সায়রে গর্জন পর্ব-৬০ এবং শেষ পর্ব

0
3

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৬০. ( শেষ পর্বের প্রথমাংশ)
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

চারদিকে একটাই সংবাদ সাবেক এমপি রায়হান মাহমুদের ছেলে শাহাদ ইমরোজ এমপি পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, তিনি নিজ থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এতে কারো হাত নেই এবং কেউ তাকে জোরাজোরি করেন নি। তিনি আরো জানিয়েছেন, এই ব্যাপারে তিনি কথা বলতে আগ্রহী নন। সোফায় বসে রায়হান সাহেব চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখছেন আজকের এই তাজা খবর। বিকেল তিনটা থেকে এই সংবাদ প্রচার করা শুরু হয়েছে। শাহাদকে ফোন দেয়া হচ্ছে। সে ব্যস্ত। বাড়ির সকলে বেশ চিন্তিত। দিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছে, দিয়া জানিয়েছে সে আজ ভোরে জানতে পেরেছে। শাহাদের প্রতিউত্তর ও শ্বশুরকে জানিয়েছে। সর্বপুরি চিন্তাগ্রস্থ বাড়ির লোকজন। শাহীন বাবা মাকে জানালো, আজকের ইনভাইটেশনের কথা। সকলকে তৈরি হয়ে নিতে বললো। রায়হান সাহেব খানিকটা আক্রোশ নিয়ে বললো,

– ও কি করতে চাচ্ছে?

শাহীন মাথা নত করে বললো,

– আব্বু আমাকে জানিয়েছে, বাসার সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে কক্সবাজার রওয়ানা হতে। নিরা তো ট্রাভেল করতে গেলেই শরীর খারাপ করবে। তাই ওকে, আম্মুকে আর আপনাকে এয়ারে পাঠাতে বলেছে।

সুলতানা কবির স্তব্ধ হয়ে বললো,

– ও কি গোটা জেনারেশন নিয়ে রওয়ানা হতে বলেছে নাকি?

– জ্বি আম্মু।

দিয়া মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,

– আবার জার্নি?

– স্যরি ভাবীমা কিছু করার নেই।

বিনাবাক্য বেয়ে সকলে রাজি হয়ে তৈরি হতে গেলো। দিয়া শাহাদকে ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও পাচ্ছেনা। কিছুটা বিরক্ত ঝাড়লো মুখে। মেসেজ করলো,

– আমি মেয়েটাকে নিয়ে একা কিভাবে ট্রাভেল করবো এতখানি পথ? আপনি কোথায় শেহজার বাবা?

আরামপ্রদ জামা নিজে পরে, মেয়েকেও পরিয়ে দিলো। ঘন্টা খানেক পার হলো তবুও রিপ্লাই না আসাতে বুঝেই গেলো ইচ্ছে করে করছে। তবে এটাই কি সারপ্রাইজ! দম ফেলে ব্যাগ গুছাতে লাগলো।
___

অপরাহ্ন কন্যার আগমনী গান। আছরের নামাজ আদায় করে ছাদের কোল ঘেঁষে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে পাভেল। কিছুক্ষনের মাঝেই সবাই মিলে রওয়ানা হবে কক্সবাজার। শিফাকে তো বুঝিয়েছে কিছুক্ষন আগে। মেয়েটা কি বুঝলো কে জানে? নিজেকে বুঝাতেই অক্ষম পাভেল। যখনই শিফার স্নিগ্ধ ক্রন্দনরত মুখটা ভেসে উঠে মনের কোণে বিষাদের ঘন্টা বাজতে থাকে, শোক যেন ছেয়ে যাচ্ছে চারদিকে। কিছুক্ষন আগের ঘটনা বুকের ব্যাথাটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ব্যাথা কাউকে দেখানো যায়না, বোঝানো যায়না। চিলেকোঠায় এসেছিলো শিফা। পাশাপাশি বসেছে দুজন। শিফার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললো,

– শিফা তুমি বড় হচ্ছো, তোমার ভাইজানেরা তোমাকে কত করে বুঝাচ্ছে। অবুঝ তো নও তুমি, কেনো পাগলামি করছো? এই বাড়িতে যাই হয় সব খবর ভাইজানের কাছে চলে যায়। উনি তো আমার উপর রেগে আছে। তোমাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই শিফা। কিন্তু আমার শুধু ভাইজান আছে, বস ও উনি অভিভাবক ও তিনি। তার হাত আমার উপর থেকে সরে গেলে তো আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাব। কেনো সাধারণ ব্যাপারটা বুঝতে চাইছোনা? কি পেয়েছো আমার মাঝে?

শিফা চোখের পানি মুছে তাকিয়ে বললো,

– ভাইজানকে আমি বলেছি সেদিনের কথা। আমাকে আপনারা দুজন মিলে মে/রেছেন। প্রতিবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিসের এত দম্ভ আপনার! বাসলাম না ভালো আপনাকে, করলাম না বিয়ে তাতে কি? আমি ছোট মানুষ বলে শুধু তাচ্ছিল্যই করেছেন। কোনো দিন গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেছেন? বলেন নি।

থেমে নাক টেনে বললো,

– আমি ভাইজানের কাছে কিছু লুকাই না। আপনাকে ভালোবাসার কথা লুকিয়েছিলাম আগে,সেদিন ফোনে এই কথাও বলে দিয়েছি। যেহেতু এক তরফা ভালোবাসা তাই আপনার কাছে দোষ পড়ার আগেই বলে দিয়েছি যে সব দোষ আমার। আগে হোক বা পরে ভাইজান খবর পেয়েই যাবে। তখন হয়তো আপনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করবে। আমি চাইনা আমার জন্য ভাইজান আপনাকে ভুল বুঝুক। শেফালী আপার জন্য আজ অবধি নোমান ভাইকে মাফ করেনি। আমাকে আর বুঝাতে হবে না। আপনি বললেন তাই এখানে এলাম। নতুবা আসতাম না। বিয়ে করে নিন। আপনি আমার ভাগ্যে নেই।

চোখের কোণায় চিকচিক করছে পানি। তর্জনি দিয়ে চেপে নিলো পানি টুকু। শিফায় মাথায় হাত রেখে কম্পিত গলায় বললো,

– দোয়া করি অনেক ভালো থাকো।

বেরিয়ে যাবে দরজা দিয়ে তখনি শিফা পেছন থেকে ডাকলো,

– পাভেল ভাই…

ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তর দিলো,

– হুম।

ছুটে এলো শিফা। আঁছড়ে পড়লো পাভেলের বুকে। দরজায় ঠেস দিয়ে পাভেল নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হেলে পড়লেও সামলে নিলো নিজেকে। বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে ফেটে যাবে হৃদপিন্ড। মেয়েটা উচ্চস্বরে কেঁদে বলছে,

– আমি জানি আমিই প্রথম নারী যে আপনার বুকে এসেছি। আপনি আমার ছিলেন, আমার আছেন এবং আমারই থাকবেন। কিন্তু কখনো আমি দাবি করবোনা আপনি আমার।

রোবটের মতো হাত দুটো সোজা করে রেখেছে। শিফা আকড়ে ধরেছে পাভেলকে। চোখ বন্ধ দুজনের। পাভেলের অন্তরের খবর কেউ রাখেনা। মন চাইছে মেয়েটাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে। সবসময় নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি অনুভুতি এত প্রবল কেনো? পাভেলের কাছে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে নিচে চলে গেলো শিফা। মেয়েটা চলে যাবার পর একই জায়গায় বুকে হাত দিয়ে বসে আছে মানুষটা। এই মুহুর্তটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহুর্ত। যদি সাধ্য থাকতো তবে ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতো। ভাইজানকে জানাতে হবে বিয়ে করবেনা কাউকে। শিফাকে চাওয়ার সাহস নেই তবে বিয়ে করবেনা এতটুকু তো বলা যেতেই পারে।

___

গাড়ি ছুটে চলেছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। ঢাকা পেরুতেই তিন ঘন্টা লেগেছে। রাস্তায় জ্যাম। এরপর কুমিল্লা, চট্টগ্রাম। ঘন্টা খানেকের মাঝেই পৌঁছে যাবে হোটেলে।

স্বপ্নীল সিন্ধু। নেভি হোটেল। পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় মধ্যরাত। রায়হান সাহেব, সুলতানা কবির এবং নিরাকে আগেই রিসিভ করে নিয়েছে হোটেল কতৃপক্ষ। বাকিরা আসার পর দেখতে পেলো বেশ কিছু সাদা পোশাক পরা অফিসার দাঁড়িয়ে আছে রিসিভ করার জন্য। একসাথে দুটো গাড়ি ঢুকলো হোটেলে। সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে ভেতরে নেয়া হলো তাদের।

হালকা কিছু খেয়ে সকলে রেস্ট নিতে চলে গেলো। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এখানে আসার পর সব কটা পুরুষ মানুষ গায়েব রায়হান সাহেব ব্যতীত। দিয়া মেয়েকে নিয়ে একা কামরায় ভয় পাচ্ছে। এদিকে শিফা,শেফালী এক কামরায়, নওরীন একা। এক থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি কামরার সামনে ষন্ডা টাইপের সিকিউরিটি অফিসার পাহারায় বসিয়েছে। শেহজাকে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে যাবে এই মেয়ে বাবা বাবা লাগিয়ে দিয়েছে। দিয়া মেয়ের কষ্ট বুঝতে পারছে। কাল থেকে বাবাকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে আছে। কাকে দিয়ে খবর পাঠাবে? লিমনকে ফোন দিতেই ফোন ব্যস্ত, পাভেলের ফোন বন্ধ। শাহীনের ফোনে লাইন পেয়ে শাহীনকে বললো,

– ভাইয়া, আপনার ভাইজান কোথায়? শেহজা কিছুতেই থামছেনা। বাবা বাবা করে অস্থির করে তুলেছে।

শাহীন জানালো,

– ভাবীমা আমি নিজেও ভাইজানকে রিচ করতে পারছিনা। আমি আসছি।

দিয়া ঘুমে চোখ খোলা রাখতে পারছেনা। এদিকে শেহজা মাকে বলছে হেঁচকি তুলতে তুলতে,

– বাবা দাবো, বাবা নিয়ে দাও। মা বাবা দাবো।

– হ্যাঁ মা, বাবা দাবো তো আমরা। বাবা আসবে।

রুম ঠকঠক আওয়াজ হতেই দিয়া খুলে দেখলো শাহীন আর লিমন দাঁড়িয়ে আছে। শাহীন হাত বাড়িয়ে বললো,

– ভাবী দিন। আপনি রেস্ট নিন। আমরা নিচে আছি ওকে নিয়ে। কিছু লাগলে কল দিবো। ভাইজানকে রিচ করতে পারলে তো হলোই।

দিয়া নিজেও আর পারছিলোনা দুষ্টু মেয়েটাকে নিয়ে। শাহীন এবং লিমনকে ওর একটা ড্রেস দিয়ে দিলো। ডায়াপার বদলে দিলো। চাচাদের সাথে খুশি মনে চলে যাচ্ছে কারণ সে বাবা দাবে। তার ধারণা চাচারা বাবা নিয়ে যাবে। বের হতে হতে মাকে বললো,

– বয় পেও না মা। তেজা হ্যালো। তেজা আব্বে। তেজা টা টা। উম্মা।

দিয়া নাক মুখ কুচকে বলে,

– দেখছেন মেয়ের সাহস, এতক্ষন আমার মাথা শেষ করছে, এখন আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে। বাপের ফটোকপি হইছে।

শাহীনের কোলে উঠেছে। কাঁধের পেছনে নিজের ওয়াটার মেলন বেবি ব্যাগটা জুলিয়েছে। ওটার ভেতর একটা সুতি জামা। এই সময়টা সবাই ঘুমাচ্ছে। আর এই মেয়ের ঘুম নেই। সারা গাড়িতে ঘুমিয়েছে। শাহীন, লিমনকে উদ্দেশ্য করে দিয়া বললো,

– ভাইয়া বেশি বিরক্ত করলে দিয়ে যাবেন। এ্যাই মেয়ে চাচ্চুদের জালাবেনা।

– তুপ, তেজা গুড। দুমাও তুমি। তেজা চক্কেত কাবে চাচ্চু।

– কিসের চকলেট। ভাইয়া চকলেট দিবেন না। এ্যাই আমার কাছে আয়, তোর যাওয়ার দরকার নেই। গিয়ে সবার মাথার উপর নাচবি আমি জানি।

দিলো কান্না জুড়ে। এদিকে শাহীন লিমন হাসতে হাসতে শেষ। শাহীন ভাবীকে বললো,

– ভাবীমা আপনি ঘুমান। আমি দেখছি আমাদের শাহজাদীকে।

টুপ করে চাচ্চুর গালে চুমু খেলো। লিমন হেসে বলে,

– সব শিখে গেছে।

দিয়া হেসে বললো,
– আপনাদেরই তো রক্ত। কিভাবে মানুষকে বশে আনতে হয় তা জানে ভালো। ভাইয়া বেশি লাই দিবেন না যেন।

লিমন বলে উঠলো,

– ফিকার নট ভাবীমা। ওকে বাদর বানানোর জন্য স্পেশাল ট্রেইনিং নিয়েছি আমি।

দিয়া হেসে মজা দেখছে মেয়ের সাথে চাচাদের। ওরা চলে যেতেই দিয়া বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। কি একটা ধকল যাচ্ছে শরীরের উপর দিয়ে।
____

বন্ধ কামরায় এলিন। আশপাশটা লক্ষ্য করে বুঝলো এই কামরা কোনো পশ এরিয়ায় অবস্থিত। সকাল না রাত কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা। গতকাল থেকে এখানে বন্ধি শোনা যাচ্ছে আজ ছেড়ে দিবে। কিন্তু শাহাদেরই কোনো ভয় নেই। আজ যদি ছেড়ে দে এরপর সব কথা এলিন ফাঁস করে দিলে কি হবে? বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। শাহাদের মোহে পড়ে বাবার পাওয়ার ব্যবহার করেছে ওর সান্নিধ্যে পৌঁছাতে। বাবা জানে অনেক তথ্য। বাবার সাথে যখন সেনাবাহিনীর জেনারেল, নৌবাহিনীর এডমিরালদের গোপন বৈঠক হচ্ছিলো অনেকাংশ কানে আসে এলিনের। সব ছাড়িয়ে একটাই উদ্দেশ্য ছিলো শাহাদকে নিজের করে পাওয়া। একই ভুল করেছিলো মনি। মুখ বাঁধা, হাত পা বাঁধা। তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে প্রবেশ করলেন একজন ভদ্রলোক। অদ্ভুতভাবে সেই ভদ্রলোককে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে অবস্থান করছে এলিনের সব কটা ইন্দ্রিয়। হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। ভদ্রলোক কাট কাট গলায় বললেন,

– আশা করি ভালো আছো। আর বেশিক্ষন নেই। সঠিক সময়ে তোমাকে খাবার দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হচ্ছে না আমার নির্দেশে। বয়স এখন পয়ষট্টি বছর। এই বয়সেও নিজের নাম,যশ, সততা ধরে রেখেছি। তুমি মেয়ে আমার সম্মান এক নিমেষে মিশিয়ে দিবে তা তো হতে দিবোনা। বাবা হিসেবে সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। এখন মেয়ে হওয়ার পরীক্ষা দাও। শাহাদ আমার অনেক স্নেহের। ওর গোপনীয় রক্ষা করা শুধু আমার নয় দেশের কর্তব্য। তুমি সেখানে আমার মেয়ে হয়ে দেশের এত বড় ক্ষতি করবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। দুঃখিত মা। আমাদের কাজ শেষ হলে তুমি ছাড়া পাবে। এখানে শাহাদই তোমাকে আটকে রেখেছে আমার নির্দেশে। মাথায় কোনো কুবুদ্ধি থাকলে ঝেড়ে ফেলো। শাহাদকে পাওয়ার নেশায় এতটাই বুদ হয়ে আছো যে ভুলে গিয়েছো শাহাদের সাজানো সংসার আছে। এমন ভুল আরো একজন করেছিলো। যার সঙ্গী এখন পঙ্গুত্ব। আমি চাইনা তুমি এমন জীবন গ্রহন করো। তোমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিব। তুমি সেখানেই সেফ এন্ড সিকিউর। এখন একটা ঘুম দাও। অপরাধীর মতো এভাবে বাঁধা অবস্থায় থাকো। যে অপরাধ করতে যাচ্ছিলে এতে যে পরিমাণ ক্ষতি দেশের হতো, আমার প্রাণ দিয়েও তা পূরণ করা যেত না।

বেরিয়ে গেলো মিনিষ্টার দেলোয়ার। মেয়ের কীর্তিকলাপ বেশ কিছুদিন ধরে সন্দিহান ছিলো। তাই মেয়ের পেছনে লোক লাগিয়ে, আইডি,কললিস্ট হ্যাক করে জানতে পারলো মেয়ে শাহাদের পিছু নিয়েছে। বাবা হয়ে মেয়ের বিপদ তা কিছুতেই যেমন মেনে নিতে পারছেনা ঠিক তেমনি শাহাদের এতদিনের পরিশ্রম পন্ড হতে দেয়া যায়না, এতে দেশের নাগরিক এবং দেশসেবক হয়ে বেঈমানী করার মত। এত বড় বেঈমান হওয়া যাবেনা তাই বাবা হয়ে মেয়ের ভালোর জন্য এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
___

সকাল আটটা। দরজার আওয়াজ শুনে দিয়া ধড়ফড়িয়ে উঠলো। শেহজাকে আশপাশে খুঁজে না পেয়ে মনে পড়লো মেয়েটাতো চাচাদের কাছে। এখনো এলোনা? দরজা খুলতেই দেখতে পেলো একটি মেয়ে কিছু উপহার এবং নাস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলো,

– কে পাঠিয়েছে?

– স্যরি ম্যাম, ইট’স কনফিডেনসিয়াল। উই আর ইনফর্মড টু ডেলিভার। আন এবল টু গিভ ইউ এনি ইনফরমেশন। ম্যাম, হিয়ার ইজ দ্যা নোট টু ফলো। প্লিজ এক্সেপ্ট ইট।

একটা খাম বাড়িয়ে দিলো দিয়ার দিকে। খামটা নিয়ে দিয়া উপহারের ট্রলিটা রুমে ঢুকালো। খাটে বসে শাহীনকে কল দিলো। শাহীন জানালো শেহজাকে খাইয়ে দিয়েছে, শেফালী চেঞ্জ করে দিয়েছি। কিছু গিফট পাঠানো হয়েছে। রেডি হয়ে নাস্তা করে যেন নিচে নেমে আসে। সবাই নামছে কিছুক্ষনের মাঝে। দিয়া খাম খুলতেই দেখলো একটি চিঠি।

প্রিয় শাহাদবধূ,

আপনার জন্য সামান্য উপহার পাঠানো হয়েছে, তা গ্রহন করে আপনার একান্ত বাধ্যগত স্বামীকে ধন্য করবেন। গত একটি দিন আপনাকে ছাড়া থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু এই বান্দা নিরুপায়, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হচ্ছে। আজ অবসান ঘটবে আমাদের সকল চিন্তার। আপনার শাহাদ নতুন রূপে আপনার কাছে ধরা দিবে। যা আপনার চির প্রতীক্ষিত ছিলো। মেয়ে সারা রাত আমার কাছেই ছিলো। আপনার জন্য হৃদপিন্ডের অন্তঃস্তল থেকে ভালোবাসা প্রিয়তমা।

ইতি
আপনার শাহাদ।

কি ছিলো এই চিঠিতে? দিয়া জানেনা। তবে নিজেকে আজ বিশেষ মনে হচ্ছে। এত সুন্দর সম্বোধন। এত গুছিয়ে লিখা। তবে মনে করতে পারছেনা এমন কি জিনিস দিয়া চেয়েছিলো যা দিতে শাহাদ আজ এতটা ব্যাকুল। কি সেই সারপ্রাইজ?

উপহারের ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে এলো শুভ্র জামদানী। সাথে সব রকম জুয়েলারি। নাস্তা করে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো। নিজেকে আয়নায় দেখে আজ নিজেই মুগ্ধ, সাদা শাড়ি, শাড়ির কপার রঙা সুতার সাথে মিলিয়ে হিজাবে এতটা মোহনীয় লাগছে। জুতা পরে পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সেই ষন্ডা সিকিউরিটি গার্ড এখনো দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া হাঁটতেই তার পিছু নিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো,

– আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

প্রতিউত্তর করলো,

– ম্যাডাম, আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়া অবধি যেন আপনার পাশে থাকি।

দিয়া বুঝতে পারছে এরা পিছু ছাড়বেনা। তাই কথা না বাড়িয়ে হোটেলের রিসিপশনের সামনে আসতেই দেখলো বাকিরা তৈরি। সবাইকে বেশ সুন্দর লাগছে। শেফালী এবং নওরিন ছুটে এসে দিয়াকে বললো,

– মাশাল্লাহ ভাবীজান। চোখ ফেরাতে পারছিনা।

– বেশি বেশি লাগছে না তো?

শেফালী বললো,

– বিশ্বাস করো, আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ভাইজানের কি হবে ভাবতে পারছিনা।

নওরীন হেসে বলে,

– আপা আস্তে ভাইজানের এখানে কান ফিট করা থাকতে পারে।

শেফালী জিভে কামড় দিয়ে বলে,

– থুক্কু আমার ভাইজান তো সব দিকে নজর রাখে।

তিনজনই হেসে দিলো। শেহজাকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো রায়হান সাহেব নাতনী কোলে নিয়ে বসে আছে। শেহজাকে একটা সাদা প্রিন্সেস গাউন পরানো হয়েছে। এতকিছু কখন হলো? অফিসাররা এসে জানালো বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে। সকলে নির্দেশমত বেরিয়ে আসলো। গাড়ির সামনে আসতেই সকলে চমকে গেলো, চরম বিস্ময় নিয়ে দেখলো, শাহীন ইউনিফর্মে আছে। অদ্ভুত ভাবে লিমনও আজ কালো পোশাক পরেছে। এসে যোগ দিয়েছে পাভেল। লিমন এবং পাভেলের পোশাক একই। ইয়াজ এবং নোমানের পোশাক একই। ইউনিফর্ম এর মতো। দেখে মনে হচ্ছে কোনো ডিফেন্স কর্মকর্তার পোশাক। তেমন বিশেষ কিছু নেই তবে, কেমন যেন দাম্ভিকতা। গাড়িতে চড়ে বসলো সকলে। দিয়া শাহাদের রেঞ্জ রোভারে বসেছে। সেই গাড়িতে ছিলো দিয়া একা এবং শেহজা। রায়হান সাহেব নিজের গাড়িতে। নেভি জিপে বসেছে বাকিরা। গন্তব্য কোথায় কেউ জানেনা।

গাড়ি প্রবেশ করেছে চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমীতে। এখানে তো সেই মহাসমারোহ কারবার। ফিল্ডে কুচকাওয়াজ চলছে। গাড়ি থেকে নামতেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো গ্যালারীতে। রায়হান সাহেব ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন,

– কি হচ্ছে শাহীন?

– আব্বু দেখে যান। সারপ্রাইজ।

রায়হান সাহেব কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে পড়লো পরিবার সমেত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,বানিজ্যিকমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদস্য সহ রাষ্ট্রপতি প্রবেশ করছেন। সেই সাথে মাইকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাদের প্রবেশের খবর। আকাশ বাতাস কেঁপে উঠছে। গার্ড অফ অনার দেয়া হচ্ছে সবাইকে। নিজ নিজ আসনে বসার পর সকল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। পবিত্র আল- কুরআন তিলাওয়াত, পবিত্র গীতা থেকে পাঠ, জাতীয় সংগীত এবং রণ সংগীত। শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে নিরবতা পালন। শুরু হতে যাচ্ছে আজকের পর্বের মূল অনুষ্ঠান। প্রথমে মাঠে ডান পাশ থেকে দেখা গেলো প্রবেশ করছে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রাশেদ ইমরোজ এর মা মেহনাজ পাঠান। যাকে সম্মান জানিয়ে নেয়া হচ্ছে সামনে। রাশেদকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হলো। তার মাকে পরিয়ে দেয়া হলো উত্তরীয়, স্মারক লিপি প্রধান করা হলো এবং রাশেদের সোর্ড অফ অনার তুলে দেয়া হলো তার মায়ের হাতে। মেহনাজ পাঠান কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তার পাশে ছিলো তামজীদ লিমন এবং মোরশেদ পাভেল। ডি জি এফ আই এর গোয়েন্দা অফিসার ( ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স), এবং মেজর শাহীন ইমরোজ। সম্মাননা পর্ব শেষে অগ্রসর হলো পরবর্তী পর্বে।

প্রথমে সাদা ঘোড়া নিয়ে ঢুকলো একজন অফিসার। দিয়া হঠাৎ চমকে উঠলো। এতো কোহিনূর। সেই অফিসার সম্মাননা জানাচ্ছে আগত অফিসারকে।
মাইকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শাহাদ ইমরোজের নাম। গার্ড অফ অনার দিয়ে তাকে স্টেজের সামনে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ নেভির একজন চৌকস, বুদ্ধিদীপ্ত অফিসার। দিয়ার চোখ গেলো মাঠের মাঝখানে বিছানো লাল গালিচায়। ধবধবে সাদা নেভির ইউনিফর্মে এই প্রথম দেখতে পেলো প্রিয় পুরুষকে। কোহিনূর লাফিয়ে সম্মান দেখাচ্ছে শাহাদকে। শিউরে উঠলো শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। সাদা ইউনিফর্মে মানুষটা ঝলঝল করছে। বুকের মাঝে থাকা র‍্যাংকগুলো সূর্যের প্রখর কিরণ পড়াতে চিকচিক করছে। চোয়াল টান টান। প্যারেড করছে নেভির সদস্যরা। আকাশে বাতাসে জয়ধ্বনি। মিউজিক বাঁজছে,

– ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা।
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।

সুলতানা কবির পাশে বসা ছিলো। ছেলের বউয়ের হাত চেপে ধরলো। উনার চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে উনিও ঠিক ততটাই বিস্মিত যতটা দিয়া। বাকি সবাই থমকে আছে। গার্ড অফ অনার শেষ করে রাষ্ট্রপতির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। স্যালুট জানালো সকলে। ঘোষণা করা হচ্ছে নতুন পদ। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার থেকে কমান্ডার শাহাদ ইমরোজ। বুকে কাঁধে অসংখ্য ব্যাজ থাকার পরো নতুন র‍্যাংক যুক্ত হলো। দূর্দর্ষ সব র‍্যাংক। শেহজা চিৎকার দিয়ে উঠলো বাবাকে দেখে। র‍্যাংক পরানো শেষে রাষ্ট্রপতিকে স্যালুট জানিয়ে নিজ আসনে বসলো। উপরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে পরিবারের দিকে তাকিয়ে মোহনীয় এক হাসি উপহার দিলো। ইশারা দিলো শেহজাকে পাঠিয়ে দিতে। লিমন গিয়ে শেহজাকে নিয়ে এলো। মেয়ে তো বাবাকে পেয়ে সব ভুলে গিয়েছে। এদিকে দিয়ার আজ অন্যরকম লাগছে দিনটি। সকলে আশ্চর্য এই ভেবে শাহাদ তো অবসর নিয়েছিলো। শাহীন পাশে থাকাতে রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলো,

– শাহীন শাহাদ তো অবসর নিয়েছিলো?

শাহীন হেসে বলে,

– অবসর নেয় নি আব্বু, অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে ছিলো। সমুদ্রসীমা রক্ষা করার পণ নিয়ে বেরিয়েছিলো নেভাল একাডেমী থেকে। আজ সেই সীমায় বাংলাদেশ একচ্ছত্র অধিকার স্থাপন করেছে। রাশেদ ভাই, দূর্জয় ভাই এবং মাহফুজ ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ ছিলো মহীসোপান। ভাইজান সেই মহীসোপান দেশের নামে ছিনিয়ে এনেছে। আন্তর্জাতিক আদালত রায় দিয়েছে বাংলাদেশ মহীসোপান অনুযায়ী প্রায় এক লক্ষ আঠারো হাজার আটশো তেরো বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর মালিকানা লাভ করে। ভাইজান তার সমুদ্রবাড়িতে ফিরে যাচ্ছে আব্বু। আমাদের জন্য যেমন আনন্দের তেমনি ঘোর দুঃখের। ভাইজানকে আমরা হয়তো কাছে খুব কম পাব। সমুদ্র তার ‘স্রোতের রাজা’ কে ফিরিয়ে নিচ্ছে সমুদ্র শাসনের কাজে। দুদিন ধরে বহির্বিশ্বের অন্যসব গোয়েন্দা সংস্থা ভাইজানকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। আজ যেন র‍্যাংক গ্রহন করতে না পারে। কারণ র‍্যাংক গ্রহন করা মাত্রই ভাইজান তার সার্ভিসে ফিরবে এবং তারা কোনোভাবেই একজন অন ডিউটি অফিসারের উপর অ্যাটাক করতে পারবেনা। এজন্যই ভাইজান রিজাইন লেটার আমার কাছে জমা দিয়ে ইকুয়েডর চলে যায়, সেখানে গিয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সীমানা নিয়ে আলোচনায় বসে। যা পুরোপুরি অগোচরে ছিলো। ভাইজানের সাথে নেভির এডমিরাল তওহীদ আহমেদ স্যার ছিলেন সেখানে। ভাইস এডমিরাল মানিক মোজাম্মেল স্যার দেশের সব ঝামেলা সামলেছেন। সবাই ভেবেছে ভাইজান ঘুরতে গিয়েছে। ভাবীমা আর শেহজার নিরাপত্তা দেয়া কঠিন হয়ে পড়তো বলে সাথে করে ওদের নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলো। কোথায় যাচ্ছে কিভাবে যাচ্ছে পুরোটাই গোপন ছিলো। এয়ারে না গিয়ে শিপে গিয়েছিলো কারণ প্রয়োজনীয় সকল মিটিং আলোচনা শিপে শেষ করেছে।

রায়হান সাহেব দম ফেলে বললেন,

– আমার সন্তান অসাধারণ তবে এতটাও আমি চাইনি। ওর জীবনটা এখন আর সাধারণ নেই। বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে থাকতে পারতো ছেলেটা। ওর কিছু হয়ে গেলে দিয়া আর শেহজাকে নিয়ে কোথায় যাবো?

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
#অন্তিমপর্বের_অন্তিমঅংশ

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বিস্ময়কর এক দিন পার হলো আজ। সবাই হোটেলে ফিরে এসেছে। রায়হান সাহেবের কামরায় আলোচনা বসেছে। অফিশিয়াল কাজ শেষ করে বিকেলে ফিরবে বলে জানিয়েছে শাহাদ। সুলতানা কবির স্বামীকে প্রশ্ন করলেন,

– এই মহীসোপান কি? যার জন্য নিজের জীবনকে বাজিতে রেখে কাজ করেছে বাবু?

– মহীসোপান বলতে বাংলাদেশের যে অংশ ভারত মহাসাগর বা বঙ্গোপসাগরে নিমজ্জিত আছে তাকে বুঝায়। এটি কিন্তু বাংলাদেশেরই একটি অংশ। ভূগোলের ভাষায় একে বলা হয় মহীসোপান। ১৯৫৮ সালের ঘোষণা অনুযায়ী সমুদ্রতীরবর্তী ২০০ মাইল পর্যন্ত এলাকা ওই দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর একচ্ছত্র অধিকার শুধু মাত্র সে দেশেরই হোক সেটি প্রশান্ত বা ভারত মহাসাগরে নিমজ্জিত। বাংলাদেশের মহীসোপান পড়েছে অন্য মহাসাগরে। যার জন্য আপত্তি জানিয়েছে বহির্বিশ্বের অন্যদেশ। অথচ আইন অনুযায়ী এর একমাত্র হকদার বাংলাদেশ এবং পানির নিচে থাকা সকল প্রকার তেল, গ্যাস এবং খনিজ সম্পদের মালিক হবে বাংলাদেশ। দেশের আকার ভেদে মহীসোপান কম বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে তিনশ মাইল মহীসোপান নিজের বলে দাবি করেছে জাতি সংঘে। মহীসোপান প্রকৃত পক্ষে একটি দেশের বর্ধিত অংশ। খনিজ সম্পদের কারণেই মহীসোপানের এতো গুরুত্ব। তেল, গ্যাস, সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল-সব কিছুর মালিক সেইদেশ। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার পেয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তে আপত্তি পোষন করেছে। তবে ২০২০ এ পুনরায় সংশোধনী প্রকাশ করা হয়। এটি নিয়ে আবারো গুঞ্জন রটেছিলো। তারই পক্ষে এখন অবধি বাংলাদেশ মহীসোপান হিসেবে এক লক্ষ আঠারো হাজার আটশত তেরো বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ অবস্থিত সব ধরণের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যা দেশের সার্বভৌমত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

– এক কথা শুনে যাচ্ছি এত বছর, যা করছি সব দেশের জন্য? কি দিয়েছে এই দেশ ওকে?

– আহা! গিন্নী আবেগে ভেসো না তো। শুধু তোমার ছেলেই এমন কষ্ট করেনা। রাশেদ নেই, দূর্জয় নেই, মাহফুজ নেই। ও চোখের সামনে বন্ধুদের মৃত্যু দেখেছে কি করে নিজেকে শান্ত রাখবে? শপথ নিয়েছে নিজকে দেশের সেবায় নিয়োজিত করবে, দেশের প্রতি সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। তাহলে পেছাবে কি করে দেশব্রত থেকে? কাপুরুষের মত পিছিয়ে যাবে? ওর রক্তে রক্তে দেশপ্রেম। ভুলে গেলে তুমি আফসারের কথা? আফসার মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করেছিলো, আমি অবাক হয়েছি লিমনকে আজ দেখে। ছেলেটা বাবার আদর্শে বড় হয়েছে জানতামই না।

– সব তোমার ছেলের দোষ। সব কটারে গোয়েন্দা বানাইছে। যেমন লিমন, তেমন পাভেল, একইরকম শাহীন। আমার তো মনে হয় আমি কোনো জেলখানায় থাকি। আশপাশে সব পুলিশ, গোয়েন্দা ,সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী। দমটুকু শান্তিমতো ফেলার উপায় নাই। সারাক্ষন চিন্তায় থাকতে হয় কখন কি খারাপ খবর শুনবো।

– আর চিন্তায় থাকতে হবে না। হয়েছে সবাই উঠো। বড় বৌমা, ছোট বৌমা যাও শিফাকে তৈরি করে দাও। শাহাদ এসেই শুভ কাজ সেরে ফেলবে জানিয়েছে।

তড়াক করে উঠলো সকলে। প্রশ্নাতুর দৃষ্টি শ্বশুরের দিকে। শাহীন হেসে বললো,

– ভাইজান জানিয়েছে হোটেলেই আজ শিফার বিয়ে হবে। ছোট করে কাবিন হবে। প্রোগ্রাম ওর এইস.এইচ.সির পর হবে। পাত্র ভাইজানের পছন্দের। আঠারোতে তো ইতিমধ্যে শিফা পা দিয়েছে। আব্বুর ও আপত্তি নেই।

দিয়া প্রতিবাদ করলো,

– এটা কেমন কথা। শিফাকে কি একবারো জিজ্ঞেস করেছে আপনার ভাইজান? বললেই তো হলো না। এত অল্প বয়সে ওর বিয়ে দিতে হবে না। আমি কথা বলছি।

দিয়ার চেঁচিয়ে উঠা দেখে বাকিরা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। রায়হান সাহেব দিয়াকে শান্ত করে বললো,

– বড় বৌমা আমাদের বাড়ির মেয়েদের একটু আগেই বিয়ে হয়। শিফার আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং শিফা পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে গিয়েছে, ছোট বয়সে ইয়ার ড্রপ দেয়াতে। শিফা তোমার কি আপত্তি আছে?

বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝরঝর করে অশ্রু পড়ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার কীর্তি কলাপের কথা বাবা জানে। কার জন্য প্রতিবাদ করবে? যে মানুষটা তাকে পছন্দই করেনা? বিনা বাক্যে শিফা মাথা নেড়ে বললো,

– আমার আপত্তি নেই আব্বু।

দিয়া হতবাক, সাথে নওরিন ও চিন্তিত। কথা বাড়ায়নি দুজনের একজন ও। শিফাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ওর রুমের উদ্দেশ্যে।
___

কাজী এসে বিয়ে পড়িয়ে গেলো রুম থেকে। শাহাদ একটিবার ও বোনের সামনে আসেনি। বর আলাদা রুমে। বিয়ে পড়ানো শেষে শাহাদ এসেছে। মেয়েরা শিফার কামরায়। এখানেই বিয়ে পড়াতে বলেছেন রায়হান সাহেব। অদ্ভুত এক বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো। শিফা রোবটের মতো বসে আছে। বাকিরা স্তব্ধ, কেউ টু শব্দ করলোনা। দিয়ার আজ প্রচন্ড রাগ হয়েছে। স্বামীর প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ ছিলো তা এক নিমিষেই হারিয়ে গেলো। মানুষটা জানে শিফা পাভেল ভাইকে পছন্দ করে, তবুও কেনো জোর করে আজ বিয়েটা দিলো। মেয়েটা কেমন নিশ্চল। মুখে মুখে বলে শিফা আমার জান অথচ আজ প্রমান হয়ে গেলো পুরো বাড়ির মানুষ শাহাদ ইমরোজের হাতের ইশারায় নাচে। খেলার পুতুল। কেবলই সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত শাহাদ ইমরোজ ঢুকলো। সকালের পর এখন দেখলো মানুষটাকে। এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে সাইডে চলে গেলো। বোনের পাশে এসে বসলো শাহাদ। বোনের মাথায় হাত রাখতেই শিফা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে আঁছড়ে পড়লো ভাইয়ের বুকে। চিৎকার দিয়ে বললো,

– ভাইজান, কেনো বিয়ে দিলেন আমাকে??

হাত পা ছোড়াছুড়িতে ভাইয়ের বুকে লাগলো। সুলতানা কবির ধমকে উঠলেন,

– শিফা… বদমাইশি বন্ধ করো। তোমার ভাইজানের গায়ে লাগছে হাত পা, আঘাত করছো তুমি ভাইজানকে।

শাহাদ মাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে বোনকে শক্ত করে ধরে বললো,

– যা করেছি আমার ফুলের ভালোর জন্য করেছি।

সেই মুহূর্তে দিয়া চেঁচিয়ে উঠলো,

– কিসের ভালো করেছেন আপনি? কার ভালো করেছেন আপনি? আপনি ভালো বললেই ভালো হলো? এত বড় ক্ষতি করতে বিবেকে বাঁধলোনা? মেয়েটার বয়স কত? আপনাকে সম্মান করে বলে ওর পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম দিলেন না। আপনি তো ভাই নামের কলঙ্ক। নিজে বিয়ে করলেন নিজের পছন্দে, শাহীন ভাইকে বিয়ে দিলেন তার পছন্দে, ছোট ভাই বোনরাও সব নিজের মানুষটাকে আপন করে পেলো, অথচ ঠকে গেলো ছোট্ট শিফা? ওর দোষ কি ছিলো? ভাইজানকে আপন ভেবে সব শেয়ার করা? তাহলে পৃথিবীতে কোনো বোন তার ভাইদের বিশ্বাস করবেনা।

আঁৎকে উঠেছে বাড়ির মানুষ। এভাবে গর্জন করেনি কেউ শাহাদের সাথে আজ অবধি। স্থির, শান্ত দৃষ্টি শাহাদের। সুলতানা কবির আজ ভীতসন্ত্রস্ত। দিয়া পুনরায় চেঁচিয়ে বললো,

– হুট করে আমার মেয়েটার সতেরো আঠারো বয়স হলে তো একদিন ধরে এনে দেখা যাবে যার তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন। আমি কিছুতেই মেনে নিবোনা। নিজের ইগো স্যাটিসফাই করতে আপনার মত পাষাণ মানুষের পক্ষে সব সম্ভব।

শিফাকে ছেড়ে শাহাদ উঠে দাঁড়ালো। সুলতানা কবির দমাতে দিয়াকে ধমক দিলেন,

– বৌমা আস্তে কথা বলো, স্বামীকে অসম্মান করা বড়ই অভদ্রতা।

– যে নিজের সম্মান নিজে রাখতে পারে না, তাকে কিসের সম্মান?

এতক্ষনে শাহাদ মুখ খুললো,

– আম্মু বলতে দিন। পরে বলার সুযোগ না পেলে…

রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা পুনরাবৃত্তি হলো। রায়হান সাহেব,শাহীন এবং লিমন শিফার বরকে নিয়ে ঢুকলো। সাদা পাঞ্জাবী পরা সবাই। রায়হান সাহেব সকলকে বললো,

– হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে কেনো এতো? আমার মনে হয় এখানে আর কারো কোনো কাজ নেই। শিফা- পাভেলকে একটু স্পেস দাও সবাই।

মেয়েরা সব পাভেলের দিকে তাকালো। চমকে উঠলো। একমাত্র পাভেলের মাথায় টুপি। সুলতানা কবির কাঁপছে রীতিমতো। প্রশ্ন করলো,

– পাভেল রুমে কি করবে?

শাহীন ভ্রু কুচকে বলে,

– বরের নাম উচ্চারন করেছে যে শুনেন নি আম্মু? কি বলেন এসব। শিফার বর তো পাভেলই।

শেফালী বেকুপের মতো প্রশ্ন করলো,

– পাভেল ভাইয়ের নাম কি?

লিমন বললো,

– মোরশেদ আলম পাভেল।

নওরীন বললো,

– আমরা মোরশেদ আলমই শুনেছি। পাভেল খেয়াল করিনি।

ফ্রিজের মতো জমে গেলো সব। গরম ধোয়া বের হচ্ছে কামরা থেকে। শাহাদ পাভেলের কাঁধে হাত রেখে বেরিয়ে যাবে এমন সময় শিফা ছুটে এসে ভাইজানের পায়ের কাছে পড়লো। সুলতানা কবির মাথায় হাত দিয়ে বসে গেলো সোফায়। ছেলেরা রীতিমতো ঘাঁবড়ে গিয়েছে এদের আচরনে। শাহাদ শিফাকে তুলে দাঁড় করিয়ে বললো,

– আমার ফুলের গায়ে আমি কোনো আঁচড় পড়তে দিবো? আমার চেয়ে বেশি যত্ন করবে এমন কারো হাতেই তুলে দিলাম।

বোনের কপালে আদর দিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। বাকিরা বেরিয়ে গেলো। দিয়া দিশেহারা হয়ে ছুটলো নিজের কামরায়। কি করলো আজ! মানুষের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি বাক্যই চাইলে অন্যজনকে তছনছ করে দিতে পারে। আজ তাই করলো। রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে কেঁদে দিলো নিজে নিজে। চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। শাহাদের শেষ কথাটা বেশি নেড়েছে দিয়াকে- “বলতে দিন আম্মু, পরে যদি সুযোগ না পায়!” শিফা নাহয় বোন। পায়ে পড়ে মাফ চাইলো। দিয়াকে কি মাফ করবে? দুহাতে চোখ মুছে শাহাদের ফোনে কল করলো। রিং হচ্ছে রিসিভ হচ্ছেনা। মেয়েটা কোথায় তার জানা নেই। দরজার কড়া নড়ার আওয়াজ পেয়ে উঠে খুলে দিলো। মেয়েকে নিয়ে শাহাদ কামরায় ঢুকলো। মুখে কোনো শব্দ নেই। শেহজা ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনের ছুটোছুটিতে ক্লান্ত। মেয়েকে খাটে শুইয়ে দিলো। বেরিয়ে যাবে, দিয়া ছুটে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো মানুষটাকে। পাথরের মতো বজ্রকঠিন, অনড়।

– ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। আমার কেউ নেই আপনি ছাড়া। অনেক বড় ভুল করেছি মাফ করে দিন। আমি বুঝতে পারিনি। শিফার কান্না সহ্য হচ্ছিলোনা।

– ছাড়ো, আমি কিছু মনে করিনি। এমনিতেই তোমার মেয়ের সব দায়িত্ব তোমার। আগামীকাল আমি শিপে ফিরে যাচ্ছি। সেদিন বলেছিলাম না কিছু চাইবো। এটাই চেয়ে নিতাম, আমার অনুপস্থিতিতে নিজেকে এবং মেয়েকে সামলে নেয়ার ওয়াদা। এখন তো আমি নিশ্চিন্ত, আমার মত মানুষের ছায়া পড়লে মেয়েটার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে…

শাহাদের মনে হলো দিয়ার হাত হালকা লাগছে। বুকের উপর থাকা দিয়ার হাতের বাঁধন হালকা করতেই মেয়েটা পেছন দিকে পড়ে যেতে নিলেই ধরে ফেললো। আতঙ্কিত হয়ে গেলো শাহাদ। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। চোখ বুজে দম নিলো শাহাদ। কোলে তুলে খাটে শুইয়ে দিলো দিয়াকে। বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ার চোখে মুখে দিতে থাকলো। মনে মনে ভাবছে,

– কার উপর রাগ করবো আমি? এতটুকু রাগ সইতে পারলোনা আমার? দু বছর কিভাবে ছিলো?

পাঁচ মিনিট পর চোখ খুললো, শাহাদকে মাথার কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো। হাতের গ্লাস বেড সাইড টেবিলে রেখেই বুকে আগলে নিলো প্রেয়সীকে। শান্ত পরিবেশ। রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করলো,

– এখানে সেন্সলেস হওয়ার মতো কি হলো?

নিরব দিয়া। শাহাদ পুনরায় প্রশ্ন করলো,

– দু বছর তো আমি দূরেই ছিলাম। শেহজাকে পেটে নিয়ে একা একা সারভাইভ করতে হয়েছিলো, তখন তো এমন রোগ দেখিনি। তবে আজ হঠাৎ কেনো?

বুকে মুখ গুজিয়েই উত্তর দিলো,

– জানিনা, দু বছর এত ভালোবাসা পাই নি যতটা গত দেড় বছর পেয়েছি৷ অস্তিত্বে মিশে গিয়েছেন আপনি। এত টুকু জানি নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার কিছু ভালো লাগছেনা। মাথায় যন্ত্রণা করছে, মস্তিষ্কে একটাই নাম গেড়ে বসে আছে, একটাই বাক্য বার বার মস্তিষ্ক স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, দিয়া শাহাদ দূরে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনার কাছ থেকে আলাদা হওয়া মাত্রই আমি সব নিঃশ্বাস শেষ হয়ে যাবে। একদিন ও সারভাইভ করতে পারবোনা। আপনি আমার কাছে থাকবেন না মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই জিনিস ভাবতেই মনে হচ্ছে আজই ম*রে যাই আপনার বুকে। এর মাঝে যা পাগলামি করেছি কিছুক্ষণ আগে। আর কিছু বলার নেই আমার। মাফ চাওয়ার ও মুখ নেই।

– কি আবোল তাবোল বকছো?

– আপনি যাবেন না। গেলে আমি পাগলামি শুরু করে দিবো। আম্মিজান, বাবাজান, দাদাসাহেব চলে গেছে, আপনিও যাবেন? অসম্ভব যেতে দিবোই না।

আবার শুরু করেছে পাগলামি। কে সামলাবে এই পাগলীটাকে তার অনুপস্থিতিতে। শাহাদ হাসছে। তখন কিছুটা মনে কষ্ট পেয়েছিলো দিয়ার কথায়, তবে নিচে বসে ভাবতেই খুব ভালো লেগেছে, বউটা প্রতিবাদ করা শিখে গিয়েছে। দিয়া উঠে শাহাদের দিকে চেপে বসলো। আরো শক্ত করে ধরলো মানুষটাকে। শাহাদ প্রশ্ন করলো,

– কি চাই?

ঠোঁট উলটে উত্তর দিলো,

– আপনাকে।

– আছি তো আমি।

– ভালো করেছি তখন ওসব বলেছি। আমার কষ্ট হয়েছে তাই বলেছি। আপনি কেনো দুদিন ধরে নাটক করলেন। আমরা মা মেয়ে আপনাকে দেখিনি দুদিন।

– তোমার মেয়ে কাল রাতেও আমার কাছে ছিলো।

– বার বার তোমার মেয়ে তোমার মেয়ে করছেন কেনো? মেয়েকে কাছে রেখেছেন, আমাকে রাখলে কি অন্যায় হতো?

– আমি নাকি বাবা হিসেবে খারাপ, যার তার সাথে বিয়ে দিব। ভাই নামের কলঙ্ক। তাই তোমার মেয়ের বাবা হয়ে তার ক্ষতি করতে চাইছিনা। তোমাকে দুঃখ দিব বলে কাছে রাখিনি। খারাপ মানুষ না আমি?

– এবার কিন্তু ম*রে যাবো আরেকবার আমাকে রাগালে?

– ম*রো। ম*রা কি এত সহজ?

এমন উক্তি শোনা মাত্রই এক লাফে খাট থেকে নেমে গেলো। টেবিলের উপর ফল কাটার ছু*রিটা সাজানো ছিলো। শাহাদ দিয়ার উদ্দেশ্য বুঝে ছুটে গিয়ে সেটা ধরলো। ধমকে বললো,

– এক চ*ড় দিবো ফাজিল। পাগলামি পেয়েছো। কি শুরু করেছো? চুপচাপ খাটে গিয়ে বসো।

– ম*রতে বলেছেন না।

– অনেক কিছুই তো বলি। কয়টা শুনেছো?

এবার আহ্লাদে শাহাদের গলা পেঁচিয়ে ধরে বললো,

– আচ্ছা সব শুনবো। প্লিজ আপনি যাবেন না। আমাদের কষ্ট হবে তো।

একপাশে ছু*রি রেখে দিয়াকে পাঁজকোলে তুলে খাটের কাছে বসে বললো,

– ইউনিফর্মে দেখতে চেয়েছিলে। আজ দেখে কেমন লাগলো?

– ভয়।

– কেনো? তোমাকে সারপ্রাইজ দিতেই তো কিছু বলিনি।

– আমার মনে হয়েছিলো, আপনি আমার শেহজার বাবা নন। অসাধারণ কেউ। সত্যি বলছি আপনি তখন কথা বলতে আসলে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হতোনা। আপনার মাঝে অন্য কাউকে দেখেছি। যাকে আমি কখনো দেখিনি, যাকে আমি চিনি না। প্রচন্ড ভয় পেয়েছি।

দিয়া অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। শাহাদের মন অন্য কোথাও সীমাবদ্ধ। হঠাৎ দিয়াকে থামিয়ে বললো,

– ফারাহ্ আর কারো কি আমার প্রতি কোনো অভিযোগ থাকবে?

কিছুক্ষন নিরব ভূমিকা পালন হচ্ছে কামরায়। সত্যিই তো। সবার মনের আশা পূর্ণ হয়েছে। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দেয়া হয়েছে। চলার পথ কখনো মসৃন ছিলোনা। ভেঙেছে, গড়েছে। অসুস্থ হয়েছে। কাজকে ছোট করেনি। পুনরায় কাজে ফিরছে। সমুদ্র তার ঠিকানা, কি করে ভুলে থাকবে? ভাইবোনদের সবার খায়েশ সাধ্য অনুযায়ী মিটিয়েছে। বাবা- মাকে অসন্তোষ রাখেনি। নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছে।

দিয়া হঠাৎই উঠে গেলো। মেয়েকে পাশের বেডটাতে শুইয়ে দিলো। দুপুরের শাড়িটা খোলা হয়নি। ট্রলি থেকে একটা শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাহাদ ফোন চালাতে ব্যস্ত। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিলো। কাজল দিলো। তখনো শাহাদ খেয়াল করেনি। কাজে মগ্ন। বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে সাগর দেখছে। হোটেল থেকে সী ভিউ খুব সুন্দর। চুড়ির ঝনঝন শব্দে সামনে তাকিয়ে দেখে নতুন রূপে দাঁড়িয়ে আছেন শাহাদ ইমরোজের অর্ধাঙ্গীনি। সিঁদুর লাল জর্জেট শাড়ি, চেরি রঙা লিপস্টিক। চোখ দুটো স্বাভাবিক স্থির রেখে ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসি দিলো শ্যাম বর্ণের কমান্ডার। ধূসর হ্যাজেল চোখ দুটোতে অন্যরকম দুষ্টুমি ছিলো। দরজায় হেলান দিয়ে তখনো নিম্ন অধর কামড়ে হাসছে কমান্ডার শাহাদ ইমরোজ। শাহাদের এমন আচরণে দিয়া বিচলিত হয়ে নিজের দিকে তাকাচ্ছে, কোনো ভাবে ওকে বাজে লাগছে নাতো?

– দেখেছি শারদপ্রাতে তোমায়
দেখেছি মাধবী রাতে তোমায়
দেখেছি… হৃদি-মাঝারে
ওগো বিদেশিনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।

গাইতে গাইতে বারান্দার দরজা টেনে গুটি পায়ে এগিয়ে এলো। এতক্ষন যতখানি সাহস করে দিয়া এগিয়ে এসেছিলো। ঠিক ততখানি লজ্জায় ডুব দিয়েছে এখন। সরাসরি এসে দাঁড়ালো দিয়ার। কোমড়ে হাত দিয়ে এক টানে নিজের কাছে এনে, সামনের এলো মেলো কেশ গুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিলো। মুখের উপর হাত বুলিয়ে কপালে অধর স্পর্শ করলো তর্জনি দিয়ে। টকটকে লাল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,

– মাই বার্মিজ গ্রেইপ।

কোলে তুলে নিলো প্রেয়সীকে। রুমের দেয়ালে থাকা শ্যান্ডেলিয়ারটা নিভিয়ে দিলো। নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো কামরা। অধরে অধরে মিলিয়ে বেশ কিছুক্ষন পর বললো,

– কোথায় পাবো এই স্বাদ?

ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো দিয়া। চলে যাবে কাল। এরচেয়ে বেদনার আর কি হতে পারে! স্নেহে,যত্নে,আদরে ভরিয়ে তুললো প্রেয়সীকে। নিঃশ্বাসের শব্দ গভীর হতেই শাহাদ বলে উঠলো,

– শাহাদের সবকিছু এসে থেমে যায় ফারাহ্তে। তোমার প্রতি শাহাদ ইমরোজ চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে ফারহানা মেহতাব দিয়া।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন।
শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা।
শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
স্পর্শসুখে লিখা হবে অজস্র কবিতা।
শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ।
শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।
শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
তারপর হব ইতিহাস।
~ নির্মলেন্দু গুণ।
___

শিফা বসে আছে খাট আঁকড়ে ধরে। পাভেল সোফায়। দুজনের মাঝে এখন আকাশসম কৌতুহল।প্রথমে পাভেলই মুখ খুললো,

– ভাইজান, হঠাৎ এসে হাতে একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে বললো তৈরি হয়ে নিতে। এরপর তো ঘটনা তোমার সামনে।

মিনমিনে গলায় বললো,

– আমি চাইনি এভাবে বিয়েটা হোক। আপনার জীবনে ভাইজান আমাকে চাপিয়ে দিলেন। সারাজীবন বোঝা হয়ে থাকবো আমি।

পাভেল সোফা থেকে উঠে শিফার পাশে এসে বসলো। শিফা একটু দূরে সরে গেলো। ঠোঁট টিপে হাসছে পাভেল। ডান হাতে শিফাকে আগলে জোর করে টেনে এনে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

– ওহে বউ, আমি তোমাকেই ভালোবাসি।

শিফা চট করে তাকালো। পাভেল চোখের পলক ঝাপটে মুচকি হেসে দুহাত মেলে বললো,

– বুকে আসো। ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবো আমৃত্যু।

বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে শিফা। পাভেল পুনরায় বললো,

– ভীষণ ভালোবাসি। কাছে আসো।

ঝাঁপিয়ে পড়লো শিফা। এমনটাতো সে স্বপ্নেও ভাবেনি। এ যেন কল্পনা সত্যি হলো। নিজ থেকেই পাভেলের ডান গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

– ধন্যবাদ আমাকে ভালবাসার জন্য পাভেল মিয়া।

পাভেল মুখটা ব্যাঁকা করে নাক কুচকে বললো,

– এত কিছু থাকতে পাভেল মিয়া? নামটা শুনতে কেমন লাগে?

– আমিতো এই নামেই ডাকবো নতুবা পাভেল ভাই ডাকবো।

পাভেল মৃদু ধমক দিয়ে বললো,

– চুপ বেয়াদপ, কিসের ভাই! দিব না একটা চড়? বিয়ে করা বউ ডাকবে ভাই? থাক, জরিনা এরচেয়ে পাভেল মিয়াই ডাকো।

– ইছ, জরিনা কি?

– আমি পাভেল মিয়া হলে তুমি জরিনা বিবি।

– শিফা ডাকবেন শিফা।

– পাভেল ডাকো।

– শরম করে।

– গালে চুমু দিতে তো শরম করেনাই?

শিফা গাল ফুলিয়ে ধাক্কা দিয়ে অন্যপাশে সরে গেলো। কিঞ্চিৎ হাসলো পাভেল। শিফার পাশে বসে মুখটা আজলে তুলে সযতনে আপন ওষ্ঠ ছোঁয়ালো প্রেয়সীর ওষ্ঠে। আদুরে গলায় বললো,

– খুব সুন্দর লাগছে গোলাপী শাড়িতে। একটা গোলাপ লাগছে। তুমি আমার রোজ । তোমাকে কি করে অন্য নামে ডাকি? আমাকে যেকোনো নামে ডাকতে পারো। রোজের সেবায় এই মালি সর্বদা নিয়োজিত। শুধু তোমার সুবাসে মাতোয়ারা করে রাখবে এতেই মালি খুশি।

খিলখিল করে হেসে উঠলো শিফা। নব দম্পতি যেন সুখের দেখা পেলো। গল্প- আড্ডায় মেতে উঠলো দুজন।

___

নওরীনের পেটের উপর হাত, কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেজর। কিছুক্ষন নিজেদের মাঝে খুনশুটি করলো। অকস্মাৎ দুজনের মন খারাপ হয়ে গেলো। ভাবতেই খারাপ লাগছে কাল থেকে ভাইজানকে কাছে পাবেনা। এত বছর সব ধরনের সমস্যায় পাওয়া মানুষটাকে কাল থেকে চাইলেই ফোন করে বলতে পারবেনা,

– ভাইজান এখন কি করবো?

ভাইজান প্রায় বলতো, মেজর নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শেখো। আমি না থাকলে কি হবে? শাহাদের সমুদ্রযাত্রা এমন ভাবে সকলকে আতঙ্কিত করে তুলেছে যেন চারদিকটাকে শোকাবহ বেদনাদায়ক পরিস্থিতি গ্রাস করে নিচ্ছে। কোনো এক দানব এসে গিলে নিচ্ছে এক গালে। নওরীন হঠাৎ বলে উঠলো,

– মেজর, আমাদের যখন পুচকু হবে ভাইজান কি আসতে পারবে?

– জানিনা নিরা। তুমি কিন্তু এখনো কাউকে জানাবেনা এই কথা। ভাইজান কাল ফিরে যাবে তা শুধু আমরা কয়েকজন জানি। আমি তোমাকে সব শেয়ার করি তাই বললাম। আমাকে দৃঢ়ভাবে বারণ করেছে যেন আজ এই খবর কাউকে না দিই। এতে সবাই ভেঙ্গে পড়বে।

– ভাবীজানের কি হবে?তুমি তো তিন চার মাস থাকতে, ফোন দিলে চলে আসো। আগামী মাসে ঢাকায় শিফট করবে। দু তিনমাস থাকো না এটাই মেনে নিতে পারিনা, ভাইজান তো কোন সমুদ্রে চলে যাবে।

– মন খারাপ করোনা, আমাদের এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে ভাবীমা ভেঙ্গে পড়বে। উনার স্ট্রং থাকা অনেক দরকার।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো নওরীন। দিয়ার জন্য বুকের ভেতর হাহাকার জন্মেছে। সুদিন ফিরে আসুক। ভাইজানের ছায়া যেন সবসময় সবার উপর থাকে। শাহীন প্রেয়সীর পেট জড়িয়ে ধরলো আদরে।
___

সমুদ্রের গর্জন শুনছে। বাতাসের ঝাপটা আঁচল উড়ছে। পেছন থেকে নির্মেদ উন্মুক্ত কোমড় জড়িয়ে ধরেছে কেউ। পরিচিত স্পর্শ। ঘাড়ে মাথা রেখে গলায় মুখ ডুবিয়ে বললো,

– আপনার নিরবতা আমার ভালো লাগছেনা মিসেস লিমন।

– কি দরকার ছিলো গোয়েন্দা হওয়ার? একজনকে হারিয়েছি, আরেকজনকে হারানোর শক্তি নেই আমার। আমি সাদামাটা জীবন চাই।

– আমি সাদামাটাই। আমার মাঝে কোনো আড়ম্বরপূর্ণ কিছু কি কখনো দেখেছেন?

– অল্প খেতাম, হিসেব করে চলতাম তবুও রাতে শান্তির ঘুম হতো। এখন তো প্রতিরাতে ভাবতে হবে পাশে পাবো তো আমার স্বামীকে।

তাহিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আঁজলে মুখ তুলে বললো,

– পাবেন। প্রয়োজনে আপনার সেবায় সব ছেড়ে দিব। রক্তে আমার দেশসেবা। আব্বু ডিজিএফআইয়ের ডিরেক্টর ছিলেন। মা*রা যান দূর্ঘটনায়, প্ল্যানমাফিক হত্যা ছিলো, ভাইজানেরা সবাই ডিফেন্সে আমি কি করে সাধারণ হবো? ছোট বেলা থেকে ছু*রি, বন্দুক, তলোয়ার এসব দিয়ে খেলে বড় হয়েছি। মস্তিষ্কে ওসবই ছিলো। তবে আপনার খাতিরে সব কুরবান প্রিয়তমা।

লিমনের উন্মুক্ত শরীরে কোপের দাগ জলজল করছে। সেলাই শুকিয়েছে বহু আগে। তাহি হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলো,

– ব্যাথা আছে?

– হু।

– কি বলেন? এত মাস হলো ব্যাথা থাকে কি করে?

– কেউ যদি ভালোবেসে যত্নে উষ্ণ আদর দেয় তবে ব্যাথা হারিয়ে যাবে।

– সুযোগ পেলেই ফাইজলামি। সরুন তো।

– ভাইজান ভেবে নিয়েছে আমি তাকে বড় বাবা বানানোর প্ল্যান করছি আর আপনি তো এখনো আমাকে সতী রেখে দিলেন।

তাহি অট্টহাসি দিয়ে বলে,

– কি রেখেছি?

– আরেহ মজা নিবেন না তো। পুরুষ ভার্জিনকে বাংলায় কি বলে? ধ্যাৎ, মেয়েদের তো এমন কিছুই বলে, ছেলেদের কি বলে?

– আগে ওটা শিখে আসুন এরপর কাছে আসবেন।

তাহি বারান্দা থেকে কামরায় প্রবেশ করেও হাসছে। লিমন মোবাইল বের করে গুগলে সার্চ দিবে তাহি ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,

– নো চিটিং, শিখে আসতে বলেছি। ডিকশিনারি থেকে বের করে শিখবেন, ফোন থেকে নয়।

– ইয়া আল্লাহ মাফ করো, কেনো যে এই শব্দ উচ্চারণ করেছিলাম। আর আপনি সোজাসাপটা বললেই তো পারেন যে আমার রাতটা এভাবে নষ্ট করবেন। সবাই হানিমুনে মগ্ন আর আমি বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছি হেড মিস্ট্রেসের কাছে। পাশ না করলে পরের ক্লাসে উঠতে দিবেনা।

তাহি গালটা টেনে দিয়ে বললো,

– আপনি তো এখনো বেশ ছোট?

লিমন তাহিকে শক্ত করে চেপে ধরলো। বুকের সাথে মিশিয়ে অধরে অধর মিশিয়ে কিছুক্ষন পর বললো,

– আরেকবার বলুন আমি ছোট।

তাহি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

– অসভ্য।

লিমন গেয়ে উঠলো,

– আমার এই বাজে স্বভাব কোনো দিন যাবেনা।

___

দিনটা কে/টে ঘনিয়ে এসেছে অপ্রিয় সেই গোধূলি। যে লগ্নে কমান্ডার তার পরিবার ছাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ উপস্থিত। পরিবারের সবাই আজ ফিরে যাবে। শাহাদের জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়েছে বন্দরে। গাড়ি থেকে নেমেছে সবাই। দিয়ার এমন পাথুরে স্বভাব যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে শাহাদকে। গতকাল রাত থেকে মেয়েটা কথা বলছেনা। সকালে একসাথে সালাত আদায়ের সময় বলেছিলো,

– আমি কাল থেকে কার সাথে সালাত পড়বো শেহজার বাবা?

কিঞ্চিৎ হাসলো শাহাদ। উত্তর নেই তার কাছে। আবেগী হলে তো চলবেনা। ভাবনা থেকে বেরিয়ে কোলে তুলে নিলো সকলের সামনে প্রেয়সীকে। শেহজা চাচ্চুর কোলে। চুপসে যাওয়া দিয়া কেঁদে দিলো। সুলতানা কবির কাঁদছে। রায়হান সাহেব আড়ালে চোখ মুছলেন। সকলের চোখে পানি। এই যাত্রা ক’ মাসের জানা নেই। ধারনা অনুযায়ী কমপক্ষে ছ মাস। স্ত্রীকে কোলে নিয়ে নিজের রাজকীয় অভ্যর্থনা গ্রহন করে নামিয়ে দিলো। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বুকের সাথে আগলে বললো,

– বাবা আবার আসবো সোনা। ততদিনে আমার মা টা আরো বড় হবে।

শেহজা বাবাকে আঙ্গুল দিয়ে শিপ দেখাচ্ছে। শাহাদ মেয়ের গালে, মুখে,কপালে আদর করতে করতে একে একে মা বোনদের ধরলেন। শেফালী, শিফার কান্না থামছেনা। আবির মামার কোল ছাড়ছেনা। সকলের সাথে কথা শেষে বিদায় নিয়ে শিপে উঠার আগে দিয়ার কোলে মেয়েকে দিয়ে বললো,

– আমার কলিজা টা এখানেই থাকবে ফারাহ্ । যত্ন নিও।

বাবা- মায়ের হাতে স্ত্রী সন্তানের হাত দিয়ে বললেন,

– আমার আমানত রেখে গেলাম আব্বু আম্মু। আমার অনুপস্থিতিতে জালালে নাহয় একটু সহ্য করে নিবেন। আমি এলে সামলে নেব।

কেঁদে দিলেন সুলতানা। মাকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। দিয়ার মাথায় হাত রাখলো। দিয়া সকলের সামনেই মেয়ে কোলে নিয়ে স্বামীর পা ছুঁলো। শাহাদ উঠিয়ে ভুবন মাতানো হাসি উপহার দিয়ে বললো,

– ভালো থেকো।

আর পিছু ফিরলোনা। শিপ ছেড়ে দিলো। মেয়েটা এতক্ষন না বুঝলেও বাবা যখন দূরে যাচ্ছে বুঝতে পারলো চিৎকারে বন্দর কাঁপিয়ে তুললো। দূর থেকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। কিছুতেই থামছে না। শাহীন,পাভেল লিমন কেউ থামাতে পারছেনা। কোল থেকে নেমে যেতে চাচ্ছে। শিপ সরতে সরতে সকলে স্পষ্ট দেখছে শাহাদ কাঁদছে। চোখে জল, ঠোঁটের কোণে বিষাদগ্রস্ত হাসি। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে বাবা ছাড়া কিছুই বুঝেনি। বাবার অসুস্থতার সময়টাতে কয়েক মাসেই নেতিয়ে গিয়েছিলো। তখন অবুঝ ছিলো। এখন এই মেয়েকে সামলানো দায় হবে পরিবারের। শিপ অনেকখানি চলে গিয়েছে। আর দেখা যাচ্ছে না শাহাদের অবয়ব। সমুদ্র তার ‘কিং অভ ওয়েব’ কে নিজের টানে নিয়ে গেলো তার বাড়ি। আকাশে জলজল করছে তারাগুলো। পরিবারের মানুষদের চোখে আজ জল। গাড়িতে উঠতে উঠতে মেয়েটা ঘুমিয়েই পড়লো। ঘুমের মাঝে হেঁচকি তুলছে বাবা বাবা বলে। বাবা দাবো, বাবা তোলে নাও।

আবার কখন বাবার দেখা মিলবে?ক’ মাস নাকি কয়েক বছর? যাত্রা এখন অনির্দিষ্টকালের। পরিবারের সুখ তাদের থাকেনা। হাসি খুশি, বিপদ সব মিলিয়ে শাহাদের সুখী পরিবার আজ বিচ্ছিন্ন। ঝগড়াবিবাদ,খুনশুঁটি যাই হতো মিটিয়ে নিতো। তবুও মানুষটা কাছে থাকতো। আজ থেকে একেকটা রাত বিষাদে কাটবে। নতুন সংগ্রাম শুরু হবে। কে সামলাবে দিয়ার পাগলামি! কে আদরে আদরে মুড়িয়ে নিবে বিদেশীনিকে। রাতে বিরাতে ঘুম থেকে তুলে কে বলবে,
– আই ওয়ান্ট মাই বার্মিজ গ্রেইপ নাও।

কেউ না। কারণ বলার মানুষটাই যে বহুক্রোশ দূরে। সিন্ধুপারে। ক্লান্ত দিয়া মেয়ে বুকে নিয়ে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। গালে কান্নার দাগ। চেয়ে দেখছে শ্বাশুড়ি। এক হাতে বুকে আগলে নিলো ছেলের বউ এবং নাতনীকে। দুচোখ ভরা জল তার। মনে মনে বললো,

– বাবু তোর আমানত আমি রক্ষা করবো। দুজন আমার বুকে থাকবে, স্নেহে থাকবে, আশ্রয়ে থাকবে। তুই দেশ মাতার সমুদ্রকন্যাকে রক্ষা কর, আমি তোর সহধর্মিণী এবং কন্যাকে রক্ষা করবো ইনশাআল্লাহ।

___

স্পষ্ট ওরিয়ন। স্টার প্যাটার্ন। আজ আকাশে প্রতিটি তারা জ্বলছে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,

– রাশেদ তুই নেই আজ, আমাকে একাই ফিরতে হলো। তবে আমি সবসময় জেনে এসেছি তুই আমার পাশেই ছিলি, আছিস এবং থাকবি। যখনই দুশ্চিন্তা হবে তোকে ডাকবো। সাড়া দিস কিন্তু।

নিজে নিজে বিড়বিড় করে সামনে এগিয়ে জাহাজের কিনারায় এসে শাহাদ উচ্চস্বরে বললো,

– ফিরিয়ে আনলেই তোমার দুয়ারে তবে। থাকতে পারলেনা আমাকে ছাড়া। অবশ্য তুমি নিরুপায় তোমার ”কিং অভ ওয়েভ” ছাড়া। #সায়রে_গর্জন যে আর কেউ তুলতে পারেনা এ তোমার জানা সমুদ্র তনয়া। হতে পারো তুমি আকর্ষণীয়, থাকতে পারে তোমার আকাশে ঝিকিমিকি অসংখ্য তারা, থাকবে তোমার স্বচ্ছ জলরাশির প্রেমে মগ্ন অসংখ্য প্রেমিক , হবে তোমার গভীরতার বিশালতা অপরিমেয়। তবে আমার রানী তোমার চেয়ে ঢের দামী। তুমি বড্ড হিংসুটে সমুদ্রকন্যা। স্রোতের রাজাকে নিজের করে রাখতে কত মায়ায় জড়ালে। এসেছি তোমাকে রক্ষা করতে। তাই বলে ভেবোনা তোমায় ভালোবাসি। ভালোবাসি তো আমার বিশালতার উপমায় ভরা বিদেশীনিকে যার কাছে তুমি তুচ্ছ। সে আমার রাজ্যের সমুদ্রকন্যা। আর আমি তার সমুদ্র রাজ্যের রাজপুত্র। যার জোয়ারে আমি ভেসেছি বহু আগে, যার জন্য অবনী মায়া কা*টাতে প্রাণত্যাগ করতে হলেও সুখে আলিঙ্গন করবো ম*রণ ব্যাথা, পরকালে সেই হবে আমার প্রিয়া।

এক ঝটকায় স্রোত এসে ভিজিয়ে দিলো শাহাদকে। গর্জে, ফুলে ফেঁপে উঠলো সমুদ্র, ঢেউ আছড়ে পড়ছে শিপের ছাদে। আকাশ ধারণ করলো ভয়ংকর প্রলয়ঙ্কারী রূপ। নিমেষে কেমন যেন থমথমে পরিবর্তন। এ যেন সমুদ্র কন্যার ক্রোধ। উচ্চশব্দে হেসে বলে উঠলো,

– হা হা হা হা। তোমার রাগ আমি ভাঙাবোনা সমুদ্র কন্যা। যতই তুমি অভিমান করো। আমার অভিমানীনি তোমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে, যার গভীরতায় আমি বহু আগেই ডুবেছি। হিংসে হচ্ছে বুঝি আমার ভালোবাসা না পেয়ে। আমি তারই ভালোবাসার কাঙাল সর্বনাশীনি সমুদ্র। আটকে রাখার পরিকল্পনা যতই করো জলধি, ফিরে যাবোই আমার জলনিধির কাছে।

গেয়ে উঠলো,

– আমি আকাশে পাতিয়া কান
শুনেছি শুনেছি তোমারি গান
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ
ওগো বিদেশিনী
তুমি থাকো সিন্ধু পারে
ওগো বিদেশিনী।

সমাপ্ত।