#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২৮.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
দুবার দরজার কড়া নড়ার শব্দ কানে আসলো। দিয়া শোয়া থেকে উঠে বসলো। বেড সাইড ল্যাম্পটা জ্বালালো। পুনরায় আওয়াজ হলে গায়ে ওড়না জড়ালো। এত রাতে আবার কে এলো? উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখে শেফালী। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। শাহাদ যাওয়ার পর থেকে শেফালীর বন্দি দশা কাটলেও স্বেচ্ছায় নিজেকে বন্দি করে রেখেছে। খাওয়ার সময় ছাড়া বের হয় না। স্বাভাবিক গলায় বললো,
– আপা আপনি! কিছু বলবেন?
– ভেতরে আসবো?
দিয়া শেহজাকে দেখলো। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। দরজা থেকে সরে, মনে মনে আল্লাহর কাছে রক্ষা পাওয়ার দোয়া পড়লো। শেফালী ঢুকলো রুমে। দিয়া ঘড়ির দিয়ে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি দুশ্চিন্তায়। কেবল চোখ লেগেছিলো, দরজায় কড়ার আঘাতে ভেঙে গেলো সেই ঘুম। শেফালী সিংগেল সোফায় বসলো। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– বসেন ভাবীজান।
দিয়া বিস্মিত নয়নে দেখছে। শেফালী তাকে ভাবীজান সম্বোধন করলো! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বসলো। শেফালী নিরব। দিয়া লক্ষ্য করলো ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শেফালীর কাছে এসে পাশের সোফায় বসে বললো,
– আপু কি হয়েছে কাঁদছেন কেনো?
ক্রন্দনরত গলায় বলে উঠলো,
– ভাইজান কেমন আছে ভাবীজান?
প্রশ্ন করেই তাকালো দিয়ার দিকে। মেয়েটার চোখ মুখ ফোলা। স্বাভাবিক থাকার প্রশ্নই যে আসেনা। তবুও এই প্রশ্ন জানতে চাওয়ার ইচ্ছা! দিয়া ছন্দহীন নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বললো,
– ভালো নেই আপু। একবার দেখেছিলাম হুঁশ নেই।
– সবাই দেখেছে?
– হামজা ভাই ফোন দিয়েছিলো তখন দেখেছে।
– দেখেছেন কত বড় হতভাগী আমি একবার দেখতেও পারলাম না। আমার ভাইজান রাগ করেই আমাকে ফেলে চলে গেলো। কত রাগ জমেছে! আমার মুখটা ও দেখলো না যাওয়ার আগে।
দিয়া হেসে দিলো ঝাপসা চোখে। বলে উঠলো,
– তাহলে তো আপু আমি আর আমার নিষ্পাপ মেয়েটা আরো হতভাগী। আমাদের ও দেখা দিলোনা।
শেফালী দুহাতে চোখ মুছলো। নাক টেনে সোজা হয়ে বসে বললো,
– ভুল বললেন ভাবীজান। আপনি আর শেহজা ভাইজানের শরীরের সবচেয়ে দূর্বল জায়গা কাবু করে বসে আছেন। আপনাদের দেখা দিলে যে আর যাওয়া হতনা। আর আমাকে দেখা দেয়নি কারণ শুভ কাজে যাচ্ছে, আমার পাপী চেহারা দেখে অশুভ কিছু ঘটতে পারে। পবিত্রতার ও তো ব্যাপার আছে।
নিরুত্তর দিয়া নিষ্পলক চেয়ে আছে। কি উত্তর দিবে! উত্তর নেই। শেফালীর দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
– কাঁদবেন না তো আপু আল্লাহ ভরসা। আপনাদের ভাইজানের জন্য দোয়া করবেন। বোনের দোয়া অনেক কাজে লাগে।
– পাপী বোনের!
– কে পাপী কে নিষ্পাপ সে তো উপর ওয়ালাই বিচার করবেন। আপনি আমাদের কাছে সবসময় সম্মানের। বাড়ির সম্পদ তো আপনারা।
ক্ষীণ হাসলো শেফালী। চোখে মুখে এক রাশ মুগ্ধতা জমিয়ে তাকালো দিয়ার পানে। উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সময় বললো,
– মনে প্রশ্ন ছিলো কি আছে এই দিয়ার মাঝে যাকে ভাইজান সযতনে হৃদয়ে আগলে রেখেছে! আজ সেই ধারণা সুস্পষ্টভাবে ধরা দিলো, শাহাদ ইমরোজের সুযোগ্যা সহধর্মিণীই তার ফারাহ।
বেরিয়ে গেলো শেফালী। রেখে গেলো নিষ্প্রাণ মেয়েটাকে। পুনরায় মনের মধ্যে ঝড় তুলে দিলো। দু লাইন ভালো বাক্য হয়তো শেফালী আওড়েছে কিন্তু কোথায় শাহাদ! দরজা লাগিয়ে মুঠোফোনের গ্যালারীতে গেলো। শাহাদের সাথে সেই ছবিটা পেলো। শাহীনের হলুদ সন্ধ্যায় গান শেষ করে যখন মুচকি হাসিতে দিয়ার দিকে তাকালো সেই সময়টা ক্যামেরা বন্দি করেছিলো লিমন। বুকটা জ্বলছে। মুগ্ধ চাহনীতে চেয়ে আছে দিয়ার দিকে। ভেতরে তোলপাড় করা ঝড়। কি করে থামবে সেই ঝড়! চিৎকার দিয়ে কাঁদলে মেয়েটা জেগে যাবে। ওড়নাতে মুখ চেপে ধরলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। মেসেঞ্জারে ঢুকে কল দিলো হামজাকে। সময় টা অনুচিত। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। ও পাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো। হামজা হাসপাতালের ক্যান্টিনে। দিয়াকে সালাম দিলো, শাহাদের অবস্থা কিছুক্ষনের মধ্যে জানাচ্ছে। দশ মিনিট পর ফোন আসতেই রিসিভ করলো,
– ভাইয়া আপনার স্যার কেমন আছে?
– ম্যাডাম আগের মতো।
– আচ্ছা। ভালো থাকবেন।
– জ্বি ম্যাডাম
দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ফোন কেটে দিলো। হামজার উপর ও অনেক ধকল যাচ্ছে। বেচারা না ঘুমিয়ে পড়ে আছে। চেহারা দুদিনেই ভেঙে গিয়েছে। নিরাশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো একটু খানি ঘুমের আশায়। নিজে অসুস্থ হয়ে গেলে মেয়ের সুস্থ থাকাটা দুষ্কর হয়ে পড়বে।
___
হাসপাতাল থেকে বের হতে হতেই সাড়ে তিনটা। সকালের ডিউটি টা প্রক্সি দিয়েছে মেহেদীকে। মেহেদী ডিউটি পেয়ে খুশিতে গদগদ। হাসপাতাল থেকে রওয়ানা হয়েছে সি এম এইচের উদ্দেশ্যে৷ শাহীনের পোস্ট মর্টেম এর সাথে এই হাসপাতালের একয়াতা গুরুতর কানেকশন আছে। রাতের বেলা সন্দেহের তীর কম যাবে। সি এন জি ক্যান্টনমেন্টের সামনেই ছেড়ে দিলো। মনে হলো কেউ ফলো করছে। মনিকা পেছন ফিরে দেখলো না তেমন সন্দেহ জনক কাউকে চোখে পড়ছেনা। পুনরায় হাঁটা ধরলো সরাসরি হাসপাতালে ঢুকে গেলো।
– বস ঢুকে গিয়েছে।
– ফলো করো।
– কোনো তথ্য যেন না পায়।
– ওকে বস।
আগন্তুকের সাথে কথা শেষ করে ছেলেটা হাসপাতালে ঢুকে পড়লো। মনিকার সাথে কথা বলতে দেখলো আরেকজন এপ্রোন পরা ডাক্তারকে। ভ্রু কুচকে ভাবলো এই ডাক্তারকে চেনা লাগছে। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো এটা তো ডাক্তার অনিরুদ্ধ। আচ্ছা! ইনফরমেশন এখান থেকেই সংগ্রহ করতে এসেছে। ছোট ভিডিও চিত্র ক্যামেরা বদ্ধ করে নিলো। মনিকা বের হয়েই পুনরায় সি এন জি তে উঠলো। মনিকাকে ফলো করছে আগন্তুকের নিয়োজিত ব্যক্তি। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সামনে এসে গাড়ি থামলো চারটায়। মনিকা সরাসরি মর্গের দিকে পা বাড়ালো। মর্গের দায়িত্বে নিয়োজিত ডোম খসরু মিয়া এগিয়ে এলো।
– সালাম ডাক্তার আপা।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম।
– অনিরুদ্ধ স্যার পাডাইছে?
– জ্বি। কাজের কথায় আসুন। এই ফাইলটা আর মানুষটাকে চিনতে পারছেন? এমন লা*শ কি পোস্টমর্টেম করেছেন?
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো খসরু। মাথা নেড়ে বললো,
– মনে পড়তাছে না। কহনের এই লা*শ*ডা?
– এই ধরুন তিন বছর আগের? আ/ত্ন/হ/ত্যা/র কেইস ছিলো।
– আইজকা কাটলে কাইলকোই ভুইলা যাই আর এইডা তো তিন বছর আগের। মনে নাইক্কা…
বিশ্রী একটা গালি বের হলো মনির মুখে। মুখে পানের পিক লেগে আছে এই খসরুর।দেখলেই বমি আসছে। মনে হচ্ছে শরীর থেকে লা/শে/র গন্ধ বের হচ্ছে। মনি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে সামনে বাড়িয়ে দিতেই ওই লাল হওয়া দাঁত দেখিয়ে খসরু বিশ্রী হাসি দিলো। বলে উঠলো,
– আগে কামডা করলে আমার সময়ডা নষ্ট হইতো না। আহেন আমার লগে।
মনি গালি দিলো মনে মনে, মা****দ। পিছু পিছু যেতেই একটা নির্জন রুমের পাশে নিয়ে আসলো। এবার থেমে বললো,
– বলেন কি জানবার চান?
– আর কয়বার একই প্রশ্ন করবো?
– এই লা*শডা কাডি নাই। উপর থেইকা নির্দেশ আছিলো। দুইজন হুজুর ডাইকা গোছল দিয়া ঠিকানা মত পাডায় দিছিলাম। আরেক কাডা লাশের রিপোর্ট চালায় দিছিলাম এর নামে।
– এত বড় ধোঁকা।
খসরু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
– কেডায় দিছে ধোঁকা।
– আপনি না জানলেও চলবে।
রাগে গজগজ করতে করতে মনি বেরিয়ে আসলো। নিজের চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সব কিছু হাতছাড়া হচ্ছে। শাহাদ চলে গেলো। ভেবেছিলো শাহাদের অপারেশনের আগে নিজের ভিসাটা ঠিক করে ফেলবে। একসাথে যাবে বাইরে। শাহাদের রিপোর্ট টাও হাতে পেলোনা। লাস্ট চেকাপের সময় মনি গিয়েছিলো সেই হাসপাতালে। চাইলে ট্রিটমেন্টটা বাংলাদেশে করাতে পারতো শাহাদ, তাহলে মনির অবজারভেশনে থাকতো। কেনো করায় নি তার উত্তর ও মনির জানা! গত মাসেই শাহাদের ডাক্তারের কাছ থেকে নিউরোমেডিসিনের কোর্স এসিস্টের পারমিশন নিয়েছে। আর কিভাবে চেষ্টা করলে শাহাদকে নিজের করে পাবে! শাহাদ সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের নাম অজ্ঞাত রেখেছে সকলের কাছে। মনি খোঁজ নিয়ে জেনে নিয়েছে বাংলাদেশ থেকে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে একজন পেশেন্ট আছে শাহাদ ইমরোজ নামে। খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবে। এত তাড়াতাড়ি শাহাদের ট্রিটমেন্ট শেষ হবে না। বেঁচে গেলেই হয়। শেফালীর সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। কিন্তু এই মেয়ের তো ফোন বন্ধ। শাহাদ চলে যাবার পর শাহীন ও সেই কঠোরতা ধরে রেখেছে? হাতে এখন সেই লা*শের রিপোর্ট, রাশেদের ফেক রিপোর্ট এবং ডি এন এ রিপোর্ট। বাকি আছে অহনার রিপোর্ট। দুয়ে দুয়ে চার করে আগামীকাল তাও উদ্ধার করে ফেলবে। হাসপাতালের বাইরে আলতাফের গাড়ি চলে এসেছে মনিকাকে নিতে।
___
কুঠি বাড়ি আজ নিরব। মেহেরজান আম্মা সকাল থেকে রুমের দরজা আটকে বসে আছে। চোখ দুটো লাল। এইদিন আম্মাকে কেউ বিরক্ত করে না। বুকে একটা ছবি জড়িয়ে বসে আছে। ছবির মানুষটা তার নাড়িছেঁড়া ধন। কত আদরে আগলে রেখেছিলো সন্তানকে। সমাজের চোখে নিজেকে অসৎ বানিয়ে সন্তানকে মানুষ করেছে আঁড়ালে। অথচ সেই সন্তান আজ নেই। শোক পালন করেনি আর পাঁচটা মানুষের মত। সন্তানের উৎসবে শামিল হতে পারেনি, পারেনি সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বলতে, তুই আমার সন্তান,আমার সাত রাজার ধন। পারেনি শামিল হতে সন্তানের শেষকৃত্যে। একেক মায়ের
প্র/তি/শো/ধ একেক রকম। মেহেরজান আম্মার
প্র/তি/শো?ধ সবার চেয়ে ভিন্ন। ঠিক যতটা কষ্টে তার সন্তান ম*রে*ছে তার চেয়ে ঢের কষ্টে ম/র/বে অপরাধীরা। ছবিটা নিজের আলমারির গোপন কুঠুরিতে রেখে চোখে কালো চশমা লাগিয়ে দরজা খুললো। হাতে মখমলের পার্স। পরনে চকমকে জরির শাড়ি। হাঁক ছাড়লো।
– মকবুল গাড়ি বাইর কর।
আম্মাকে বের হতে দেখে কুঠির সবার মাঝে প্রাণ ফিরে এলো। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,
– জোনাকি আর আসমারে ক আমার লগে আইতে। খালেদ পারভেজ খবর পাঠাইছে ইশকুলে যাইতে হইবো।
জোনাকি এবার এস এস সি দিবে, আসমা এইচ এস সি। দুজনের রেজিষ্ট্রেশন প্রক্রিয়া চলছে। মেহেরজান আম্মার মেয়েগুলোর এই কাজটা খালেদ পারভেজ করে দেয়। তার বিনিময়ে আম্মার মেয়ে গুলোকে অবশ্য মাশুল গুনতে হয়। আসমা,জোনাকি কুঠি বাড়ির সবচেয়ে আদরের কন্যাদ্বয়। এরা দুজনই খালেদ পারভেজ এবং ফরিদের কেনা। আম্মার শর্ত অনুযায়ী এই দুজনকে কাছে পাবে এদের পরীক্ষার পর। তাই এদের সব কিছুর দায়িত্ব আপাতত ফরিদ এবং পারভেজের। সবাই আতঙ্কে থাকে আম্মা মেয়েদের নিয়ে বের হলে। বের হওয়ার সময় শক্ত গলায় কুঠি বাড়ির দারোয়ানকে সকলের সামনে বললো,
– তমজিদ কুঠির দুয়ার খুলবিনা আমি আসা অবধি। যদি কথার হেরফের হয় তোর গর্দান আর আমার ছোরা।
মাথা ঝুঁকে সম্মতি জানালো,
– জ্বি আম্মা।
– মাইয়ারা সব ভিত্রে যাও।
সবাই ভেতরে যেতেই তমজিদকে পুনরায় বলে,
– তুই কুঠিতে পা বাড়াবিনা।
– জ্বি আম্মা।
গাড়ি চলছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। একটু একটু করে উদ্দেশ্য সফল হতে যাচ্ছে।
___
‘ এবার তো ফেঁসে গেছে এমপি, বেঁচে আসলে মান সম্মান শেষ আর ম*রে গেলে তার পরিবার শেষ। যে ভাইটা আছে ওটা আহাম্মক।’
পারভেজ কথাটা বলেই খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। সেই সাথে হাসছে ফরিদ। মনিকার সংগ্রহ করা রিপোর্ট এখন ফরিদের হাতে। শাহাদের চাল বুঝতে পারেনি তো কি হয়েছে,শাহাদকে ফাঁ/সা/তে এই রিপোর্টই যথেষ্ট। সরকারের চোখে ধূলা দিয়েছে এমপি। সরকারই মান সম্মান ধূলিসাৎ করবে। অহনার রিপোর্ট উদ্ধার হলে আর কোনো বাঁধাই থাকবেনা।
পকেটে বেজে উঠলো ফরিদের ফোন। ফোন রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে সালাম ভেসে আসলো,
– আসসালামু আলাইকুম ফরিদ সাহেব।
– কে?
– গেম খেলা শেষ?
– মানে! কে বলছেন?
– আপনার যম। রিপোর্ট টা সুন্দর করে হামার লোক আছে আপনার সামনে তাকে দিয়ে দিন।
ফরিদ সামনে তাকিয়ে দেখে রিসোর্টের দরজার সামনে একজন পোস্টম্যান দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা খাম। ক্ষেপে গিয়ে ফরিদ ফোনে বলল,
– এই তুই কে রে? কিসের রিপোর্ট দিব।
– বললাম না আপনার যম। রাশেদের রিপোর্ট টা দেন।
– দিবনা কি করবি? এ্যাই কে কোথায় আছিস। এই ছেলেকে ধর।
কেউ এলো না। খালেদ পারভেজ ভয় পেয়ে গেলো। সামনে দাঁড়ানো পোস্টম্যান হাসছে। ফরিদ ডাকাডাকি করেও লাভ হয়নি। পোস্টম্যান পকেট থেকে আয়রনের যন্ত্রটা বের করে বললো,
– চুপ থেকে দিয়ে দিন। আমি কিন্তু আপনার আত্নীয় না যে দয়া দেখাবো।
খালেদ পারভেজ রিপোর্ট টা কেড়ে নিলো ফরিদের হাত থেকে। সে কিছুতেই দিবেনা। ঠিক তখনই সজোরে এক ঘুষি পড়লো নাক বরাবর। ছিটকে গেলো দূরে। ফরিদ নিজেকে শান্ত রেখে রিপোর্ট হাতে দিয়ে দিলো। পোস্টম্যান বের হবার আগে বললো,
– মন্ত্রীত্ব নিজের আস্তানায় ভালো। আস্তানা থেকে তিনশ ছয় কিলোমিটার দূরত্বে কুকুর বেড়াল তো দূরের কথা মানুষ ও পাত্তা দিবেনা আর এটাতো পাহাড়।
ততক্ষনে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফরিদ চেঁচিয়ে উঠলো,
– এই শাহাদ কাঁচা মাল না! কিছুতেই কেনো ওকে ধরতে পারছিনা ওর চাল? ম*র*ন দশা চলছে শা*লা*র। বিদেশ থেকে ও নাজেহাল করে তুলছে আমাদের। এত সোর্স আর পাওয়ার আসে কি করে ওর!
নিজের চুল নিজে টানছে। তবে ফোনের ওইপাশে থাকা গলা টা সম্পূর্ণ অপরিচিত। টোন বলছে বিদেশী ভাষাভাষীর লোক। মস্তিষ্কে আর প্রেশার দিলোনা। খালেদ পারভেজকে উঠিয়ে সোজা দরজার বাইরে আসলো। এসে যা দেখেছে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। গার্ড সহ দলের প্রতিটি ছেলে কেমন অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তাদের নাকের কাছে হাত দিতেই দেখলো শ্বাস চলছে। পুলিশকে খবর দিলোনা কেইস খেয়ে যাবে। নিজের দলের আরেকটা ছেলেকে খবর পাঠালো যার আস্তানা এই পাহাড়েই। ছেলেটা আদিবাসী, নাম মগাই। আসতেই বাকিদের নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। ডাক্তার এসে খালেদ পারভেজকে দেখে গেলো। ঔষধ দিলো।
কিছুক্ষন পর মগাই ফোন দিলো ফরিদকে,
– স্যার ওদের কে ডেভিল’স ব্রেথ দিয়েছে। অতিরিক্ত পাওয়ারফুল হওয়াতে ওরা চেতনা হারিয়েছে। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। বাঁচবে কিনা সন্দিহান।
– ঠিক আছে থাকো ওখানে, যা খরচ লাগে দিব।
__
লেফটেন্যান্ট তানভীর, লিমন, পাভেল এবং শাহীন আজ মুখোমুখি। চাপা সত্য আজ বের করেই ছাড়বে। শাহাদ ব্যতীত আরো একজন রাশেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যাকে শাহাদ আড়ালে রেখেছিলো এত বছর। আজ তানভীর নিজ থেকে মুখ খুলবে বলেছে। দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে। যে কোনো সময় যা তা ঘটে যেতে পারে। অলরেডি প্রেস জেনে গিয়েছে এমপি দেশে নেই। কিছু মিডিয়া প্রকাশ করছে এমপি না জানিয়ে বাইরে কেনো গিয়েছে! কোনো অন্যায়ের কারণে আত্নগোপন করেছে কি? তানভীর শুরু করলো,
– তিনবছর আগে গেট টুগেদার ছিলো শিপে আপনারা তো জানেন। সেদিন রাতে স্যার নতুন সাবমেরিনের সন্ধান দিয়েছিলো আমাদের যা আমাদের জন্য বিপজ্জনক ছিলো। সমুদ্রসীমার বিপজ্জনক কিছু দেখলেই স্যারের সেন্স খুব দ্রুত কাজ করে। সকাল বেলা সবাই নাস্তার পর ঘুরাঘুরি করছিলো। ক্যাপ্টেন আলতাফের বোনের নজর ছিলো স্যারের দিকে। স্যার ব্যাপারটা বুঝতে পারে। হঠাৎ করে অহনা সকলের সামনে এসে রাশেদ ভাইয়ের সাথে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছিলো। আমি আর রাহাত তো হতবাক।এই মেয়ে কি পল্টিবাজ! রাতে স্যারের সাথে ঘেষছিলো আর এখন রাশেদ স্যার! রাশেদ স্যার ব্যাপারটা নজরে নেয় নি। স্যার বলেছিলো শাহাদ স্যারের ইনফরমেশন জানতেই এসেছে। বাকিদের নজরে এলো ব্যাপারটা। কিছুক্ষন পর স্যার কন্ট্রোল রুমে সবাইকে নিয়ে বসলো সাবমেরিনের ব্যাপারে ডিসকাস করতে। আলোচনা শেষ করে সকলকে জানালো আজ রাতে সতর্ক থাকতে কারণ বি এন এস সমুদ্র জয় আজ বঙ্গোপসাগরে একটা ইম্পোরটেন্ট মিশনে আছে। স্যার রাতেই রওয়ানা হবে। রাশেদ স্যারের গায়ে জ্বর চলে এসেছে সন্ধ্যায়। স্যার বাধ্য হয়ে আমাকে আর রাহাতকে রেখে গেলো স্যারের দিকে খেয়াল রাখতে। উনি আরো দুজন লেফটেন্যান্ট নিয়ে রওয়ানা দিলেন। কালকের মধ্যেই চলে আসবেন। এই দূর্ঘটনার সূত্রপাত এখানেই…
দম ফেললো তানভীর। ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।
লিমন কাঁপা গলায় বললো,
– এরপর…
– এরপর রাত একটা বারো তে অহনা স্যারের কেবিনে ঢুকলো। আমি ওকে ঢুকতে দেখেছি। ভাবলাম রাশেদ স্যারকে দেখে বেরিয়ে যাবে। শাহাদ স্যার এবং রাশেদ স্যার একই কেবিন নিয়েছেন। কিন্তু বের হলো কাঁদতে কাঁদতে। ওকে বের হতে দেখে আমি রাশেদ স্যারের কেবিনে গিয়ে দেখি স্যার শুয়ে আছে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার অহনা কাঁদছিলো কেনো। রাশেদ স্যার বিরক্ত নিয়ে বলে, মেয়েটা জাতের খাটাশ। দেখবেনা আমি কে? মানলাম তুই শাহাদকে ভালোবেসেছিস একদিনে, তাই বলে আমি শুয়ে আছি পেছন দিক থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে এলোপাতাড়ি চু*মো খাচ্ছে। হা**মি একটা। একে তো জ্বরের শরীর তাল সামলাতে না পেরে এক চ/ড় দিয়েছি। আমাকে আমার তাহি ছাড়া কেউ ছুঁয়েও দেখেনি আর এই মেয়ে কিনা। ঘে*ন্না লাগছে। এরপর আমাকে দেখে বিব্রত হয়ে গিয়েছে। একবার ভাবো শাহাদ থাকলে কি হত! ওকে তুলে শিপ থেকে ফেলে দিত। বাদ দাও, এসব কাউকে বলো না। শাহাদ আসলে বুঝিয়ে বলবো।’ এরপর আমি স্যারের পাশের বেডে শুয়ে পড়লাম তার অনুরোধে। তখন জ্বর কিছুটা কমেছে। ভোর ছয়টা সাতচল্লিশে শুনি অহনা রেপড,সুইসাইড করেছে। স্যার বিশ্বাস করবেন না তখন এতজোরে ঝটকা খেয়েছি, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছিলো। রাশেদ স্যার সহ ছুটে গিয়েছি। ওই মেয়ের একটা ভুলের জন্য ফেঁসে গিয়েছে রাশেদ স্যার।
– এখানে রাশেদ ভাই কিভাবে ফাঁসলো। তুমিও ফাঁসতে পারতে?
– কারণ অহনার ফোনের ছবি আর রাশেদ স্যারের পরনে শাহাদ স্যারের শার্ট।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২৯.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
সকলে স্তব্দ। কামরা জুড়ে নিরবতা। রাশেদের পরনের শার্ট কি করে ওকে ফাঁসাবে আর কিসের ছবি। তানভীর উৎসুক জনতার দিকে তাকিয়ে বললো,
– শাহাদ স্যারের শার্ট ছিলো রাশেদ স্যারের পরায়। রাশেদ স্যার ইউনিফর্ম ছাড়া শার্ট কম পরতেন, টি শার্ট প্রিয় ছিলো তার। জ্বরের কাঁপুনিতে শার্ট পরে ব্ল্যাংকেট পরেছিলেন। অহনা দরজা খুলেই পেছন দিকটা দেখে ভেবেছে শাহাদ স্যার। পরনে স্যারের ব্লু শার্ট। প্রথমের জড়িয়ে ধরে কয়েকটা পেছন দিকের ছবি তুলে ফেলেছে। জ্বরের প্রকোপে বুঝতে সময় লেগেছিলো রাশেদ স্যারের। সেদিন শিপে শাহাদ স্যার থাকলে উনিই ফেঁসে যেতেন। ছবি তুলেই ক্ষান্ত হয়নি এই মেয়ে, স্যারের গলায় কি*স করা ছবি তুলেছে। এরপরই স্যারকে এলোমেলো চু*মু। হুঁশ আসতেই রাশেদ স্যার সপাটে চ/ড় লাগিয়েছে। চ/ড় খেয়ে ছুটে গিয়েছে ভাইয়ের রুমে। ক্যাপ্টেন আলতাফ তখন খালেদ পারভেজ, ফরিদ রেজা, গওহর রাজা এদের সাথে খেয়ে টাল হয়ে ছিলো। অহনার সেই অর্ধ পোশাক আবৃত শরীর ম/দ্য/প গুলোকে টানবে স্বাভাবিক। যা ভয় ছিলো তাই হলো। আলতাফের সামনে খু/ব/লে খে/য়ে/ছি/লো অহনাকে। অথচ ভাই নিশ্চুপ। ভাইয়ের এই রূপ সেদিন প্রথম দেখেছিলো অহনা। ওর ভুল ছিলো শাহাদ স্যারের মোহে পড়া, ভুল ছিলো বাবার আহ্লাদী হওয়া। যতই আলতাফ ওকে বোন বলে পরিচয় দিক, সবসময় চাইতো অহনার খারাপ। বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান এই অহনা। তার সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক। আলতাফের বাবাও বেশ নামকরা বিজনেসম্যান। তার বিজনেসে লাভের সবটাই মেয়ের নামে রেখে দেন তিনি। এই জিনিস সহ্য হত না আলতাফের। অহনাকে নিয়ে এসেছিলো কোনো ভাবে বিপদে ফেলে দিতে। সে এখন নিশ্চিন্ত।কাজ হয়ে গিয়েছে। ফরিদ আর খালেদ পারভেজ সরে গেলো। অহনা এই যন্ত্রনা নিতে পারেনি। নিজের কেবিনে গিয়ে আ-ত্ন-হ-ত্যা করেছিলো। শিপ ভর্তি তিন বাহিনীর সদস্য,প্রেস। ঘটনা সর্বত্র ছড়িয়ে যায়৷ শাহাদ স্যার ততক্ষনে কাজ শেষ করেছে। আসতে আসতে সকাল নয়টা। ফোনে সব শুনে মাথা ঠান্ডা রেখেছে। রাশেদ স্যারকে অহনার দেয়া সেই চু*মুর স্যাম্পল নিয়েছে গোয়েন্দা বিভাগ। অহনা লাল লিপস্টিক তখনো স্যারের ঘাড়ে। বেচারা বুঝতেও পারলোনা কিভাবে সে ফেঁসে গেলো। সি সি টি ভি ক্যামেরা চেক করে দেখেছে অহনা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছে। সব প্রমান রাশেদ স্যারের বিরুদ্ধে। বাকি গেমটা খেললো খালেদ পারভেজ, ফরিদ রেজা আর গওহর রাজা। অহনার রিপোর্টই চেঞ্জ করে দিলো তিনদিন পর। পরের কাহিনী বের করলো সেদিন সন্ধ্যায় রাশের স্যারের সাথে ভালো সম্পর্ক হয় অহনার, অহনা কি’স বলে দিচ্ছে সে সেচ্ছায় দিয়েছে। এরপরই নাকি রাশেদ স্যার জোর করে রে*প করেছে। তিনদিন অবজারভেশনে ছিলো রাশেদ স্যার। বার বার ইনভেস্টিগেশনের জন্য বসেছিলো। শাহাদ স্যার সেদিন রাশেদ স্যারকে ভুল বুঝেছিলো বলে আমাদের ধারনা ছিলো। কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। রাশেদ স্যার শাহাদ স্যারের পায়ে ধরে কেঁদেছিলো। শিপ সেদিনই চলে আসে বন্দরে। তাহি ম্যাডামকে সব বলেছিলো রাশেদ স্যার। ম্যাডাম ও তো মানুষ। দূরত্ব কতটা ভাবলেই কষ্ট লাগে। নতুন বিয়ের পর এমন একটা খবর কেমন লাগে! সমাজে তো তাকেও বাস করতে হবে। তাহি ম্যাডাম হয়তো মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন নি এই মিথ্যা নিউজ কিন্তু রাশেদ স্যার বুঝেছিলো বিশ্বাসের ভীত নড়ে গিয়েছে। সেই তিনদিন কেটেছে ন/রকের মতো। আমরা সবাই স্যারকে বুঝিয়েছি। আমি তো স্বাক্ষী ছিলাম। আমাকে স্বাক্ষ্যই দিতে দিলোনা সি আই ডি। শেষদিন, এরেস্ট করার আগের দিন রাশেদ স্যার শাহাদ স্যারকে ডেকে বললেন,
– তুই আর তাহি আমার সব। তোরা দুজনই অবিশ্বাস করলি?’
নিরবতা ভেঙে করে শাহাদ স্যার বলেছিলেন,
– আমি নিজেকেও এতটা বিশ্বাস করিনা তোকে যতটা করি। প্রমান জোগাড় করেছি। কিন্তু তোর জেলে যাওয়া কি করে আটকাই তাই ভাবছি। রিপোর্ট তো বলে তুই রে/পি/স্ট।’
– তুই কি বলিস?
– আমি বলি আমার বন্ধু ফুলের মতো পবিত্র।
– তাহলেই হলো। তবে তাহি অবিশ্বাস করেছে। কথা বলছেনা আমার সাথে। ওকে বলে দিস, ওর রাশেদ ওকে ছাড়া কাউকে কখনো ভালোবাসেনি আর কখনো বাসবেনা। শেষ নিশ্বাস অবধি ওর নামে থাকবে।
এই ছিলো শেষ কথা। বিকেল থেকে সমানে সব টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হচ্ছে লে.কমান্ডার রাশেদ আবেদীনের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আগামীকালই গ্রেফতার করা হবে B.N.S Somudro Joy থেকে। শাহাদ স্যার সবার সাথে যোগাযোগ করে চাইছে কিছুদিন পেছাতে। সরাসরি রিমান্ডে নেয়া হবে।এরমধ্যে সন্ধ্যা সাতটায় তাহি ম্যাডাম ফোন দিল শাহাদ স্যারকে। ফোন দিয়ে বললেন রাশেদ স্যারকে বুঝাতে, উনি স্যারকে ভুল বুঝেন নি। মাথা ঠান্ডা রাখতে বলতে। ফোন নাকি বন্ধ। শাহাদ স্যার হেসে আমাদের বললেন,
– তানভীর ভালোবাসার কত শক্তি দেখেছো ভেবেছিলাম তাহি বাকিদের মতো মেনে নিবে রাশেদ দোষী। কিন্তু মেয়েটা ভুল প্রমান করলো।
সকলে মিলে স্যারের কেবিনের দিকে গেলাম। খুশি লাগলো কয়েকদিন এরেস্টের পরোয়ানা পিছিয়েছে। শাহাদ স্যার নিজে দায়িত্ব নিয়ে পিছিয়েছেন এই নির্দেশ। দরজার সামনে এসে কয়েকবার ধাক্কাতেই খুলছেনা। প্রায় পনেরো মিনিট না খোলাতে শাহাদ স্যার উচ্চ আওয়াজে ডাকলেন।ভেতর থেকে শব্দ আসছেনা। এবার সকলে মিলে কেবিনের দরজা ভেঙ্গে ফেললাম। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে। আমাদের প্রত্যেকের পছন্দের মানুষ, হাস্যোজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত, সচ্চরিত্রবান লে. কমান্ডার রাশেদ আবেদীনের দেহ ঝুলছে। স্তব্ধ শিপ। শাহাদ স্যার বাক্য হারিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন। কি হলো জানি না, মাথা ঘুরছে সকলের। চিৎকার দিয়ে উঠলেন শাহাদ স্যার। একটাই কথা বললেন,
– আমি ছাড়বোনা কাউকে, আমার রাশেদের এক ফোঁটা চোখের জলের হিসেব তোদের দিতে হবে জা**** বা***।
দম ওখানেই শেষ স্যারের। এতটুকুই ছিলো তার হায়াৎ। সেই রাতে পাগলের মত পাগলামি করেছে শাহাদ স্যার। আমাদের সব এডমিরাল,ভাইস এডমিরাল,কমান্ডাররা এসেছিলেন। কেউ সামলাতে পারেনি স্যারকে। যাকে পেয়েছে তাকে ধরে কেঁদেছে। শকে চলে গিয়েছিলো স্যার। আমরা তো একবার ভেবেছিলাম না জানি শাহাদ স্যার নিজেও
সু/ই/সা/ই/ড করবে। উনাকে একা ছাড়িনি কেউ। বার বার বলছিলো,
– আমি থেকে কি করবো! আমিও চলে যাব। আমাকে কেনো ব্যর্থ প্রমান করে ফে*লে গেলি। ব্যর্থ বন্ধু আমি। তোর জন্য কিছুই পারলাম না করতে। আমার জন্য গুলি খেলি,আমার জন্য নিজের জান টা ও কুরবান করতে রাজি ছিলি আর আমি। ছিঃ তোর মৃত্যুর জন্য আমি ও দায়ী কোনো না কোনো ভাবে। কেনো ফেলে গেলাম তোকে সেদিন। থাকতে পারতাম তোর পাশে। অথচ দেশের জন্য তোকে হা*রা*লা*ম। আমার সুখ ছিনিয়ে নিলিরে ভাই। সব নিয়ে গেলি তুই।
কেদেছিলো সেদিন B.N.S Somudro Joy. আমাদের কুক দবির চাচা তো শিপে গড়িয়ে কেঁদেছেন। প্রতি সন্ধ্যায় নতুন আইটেম করতেন দবির চাচা, আর মেয়োনিজ বানাতেন রাশেদ স্যার। নেভির প্রত্যেকটি অফিসার শপথ করেছিলেন সেদিন দেহে প্রাণ থাকতে এই বলিদানের প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। রাশেদ স্যার আমাদের গর্ব ছিলোনা আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রাণ ছিলো। উনি চলে যাবার পর শাহাদ স্যারকে হাসতে দেখিনি। রাতে ছটফট করতে দেখেছি। মাঝে মাঝে বেসামাল হয়ে বলতেন, ‘আমি কেন সেদিন তোকে ছেড়ে গেলাম। আমি ম*রে গেলে কাঁদার মত মানুষ কম থাকতো। তুই ম*রে আমার ছুটকিকে বিধবা করে দিলি। ধৈর্য্য কেন ধরলি না, ভরসা কেনো রাখলিনা আমার উপর। ‘
এখানেই শেষ। আমাদের একজন রাশেদ ছিলেন। যার জন্য পুরো ডিপার্টমেন্ট এখনো কাঁদে। তিন বছর আগে আজকের দিনটাতে স্যার সু/ই/সা/ই/ড করেছেন। কেইস অমীমাংসিত রয়ে গেলো। এই কেইস আর আগায় নি। অন্য কারো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখিয়ে বলেছে রাশেদ স্যার নির্দোষ। শাহাদ স্যার চায় নি তার বন্ধুটি আর কষ্ট পাক। ভালো হয়েছে শাহাদ স্যার এখন হাসপাতালে বেহুঁশ। তাহি ম্যাডাম আজকে স্যারের কবরের সামনে চলে গিয়েছেন আমি জানি। সারাদিন সেখানেই থাকবেন। আরো একজন থাকবেন, তবে আড়ালে?
পাভেল প্রশ্ন করলো,
– কে?
শাহীন উত্তর দিলো,
– মেহেরজান আম্মা, রাশেদ ভাইয়ের মা।
এই কথা শুনে চমকে উঠলো সকলে। শাহীন ক্ষীণ হেসে বলে,
– এই তথ্য ভাইজান যাওয়ার আগে আমাকে আর তানভীরকে বলে গিয়েছে। আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম ভাইজানের ক্লান্ত লাগে না, এত খবর কিভাবে রাখে? এখন মনে হয় ভাইজান সাধারণের মাঝে অসাধারণ কিছু। হয়তো দেশে থাকলে খালেদ পারভেজের লা*শ ফেলতো আজ। ভাইজানের টার্গেট দুটো। আজকের দিন টা মিস হয়ে গেলো। পরবর্তী দিনের নির্দেশ আছে আজ থেকে ঠিক কয়েকমাস পর নিদিষ্ট তারিখে খালেদ পারভেজ এবং ফরিদ রেজার মুখোশ উন্মোচন করবে। ফরিদ রেজা এই কান্ডে জড়িত ছিলো তা জেনেছে বেশ কিছুদিন আগে। এর আগ অবধি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো। যেদিন ভাইজানের পরিবর্তে ভুলে হামজার উপর আক্রমণ হলো সেদিনই জানতে পারলো ফরিদ রেজা সন্দেহের বশে ভাইজানের উপর আক্রমণ করেছে। ভেবেছিলো ভাইজান তার রহস্য জেনে গিয়েছে। অথচ ও নিজেই নিজের ফাঁদে পা দিয়েছে।
লিমন বললো,
– ছোট ভাইয়া আমাকে কেনো ইনভলভ করলে এসবে তাহলে? আমি তো তোমাদের মতো ফোর্সের কেউ না।
– বড় ভাইজানের নির্দেশ ছিলো। তাহিকে সামলাতে পারবি? মেয়েটা একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে ভেতরে।
লিমন শুকনো ঢোক গিললো। মুখটা শুকিয়ে গেলো। কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
– বড়… ভাইজান..!!! কি বলেছে?
– ভাইজান আসা অবধি তোকে সামলে রাখতে বলেছে। ও কারো সাথে কথা বলেনা তেমন। রাশেদ ভাই যাওয়ার পর একমাত্র তোর সাথেই কথা বলে। কি করতে হবে বুঝতে পারছিস?
– জ্বি ভাইয়া।
– তাহলে পাভেল আর লিমন চলে যাও রাশেদের গ্রামের বাড়িতে। আমি তানভীরের সাথে বের হচ্ছি। রিপোর্ট আছে জায়গা মত। ওটা আগে নিঃশেষ করবো। এতবার হাত বদলে কাহিনী ঘোলাটে হচ্ছে।
সামলে নিস তাহিকে লিমন।
লিমন মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
___
জায়গাটা স্বাভাবিক, মানুষজন স্বাভাবিক তাহলে এখানে অস্বাভাবিক কি? পুরান ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন বাড়িদের মধ্যে এটি একটি। বাড়িটি তালাবদ্ধ। আজ পঁয়ত্রিশ বছর এই বাড়িতে কেউ থাকেনা। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্কারের জন্য একজন লোক আছে সেই দেখে। এই বাড়ির সাথে রাশেদের কি সংযোগ মাথায় আসছেনা শাহীনের। হাম্মাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– হাম্মাদ, আপনার কি মনে হচ্ছে এই বাড়িটা দেখে? বাড়িতেই রহস্য মনে হচ্ছে। এই বাড়িতে মানুষ না থাকলেও আসা যাওয়া আছে। যেভাবে বলা হচ্ছে ব্যাপারটা ওরকম না।
– মেহেরজান আম্মার শ্বশুরবাড়ি এটা আপনি শিউর শাহীন?
– পাক্কা খবর।
– ভেতরে যাওয়া যাক।
হাম্মাদ আর শাহীন ভেতরে পা বাড়াতেই দারোয়ান বাধা দিলো। শাহীন সরাসরি কার্ড দেখালে দারোয়ান ভয় পেয়ে জায়গা ছেড়ে দিলো। দারোয়ানের সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলো দুজন। যা ইনফরমেশন নেয়ার সব নিয়ে নিলো।
দুজন বেরিয়ে এসে হেসে দিলো। হাম্মাদ শাহীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তাহলে ফলাফল এই দাঁড়ালো।
দুজনই রওয়ানা দিলো গোয়েন্দা হেড কোয়ার্টারের দিকে। কাজ যা ছিলো সব আজকের মধ্যে শেষ করতে হবে। শাহাদ দেশে এসে যেন সুস্থ পরিবেশ পায় তার জন্যই এই আয়োজন।
___
আকাশের তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। শাহীন ছাদে উঠেছে। সাথে নওরীন,শেফালী ও শিফা। চিলি কোঠা থেকে পাভেল ও বের হয়েছে। শাহীনের কোলে শেহজা। রুমে দম আটকে আসছে সবার। শেফালীর পাশে আবির দাঁড়িয়ে আছে। আবির হঠাৎ করে বলে উঠলো,
– ছোট মামা বড় মামা কবে আসবে?
শাহীন হালকা হেসে ভাইগ্নার চুল এলোমেলো করে বললো,
– খুব তাড়াতাড়ি আসবে মামা, তুমি একটু বড় মামার জন্য দোয়া করো। বড় মামা একটু অসুস্থ।
– আমি দোয়া করি তো। আজ বলেছি আল্লাহ কে বড় মামা যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে এসে আমাকে গ্যালাপাগোস নিয়ে যায়।
সকলে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে একসাথে বলে,
– গ্যালাপাগোস!!!
শাহীন উৎসাহী ভঙ্গিতে বলে,
– তোমাকে বড় মামা নিয়ে যাবে বলেছে?
আবির দু পাশে মাথা নাড়িয়ে বলে,
– হ্যাঁ।
নওরীন প্রশ্ন করলো,
– গ্যালাপাগোস কি?
শেফালী উত্তর দিলো,
– আমাদের আবেগ। ছোট থেকে বড় হয়েছি গ্যালাপাগোসের গল্প শুনে। তবুও পুরোনো হয়না এই গল্প। ছোট ভাইয়া আমি সত্যি ভাগ্যবতী। আমার ছেলেকে বড় ভাইজান গ্যালাপাগোস নিবে বলেছে। আমি ভাবতে পারছিনা।
শাহীন নওরীনের কৌতুহল দমাতে বলে,
– ভাইজান যাদের ভালোবাসেন তাদের গ্যালাপাগোস নিয়ে যাবেন বলেন। যেহেতু ভাইজান একজন নেভিয়ান তার দ্বীপ,সমুদ্রের প্রতি অনেক আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে ভাইজান গ্যালাপাগোসের গল্প পুরোপুরি শেয়ার করেছেন এমন মানুষ খুব কম। আমাদের সাথেও সেই গল্প করেন নি। আমার জানামতে রাশেদ ভাইয়ের পরে এই প্রথম আবির জানলো বিষদভাবে গ্যালাপাগোস সম্পর্কে। রাশেদ ভাই চলে যাবার পর ভাইজান উনার গ্যালাপাগোস নিয়ে সবচেয়ে প্রিয় জার্নাল টা পুড়িয়ে ফেলেছে। আর কখনো নাম উচ্চারণ করেনি গ্যালাপাগোসের। আজ আমি দ্বিতীয় বার শুনলাম এত বছর পর।
আবির তখনই চিৎকার দিয়ে খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বললো,
– জানো বড় মামা আলবাট্রস দেখাবে বলেছে।
সবার মাঝে একটু উত্তেজনা কাজ করলো। পাভেল এগিয়ে এসে বললো,
– বলো আমাদের,শুনি।
– অনেক গল্প কিন্তু বলবোনা। মামা বলেছে টপ সিক্রেট।
শাহীন হঠাৎ বললো,
– পাভেল রহমত চাচারে বলো দুইটা ডেইরী মিল্ক,আইসক্রিম যা যা আছে আবির মামার প্রিয় সব আনতে। মামা এবার বলবে গ্যালাপাগোসের গল্প।
আবির বেচারা বুঝতে পারছেনা, এত চকলেট আবার বড় মামার ওয়াদা। একটু ভেবে বলে,
– পাভেল মামা, এনো না কিছু লোভ করে পঁচা রা বড় মামা বলেছে। আমি স্যরি। বড় মামা আসলে পারমিশন নিয়ে শুনাবো গল্প। আমাকে আল্লাহ পানিশ করবে লোভ করলে, যেমন আল্লাহ মাম্মাম কে করেছে।
শেফালী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ভাইদের বললো,
– ভাইজান জোর করোনা। আমার ছেলে ওয়াদা রাখুক। প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছে ভাইজানের কাছ থেকে।
___
লাল খামে ভরা চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে। একটু পর পর চোখ মুছেই যাচ্ছে, কেঁদেই যাচ্ছে। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। আজ মেয়েটাকে খাইয়ে শিফা-শেফালীর কাছে রেখে এসেছে। দ্বিতীয়বারের মত খুললো সেই চিঠি, একবার খুলে বার বার পড়ে যতক্ষন না মন ভরে,
প্রিয় শাহাদ বধূ,
তোমাকে শক্ত ভেবেছিলাম কিন্তু এতটা দূর্বল হলে কি করে, আমার অনুপস্থিতি তোমাকে এভাবে পোঁ/ড়া/বে জানলে সেদিন কক্সবাজার থেকে তুলে এনে নিজের করে রাখতাম। অন্তত দুটো বছর বেশি কা/টা/তে পারতে আমার সাথে। শাহাদের প্রতি কত মেয়ের কত আকর্ষণ অথচ শাহাদের চোখের মনি যে ফারাহ তা কি সে জানে! জানে না কারণ শাহাদের হৃদয় আত্নগোপন করেছে তার প্রকৃত পরিচয়৷ শাহাদপ্রিয়া ঘুম ভাঙার পর আর পাশে পাবে না তার প্রেমিক পুরুষকে। ব্যাপারটা বিরহের। ইশ কি সুন্দর পত্র লিখছি আমার বৈধ প্রেমিকাকে। তোমাকে আমার সিঙ্গাপুর বড্ড প্রয়োজন পড়বে। একটা সিক্রেট বলি? তুমি তো আমার সিক্রেট হোল্ডার। শাহাদ ইমরোজ যতই কাঠখোট্টা, নিরস, গোমড়ামুখো, দুঃসাহসী হোক না কেনো আসলে সে বড্ড ভীতু৷ কখনো লজ্জ্বায় বলিনি যদি তুমি অন্য কিছু ভাবো। আজ বলছি যদি বলার সুযোগ না পাই। ফারাহ… আমি প্রায় রাতে ঘুম থেকে উঠে তোমার কাউচের সামনে বসতাম। অথচ ভয়ে তোমাকে জাগাতাম না। ডীম লাইটের আলোয় তোমায় দেখে পুরো এক প্রহর কাটিয়ে ঘুমোতে যেতাম। তুমি আমার চোখে দেখা সবচেয়ে বড় প্রশান্তি। যখনই চিন্তারা ঘিরে ধরে যেখানেই থাকি তোমার ছবি চোখের সামনে ধরি। যখন দু বছর তোমাকে আলাদা রেখেছি তখন আমার যত্ন করার মানুষ কম ছিলো। অসুস্থতায় কাউকে বলিনি। জানো প্রতি রাতে মাথায় পাগলামি চেপে বসতো। সিঙ্গাপুর গেলেও এই পাগলামি তাড়া করবে। এই একটা কারনে তোমাকে আমার পাশে প্রয়োজন ছিলো বউ। জানতে চাও কি সেই পাগলামী! এই আটত্রিশ বছর বয়সী পুরুষের তোমার বুকে যাওয়ার বড্ড লোভ অথচ সেই লোভ সামলে এসেছি গত আড়াই বছর। তোমার পাতলা অধর আমার কপাল ছুঁবে কবে! আমি আদৌ ফিরে আসবো! মাঝে মাঝেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতাম, পরক্ষনে মনে পড়তো কিভাবে দু বছর তোমাকে কষ্টে রেখেছি। কতটা স্বার্থপর আমি! এভাবে দিন কে*টেছে, আমার অসুখ বেড়ে চলেছে। এই তো শাহাদের গল্প। ফিরে আসলে নতুন প্রেমের কাহিনি শুরু করবো। আর চলে গেলে তুমি শাহাদ বন্দনা রচনা করবে… একটা আবদার করবো বউ, শুনবে! আমি যদি ফিরে আসি একটা রাত আমার নামে সমর্পন করো! একদম জ্বালাবোনা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তোমার বুকে ঘুমাবো৷ পারবে না!!!
ইতি
তোমার নিরস স্বামী
শাহাদ ইমরোজ।
বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে জোরেই কাঁদছে দিয়া। আজ চার চারটা দিন শাহাদের সাথে যোগাযোগ নেই। গুটিশুটি মে*রে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হাতে বিয়ের ছবি। এই বাড়িতে আসার পর শিফা তুলে দিয়েছিলো। টেবিল কাঁপিয়ে ফোন রিং হলো। শাহাদ কল করেছে। হয়তো হামজার ফোনে চার্জ নেই তাই শাহাদের ফোন থেকে কল করেছে। লাইট জ্বালিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসলো৷ রিসিভ করতেই দিয়া সালাম দিলো,
– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম।
ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দিয়া স্তব্ধ। বুক কাঁপছে। নেত্রজল গড়িয়ে পড়ছে। হেঁচকি উঠে গিয়েছে। চার চারটা দিন পর মানুষটাকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারছেনা। শাহাদের মুখে হাসি, চোখে পানি। শাহাদ নিজেও চোখের কোণায় জমে যাওয়া অশ্রু বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে নিলো। দু পাশে শুধু নিরবতা। নিরবতা ভেঙে বললো,
– ভালোবাসি ফারাহ…
এবার জোরে কেঁদে দিলো দিয়া। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– আমি আপনার কাছে যাব। নাহয় আপনি চলে আসেন। আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবোনা।
ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত করছে শাহাদ। চোখের সামনে কিভাবে কাঁদছে বউটা। বুকের ভেতর তোলপাড় করছে। শান্তনা দেয়ার ভাষা নেই। ঢোক গিলে বললো,
– এই তো সোনা চলে আসবো। আর তো মাত্র কটা দিন। একটু অপেক্ষা করো। এরপর আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা।
– সত্যি তো!
– এক সত্যি, দুই সত্যি,তিন সত্যি এন্ড লাস্ট পিংকি প্রমিজ।
দিয়া এর মাঝেই এক অদ্ভুত কাজ করে বসলো। ফোনের উপর শব্দ করে চু*মু দিলো। শাহাদের অধর আলগা হয়ে গেলো। হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,
– ট্রেইনার কে?
– আপনার চিরকুট।
– বাহ কয়বার রিভিশন হয়েছে?
– মুখস্ত হয়ে গিয়েছে।
– আরেব্বাবাহ! আমার জন্য তাহলে রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ, বালুশাই অপেক্ষা করছে।
– মজা করবেন না তো। লজ্জা দিচ্ছেন কেনো আমাকে?
– আচ্ছা আর দিব না। এখানে একজন সুন্দরী সিস্টার আছে, তাকে দিব।
সাথে সাথে দিয়া মুখ গম্ভীর করে ফেললো। পুনরায় ছলছল চোখে বললো,
– আচ্ছা।
শাহাদ হেসে বলে,
– আসো পরিচয় করিয়ে দি।
তখন সিস্টার ম্যারি সামনে এসেছে। শাহাদের ইশারায় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
– হ্যালো বিউটিফুল লেডি।
দিয়া তাকিয়ে অধরদ্বয় আলগা করে ফেললো। নিজেকে সামলে বললো,
– হ্যালো সিস্টার ইউ আর সো চার্মিং।
– ত্যাংকিউ
শাহাদকে জিজ্ঞেস করলো,
– হু ইজ শী?
– মাই হার্ট, মাই ব্রিথ এন্ড মাই আইস।
শাহাদের কথা শুনে দিয়ার দিকে তাকালো। দিয়া নিজেও লজ্জা পেলো এসব সম্বোধনে। এমপি সাহেব এভাবেও তাকে পরিচয় করায় সকলের সাথে! ভাবতেই মনে প্রজাপতি উড়ে। সিস্টার ম্যারি এসব শুনে দিয়াকে বললো,
– হাউ সুইট। ইউ আর সো লাকি সুইট গার্ল।
– থ্যাংকিউ।
নার্স চলে যেতেই দিয়া শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– এই আপনার সুন্দরী পঞ্চাশ/ষাট বছরের সিস্টার??
– কেনো সুন্দর না!
– অবশ্যই সুন্দর কিন্তু আপনি অন্য কিছু ভাবিয়েছেন আমাকে।
– কি ভাবিয়েছি! তুমি জেলাস?
দিয়া নিশ্চুপ। শাহাদের মুখের দিকে বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– কবে আসবেন?
– যদি আসি চিরকুটের শেষ আবদারটা রাখবে?
দুহাত মেলে দিলো দিয়া। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে বলে উঠলো,
– আপনি এখন আসেন, এখনই রাখবো।
– সুস্থ না হয়ে!
দিয়া হাত গুটিয়ে চোখ মুছে বলে,
– না সুস্থ হয়ে। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
– আমিও।
শাহাদ ঝিমুচ্ছে। সিস্টার এলো মেডিসিনের সময় হয়েছে। হামজা ঢুকলো। শাহাদ ফোনের স্ক্রিনেই ঠোঁট ছোঁয়ালো। শেষে বললো,
– আমার কলিজাকে আমার ভালোবাসা দিও। মেয়েটাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে। জানি ঘুমিয়েছে রাতে তাই জিজ্ঞেস করিনি। ওকে দেখলে আমি আরো অসুস্থ হয়ে যাব। ওর বাবা ডাক শুনলেই আমার শ্বাস আটকে যাবে। ওকে সামলে রেখো ফারাহ। আমি ফিরলে তোমাদের দুজনের দায়িত্ব আমার। না ফিরলে তোমাকে নিতে হবে সেই দায়িত্ব। ভালো থাকো। আল্লাহ হাফেজ।
ফোন কেটে গেলো। দিয়া কাঁদতে কাঁদতে ফোন,চিরকুট, ছবি সব বুকে জড়িয়ে ঘুমের জগতে হারালো। প্রিয় মানুষের সাহচর্য মানুষকে দূর্বল করে তোলে। চাপা অনুভূতি সব বেরিয়ে এলো আজ। এইতো সেদিনের বদ রাগী শাহাদ আজ আগ্রাসী প্রেমিক। মানুষ বদলায়,শুধু সময়টা সঠিক হওয়ার অপেক্ষা।
চলবে…