সায়রে গর্জন পর্ব-৫২+৫৩

0
6

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৫২.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

কন্যা বিদায় কোনো পরিবারের নিকট সুখকর নয়। তবে কন্যার যদি পিতা না থাকে তবে সেই কন্যার জীবনে কি দুঃখের অভাব আছে? নেই তো! সবাই যখন অনুরোধ করেছিলো আজ রাত তাহিকে বিদায় না দিতে, অন্যদিকে লিমন তো এই বাড়ির ছেলে তাহিকে বিদায় দিতে হবে কেনো বলেছিলো মঞ্জিলা। সকলের চোখে স্পষ্ট তাহির কষ্ট সেখানে বাঁধ সাধলো শাহাদ। ঠিক রাত এগারোটায় প্রোগ্রাম বন্ধ করে দিয়ে ঘোষনা দিলো তাহির বিদায়ের জন্য প্রস্তুত হতে সকলকে। সুলতানা বেগম মনোকষ্ট নিয়ে ছেলেকে বুঝাতে চাইলেন,

– বাবু মেয়েটা সামলাতে পারবেনা নিজেকে। আমরা কাল সকালে পাঠাই?

নাছোড়বান্দা এমপি সকলকে বুঝিয়ে দিলো এই বলে,

– কাল সকালে কি মন খারাপ কম হবে নাকি লিমন ওকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাবে? যদি কেউ আমাকে গ্যারান্টি দেয় রাতারাতি ম্যাজিক করে ওর মন ভালো করে দিবে তবে কাল কেনো পরশু গেলেও আমি বাঁধ সাধবো না।

বাইরের অতিথি বিদায় নিয়েছে। পরিবারের সকলের নাথা নত। লিমন হঠাৎ করে সাহস করে বলে উঠলো,

– ভাইজান, আমার মনে হয় আমাদের উঠা উচিত। এগারোটা তো বাজে অলরেডি।

– ভেরি গুড। আমি আসছি জাস্ট ফাইভ মিনিটস।

বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– আমি যাচ্ছি ওদের রেখে আসতে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। শ্বশুর বাড়ি যেমনই হোক, ওটা শ্বশুর বাড়ি। লিমন বা চাচী আম্মু এখানে স্থায়ী ভাবে থাকেনা যে সবাই মিলে এই বাড়িকে শ্বশুর বাড়ি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।

বোনঝির দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় সুলতানা বললো,

– আম্মু, রাগ করিস না আমাদের উপর। আমরা যা করি তোর ভালোর জন্য। হয়তো তোর মনে হতে পারে খালামনি খারাপ, ভাইজান খারাপ কিন্তু আমরা তোর অমঙ্গল চাই না মা।

তাহি ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। আবেগ-অনুভূতি আজ ছুঁতে পারছেনা এই মেয়েকে। সাবিনা মেয়ের জামাইর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছে এগিয়ে এসে হাত ধরলো। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো সাদা সুতার কাজের পাঞ্জাবিতে ছেলেটাকে বেশ মানিয়েছে। বিয়ে বলে নিজেও কোনো জাঁকজমকপূর্ণ কোনো ভাব-ভঙ্গি করেনি । সাবলীল সাজ। দুজনকে একসাথে বেশ লাগছে। মনেই হচ্ছে না মেয়েটা বড়। মেয়ের জীবনে সুখ আশা করাটা বোকামী তবে আল্লাহ চাইলেই মেয়ে ফিরে আসতে পারে নতুন জীবনে। তাই মন থেকে দোয়া করে লিমনকে বললো,

– বাবা আমার মেয়েটার যত্ন নিও। যদি কখনো মনে হয় তোমাকে অশ্রদ্ধা করেছে,অসম্মান করেছে আমাকে জানিও আমি নিয়ে আসবো। ও ছাড়া যে আমি নিঃস্ব।

লিমন শ্বাশুড়ি দুহাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বলে,

– খালামনি, আপনার মেয়ে আমার কাছে আমানত। যে মানুষটার ছায়াতলে উনি শৈশব,কৈশোর কাটিয়েছেন আমিও একই মানুষটার আদর্শে বড় হয়েছি। তিনি বড় ভাইজানের ভালোবাসার স্নেহের একজন, রাশেদ ভাইয়ের মত অসাধারণ ব্যক্তির সহধর্মিণী হওয়ার জন্য যোগ্যতা লাগে। সেখানে ডাক্তার তাহি তো রাশেদ ভাইয়ের প্রাণ ছিলেন। আমি তো তুচ্ছ। বরং যদি কখনো আমার দ্বারা কোনো ভু ল চুক হয় অগ্রিম মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আর যাই করুক উনাকে বলবেন যেন আমাকে ছেড়ে না যায়। প্রয়োজনে ঝগড়া করবে,কথা না বলবে, আমাকে রান্না না করিয়ে একবেলা উপোস রাখবে এতে আমার আপত্তি নেই। তবুও যেন ছেড়ে না যায়। আমি আপনার সম্পদের হেফাজত করবো ইনশাআল্লাহ। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।

কেনো আজ চারদিকে এত মুগ্ধতা। প্রতিটি কথাই কর্ণকুহুরে বেজে উঠেছে দুজন মানুষের। রাশেদের প্রিয় বন্ধু ও তার প্রিয়তমার। বন্ধুর ভেতরটা সুখে আন্দোলিত হলো এই ভেবে যে তার শিক্ষায় ঘাটতি হয়নি। অথচ প্রিয়তমার হুঁশ নেই।

শাহাদ গাড়ির চাবি হাতে রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় কানে এসেছে প্রতিটি বাক্য। সুলতানা কবির শাহাদকে দেখে বললেন,

– বাবু শিফাকে দিই তাহির সাথে?

ছেলের বুদ্ধি মাপতে এখনো অক্ষম সুলতানা কবির। বাবু ততক্ষণে প্রতিউত্তর করলো,

– ওরা ইতিমধ্যে সবাই ওই বাসায় আছে। আজ রাত থাকবে। আমি ফিরে আসবো আপনাদের বৌমাকে নিয়ে।

সুলতানা বেগম চমকে বললো,

– কখন গেলো ওরা?

– আধ ঘন্টা আগে সবাইকে কাব্য, নিশাদ এবং মেজরের সাথে পাঠিয়েছি।

বাকিরাও বিস্মিত। শাহাদ লিমন, তাহিকে তাড়া দিয়ে বললো,

– লিমন- তাহি আগাও। চাচী আম্মু চলুন বউ বরন করবেন।

সবাই আগালে শাহাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আম্মু মনে যদি এমন কিছু উঠানামা করে তবে এখানেই থামুন। কাল মেয়ে পক্ষ হয়ে যাবেন। আজ রাতে আপনার বউ বরনের প্রয়োজন নেই। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে শরীরের উপর। চাচী আম্মুকে যেতে হবে বলেই যেতে দিচ্ছি। আর নিরাপত্তার জন্য আমি স্বয়ং ওদের নিয়ে যাব এবং আমার গাড়ি বহর সাথে থাকছে। এখানে পাভেল, হামজা এবং তুহিনকে রেখে যাচ্ছি।

রায়হান সাহেব তাড়া দিয়ে বললেন,

– ঠিক আছে যাও। দেরী করোনা। অনেক রাত হলো।

রওয়ানা হলো শাহাদের ব্যক্তিগত রেঞ্জ রোভার। নিঃশব্দ পরিবেশ। যতবার ওদের দিকে তাকিয়েছে ততবার লিমনের জায়গায় রাশেদকে ভেসে উঠছে।

– ভাইজান একটু গাড়িটা পাশ করে রাখবেন। ডাক্তার তাহির খারাপ লাগছে। বমি করবে।

শাহাদ পাশ করে গাড়ি পার্ক করলো। কিছুটা চমকিত। তাহির কি শরীর বেশি খারাপ! সাধারণত জার্নিতে তো এই মেয়ের বমি হওয়ার কথা নয়। ডোর খুলে বের হয়ে বোনের ডোর খুললো। তাহিকে ধরে নামালো। শাহাদ ছেড়ে দিলো দায়িত্ব লিমনের উপর। দূর থেকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো। একটু আড়াল হতেই গলগল করে ছেড়ে দিলো। লিমন তাহিকে আগলে ধরলো। রত্না পানির বোতল নিয়ে বের হয়ে ছেলের বউকে পানি খাইয়ে মুখ ধুইয়ে দিলো। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে সামান্য দূরত্বে অবস্থান ভাইজানের। টিস্যু দিয়ে তাহির মুখ মুছে দিলো লিমন। একবারের জন্য মনে হচ্ছেনা এদের মাঝে বয়সের ফারাক। লিমনকে পরিণত লাগছে। পেছনে শাহাদের নিরাপত্তা গাড়ি বহর। ধীর পায়ে তাহিকে নিয়ে এগিয়ে এলো লিমন। কাট কাট প্রশ্ন শাহাদের,

– কিছু খাস নি কেনো দুপুর থেকে?

আনত মাথা তাহির। ভাইজান ধরে ফেলেছে। লিমন চমকে গিয়ে তাহির দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবছে সংগ্রাম তো সবে শুরু, এখন থেকেই সামলে নিতে হবে এই রমনীকে। জেনে বুঝে কুয়ায় ঝাঁপ দিয়েছে, ডুবে ডুবে জল খেতেই হবে। অন্যদিকে সাঁতার জেনেও সাতরাতে পারছেনা কারণ কুয়ার গভীরতা অপরিমেয়। দম ফেলে শাহাদকে বললো,

– ভাইজান বাসায় যেয়ে খেয়ে নিবে। সন্ধ্যায় আমাকে বলেছিলো মাথা ব্যাথা করছে।

তাহি স্বামীর দিকে তাকাতেই লিমন চোখ ঝাপটে আশ্বস্ত করলো। একবার লিমনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো শাহাদ। রত্না তাহিকে আগলে পেছনে বসলো এবার। লিমন সামনে বসলো। ব্যাগ থেকে একটা কেক বের করে তাহিকে খাইয়ে দিচ্ছে। সুলতানা কবির আসার সময় জোর করে কিছু কেক,বিস্কুট দিয়েছিলো। গাড়িতে রত্নার শরীর খারাপ লাগে যদি, শরীরের উপর ধকল নিতে পারেনা বেশি। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে তাহির। পুনরায় শাহাদের ধমক,

– তাহি কাঁদার তো কিছু দেখছিনা আমি। কাঁদলে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিব।

লিমন শাহাদের দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরলো। শাহাদের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। কথার মাঝে প্রাণ নেই। লিমনের মনে হলো ভাইজান খুশি নয় এই বিয়েতে। যত যাই বলছে আজ সারাদিন শাহাদের আচরণ পরিলক্ষিত ছিলো। যতক্ষন আম্মা ছিলো ততক্ষন হাসিখুশি ছিলো। পকেটের ফোনটা কেঁপে উঠলো। লিমন ফোন বের করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ‘Amma’।

– আসসালামু আলাইকুম আম্মা।

– আব্বা ভালো আছেন?

– জ্বি আম্মা। আপনি পৌঁছাতে পেরেছেন?

– জ্বি আব্বা সুস্থ মত এসেছি। আমার বৌমা কেমন আছে?

– ভালো তবে কাঁদছে।

– দেন উনাকে।

মনোযোগ দিয়ে পেশীবহুল হাতে দক্ষতার সাথে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত শাহাদ। শার্টের উপর মাসল গুলো ফুলে ফুলে উঠছে। লিমন পেছন ফিরে তাহির দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলো। কানে ফোন লাগাতেই শুনতে পেলো প্রিয় মানুষটার স্বর। রত্নার চোখ লেগে এসেছে। তাহি ধীরে ধীরে কথা বলছে। খুব সাদা মাটা প্রোগ্রামে আজ আকর্ষণ ছিলো মেহেরজান আম্মা। আজ এসেছিলো লে.কমান্ডার রাশেদের মা হয়ে। সুন্দর সাবলীল মার্জিত জামদানী শাড়িতে সকলের নজর কেড়েছিলো মেহেরজান আম্মা ওরফে মেহনাজ পাঠান। শাহাদ লিমন এক যোগে পরিচয় করিয়েছিলো রাশেদের মা হিসেবে। আড্ডা জমেছিলো সকলের সাথে। লিমনকে বুকে টেনে সকলের সামনে বলেছিলো,

– তাহিকে আমি কখনো মেয়ে বলবোনা। ও সর্বদাই আমার পুত্রবধূ। আমার রাশেদ না থাকুক, লিমন তো আছে। তাহির কাজ লিমনের ঘরনী হয়ে ওঠা। তাহি অবশ্যই ভাগ্যবতী নারী যে আমার দুই রত্নের সহধর্মিণী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

সকলে দেখেছে রাশেদের মায়ের তেজ। গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ এই নারী। মার্জিত শব্দ। কেউ জানেনা তার অতীত, জানতে চায়নি কোথায় ছিলো এতটা দিন। শুধু এতটুকুই জেনেছে দেশ রত্ন অকুতোভয় বুদ্ধিদীপ্ত তারকা নেভীর লে. কমান্ডার রাশেদ আবেদীনের মা মেহনাজ পাঠান। যার চোখে ছেলে হারানোর বেদনা থাকার কথা অথচ পরিবর্তে তার চোখে ছিলো ছেলের বউকে পুনরায় বিয়ে দেয়ার আনন্দ। লিমনকে ছেলে হিসেবে সকলের সামনে বুকে টেনে নিয়েছিলো। কেউ না জানুক মেহনাজ পাঠান জানেন লিমনের রহস্য। সিক্স স্পাইডারের প্রতিটি সদস্যকে চেনেন। তাদের সাহায্যই যে ফরিদকে ডুবাতে কাজে লেগেছিলো সে কথা পৃথিবীলোকের মানুষ গুলোর অগোচরেই থাকবে। একেকটা তথ্য নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার করে এনেছে এই লিমন। লিমনের মাঝে খুঁজে পায় অদম্য সাহসের অধিকারী রাশেদকে। তাই হয়তো সময় অসময়ে মাঝে মাঝেই ছেলেটাকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। মেহনাজ পাঠানের সংসার,সন্তান সব ধ্বংস হলো ফরিদের লোভের শিকার হয়ে। এভাবে অনেক নারী হারাচ্ছে তাদের সম্ভ্রম। মেহনাজ ছিলো একা। তাই তাহি একা থাকুক এই ব্যাপারটা মেহনাজ মেনে নিতে পারবেনা কখনো। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। তাহিকে রাজি করিয়ে ফেলেছে বিয়েতে।

___

মাঝরাতে ঘুম ভেঙেছে। অবশ্য ঘড়িতে এখন ভোর চারটা। আজান দিবে আরো কিছুক্ষন পর। পিট পিট নেত্রে তাকিয়ে দেখে এমপি সাহেব কি যেন লিখছে। ল্যাম্পশেডের হলদে ক্ষীন আলোটা আবছায়া সৃষ্টি করেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে শাহাদ-দিয়ার প্রায় একটা বেজেছে। ফ্রেশ হয়ে শেহজাকে খাইয়ে শুতে শুতে প্রায় দুটো। মানুষটার নিশাচরী স্বভাবটা গেলোনা। উঠে বসে দিয়া ডাক দিলো,

– শেহজার বাবা! কি করছেন?

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রখরতায় খাট নড়েচড়ে উঠার আওয়াজটা কানে লাগে। তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় প্রেয়সীর পানে। কিঞ্চিৎ হেসে বললো,

– জরুরি কাজটা সেরে নিলাম। নতুবা এমন উষ্ণ পরিবেশ, আদুরে বউ ছেড়ে এখানে বসে লিখার সাধ্য ছিলোনা। তুমি উঠে গেলে যে?

ঘুমো ঘুমো চোখে দিয়া হেসে বললো,

– একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে হুট করে ঘুম ভেঙে গেলো।

সম্ভবত মানুষটা তার প্রিয় আইকনের ডায়েরিতে কিছু লিখছিলো। সযতনে ডায়েরিটা বন্ধ করে টেবিলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ড্রয়ার খুলে সেখানে রেখে লক করে দিলো। অন্যসব ড্রয়ার থেকে এই ড্রয়ার আলাদা। দিয়া সেটি বুঝে। কোড লক দেয়া থাকে , আজ অবধি সাহস করেনি কেউ এই ড্রয়ার ধরতে। সে যাই হোক আপাতত এমপি সব কাজ শেষ করে স্বপত্নীকে সময় দেয়া জরুরি মনে করে উঠে তার পাশে বসলো। গালে ডান হাত রেখে নমনীয় গলায় বললো,

– স্বপ্ন বাস্তব হয়না ফারাহ্। আর খারাপ স্বপ্ন মস্তিষ্কের ভাবনা মাত্র। কিছু নিয়ে কি দুশ্চিন্তা আসছিলো মনে?

অসহায় গলায় বললো,

– হুঁ।

– কি সেটা?

– আপনার গ্যালাপাগোস।

হো হো করে হেসে উঠলো মানুষটা। এখনই এত উৎকন্ঠা। যাওয়ার দিন আসতে আসতে তো এই মেয়ে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিবে। স্ত্রীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,

– ম্যাডাম শুনুন তবে, আপনি যেমন কোহিনূরকে নিয়ে দূর দূরান্তে পাড়ি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন ঠিক তেমনি আপনার স্বামীর ও সেই ছোট বেলা থেকে গ্যালাপাগোস যাওয়ার ইচ্ছে ধারণ করেছে। আপনার ইচ্ছা তো পূর্ণ করতে পারবোনা কারণ কোহিনূরকে নিয়ে আমরা চাইলেও বাংলাদেশের রাস্তায় বের হতে পারবোনা। এমন একটা ব্রিড মানুষ তাকে আঘাত করতে পারে। তবে আমি চাইবো শেহজা যেন কোহিনুরে পারদর্শী হয়। আপনি হবে তার মাস্টার। পারবেন না?

দিয়া মুখে হাসি ঝুলিয়ে জানান দিলো,

– পারবো ইনশাআল্লাহ । আচ্ছা আমরা কবে যাবো?

– নেক্সট উইক।

– আমাদের কি আপনি শিপে চড়াবেন?

– অবশ্যই। তাই তো আকাশপথ ছেড়ে সমুদ্রস্নানে নামবো। আগে সাগর মাতাকে দেখাবেন। যেখানে আকাশ মিশেছে সায়রে, যেখানে সূর্য অতি নিকটবর্তী,যেখানে #সায়রে_গর্জন উঠে, যেখান থেকে ঝড়ের তীব্রতা সন্নিকটে তেমনি বাতাসের বেগ, পানির স্রোত আঁচড়ে পড়ে মানবকূলের পদমুখে। আপনার স্বামীর আসল বাড়ি হলো সমুদ্র। দেখাবো আমার শেহজাকে তার বাবা ‘ কিং অফ ওয়েব’ এর সমুদ্ররাজ্য। একটা শুভারম্ভ করতে যাচ্ছি আমরা ইনশাআল্লাহ। বুঝতে পেরেছেন শাহাদ প্রিয়া?

– কিন্তু শেহজা তো ভুলে যাবে বড় হতে হতে।

– দিবই না। কারণ আমি প্রতি বছর সাগর পাড়ি দেব আমার প্রিয় রমনী ও মেয়েকে নিয়ে।

– কিভাবে?

– আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন আপনার স্বামী একজন এক্স- লে. কমান্ডার? সাগতে যেতে কি তার টিকিট লাগে?

খানিকটা হাসলো দিয়া। কিছুটা শান্তি এই ভেবে যে আপাতত সব রকমের ঝুট ঝামেলা বিদায় হলো। শাহাদের কথার মাঝে কেমন রহস্য খুঁজে পাচ্ছে। তবুও দিয়া কর্ণগোচর করলো সেসব ভাবনা।

___

এভাবে কি ঘুমানো আদৌ সম্ভব। কিছুক্ষন মেঝেতে পায়চারি করছে, কিছুক্ষন খাটে বসছে। বউ বরনের পর্ব শেষে সবার প্ল্যান ছিলো আড্ডা দিবে। যাওয়ার আগে শাহাদের কড়া নির্দেশ দুজনকে বিশ্রাম নেয়ার জন্য, কেউ যেন তাদের বিরক্ত না করে, অন্যদিকে পাহারাদার হিসেবে এই বাড়িতে আছে একদল বিচ্ছু। মাঝে একবার বের হয়েছিলো কামরা ছেড়ে শাহীনের ধমক খেয়ে ভেতরে চুপচাপ বসে আছে। হাত পা নিশপিশ করছে আড্ডা দিতে। ডাক্তার তাহি ঘুমাচ্ছে তাতে কি হয়েছে, ঘুমাক তিনি। লিমনের আড্ডায় কেনো বাঁধ সাজছে বাকিরা? অন্যদিকে ঘুম আসছেনা। আবার এক বিছানায় শুতেও বেশ বিব্রত বোধ করছে। তাহি অনুমতি দেয় নি সরাসরি। মেয়েটা রাতে কোনো রকম খেয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কোনো সংকোচ নেই। এদিকে লিমন যে কষ্ট পাচ্ছে তাতে কিছুই না। বিছানায় শুয়ে পড়লো অধৈর্য্য হয়ে। সহসা ভেসে এলো মেয়েলী স্বর,

– না ঘুমিয়ে ছটফট করছেন কেনো?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললো,

– আপনি ঘুমান নি?

– রুমে যেভাবে তান্ডব করছেন ঘুম পালিয়েছে যোগ হয়েছে মাথা ব্যাথা।

– স্যরি…

থেমে গেলো লিমন। পুনরায় বলে উঠলো,

– ঘুম না আসলে উঠে বসুন গল্প করবো। আমার ভালো লাগছেনা। অফিস থেকে কি ছুটি নিবো কাল?

মাথা টনটন করছে। গত কটা রাত ঠিক ভাবে ঘুমাতে ভু লে গিয়েছে তাহি। আজ ও ঘুমাতে পারছেনা রুমের মাঝে এই তান্ডবের জন্য। বিরক্ত হয়ে হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে উঠে বসলো। প্রশ্ন করলো,

– বলুন কি বলবেন?

– আরেহ পরামর্শ দিন ছুটি নিবো?

– আমি কি করে বলবো?

– আপনি কি কাল যাবেন হসপিটালে?

– নিশ্চিত নই। এমার্জেন্সি পেশেন্ট থাকলে তো যেতে হবে, বিশ্রাম নেয়ার পরিকল্পনা আছে।

– তাহলে আমি ছুটি নিই?

তাহির এবার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। এমন ভাবে আবদার করছে মনে হচ্ছে তাহি অনুমতি না দিলে ছুটি নিবেইনা। মাথার পাশে বালিশটাকে ঠিক করে শুয়ে বললো,

– সমস্যা না হলে নিতে পারেন।

লিমন খুশি হয়ে গাল ভরা হাসি দিয়ে বললো,

– ধন্যবাদ ডাক্তার তাহি। ও আরেকটা প্রশ্ন আপনার পাশে শুতে পারি?

লিমনের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছিলো তাহি। নাক মুখ বিরক্তিতে কুচকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,

– লিমন বড্ড বিরক্ত করছেন। আমার পাশে শুবেন না তো রাস্তায় গিয়ে শুবেন? আপনার কি মনে হচ্ছে আমি এখন অশোভনীয়, অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব কথা বলবো যে আপনাকে নিচে শুতে হবে অথবা ডিভানে। যদিও আপনার রুমে ডিভান নেই। কথা কম বলে ঘুমান সুস্থ ভাবে। আমাকে ও ঘুমাতে দিন। আমি যত না সম্পর্কটা নিয়ে ভাবছি আপনি তার চেয়ে বেশি আমাকে ভাবাচ্ছেন। এমন অদ্ভুত ব্যবহার করবেন না। আমাকে স্বাভাবিক হতে দিন। আমি আপনাকে মনে প্রাণে স্বামী মেনে নিয়েছি বলেই এক বিছানায় শুতে এসেছি। উফ! আর বিরক্ত করবেন না তো। ঘুমাতে দিয়ে নিজেও ঘুমান।

চোখ বড় বড় করে লিমন ঠোঁট ভেঙচি দিয়ে বললো,

– উফ! বিরক্ত করবেন নাতো?

– ভেঙালেন?

– পাশে ঘুমাতে দিয়ে কি আমাকে উদ্ধার করেছেন? আমি এমনিতেও আপনার পাশেই ঘুমাতাম। শুধু ভদ্র ছেলের মতো অনুমতি নিয়েছিলাম। অনেক প্রতিশোধ নেয়া বাকি ডাক্তার তাহি।

– অনলি তাহি। মাইন্ড ইট। আর কিসের প্রতিশোধ?

– আমি ডাক্তার তাহিই ডাকবো। সবাইকে দেখাতে হবেনা আমার একজন বুদ্ধিমতি, প্রতিভাশালী ডাক্তার বউ আছে। এনিওয়ে, মনে নেই অপমান করেছিলেন যে? সেই প্রতিশোধ।

– কি ব্যাপারে?

– আমার সুন্নতে খৎনা…

– আল্লাহ, প্লিজ। এসব কেনো মনে রেখেছেন?

– হা হা হা প্রতিশোধ। আমি তো ছোট মানুষ,তাই না?

তাহি দু হাত জোড় করে বলে,

– মাফ চাই, আর বলবোনা। কখন কি বলেছিলাম নিজের ও মনে নেই। এখন এসব তুলবেন না।

– আপু ডাকতে বলেছিলেন না?

তাহি ঠান্ডা চোখে প্রশ্ন করলো,

– ডাকতে চান?

লিমন ঘাবড়ে গেলো। এতক্ষন সব ধরনের মজা ছিলো তাহির মুখে হাসি ফোটাতে। একা ভালো লাগছিলোনা তাই বকবক করছিলো। এখন তো মনে হচ্ছে ঘটনা বিগড়ে দিয়েছে। তবে কি বেশি বলে ফেললো। কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়াই ভালো। লিমন নিরবে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লো। তাহির পুনরায় প্রশ্ন,

– ডাকতে চান? উত্তর পাই নি।

তাহির দিকে ফিরে বললো,

– সামর্থ্য নেই আপনাকে অনেক কিছু দেয়ার মতো। তবে গত পরশু রাতে বের হয়ে একটা জিনিস কিনেছিলাম। সারাদিন পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে ঘুরেছি। দিবো?

– আগে উত্তর চাই?

– অনুমতি দিলে প্রিয়তমা ডাকতে চাই। দিবেন?

– উপহার নিয়ে আসুন।

সুস্পষ্ট ইঙ্গিত একটি সুন্দর স্বাভাবিক সম্পর্ক শুরুর। অনুমতি পেতেই উঠে বসলো লিমন। স্বীয় স্ত্রীকে অনুরোধের স্বরে বললো,

– উঠে বসুন।

তাহি নিরবে উঠে বসলো। লিমন পাঞ্জাবির পকেট থেকে উপহার বের করে তাহির সামনে মেঝেতে বসলো। নিজের হাঁটুতে তাহির ডান পা উঠাতেই মেয়েটা চমকে পা সরাতে চাইলে লিমন বললো,

– বন্ধু ভেবে বিশ্বাস করে চুপচাপ বসুন।

বক্স খুলে একটা সোনার পায়েল বের করে পায়ে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,

– একটারই টাকা ছিলো। সোনার যা দাম। দুটো কিনতে গেলে কিডনী বেচলেও কম হবে। অন্য পায়ের জন্য পরে কিনে দিব। আপাতত এই অল্পই গ্রহন করুন তাহি।

পায়ের দিকে তাকিয়ে তাহি হেসে বললো,

– ধন্যবাদ, খুব সুন্দর হয়েছে।

অকস্মাৎ তাহি প্রশ্ন করে বসলো,

– সবাই এতবার করে রাশেদের কথা বলে আপনার শুনতে খারাপ লাগেনা।

লিমন মুচকি হেসে উত্তর দিলো,

– আমি, জেনে শুনে বিষ করেছি পান।
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।
যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি,
লই গো বুক পেতে অনল-বাণ।
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি প্রাণ।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৫৩.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বালুঘড়ির বালুকনার মতো গড়িয়ে পড়েছে সময়ে
কাঁ/টা। সময়ের সাথে স্রোতের পাল্লা দিয়ে চলা যেন প্রকৃতির এক অপার মহিমা। সপ্তাহ পেরিয়ে এলো বলে। প্যাকিং চলছে সুলতানা মঞ্জিলে। সমুদ্র অভিযানের, পরবর্তীতে কোনো এক দ্বীপের হদিসে যাচ্ছে শাহাদ-দিয়া জুটি। যে দ্বীপের নাম খুব কম মানুষের জানা, যার পাড়ি দিতে ভ্রমনপিপাসুদের শত দিনের আকাঙ্ক্ষা তার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে আগামীকাল ভোরে। ট্রাভেল ব্যাগে সব গুছানো শেষ। লিভিং রুমের সোফাতে বসে আছে শাহাদ পরিবার। আবিরকে বর্ণনা দিচ্ছে গ্যালাপাগোসের। জানিয়েছে আরেকটু বড় হলে আবিরকে নিয়ে যাবে। আবির মনোযোগ দিয়ে শুনছে বড় মামার গল্প। এই সেই প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসেছে মামার কাছে।

আবির প্রশ্ন করলো,

– মামা আপনি তো চলে আসবেন, আবার তো অনেক পরে যাবেন। তাহলে আমি সাগর দেখবো কিভাবে? আমাকে কখন সাগরে নিয়ে যাবেন?

বোনের ছেলেটাকে কাছে টেনে বললো,

– তোমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবো মামা। এখন তো মা যাবেনা তাই তোমাকে নিতে পারছিনা।

শেফালীকে গুটি কয়েকবার প্রশ্ন করেছিলো যাবে কিনা, উত্তরে প্রতিবার জানিয়েছে এখন যাবেনা। মা ছাড়া আবিরকে নেয়াটাও বোকামী। আবির ছোট না হলে সাথে করেই নিয়ে যেতো। পরিকল্পনা মোতাবেক সব ঠিক থাকলে আবিরসহ পাড়ি দিবে ভবিষ্যতে।

রাতের খাবার শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে শাহাদ দম্পতি। কামরাতে টুকটাক শেহজার কাপড় গুছাচ্ছে দিয়া। শাহাদ মেয়েকে নিয়ে খেলতে খেলতে প্রশ্ন করলো,

– ফারাহ্ তুমি কি পেঙ্গুইন ভয় পাও?

ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে বললো,

– দেখিনি তো কখনো। নিশ্চিত ভয় পাবো। এমন প্রশ্ন কেনো করেছেন?

– না এমনি। গ্যালাপাগোসে পেঙ্গুইন থাকতে পারে তাই।

– দ্বীপ যেহেতু থাকতেই পারে। কিন্তু ওগুলো তো সমুদ্রে থাকবে, থোড়াই আমার কাছে আসবে?

শাহাদ ঠোঁট টিপে হেসে বলে,

– তা ঠিক। ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই। এমনি জিজ্ঞেস করলাম দূর থেকে ভয় পাবে কিনা আবার তাই।

– ওহ।

পুনরায় দিয়া গোছগাছ শুরু করেছে। এদিকে এমপি সাহেব আপন মনে হাসছে। এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যার সম্পর্কে প্রেয়সীর ধারণা টুকু নেই। কি যে হবে এই মেয়ের!

___

সকালেই উড়জাহাজ যোগে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেছে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর। শিপে উঠতেই নতুন পরিবেশের মুখোমুখি হলো দিয়া। এ যেন ফুলেল অভ্যর্থনা চারিপাশে। বিয়ের সানাই হয়তো এভাবে বাজেনি তবে পূর্ণ আয়োজন ও শুভেচ্ছায় ভাসিয়ে নিলো নেভির প্রতিটি সদস্য এই দম্পতিকে। নেভির সাবেক লে. কমান্ডারের জন্য এভাবে আয়োজন করবে দিয়ার ধারণা ছিলোনা। স্যালুটে অভ্যর্থনায় বরন করে নিয়েছে শাহাদ ইমরোজকে। কিছুক্ষন হলো শিপের কেবিনে এসেছে। দিয়াকে রেস্ট করতে দিয়ে শাহাদ মেয়েকে নিয়ে বের হয়েছে। সকলের আদরের মধ্যমনি হয়ে আছে শেহজা। সময় পেরিয়ে গেলো টেরই পেলো না দিয়া। সাগরের মাঝখানে এসে কেবিনের ভেতর বুঝতেই পারছেনা দিন কি রাত! টানা অনেকক্ষন ঘুমে থাকার কারণে শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। সমুদ্রে নেটওয়ার্ক নেই বলতে গেলে। কেবিনের ইন্টারকম ব্যবহার করতে বলেছে শাহাদ। ইন্টারকমে ফোন দিতেই ও পাশ থেকে অন্যকেউ রিসিভ করলো, দিয়া জানিয়ে দিলো শাহাদকে প্রয়োজন।

ওয়াশরুমে থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই কেবিনের দরজায় কড়া নাড়লো শাহাদ। একেকটা শিপ পুরো একটা ছোট কলোনীর মত, যার মাঝে বেশ কিছু এপার্টমেন্ট, বাড়ি থাকতে পারে। দিয়ার কেবিন ও ভীষণ লাক্সারিয়াস। শাহাদ মেয়েকে নিয়ে ঢুকে বেডে বসে বললো,

– নাস্তা এখনো নেয়া হয়নি কেনো? বেশ আগে পাঠিয়েছি।

– ফ্রেশ হয়ে মাত্র বের হলাম। মাথা ব্যাথা কমছেনা।

– তাহলে রেস্ট নাও আর কিছুক্ষন। মেডিসিন নেয়ার প্রয়োজন নেই। রেসিস্টেন্স হয়ে যাবে। মেয়েকে খাইয়ে দাও। আমার গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ পড়েছে।ওটা সেরে এসে তোমাদের আকাশের তারা দেখাবো। ছানাটার চোখে ঘুম মনে হয়। কেমন করছে চোখ দুটো তাকিয়ে দেখো?

– ঠিক আছে আমি দেখছি। আপনি কাজ সেরে আসুন। এরপর বের হবো।

শাহাদ সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে এলো। ভেতরে স্ত্রী কন্যাকে রেখে এলো। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে। শিপের প্রতিটি মানুষ জানে আজকের সভা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয়, যতটা হলে আজ তাদের শিপে জয়েন করেছে ভাইস এডমিরাল মানিক মোজাম্মেল স্বয়ং। সচরাচর কোনো র‍্যাঙ্ক বা বড় একাডেমিক অনুষ্ঠানে তিনি আসেন। অথচ আমেরিকা যাওয়ার শিপে তার কাজ কি! আদৌ জানেনা বাকি সদস্যরা।

বিশেষ সজ্জিত কামরায় এসে উপস্থিত শাহাদ। দুজন অফিসার স্যালুট জানালো। মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করলো। চেয়ারে বসে আছে মানিক মোজাম্মেল। স্যালুট জানালো শাহাদ। এক্স- লে. কমান্ডারকে দেখে কিঞ্চিত হেসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। পাশে বসিয়ে সবার খোঁজ জানতে চাইলেন। স্ত্রী- কন্যাকে দেখা করাবে জানালো শাহাদ। উষ্ণ আলাপচারিতার মাঝে মানিক সাহেব প্রশ্ন করলেন,

– তোমার নামে বিশেষ লেটার এসেছে লে. কমান্ডার। এখন রিসিভ করবে?

– না স্যার।

– পেপার রেডি করা হয়েছে?

– সব তৈরি আছে। সময় অনুযায়ী সাবমিট হবে।

– তোমার ফিরতে তো বেশ কিছুদিন লাগবে তাই না?

– জ্বি স্যার।

দেশ পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের মাঝে বিষদ আলোচনা নিয়ে বসেছে দুজন। সাউন্ডপ্রুফ কামরার আলোচনা বাইরে যাবেনা। মানিক মোজাম্মেলের শিপে আসা নিয়ে ফিসফিস আলোচনা হচ্ছিলো অফিসারদের মাঝে। দু দুজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা শিপে তাই সকলে ভীত সন্ত্রস্ত। একজন নেভি প্রধান, তো অন্য জন নেভির প্রাক্তন ইউনিট প্রধান ও বর্তমান দেশ সেবক। সামান্য ভুল করলেই দুজনের একজনও বরদাস্ত করেনা।

___

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। স্ত্রী- কন্যাকে নিয়ে শিপের ছাদে। আকাশের তারা দেখছে তিনজন। শেহজা ছটফট করছে। শাহাদ বুঝতে পারছে মেয়ের মনের অবস্থা। একটু বেড়ে উঠার পর এমন সুবিশাল সমুদ্র কখনো দেখেনি তাই হয়তো উত্তেজিত। মেয়েকে কোলে নিয়ে হেঁটে দিয়াকে বললো,

– ফারাহ্ মেয়ে তো এখনই ছটফট করছে পরে কি করবে?

– আপনার মেয়ে না?

শাহাদ খানিকটা হতবাক। তার মেয়ে বলে কি অপমান করলো! চেহারা মলিন হলো। প্রশ্ন করা চাহনীতে তাকালো স্বীয় স্ত্রীর পানে। দিয়া অধর প্রসারিত করে জবাব দিলো,

– রক্তের টান বুঝেন? সমুদ্র দেখলে আপনি ঝাঁপিয়ে পড়েন, সমুদ্রকে নিজের বাড়ি বলেন আর এই মেয়ে কি করে শান্ত থাকবে? শান্ত থাকা যায়! অশান্ত সাগরমাতাকে দেখে বুঝান দেখি আমায়?

স্বস্তির শ্বাস শাহাদের। যাক, স্ত্রী অপমান তো করেনি। মৃদু হাসি ঠোঁটের কোনে। শেহজাকে তারা দেখাতে দেখাতে দিয়াকে বললো,

– আমরা কেনো সমুদ্রে পথে যাচ্ছি জানো ফারাহ্?

দিয়া দুপাশে মাথা নাড়লো।

শাহাদ স্বাভাবিক গলায় বললো,

– তোমাদের তারা দেখাতে। ভূপৃষ্ঠে আমরা মাটি এবং পানি উভয় উপাদানই পাই। মাটির মোটামুটি সঠিক ব্যবহার হলেও পানি দূষিত এরপরও পানির অভাব হয়না। বেঁচে থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি আলো। দিনের আলোতে সূর্য আমাদের সাহায্য করে রাতের জন্য আমরা ব্যবহার করি কৃত্রিম আলো। টমাস আলভা এডিসন সর্বপ্রথম ১৮৮০ সালে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন। আমরা কবিতায় পড়েছি একবার না পারিলে দেখো শতবার, সেদিক থেকে এডিসন একবার না পারিলে দেখিবে সহস্রবার পণ নিয়ে নেমেছিলো গবেষণায় এবং সে সফল। নয়শত নিরানব্বই বার ব্যর্থ হওয়ার পর হাজার বারে সফলতা কেড়ে নিলো। এখন প্রশ্ন হলো, ১৮৮০ সালের আগে মানুষ কি করতো? আলো কি ছিলোনা? উত্তর হলো, অবশ্যই ছিলো। তখন মানুষ রাতের আকাশে তারা দেখতো, চাঁদের ফকফকা জোৎস্না ছিলো, কুপি ছিলো,হারিকেন ছিলো। তাহলে এখন আমরা রাতের আকাশে তারা এত স্বল্প কেনো দেখি? তুমি উত্তর দাও তো?

দিয়া ঠোঁট উলটে বলে,

– আপনার মত এত গবেষণা করি নাকি তারা দেখার সময়। দেখার দরকার দেখেছি।

– করতে হবে ফারাহ্। এটা গবেষণা নয়। জানতে হবে। না হলে অদেখাকে দেখার,অজানাকে জানার মজা পাবেনা তো। আচ্ছা শোনো তবে, আমরা কেনো স্থলভাগের আকাশে এখন তারা কম দেখি? অথচ সমুদ্র পৃষ্টের আকাশটা দেখো কত সুন্দর জ্বলজ্বল করছে? এর কারণ হলো আমরা আলো দূষণ থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছি। স্থলভাগের আলোর ছিটেফোঁটা ও নেই জলভাগে। স্থলভাগের কৃত্রিম আলোর জন্য রাতের আকাশে তারাদের অনুজ্জ্বল দেখা যায় তাই আমরা তারা কম দেখি। মাঝে মাঝে রাতের তারাদের স্টার প্যাটার্ন দেখা যায়। বিভিন্ন আকৃতি তৈরি করে তারারা একত্রিত হয়ে। সেই স্টার প্যাটার্নকে বলে কনস্টিলেশন। এরা একধনের ইমাজিনারি শেপ তৈরি করে আকাশে। আরো মজার ব্যাপার কি জানো? তাদের প্যাটার্নের আবার নাম ও আছে এই ধরো ওরিয়ন, প্যাগাসাস,লিও সহ আরো অনেক। কোনোটি দেখতে শিকারীর মতো,কোনোটি দেখতে ঘোড়ার মতো যেমন তোমার কোহিনূর, আবার কোনোটি সিংহের মতো। সুন্দর না?

শাহাদ কথা থামিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালো। দিয়া হাঁ করে তাকিয়ে আছে,মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়ে ও বাবার দিকে তাকিয়ে। বিব্রত বোধ করে বললো,

– ভুল কিছু বললাম?

দিয়া মুখ বন্ধ করে বলে,

– মাস্টার মশাই এইজন্য আপনাকে শিফা ভয় পায়। নাহয় ওই দস্যি মেয়ে কাউকে ভয় পায় না, আপনাকে কেনো পায়? সেদিন জিজ্ঞেস করলাম তুমি তোমার ভাইজানকে দেখলে ছুটে পড়ার টেবিলে কেনো আসো? উত্তরে জানালো, ভাইজানের প্রশ্নের বান থেকে বাঁচার জন্য। পড়ার টেবিলে দেখলে প্রশ্ন করবেনা।

শাহাদ কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো,

– স্যরি, বুঝতে পারিনি।

হেঁটে মেয়েকে কোলে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। সমুদ্রের গর্জন জোরালোভাবে কানে আসছে। মাঝে মাঝে শিপ নড়ে উঠে। রাতের দিকে নাকি সমুদ্র উত্তাল থাকে। স্রোত গুলো আঁচড়ে পড়ছে। এ যেন সর্বনাশা সমুদ্রের মোহনীয় রূপ। শাহাদের মন খারাপের আভাস।

দিয়ার কথা শুনেই আচমকা মন খারাপ হলো মানুষটার। তবে প্রতিটি কথা দিয়া মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছে শুনতেই ভালো লাগছিলো। কিন্তু সব ভুলে গিয়েছে। এত তথ্য একসাথে মনে রাখা তো যায়না। স্বামীর সামনে এসে কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো। আহ্লাদী গলায় বললো,

– ওগো আমার শ্যামসুন্দর, রাগ করেছেন বুঝি? রাগ করলে আপনার রুপসী বধূর যে কষ্ট হয় তা কি বুঝেন না?

অদ্ভুত সম্বোধনে শাহাদ হেসেই ফেললো। এই হাসি যেন সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট হাসি। মানুষটা পুরো বদন একসাথে হাসছে। চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো। অধর কোণে হাসি সরছেই না। শেহজাও হাসছে বাবার হাসি দেখে। হাসতেই হাসতেই শাহাদ বললো,

– এই প্রথম কেউ এমন সাহিত্যিক সম্বোধন করলো। বেশ সুন্দর না না অত্যাধিক সৌন্দর্য্যবোধক শব্দ। আমি আপ্লুত, পুলকিত,আনন্দিত।

– আমিও প্রফুল্লিত,উৎফুল্ল, প্রসন্ন আপনাকে আনন্দ দিতে পেরে।

– কে যেন একটু আগে বললো, আমি শুধু পড়াই, এখন যে তিনি নিজেই সব সাহিত্য রস ঢেলে কথা বলছে তার বেলায়?

– আপনার সাথে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা।

– কতদূর পারলেন?

দিয়া দূরত্ব হাতের ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে বললো,

– দিল্লী আভি বহত দূর…

হেসে উঠলো মানুষটা। বউটা ভীষণ আদুরে। মাঝে মাঝে এমন সব দুষ্টুমিতে মেতে উঠে মন খারাপের সময় টুকু হয় না। তবে এবার গুরুত্ব নিয়ে বললো,

– তবে দুঃখিত রূপসী বধূ, ঘুরতে এনে পড়ানো শুরু করেছি। ব্যাপারটা বিচ্ছিরি।

– না আমি এঞ্জয় করেছি তো। আচ্ছা শুনুন। আমরা কি আকাশে এখন সিংহ দেখবো?

শাহাদ প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে একপেশে হাসি দিয়ে বললো,

– অভিনয় করতে হবেনা আর। সিংহ দেখা লাগবেনা। সিংহ কি বসে আছে, যে কখন ফারাহ্ তাকে চাইবে আর সে প্রজ্জ্বলিত হবে? তারা দেখবে নাকি ভেতরে যাবে?

দিয়া হাই তুলে বলে,

– সত্যি বলি?

– হুম।

– খিদে পেয়েছে।

– চলো খাবে।

___

রাতের খাবার শেষ করেছে বাবা মেয়ে। মেয়েকে খাওয়ানো শেষ করে দুজন খেতে বসেছিলো। শাহাদের খাবার শেষ দিয়া তখনো খেয়েই যাচ্ছে। এত ধীরে খাচ্ছে শাহাদ ভ্রু কুঁচকে পড়ার মাঝে মাঝে খাওয়া দেখছে। হাতে একটা বই নিয়ে বসলো। সমুদ্রের গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সাগর উত্তাল। থেমে থেমে নড়ে উঠছে। মাঝে মাঝে আলোকছটা দিচ্ছে। শেহজা ঘুমিয়েছে। দিয়া ঘাবড়ে গিয়ে বললো,

– এমপি সাহেব ঝড় উঠবে?

শাহাদ হাতের বই সরিয়ে বলে,

– তাড়াতাড়ি খাও, দেরি করে খেলে উঠবে।

কি বুঝে মেয়েটা গপাগপ খাবার গিলে ফেললো। ওর খাওয়ার স্পিড দেখে শাহাদ তাজ্জব বনে গেলো। মনে মনে ভাবলো, কি বাজে একটা হুমকি দিলাম,যার কোনো ভিত্তি নেই। অথচ এই মেয়ে তা বিশ্বাস করে কেমন খাবার গিলছে। এরই মাঝে দিয়া খাবার শেষ করে শাহাদের পাশে এসে বসলো। শাহাদ দিয়ার মতি গতি বুঝার চেষ্টা করছে। দিয়া এদিকে সেদিক ফিরে কেমন করে বললো,

– খেয়েছি তো? এমন করছে কেনো তাহলে আকাশ?

শাহাদ বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– কিহ? তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে?

দিয়া আচানক গাল ফুলিয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে,

– আপনি মাইন্ড গেম খেলেছেন কেনো? আমি তো ভয়ে আপনার অযৌক্তিক কথাকে ও সত্য মেনে গিলে ফেললাম।

এর মাঝে সমুদ্রের গর্জন দ্বিগুন হলো। দিয়ার মুখ খানা এমন হলো যে কেঁদেই দিবে। শাহাদ হেসে বললো,

– ম্যাডাম একটু জানালাটা খুলুন। বাতাসটা প্রচন্ড ঠান্ডা আর শিহরণ জাগানো।

চেঁচিয়ে উঠলো দিয়া,

– পাগলে কামড়েছে আমাকে। বাইরে কি অবস্থা। আপনাকে কে বলেছে আমাদের মাঝ সমুদ্রে এনে মজা করতে। কি হবে আমার মেয়েটার। শিপটা এমন নড়ছে কেনো?

শাহাদ শান্ত। প্রথমবার বলেই দিয়ার মনে এত ভয়। এ তো সমুদ্রের সাধারণ নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। পূর্ণ মনোযোগ দিলো বইতে। দিয়া কম্ফর্টার মুড়িয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। শাহাদ নিশ্চুপ। ঝড় ক্ষীণ হয়েছে। খানিক বাদে কম্ফর্টার উঠিয়ে শাহাদকে দেখতে চেষ্টা করলো। ফলস্বরূপ লজ্জা পেলো, শাহাদ ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। কম্ফর্টার সরিয়ে বললো,

– হাসছেন কেনো?

– কাঁদার মতো কিছু কি হয়েছে?

ঠোঁট বাকিয়ে দিয়া বললো,

– কাঁদতে হবেনা। আচ্ছা কি পড়ছেন?

– The Rime of the Ancient Mariner.

দিয়া উঠে বসলো। জানার আগ্রহ নিয়ে বললো,

– সেই আলবাট্রস কাহিনী না?

শাহাদ মাথা ঝাকালো। পুনরায় দিয়া প্রশ্ন করলো,

– আগে পড়েননি?

– হুম। বেশ কয়েকবার। ভালো লাগে। এই বই থেকে অনেক কিছু শিখেছি জীবনে। তুমি পড়েছো?

– না শুনেছি। আচ্ছা আলবাট্রস কি সত্যি শুভ ভাগ্যের প্রতীক?

– জানিনা তো। তবে বইয়ের কাহিনী অনুযায়ী তো তাই বুঝায়। কোলরিজ তো আমাদের তাই বুঝিয়েছে।

– আপনাকে কেনো সবাই আলবাট্রস ডাকে?

– তুমি কি করে জানলে?

– ছোট ভাইয়া বলেছিলো। এছাড়া আজ শিপেও শুনেছি। অনেকে আপনাকে আলবাট্রস বলেছে।

শাহাদ হেসে বলে,

-The Rime of the Ancient Mariner এ যেই কাজটা আলবাট্রস করেছে, এমন কিছু কাজ আমি দশ বছর আগে করেছি বলে তাদের ধারণা তাই হয়তো ডাকে।

– কি করেছেন?

– তেমন কিছুনা কয়েক জন নাবিক এবং ক্রু ফেঁসে গিয়েছিলো সমুদ্রে। ঠিকঠাক দিক নির্দেশনা দিয়ে তাদের উদ্ধার করেছি। এগুলো সবাই করে। আমার বেলায় একটু অতিরঞ্জিত প্রশংসা করে ফেলেছে সবাই। এতটুকুই। এনিওয়ে ঘুমাও, কথা কম বলে। বিশ্রাম প্রয়োজন।

কথা না বাড়িয়ে দিয়া চুপ চাপ মেয়ের দিকে ফিরলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মানুষটা আবার বই নিয়ে বসেছে। মনে দুষ্টুমি খেললো। জানালা টা আস্তে করে খুলে দিলো। শিরশিরে বাতাস ঢুকছে। শাহাদ আড়চোখে দেখছে স্ত্রী কর্মকান্ড। খাট থেকে নেমে সরাসরি ধুপ করে শাহাদের কোলে এসে বসলো। হঠাৎ এমন কাজে শাহাদ আঁৎকে উঠলো। একপাশে বই রেখে ভ্রু কুচকে বললো,

– কি?

দিয়া গলা জড়িয়ে বললো,

– আমি আপনার কোলে বসি, আপনি পড়ুন জ্বালাবোনা।

আস্ত বউ কোলে উঠে বসেছে। পড়ায় কি আর মন থাকবে। দিয়াকে মৃদু ধমক দিয়ে বললো,

– ঘুমাতে যাও।

দিয়া উপেক্ষা করে বললো,

– পরিবেশটা দেখেছেন, কি সুন্দর। ইশ কি শিরশিরে ঠান্ডা। আমার তো ভালো লাগছে। একটু খানি কোলে উঠেছি এমন করছেন কেনো?

– আমাকে ভালো থাকতে দিলে কি ক্ষতি হতো তোমার! এই যে কোলে উঠে বসে আছো বুঝতে পারছো আমার অনুভূতি? তাই বললাম ঘুমাতে যাও।

দিয়া উঠে গিয়ে বললো,

– হুহ যাচ্ছি। সারাক্ষন বাইরে আর বই। বিকেলেও ঘুমিয়েছি। সারাদিন রাত ঘুম আর ঘুম।

ডান হাতের কবজিতে টান লাগলো দিয়ার। এক টানে কোলে বসিয়ে নিলো শাহাদ। কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বললো,

– ভেবেছিলাম জাহাজে ছেড়ে দিব। নিজের ভালো বুঝলেনা। অনুভূতি জাগিয়ে, যাচ্ছো কোথায়? এই মোক্ষম সুযোগ এত সহজে হাতছাড়া করবে না শাহাদ ইমরোজ। ছানাটা ঘুমে।

শাহাদের টেবিলের পাশে প্লেটে বিভিন্ন রকম ফল রাখা। প্লেটের উপর ঢাকনাটা উলটে একটা আঙুর নিয়ে দিয়ার মুখে পুরে দিলো। দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো,

– মিষ্টি?

দিয়া স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

– হ্যাঁ।

প্লেটে হাত দিয়ে কমলা নিয়ে দিয়াকে মুখে পুরে দিয়ে বললো,

– কেমন?

কমলা টক। দিয়া চোখ মুখ কুচকে বললো,

– মজা না টক।

দিয়ার মনোযোগ শাহাদের মুখে। শাহাদের ঠোঁটের কোণে হাসি। শেষ আরেকটা ফল নিয়ে দিয়ার মুখের সামনে আনতেই দিয়া আগের বারের মত হা করলো। এবার শাহাদ হাত ঘুরিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে বললো,

– দি ইজ মাইন সুইটহার্ট।

দিয়া প্লেটের দিকে পূর্ণ নজর দিলো কি ফল দেখার জন্য! ফল দেখেই গালের দু পাশে গোলাপি আভা ফুটে উঠলো । ঠোঁটের উপর আপনা আপনি হাত চলে গেলো। লজ্জ্বায় উঠে যেতে চাইলো, কোমড়ের বেষ্টনী আরো দৃঢ় হলো। ফলের বীজটা বসা অবস্থায় মুখ থেকে ছুড়ে বিনে ফেললো। হেসে নিজেই বললো,

– একজেক্ট পয়েন্ট।

একটানে প্রেয়সীকে কাছে টেনে বললো,

– ইট’স টাইম টু টেস্ট মাই ফেভরিট ওয়ান, ডিয়ার লেডিলর্ড অফ মাই হার্ট।

চলবে…