উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা পর্ব-০৫

0
4

#উষ্ণ_আঁচে_ভালোবাসা (০৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

গভীর নিস্তব্ধ রাত। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে সবাই। হঠাৎই কান্নার গুনগুন শব্দ পেয়ে ঘুম হালকা হয়ে আসে পিয়ার। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল সে। আবছা আলোয় কক্ষের সবকিছুই অস্পষ্ট। কান্নার সেই গুনগুন শব্দটা ঈষৎ ভয়ের সৃষ্টি করছে মনে। ফাঁকা ঢোক গিলে বিছানার অপর পাশ হাতরায় তানিয়াকে ডাকার জন্য। একি? বিছানা ফাঁকা! এবারে ভয়টা যেন আরো গাঢ় হল। তড়িঘড়ি করে শুয়া থেকে উঠে বসে সে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে পাওয়ার বাটন অন করল। রাতের এই নিস্তব্ধতা ২টা ২৯ এর ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। পলক ফেলার সাথে সাথে ২৯ হয়ে গেল ৩০। মানে এখন বাজে আড়াইটা। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে পুরো রুম নজর বুলায় পিয়া। কোথাও তানিয়ার অস্তিত্ব নেই। ওয়াশরুমের দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ। তাই ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বালিশের পাশে রাখা ওড়না ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামল সে। বুকে সাহস সঞ্চার করে একটু একটু করে সেই শব্দের দিকে অগ্রসর হয়। শব্দটা বারান্দা থেকে আসছে। চাপিয়ে রাখা দরজাটা হালকা ধাক্কা দিতেই অবাক হয়ে গেলো পিয়া। কনকনে এই শীতের রাতে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে হেঁচকি তুলে কেঁদে চলেছে তানিয়া। মোবাইলের আলো তানিয়ার দিকে তাক করতেই হুড়মুড় করে দাঁড়িয়ে গেল সে। তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে জানতে চাইল,

‘এখনো ঘুমোসনি তুই?’

পিয়া জবাব দেয় না। ঘুম জড়ানো চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে তানিয়ার কান্নাভেজা মুখের দিকে। টকটকে লাল চোখ। ভেজা আঁখি পল্লব। ফোলা ফোলা চোখের কোটর। নাকের ডগা লাল। কান্নার প্রকোপে ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তিরতির করে।

কয়েক সেকেন্ড অবলোকন করার জন্য প্রশ্নের পিঠে উল্টো প্রশ্ন করল,

‘কাঁদছিস কেন তুই?’

তানিয়া জোর করে হাসার চেষ্টা করে। নাক টেনে মলিন স্বরে জবাব দিল,

‘কোথায় কাঁদছি? পরীক্ষার টেনশনে ঘুম হচ্ছে না। তাই এমন লাগছে। আর আজ যা শীত। ঠান্ডায় দেখ গলা বসে গেছে। চল চল ঘুমাবি চল।’

বলেই পিয়ার হাত ধরে রুম নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু একচুল নড়াতে পারল না। ভ্রু কুঞ্চিত করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

‘কিরে চল রুমে। কত রাত হলো দেখেছিস? আয় আয় ঘুমাবি। আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।’

পিয়া কঠিন গলায় বলল,

‘আমি এতোটাও অবুঝ নই যে তুই আমাকে নয়ছয় দিয়ে বুঝ দিবি আর আমি বুঝে যাবো। ঘটনা কি খুলে বল।’

পিয়ার হাত ছেড়ে দেয় তানিয়া। পিয়া যে হাল ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয় সেটা খুব ভালো করেই জানে সে। রাত পার করে হলেও সত্যটা টেনে বের করে আনবে। পিয়ার কাছে হার মানল সে।

বারান্দার গ্রিলে হাত রাখল তানিয়া। অতিবাহিত হয় কয়েক মিনিট। আচমকাই ফুঁপিয়ে ওঠে পিয়াকে দু’হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

‘ পিয়ারে আমি যে মাঝ সমুদ্রে এসে হাবুডুবু খাচ্ছি। কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এই বুঝি মা°রা যাবো আমি।’

সস্নেহে তানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

‘এইভাবে ভেঙে পড়লে চলে? কি হয়েছে খুলে বল।’

পিয়া কে ছেড়ে দূরে দাঁড়ায় তানিয়া। উল্টো হাতে চোখের পানি মুছে নেয় সে।

‘আব্বা বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে। এই অভাব অনটনের সংসারে আমার পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া আব্বার পক্ষে সম্ভব না। বাড়ি যেতে বলছে আমাকে। ভালো একটা বিয়ের সম্বন্ধ নাকি এসেছে। কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।’

‘তুহিন ভাইকে বলেছিস সবকিছু?’

‘বলেছি।’

‘ভাইয়া কি বলল?’

‘ও আর কি বলবে? মাস্টার্স শেষ করে ঘুরছে। একটা চাকরি যোগাড় করতে পারছে না। মানুষ তো ছোটোখাটো কিছু একটা করে। বিয়ের কথা বলাতে বলে আমি যেন দুই লাখ টাকা যোগাড় করে দেই ও একটা ব্যবসা করবে। পরে ফেরত দিয়ে দিবে টাকা। আমি দুই লাখ টাকা কোথায় পাবো বল? আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত আব্বা আমাদের তিন ভাইবোনের পড়াশোনা চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে। এই শহরে থেকে পড়াশোনা করা কতটা কঠিন তুই তো জানিস। দুটো টিউশনি করে কোনো রকম টিকে আছি। সেখানে দুই লক্ষ টাকা তো আমার কাছে সোনার হরিণের মতো।’

পিয়া কাঠ কাঠ গলায় বলে,

‘ছেড়ে দে তুই তুহিন ভাইকে।’

দু’কদম পিছিয়ে গেল তানিয়া। অবাক কন্ঠে বলল,

‘পাগল তুই? তুই তো জানিস আমি তুহিন কে কতটা চাই। ওকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে? আমার তো ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে।’

‘তাহলে দুই লাখ টাকা ম্যানেজ করে দিয়ে দে।’

‘এতো টাকা আমি কোথায় পাবো? আর বাবাকেই বা কি বলবো বুঝতেছি না। আমি জানি এবার গেলে আমার সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যাবে।’

এগিয়ে এসে পিয়ার হাত দু’টো মুঠোবন্দি করে নিল। অনুনয় করে বলল,

‘বোন একটা বুদ্ধি দে না। আমি এই উভয় সংকট কিভাবে এড়াবো?’

‘উপায় দুইটা।’

চকচক করে উঠে তানিয়ার চোখ জোড়া। ভালো কিছু শোনার আশায় প্রশ্ন করল,

‘কী?’

‘হয় তুহিন ভাইকে দুই লাখ টাকা দে। আর না হয় আঙ্কেলের কথামতো আঙ্কেলের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নে।’

মুহুর্তেই মুখটা ম্লান হয়ে যায় তানিয়ার। ভেবেছিল একটা না একটা পথ খুঁজে পেয়েছে। সেই আশার আলোও ধপ করে নিভে গেল। অসহায় মুখেই রুমে চলে গেল। যেতে যেতে শুনতে পেল,

‘যে প্রেমিক প্রেমিকা বিয়ের কথা বললে নিঃসঙ্কোচে টাকার কথা বলতে পারে আর যাইহোক সে প্রেমিক ভালোবাসে না। ভালোবাসা মানে সময়ে অসময়ে ভালোবাসার মানুষটার হাত শক্ত করে ধরে রাখা।’

কি বলবে তানিয়া ভেবে পেল না। হয়তো বা কথাগুলোর ফিরতি কোনো উত্তর তার কাছে নেই। গুটিসুটি হয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল।

পিয়াও চুপচাপ নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়ল। প্রাণপ্রিয় দুই বান্ধবী রইল নীরব। তবে মাঝে মাঝে একজন হেঁচকি দিচ্ছে। আরেকজন ফেলছে দীর্ঘশ্বাস।

পিয়ার মোবাইলের মেসেজ টিউন বেজে উঠল। সিম কোম্পানির মেসেজ ভেবে এড়িয়ে গেল সে। পাশ ফিরতেই পুনরায় বেজে উঠল টিউন। কৌতূহল জাগে তার। এতো রাতে কি আসলেই কি সিম কোম্পানির মেসেজ এসেছে?

‘ঠাঁ ঠাঁ গ্রীষ্মের ভরদুপুরে একজন পথিক যতটা তৃষ্ণার্ত থাকে ঠিক সেই রকম কেউ একজনের ভীষণ মন তৃষ্ণার্ত তার রাজমহিষীর কন্ঠস্বর শোনার জন্য। রাজমহিষী কি মিটাবে সেই কেউ একজনের তৃষ্ণা?’

‘পিপাসার্ত মন কি একটু তৃপ্তি পাবে?’

বিড়বিড় করে পড়তে পড়তে আনমনে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয় পিয়ার। যেন কোনো এক উদভ্রান্ত প্রেমিক অসহায়ের মতো তার প্রেমিকাকে অনুরোধ করছে একটু কথা বলার জন্য। অথচ লোকটার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এভাবে বলার প্রয়োজন নেই।

মোবাইল বুকের রেখে আবেশে চোখ বুঁজে ফেলল সে। করুন এই অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই। এই অনুরোধ উপেক্ষা করা মানে কোনো এক পরিশ্রান্ত বিকেলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে অনুরোধ না রাখার দহনে পুড়া। ইশ! আফসোস! এই আফসোস সে করতে পারবে না।

অতি সন্তর্পণে, গুটি গুটি পায়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায় পিয়া। বুক ধড়ফড় করছে। হৃদকম্পন বাড়ছে। কী বলবে সে প্রথমে? সালাম দিবে নাকি অন্যকিছু বলবে? ভাবতে ভাবতে নম্বরটায় ডায়াল করে। কি আশ্চর্য! একবার রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ হয়ে গেল। লজ্জায়, ত্রপায় চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখল। অথচ তার সামনে কেউ নেই। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে নিজেকেই দেখা যাচ্ছে না ভালো করে।

সময় গড়ায়। এক সেকেন্ড দুই সেকেন্ড করে অতিক্রান্ত হয় ত্রিশ সেকেন্ড। কেউ কোনো কথা বলছে না। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নেয় পিয়া। অতঃপর সব নীরবতা ডিঙিয়ে কম্পমান গলায় কয়েকবার থেমে থেমে বলল,

‘আস,,,, সালা,,, মু,,,আলাই,,কুম।’

সালাম খানাই মুখ দিয়ে বের হলো। আর কোনো শব্দ বের করতে পারল। কি আশ্চর্য! লোকটার সংস্পর্শে কখনো লজ্জায় নুয়ে পড়ে সে। কখনো হয় অভিমান। আবার কখনো বা তেজী সিংহীর মতো গর্জন দিয়ে ওঠে। কেন এই মিশ্র আচরণ? কেন এই এলোমেলো অনুভূতি? সে কেবল ফোনেই কথা বলছে। এখানে তো এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তাদের সামনাসামনি দেখাও হয়েছে। তবে কি এই লোকটার কথাই সত্যি? সে একটু একটু করে এই লোকটার প্রেমে পরছে? প্রেমে পরার অনুভূতি এমন? এলোমেলো করে দেয় মানুষকে?

ভাবনার মাঝেই তাকে আরো একটু এলোমেলো দেয় ঘুম জড়ানো পুরুষালি কণ্ঠ।

‘ভালোবাসি।’

#চলবে