সায়রে গর্জন পর্ব-৮+৯

0
9

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৮.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

উষা রাঙিয়ে নিলো নিজেকে আপন রঙে। বেজে উঠলো প্রকৃতির গান। ঘুম থেকে উঠেই কোমড় নাড়াতে পারছেনা। চোখ খুলতেও কষ্ট হচ্ছে। শেহজাকে রাত থেকে কিছু খাওয়ানো হয়নি। আশপাশটা তাকিয়ে দেখতে পেলো বিয়ে বাড়ির সব রকমের মেহমানে ভরা। শুকনো ঢোক গিললো দিয়া। একটু ঘুরতেই ব্যাথা চিলিক দিয়ে উঠে। কোমড়ে হাত দিতেই লক্ষ্য করলো মোটা করে ব্যান্ডেজ করা। কখন যে ঘুমিয়ে গেলো খেয়ালই ছিলোনা। ব্যাথার ঔষধে ঘুম ভালো হয়েছে বলেই বুঝতে পারেনি ব্যান্ডেজ করার সময়টাতে। কে করে দিলো ব্যান্ডেজ! আরো কিছুক্ষন এভাবে শুয়ে থাকার পর ন’ টা বাজে সকলে উঠে গেলো। দিয়াকে শিফা, নিশি সাহায্য করলো উঠতে। শেহজাকে ওর দাদীরা খাইয়ে দিয়েছে।দিয়া জোর করে উঠে সবার সাথে ডাইনিং এ বসলো খেতে। কোমড়ের পাশটা আঁচলে টেনে বসলো। শিফা শেহজাকে এনে কোলে দিলো। এতক্ষন পর শেহজা মাকে দেখে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মেয়েটা খেতে চাচ্ছে। শিফাকে বললো,

– শিফা একটু হেল্প করো ভাবীকে।শেহজা খেতে চাচ্ছে রুমে দিয়ে আসো আমাকে।

খালা সাবিনা বলে উঠলো,

– বৌমা এখানেই খাওয়াও সমস্যা নেই। পুরুষরা সব বাইরে।

দিয়ার কেমন যেন লজ্জা লাগলো। শাশুড়িও বলে উঠলো,

– হ্যাঁ বৌমা তুমি নিজেও খাও,ওকেও খাওয়াও। তোমার আবার ঔষধ খেতে হবে।দেরি করোনা।

দিয়ার ক্ষুধা ও পেয়েছে।তাই শেহজাকে এখানেই খাইয়ে দিচ্ছে। নিজেও একটু করে খাচ্ছে। মামী, চাচী,ফুফু গল্প জুড়ে দিয়েছে কাল রাতের। ঠিক সেই সময়টায় রুম থেকে শাহাদ বের হয়ে আসলো শার্টের হাতায় কাফলিং লাগাতে লাগাতে। কালো শার্ট উপরে কালো ব্লেইজার। কাফলিং লাগানো শেষে সুলতানাকে ডেকে বললো,

– আম্মু আমি বের হচ্ছি, আপনারা সবাই সরাসরি চলে যাবেন হলে।আমি সেখানেই জয়েন করবো।

শেহজা বাবার আওয়াজ পেয়ে আঁচল সরিয়ে অস্ফুট স্বরে বাবাকে নিজের উপস্তিতি জানাচ্ছে। শাহাদ উলটো ঘুরে দেখে মেয়ে মায়ের আঁচলের তল থেকে এসব করছে একবার আঁচল সরাচ্ছে আবার মুখ ঢাকছে, দিয়া আঁচল দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে বার বার। দিয়া জোর করে আঁচল টা ধরে রেখেছে। শিফার দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝালে শিফা শেহজাকে টেনে বের করে ফেলে। শাহাদ নিজেও লজ্জা পেয়ে ঘুরে গিয়েছে। মেয়েকে আদুরে ধমক দিয়ে বলে,

– বাবা,এমন করে না খেয়ে নাও। দুষ্টুমি করবেনা। বাবা এসে আদর করবো।

মেয়েটা বোধ হয় বাবার কথা বুঝে। ততক্ষণে শিফা শেহজাকে নিয়ে দাঁড়ালো। শাহাদকে ডাকাতে শাহাদ ঘুরে মেয়েকে কোলে নে।

– দুষ্টুমি করছিলে কেনো? তুমি না গুড গার্ল। বাবা এখন আসি।কাজ আছে বাবার। পরে কথা হবে।

পুনরায় শেহজাকে কোলে দিয়ে দিলো। দিয়া লজ্জায় তখন থেকে মাথা নামিয়েই রেখেছে। সুলতানা মুখ টিপে হাসছে। ছেলেকে লজ্জা পেতে দেখে বাকিরাও হাসছে। কিছুদূর এগিয়ে পুনরায় ফিরে এসে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

– কোমড়ে ব্যাথা কমেছে!

দিয়া হতবাক হয়ে বাক্য ভুলে উপর নিচ মাথা নাড়ালো। শাহাদ পুনরায় বললো,

– ব্যান্ডেজ ভেজানোর প্রয়োজন নেই।ড্রেসিং করা হয়েছে। দুদিন পর চেঞ্জ করে দিব।

দিয়ার পুনরায় ধুকপুক বেড়ে গেলো।ভেবেছিলো ব্যান্ডেজ শিফা বা নিশি করেছে। কিন্তু এটা কি শুনলো! শাশুড়ির দিকে তাকাতেই দেখে শাড়ির একপাশ উলটে উনি ব্যান্ডেজ টা দেখছেন।বাকিরাও দেখছে। সুলতানা কবির বিড়বিড় করে বললেন,

– আঘাত ও দিবে,আবার যত্ন ও করবে।এই ছেলেটাকে বুঝিনা আমি।

ততক্ষণে শাহাদ সামনে এগিয়ে গেলো। ডাইনিং পেরোনোর আগেই একটা সারপ্রাইজ ঘটে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক সুদর্শন যুবক শাহাদকে স্যালুট দিচ্ছে। শাহাদ স্যালুটের উত্তর দিলো। দুজনই নিরব। ওই মানুষটার পরনে গাঢ় সবুজের মধ্যে কালো ছোপ ছোপ জংলী পোশাক। সাধারণত এই পোশাক সেনাকর্মকর্তাদের পরনে থাকে। মেজর শাহীন ইমরোজ। ভাইকে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেললো। শাহাদ নির্বাক। বয়সে প্রায় আট বছরের ছোট শাহীন। শাহীন ডাকলো,

– ভাইজান…

শাহাদ মুচকি হাসি দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। এভাবে সারপ্রাইজ দিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে দিবে কেউ ভাবেনি। গত তিনবছরে খুব কম স্যালুট জানিয়েছে লোকদের। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে ফেলেছিলো শাহাদ।

– ভেতরে যাও। ফ্রেশ হও। রাতে কথা হবে।

– জ্বি ভাইজান।

শাহাদ বেরিয়ে যাওয়ার পর একে একে পরিবারের অন্য লোকদের সাথে ও দেখা করলো। দিয়া ঘোমটা দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দিয়ার সামনে এসে বড় করে এক সালাম দিলো।শেহজাকে শিফার কোল থেকে নিয়ে বললো,

– ভাবী মা কেমন আছেন?

এতদিন কাজিন দেবরদের কাছ থেকে সম্বোধন পেয়েছে।ওরা প্রত্যেকে শাহাদ,শাহীন থেকে ছোট। এত বয়সের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ওকে ভাবীমা বলছে নিজেরই লজ্জা লাগছে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললো,

– জ্বি ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি ভালো আছেন?

– ছিলাম না, কিন্তু আপনাকে আর আমার শেহজা আম্মাকে দেখে অনেক ভালো হয়েছি। প্রায় তিনবছর পর দেশে এসেছি। আপনাদের বিয়েতে তো থাকতে পারিনি। এমন একটা প্রফেশনে আছি চাইলেই নিজের মন খুশি মত কিছু করতে পারিনা।

– এবার তো আছেন বেশ কিছুদিন তাই না। সবাইকে নিয়ে আনন্দে কাটান।

– আরেহ আছিনা ভাবিমা, বুড়া হয়ে যাচ্ছি বিয়ে করতে আসছি। আমার ব্যাপারে তো কারো কোনো ধ্যানই নাই। চুল পেকে যাচ্ছে। আমার না হওয়া বউটা বোধ হিয় দিন রাত কেঁদে কেটে ঘরকে প্রশান্ত মহাসাগর বানিয়ে দিয়েছে। অথচ আমার বাপ,মা,ভাইজানের কোনো খেয়াল নেই আমার দিকে।এবার আপনি একটা ব্যবস্থা করুন তো।

সুলতানা ছেলের কান ধরে বলে,

– তবে রে, এসব ভেবে এসেছিস তাহলে।আমাদের জন্য নয়!

ফুফু মঞ্জিলা হেসে বলে,

– নিশাদের বিয়ের পর তোরে বিয়ে দিব অপেক্ষা কর। যা হলে যেতে হবে রেডি হয়ে যা।

– দেখেছো আমার ছোট টার ও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

সকলে হেসে উঠলো।ভাতিজিকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো যেখানে আস্তানা গেড়েছে শিফা। শিফার রুম টা কেড়ে নিয়েছে শেফালী। ভাই আসাতে আপাতত কোনো রকম গুছিয়ে দিয়েছে।
___

হামজার অবস্থা আগে থেকে কিছুটা ভালো।আশঙ্কাজনক অবস্থা কে-টেছে। শাহাদ দেখেই বের হয়ে সোজা অফিসে এসেছে। সামনে পাভেল,লাবিব বসে আছে। প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত, উত্তপ্ত মেজাজের লোকটাকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এই লোকের র*ক্তে,শিরায় রয়েছে স্পেশাল ট্রেইনিং। উচ্চ পদস্থ অনেক কর্মকর্তা, এম পি শাহাদ ইমরোজ বললেই কেঁপে উঠে। তার অবশ্য যথাযথ কারণ আছে। রাজনীতির মাঠে শাহাদ ইমরোজকে কয়েকজন নেতা তো গুন্ডা শাহাদ ও ডাকে। ইলেকশনের সময় দূর্নীতি করে তারই দলের একজন সিনিয়র নেতা ভোট চুরি করতে অন্য কেন্দ্রে গিয়ে দলের ছেলেদের আদেশ দিচ্ছিলো।তখন একজন মধ্যবয়স্ক নারী প্রতিবাদ করলে সেই নারীর গায়ে হাত তোলে। নারীর উনিশ বছরের মেয়েকে তুলে আনার হুমকি দেয় এবং সেই মেয়ের গায়ের ওড়না খুলে জনগনের সামনে অশালীনভাবে মেয়ের শরীরের অঙ্গ ছুঁয়ে দেয়। ঘটনা ঘটার আগেই শাহাদের কানে খবর চলে যায়,সেই নেতা কেন্দ্রে ঝামেলা করছে।আশেপাশে থাকায় দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়,চোখের সামনে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখলে এগিয়ে যেতে যেতে পাভেলের কাছে পুরো ঘটনা শুনে পাঞ্জাবির হাতা গুঁটে নিলো। চোখের চশমাটা জায়গামত লাগিয়ে হাত ঘড়ি খুলে পাভেলের হাতে ধরিয়ে দায়িত্বরত পুলিশের কাছ থেকে দেড় ইঞ্চি মোটা লাঠি নিয়ে উত্তম মধ্যম সকলের সামনে ওই নেতাকে বেধড়ক পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠায়।উপস্থিত জনতার মুখে হাসি তো ছিলোই পাশে ওই মা মেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শাহাদের সামনে। শাহাদ সেদিন প্রতিটা মা-মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলো,

– প্রতিবাদ করবেন, কেউ যদি কোনো ক্ষতি করে সরাসরি আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।কার বাপের ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে দেখবো যে আমার মা বোনকে অপমান করে। পাভেল এই হারাম** কে হাসপাতালে নিয়ে যা। খবরদার যদি ভোট চুরি হয়েছে তো ব্যালট বক্সে আগুন জ্বালায়ে দিব। আর পুলিশ কি দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চু/ষ/তে/ছে। একটা চুষনি এনে দে রে লাবিব। সাথে চুড়ি আর ওড়না এনে দিস। এদের কাছে নাকি সরকার পাওয়ার দিছে। পাওয়ার তো শুধু রাস্তায় বাইকার ধরে ক্ষেপ মারার জন্য আর গাড়ির লাইসেন্স ধরে ঘুষ খাওয়ার জন্য দিছে তাই না! লাইন্সেন্স বিহীন বাস গুলা বাপের জন্মেও ধরছে কিনা সন্দেহ আছে। থানায় যে শত শত অমীমাংশিত কেইস পড়ে আছে তার বেলায় খবর নাই। যদি একবার ক্ষমতায় আসি তো বুঝায় দিব আমি কত বড় গুন্ডা।

সেদিন সেই কেন্দ্রে খুব ভালো ভোট হয়েছিলো। তবে শাহাদের দলের সেই নেতা হেরে গিয়ে বিরোধী দলের একজন হয়েছিলো। শাহাদ জানে বিরোধী দলের সেই প্রার্থী ও মানুষ হিসেবে চমৎকার। যে দলেরই হোক, দেশের উপকার প্রয়োজন।

– লাবিব,কাজটা কার ছিলো।

লাবিব এবং পাভেল বসের দিকে মনোযোগ দিলো ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে। লাবিব একটু ভেবে বললো,

– স্যার আমি নিশ্চিত না তবে নেতা পারভেজের কাজ ও হতে পারে। হামজার বাবা পারভেজের দলে কাজ করতো।উনি তো কিছু বছর আগে মারা গিয়েছে।

পাভেল আচমকা বলে উঠলো,

– বস পারভেজের কাজ না এটা। হোম মিনিষ্টারের কাজ।

শাহাদ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। পাভেল ঘটনা পরিষ্কার করতে বললো,

– বস হামজার জায়গায় আজকে সেখানে আপনি থাকতেন।

লাবিব কিছুটা চমকে উঠলো। শাহাদ জানতে চাইলো,

– হেয়ালি না করে ক্লিয়ার করো।

– বস আপনি তো ওইদিন রাতে বাসায় আগে গিয়েছেন।আমাকে আর হামজাকে বলেছিলেন পার্টি অফিসে গিয়ে মিটিং টা এটেন্ড করতে। সচরাচর আপনি তো আমার পাশে বসেন এটা সবাই জানে। হামজা আমার পাশেই বসেছিলো। হামজা পরেছিলো আপনার দেয়া কালো পাঞ্জাবিটা। ওরা হামজাকে অন্ধকারে বুঝে উঠতে পারেনি। হামজাকে আমি ওর ফ্রেন্ডের বাসায় নামিয়ে দিই। ওরা আমাদের গাড়ি ফলো করছিলো।হামজা নামার পর পরই এই দূর্ঘটনা ঘটে। অন্ধকারে আপনাকে না চিনে যেভাবে পেরেছে ওভাবে কুপিয়েছে।

শাহাদ হাসছে। মনে মনে ভাবছে, হোম মিনিষ্টার তুমি আমাকে মারতে এত মরিয়া হয়ে উঠেছো অথচ সামনে গেলেই বলো রাশেদের কেইসটার যেন একটা সুরাহা করি। অবশ্যই সুরাহা করবো ইনশাআল্লাহ।

___

ভাইয়ের রুমে সেই ছবিটা। শাহাদ, শাহীনের কাঁধ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহাদের হাত ছিলো শাহীনের জন্য ভরসা,আত্মবিশ্বাস। শাহীনের র‍্যাংক পরিয়ে দেয়া মানুষটা ছিলো শাহাদ। ভাইয়ের রুম টা আজো সেই পরিচয় বহন করে। ছবিতে জ্বলজ্বল করছে অকুতোভয়, দুঃসাহসী, সংগ্রামী সৈনিক বাংলাদেশ নৌবাহিনীর লে.কমান্ডার শাহাদ ইমরোজ। সাদা ইউনিফর্ম, কাঁধে গুরুত্বপূর্ণ র‍্যাংক। প্রতিটি চিহ্ন প্রকাশ করছে তার দুঃসাহসীকতা,বুদ্ধিদীপ্ততা,ক্ষীপ্রতা। মাথায় সাদা কালো ক্যাপ, চোখে নির্ভয় যেন যেকোনো সময় প্রতিটি আক্রমনের জন্য প্রস্তুত। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ভাই শাহীন ইমরোজ ক্যাপ্টেন র‍্যাংক পেয়েছে।

কাঁধে শক্ত হাতের ছোঁয়া। পেছনে ঘুরতেই প্রফেশনাল জীবনের অভিভাবককে পেয়ে চোখের কোণে উঁকি দেয়া জলটুকু আঙুলের খোঁচায় অদৃশ্য করে দিলো।

– হোয়াট হ্যাপেন্ড মেজর!

– নাথিং সিরিয়াস স্যার।

– ডোন্ট বি স্যাড, পাস্ট ইজ পাস্ট।ইউ হ্যাভ টু লিভ ইন প্রেজেন্ট এবং থিংক এবাউট ফিউচার। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার।

– আই,আই স্যার।

শাহাদ কিঞ্চিৎ হাসলো। ভাই এখনো তাকে আইডল ভাবে। আই,আই কথাটা শুনে র*ক্ত আবার ঝলসে উঠেছে। মনে হচ্ছে এইতো হাত ছানি দিয়ে ডাকছে সমুদ্র। বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি ছিলো তার ঘাঁটি। সমুদ্র ছিলো তার বাড়ি। অথচ আজ তিন বছর বাড়ি যাওয়া হয়না বাড়ি, হবেও না কখনো। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে।এখনো রাতে মনে হয়, এইতো কল আসছে মিশনে যাবার।নতুন অফিসারদের লিড করার। নেভাল টার্মে (Aye,Aye Captain or Sir) এই তিন শব্দের মানে অনেক সিম্বোলিক। যার অর্থ ( I hear the order, I understand the order and I will obey the order)

– রেডি হতে যাও,শাহীন। কিছুক্ষনের মধ্যে বের হতে হবে আমাদের।

– জ্বি ভাইজান।

‘ শান্তিতে সংগ্রামে, সমুদ্রে দূর্জয়’ এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমেছিলো। সেই পণকে মনে প্রাণে ধারণ করে হয়ে উঠেছিলো সেরাদের একজন। যাকে ঘিরে ছিলো ডিপার্ট্মেন্টের আশা। অনেকগুলো
মিশন,অপারেশন সাকসেসফুল করেছে দেশের জন্য। হাতে ক্ষমতা ছিলো। কিন্তু প্রয়োজনে সেই ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারেনি। সেদিন থেকেই প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলো যেখানে ক্ষমতা সেখানে শাহাদ। স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহন করেছে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর চৌকস,অত্যন্ত সাহসী,বিচক্ষন লে.কমান্ডার শাহাদ ইমরোজ। নেভাল একাডেমি এখনো স্মরণ করে সেই অফিসারকে। যার আন্ডারে থাকা প্রতিটি অফিসার এখনো খোঁজ নিয়ে বলে,

– Your Team Miss you King of the wave.

‘কিং অফ দ্য ওয়েভ’, এই নাম রাশেদের দেয়া। এরপর থেকে নেভাল একাডেমিতে কিং অফ ওয়েভ বললে এক নামে চেনে। শাহাদের অসাধারণ ক্ষমতা ছিলো স্রোতের সাথে সখ্যতার।#সায়রে_গর্জন তোলার। বিশাল উত্তাল ভরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে কত মিশনের ঝুঁকি নিয়েছে, কত অপরাধ দমন করেছে, কত অসহায়ের প্রাণ বাচিঁয়েছে।মহান রব সবসময় পাশে ছিলেন। সর্বোচ্চ ভয়ানক মিশন ছিলো নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনশ বিশ জন নাবিকদের উদ্ধার করা, তিনটে নেভি শিপ জ্বালিয়ে দেয়া। যেখানে দেশের হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য ছিলো। নাবিকরা তার নাম দিয়েছে ‘ আলবাট্রস’। সেদিন উড়ে এসে ‘আলবাট্রসের’ মতো বাঁচিয়েছিলো তাদের।দস্যুদের জন্য আতঙ্ক ছিলো এই নেভি অফিসার। মনের সাথে সেবার যুদ্ধ করে খুব অল্প বয়সে এই ‘স্রোতের রাজা’ অবসরে চলে আসে। এই নিয়ে কত বাকবিতন্ডা,তর্ক-বিতর্ক উচ্চ পদস্থ অফিসারদের সাথে,নেভাল একাডেমি তাকে ছাড়তেই চায়নি। বাবার সাথে তো রীতিমতো নিরব স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে কয়েকমাস। শেষে রায়হান সাহেব হাল ছেড়ে বলেন,

– ইউর লাইফ, ইউর উইশ। ক্যান ডু এনিথিং।

শাহাদ হেসে মনে মনে বলে উঠে,
-ফাইনালি দ্য ডিসিশন হেজ বিন লকড।

নতুন লড়াইয়ের জন্য মাঠে নেমে পড়তে হবে। এখন সে এমপি শাহাদ ইমরোজ, জনগনের ভবিষ্যৎ। ছেড়ে এসেছে তার সমুদ্র বাড়ি। সময়ের অপেক্ষা, পুনরায় জলোচ্ছ্বাস হয়ে আঁছড়ে পড়ার। আবার তুলবে #সায়রে_গর্জন। এবার প্রস্তুতি অসীম। মানচিত্র বদলে দেবে সেইসব মানবরূপী নামধারী পশুদের, তার জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাকে কেড়ে নেয়ার অপরাধে।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৯.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

দিয়া একপাশে শেহজাকে কোলে নিয়ে বসে আছে গেস্টের মতো। মাঝে মাঝে নিশি,শিফা এসে দেখে যাচ্ছে। শেহজা এতক্ষন চুপচাপ ছিলো। সদ্য নতুন কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। মেয়েটা এখন আর চুপ থাকবেনা। দূর থেকে যা শুনার শুনেছে। এত দূর থেকেও কিভাবে চিনে ফেলে গলাটা। হয়তো রক্তের টান বলেই। দিয়া নিজেও কোমড়ে ব্যাথা নিয়ে সামলাতে পারছেনা, অপর দিকে শেহজাকে নেয়ার জন্য কাউকে ডাকতেও পারছেনা। পারপেল কারচুপি কাজের মসলিন শাড়ি পরেছে। একবার তাকালেই মায়ায় পড়ে যাবে। হাসলে একপাশে টোল পড়ে। মাথায় পারপেল হিজাব। শেহজাকে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে যায়৷ ব্যাথাটা সাথে সাথে টনটন করে উঠে। লম্বা পা ফেলে দিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়, শেহজা অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলছে বাবাকে দেখে৷ দিয়া তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, শাহাদ আগ বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নেয়। দিয়া দাঁড়াতে পারছিলো না, দূর থেকে ঠিকই খেয়াল করেছে।শাহাদকে দেখে চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহাদ আশপাশটা দেখছে প্রচন্ড ভিড়।শেহজাকে কোলে নিয়ে দিয়ার দিকে তাকালো। হাত বাঁড়িয়ে দিলো দিয়ার দিকে।দিয়া বুঝতে পারছেনা শাহাদ কি চাইছে। শাহাদ দিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে বললো,

– ফারাহ… হাতটা ধরো।

দিয়া ঘোরের মধ্যে চলে গেলো। আবারো সেই মনে ঝড় তোলা আর্তনাদ। সেই উচ্চারন, সেই ডাক। সাতপাঁচ না ভেবে মুহুর্তের অপচয় না ঘটিয়ে খপ করে হাতটা ধরে ফেললো। শাহাদ হাতের দিকে তাকিয়ে হাতের মুঠো ঘুরিয়ে আকড়ে ধরলো দিয়ার হাত। ডান পাশে কোলে মেয়ে, বাঁ হাতে স্ত্রীর হাত। দিয়া একহাতে শাড়ির কুচি ধরেছে।অন্য হাত শাহাদের মুঠো বন্ধি। মাঝপথে এগিয়ে আসে এলিন। বানিজ্য মন্ত্রী কিছুক্ষন আগেই তার পরিবার নিয়ে বিয়েতে এসেছে।পারিবারিক সব প্রোগ্রামে শাহাদ নিমন্ত্রণ জানায় মন্ত্রীকে। এলিন এসে শাহাদের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়।সালামের উত্তর দিলো শাহাদ। শাহাদের পাশে মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন মোহে চলে গেলো। কোলে থাকা পুতুলটা শাহাদের মেয়ে বুঝতে পেরে এলিন হাত বাড়ালো শেহজাকে কোলে নিতে।মেয়েটা এমনিতে মিশুক স্বভাবের।হাত বাড়াতেই চলে গেলো। দিয়ার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো ,

– উনি কে?

শাহাদ দিয়াকে আরো শক্ত করে ধরে বললো,

-আমার সহধর্মিণী ফারহানা দিয়া।

এলিন চক্ষু ছানা বড়া করে বলে,

– সিরিয়াসলি, উনি আপনার ওয়াইফ। আপু আপনি এইজ ধরে রেখেছেন কিভাবে? আপনাকে একদম টিনেজার লাগছে?

এই প্রথম এভাবে পরিচয় পেয়ে দিয়া আজ আকাশের চাঁদ পেলো। এলিনকে লক্ষ্য করলো। যথেষ্ট মার্জিত,মানানসই, সাবলীল। হঠাৎ করে ভগে আৎকে উঠলো।বুকটা কেমন হারানোর ব্যাথা জানান দিলো।এমপি সাহেবের সাথে এই মেয়েকে মানাবে ভালোই! কি সব ভাবছে। নাহ! একদমই নাহ! এমপি সাহেব শুধুই তার। কাছেই ঘেষতে দিবেনা কাউকে। করুক অপছন্দ তাকে।তবুও তার।

এলিনের কথায় শাহাদ প্রচন্ড বিরক্ত এবং বিচলিত।এই মেয়ে বেশি কথা বলে। কানাকড়ি সময় নষ্ট না করে এলিনকে বললো,

– আপনি কি আমাদের একটু সময় দিবেন মিস।ফারাহ একটু অসুস্থ। ওকে বসিয়ে দি৷ শেহজাকেও খাওয়াতে হবে।

– নাইস নেম।শেহজাকে নাহয় আমি খাইয়ে দিব।

শাহাদ দিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার এলিনের দিকে তাকালো।প্রবল বিরক্ত ভাবে ভ্রু কুঞ্চিত, মুখ খিঁচে এলো। দিয়ার ভেতর টা কাঁচুমাঁচু করছে কিছু বলার জন্য।

– এলিন আপনি কিভাবে খাওয়াবেন। আমার বেবির বয়স ন’ মাস। ওকে ব্রেস্ট ফিডিং করাতে হবে।

শাহাদের এমন জবাবে এলিন মারাত্মক লজ্জা পেয়ে শেহজাকে কোলে দিয়ে দিলো। স্যরি বলে সামনে থেকে সরে গেলো। দিয়া নিজেও মাথা নামিয়ে ফেললো।শাহাদ এবং দিয়াকে দূর থেকে রায়হান সাহেব এবং সুলতানা দেখছে।একে অপরকে ইশারাও করছে।কিন্তু কেউ কোনো হেতু বের করতে পারলোনা। তাই আপাতত মেহমানদের সামলাচ্ছে। শাহাদ দিয়াকে নিয়ে একটা চেঞ্জিং রুমে বসলো। ভেতর থেকে দরজা আটকে নিজেও বসে পড়লো। দিয়া শেহজার মুখটা মুছে দিলো। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলছে,

– বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই বসে থাকো।

দিয়া মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। শেহজা বাবার সামনেই কাঁদছে। দিয়া সামলাতে না পারাতে শাহাদ কোলে নিতেই কি কি যেন বলছে। এমন তো করে না পুতুল টা। শাহাদ ভ্রু কুঞ্চিত করে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

– কি বলছে মেয়ে?

দিয়া মাথা নামিয়ে বলে,

– ক্ষুধা পেয়েছে।খাবে বলছে।

শাহাদ শেহজাকে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। এক মিনিটের মাথায় আবার ফিরে এসে খট দরজা লাগিয়ে দিলো। দিয়া চেয়ে রইলো মুখের দিকে। শাহাদ প্রশ্ন করলো,

– আমি থাকলে আমার সন্তানকে ফিড করাতে কি কোনো অসুবিধা হবে!

কি উত্তর দেয়া উচিত বুঝতে পারছেনা! এতটা কাছে তো এখনো আসেনি যে লজ্জা ভেঙে যাবে। তবুও মানুষটা একটু খানি কথা বলছে এত বছর পর এটাই অনেক। দিয়া ভেবে মাথা নাড়ালো। শাহাদ ফোন বের করে কাজ করছে,দিয়া অন্যপাশে ঘুরে ফিড করাচ্ছে। শাহাদ ভেবেছিলো দিয়াকে এই স্পেসটা দিবে। কিন্তু বাইরে যা অবস্থা দিয়াকে একটু ও সেফ মনে হচ্ছেনা এখানে। এরচেয়ে নিজে বসে থাকাই ভালো। এভাবে তো প্রথম দিকে ও সেভ করেছিলো। শাহাদ মেইল চেক করছে। দিয়া শাহাদের মুখের দিকে তাকাতেই কেমন যেন নিজের মানুষ মনে হলো। তখনই শাহাদ তাকালো দিয়া দিকে। চোখাচোখি হতেই লজ্জ্বা পেয়ে গেলো দিয়া, শাহাদ একদম স্থির দৃষ্টিতে দিয়ার দিকে তাকিয়েছে। দিয়ার হার্ট খুব জোরে বিট করেছে। মনে হচ্ছে এখনই জ্ঞান হারাবে। শাহাদের হ্যাজেল আইয়ের দিকে তাকিয়ে দুবার ঢোক গিললো। মানুষটা নিজের হয়েও এত পর যে তার দিকে তাকাতেই কত বার ভাবতে হয়। শাহাদের মনের অনুভূতি কখনো প্রকাশ করেনি। শাহাদ কখনোই ভালোবাসেনি দিয়াকে। ভালোবাসার প্রশ্ন আসলে শাহাদ বার বার বলেছে,

– ভালোবাসা শব্দটা পরিপূর্ণ হতে চারটা অক্ষর লাগে, অথচ ভালোবাসা উৎপন্ন হতে কখনো চার সেকেন্ডই যথেষ্ট আবার কখনো চলিশ বছরেও হয়না।

বিয়ের পর শাশুড়ির কথায় বেহায়া হয়েছিলো বার বার। আচমকা দুবছর পর এমন একটা প্রশ্ন মাথায় আসলো কেনো। দিয়া সময় নষ্ট না করে শাহাদকে প্রশ্ন করে বসলো,

– একটা প্রশ্ন করি!

শাহাদ চোখের পলক ফেলে বললো,

– হুম।

– আপনি তো আমাকে কখনোই ভালোবাসেন নি,আমার জানামতে বাসবেন ও না। তাহলে শেহজা কি আপনার-আমার ভালোবাসার অংশ নয়?

শাহাদ নিঃশব্দ,স্তব্ধ। নিজেকেই প্রশ্ন করলো, যে সন্তান তার চোখের মণি,যাকে সে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, তার মাকে সে ভালোবাসেনি কখনো! তাদের ভালোবাসার,প্রণয়ের অংশ নয় সন্তান! দিয়া জানে সে উত্তর পাবে না। শাহাদকে বিব্রত দেখতেও ভালো লাগছেনা। তাই নিজেই আগ বাড়িয়ে বললো,

– জানেন এমপি সাহেব, আমার এই দুনিয়াতে খুব কাছের সম্পর্কের মধ্যে আপনি আর শেহজা ছাড়া আর কেউ নেই। আপনি তো আমাকে কোনো ক্যাটেগরিতে বিবেচনা করেন না। শেহজাও কয়েকবছর পর ভুলে যাবে তার জীবনে মা নামে কেউ ছিলো। সেদিন বড় আপা বলছিলো, তোকে তো আমার ভাই রক্ষিতাও রাখবেনা। তুই আমার সংসার নষ্ট করেছিস। এই একটা কথা কেনো আমাকে সবাই বলেন। আমি আপনাকে কতবার বুঝিয়েছিলাম আমি ইচ্ছে করে করিনি।

কথার মাঝে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পারলো শাহাদ বেরিয়ে গিয়েছে। দিয়ার কথা শুনতে পছন্দ করছে না।শাহাদ গিয়ে শিফা এবং নিশিকে পাঠিয়ে দিয়েছে।

___

শেফালী তখন থেকে কার সাথে কথা বলেই যাচ্ছে ফোনে। মা ডাকাতে নিশাদের বউয়ের কাছে চলে এসেছে। নিশাদের বউ মাশাল্লাহ খুবই সুন্দর। আচমকা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেউ একজন বলে ধীরে বলে উঠলো,

– যে যাই বলুক আমাদের শাহাদের বউ লাখে একটা।

শেফালী শরীরে জ্বলন ধরে গেলো। এই মেয়ে বাড়ি আসার পর থেকেই সবার কেনো তুলনা করতে হবে। বংশের সব ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর শেফালী। দুইভাইকে প্রেম পত্রের জন্য কত ছেলের বিচার বসাতে হয়েছিলো তার ইয়ত্তা নেই। সেখানে সংসারে একটা নতুন মেয়ে আসতেই তুলনা শুরু করেদিলো সবাই তার সাথে। ওই গেঁয়ো মেয়েটার সাথে তার সবসময় তুলনা করতে হবে কেন! পড়াশোনাটাও তো করেনি ঠিক ভাবে। অথচ শেফালী ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে এরপর ঘরে বসে আছে। ছোট ভাইয়া বার বার বলেছে জব করতে। এত কষ্ট কে করবে। বাবা ভাইদের আছে অনেক।দিব্যি চলে যাবে আরামে। ভিড়ের মধ্যে সে কথার উত্তর শেফালী দিতে এক মিনিট ও দেরী করলো না।স্টেজে সকলের সামনে বলেই ফেললো,

– আন্টি কিসের সাথে কি তুলনা করেন, কোথায় দিয়া আর কোথায় অন্বেষা। অন্বেষা ফার বেটার দ্যান দিয়া। আপনারা দিয়াকে কি হিসেবে সুন্দর বলেন।সাদা চামড়া যদি সুন্দর হইতো তাহলে তো চায়নিজ গুলাও সুন্দর। আসল কথা চায়না জিনিস আমরা বিশ্বাস সহজে করিনা।

– শেফালী, জাস্ট শাট আপ। আর একটা কথা বাড়ালে আমি ভুলে যাব তুমি কে? তোমাকে এত বয়সে বার বার কেনো শেখাতে হবে বড়দের কিভাবে সম্মান করতে হয়!

শাহাদের বজ্রকন্ঠের ধমকে ভয় পেয়ে গেলো সকলে। শেফালী মাথা নত করে রইলো। শাহাদ গমগমে পায়ে প্রস্থান করলো। এক ডোজই যথেষ্ট ভরা মহলে এই মেয়েকে দমাতে। ফুফু নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছে। এই মেয়েকে কেউ পছন্দ করেনা। যেখানে যাবে সেখানেই ঝামেলা করবে। কে বলেছে শাহাদের বউয়ের সাথে তুলনা করতে। শাহাদের বউয়ের সাথে তুলনা করে আদৌ কোনো লাভ আছে। তাহলে তো বিদেশী মেয়ে বিয়ে করালেই পারতো। শেফালী আজন্ম হিংসুটে। কার মতো হয়েছে। শরীর ভরা অহংকার এই মেয়ের।

___

বাড়িতে আসার সাথে সাথে মঞ্জিলা জেদ ধরে বসলো সবাইকে নিয়ে আজ রাতেই রওয়ানা দিবে ইন্দ্রপুর। সেখানে বাবা- মায়ের, শ্বশুর-শাশুড়ির কবর আছে।ছেলে নতুন জীবন শুরু করার আগে তাদের কবর জিয়ারত করে আসুক। বৌভাতের অনুষ্ঠান ও সেখানে হবে। মঞ্জিলার কথায় রাজি হয়নি রায়হান সাহেব। ভাইকে রাজি করাতে না পেরে ভাতিজার কাছে চলে যায়। শাহাদকে অনেক বুঝানোর পর রাজি হয়ে যায়। এখন আপাতত পাঁচটা মাইক্রো বাস রওয়ানা হলো ইন্দ্রপুরের উদ্দেশ্যে। শাহাদ যাচ্ছে না আজ রাত। আগামীকাল মিটিং শেষ করে যাবে।

রাতে পুরো বাড়ি নিরব, নিশব্দ, নিঃসঙ্গ। লাইব্রেরির বন্ধ কেবিনেট থেকে একটা ছবি বের করেছে। দুই বন্ধুর দূর্দর্ষ অর্জনের ছবি। ছবিটার দিকে তাকিয়ে আবেগটাকে কিছুতেই সামলে নিতে পারলো না। আবেগী জল বেয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে। বিড় বিড় করে বলছে,

– তুই চলে গেলি, আমার জীবনের অনেক বড় একটা অংশ ছিনিয়ে নিয়ে গেলি। চাইলেই আর কাম বেক করতে পারবোনা। কথা দিয়েছিলি একসাথে রিটায়ার্ড করবো। অথচ আমার আগেই রিটায়ার্ড নিলি।

চোখ বুঁজে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রথম কমিশন্ড পাওয়ার দিনের কথা। শিপে ট্রেইনিং চলছিলো। সমুদ্রকে করে নিতে হয় বাড়ি। প্রথম দিকে শাহাদ মন খারাপ করে ফেলতো, রাশেদ সাহস দিত। কমান্ডিং এ ভুল করে ফেলতো। শরীর খারাপ হয়ে যেত। যেদিন প্রথম কমিশন্ড পেলো মনে হলো সাগরটাকে নিজের নামে করে নিলো। BNS Samudra Joy ছিলো ঠিকানা। সমুদ্রে প্রতিটি দিন ছিলো আতঙ্কের। যেদিন লে.কমান্ডার কমিশন্ড পেলো সেদিনই রাশেদ শাহাদকে বলেছিলো Congratulations, king of the wave Lt. Commander Shahad Imroz’। রুমের গ্লাস কেবিনেটে প্রতিটি অর্জনের পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাঁধানো ফ্রেমটি। শাহাদের জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলো রাশেদ। যেখানে লিখা আছে ব্লক লেটারে এই কমপ্লিমেন্ট। আঠারো বছর আগের ভীতু শাহাদকে পরিবর্তন হতে দেখেছে ডিপার্টমেন্টের প্রতিটি অফিসার। শাহাদ ছিলো অন্যায়ের জন্য ভয়ের অপর নাম। গতবছর কক্সবাজার গিয়েছিলো একটি কাজে। নেভাল একাডেমির সামনে দিয়ে আসার সময় মনে হলো সেখানে নেমে অবস্থা দেখে আসা যাক। ভেতরে ঢুকতেই আগের মত সম্মান। এগিয়ে এলো কমান্ডার আবদুল গফফার, জুনিয়ররা সবাই, শাহাদকে দেখে তাদের মধ্যে অন্যরকম তেজ লক্ষ্য করা গেলো। সাব লেফটেন্যান্ট তানভির তো বলেই ফেললো,

– স্যার সেদিন অসুস্থ না হলে জানতামই না আপনি শাস্তি হিসেবে টেন পুষ আপ ফিনিশ করতে বলেন।

লেফটেন্যান্ট আশিক বললো,

– স্যার আমাকে তো গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে তিন মিনিট বেশি কথা বলার অপরাধে ত্রিশ রাউন্ড রেস শেষ করতে বলেছিলেন শাস্তি হিসেবে।

কমান্ডার গাফফার হেসে বললেন,

– এতে তোমাদের লস কি কি হলো শুনি?

তানভীর মুচকি হেসে বললেন,

– অনেক বড় লস হয়েছে। ওইসব শাস্তিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়েছিলাম যে স্যার যখন সোয়াডস এ যান মারাত্নকভাবে আপনার শাস্তি গুলো মিস করতে থাকি। এরপর তো আপনাকেই হারালো বাংলাদেশ নেভি।

শাহাদ ইষৎ হেসে বলেছিলো,
– আমার চেয়ে বেটার অপশন আছে তোমাদের।

কমান্ডার গাফফার বলে উঠলেন,

– কমান্ডার তোমার থেকে বেটার অপশন হয়তো আছে কিন্তু তুমি নেই।

শাহাদ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সেসব ভুলতে উঠে গেলো চেয়ার থেকে। বেরিয়ে আসে লাইব্রেরি থেকে। ঘুম আসবে না আজ রাতে। ভাবছে ধানমন্ডিতে লেকের সাইডটাতে একটা রেস লাগানো যাক। রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো রাত দেড়টায় রেস লাগাতে। অভ্যাস পরিবর্তন হয় না এত সহজে।

ফুরফুরে বাতাসের শীতল ঝাপটা মুখে নাকে,সর্বাঙ্গে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। যান্ত্রিক শহরটা ভুলেই যায় তার সুখের কথা।নিজেকে বিলিয়ে দেয় শহরের মানুষগুলোর নির্মম অত্যাচারে। রাত্রি নামতেই আবার ফিরে আসে নিজের রূপে। নিশাচর প্রাণী হয়ে শহরের প্রিয় জায়গায় বিচরনের সুযোগটা আজ হারাতে চায়না। এই রাস্তায় কত শত রেস লাগিয়েছে রাশেদকে সাথে নিয়ে। বট গাছটার নিচে এসে থমকে গেলো। পকেট থেকে ফোন বের করে ছোট্ট ক্ষুদে বার্তার উত্তর চেক করলো,

– Vaijan safely reached. Little fairy and Bhabi ma both are safe.

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে পুনরায় এগিয়ে গেলো জীবনের রেসে।

চলবে…