সায়রে গর্জন পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
5

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩৬.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ফজরের আজান পড়বে। হঠাৎ ফোনকল। বিরক্ত হয়ে দু দু বার কল কে*টে দিলো। তৃতীয় বার কল আসতেই ধরে খুব সুন্দর করে একটা বাণী ছুঁড়লো,

– কোন হা*রামী আমার ঘুম ছুটাচ্ছে?

– একটু আসতে পারবে হাসপাতালে?

ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে লাফ দিলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো। জোরে জোরে দু বার শ্বাস নিয়ে বললো,

– আম স্যরি, আসছি।

ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওযূ করে বের হলো।নামাজ আদায় করে মনের সুপ্ত বাসনা চেয়ে নিলো উপর ওয়ালার কাছ থেকে। গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো, আফিয়া খালা দরজা লাগিয়ে দিলো।

হাসপাতালে পৌঁছে চোখে পড়লো ঘড়িতে ছ’টা। তাহিকে দেখে এগিয়ে এলো। সারা রাত কি এই মেয়ে বাসায় যায়নি! মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। তাহির মুখে আতঙ্ক। ভয়ে ভয়ে বললো,

– রাতে বাসায় যাই নি, মন সায় দিচ্ছিলো না। মনিকে কেবিনে শিফট করেছে। কাল সারা রাত হাসপাতালে কিছু অপরিচিত মুখ ছিলো। প্রথমে তেমন আমলে নেয়ার মত ছিলোনা ব্যাপার টা। কিন্তু এখন এদের একজন আমার চেম্বারে বসে আছে। ভীষণ ভয় করছে। আমি আউটডোর ভিজিটে আছি বলে সিস্টার পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। ছোট ভাইয়া ফোন ধরছেনা। হয়তো ক্লান্ত। আর বড় ভাইজানকে তো জানানোই যাবেনা। এখন কি করবো?

লিমন তাহির চোখে মুখে ভয় দেখতে পেলো। আশপাশটা দেখলো নিরব। কিছু রোগী আছে, সিস্টার আছে। এত সকালে মানুষ কম থাকাটাই স্বাভাবিক। কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো,

– হাসপাতালে সবচেয়ে সিকিউর রুম কোনটা?

তাহি ভেবে বললো,

– তেমন সিকিউর কোনোটাই নয়।

– মনি আপার কেবিনে কে আছে?

– আন্টি, আংকেল দুজনই আছেন।

– চলুন।

– ওখানে কেনো?

– আপনাকে ওখানে রেখে আমি আপনার কেবিনে সেই আগন্তুকের সাথে মিটিং করবো।

– কিসের মিটিং?

– তাকে আমার বিয়ের ঘটক বানাবো?

– কিহ?

– এত প্রশ্ন করেন কেনো বলুন তো? সামনে পা বাড়ান।

লিমন সরে গিয়ে তাহিকে জায়গা করে দিলো সামনে যাওয়ার। মনি এখনো ঘুমে। রেদোয়ান কেবিনের দরজা খুললো। তাহি আর লিমন যাওয়ার সময় নাস্তা নিতে ভুললো না। রেদোয়ান কিছুটা খুশি হলো ওদের দেখে। কাল রাতে ভাই-ভাবী থাকতে চেয়েছিলো জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। থাকার জায়গা নেই, দুজনই অসুস্থ। বাড়িতে অনেক গুলো মেয়ে। এছাড়া মোমেনা রাত থেকে কিছু খায়নি। রেদোয়ান দুজনকে দেখে বসতে বললো। তাহি সিস্টারের সাহায্যে নাস্তা বেড়ে দিলো সবাইকে। মোমেনা নিরব। অধিক শোকে পাথর আজ। তাহি পাশে বসে খাইয়ে দিচ্ছে। লিমন অল্প একটু ভদ্রতার খাতিরে খেয়ে বেরিয়ে এলো তাহিকে রেখে। জানে তাহি জেঠুর কাছে নিরাপদ। এই লোকটা নিজেই একটা ত্রাস। মোমেনার কোনো অভিযোগ নেই। মেয়ের এমন পরিস্থিতিতে কি করে আরেকজনের মেয়েকে অভিশাপ দিবে, যখনই ভাবে চোখ ভেঙ্গে কান্না পায়।

লিমন তাহির রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো ষন্ডা আকৃতির এক লোক বসে আছে। উচ্চতায় লিমন থেকে দু তিন ইঞ্চি বেশি হবে। লিমন দেখেই বললো,

– কাকে চাই?

লোকটা ভাব ধরে বসে আছে। ডাক্তার তাহির নেমপ্লেটে টোকা দিয়ে বললো,

– কোথায় এই ডাক্তার? কতক্ষন বসিয়ে রাখবে?

– উনি আসবে না। কি প্রয়োজন আমাকে বলুন?

লিমনের আপাদমস্তক দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

– আপনাকে কেনো বলবো?

– আপনি কি পেশেন্ট?

– যেই হই না কেনো? আপনি কি ডাক্তার?

– অ্যাপয়েন্টমেন্ট কোথায়?

– নিয়নের কারো অ্যাপোয়েন্টমেন্ট লাগে না।

– একদম নিয়ন বাতির মতো জ্বলজ্বল করছে আপনার বদন তাই না, একদমই সত্যি ভাববেন না। দেখতে বিদঘুটে লাগছে।

রাগে নিয়নের গা টা জ্বলে উঠলো।এত বড় অপমান এর আগে কেউ করেনি।

– কথা কম বলে তাহিকে পাঠান?

– আমি তাহিকে নাম ধরে ডাকার সাহস পাই না, শালা তোর এত সাহস?

নিয়ন কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। ভুলেই তাহি বলে ফেলেছিলো। ব্যাপারটাকে এই ছেলে এত লম্বা চওড়া ভাবে দেখছে কেনো? নিজের ভাব বজায় রাখতে জোরেই বললো,

– তাহিকে তাহি বলবোনা তো কি জান বলবো?

কথার সাত পাঁচ না ভেবে লিমন নিয়নের নাক বরাবর দিলো এক ঘুষি। তাল সামলাতে না পেরে নিয়ন ও দিলো একটা। ব্যস, লেগে গেলো। ভেতরে আওয়াজ শুনে সিস্টার দরজা খুলে দেখলো এই অবস্থা। ছুটে গিয়ে তাহিকে ডেকে নিয়ে এলো। তাহি এসে দেখে ভেতরে লঙ্কাকান্ড। দুজনকে ধরে থামালো। নিয়ন একপাশে সরে গেলো।

তাহি লিমনের গালে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো কামরা। এই নিয়ে দু দু বার মার খেয়েছে লিমন। এই মেয়ে নিজে ডেকে এনে এতটা অপমান কেনো করলো। তাহির দিকে তাকিয়ে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নিয়নের মুখে তেমন একটা ক্ষতি না হলেও লিমনের নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। তাহি চেঁচিয়ে বললো,

– এটা হাসপাতাল। গুন্ডামি করার জায়গা? বাইরে গিয়ে করুন।

তাহিকে দেখে নিয়ন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

– স্যরি ডাক্তার।

পুনরায় রক্তাক্ত হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

– ম্যাডাম, আপনার সাথে দেখা করে যেতে বললো স্যার। তাই অপেক্ষা করছিলাম।

নিয়ন যে তাহিকে সাফাই দিবে লিমন ভাবতেও পারেনি।

লিমন চড় খেয়ে চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে।তাহি তাজ্জব বনে গেলো, নতুন স্যার আবার কে? প্রশ্ন ছুঁড়লো,

– কোন স্যার?

– নাফিস স্যার।

– উনি কে?

লিমন হতচকিত হয়ে গেলো। এখন কথা যেভাবেই হোক ঘুরাতে হবে। নিয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আশ্চর্য পাবলিক আপনি বলবেন তো আপনি নাফিস স্যারের লোক। এতক্ষন শুধু শুধু ঝামেলা করলেন সাথে আমার গালে তিনশ বিশ ভোল্টের চ*ড় উপহার দিলেন। চলুন আমার সাথে।

লিমন কিছু একটা ইশারা দিলো। নিয়ন বুদ্ধিমানের মত ধরে ফেললো। তাহি নাছোড়বান্দা। পথ আটকে বললো,

– নাফিস কে?

নিয়ন আত্মবিশ্বাস নিয়ে না ঘাবড়ে বললো,

– কমান্ডার শাহাদের বন্ধু।

– আচ্ছা, আমার সাথে দেখা করতে কেনো বলেছে?

– শাহাদ স্যারের বোনের এক্সিডেন্ট হলোনা, ভেবেছিলো আপনার কিছু হলো কিনা? আপনি তো কমান্ডার রাশেদের মিসেস…

লিমন নিশ্চিত বুঝতে পারছে নিয়ন কথা গুলিয়ে ফেলছে। খালেদ পারভেজ এখনো ধরা পড়েনি ইয়াজ জানিয়েছে। তার জন্য হাসপাতালে তাহি যদি কোনো রকম এসব ঝামেলার কথা জানতে পারে অনেক বিপদ। পরিস্থিতি সামলে বললো,

– মি. নিয়ন আপনাকে মূলত পাঠিয়েছে কমান্ডার রাশেদের কিছু জিনিসপত্র মিসেস রাশেদের কাছে পৌঁছে দিতে। নাফিস স্যার তো আমাকে দুদিন আগেই ইনফর্ম করেছিলো। আপনি কিসব ছন্নছাড়া কথা বলছেন। আর নিচে এত সব সিকিউরিটি বসিয়েছেন কেনো? সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে যাচ্ছে।

– ওহ হ্যাঁ তাই তো। আমি তো জিনিস গুলো গাড়িতে ফেলে রেখে এসেছি। আপনি আসুন আমার সাথে।

কথা না বাড়িয়ে লিমনের হাত ধরে বেরিয়ে এলো। তাহি হতবাক। দুইটা পাগল এক সাথ হলে যা হয় তাই হয়েছে এতক্ষন। একে তো মনির চিন্তায় দিশেহারা, এর মাঝে উটকো ঝামেলা।

___

ঘড়িতে সকাল সাতটা শাহাদ ফ্রেশ হয়ে একটু মেডিটেশন করছে। অল্প এক্সারসাইজ করে শেহজাকে ঘুমের মধ্যে আদুরে চুমু দিয়ে খাটে বসলো। হাতে পেপার নিয়ে এক নজর চোখ বুলালো। স্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক খবরই বেশি। হ/ত্যা,
ধ/র্ষ/ন,এসব দেখতে ভালো লাগছেনা। ফরিদের শাস্তি হয়েছে শুনেছে। পুরোটা বিস্তারিত জানতে হবে। সমাবেশ আছে আগামীকাল। অনেক দিন কাজ থেকে দূরে। এরই মাঝে দিয়া রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

– এমপি সাহেব খেতে চলুন।

দিয়ার এমপি সাহেব মুচকি হেসে পেপারটা সরিয়ে বধূর দিকে তাকিয়ে দেখলো। খয়েরী একটা তাতের শাড়ি গোল্ডেন জরিতে কাজ। ছিপছিপে দেহে একেবারে মিশে গিয়েছে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে কামরা জুড়ে। এত সুন্দর মায়া কেনো? খুব পছন্দের গানের দুটি লাইন আওড়ালো,

– ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়
ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মণিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে
ভালবাসবো তোমায়।

উঠে দাঁড়িয়ে প্রেয়সীকে কাছে টেনে বললো,

– অপূর্ব লাগছে, ঠিক যেন ভোরের শিশির।

– আর কত উপমা পাবো?

– যতটুকু আছে এই হৃদয়ে।

– হয়েছে, দিন দিন দুষ্টু হচ্ছেন।

– এই যাহ এজন্যই কারো ভালো করতে নেই। আগের শাহাদই ভালো ছিলো। সামনে দাঁড়ালে তো তখন এমপি বধূর হাত পা কেঁপে উঠতো…

দিয়া ঝাপটে ধরলো শাহাদকে। মেয়েটা অকস্মাৎ শান্ত হয়ে গেলো। এমন ভাবে ধরলো মনে হলো কেউ কোনো সম্পদ কেড়ে নিবে শক্ত পোক্তভাবে না সামলালে। শাহাদের অভিপ্রায় হতেই জড়িয়ে ধরে বললো,

– ইটস ওকে, মজা করেছি। আর করবোনা। বি নরমাল ফারাহ্, বি নরমাল। আই প্রমিজ আর করবোনা।

আফিয়া খালা বাইরে থেকে ডাক দিলো নাস্তার জন্য। দিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো ডাইনিং এর উদ্দেশ্যে।
টেবিলের দিকে পা বাড়ালো। সবাইকে দেখে মৃদু হাসলো। খাবার টেবিলে পছন্দের খাবার গুলো দেখে হেসে সকলের সাথে গল্প করতে করতে মুখে তুললো। ফোন টা অন করতেই সাথে সাথে রিংগিং। চমকে উঠলো। ভাবলো কার এত তাড়া। ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো। অপর পাশ থেকে শাহাদকে কথা বলার সুযোগটাই দিলোনা। লাইনটা কেটে গেলো। যা শুনলো টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায়। সামনে বাবা,মা, দিয়া, ভাই-বোন সবাই বসে আছে। পুনরায় বসে পড়লো। শাহাদ চিন্তিত ভঙ্গিতে দেখে শাহীন প্রশ্ন ছুড়লো,

– ভাইজান কোনো সমস্যা?

শাহাদ নিরব। খেয়েই যাচ্ছে। রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলো, সুলতানা কবির প্রশ্ন করলো। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। আচমকা শাহীন ভয় পেয়ে গেলো। শাহাদ বেসিনে হাত ধুয়ে টিস্যুতে হাত মুচছে। শাহীন খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে শাহাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

– ভাইজান আপনি কাল ফিরলেন তাই,আমি আপনাকে জানাতাম…

কথা পুরোপুরি শেষ করার আগেই শাহীনের গালে চড় পড়লো একটা। ডাইনিং রুম কেঁপে উঠলো। দিয়ার হাত চেপে ধরলো নওরীন। সুলতানা কবির,রায়হান সাহেব সকলে আঁৎকে উঠলো। শাহীন মাথা নত করে রেখেছে। এখনো কারো উপলব্ধি হলোনা প্রকৃত কারণ। শাহীনের গায়ে শাহাদ হাত তুলেছে এটা কেউ ভাবতেই পারছেনা।

– কত বড় ভুল করেছো তুমি জানো?

ঠান্ডা মাথা প্রশ্ন ছুঁড়লো শাহাদ। শাহীন শাহাদের চোখে আজ ক্রোধ দেখছে। হয়তো শাহীনেরই ভুল।

– ছুটির আর কদিন আছে?

– পনেরো দিন।

শাহাদ ফোন বের করলো। কাকে যেন ফোন দিলো। ফোন দিয়ে একটু দূরে গিয়ে কথা শেষ করে আগের জায়গায় এসে শাহীনকে বললো,

– মালদ্বীপের টিকিট কেটে দিয়েছি, বৌমাকে নিয়ে ঘুরে আসো। বারোদিনের দিন ঢাকায় ল্যান্ড করবে। সকলের সাথে দেখা করে চলে আসবে। আমার পরবর্তী নির্দেশ আসা অবধি এখানে পা রাখবেনা। ক্লিয়ার!

– জ্বি ভাইজান।

নওরীনের দিকে তাকিয়ে বললো,

– বৌমা আমি খুবই দুঃখিত তোমার সামনে তোমার স্বামীর গায়ে হাত তুললাম। ও যে ভুলটা করেছে তা জানলে চড় টা আমার জায়গায় আব্বু বা আম্মু মারতো। আমি চাইনা আমি ব্যতীর কেউ ওর গায়ে হাত তুলুক। আব্বু, আম্মুর চেয়ে ওরা তিনজনই আমার শাসনে বড় হয়েছে। শাহীন আমার হাতে গড়া। ও এত বড় ভুল করবে সেটা আমি মেনে নিতে পারছিনা।

নওরীন মাথা নেড়ে বললো,

– ভাইজান আপনি যা করবেন নিশ্চয়ই আমাদের ভালোর জন্য করবেন। ভুল করলে শুধরে দিবেন। এতে আমাদের কারো কোনো অভিযোগ নেই।

শাহাদ রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই বললো,

– ফারাহ্ তৈরি হয়ে নাও, মনিকে দেখতে যাবো। আব্বু আম্মু আপনারা যেতে চাইলে চলুন। শেহজা থাকুক শেফালী আর শিফার কাছে। ততক্ষন শাহীন আর নওরীন তো বাসায় আছেই।

শেফালী বললো,

– জ্বি ভাইজান যান আপনারা আমরা আছি।
__

কেবিনের টিভিতে যখন দেখতে পেলো শাহাদ দেশে তখন থেকে মনি চেঁচামেচি শুরু করেছে শাহাদের জন্য। বাধ্য হয়ে রেদোয়ান সাহেব শাহাদকে ফোন দিলো। পুরো কথা শেষ করতেও পারলেন না, মনি এর আগে চিৎকার শুরু করলো। যদিও তিনি রাতে জানতেন না শাহাদ এসেছে। চিকিৎসার জন্য বাইরে গিয়েছে এটা জানতেন। ওর শরীরের অবস্থাও বেশ ভালোনা বুঝতে পারছেন তাই হয়তো রায়হান সাহেব কিছু জানান নি। মেয়ে যে শাহাদকে অনেক আগেই থেকেই পছন্দ করে তা দুজনই জানতেন। সাহস করে বলেননি ভাইকে কারণ শাহাদ মনিকে বোনের চোখেই দেখে এসেছে এটা সকলের জানা। মনির বেহায়াপনাকে প্রশ্রয় দিলে নিজের মান ইজ্জত খুইয়ে বসতেন। কেবিনের দরজায় টোকা পড়তেই মনি লাফিয়ে উঠলো। বলতে লাগলো,

– দরজা খুলো আমার শাহাদ এসেছে।

মোমেনা ছলছল চোখে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পেলো শাহাদ, দিয়া, সুলতানা কবির এবং রায়হান সাহেব এসেছেন। উনারা ভেতরে ঢুকতেই মনি কেঁদে দিলো। এক হাত দিয়ে শাহাদকে ডেকে বললো,

– শাহাদ ভাই…

জড়িয়ে ধরার জন্য দু হাত মেলে ধরলো মনি। কামরা জুড়ে শশ্মান নিরবতা। মনে হচ্ছে নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাবে। মনি থেকে চোখ ঘুরিয়ে শাহাদ চাচাকে বললো,

– ডাক্তার কি বলেছে?

বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,

– দুদিন পর আবার চেক আপ করবে, ড্রেসিং করতে হবে। কিছুটা শুকালে তখন বাসায় নিতে পারবো।

মনি এবার জোরে বললো,

– শাহাদ ভাই আমাকে ধরো। আর তোমার সাথে এই মেয়েটাকে কেনো এনেছো? বের হয়ে যেতে বলো।

শাহাদ এতক্ষন মনির দিকে তাকায় নি সরাসরি। এখন সরাসরি তাকিয়ে বললো,

– উত্তেজিত হয়োনা মনিকা। তোমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। আর এটা আমার দায়িত্ব পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমার সহধর্মিণীসহ দেখতে যাওয়া।

– ও শাহাদ ভাই তুমি তো জানো আমি তোমাকে কত্ত ভালোবাসি, জানো আমি তোমার জন্য সিঙ্গাপুর যেতে চেয়েছিলাম বাবাকে মিথ্যা বলে ওখানেই আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে কিডন্যাপ করে। তোমাকে ভালোবেসে আমি কি পেলাম।

সকলে চমকে উঠলো। শাহাদ নিজেকে স্থির রাখলো। দিয়া শাহাদের হাত খামছে ধরলো। মনে হচ্ছে সবগুলো নখ বিঁধে যাচ্ছে হাতে। দিয়ার দিকে তাকাতেই মেয়েটার চোখে মুখে ভয়। শাহাদ বরফ শীতল গলায় বললো,

– নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ ব্যাপারটা শয়তানের প্ররোচনায় হয়। তুমি পিতৃসমতুল্য ভাইয়ের দিকে চোখ দেয়াটা অবশ্যই অন্যায়। যা করেছো তার জন্য মাফ চাও আল্লাহর কাছে। তোমার কাজ কিছুই আমার অজানা নয়। তুমি যদি ভেবে থাকো আজ আমার আফসোস হচ্ছে তোমার এই অবস্থার জন্য। আমি বলবো একদম হচ্ছেনা। নিজে যেচে এই পথ বেছে নিয়েছো। শুকরিয়া আদায় করো যে সম্মান বেঁচে আছে। আছে না?

মোমেনা চেঁচিয়ে উঠলো,

– কি বলছো শাহাদ এসব?

– চাচী আস্তে? আপনার মেয়ে ছাড়া হাসপাতালে অনেক রোগী আছে যারা প্রকৃতপক্ষে অসুস্থ আমি চাইনা সিনক্রিয়েট করি। তবে ও সুস্থ হলে জেনে নিবেন ওর অন্যায়ের খাতায় কি কি জমা হয়েছে।

দিয়া হঠাৎ অনলের মত ফুসলে উঠে বললো,

– আজ যদি তুমি বিছানায় না থাকতে যে মুখ দিয়ে বলেছো সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলে ওই জিভ আমি ছি/ড়ে ফে*লতাম। আমি তো এখানে আসতেই চাইনি এমপি সাহেব বলায় এসেছি। তোমার জন্য আমার আফসোস হচ্ছেনা। কেনো হচ্ছেনা সেটা নিশ্চয়ই মনে করাতে হবেনা? সুলতানা মঞ্জিল যে তোমার জন্য নিষিদ্ধ তুমি সেটা জানোনা? কোন সাহসে মুখে বলে আমার স্বামীকে ভালোবাসো।

– ফারাহ্ স্টপ। চাচ্চু আমি আসছি। কিছু লাগলে জানাবেন। আর মেয়ের জন্য কত ফ্যাসাদে সামনে আপনাকে পড়তে হবে দেখেন। সব জায়গায় আপনার আর আমার নাম বেচে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে এসেছে। কাল রাত থেকে আমার বন্ধুর সিকিউরিটি টিম হাসপাতালে ছিলো। ওকে অলরেডি মে*রে ফে*লার হুমকি ও বাতাসে আসছে।

রেদোয়ান আজ স্তব্ধ। রায়হান সাহেব রেদোয়ানকে নিয়ে বের হলো কেবিন থেকে। ভাইকে জানানো প্রয়োজন মেয়ে সম্পর্কে। শাহাদ দিয়াকে নিয়ে বের হয়ে এলো।

___

সব ঝামেলা শেষ। সবাই এখন সুরক্ষিত। ইয়াজ কিছুক্ষন আগে জানিয়েছে খালেদ পারভেজকে বর্ডার থেকে ধরেছে। তবে সে ভয়ে শাহাদের সামনে আসবেনা। তানভীর ও হেড কোয়ার্টারে ঢুকে বসে আছে। বিপদে পড়েছে পাভেল। শাহাদ সকালে ফোন দিয়ে জানিয়েছে ইয়াজকে নিয়ে বাসায় যেতে। ইয়াজ কিছুতেই যাবেনা। শেষ মেষ একাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কপালে আজ দুঃখ। লিমনকে ফোন দিতেই জানালো লিমন সঙ্গে যাবে।

নিজের বাসায় এসে চুপ করে বারান্দায় বসে আছে। তাহির কাছ থেকে টানা অপমানিত হয়েই যাচ্ছে। জবটা ছেড়ে দিয়েছে সেদিনই। ছাড়েনি, ওরাই বলেছে আর না যেতে। রেজাল্ট দিয়েছে স্নাতকের। মোটামুটি একটা রেজাল্ট করেছে। টিউশনিটাও চলে গিয়েছে। মনের মাঝে শান্তি না থাকলে যা হয়, তাই হচ্ছে। নিজেকেই নিজে দুষছে এত বড় ভুল কি করে করলো। তাহিকে ভালোবাসাটা বড্ড অন্যায় হয়েছে। বড় ভাইজান যদি এই প্রশ্ন করে কি উত্তর দিবে? কিছুতেই ভাইজানের মুখোমুখি হওয়া যাবেনা। ভাইজান কিছুক্ষন আগে ফোনে ভার্সিটির একজন স্যারের বায়োডাটা আর ছবি পাঠিয়েছেন। আগামীকাল ওকে নিয়ে ক্যাম্পাসে যাবে। স্যারকে যে তাহির জন্য দেখছে তাও জানিয়েছে। আচ্ছা তাহি কি এই বিয়েতে মত দিবে? এতক্ষন যত রাগ ছিলো সব পানি করে আবার তাহিকে ফোন দিলো। তাহি চেম্বারে পেশেন্ট দেখছিলো। পেশেন্ট চলে যাবার পর ফোন রিসিভ করলো। ধমকেই বললো,

– কি সমস্যা?

– ডাক্তার তাহি একটা কথা জানার ছিলো?

– কি?

– আপনাকে যদি কেউ বিয়ে করতে বলে করবেন?

– বেয়াদপের মত কথা বলছো কেনো?

– জাস্ট জানতে চাইলাম।

– না…

– আরেহ অপেক্ষা করুন কথা শেষ করি। ছেলেটা আমি না ম্যাচিউর কেউ। আপনার সাথে মানাবে এমন।

তাহির মনে হলো এই সুযোগ একে বুঝানোর। সাথে সাথে বললো,

– তাহলে ভেবে দেখতে পারি৷

লিমন চুপ করে আছে। তাহি নিরবতা ভেঙ্গে বললো,

– পাত্র কে?

– ভাইজান দেখছে, আমার ভার্সিটির প্রফেসর।

– ভাইজান যা বলেন তাই হবে।

– আচ্ছা রাখি স্যরি এতদিন ডিস্টার্ব করার জন্য।

– স্যরিটা আরো আগে বলা উচিত ছিলো।

– জ্বি, ভুল হয়েছে আমার। আজকে দিনটা আমার খুব খারাপ গিয়েছে জানেন। আপনার চড় দিয়ে শুরু হলো, আপনার পাত্রের ছবি দেখে শেষ হলো।

– বাহ ভালো তো। আমাকে ও দিও পাত্রের ছবি।

– দিয়েছি হোয়াটসঅ্যাপ চেক করুন। আমি রাখছি। আপনার নাম্বার আমি ব্লক লিস্টেড করবো এখন। যত মজা দুষ্টুমি যাই করি, সত্যি ভালোবেসেছিলাম। দুনিয়ার নিয়ম কানুন মানিনি। রাখছি ভালো থাকবেন।

লাইন কেটে যেতেই তাহির দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হঠাৎ মনে হলো ভাইজানের সাথে দেখা করতে হবে। আগেই তো জানিয়েছে বিয়ে করবেনা। রাশেদের স্মৃতি নিয়ে থাকতে চায়। কেনো কেউ বুঝেনা তাহিকে? সবাই নিজের মতো করে ওর জীবন সাজাতে চায়। বিয়ে করলে যে রাশেদ হারিয়ে যাবে।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩৭.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তিমির নেমেছে। বাতাসে সোদা মাটির গন্ধ। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিলো অপরাহ্নে। বাগানের রজনীগন্ধা, কামিনী সুভাস ছড়িয়েছে। অনেক দিন চুলগুলো ছাটা হয়নি। বার বার কপালের কাছে চলে আসছে বাতাসের ঝাপটায়। সময় পেলো কই। গালের মাঝে খোঁচা দাড়ির আভাস। চেহারায় এতে গাম্ভীর্যের ছাপ আরো প্রগাঢ় হয়েছে। তাতে কি! জৌলুসে এখনো ভাটা পড়েনি। এতেই বোধ হয় পুরুষের আকর্ষণ লুকায়িত। বাড়ির সামনে আঙিনায় কাঠের বেঞ্চিতে নিরবে বসে আছে। এশার সালাত আদায় করে বাড়িতে আসার খবর এখনো উপরে যায়নি তা স্পষ্ট। নতুবা এতক্ষনে মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়তো। পার্থিব জগতের সমস্ত চিন্তা যেন মাথার মাঝে কিলবিল করছে। আকাশের দিকে চোখ জোড়া স্থির। কপালে নরম,মোলায়ের আঙুলের স্পর্শ পেয়ে ঠোঁটের কোনে বিস্তৃত হাসি। অক্ষি জোড়া মুদিত। এই আরামটার প্রয়োজন ছিলো। সকাল থেকে একটার পর একটা ধকল যাচ্ছে।

– আমার ছানাটা কোথায়?

ফারাহ্ ফিক করে হেসে উঠলো। শাহাদ মেয়েকে ছানা ডাকলেই মেয়ে বাবার ইঙ্গিত বুঝে যায়। আরো বেশি আহ্লাদিত হয়ে বাবার কোল ঘেঁষা শুরু করে। মেয়ের বাবার মুখে ছানা শুনেই হাসি পেলো। ঠোঁট চেপে হাসি সংবরণ করে জানালো,

– আপনার ছানা উপরে, দাদী,চাচী এবং ফুফিদের নাস্তানাবুদ করে রেখেছে। বার বার সোফার হাতল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে আর ধপাস করে পড়ছে। হামাগুড়ি দিয়ে এটা, ওটা ছুয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা। আমি বকা দিতে গেলেই আম্মু,আব্বু উলটা আমাকে বকা দিচ্ছে। তাদের একটাই কথা, যা ইচ্ছে ভাঙ্গুক,বকা দেয়া যাবেনা। বকা দেয়া মানে নাকি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বাড়ানো। আপাতত তার পাহারায় তার দুই ফুফু এবং চাচী নিয়োজিত।

শাহাদ হো হো করে হেসে উঠলো। দিয়ার হাত ধরে পেছন থেকে টেনে সামনে এনে পাশে বসালো। ঘাড় কাত করে দিয়ার চোখে চোখ রেখে তার গভীরতা মাপার আপ্রাণ চেষ্টা। ডান হাত রাখলো দিয়ার বাম গালে। বৃদ্ধাঙ্গুল চালাচ্ছে তুলতুলে গালে। মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। হাত সরিয়ে নিলো শাহাদ। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

– আমি এখানে বুঝলে কি করে?

দিয়া হেসে উঠলো। বললো,

– ম্যাজিক।

শাহাদ ও হাসে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে কাঠগোলাপ গাছ থেকে একটা সাদা ফুল,অপরটা লাল তুলে এনে দিয়ার কানের গোঁড়ায় গুঁজে দেয়। হাত এগিয়ে বলে,

– চলো কিছুক্ষন হাঁটি। কোহিনূরকে ও দেখে আসি।

দিয়া মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

__

পাভেল চড় খেয়েছে। ইয়াজকে হাতের সামনে পায়নি। লিমনের চেহারায় ভয়ের ছাপ। ওকে কিছুই করেনি। হাতের মধ্যে প্রফেসরের ছবিসহ বায়োডাটা ধরিয়ে বলেছে এটা যেন তাহিকে দিয়ে আসে। এর চেয়ে ভালো ছিলো দুটো চড়ই না হয় দিতো। পাভেলের চিলেকোঠায় দুজন শান্ত। লিমন হাতের কাগজটা ঘুরিয়ে এপিঠ ওপিঠ দেখলো। পাভেলের হাতে কাগজটা ধরিয়ে বললো,

– ভাই এটা ডাক্তার তাহিকে দিয়ে দিবেন প্লিজ। আমি ওদিকে যাবোনা।

পাভেলের মেজাজ ও চরমে ছিলো। ঝাড়ি দিয়ে বললো,

– হ্যাঁ এবার আমার জানটাও যাক। তোকে যে কাজ দিয়েছে তুই কর। আমার আরো শাস্তি বাকি আছে।

– কিসের?

– আমি ইয়াজের ভাগের থাপ্পড়টা খেয়েছি। নিজের ভাগের টা বাকি আছে এখনো। ওটা যে কত স্পিডে মা*রবে তার ভয়ে আছি।

– আপনি কী অন্যায় করেছেন?

পাভেল নিশ্চুপ। তা যদি বুঝাতো পারতো কি অন্যায় ওর দ্বারা হচ্ছে! হায় অদৃষ্টের পরিহাস! ঘড়িতে দশটা। নিচ থেকে ডাক এসেছে। আফিয়া খালা রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাক দিলো। চেঞ্জ করে তড়িঘড়ি করেই দুজন নেমে আসলো। লিভিং রুমে সবাই বসে আছে। পাভেলের দিকে শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো শিফা। নিচের দিকে তাকিয়েই গ্লাসটা হাতে নিলো। মনের চোখ বলছে শিফা লজ্জা পাচ্ছে। ওর দিকে সবার মাঝখানে তাকানোর স্পর্দ্ধা করেনি।

– শিফা… ভেতরে যাও। দেখো ভাবীমায়েরা কি করছে?

ইমোশনের বারোটা বেজে গেলো! শাহাদের প্রগাঢ় স্বরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকালো পাভেল। শিফা আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত পা ফেললো ডাইনিং এর উদ্দেশ্যে। হাতে গ্লাসটা নিয়ে বসে আছে পাভেল। শাহীন পাভেলের কাঁধে হাত দিতেই চমকে উঠলো। এভাবে চমকাতে দেখে শাহীন বিস্মিত হয়ে বললো,

– কিরে, এমন করলি কেনো?

অকস্মাৎ হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে পাভেলের। নিজেকে শান্ত করতেই মুখে হাসি এনে বললো,

– কিছুনা ঠিক আছি। বের হবি কয়টায়?

– ভোরে।

শাহীন শুকনো ঢোক গিলে শাহাদের দিকে তাকালো। অদ্ভুত! কথা বলছে রায়হান সাহেবের সাথে অথচ চোখ এদের দুজনের দিকে। শাহীন বিড়বিড় করে বলে,

– পাভেল বিশ্বাস কর, ভাইজানকে আমার মারাত্মক ভয় লাগছে। আসার পর থেকেই আমরা চ/ড় থা*প্পড়ের উপর আছি।

পাভেল পেঁচার মতো মুখটা করে রেখেছে। শাহীনকে উঠে দাঁড়াতে দেখায় পাভেল ও উঠে দাঁড়ায়। দেখতে পেলো শাহাদ আর রায়হান সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছে। আফিয়া ডেকে গিয়েছে। খাবার টেবিলে নিরবতা বিরাজমান। শেফালী একসাথে বসিয়ে আবির আর শেহজাকে খাওয়াচ্ছে। শেহজা চারদিকে সব ছড়িয়ে খাচ্ছে। দিয়া ধমকাচ্ছে। শেফালী আর সুলতানা কবির দুজনই শেহজাকে আগলে নিচ্ছে। সুলতানা কবির সরাসরি বললো,

– শুনো বৌমা, আমার নাতনী এভাবেই খাবে। খাওয়া শিখুক। চামচ দিয়ে গুতিয়ে গুতিয়ে এত মর্ডান বানিয়ে খাওয়া শেখানোর প্রয়োজন নেই। গায়ে কাপড়ে মাখিয়ে খাক। এতেই তৃপ্তি। তুমি এর মাঝে এসোনা। আমার সন্তানরা সব গাট্টাগোট্টা হয়েছে। বাবুকে তো ছোট থেকেই নিজ হাতে খাওয়া শিখিয়েছি। দেখছোনা, মাশাল্লাহ কারো নজর যেনো না লাগে। নিজে খেয়ে নাও। শরীর টা তো পাটকাঠি বানাচ্ছো। কিভাবে যে বাবুকে সামলাও বুঝিনা বাপু…

স্বাভাবিক পরিবেশে এমন অস্বাভাবিক কথা বলেই রান্নাঘরে চলে গেলো সুলতানা কবির। দিয়ার দু অধর আলগা হয়ে গেলো শ্বাশুড়ির কথা শুনে। এদিকে যে বাবুর নাকে মুখে খাবার উঠে বিষম খেয়ে গেলো তা বুঝতেই পারেনি। সকলে ছুটে এসে ধরলো মায়ের বাবুকে। শেফালী তো রীতিমতো চেঁচিয়েই উঠলো,

– আম্মু…

সুলতানা কবির ছুটে এসে এমন পরিবেশ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে শাহাদের মাথার তালুতে আলতো আলতো চাপ দিচ্ছে। দোয়া পড়ে ফুঁ দিচ্ছে। মিনিট দশেকের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই ইশারা দিয়ে সবাইকে বুঝালো ঠিক আছে। দিয়ার নজর প্লেটে সীমাবদ্ধ। পুরো পরিবেশটাই যখন শান্ত হলো তখন পুনরায় সুলতানা কবির প্রশ্ন করলো,

– কার বদ নজর লাগছে আল্লাহ জানে। আমার বাবুটা ঠিক মতো খেতে ও পারছেনা। তোরা সবাই একটু করে দোয়া পড়ে এই গ্লাসের পানিতে ফুঁক দিস তো।

শাহাদ এবার অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আম্মু সব ঠিক আছে কিছুই হয়নি। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম তাই খাবার নাকে উঠেছে। আপনি খেতে বসুন।

নওরীন শাহীনের দিকে তাকিয়ে জিভে কামড় দিলো। শাহীন মিটমিট করে হাসছে। চাপা চাপা হাসি টেবিল জুড়ে। একবার চোখ তুলে সকলকে দেখলো শাহাদ। এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়বে ভাবতে পারেনি। খুব তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করে উঠে গেলো টেবিল থেকে। যাওয়ার সময় শাহীনকে বললো,

– রেডি হয়ে যেও। আর দেরী করোনা।

– জ্বি ভাইজান।

__

টুং করে শব্দটা ফোনের মেসেজের শব্দ। তাহি হোয়াটসঅ্যাপ খুলেই দেখলো একটা বায়োডাটা আর কিছু ছবি। সেই প্রফেসরের। মেসেজ গুলো দেখেই ফোন রেখে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষন রেস্ট নিবে। এই কয়েকদিন মনিকে নিয়ে যা একটা ধকল গেলো। কম মানসিক যন্ত্রণা দেয় নি এই মেয়ে। যেদিন থেকে জানতে পেরেছে রাশেদের কেইসের সাথে এই মেয়েও জড়িত সেদিন থেকে মনিকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে আসছে। মানবতার খাতিরে সেবা দিয়েছে প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে ও দিবে তবে স্বজন হিসেবে কখনোই আর পরিচয় দিবেনা। নিজের কু*কর্মের জন্য পা দুটোই হা*রালো। মানুষ যা পাপ করে এই দুনিয়াতেও তার শাস্তি ভোগ করতে হয়। কি মনে করে ফোনটা আবার হাতে নিলো। লক করা এপ্লিকেশন অন করলো। সবচেয়ে পছন্দের ছবি গুলো চোখের সামনে স্ক্রল করছে। ঘোড়া উপর তাহি। ঘোড়ার লাগাম ধরেছে রাশেদ। হানিমুনে গিয়েছিলো কাশ্মীর। রাশেদের চোখে মুখে খুশী। দ্রুত স্ক্রল করতেই আরেকটি ছবি সামনে তাহির জন্মদিনের। পুরো এক হাজার বেলুন দিয়ে সাজিয়েছিলো কক্সবাজারের কোয়ার্টার। নেভির অন্য কমান্ডাররা মজা করে বলেছিলো, কমান্ডার রাশেদ পুরা বউ পাগল হয়ে গিয়েছে।’
তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো শাহাদের সেই ধমক। শাহাদ রাশেদকে ধমকে বলেছিলো,

– ‘অতিরিক্ত করিস কেনো? তুই তোর বউকে ভালোবাসিস এটা দুনিয়াকে না দেখালে হয় না? সবার নজর আর হা হুতাশ লাগবে। আমাদের এখানে অনেক অফিসার সাংসারিক জীবনে সুখে নেই। তাদের দীর্ঘশ্বাস লাগবে। বন্ধ কর এসব। তাহি এমন একটা মেয়ে তুই শো অফ না করলেও খুব ভালো জানে তুই ওকে তোর জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসিস। ‘

ভাইজানের প্রতিটি কথাই হয়তো সত্য ছিলো। হয়তো কারো দীর্ঘশ্বাস ছিলো তার বৈধব্যের কারণ। ভাইজান সবসময় বলতো, ‘সুখ কাউকে দেখাতে নেই, দুঃখ কাউকে বলতে নেই। এতে সুখের মেয়াদ কমে, দুঃখ মাথা চড়া দিয়ে উঠে।’

দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রু আটকাতে ফোন রেখে দিলো। সময় পেরিয়ে গেছে টেরই পায়নি। তৈরি হয়ে নিলো। সুলতানা মঞ্জিলে যেতে হবে। শাহীন চলে যাবে। দেখা করে আসতে হবে। নিচে গাড়ি এসেছে শাহাদের। সাবিনা মেয়েকে ডাকতে এসে দেখলো মেয়ে তৈরি। বেরিয়ে পড়লো মা বেয়ে সুলতানা মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে।

___

কিছুক্ষন আগে করা সহধর্মিণীর প্রশ্নের উত্তর সাজাতে ব্যস্ত। মেয়েটা কেমন উত্তেজিত হয়ে আছে। নারী জাতি মানেই নরম আবার অন্যদিকে যম। এই যেমন এখন তার মাঝে দু রকমের রূপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রথম টা জিজ্ঞাসা দৃষ্টি অন্যটা হারানোর। শাহীনের সাথে বের হবে বলে রেডি হতে চেয়েছিলো। শাহীন যেতে বারণ করলো। বাসার সবাই অমত প্রকাশ করেছে। এই শরীরে এত ধকল নেয়া বারণ। চুপচাপ খাটে বসে আছে। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

– ফারাহ্ এই প্রথম কাউকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এক্সপ্লেইন করতে যাচ্ছি। আমার নার্ভাস লাগছে। এসবে তো অভ্যস্ত নই আমি।

দিয়া তেঁতে উঠলো। রোশানল ঝাড়লো,

– কি এমন প্রশ্ন করেছি? জানতে চেয়েছি এই থাপ্পড় মিশন চাল্লাচ্ছেন কেনো? প্রথমে ভাইয়া, এরপর পাভেল ভাইয়া এরপর কে আল্লাহ জানে। বর্ণনা করুন ঝটপট।

– যদি বলি করবোনা?

চোখদ্বয় সূক্ষ্ম, স্মিত। ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত। কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তর্জনি আঙ্গুল উঠিয়ে শাসালো,

– আমাকে কি ফিডার খাওয়া বাচ্চা মনে হয়? আপনি যে নওরীন আপুর সামনে ভাইয়াকে চড়টা মা*রলেন বুঝলেন কতটা অসম্মানজনক ব্যাপারটা?

– তাহলে ওকে সবাই কিডন্যাপার, রে*পিস্ট তকমা লাগানোটা কি খুব সম্মানজনক হতো?

দিয়া যেন আকাশ থেকে পড়লো। মস্তিস্ক কর্ম সম্পাদনা বন্ধ করেছে। চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে। কি বললো এগুলো। শাহাদ নিজেকে আশ্বস্ত করে দিয়াকে কাছে টেনে এক হাতে আগলে ধরে বুকের মাঝে দিয়ার মাথাটা চেপে ধরলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

– শাহীন,পাভেল,নোমান,লিমন,তানভীর এবং ইয়াজ এরা আমার কাছে সন্তানতুল্য। শাহীন, নোমান, লিমন এবং পাভেলকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেছি। বাকি রইলো তানভীর এবং ইয়াজ। তানভীরকে নেভিতে পেয়েছি আর ইয়াজকে রাজনীতির ময়দানে। যখন থেকে আব্বু রাজনীতি করে। ইয়াজ তখন ছোট। ওর বাবা অপজিশন ছিলো তবে সৎ। তৎকালীন সময়ে ওর বাবার লিডারই উনাকে মে*রে ফেলে। আব্বু আমাকে নিয়ে উনাকে দেখতে গিয়েছিলেন। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে তবে একা, মা ছোট থাকতে মা*রা যান। থাকে দাদীর সাথে। প্রথমদিনই মায়া লেগে যায়। এরপর থেকে ও আমার সাথে আছে সেই অনেক কাহিনি। আর আমার দূর্ভাগ্য এই যে ‘সিক্স স্পাইডার’ মিলে এমন একটা অকাজ করেছে আমাকে বাঁচাতে, তারই ভুক্তভোগী মনি এবং ওরা। আগ বাড়িয়ে বেশি বুঝে করেছে।

দিয়া মাথা উঠিয়ে প্রশ্ন করতে চাইলে শাহাদ মাথাটা আরো চেপে ধরে বলে,

– উহু, শেষ হয়নি। ওদের দলের নাম দিয়েছে ‘ সিক্স স্পাইডার ‘। ভালো কাজই করতো তাই বাধা দিই নি। ইয়াজ, খালেদ পারভেজের বেতনভুক্ত ছিলো। গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টে আইটি এক্সপার্ট হিসেবে আছে।সব ইনফরমেশন পেতাম। এয়ারপোর্ট থেকে মনিকে উঠিয় নিজেদের আস্তানায় রেখেছে। মনি বাঁচতে পালিয়েছে। বেহুশের মধ্যে পালাতে গিয়ে এই এক্সিডেন্ট করেছে। আরো মজার ব্যাপার শুনবে?

– কি?

– খালেদ পারভেজ ক্লেইম করছে মনিকে ওর লোকজন রে*ইপ করেছে। ওর লোকজন হিসেবে নাম দিয়েছে ইয়াজের। জেলে গিয়েও এসব বলছে। অন্যদিকে মনি ইয়াজকে চিনে ফেলেছে। এখন আমার হাতে ইয়াজকে দেশের বাইরে পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। একমাত্র লন্ডন ওকে শেল্টার দিবে। অন্য দেশ দিবেনা। কারণ ও ইন্টারন্যাশনাল অনেক ইনফরমেশন হ্যাক করেছে। সব মিলিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত।

ধীর গলায় বলল,

– ভুল তো করেই ফেলেছে এখন উনাকে বাঁচিয়ে দিন।

– বাঁচাতে তো হবেই। দেখা যাক। আল্লাহ সহায় ।

অকস্মাৎ দিয়া শাহাদকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নাক কুচকে বলে,

– আর ওই সাইকোকে বিয়ের কথা…

শাহাদ মুখ টিপে হাসছে। এই হাসি দেখানো বারণ। তাই আড়ালে তা লুকিয়ে বললো,

– আরেক বিয়ে করার ক্ষমতা কি আমার নেই?

মনি হাসপাতালে সমানে পাগলামি করে যাচ্ছে। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে। হাসপাতালে দুই সু/ই/সা/ইড করার চেষ্টা করেছে। প্রচুর র*ক্তপাত হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শ হলো যা চায় তাই দিতে। মনির বাবা, রায়হান সাহেবের কাছে হাত জোড় করে বলেছে শাহাদ যেন চুক্তিতে হলেও মেয়েকে বিয়ে করে মেয়েটাকে বাঁচায়। একমাত্র মেয়ে ম*রে যাবে। এই কথা শোনা মাত্র রায়হান সাহেব ভাইয়ের সাথে সব রকমের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে। উপায় না পেয়ে কিছুক্ষন আগে শাহাদকে সব জানায়। পাশে ছিলো দিয়া। সবই শুনেছে। যদিও শাহাদ বলেছে চাচার সাথে কিছুক্ষন পর কথা বলবে। এখন শাহীনের সাথে বের হবে। বর্তমান পরিস্থিতি এই দাঁড়ালো।

শাহাদের আরেকটা বিয়ের কথা শুনে দিয়া একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এতক্ষন জ্বলে উঠা মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে বললো,

– আপনি মনিকে অনেক স্নেহ করেন তাই না?

– স্বাভাবিক নয় কি? ছোট থেকে মানুষ করেছি। সব বায়না ছিলো আমার কাছে।

দিয়ার হঠাৎ মনে হলো শাহাদের সাথে ওর সম্পর্ক মাত্র তিনবছরের। এর মাঝেই শাহাদের দেয়া অপমান,কষ্ট সব সহ্য করেও প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। বিয়ে ব্যতিত কোনো র*ক্তের সম্পর্ক নেই শাহাদের সাথে সেখানে মনিতো র*ক্ত। একে অন্যের সংস্পর্শে অনেক বছর, শিশুকাল থেকে। শুকনো ঢোক গিললো দিয়া। বুকের দ্রিম দ্রিম আওয়াজটা মনে হলো কানে বাজছে। হাত কাঁপছে। নিজের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদের দিকে তাকালো। শাহাদ গভীর ভাবে দিয়াকে পর্যবেক্ষন করলো। আচমকা বলে উঠলো দিয়া,

– মনিকে বিয়ে করলে আমার জায়গা কোথায় হবে? এখানে না আগের গেস্ট রুম টাতে?

কাট কাট উত্তর,

– আমার বুকে।

– আর মনি?

– আমি কি জানি? তার ঘরে হয়তো।

– স্ত্রীর শোভার ঘরের ব্যবস্থা করা আপনার দায়িত্ব।

– করলাম তো।

– একজনকে বুকে অন্যজনকে বাইরে?

– একটা বুকে তো একজনেরই জায়গা হবে। এখন যদি বলো বুক ভাড়া করলে পাওয়া যায় তাহলে আমি আরো দুটো ভাড়া করতে চাই। একটা আমার শেহজা ছানার জন্য আরেকটা সেভিংস। ওর ভবিষ্যত ভাইয়ের জন্য। যদিও আমার ছানা আমার প্রাণ, তবে বুকে আগে তার মায়ের স্থান।

– আপনি কি বাংলা বুঝেন না?

– আমার এক্সেন্ট কি ইংলিশ?

– মনি কই যাবে?

– আমি কি জানি?

– আপনার স্ত্রী কোথায় থাকবে সেটা আপনি জানেন না?

– জানি তো বুকে।

– এমপি সাহেব!

চেঁচিয়ে উঠলো দিয়া। হালকা হেসে শাহাদ মুখ চেপে ধরলো দিয়ার। মেয়েটাকে একেবারে রাগিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা হাঁপাচ্ছে। মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়ার অধরে নিজের অধর আলতো স্পর্শ করলো। শাড়ির অতলে নির্মেদ পেট ধরে বললো,

– কমনসেন্সের এত অভাব হলে হয়না ফারাহ্। স্ত্রী তো আমার একজনই। সে আছে ইনশাআল্লাহ সেই থাকবে।এমন সিচুয়েশনে শাহাদ ইমরোজের এংগার থাকে হায়েস্ট স্টেজে, ভয়ে তটস্থ থাকতো ইউনিট। পার্টি অফিসে নেতাকর্মীরা দশহাত দূরে। অথচ আজ?

– কি আজ?

দিয়াকে কাছে টেনে কোলে বসিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে নেশালো গলায় বললো,

– শুষষ…ডোন্ট ডিস্টার্ব।

একদিকে রাগ, অন্যদিকে শাহাদের আবেদন। ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম দেখে দিয়া গাল ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। এক হাতে ছটফট করা দিয়ার মুখ চেপে ধরেছে অন্য হাতে ফোন।

– বলেন চাচাজান..
….

– ভাই বোনকে বিয়ে করার নিয়ম তো ইসলামে নেই…
….

আচ্ছা…হুম…আচ্ছা।
….

কিন্তু চাচাজান মাফ করবেন। আপনার মেয়ে পা হারিয়েছে নিজ কর্মগুণে। তবে আমি যতদুর শুনেছি মেয়েরা মাঝে মাঝে বাপের কুকর্মের শাস্তি ও পায়। এম. সাফায়েত মজুমদারের কথা মনে আছে।ব্লু ডায়মন্ড।
….

– একটু সাবধানে থাকবেন। আরেকটা কথা, মেয়ে সুস্থ না হলে মেন্টাল এজাইলাম আছে আমার পরিচিত। জানাবেন। ধন্যবাদ।

দিয়া মনোযোগ দিয়ে শুনছে কথোপকথন তবে শেষ কথাটাতে খটকা লাগলো। তাহলে এতক্ষন শাহাদ মজা নিলো? কত বড় সাহস। এখন শাহাদ মিটমিটিয়ে হাসছে। শাহাদের হাতের তালু কিছুটা ঢিলে হতেই কামড় বসিয়ে দিলো। হাতে কামড়ের আভাস পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। দিয়া কিছুটা দূরত্বে গিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,

– কে এই এম সাফায়েত মজুমদার?

– আছে একজন। কাছে আসো।

– নাহ।

দিয়া ঝট করে উঠে সামনে হাঁটা দিতেই খপ করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে এমপি সাহেব। কেমন ছটফট করছে চিংড়ি মাছের মতো। এক হাতেই কোমড় ধরে শুন্যে উঠায় প্রিয়তমাকে। বারান্দায় দোলনায় স্ত্রীকে কোলে নিয়ে বসে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে।

রেদোয়ান ফোনে বেশি চেঁচাচ্ছিলো। স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে এম.সাফায়েত মজুমদারের নাম নিলো। যিনি শাহাদের প্রয়াত শ্বশুর, দিয়ার বাবা। দিয়া জানেও না বাবার এই ছদ্মনামের কথা, নিজের নাম এম. সাফায়েত হিসেবে ব্যবহার করতেন। সব অন্যায়ের শেষ আছে। রেদোয়ান সাহেবের ও পাপ মোচনের সময় হয়ে এসেছে।

দুহাতে,চোখে,মুখে আদুরে স্পষ্ট ছুঁয়ে দিলো প্রিয়তমার। গলায় মুখ ডুবিয়ে একটা কথা বললো,

– এতটাও মোলায়েম হওয়া উচিত নয় ম্যাডাম, যাতে করে আপনার হাসবেন্ড আপনাকে সামনে পেলে দুনিয়া ভুলে যায়। তুলতুলে বেড়াল একটা।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩৮.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

মনোযোগ সেই কবে ছুটে গিয়েছে। চাপ নিতে পারছেনা। সকালে সমাবেশ, বিকেলে মিটিং সবশেষ করে এখন নিজের পার্টি অফিসে বসে আছে বাতি নিভিয়ে৷ এমন অদ্ভুদ ক্ষন এর আগে এই অফিসে কেউ দেখেনি৷ সামনে এক লিটারের পানির বোতলের পানি তলানী। গত এক ঘন্টায় পুরোটা শেষ। একটা প্রশ্ন! মাত্র একটা প্রশ্ন।

– এমপি সাহেব মুখে বলেন এতটা ভালোবাসতেন তাহলে কি করে ভুল বুঝে সরিয়ে রাখলেন দুটো বছর? সব অযুহাত কি তুচ্ছ নয়? যেখানে আপনার ভাষ্যমতে বিশ্বাস দৃঢ় ছিলো৷

সরাসরি উঠে দাঁড়ালো। বেলটা প্রেস করলো। ছুটে আসলো সকলে। লাইটের আলো চোখে পড়লো। চোখ কুচকে মিনিট খানেকের মত স্বাভাবিক করে নিলো নিজেকে। গাঢ় স্বরে

– গাড়ি বের করো।

পাভেলকে নিয়ে ছুটছে বাসার দিকে। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে মাথা রাখলো।কপালে হাত। এখন পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট। যে অন্যায় করা হয়েছে মেয়েটার প্রতি এত সহজে কি করে শাহাদকে ক্ষমা করে দিয়েছিলো? আসলে সে ক্ষমাই করেছে, মন থেকে ভুলেনি। আসার পর থেকে প্রতিরাতে একটা করে উদ্ভট প্রশ্ন করে মস্তিষ্কের ফাংশন এলোমেলো করছে৷ নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ভাবলো,

– অসুস্থতার জন্য তখন মায়া করে সব অন্যায়ের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে বুঝি?

অন্তরের অন্তস্থল থেকে দীর্ঘ শ্বাস। চিনচিন ব্যাথা। বুক ধরে চোখ দুটো নিভিয়ে অপেক্ষা করছে এই যাত্রায় অন্তিমের জন্য।
___

ভিডিও কলে গভীর আলোচনায় বসেছে ‘সিক্স স্পাইডার’৷ নোমান এবং শাহীন দেশের বাইরে থেকে কানেক্ট হয়েছে। প্রত্যেকের চেহারা বেলুনের মত চুপসে আছে। লিমন মুখ খুললো,

– তোমরা এরম মুখটা ভোঁতার মত করে রেখেছো কেনো?

ইয়াজ এখন কোথায় ঘাপটি মে*রে আছে কেউ জানেনা। শাহাদ আল্টিমেটাম দিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি দেখা করতে। নাহলে পিঠের ছাল উঠাবে। লিমন ওদের দলে যুক্ত হয়ে দু বছর। সবচেয়ে ছোট সদস্য। এই দলের প্রত্যেকের কিছু স্পেশাল হিডেন টেলেন্ট রয়েছে। শাহীন খুব সহজে মানুষকে হিপনোটাইজ করে ফেলতে পারে, পাভেলের মা*রা*মা*রির স্কিল দূর্দান্ত, নোমানের পলিটিক্যাল থেকে শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল লিংক অনেক স্ট্রং, ইয়াজ হ্যাকার, তানভীর স্কেচ খুব ভালো করতে পারে এবং যেকোনো রহস্যের সমাধান খুব দ্রুত করতে পারে সর্বশেষ লিমন। যাকে দিয়ে ছদ্মবেশে সব কাজ করানো যায়। সবচেয়ে বেশি ইনফরমেশন এনেছে এমপি মন্ত্রীদের মেয়ে,বোনদের কাছ থেকে। মেয়েদের খুব ভালো ম্যানেজ করতে পারে। হঠাৎ ইয়াজ চেঁচিয়ে উঠে,

– ওহ মাই অলমাইটি, আই এম প্রেডিক্টিং উই আর ইন ডেঞ্জার।

সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,

– কিহ?

ইয়াজ পুনরায় উত্তর করলো,

– শেষ ভাই,সব শেষ ‘অক্টোপাস’ জেগে উঠবে। তখন আমাদের আটচল্লিশটা পা এমন ভাবে তার এক পা দিয়ে ধরে সারা অঙ্গে বিষ ঢেলে দিবে।

শাহীন ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে,

– উলটা পালটা কথা কম বল। ‘অক্টোপাস’ জাগার মত কিছুই হয়নাই। আপাতত গা ঢাকা দেয়। ভাইজান তোরে কুচি কুচি করবে।

– টিকিট কে*টেছি। আপাতত মিশর থাকব কিছুদিন।

লিমন উঠসাহী হয়ে বললো,

– আচ্ছা এই ‘অক্টোপাস’ কী? আরো দশ বছর আগে শুনেছিলাম একবার। খবরে দেখিয়েছিলো।

পাভেল প্রসঙ্গে বদলে বললো,

– যে যেখানেই থাকো সেফ থাকো। আপাতত আমরা ‘ সিক্স স্পাইডার’ এর কথা ভুলে যাই। বস অনেক ক্ষেপে আছে। ‘অক্টোপাসের’ নাম মুখেও আইনো না। এই জিনিস দশ বছর আগেই ভ্যানিশ হয়েছে। নতুন ‘অক্টোপাস’ কোথা থেকে আসবে। ইয়াজ তোর কাছে এসব ফাউল নিউজ কে দেয়? নোমান তো কিছু বললিনা?

নোমান ভাবুক হয়ে বললো,

– আরেহ আমি নিজেই তো জানিনা। ও কিভাবে জানে?

ইয়াজ জানালো,

– গতকাল রাতে একটা মেইল এসেছে আমার মেইলে। লিখা ছিলো, Be carefull . Send me all the information of ‘OCTOPUS’. ইভেন মেইলটা করেছে একটা সাইট থেকে যার নাম ‘OCTOPUS’ । অনেক ট্রাই করেছি ইনফো কালেক্ট করার কিন্তু পারিনি।

শাহীন খেঁকিয়ে উঠলো,

– হ; অক্টোপাস নিজের ইনফরমেশন জানেনা, তোর কাছ থেকে নিবে।

লিমন পুনরায় বললো,

– আগে তো বলবা কি জিনিস? পরে বিবরণ কইরো তোমরা।

তানভীর এতক্ষনে মুখ খুলে বলে,

– অক্টোপাসের ফুল ফর্ম হচ্ছে Optimistic Candescent Transformation of Oppressive Politics and Unethical Service. এটা একটা…

পাভেল পুনরায় থামিয়ে বলে,

– নো তানভীর স্টপ। ইয়াজ তোর থেকেও বড় হ্যাকার -ট্র্যাকার যে এক্সিস্ট করে জানিস? আমার কেনো যেন মনে হচ্ছে আমাদের কল ট্র্যাক হচ্ছে।

বলার দেরি ইন্সট্যান্ট সকলে কল কাট করে দিয়েছে। ইয়াজের ওয়েবসাইট থেকে সকলের ফোনে মেসেজ এসেছে পাঁচ মিনিট পর,

– Yes, we are tracked. Even I can’t track the miscreant website.

নোমান মেসেজ দিলো,

– বন্ধ কর আপাতত সব। বস কি বলে শুন। যদি এসব জানতে পারে কাঁচা চিবিয়ে ফেলবে।

সকলের মেসেজ আসলো একসাথে,

– আই আই চিফ।

___

অতিথি আয়োজন চলছে। বাড়িতে একত্রিত হয়েছে সকলে। অনুপস্থিত শুধু রেদোয়ান ও তার পরিবার। মঞ্জিলা রান্নাঘরে ভাবীর সাথে কথা বলছে। যা যা হয়েছে সব জেনে নিচ্ছে। রেদোয়ানের ব্যবহারে সে খুবই মর্মাহত। মনিতো খুব আদরের ছিলো। মেয়েটা হঠাৎ এমন পাগলামি বংশের কারোই পছন্দ হচ্ছেনা।

সাথে যোগ দিয়েছে সাবিনা, ইফফাত, তাইবা। সবার আফসোসের সীমা নেই। সুলতানা প্রসঙ্গে পালটে জা বোনদের বললো,

– থাক বাদ দাও এসব। আজ আমাদের শুভদিন। সাবিনা দেখতো তাহিকে রেডি করিয়েছে কিনা ওরা। ছেলে পক্ষ এসে পড়লো বলে।

মঞ্জিলা এগিয়ে এসে বললো,

– ভাবী বুঝতেছিনা বাবু কাজটা কি ঠিক করছে?

সাবিনা আক্ষেপ নিয়ে বললো,

– আমার মেয়েটার কপাল এত খারাপ কেনো? ও বিয়েটা যদিও করে শুধুমাত্র বাবুর কথা রাখতে করবে। কাল সারা রাত কেঁদেছে।

পেছন থেকে দিয়া এসে বললো,

– খালামনি এভাবে থাকলে তো নিজে নিজেই শেষ হয়ে যাবে।

– ওর ভয় যদি বর্তমান স্বামী রাশেদকে মুছে দেয়? রাশেদের মতো কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা। সংসার ও কর‍তে পারবেনা। তখন বাবু অপমানিত হবে। অন্যদিকে একটা অবিবাহিত ছেলে বিধবা মেয়ে বিয়ে করছে তার এক্সপেকটেশন ও তো অনেক বেশি থাকবে তাই না।

সকলে সম্মতিতে মাথা নাড়ায়।

কিছুক্ষন হলো ছেলেরা চলে গিয়েছে। এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে এই বাড়িতে। রায়হান সাহেব অত্যন্ত রেগে আছেন। এ যাবৎকালে উনাকে এতটা রাগতে ঘরের ছোটরা দেখে নি। শাহাদ কেমন নিশ্চুপ। রায়হান সাহেব শাহাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

– কিছু বলছোনা কেনো শাহাদ? তখন ও দেখলাম তুমি চুপ করে ছিলে।

অন্যমনস্ক শাহাদ সম্বিত ফিরে বললো,

– কি বলা উচিত এমন পরিবেশে?

– কি বলা উচিত মানে? এক মেয়েকে দেখতে এসে অন্য মেয়েকে পছন্দ করা কোন ধরনের অভদ্রতা। এটা তো আমি মেনে নিতে পারছিনা। তাহিকে ফেলে বিবাহিত এক বাচ্চার মা কিভাবে ওদের পছন্দ হয়।

শাহাদ মাথা নিচু করে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আজ চাপ বেশি হয়ে যাচ্ছে। লাইফটা এত তিক্ততায় ভরে যাচ্ছে কেনো? সবদিকেই ঝামেলা। অফিসে ঝামেলা,বাসায় ঝামেলা। ঘাড় তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

– আচ্ছা আমি দেখছি কি করা যায়।

শাহাদকে এমন এর আগে কেউ দেখেনি। এতটা তৎপর একটা ছেলে হঠাৎ চুপ করে আছে কেনো? শরীর খারাপ ওর। তবে আজকের ব্যাপারটা খুব অপমানের। তাহি রুমের দরজা দিয়েছে। শেফালী লজ্জায় নিজের রুমে বসে আছে। ছেলে পক্ষ থেকে তাহিকে পছন্দ হলেও ছেলে শেফালীকে চেয়ে বসে আছে,ব্যাপারটা খুবই অপ্রিয়। ছেলেকে রায়হান সাহেব সকলের সামনেই বুঝিয়ে বলেছে শেফালী ডিভোর্সি। বাকিটুকু বলার আগেই ছেলে জানিয়েছে সে সবটা জানে শেফালী সম্পর্কে। তার আসার কারণ ও শেফালী ছিলো। বুঝতে পারেনি পরিবারের লোকজন শাহাদের বোন বলতে তাহিকে বুঝিয়েছে। হাসবেন্ড নেই বলতে সে শেফালীকে বুঝেছে অন্যদিকে তার পরিবারের লোকজন তাহিকে ভেবে নিয়েছে। তা নিয়ে চলছে দ্বন্দ্ব। শেফালী খুবই বিচলিত। তাহি আপার জায়গায় ওকে ছেলে পছন্দ করাতে আজ বড্ড রাগ হচ্ছে। রূপের দিক থেকে দুজনই পাল্লা দেয়ার মত। উলটা শেফালীর ছেলে আছে তা বুঝার সাধ্য নেই।

শাহাদের নিরবতা সকলকে গ্রাস করেছে। উঠে দাঁড়ায়। সকলকে বলে,

– আমার শরীর টা ভালো লাগছেনা। একটু রুমে যাই। ফারাহ্ রুমে আসবে, কথা ছিলো।

তটস্থ পায়ে হেঁটে চলে গেলো। বেডে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখেছে। দিয়ার পায়ের আওয়াজ শুনে আস্তে বললো,

– দরজা আটকে লাইট নিভিয়ে দাও। কাছে এসে বসো।

কথা অনুযায়ী কাজ করে পাশে এসে বসলো দিয়া। শাহাদ শান্ত গলায় বললো,

– আজ সবাই বিধ্বস্ত শাহাদকে দেখেছে তাই না?

দিয়া চুপ। শাহাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

– একটা প্রশ্ন সবটুকু এলোমেলো করে রেখেছে আমার। দু বছর কেনো দূরে সরিয়ে রেখেছি যদি এত ভালোবাসি, তাই না?

কামরা জুড়ে পিন পতন নিরবতা। মিনিট দশেক পেরোলো। শব্দ আসলো শাহাদের মুখ থেকে,

– আমি জানিনা… আমি সত্যি জানিনা।

কিছুটা থেমে,

– ফারাহ্…আমি ফল্টলেস নই। আমার বিশ্বাসে খুঁত ছিলো ফারাহ্। আমি তোমার মতো নিখুঁত নই। আমি তোমার দয়ায় পাওয়া ক্ষমা নিয়ে বেঁচে আছি এই কথা প্রতিটি মুহুর্তে শেষ করে দিচ্ছে ভেতরটাকে। মন থেকে ক্ষমা পাই নি আমি। ঠিকই তো, কেনো পাবো? আশা করি কি করে?

– কিছু ভুলের সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করতে হয়। সেসব ভুলকে শাস্তি দিতে গেলে জীবনের বাকি সুখটুকু ও হারিয়ে যাবে।

অন্ধকারেও স্পষ্ট দিয়ার মুখ। বাইরে থেকে পোর্চের আলোর আবছা রুমে এসে পড়েছে। সেই আলোতে সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে। বুঝতে পারছেনা কি বলবে, কি উপায়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করবে। এটাও মেনে নিতে পারছেনা, তার সহধর্মিণী তার প্রতি দয়া দেখিয়েছে। অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ায়। সরাসরি বাতি জ্বালিয়ে বললো,

– ফারাহ্, আমি কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাবো। তুমি, শেহজা কাছে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো। পাগলামী আচরণ গুলো এর আগেও কেউ দেখেনি এখনও কেউ না দেখুক।

– এটা সল্যুশন?

– উপায় আছে আর?

– নেই বুঝি?

শাহাদ সরাসরি দিয়ার পায়ের কাছে বসে হাঁটু জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রেখে বললো,

– বলে দাও। নিতে পারছি না আর।

– প্রশ্নের উত্তর দিন। তবেই বলে দিব।

জবাবটা আসলো ধীরে,

– অবিশ্বাস করেছিলাম। হালকা হলেও করেছিলাম। স্বীকার করলাম। নোমানকে তো বিশ্বাস করতাম আমি। ও মিথ্যা বলবে বুঝিনি। শেফালী তো আমার বোন। তোমাকে ফাঁসাবে বুঝিনি। যখন জানলাম আমার শেহজা তোমার গর্ভে। তুমি তাকে নিজের সবকিছু দিয়ে আগলে রাখছো। একটু করে রাগ কমতে থাকলো। পুরো ঘটনা বের করার চেষ্টা করলাম। অনেকটুকু বের করে ফেললেও মেনে নিতে পারছিলাম না তুমি নির্দোষ।আমিও তো মানুষ। ভুল করেছিলাম। শেহজা যেদিন পৃথিবীতে এলো। আমার পুরো পৃথিবী বদলে গেলো। এরপর থেকে নোমানকে খুঁজছিলাম। বাকি সব তুমি জানো।

পুনরায় বললো,

– স্যরি, মন থেকে মাফ করে দাও না। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। বাইরে কেমন আচরণ করলাম দেখলে তো। একই কাজ আজ অফিসে করেছি, মিটিংয়ে করেছি।

– ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খাবার বাড়ছি।

তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায়, গর্জে উঠলো,

– আহ্লাদ দেখাবেনা। আমি বলেছি আমি খাবো?

– তো কি করবেন?

আচমকা টেবিলের পাশে ফুলদানি আছাড় দিলো। আশপাশে যা পারছে সব ভাঙছে। দিয়া ভয়ে আঁৎকে উঠলো। একি রূপ শাহাদের। এত সেন্সিবল একজন মানুষকে এত বছরেও এমন রূপে দেখেনি।

– কি করছেন আপনি এসব? হাতে লাগবে।

– লাগুক, যা খুশি হোক। সব ভেঙ্গে ফেলবো। কিছুই রাখবো না। আমি ভেঙ্গে যাচ্ছি। সবাই কেনো ভালো থাকবে। সব কেনো ঠিক থাকবে? আমার জীবনে অগোছালো হয়ে আছে, সব ধ্বংস করে ফেলবো।

শাহাদের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেয়ালে। বাইরে থেকে দরজা ধাক্কার আওয়াজ। পুনরায় চেঁচিয়ে উঠলো,

– খবরদার দরজা খুলবে না।

– পাগলের মত আচরণ করছেন কেনো?

হাত চুয়ে র*ক্ত পড়ছে। কিভাবে কে*টেছে জানেনা। কিছু ভাঙার সময় হয়তো হাতে লেগেছে। চোখ দুটো দেখতে আজ ভয়ানক লাগছে দিয়ার। শাহাদ প্রগাঢ় স্বরে বললো,

– সবকিছুতেই শাহাদকে সেন্সিবল থাকতে হবে, সবকিছুতে শাহাদ এগিয়ে আসতে হবে, অথচ শাহাদের যে শান্তির প্রয়োজন কেউ তো বুঝলোনা। দায়িত্বটা কেনো আমার হতে হবে সবসময়?

আবার আছাড় দিলো নিজের প্রিয় পারফিউম। দরজার লক খুলে ফেলেছে সুলতানা কবির। রুমের অবস্থা থেকে সবাই হতবাক। দিয়ার চোখে পানি। মেয়েটা ভয় পেয়েছে। শিফার কোলে শেহজা। শেহজা বাবার এই রূপ দেখে কেঁদে দিলো। ঘুম থেকে উঠার পর বাবাকে সকালের পর আর দেখেনি,মাত্র দেখলো। দু হাত বাড়িয়ে কাঁদছে কোলে নিতে। শাহাদ পুনরায় চিৎকার দিলো,

– ওকে এখানে কেনো এনেছিস?

শিফা ভয়ে শেহজাকে নিয়ে বের হবে এমন সময় মেয়েটা আরো জোরে কাঁদছে। শিফার কোল থেকে নেমে যাচ্ছে। বাবা বাবা করছে। জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে সংযত করছে। একটানে আলমারি খুলে ড্রয়ার থেকে একটা রুমাল বের করে হাতে পেঁচিয়ে নিলো। সেই ভাঙা টুকরো গুলো মাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে সকলের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে বলতে থাকলো,

– আম্মা আপনি ছাড়া কেউ বুঝেনা বাবাকে, কেউ না।

চলবে।

(নোট: নতুন কিছুর গন্ধ পাচ্ছেন?)