#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সূচনা পর্ব ১
#সমুদ্রিত সুমি
ভার্সিটিতে এসে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে পাত্রের মা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাও ভার্সিটিতে এটা জানা ছিলো না। তোহফা, বাবা-মায়ের তৃতীয় অর্থাৎ ছোট সন্তান। আল্লাহ তাকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর তোহফার মা-বাবা আর কোনো সন্তানের জন্য আর্জি করেনি মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট, তার কারণ পরে বলা যাবে। এখন বলি একটু আগে তোহফার সাথে ঘটে যাওয়া আজগুবি ঘটনাটি। আজ ভার্সিটিতে প্রথম দিন। চারিদিকের গ্রীষ্মতপ্ত পরিবেশে তোহফার অবস্থা শোচনীয় হলেও নিজের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার খুশি বেশি ছিলো বলেই কষ্ট উপলব্ধি করেনি। যানজট যুক্ত পরিবেশ পেরিয়েই নিস্তব্ধতায় মোড়ানো শৈথিল্যের হাওয়ায় নিজেকে বিলিয়ে বিশাল দরজা পেরিয়ে ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করেছে মাত্র। চারিদিকের সৌন্দর্য যেন পাগল করে তুললো মুহুর্তেই। গোল হয়ে বসে আড্ডায় মেতে থাকা বন্ধুমহলের ছবি তুলতেও ভুললো না নিজের পছন্দের ফোনে। সারি সারি গাছগুলোর ডালে বসে থাকা পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতে এগিয়ে যাচ্ছিলো সামনের দিকে, ঠিক তখনই কোথা থেকে একজন ভদ্রমহিলা এসেই ওর গাল টেনে দিলেন। ‘আহ্’ বলেই যখন কিছু বলতে যাবে অমনি তিনি তোহফার চোখে মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
“কি মিষ্টি দেখতে তুমি মেয়ে! এতো সুন্দর মেয়ে রেখে আমি কিনা এতোক্ষণ চরকির মতো এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছিলাম ভাবা যায়। তুমি মেয়ে ভারি মিষ্টি। তোমাকে আমার ছেলের বউ করতে চাই। তুমি রাজি?”
উনার কথায় তোহফা শুকনো বিষম খেলো। কাশতে কাশতে বললো,
“আন্টি আমি এখানে পড়ালেখা করতে এসেছি, বিয়ে করতে না। আপনি কে? আর বেছে বেছে আমাকেই আপনার কেন পছন্দ হলো?”
“দেখো দেখি মেয়ে বলে কি? শোনো মেয়ে, আমি জানি এখানে সবাই পড়ালেখা করতে আসে। তাই এখানেই মেয়ে খুঁজতে এলাম। তবে একটা মেয়েও পছন্দ হলো না। তুমি একটু ভালো করে চেয়ে দেখো ওরা কেমন ভাবে এসেছে লেখাপড়া করতে। এদের পোশাকআশাক দেখে আমি খুব কষ্ট পেলাম। মনে হচ্ছে এরা লেখাপড়া করতে নয় বিয়ে বাড়িতে এসেছে। তবে তোমার এমন শালীন পোশাক দেখে আমি বুঝে গেছি তুমি খুব ভালো।”
ভদ্রমহিলা চারিদিকে থাকা মেয়েদের দেখিয়ে কথাগুলো বললো। ওরা জিন্স, ফতুয়া, টপস পরে এসেছে । ওদের দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি দিতেও দ্বিধা বোধ করলেন না ভদ্রমহিলা। তোহফা নিজেও এসব পরে, তবে বাড়িতে। বাহিরে বের হলে সব সময় বোরকা পরে বের হয়। এবার সে ভদ্রমহিলাকে বললো,
“আন্টি আমি নিজেও এসব পরি।”
ভদ্রমহিলা ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন,
“দাঁড়াও আমার ছেলেকে ভিডিও কল দেই। ওকে দেখাই কেমন পুতুলের মতো একটা রাজকন্যা পেয়েছি ওর বউ করার জন্য। আমার ছেলে তোমাকে দেখলে নির্ঘাত হার্টঅ্যাটাক করবে। উফফ! এটা ভাবতেই আমার খুশি খুশি লাগছে।”
কথাগুলো বলে ভদ্রমহিলা ফোন বের করলেন। অবস্থা বেগতিক দেখেই তোহফা ছুটে চলে যেতে নিলো। তার আগেই মহিলা তার হাতটা খপ করে ধরে ফেললেন। কারো উদ্দেশ্যে বললেন,
“দেখ আমি মেয়ে পেয়ে গেছি, এবার তোকে বিয়ে দেওয়া থেকে আমাকে কে আটকায় আমিও দেখছি। দেখ মেয়েটা কতো কিউট আর সুন্দর। ”
এই কথা বলেই মোবাইলটি তোহফার নিকট এগিয়ে ধরলেন। তোহফা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যস্ত। তাই সে খেয়াল করলো না ফোনের ওপাশে কেউ তাকে মুগ্ধ চোখে দেখছে। তবে মুগ্ধতা গভীর হবার আগেই ছেলেটি তোহফার ছটফটানি দেখতে পেলো। তোহফার অস্বস্তিও চোখ এড়ালো না। নিজের মুগ্ধতা দূরে ঠেলে জোর গলায় মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“মা তুমি এগুলো কি করছো? তোমার পাগলামি এবার বন্ধ করো। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তোমার পাগলামির জন্য একটা মেয়ে বিব্রতবোধ করছে? প্লিজ মা দয়া করে মেয়েটার হাতটা ছেড়ে দাও। যেতে দাও উনাকে। ”
তোহফা ছেলেটার বলে যাওয়া প্রতিটি কথা শুনতে পেলো। তবে চোখ তুলে তাকানোর সাহস এই মুহূর্তে তার হয়ে উঠেনি। কি একটা বিচ্ছিরি অবস্থায় তাকে পরতে হলো ভেবেই তার খারাপ লাগছে। সতেজ মনটা বিগড়ে দিলেন এই ভদ্রমহিলা। ইচ্ছে করছে দু’চারটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। তবে কেন জানি নিজেকে কঠিন করতে পারলো না। তাই নরম সুরে বললো,
“আন্টি দয়া করে আমার হাত ছেড়ে দিন। দেখেন সবাই কীভাবে দেখছে আমাদের। ”
ভদ্রমহিলা চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তোহফাকে অবাক করে দিয়ে ফোনকলে থাকা ছেলেটির উদ্দেশ্য বললেন,
“সত্যি করে বল, মেয়েটা সুন্দর না?”
মায়ের আকস্মিক প্রশ্নে থমকে যায় ছেলেটি। তৎক্ষনাৎ বলার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সে। চোখ তুলে একবার তোহফার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। সত্যি বলতে মেয়েটা মাত্রাধিক সুন্দর। এই যে তার মায়ের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে – এখানেও যেন সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। সে ফোনকলে আছে প্রায় সাত মিনিট, এই সাত মিনিটে মেয়েটা একবারের জন্যও ফোনের স্ক্রীনে তাকায়নি। সেখানেও সৌন্দর্য খুঁজে পেলো ছেলেটি। মায়ের পাগলামির জন্য খারাপ লাগলেও মেয়েটার এমন সৌন্দর্য দেখে কিছুটা নয় অনেকটা ভালোও লেগেছে।
“কিরে কিছু বল। ”
হঠাৎ মায়ের কথায় ছেলেটা সম্বিৎ ফিরে পেলো। বিচলিত কন্ঠে বললো,
“কোথায় বসে এসব করছো তুমি মা?”
“কেন? আসবি এখানে? ঠিকানা দিবো? আমি জানতাম তুই এমন কিছুই বলবি। তবে তোর আসতে হবে না। আমি নিজেই আসছি মেয়েটাকে নিয়ে। তুই অপেক্ষা কর।”
এই কথা বলেই ফোনের লাইনটা কেটে দিলেন। এদিকে ভদ্রতা বজায় রাখতে গিয়ে তোহফার অবস্থা বেহাল। সে পারছে না ভদ্রমহিলাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে। অন্যদিকে ভদ্রমহিলা তোহফার হাত ধরেই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতটা এমন ভাবে আগলে ধরে আছেন যেন তোহফা কোনো চোর বা ডাকাত। ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। তোহফা হাঁটতে হাঁটতেই ভদ্রমহিলার উদ্দেশ্য বললো,
“আন্টি এমন করছেন কেন? আমাকে ছেড়ে দিন। আমি কোথাও যাবো না। আমি বাড়িতে না ফিরলে আমার বাবা-মা কষ্ট পাবে। দুই ভাই আর ভাবি পাগল হয়ে যাবে। দয়া করে আমায় ছেড়ে দিন।”
“চুপ করো মেয়ে, আমি কি তোমায় বিক্রি করতে যাচ্ছি নাকি? আমি তো রাজকন্যার সাথে রাজপুত্রের সাক্ষাৎ করাতে যাচ্ছি। আর তুমি বাড়ি না ফিরলে তোমার মা-বাবা কষ্ট পাবে কেনো? তোমার ভাইয়েরাও বা পাগল হবে কেনো? তুমি কি আজই আমাদের বাড়িতে সেটেল্ড হওয়ার পরিকল্পনা করছো না-কি? দেখো মেয়ে, আমি তোমার পরিবার ছাড়া তোমায় এভাবে নিয়ে যাবো না আমার বাড়িতে। আজ দুজনে দুজনকে দেখো, তারপর দুই পরিবার পাশাপাশি বসে কথা হবে। ”
তোহফা ভদ্রমহিলার কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না। তার কথার ভুল মানে বের করে কীভাবে তাকে এতোগুলা কথা শুনিয়ে দিলো মহিলা! এ কার খপ্পরে সে পড়লো? এটা ভেবেই নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো। কোনো উপায় না পেয়ে ভদ্রমহিলার সাথেই তোহফাকে রিক্সায় উঠতে হলো। সে যে চিৎকার করে লোক জড়ো করবে তারও কোনো উপায় নেই। সে ছোট নয় যে তাকে চকলেট দেখিয়ে উনি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। উল্টো লোকজন তোহফাকে পাগলের উপাধি দিবে। এমন সাত পাঁচ যখন ভাবছে তখন তার হাতে ঠান্ডা শীতল কিছু অনুভব করলো। ভালো করে তাকাতেই দেখলো ভদ্রমহিলা কাঁদছেন। তোহফা ঘাবড়ে গেলো। ভদ্রমহিলার হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে তোহফা কি বলবে খুঁজে পেলো না। তবে ভদ্রমহিলার কান্নার গতিটা খুব ভয়াবহ। ফর্সা নাকমুখ হঠাৎ করেই লাল হয়ে উঠলো। কোনো গভীর ব্যথায় যে কাঁদছেন তিনি সেটা বুঝতে পারলো তোহফা। যে ব্যথায় তিনি রোজ কষ্ট পান হয়তো। নিজেকে সামলে তোহফা বললো,
“কি হয়েছে আন্টি কাঁদছেন কেন? এই দেখুন আমি আর ছোটাছুটি করবো না চলে যাবার জন্য। তবুও আপনি কাঁদবেন না প্লিজ।”
ভদ্রমহিলার কান্না থামেনি। তিনি নিজের মতো করেই চোখের জল বিসর্জন দিতে থাকলেন। এভাবেই কেটে গেলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর ভদ্রমহিলা বললেন,
“আমি ডিমেনশিয়া নামের একটা রোগে আক্রান্ত, যাকে বলে ভুলে যাওয়া রোগ। আমার ভুলে যাওয়ার রোগ আছে। সকালে কি নাস্তা খেয়েছি সেটাও ভুলে যাই মিনিট দু’য়েক পর। তাই তোমাকে ধরে আছি যেনো তোমাকে ভুলে না যাই । এই জন্যই এতো তোড়জোড় করে “আওয়াদ” আমার ছেলের সাথে তোমাকে দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি কষ্ট পেয়ো না মা। আমি তোমাকে জোর করে নিয়ে আসায় কিছু মনেও করো না। আমার ছেলেকে দেখে যদি তোমার মনে হয় সে দেখতে বাজে। তাহলে আমি কিছু বলবো না বা মনেও করবো না। সত্যি বলছি। আমার এই রোগের জন্য ছেলেটা আমাকে নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকে। এমনকি আমার জন্যই বিয়ে করতে চাইছে না। ও মনে করে আমার এই রোগের জন্য আমার ছেলের বউ আমাকে অপছন্দ করতে পারে। তাই এতো শীঘ্রই ও বিয়ে করবে না। তুমিই বলো মেয়ে, আমি কি চিরজীবন ওকে দেখে রাখতে পারবো? আজ বা কাল যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তখন কি হবে ওর ? তিলতিল করে জমিয়ে রাখা আমাদের সম্পদের দিকে ওত পেতে আছে আমার ভাসুর, দেওর ও তাদের ছেলেরা। আমার সহজ সরল ছেলেটাকে ওরা খুন করতেও পিছপা হবে না। তুমিই বলো ক্ষতি হতে পারে জেনেও কীভাবে ছেলেটার একটা গতি না করে থাকি আমি। আমি যে মা, নিজের মৃত্যুকে এতো ভয় পাই না, যতোটা ভয় পাই আমার অনুপস্থিতিতে আমার সন্তানের কি হবে ভেবে। ”
ভদ্রমহিলা নিজের কথা শেষ করেই আবারও কাঁদতে শুরু করলেন। অন্যদিকে তোহফা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো ভদ্রমহিলার দিকে। বয়স কত হবে উনার? আটচল্লিশ বা সাঁতচল্লিশ হবে হয়তো। তবুও চেহারার জৌলুশ কেমন চকচক করছে। চোখের জলের প্রতিটা ফোঁটা মুক্তোর মতো ঝড়ে পড়ছে অধর বেয়ে। জৌলুশ চেহারা কেমন পাংশুটে হয়ে গেছে। একটু আগের অস্বস্তি কাটিয়ে তোহফা এবার নিজে থেকে ভদ্রমহিলার হাত দু’টো আকঁড়ে ধরে বললো,
“এভাবে কাঁদবেন না আন্টি আমার খারাপ লাগছে। আপনার সাথে কোনো রকম কথা না বাড়িয়েই আমি যাবো। দেখাও করবো আপনার ছেলের সাথে। তবুও আপনি কাঁদবেন না প্লিজ। কাউকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।”
তোহফার আবেগপ্রবণ কথায় ভদ্রমহিলা নিজের কান্নার গতি কমিয়ে দিলেন। তোহফাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুঁজে দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নেন বক্ষঃস্থলে। তার বিশ্বাস এই মেয়েই হবে তার সহজ সরল ছেলের জীবন সঙ্গী ইন শা আল্লাহ।
ইন শা আল্লাহ চলবে…..