়ায়। তার ওপর মেয়েটা তার ছোটো বোনের বান্ধবী প্লাস প্রতিবেশী। তাই কথা না বাড়িয়ে ওপরে যেতে যেতে বলল,
“আমি রুমে যাচ্ছি। তুই মুভি দেখ”

এই বলে রিমোট আনায়ার দিকে ছুড়ে দিয়ে গট গট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল। আনায়া রিমোট হাতে পেয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করলো। অর্ষা এখনো তাকিয়ে আছে আবিরের যাওয়ার পানে। আনায়া গিয়ে অর্ষাকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“চলে গেছে”

অর্ষা হুস ফিরে আনায়ার কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“মানে?”

“ভাইয়া আরো আগেই চলে গেছে”

“ও আচ্ছা”

“আয় মুভি দেখি আর গল্প করি”

দুই বান্ধবী বসে পড়লো গল্প করতে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় হুট্ হাট ইচ্ছে হলেই বান্ধবীর সাথে গল্প করতে চলে আশা যায়। অর্ষা প্রায় সময়ই আনায়াদের বাড়িতে চলে আসে গল্প করতে। ওদের বাড়িতে ও আর ওর মা ছাড়া কেউ নেই। গল্প করারও তেমন সঙ্গী নেই। এখানে আসলে মিহি, আনায়া, নীলিমা, মাহির মিলে একসাথে আড্ডা দেয়। মন ফ্রেশ হয়ে যায় নিমিষেই।
——

রাত নয়টা নাগাদ ব্যস্ত শহরে মানুষের আনাগোনার শেষ নেই। রাস্তায় গাড়ি চলছে অবিরাম। দূর থেকে অস্পষ্ট শব্দে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ণের শব্দ। আনায়া ব্যালকনিতে বসে আছে। হুট্ করে মাথায় এলো অর্ণবের কথা। সেদিন কল কাটার পর অর্ণব ওকে ফোন দিয়েছে বহুবার। তবে আনায়া রিসিভ করেনি। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে। আনায়া চায় না অর্ণবের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতে। সে যে রাজনীতি আর রাজনীতি করা মানুষ গুলোকে বড্ড অপছন্দ করে। তবে ওপর ওয়ালার ইচ্ছে যে অন্য কিছু।

আনায়ার ভাবনার মাঝে পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। আনায়া ধ্যান ফিরে পেয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো আবিরের নাম্বার। ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। আবির রুমে বসে ওকে কল দিচ্ছে কেন? যা বলার সরাসরি ডেকেই তো বলতে পারে। আনায়া রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এলো,
“২ মিনিটের মাঝে ছাদে এসো। নাহয় আমি যদি রুমে আসি তাহলে ভালো হবে না মেয়ে। আগেই সতর্ক করে দিচ্ছি, পড়ে কিন্তু বলতে পারবে না লু’চু এমপি”

ফট করে কল কেটে গেল। আনায়া ঢোক গিললো। এখন না গেলে যদি সত্যি সত্যি অর্ণব চলে আসে তখন? এই অ*সভ্য এমপি কে দিয়ে বিশ্বাস নেই। আনায়া সুন্দর করে গাঁয়ে ওড়না জড়িয়ে নিলো। বুকে ফুঁ দিয়ে ছাদের দিকে হাঁটা দিলো।

আনায়া ছাদের দরজায় এসে থেমে গেল। বুক কাঁপছে! হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে অস্বাভাবিক গতিতে। মানুষটা কি তার নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলার জন্য আনায়ার গর্দান নিবে? নাকি জেলে দিবে তাকে? আনায়া নিজের মাথায় চাপড় মা*রলো। এতো টুকু বিষয়ে নিশ্চই কেউ এমন কিছু করবে না। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ছাদে প্রবেশ করলো।

ছাদের এক কোণে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। আনায়ার পায়ের শব্দ পেয়ে পিছু ঘুরে তাকালো। একটু একটু করে এগিয়ে আসলো ওর সামনে। একদম বরাবরই দাঁড়িয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো আনায়াকে। চাহনি তার শান্ত। আনায়া ভিতরে ভিতরে ভয় পাচ্ছে। অর্ণব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ফোন রিসিভ করেছিলে কেন?”

“ব্যস্ত ছিলাম তাই”

আনায়া মিন মিনে স্বরে জবাব দিলো। অর্ণব হাসলো।
“ব্যস্ত ছিলে ভালো কথা তাহলে নাম্বার ব্লক লিস্টে গেল কিভাবে?”

আনায়া এবার চুপ। অর্ণব কণ্ঠ কিছুটা গম্ভীর করে বলল,
“আমায় শেখাতে এসো না মেয়ে। এই অর্ণব সিকদার তোমার চেয়ে বহুগুন জানে। এসব বাহানা আমার সামনে চলবে না”

অতঃপর আরেকটু এগিয়ে এসে আনায়ার নত মুখ থুতনিতে হাত রেখে তুলে দিলো। চোখে চোখ রেখে বলল,
“এর পরের বার এতটা সুন্দর করে বলবো না। নাম্বার ব্লক লিস্টে গেল ঠুস্ করে তুলে নিয়ে গিয়ে ঠাস করে বিয়ে করে ফেলবো। এখন তো আমার ফোন সহ্য করছো, তখন গোটা আমিটাকেই সহ্য করতে হবে”

আনায়া ঢোক গিললো। মনে মনে বলল,
“তোকে কে বিয়ে করবে, বেটার অ*সভ্য এমপি”

কিন্তু মুখে বলার সাহস হলো না। ও যা করেছে এরপরও যে অর্ণব বেশি কিছু করেনি এই অনেক। ও তো ভেবেছিলো অর্ণব বুঝি আচ্ছা মতো ধোলাই দিবে। অর্ণব আনায়ার মাথায় দেওয়া ওড়নাটা আরেকটু টেনে দিয়ে বলল,
“কথা গুলো মনে থাকে যেন। নাম্বার ব্লক লিস্ট থেকে উঠাবে। আর ফোন দিলে প্রথম বারেই রিসিভ হওয়ার চাই”

আনায়া ভয়ে ভয়ে সম্মতি জানিয়ে দিলো। অর্ণব আনায়ার কাণ্ডে হেসে দিলো।
“গুড গার্ল”

এর মাঝেই কল দিলো আবির। অর্ণব কে ডাকছে, দুজন মিলে বের হবে। পুরোনো কিছু বন্ধুবান্ধব দের সাথে দেখা করবে। অর্ণব আনায়াকে বলে ছাদ থেকে চলে গেল। আনায়া পিছন থেকে ভেংচি কাটলো।

#চলবে?

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ )