উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা পর্ব-০১

0
5

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

পর পর তিনবার কবুল বলেই তাজ্জব হয়ে গেল পিয়া। বাবার বাধ্য মেয়ের মতো বিয়েতে রাজি হয়ে এতোক্ষণে সম্বিত ফিরে পেলো সে। কাজীর মুখ নিঃসৃত আলহামদুলিল্লাহ শুনে স্তম্ভিত, হতবাক, কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। আশপাশের এতো কোলাহল তার কর্ণকুহর স্পর্শ করতে পারছে না। বোধগম্য হচ্ছে না কে কি বলছে। অনুভূতিশূন্য এক মানবী। মাথার উপর ভনভন করে ঘুরছে একটা কথাই। সে বিবাহিত! সে বিবাহিত! অবিবাহিত নামক শব্দটা এখন তার অতীত। অবিবাহিত তকমাটা মাথার উপর থেকে বিলীন হয়ে গেছে। সে বিয়ে নামক দৃঢ় বন্ধনে বাঁধা পড়েছে সে। বড্ড শক্ত সেই অদৃশ্য বাঁধন। একটা অচেনা অজানা পুরুষের সাথে তার নাম জড়িয়ে গিয়েছে সারাজীবনের জন্য। একদিনের ব্যবধানে বদলে গেলো তার পরিচয় তার ঠিকানা।

হঠাৎ কারো স্পর্শে কেঁপে উঠল সে। মাথা উঁচিয়ে তাকায় সেদিকে। অক্ষিপটে ভাসলো কোনো এক মাঝবয়সী নারীর মুখশ্রী। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। অসম্ভব সুন্দর হাসির অধিকারী নারীর দিকে চেয়ে রইলো পলকহীন। মহিলাটির ঠোঁট নড়ছে। কিছু বলছেন তিনি। কিন্তু কি বলছেন? বোকার মতো চেয়ে রইলো নাযীফাহ। সহসা সেই নারী ললাটে মমতাময়ী উষ্ম স্পর্শ দিতেই হুঁশ ফিরে।

‘আমি তোমার আরেকটা মা।’

কথাটার পরিপ্রেক্ষিতে কি জবাব দেওয়া যায় বুঝে উঠতে পারলো না সে। বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো। হাসফাস করতে লাগল। এতটুকু বোধগম্য হলো নারীটি তার শ্বাশুড়ি।

ছোট ছোট দু’টো হাত পিয়ার পা ছুঁয়ে দিতে আঁতকে ওঠে পা জোড়া গুটিয়ে নিলো। দেখার জন্য একটু উঁকি দিতেই দৃষ্টিগোচর হলো একটা চাঁদের টুকরো। ফোকলা দাঁতে কিটকিটিয়ে হাসছে সে চাঁদ। পিয়া অনুভব করলো আজকের দিনে সবচেয়ে সুন্দর, মোহনীয় দৃশ্য এটা।মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। তার ওষ্ঠ যুগলও বিস্তীর্ণ হলো। অপটু হাতে বিছানার চাদর খামছে ধরে দুলছে সে।

‘মিষ্টি আমায় কিন্তু ভীষণ জ্বালাচ্ছো। এখন কিন্তু আমি রাগ করবো।’

মিষ্টি শাসনে সে বিছানার চেপে উপর উঠে আসার চেষ্টা চালালো। ছোট্ট পা জোড়া বিছানা অব্দি এলো না। পিয়া হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো। অসাধ্য যেন সাধন করলো ছোট্ট মেয়েটা।

‘আশকারা দিও না। তাহলে তোমায় জ্বালিয়ে মা’রবে। পুরো বাপের ফটোকপি।’

পিয়ার থেকে বয়সে চার কি পাঁচ বছরের বড় একজন বলে উঠলো কথাটা। চেহেরার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার শ্বাশুড়ির সাথে মেয়েটির চেহেরার মিল আছে। ধরে নিলো এটা তার ননদ কিংবা ননস হবে। কিছু না বলে মিষ্টির দিকে মনোযোগ দিলো সে। অপরিচিত হয়েও কিভাবে লেপ্টে আছে বুকের সাথে। যেন কত বছরের চেনা।

___________________

লম্বা ঘোমটা টেনে উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছে পিয়া। পিছনে এক পুরুষের উপস্থিতি ক্ষনে ক্ষনে কাঁপিয়ে তুলছে তার কায়া। বুক দুরুদুরু করছে। প্রগাঢ় ত্রপায় নাক কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অন্তঃস্থলে নাম না জানা এক অনুভূতির আনাগোনা।

‘আপনার বরকে একবার দেখবেন না?’

অতর্কিত প্রশ্নে চমৎকৃত হলো পিয়া। ধুকপুকানির নিনাদ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। জিহবায় কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। ডানে বামে মাথা ঝাঁকায় সে। সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় প্রশ্ন শুনতে পেলো,

‘কেন? বর পছন্দ হয়নি বুঝি?’

জিহবা দিয়ে ওষ্ঠ যুগল ভিজিয়ে নিলো সে। কম্পমান গলায় মৃদু শব্দে বলল,

‘দেখতে খারাপ হলেও সে আমার বর। ভালো হলেও সে আমার বর।’

‘তবে দেখবেন না কেন?’

জবাব দিলো না সে। নিরুত্তর, নিসাড় হয়ে বসে রইলো।

‘আপনি জানেন না সঙ্গীর দিকে প্রেম নিয়ে তাকালেও সাওয়াব হয়।’

কথাটা তেমন একটা প্রভাব ফেলল না পিয়ার উপর। মন্থর, নিষ্ক্রিয় রইলো। হাত কচলাচ্ছে সে।

‘দেখি এদিকে একটু ফিরুন তো। আপনার তো সাওয়াব লাগবে না। কিন্তু আমার লাগবে। আমি আমার বিবিজানকে দেখে সাওয়াবের পাল্লা একটু ভারী করি।’

ভীষণ অপ্রস্তুত হলো পিয়া। বাক্যটায় অশ্লীলতা লেসমাত্র নেই। তারপরও তার মনে হলো লোকটা ঠোঁটকাটা, লাগামহীন। মুখে কিছু আটকায় না। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গুটিয়ে নিলো নিজেকে। দেয়াল ঘেঁষল।

‘আপনাকে এদিকে ফিরতে বলেছি। আর আপনি তো দেখছি দেয়াল ভেদ করে পাশের রুমে চলে যাচ্ছেন।’

লজ্জারা ভীর জমালো পিয়ার চোখেমুখে। লাল হলো নাকে ডগা।উপলব্ধি করলো পুরুষটি তার নিকটে আসছে। এক পা এক পা তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমছে। বাড়ছে সান্নিধ্য। পিয়া’র নিঃশ্বাসের গতি বাড়ছে। মৃগী রোগীর ন্যায় হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। তার হাতটা পুরুষালি হাতের ছোঁয়া পেতেই বরফের ন্যায় জমে গেলো একেবারে। নিঃশ্বাস আটকে এলো নাসিকায়। নতুন এক অনুভূতির আগমন ঘটেছে কায়া জুড়ে। তর্জনীতে আংটির পড়িয়ে দিচ্ছে মানুষটা। নিষ্প্রভ, বিহ্বল চোখে এলোমেলো নেত্রপাত করলো। অপ্রস্তুত হাত টান দিতেই মানুষটা ঘোরলাগা কন্ঠে বলল,

‘নড়বেন না, প্লিজ।’

মানুষটার গরম নিঃশ্বাসে জড়বস্তুর ন্যায় অনড়, নিশ্চল বসে রইলো নাযীফাহ। নিঃশ্বাসও নিচ্ছে না।

পিয়ার মুখোমুখি বসে ঘোমটার আড়াল হতে মুখটা হাতের আঁজলে নিলো। পিয়া এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে তৎক্ষনাৎ। অস্বস্তিতে অবস্থা নাজেহাল। একটা পুরুষের এতো কাছাকাছি সে কখনো যায়নি।

‘তাকান আমার দিকে।’

পিয়া শুনলো না কথা। তাকালো না তার দিকে। তিরতির করে কাঁপছে কন্ঠনালী আর ওষ্ঠ জোড়া। জড়োসড়ো হয়ে মিইয়ে গেলো আরো একটু। অনুভব করলো তার বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছে। পানির অভাবে গলা শুকিয়ে কাঠ। এক ফোঁটা পানি না পেলে এখনই সে মা’রা যাবে। প্রান পাখি এখনই উড়াল দিবে খোলা অন্তরীক্ষে। দৈবাৎ ললাটে মোহময় স্পর্শ পেয়ে কম্পিত হলো সর্বাঙ্গ। গা হাত পা ছেড়ে দিলো তার। শিরদাঁড়া বেয়ে প্রবাহিত হলো তরল স্রোত। অজানা অনুভূতিতে শিহরিত হলো গা। চকিত, ভীত সন্ত্রস্ত চক্ষু জোড়া আবদ্ধ হলো মানুষটার চঞ্চল চক্ষে। সুদীপ্ত হাসলো পাশের মানুষটা।

‘এগুলো তানভীরের নামের সিলমোহর। আপনি যতবার আপনার আঙুলের দিকে তাকাবেন ততবার আপনার হাত আপনার কপাল ছুঁবে। আপনি অনুভব করবেন আপনার স্বামীর প্রেমময়ী প্রথম স্পর্শ।’

পিয়া মনে মনে বার কয়েক নামটা আওড়াল, ‘তানভীর! এই তানভীর নামক মানুষটার অর্ধাঙ্গী সে।’

‘আপনাকে নিজের করে এখানে রেখে গেলাম। আমি আবারও আসবো। বরবেশে। আপনাকে সাদা মাটা না রানীর মতো সাজিয়ে নিয়ে যাবো আমার ছোট্ট সাম্রাজ্যে।’

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় তানভীর। পিয়া এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে যেন সব হয়ে গেলো।অক্ষিবিভ্রম এখনো কাটছে না।বিছানার উপর বসা হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমুঢ় রমনীকে দেখে হাসলো তানভীর। দরজার কাছে গিয়ে আবারও পিয়াকে ডাকলো তানভীর।

‘শুনুন?’

আকস্মিক ডাকে ভড়কে গেল পিয়া। ঘাড় কাত করে চাইলো।

‘আমার রাজমহিষীকে আপনার আমানতে রেখে গেলাম। তার একটু যত্ন নিবেন ঠিক আছে?’

পিয়াও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। পরক্ষনে নিজের বোকামি আর অকিঁচনতা বুঝতে পেরে হতবুদ্ধি হয়ে গেলো সে। জিভে কামড় দিয়ে তড়িঘড়ি করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।

পিয়ার এহেম কান্ড দেখে ফিক করে হেসে ফেলল তানভীর। নাযীফাহ কে অপ্রস্তুত করতে পেরে যেন মজা পেল। হাসির নিনাদে পিয়ার লজ্জার মাত্রা আরো একটু বেড়ে গেলো।

_________________

নিজের ছোট্ট আলমারি থেকে এক এক করে সবগুলো কাপড় ভাঁজ করে ট্রলিতে নিলো পিয়া। ট্রলি নিয়ে বসার ঘরে পা রাখতেই পেপার থেকে মুখ সরিয়ে বেলাল শেখ প্রশ্ন করলেন,

‘সাত সকালে এতো বড় ট্রলি নিয়ে কোথায় যাও?’

পিয়া মুখ কালো করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

‘মাথার উপর বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম বলেই তো মিথ্যে অসুস্থতার কথা বলে এনে অপরিচিত লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছো। মিডটার্ম শেষ হলে এতো বড় ট্রলি নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠবো। তোমার বাড়িতে আর আসবো না।’

‘তোর বাপের সাথে যখন আমার বিয়ে হয়েছিল তখন তিনিও আমার অপরিচিতই ছিলো। আমি কি সংসার করিনি? তোদের দুই ভাইবোন কে জন্ম দেইনি?’

ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো পিয়া।

‘ ওটা নব্বই দশকের ঘটনা। এখন যুগ পাল্টেছে।’

‘বিয়ে হয়েছে এখন আস্তে আস্তে চিনে যাবি।’

‘তাই বলে ধরে বেঁধে একটা বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে? এখন আমি হলে গিয়ে বান্ধবীদের কি বলবো? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি বিবাহিত মহিলা। আমার বর দেখতে বুড়ো?

বুড়ো শব্দটা শুনে বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেলো শিরিন আহমেদ আর বেলাল শেখের। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দুজনেই।

‘বলতে ইচ্ছে না হলে বলো না। অনুষ্ঠান যখন হবে তখন সবাইকে জানিও।

‘কেন বলবো না কেন? আমি চিৎকার করে বলবো আমি বিবাহিত। আর সবাইকে বলবো ওই অপরিচিত লোক কে ট্রিট দেওয়ার জন্য পাগল করে ফেলে।’

‘আচ্ছা সবাইকেই বলো। কেউ নিষেধ করেনি বলতে। এখন খেয়ে তারপর বাসা থেকে বেরুবে। শিরিন টেবিলে নাস্তা দাও।’

‘খাবো না তোমার টাকায় কেনা খাবার। তুমি টাকায় খাই বলেই তো বিয়ে দিয়ে আমাকে পর করে দিয়েছো।’

‘তাহলে জামা কাপড়ও রেখে যাও। সেগুলোও আমার টাকায় কেনা।’

পিয়ার কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, ‘তো?’

বলেই হনহনিয়ের বেরিয়ে গেলো।

পাঁচ মিনিটও গেলো না। এর আগেই পিয়া একহাতে ট্রলি আর অন্য হাতে নাক মুছতে মুছতে ভেতরে ঢুকলো।

কান্নার ফ্যাঁচফ্যাঁচ শব্দে সামনে চাইলেন বেলাল শেখ। মেয়েকে কাঁদতে দেখে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো উনার। পেপার ফেলে ব্যতিব্যস্ত হাতে মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন তিনি। একেকটা হেঁচকি বুকে গিয়ে বিঁধছে খুব সূক্ষ্মভাবে।বড্ড অপরাধবোধ হচ্ছে। মাথার উপর ঘুরপাক খেতে লাগলো একটা কথাই, বিয়েটা দিয়ে কোনো ভুল করে ফেললেন না তো?

চলবে।