#লেবু
৩৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বিপ বিপ শব্দ কানে আসছে। দৃষ্টি তার অতিরিক্ত ঝাপসা। তবুও চোখ দুটো আশেপাশে বুলিয়ে দেখলো সাবা। একেকটা নিঃশ্বাস যেন একেকটা যুদ্ধের সমান। সাবা নড়ার চেষ্টা করলো কিন্তু তিল পরিমাণ নড়তে পারলো না। তার শরীরটা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে অদৃশ্য শিকল দিয়ে। সেই সঙ্গে কাঁধে আর বুকে অনুভূত হলো তীব্র ব্যথা। ভারী নিঃশ্বাস তার ঠোঁট দুটো থেকে বেরিয়ে এলো।
নীলচে একটা আলো তার আবছা দৃষ্টি ভেদ করে চোখে এসে লাগলো। বড় বড় সাদা দেয়াল, হালকা নীল পর্দা, অচেনা কতগুলো যন্ত্রপাতি – সবই এলো চোখের সীমানায়।
দৃষ্টির মতো সাবার মস্তিষ্কেও আবছা একটা ঘোর। কিছু ভাবার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে। অন্য সময় হলে হয়ত তার মনে প্রশ্ন জগতো, “আমি কোথায়?” আজ তাও জাগলো না।
হঠাৎ ঝড়ের গতিতে একটার পর একটা দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
“সেজন্যেই শোধ তুললে?”
“শোধ এখনো তুলিনি তো! এখন তুলবো।”
বিকট শব্দ, অসহনীয় ব্যথা, র/ক্তে চারপাশ তলিয়ে যাওয়া, তার মাটিতে লুটিয়ে পড়া। সাবার একবার সন্দেহ হলো নিজের অস্তিত্বের ওপর। সে কি আদৌ বেঁচে আছে? এটা কি তার চিরচেনা পৃথিবী? নাকি ভিন্ন কোনো জগৎ?
আর কিছুই ভাবতে পারলো না সাবা। চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বোধ হয় সত্যিই সে হারিয়ে ফেলেছে। সত্যিই বোধ এটা ভিন্ন কোনো এক জগৎ। আবারও বন্ধ হয়ে গেল তার চোখ দুটো।
ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে সরাসরি সাবার আইসিইউর দরজা। সেদিকেই জহুরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে শাফকাত। গত তিন দিন ধরে ওই দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুতেই শান্তি খুঁজে পায়নি সে। সাবাকে কাছ থেকে আরও একবার দেখার সুযোগ পেয়েছিল। দূর থেকে দেখতে না পেলেও, মনটা সর্বক্ষণ তার চিন্তাতেই ডুবে আছে।
শাফকাত হঠাৎ লক্ষ্য করলো আইসিইউর বাইরে শোরগোল বেড়েছে। ডক্টর আফরোজা নিচতলা থেকে এসে ব্যস্ত পায়ে প্রবেশ করলেন। একটু পর পর কয়েকজন নার্স ভেতরে প্রবেশ করছে, আবার বেরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আবারও প্রবেশ করছে আইসিউর ভেতরে। চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠলো শাফকাতের কপালে।
শাফকাত তড়িৎ গতিতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো আইসিইউর দিকে। ততক্ষণে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একজন নার্স। তার চোখে মুখে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। ডক্টর আর নার্সদের আকস্মিক এই ব্যস্ততা শাফকাতের বুকে নিমিষেই ঝড় তুলল। সাবা ঠিক আছে তো? ডক্টর তো বলেছিল মেয়েটা এখন শঙ্কামুক্ত। তাহলে এই ছোটাছুটি, ব্যস্ততা কীসের?
সাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছে আজ চারদিন হলো। চারদিন আগেই শেষ স্বাভাবিক নিঃশ্বাস ফেলেছিল শাফকাত। চারদিন ধরে তার প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস পাথর সমান ভারী। একেকবার সেই নিঃশ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে একটু একটু করে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে যেন ভেতরটাকে।
শাফকাত উদ্বিগ্ন গলায় কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সেই নার্স ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “ম্যামের জ্ঞান ফিরেছে। উনি খুব ভয় পাচ্ছেন। হার্টবিট অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।”
একই সঙ্গে কতশত অনুভূতি যে স্পর্শ করলো শাফকাতকে সে নিজেই বুঝে উঠতে পারলো না। সাবার জ্ঞান ফেরায় স্বস্তি, তার ভয়ে উদ্বেগ, দু চোখ ভরে তাকে দেখার আকুলতা – একেক অনুভূতির একেক তীব্রতায় দিশেহারা হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো শাফকাত। তার হৃদস্পন্দন এক লাফে বেড়ে গেছে, টের পাচ্ছে শাফকাত। তবুও বাড়ন্ত হৃদস্পন্দনকে শান্ত করার কোনো প্রয়াস তার মাঝে নেই।
আইসিউর ভেতরে পা রাখতেই শাফকাতের চোখ গেল সাবার দিকে। ব্যস্ত ভঙ্গিমায় হাঁটতে থাকা নার্স বা মনিটরের দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ডক্টর – কোনো কিছুতেই দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন বোধ করলো না।
লম্বা লম্বা পা ফেলে সাবার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শাফকাত। মেয়েটার আধবোজা চোখ দুটো তিরতির করে কাঁপছে। একটু পর পর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মনিটরে বিপের ঊর্ধ্বগতি তার বাড়ন্ত হৃদস্পন্দনের জানান দিচ্ছে।
সাবার চোখ দুটো শাফকাতের ওপর পড়তেই বন্ধ হয়ে গেল তার সকল অস্থিরতা। শাফকাত সাবাকে শান্ত করবে কী? নিজেই কেমন অশান্ত হয়ে পড়লো মুহূর্তেই। আজ কতদিন পর ওই চোখ দুটো দেখছে সে।
শাফকাতকে দেখে সাবার ভয় কমলো না বাড়লো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বেড়ে যাওয়ারই তো কথা। যে অবস্থায় সে জ্ঞান হারিয়েছিল, সে অবস্থায় শাফকাতই তো ছিল তার সব থেকে বড় ভয়ের কারণ। সাবা হয়ত মনে মনে ভাবছে, এই খারাপ মানুষটা এই মুহূর্তে তাকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার জন্যে শাস্তি দেবে।
ভয় পেলেও চোখ দুটো সরিয়ে নিলো না সাবা, বুজেও ফেলল না। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। যে মানুষটাকে সে ভয় পাচ্ছে, হয়ত তার মাঝেই আবার দেখতে পাচ্ছে ভরসার ক্ষীণ আলো।
শাফকাত সাবার বাম হাতটা আলতো করে ধরলো। দাঁড়িয়ে থেকেই তার কপালের ওপর ঝুঁকে নিজের ঠোঁটের শীতল স্পর্শ দিলো। এই পুরুষের কাছ থেকে এমন গাঢ় স্পর্শ আগেও একবার পেয়েছিল সে। সেদিন যেমন অস্বস্তি লাগেনি, আজও লাগলো না। অবশ্য অস্বস্তি কিংবা অন্য যেকোনো অনুভূতি অনুভবের পর্যায়ে সে নেই।
শাফকাত সাবার কানের কাছে কম্পিত কিন্তু নীচু গলায় বলল, “সাবা? কোনো ভয় নেই তোমার। আমি আছি তো!”
কী অদ্ভুত ব্যাপার! যে মানুষটার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে সাবা জীবনের ঝুঁকি নিলো, আজ সেই মানুষের উপস্থিতিই তাকে স্বস্তি দিচ্ছে, ভয় পেতে দিচ্ছে না।
বিচিত্র এক ঘোরের মাঝে ডুবে আছে সাবা। এই ঘোরে সারা পৃথিবীটাকেই এতক্ষণ বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছিল। চোখ বুজতেও করছিল মারাত্মক ভয়। কিন্তু শাফকাত পাশে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভয়গুলো সব পালিয়ে গেল ভয় পেয়ে। সাবা জানে, চোখ বুজলেও এখন নিরাপদে থাকবে সে।
চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল সাবার। মিনিট দশেকের মধ্যেই আবারও স্বাভাবিক হয়ে গেল তার শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দনের গতি। ডক্টর, নার্সরা চলে গেল। শাফকাত আরও বেশ কিছুক্ষণ রইলো মেয়েটার সঙ্গে। পুরোটা সময় তার হাতটা আলতো করে ধরে রেখে, আর মায়াভরা মুখটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে।
এই মেয়েটার ক্ষমতা যে কতটা প্রবল সে নিজেও জানে না। পাহাড়ের ন্যায় দৃঢ় শাফকাতকে মোমবাতির মতো গলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সে রাখে। অনুভূতিহীন যন্ত্রের অনুরূপ শাফকাতকে অনুভূতির মাতাল করা হাওয়ায় ভাসিয়ে পাগল করে তোলার ক্ষমতা সে রাখে।
সাবার ভেন্টিলেশন খুলে নেওয়া হলো আরও দু দিন পর। নিজে থেকেই স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে পারছে সে। জ্ঞান ফিরলেও দুদিন ধরে ঘোরের মধ্যেই আছে। আজ সাবাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।
যদিও এখনো সম্পূর্ণ জ্ঞান তার নেই। চোখ মেলে দুর্বল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। আশার কথা হলো তার মস্তিষ্ক সচলভাবে কাজ করতে পারছে। ডক্টররা সকালবেলা দুয়েকটা প্রশ্ন করায় মাথা নেড়ে উত্তর সে দিতে পেরেছিল।
পরিবারের মানুষেরা সাবার সঙ্গে দেখা করেছে। হাতে হাত রেখে আশ্বাস দিয়েছে, “আমরা তোমার কাছেই আছি।” যদিও সাবা সাড়া দিতে পারছে, তবুও তাকে কেউই বেশি কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তার মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করে এমন কাজ করা যাবে না।
ওই গুলি দুটোতে সাবার শরীর যেমন ভেঙে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে মস্তিষ্কও। এমন ঘটনায় মস্তিষ্ক প্রচণ্ড শক পায়। স্বাভাবিক হতে তাদের অনেকটা সময় লাগে। সাবা তো তবুও সাড়া দিতে পারছে, চোখ মেলে তাকাচ্ছে। অনেক সময় রোগী এই প্রচণ্ড শকে সাড়াই দিতে পারে না।
অনেকটা সময় লাগবে মেয়েটার পুরোপুরি সুস্থ হতে। এ মাসটা তার হসপিটালেই কাটবে। সামনের মাসেও বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা ডক্টররা দিতে পারেননি।
সকাল থেকে সাবার পাশে ফাহমিদা বেগম ছিলেন। যদিও পুরোটা সময় সাবা ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। শাফকাত ফাহমিদা বেগমকে বিশ্রামের জন্যে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।
পরিবারের সকলেই দিনের কোনো না কোনো সময়ে বাড়িতে যাচ্ছে। বিশ্রাম নিতে, ফ্রেশ হয়ে আবারও ফিরে আসছে হসপিটালে। যাচ্ছে না কেবল শাফকাত। আর অফিস যে কাকে বলে, তার আদৌ মনে আছে কিনা সন্দেহ!
আতিয়া আলম প্রথম প্রথম তাকে বাড়িতে পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। এখন হার মেনে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বেশ বুঝতে পারছেন, পুত্রবধূ সুস্থ হলেই তার নাছোড়বান্দা পুত্র বাড়ি ফিরবে।
ফাহমিদা বেগম চলে যেতেই সাবার বেডের পাশে থাকা চেয়ারটায় নিঃশব্দে বসলো। সাবার জ্ঞান ফেরার পর থেকে এই প্রথম তাকে
জাগ্রত অবস্থায় পাওয়া গেল।
শাফকাত আলতো স্পর্শে একটা হাত রাখলো সাবার কপালে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো কিছুক্ষণ। সাবাও প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে রইলো।
হঠাৎ শাফকাতের চোখে পড়লো ব্যান্ডেজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সাবার বুকের ওপরের দিকে ক্ষতচিহ্নটা। শাফকাত আলতোভাবে দুটো আঙুল বোলালো ব্যান্ডেজের এক প্রান্তে।
এই স্পর্শে হঠাৎ মৃদু শিউরে উঠলো সাবা।
শাফকাত নীরবতা ভঙ্গ করে নরম স্বরে বলল, “ব্যথা লাগে?”
সাবা কয়েক মুহূর্ত পর দুর্বলভাবে না-সূচক মাথা নাড়লো। ফের চোখ দুটো বুজে ফেলবে, তার আগেই শুনতে পেলো শাফকাতের ডাক।
“সাবা?”
সাবা তাকালো শাফকাতের চোখের দিকে। অব্যক্ত কতশত কথা যে ওই চোখ দুটো ফুটে উঠেছে! সে কথা উপলব্ধির পর্যায়ে সাবা নেই। তবুও কথাগুলো যেন এসে বাসা বাঁধলো তার বুকের ভেতরে।
“এত ঘৃণা করো আমাকে?”
শাফকাতের কণ্ঠে একরাশ অভিমান, একরাশ আক্ষেপ। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী শাফকাত
আলমের কণ্ঠের এই তীব্র কম্পন আগে কেউ কখনো শোনেনি।
সাবা কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। সাবার চোখ দুটো একইসঙ্গে ফুটে উঠেছে অনুতাপ আর ভয়।
তাদের অগ্রাহ্য করে শাফকাত নরম স্পর্শে সাবার হাতটা ধরে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “খুব কষ্ট হয় না আমার সাথে থাকতে? দমবন্ধ লাগে?”
আসলেই তো! সাবা তার সঙ্গে থাকতে দমবন্ধ লাগতো বলেই তো অত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু শাফকাতের অভিমানী এ কণ্ঠে সেই কথা বড্ড বেমানান, যন্ত্রণাদায়ক।
শাফকাত মলিন হাসি হেসে সাবার কপালে চুমু খেলো।
ক্ষীণ গলায় বলল, “থাক! এত কষ্ট আর পেতে হবে না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও, তারপর আমি নিজে তোমাকে মুক্তি দেবো।”
সাবা চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। কথা বলার মতো অবস্থায় সে নেই। থাকলেও এই মুহূর্তে নির্ঘাত নির্বাক বনে যেত।
শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমাদের ডির্ভোস হয়ে গেলে, যা ইচ্ছা তাই করবে তুমি। তোমাকে বাঁধা দেওয়ার আর কেউ থাকবে না।”
নিজের উচ্চারিত একেকটা শব্দ একটু একটু করে শেষ করে দিলো শাফকাতকে। সে জানে না, এই মেয়েটাকে ছাড়া সে বাঁচবে কী করে। তবুও, অন্তত এতটুকু নিশ্চয়তা তো পাবে – তার ভালোবাসার মানুষটা ভালো আছে। তার সঙ্গে থেকে তো কোনোকালেই ভালো ছিল না। থাকার সম্ভাবনাও নেই। দূরেই ভালো থাক। ভালোবাসা শব্দটা না হয় অর্থহীন হয়েই রয়ে যাক তার জীবনে।
(চলবে)
#লেবু
৩৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“আমি তো সেই প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি ডিভোর্সের কথা! তবুও আপনি আমাকে ডিভোর্স দেননি। সেটা আপনার ব্যর্থতা। এখন আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো।”
শাফকাত যেন স্পষ্ট সাবার কণ্ঠে কথাগুলো শুনতে পেলো। যদিও এখনও কথা বলার সক্ষমতা আসেনি মেয়েটার মাঝে। তবুও ঝড়ের সেই রাতে সাবার বলা প্রতিটি কথা এমনভাবে বুকের মাঝে গেঁধে গেছে যে চোখ বুজলেই তা শুনতে পায় শাফকাত।
নিজের প্রতি ঘৃণা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ক্রমশ। যে মানুষ নিজেকে ঘৃণা করতে দ্বিধাবোধ করে না, তাকে অন্যেরা তো ঘৃণা করবেই। অন্যেরা তাকে ঘৃণা করলো কী করলো না তাতে তার কিছুই এসে যায় না। কিন্তু সাবা কেন ঘৃণা করবে? তাকে জীবনে প্রথমবারের মতো ভালোবাসা নামক ভয়ানক অনুভূতির স্বাদ দিয়ে আবার তাকেই ঘৃণা করবে? এটা তো গুরুতর অন্যায়!
অন্যায় হলেও মেনে নিতে হবে। কারণ সাবার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা অন্যায় নয়। তার অস্তিত্বের লড়াই। শাফকাতের সঙ্গে থাকলে হয়ত একদিন তার অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে।
ঠোঁট জুড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে তুলে শাফকাত চুমুক দিলো ড্রিঙ্কসের গ্লাসে। হসপিটালে সাবার আশেপাশে দমবন্ধ লাগছিল রীতিমতো। এতগুলো দিন পর হসপিটালের বাইরে পা রেখে স্বস্তি খোঁজার জন্যে বাড়ি ফিরে যায়নি সে। ‘The Paradise’ এ এসে নিজের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে বসে ঠোঁট ডোবাচ্ছে নেশার মাঝে।
নেশা যদিও স্বস্তি দেয় না। তবে অস্থিরতা বাড়তেও দেয় না। শাফকাতের অন্তরাত্মা জুড়ে কোনোপ্রকার অস্থিরতা নেই। যথেষ্ট শান্ত সে। যা আছে, তার নাম দীর্ঘশ্বাস। ব্যর্থতার উষ্ণ অনুভূতি ঘিরে রেখেছে তাকে। নিঃশ্বাস ফেলছে দিচ্ছে না।
জীবনে প্রথমবারের মতো হেরে গেল শাফকাত আলম। সাবার কাছে নয়, নিজের কাছে। চাইলেই পারতো সাবাকে জোর করে নিজের কাছে রেখে দিতে। তার ওপর নজরদারি আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তাকে ঘরবন্দি করে রাখতে।
কিন্তু মন সায় দিলো না শেষমেশ। ভালো তো বেসেছে শাফকাত মেয়েটাকে। বেসেছে বললে ভুল হবে, বাসে। এখনো বাসে, পাগলের মতো বাসে। যদিও সে ভালোবাসা মূল্যহীন সাবার কাছে। তাতে কী? ভালোবাসার মানুষকে দিনের পর দিন কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
এই সিদ্ধান্তটা নিতে বহু মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছে শাফকাত। কিন্তু পিছিয়ে পড়েনি। সাবার ভালোর জন্যেই মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠলেই ডিভোর্সের প্রক্রিয়া শুরু করবে শাফকাত।
আরেকবার চুমুক দিলো ড্রিঙ্কসের গ্লাসে। আক্ষেপে জর্জরিত তার মস্তিষ্ক উপহাসের সুরে প্রশ্ন করলো তাকে, “সাবার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন? এখনই ডিভোর্সের প্রক্রিয়া শুরু করো?”
আসলেই তো! আলাদা যখন হয়ে যেতেই হবে তখন আর কাজটা ঝুলিয়ে রেখে লাভ কী? শাফকাত আক্ষেপের ভঙ্গিতে আরও একবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডায়াল করলো তার লয়ার আকাশের নম্বরে। একটা রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ হলো কলটা।
আকাশকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শাফকাত বলল, “আমার ডিভোর্সের কাগজ-পত্র রেডি করো আকাশ।”
“কিন্তু স্যার…”
আকাশকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কলটা কেটে দিলো শাফকাত। নিজেকে যেন বড্ড অচেনা লাগছে তার। একটা সময় যে মেয়েটাকে রীতিমতো অসহ্য লাগতো, আজ তার কারণেই হৃদয়ে এ বিচিত্র র/ক্তক্ষরণ। মেয়েটাকে ছেড়ে বেঁচে থাকার চিন্তা করতেই নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। সত্যিই যখন তাকে ছেড়ে বাঁচতে হবে, তখন যে কী হাল হবে তার কে জানে?
বোতল থেকে আরেকদফা গ্লাসে ড্রিংকস ঢেলে কতক্ষণ এলোমেলোভাবে ফোনে বিচরণ করলো। ই-মেইল চেক করলো, যে কোম্পানি থেকে যে রিপোর্ট এসেছে তাতে চোখ বোলালো বটে তবে মাথায় কিছু ঢুকলো কিনা সন্দেহ।
মোবাইল স্ক্রিনে বিচরণ করতে করতে আনমনেই শাফকাতের আঙুল গিয়ে পড়লো ইনস্টাগ্রামের ওপর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সে একেবারেই চালায় না। তার অ্যাকাউন্ট থেকে শেষ পোস্ট করা হয়েছিল তিন বছর আগে। তার মতে এসব অ্যাপ মানুষের সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই করে না।
তবুও মাঝেমধ্যে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে হয়। আজ মনটা যে হারে বিক্ষিপ্ত, সময় নষ্ট করার একটা না একটা পাঁয়তারা খুঁজেই বেড়াচ্ছে শাফকাত।
ইন্সটাগ্রামে ঢুকতেই নিউজ ফিডের শীর্ষে যে ছবিটা শাফকাত দেখলো, তা ছিল গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো। মোবাইলটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখছে শাফকাত। রাগে তার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে যেন।
পোস্টদাতা সুপারস্টার আরশাদ হক। এক হাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তার স্ত্রী অরাকে। কোনো এক সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দুজনে। দুজনেই ঠোঁটেই হাসির ছড়াছড়ি। ক্যাপশনে লেখা, “We’re going to welcome our little one soon. Keep us in your prayers.”
ক্যাপশনটা পড়ে আরেকদফা গা জ্বলে উঠলো শাফকাতের। সবেগে হাত থেকে মোবাইলটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল শাফকাত। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে চুমুক দিলো ড্রিঙ্কসের গ্লাসে।
এমন না যে অন্যের সুখ শাফকাতের সহ্য হয় না। কিন্তু এই আরশাদ হকের সুখ আসলেই তার সহ্য হয় না। বিশেষ করে এই মুহূর্তে তো একেবারেই না! কিছু কিছু মানুষ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়। তাই বলে সেই চামচ আজীবনই তার মুখে থাকবে? মানুষের ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন হয় কী করে?
সাফল্য, খ্যাতি, ভালোবাসা – এক জীবনে মানুষ যা যা স্বপ্ন দেখে সবই পেয়েছে আরশাদ! একা হাতে বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে নতুন গড়ে তুলেছিল শাফকাত। তার সাম্রাজ্য অতর্কিত এসে দখল করেছে আরশাদের কে ফিল্মস। যা আজ শাফকাতের সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার থেকে বহুগুণ সফল।
বিজনেসম্যান হিসেবে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সফল হলেও এই একটা ক্ষেত্রে তার সফলতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরশাদ। আরশাদের ওপর তার রাগটা শুধু এ কারণে সীমাবদ্ধ হলে তো হয়েই যেত!
আরশাদের প্রতি শাফকাতের এই রাগের আরও বড় একটা কারণ আছে। কর্মক্ষেত্রের কোনো কারণে নয়। কারণটা ব্যক্তিগত।
সাবার আগে শাফকাত কোনোদিনও কাউকে ভালোবাসেনি সত্যি। তবে ভালো লেগেছিল একজনকে। শাফকাতের প্রযোজনায় আজ থেকে কয়েক বছর আগে নির্মিত হয় বহুল জনপ্রিয় সিনেমা ‘আয়না’। সেই সিনেমায় নায়ক হিসেবে ছিল আরশাদ। আরশাদ তখন ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত সুপারস্টার। নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছিল নওশীন।
বলতে গেলে নবাগত নায়িকা। আগে যাও দুয়েকটা সিনেমা করেছে, তা সাফল্যের মুখ দেখেনি। ‘আয়না’ নওশীনের জন্যে বিশাল একটা সুযোগ। তৎকালীন দেশের সব থেকে বড় প্রোডাকশন কোম্পানি সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার ব্যানারে, সুপারস্টার আরশাদ হকের বিপরীতে সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ তো আর সবাই পায় না!
সেই সময়টাতে সিনেমা নিয়ে শাফকাতের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। সিনেব্লাস্টের সিইওর দায়িত্ব সে নিজেই পালন করতো। শুটিং সেটে তার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেটেই ভালো লেগে যায় মেয়েটাকে। প্রেমে পড়া জাতীয় উষ্ণ কোনো অনুভূতি তাকে স্পর্শ করেনি। ভালো লেগেছে, এতটুকুই!
‘আয়না’ ব্যাপক সাফল্যের মুখ দেখে। এই সিনেমার মাধ্যমেই দর্শকের মাঝে পরিচিতি মেলে নওশীনের। একটা জুটির সিনেমা হিট হয়েছে আর তাদের নিয়ে দ্বিতীয় সিনেমা তৈরি হবে না? এমনটা তো হতেই পারে না।
সিনেব্লাস্ট আবারও আরশাদ-নওশীন জুটিকে নিয়ে নতুন সিনেমার ঘোষণা দিলো। এই সিনেমার নাম ‘প্রহর’। এই সিনেমার সেটেই মূলত শাফকাতের ভালো লাগাগুলো প্রেমের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করে।
মেয়েটা আর দশটা নায়িকার মতো নয়। ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ নায়িকাই গায়ে পড়া স্বভাবের। এদের প্রতিটা কথায় উপচে পড়া ঢং, প্রতিটা কার্যকলাপে প্রযোজককে খুশি করার চেষ্টা। নওশীনের মধ্যে এসব নেই। চুপচাপ শুটিংয়ে আসে, অভিনয় করে, বাড়ি ফিরে যায়।
‘প্রহর’-এর শেষের কয়েকদিনের শুটিং হয় কক্সবাজারে। টিমের অন্যান্য সদস্যদের জন্যে সাধারণ ফ্লাইট বুক করা হলেও, নওশীনকে শাফকাত নিমন্ত্রণ জানায় নিজের প্রাইভেট জেটে। মেয়েটার মধ্যে খানিক সংকোচ থাকলেও না করতে পারেনি শাফকাতকে। নওশীনের জন্যে দুবাই থেকে বিশেষ একটা আংটি আনিয়েছিল শাফকাত।
আংটিটা তাকে দিয়ে সোজাসাপ্টা বলে দেয়, “আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই নওশীন।”
শাফকাতের আচমকা এমন কথায় হকচকিয়ে যায় নওশীন। এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিল যে বিস্ময়ে কয়েক মিনিট কোনোপ্রকার কথাই বের হয়নি তার মুখ থেকে। চোখদুটিতে একরাশ অস্থিরতা নিয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল কেবল। ঘন ঘন নিঃশ্বাসও ফেলছিল।
শাফকাত জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলে, “কোনো সমস্যা?”
নওশীন কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, “না আসলে… কীভাবে যে বলি!”
শাফকাত সহজ গলায় বলে, “এত চিন্তার কিছু না। কোনো সমস্যা থাকলে সরাসরি বলে দাও! আমি কিছুই মনে করবো না।”
নওশীন আরও কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলে, “সমস্যা না আসলে। আমি একজনকে ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। মনেপ্রাণে শুধু তাকেই চাই। সেও হয়ত তাই চায়। I’m really sorry, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি যদি জীবনে কখনো বিয়ে করি, তাকেই করবো।”
মনে মনে অবাক না হয়ে পারেনি শাফকাত। উপরে উপরে যে মেয়েটা এতটা চুপচাপ, ভেতরে ভেতরে সে যে প্রেম করে বেড়াচ্ছে – ভুলক্রমেই বুঝতে পারেনি শাফকাত। কিছু কিছু মানুষকে তো দেখলেই বোঝা যায় এরা প্রেম করছে কিনা। নওশীনকে দেখলে তার ছিটেফোঁটাও আভাস মেলে না। সত্যিই পাকা অভিনেত্রী সে।
শাফকাত আত্মসংবরণ করে বলে, “It’s okay. কিন্তু ছেলেটা কে?”
প্রশ্নটা শুনেই যেন নওশীনের আত্মা কেঁপে উঠলো। আগের থেকেও কয়েকজন বেশি ইতস্তত করতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আরশাদ।”
নওশীনকে না পেয়ে কোনো আক্ষেপ নেই শাফকাতের। বরং জোর বাঁচা বেঁচেছে সে, মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে হয়নি বলে। ‘প্রহর’ মুক্তির আগের দিনই হুট করে বিয়ে করে ফেলে আরশাদ আর নওশীন। সুপারস্টার সাহেব প্রেমে এতটাই মশগুল যে দিগ্বিদিক বিচার করার সময় তার নেই। অন্ধ হয়ে গিয়েছিল আরশাদ প্রেমে।
চোখ থাকলে দেখতে পেতো, নওশীন মেয়েটা মোটেও সুবিধার নয়। বিবাহিত জীবনে তাদের ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে কন্যাসন্তান। মা হওয়ার পর কাজ একেবারেই কমিয়ে দেয় নওশীন। ওদিকে আরশাদ তার ক্যারিয়ারের তুঙ্গে।
হতাশায় জর্জরিত হয়ে, না-কি আরশাদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে কিনা কে জানে? নওশীন তার সঙ্গে শুরু করে দেয় বিশ্বাসঘাতকতা। ধরা পড়ে যখন, দ্বিতীয়বার কনসিভ করে নওশীন বাচ্চাকে আরশাদের বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
সঙ্গে সঙ্গে ডিভোর্সের উদ্যোগ নেয় আরশাদ। যদিও মিডিয়ায় তখনো তাদের ডিভোর্সের কারণটা ধোঁয়াশার আড়ালেই ছিল। ডিভোর্সের পর মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল আরশাদ।
অবশেষে জীবনে একটু শান্তি খুঁজে পাওয়ার জন্যে যখন বিয়ে করলো অরাকে, তখনই তার সুখের জীবনটাকে তছনছ করতে ফিরে এলো নওশীন।
অরাকে কিডন্যাপ করিয়ে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল আরশাদের জীবন থেকে। যদিও ব্যর্থ হয় সে। এই ঘটনার পরই মিডিয়ার সামনে নওশীনের পূর্বের সমস্ত কুকীর্তি ফাঁস করে দেয় আরশাদ।
মেয়েমানুষ হবে ফুলের মতো কোমল। যাদের আলতো স্পর্শ ব্যতীত ছুঁতে গেলেও বুক কাঁপবে। চিট করছে, কিডন্যাপ করছে – এ আবার কেমন মেয়েমানুষ!
নওশীনের মতো মেয়েকে না পেয়ে আরশাদের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই শাফকাতের। ক্ষোভটা অন্য জায়গায়। শাফকাত তার জীবনে যা যা চেয়েছে, তার সবই পেয়েছে আরশাদ!
শাফকাত নওশীনকে চেয়েছিল। সে পায়নি, পেয়েছে আরশাদ। শাফকাত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তার একেক আধিপত্য চেয়েছিল। সে পায়নি, পেয়েছে আরশাদ। শাফকাত তার জীবনটা ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল। অথচ আজ নিজের হৃদয়টাকে জখম করেই ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ভালোবাসা পেয়েছে কে? আরশাদ!
আরশাদের জীবনটাকে তো এত সুখময় হতে দেওয়া যাবে না! সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ছেলেটা এবার বুঝবে জীবনে যন্ত্রণা কাকে বলে!
(চলবে)
#লেবু
৩৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
এই মাঝ রাতে সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার অফিসে জরুরি মিটিং বসেছে। থমথমে মুখে মিটিং রুমের চওড়া টেবিলের শীর্ষে বসে আছে শাফকাত। কিছুক্ষণ আগে ড্রিঙ্কসের নেশার ডুবে থাকলেও নেশার কোনোপ্রকার লক্ষণ তার চোখমুখে নেই। আশেপাশে ড্রিঙ্কসও নেই এই মুহূর্তে। তবে ঠোঁটে ঠিকই জড়িয়ে রেখেছে ধুম্রজাল। সিগারেটের ধূসর ধোঁয়া ঘিরে রেখেছে তাকে। তার রক্তিম বর্ণ ধারণ করা চোখ দুটো দেখতে হলে, দেখতে হবে এই ধোঁয়ার আবরণ ভেদ করে।
শাফকাতের সামনেই বসে আছেন সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার সিইও রাশেদ সাহেব। সিনেব্লাস্ট একটা সময়ে মারাত্মক শখের ছিল শাফকাতের কাছে। শখ ফুরিয়ে গেলেও, সিনেব্লাস্টের অস্তিত্ব তো আর বিলীন হয়ে যায়নি। শখের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সে অর্পণ করেছে রাশেদ সাহেবের হাতে। রাশেদ সাহেবের সিনেব্লাস্টের ব্লকবাস্টার ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখতে ব্যর্থ। স্বভাবতই তাই তার ওপরে শাফকাতের রাগটা ভয়াবহ।
রাশেদ সাহেবের পাশে মাথা নীচু করে বসে আছে মাহমুদ। এই ছেলেটা গত দু মাস ধরে আরশাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কে ফিল্মসে কাজ করছে। ওখান থেকে তথ্য এনে দিচ্ছে। সেই তথ্য আদৌ সিনেব্লাস্টের কোনো কাজে লাগছে কিনা কে জানে?
অবশেষে শাফকাতের তীক্ষ্ণ শীতল কণ্ঠস্বর ভাঙলো নীরবতা। সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে সে বলে উঠলো, “গত দুই মাসে আমাদের তিনটা সিনেমা রিলিজ পেয়েছে। তিনটারই বক্স অফিস কালেকশন অসাধারণ!”
রাশেদ সাহেব প্রকাশ্যে ঢোক গিললেন। এই অসাধারণ যে তার বস প্রশংসার সুরে বলেনি, বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হলো না তার।
শাফকাত দাঁতে দাঁত চেপে মাহমুদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “আমি আগেই বলেছিলাম আপনার এই স্পাই কোনো কাজের না! কী ইনফরমেশন আনছে সে কে ফিল্মসকে থেকে? আমি বলেছিলাম, ওদের সিনেমা হিট করানোর ফরমুলা খুঁজে বের করে সেই ফরমুলাতেই ওদের হারাতে। কিছুই তো করতে পারলেন না! কে ফিল্মসের গত দুই মাসের চারটা সিনেমাই হিট। মানে কী এসবের?”
রাশেদ সাহেব ব্যস্ত গলায় বললেন, “স্যার… মাহমুদের কোনো দোষ নেই।”
মাহমুদ তার কাজ ভালোভাবেই পালন করছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা কে ফিল্মসে কাজ করে রাতের বেলা ছুটে আসছে সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার অফিসে। ওখানকার কাজের সমস্ত পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলছে রাশেদ সাহেবকে। একটা সিনেমাকে সফলতার মুখ দেখানোর জন্যে কে ফিল্মস কোন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে, তা এখন তার জানা।
কিন্তু সদ্য শেখা পদ্ধতিগুলো কাজে প্রয়োগ করতে একটু হলেও তো সময় লাগবে। গত দুই মাসে যে সিনেমাগুলো মুক্তি পেয়েছে, সেগুলোর শুটিং শুরু হয়েছে বহু আগে। কে ফিল্মসের পদ্ধতি প্রয়োগ করবে কোথায়?
শাফকাত শীতল গলায় বলল, “আমি জানি মাহমুদের কোনো দোষ নেই। সব দোষ আপনার। অন্যকে ডিফেন্ড না করে নিজেকে ডিফেন্ড করতে শিখুন!”
এবার যেন একেবারে দমে গেলেন রাশেদ সাহেব। আবারও ঢোক গিলে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
শাফকাত আরও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “আমিই ভুল ছিলাম। কে ফিল্মসের ফরমুলা দিয়ে কে ফিল্মসকেই হারানোর চিন্তা নেহায়েত বোকামি। We need a new plan.”
রাশেদ সাহেব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী প্ল্যান স্যার?”
শাফকাত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “সেটা আপনাকে বলে কী হবে? আপনি এক্সিকিউট করতে পারবেন?”
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই লোকটাকে যেন সহ্যই করতে পারে না শাফকাত। তার হাতে গড়া আরও কতগুলো কোম্পানি রয়েছে। প্রত্যেকটা কোম্পানির সিইও রয়েছে। কাউকে তো এতটা অসহ্য লাগে না।
শাফকাত শীতল গলায় বলল, “যারা এক্সিকিউট করবে তাদেরই বলবো। মেয়েটা কোথায়?”
রাশেদ সাহেব কম্পিত স্বরে বলল, “আসছে স্যার।”
মেয়েটার নাম সুজানা। ইন্ডাস্ট্রিতে নতুনই বলা চলে। একটা মাত্র সিনেমায় অভিনয় করেছে। সিনেব্লাস্টের ব্যানারে তার একটা সিনেমায় অভিনয় করার কথাবার্তা চলছে। কিন্তু তার আর বোধ হয় সিনেব্লাস্টের সিনেমায় অভিনয় করা হবে না।
শাফকাত রাশেদ সাহেবকে দেখতে না পারলেও তার এই একটা কাজে সন্তুষ্ট। শাফকাত তাকে এক ঘণ্টার মধ্যে এমন একটা মেয়েকে খুঁজে বের করতে বলেছিল যে একই সঙ্গে ভালো অভিনয় করতে পারে, আবার যার টাকার খুব দরকার। টাকা নামক কয়েকটা কাগজের জন্যে যে সব করতে পারে। সুজানা তেমনই একটা মেয়ে।
মিনিট কয়েকের মধ্যে দরজায় নক পড়লো। দেখা মিলল সুজানার। হালকা মেকআপ আর জমকালো একটা টপস-জিন্সে।
সুজানা ভদ্রভাবে বলল, “বস আসবো?”
সিনেব্লাস্টের এই অফিসে সবাই শাফকাতকে “স্যার” বলেই সম্বোধন করে। “বস” ডাকটা সাধারণত সে শোনে ‘Infinite Safety’ এর অফিসে। মিটিং রুমের বাইরের ডেস্কে ‘Infinite Safety’ দুটো ছেলে কিছু কাজ করতে এসেছে। সুজানা হয়ত তাদেরই জিজ্ঞেস করেছে, শাফকাতকে কী ডাকবে।
শাফকাত অনুমতি দিয়ে বলল, “হুঁ।”
রাশেদ সাহেব এবং মাহমুদের মাঝে একটা চেয়ার ফাঁকা ছিল। সেই চেয়ারেই এসে বসলো সুজানা।
শাফকাত রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “পরিচয় করান এদের!”
আগামী কয়েকটা মাস একসঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছে মাহমুদ এবং সুজানা। যে কাজটা তারা করতে যাচ্ছে, তাতে একে অপরের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে সব থেকে বেশি।
কথোপকথনের শুরুতেই শাফকাত পরিষ্কার জানিয়ে দিলো, তার মাথায় যা ঘুরপাক খাচ্ছে তা বাস্তবায়নের জন্যে মাহমুদ এবং সুজানা দুজনকেই মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে। টাকার পরিমাণ শুনে অচিরেই চকচক করে উঠলো সুজানার চোখ দুটো।
শাফকাত মাহমুদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “মাহমুদ? তুমি তো কে ফিল্মসে ক্রিয়েটিভ টিমের মেম্বার হিসেবে ঢুকেছ তাই না?”
মাহমুদ ভদ্রভাবে বলল, “জি স্যার।”
“আরশাদের নেক্সট বিগ বাজেটের সিনেমা কোনটা?”
মাহমুদ ভাবনার এক মুহূর্তও অপচয় না করে বলল, “দিগন্ত।”
“এই সিনেমার কোনো কাজ শুরু হয়েছে?”
“না স্যার। শুধু সাইন হয়েছে। স্ক্রিপ্টের কাজ কিছুদিন আগেই শেষ হলো।”
“তার মানে কাস্টিং হয়নি এখনো?”
“না স্যার।”
একটা সিনেমার গল্প, স্ক্রিপ্ট ঠিকঠাক হয়ে গেলেই তার কাস্টিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাস্টিং মূলত সিনেমার কোন চরিত্রে কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করবে তা নির্ধারণ করা।
শাফকাত নতুন আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে কিঞ্চিৎ হালকা গলাতেই বলল, “কীভাবে হয় ওখানকার কাস্টিং?”
মাহমুদ ইতস্তত করে বলল, “অরা ম্যাডাম সিনেমার ডিরেক্টর আর কাস্টিং টিম নিয়ে মিটিংয়ে বসেন স্যার। ক্রিয়েটিভ টিমের কিছু মেম্বারও থাকে। মিটিংয়েই কাস্টিং ঠিক হয়।”
শাফকাত কী যেন ভেবে বলল, “দিগন্ত সিনেমার কাস্টিংয়ের মিটিংয়ে কোনোভাবে তোমাকে ঢুকতে হবে। পারবে না?”
মাহমুদ আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, “অবশ্যই পারবো স্যার!”
“মিটিংয়ে তুমি সুজানার নাম সাজেস্ট করবে।”
শাফকাতের এই কথায় মাহমুদের পূর্বের আত্মবিশ্বাস যেন মোমবাতির ন্যায় গলে গেল।
“কিন্তু স্যার…”
শাফকাত বিরক্ত গলায় বলল, “আবার কিন্তু কীসের?”
মাহমুদ চিন্তিত গলায় বলল, “আমার সাজেশন তারা শুনবে স্যার? না মানে, আমি তো এখনও অফিসে নতুন।”
শাফকাত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “না শুনলে শোনার ব্যবস্থা করবে। বেশি বেশি করে সুজানার অভিনয়ের প্রশংসা করবে। জোর দিয়ে ওর নাম সাজেস্ট করবে।”
“সেটা করতে পারবো স্যার। কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে।”
“আবার কী?”
মাহমুদ একবার সুজানার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু যেহেতু নতুন, উনাকে অডিশন দিতে হবে।”
শাফকাত সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো, “তো দেবে! কী সুজানা? পারবে না?”
সুজানা ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “পারবো বস।”
শাফকাত ফের মাহমুদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “সুজানা অডিশনে সিনেমার নায়িকা হিসেবে সিলেক্টেড হয়ে গেলেই তোমার কয়েকদিনের ছুটি। শুটিং শুরু হওয়ার পর থেকে সুজানার প্রধান কাজ হবে আরশাদকে পটানো।”
সুজানার চোখে মুখে বিন্দুমাত্র বিস্ময় ফুটে উঠলো না। শাফকাত তাকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব তো আর ভালো কোনো কাজের জন্যে দেবে না!
শাফকাত অভিজ্ঞ গলায় বলল, “যে করেই হোক। পার্সোনাল লাইফের কথা বলে সিম্প্যাথি নিয়ে, বিভিন্ন সিনেমার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করে। কিংবা সব থেকে ভালো হয়, ইচ্ছা করে খারাপ অভিনয় করলে। আরশাদ নিজে থেকে এসে তোমাকে অভিনয়ে হেল্প করবে।”
সুজানা মন দিয়ে শুনলো শাফকাতের নির্দেশনাগুলো। অবশেষে ভদ্রভাবে বলল,
“সমস্যা নেই, কোনো সমস্যা নেই। আমি পারবো তো বস? মানে, আরশাদ হক আমার প্রেমে পড়বে?”
সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। মুহূর্তেই সেই হাসিটা মুছে ফেলে শাফকাত বলল, “মোটেই না! আরশাদের তার ভালোবাসার কাছে মারাত্মক লয়াল। তোমার প্রেমে সে কিছুতেই পড়বে না। আর সেই চেষ্টাও তুমি করবে না।”
মুহূর্তেই থতমত খেয়ে গেল সুজানা। সুপারস্টার আরশাদ হকের সঙ্গে প্রেম করতে হবে, সেই প্রেমের বদলে আবার মোটা অঙ্কের টাকাও পাবে – এসব ভেবে ভেবে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল যেন। কিন্তু শাফকাতের একেকটা কথায় একটু একটু করে বিভ্রান্ত হয়ে মাটিতে নেমে আসছে আবারও।
সুজানা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “মানে? ঠিক বুঝলাম না বস।”
শাফকাত সতর্ক কণ্ঠে বলল, “আরশাদকে ভুলেও সিডিউস করার চেষ্টা করবে না। তাতে দেখা গেল সে নিজেই তোমাকে সেট থেকে বের করে অন্য নায়িকা নিয়ে শুটিংয়ে নেমে পড়েছে।”
সুজানার চোখ দুটো থেকে বিভ্রান্তি যেন দূর হতেই চাইছে না।
তার বিভ্রান্তিতে উপেক্ষা করে শাফকাত আবারও পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “ওর সামনে এমন একটা ভাব করবে যেন কো-অ্যাক্টর হিসেবে অভিনয়ে ওর সাহায্য চাচ্ছো। পার্সোনাল লাইফের দুঃখের কথাও বলবে শুধু মাত্র বন্ধু হিসেবে।”
শাফকাত এবার মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর মাহমুদ! সুজানা আরশাদের বিশ্বাস অর্জন করার পরই তোমার কাজ আবারও শুরু হবে। সুজানা আর আরশাদকে প্রায়ই সেটে একসাথে দেখা যাবে। সুজানা অভিনয়ে হেল্প চেয়ে বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক তাকে নিজের কাছাকাছি রাখবে। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তুমি দূর থেকে ওদের ছবি তুলবে।”
মাহমুদ শুকনো ঢোক গিলে বলল, “আমি স্যার?”
শাফকাত আলম ভয়ংকর হলে আরশাদ হকও
নেহায়েত কম ভয়ংকর নয়। যদি কোন ভাবে টের পায় তারই সেটে কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে তার ছবি তুলছে, কী যে সে করবে একমাত্র সে-ই জানে।
শাফকাত অগ্রাহ্যের সুরে বলল, “তুমি তোলো বা প্রোডাকশনের কাউকে দিয়ে তোলাও আই ডোন্ট কেয়ার। আমার দরকার ছবি। এসব ছবি তুমি ছোটখাটো নিউজ পোর্টালের কাছে পাঠিয়ে দেবে। ভুলেও লিডিং কোনো নিউজ চ্যানেল বা পত্রিকায় পাঠাবে না। ছোটখাটো নিউজ পোর্টালের নিউজ নিয়ে আরশাদ মাথা ঘামাবে না। তাদের দিয়ে তুমি চটকদার শিরোনামে নিউজ করাবে। এমনভাবে রিপোর্ট লিখতে বলবে, যাতে মনে হয় আরশাদ আর সুজানার প্রেম চলছে।”
শীতল নীরবতায় ডুবে গেল গোটা মিটিং রুমটা। এই তাহলে শাফকাতের প্ল্যান? সুজানাকে ব্যবহার করে আরশাদের নামে প্রেমের গুজব ছড়ানো? বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও নায়িকার সঙ্গে প্রেম করে দর্শকমহলে কটাক্ষের স্বীকার করতে চাইছে সে আরশাদকে।
রাশেদ সাহেব সেটাই ভাবলেন। রাগী বসকে খুশি করার উদ্দেশ্যে প্রশংসার সুরে বললেন,
“জিনিয়াস প্ল্যান স্যার! এই নিউজগুলোর কারণে আরশাদ হকের ইমেজ নষ্ট হবে। কেউ তার সিনেমা দেখতে যাবে না। কে ফিল্মসকে বয়কট করবে। এই সুযোগে আমাদের সিনেমা আবারও ঘুরে দাঁড়াবে!”
কয়েক মুহূর্ত শূন্য দৃষ্টিতে শাফকাত তাকিয়ে রইলো রাশেদ সাহেবের দিকে। রাগী কণ্ঠে হতাশ সুরে বলল, “আপনার ব্রেইনের দেখি ভয়ানক অবস্থা রাশেদ সাহেব। নো ওয়ান্ডার সিনেব্লাস্টের সিনেমা হিট হয় না কেন!”
আবারও দমে গেলেন রাশেদ সাহেব। শাফকাতের সামনে কেন যে মুখটা খোলেন তিনি!
শাফকাত আবারও বলল, “প্ল্যানটা সবে মাত্র শুরু হলো। এই চুনোপুঁটি নিউজ পোর্টালের নিউজ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়াবে আর…”
আরশাদের স্ত্রী অরার মনে একটু একটু করে সন্দেহের বীজ বপন করবে। সে কথা না হয় প্রকাশ্যে নাই বলল শাফকাত।
“আসল খেলাটা শুরু হবে শুটিংয়ের শেষ দিনে। পুরো দায়িত্বটাই সুজানার। তুমি শেষ দিন আরশাদের আশেপাশেই থাকবে। সুযোগ বুঝে ওর কোনো একটা শার্টে বা জ্যাকেটে নিজের পারফিউম মিশিয়ে দেবে। ওহ ভালো কথা! শুটিংয়ের চলাকালীন সময়েই একদিন সুযোগ বুঝে ওর জামায় লিপস্টিক জাতীয় কিছুর দাগ লাগিয়ে দেবে। কস্টিউম তো সব গ্রিন রুমেই থাকে। আশা করি কাজটা তোমার জন্য কঠিন হবে না।”
অরার মনে সন্দেহের বীজকে চারায় রূপান্তর করানোর জন্যেই মূলত লিপস্টিকের বুদ্ধিটা দিলো শাফকাত।
সুজানা আবারও সেই এক বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “না বস। কিন্তু এতসব… কেন?”
শাফকাত কঠিন গলায় বলল, “এত কেন’র উত্তর তো দিতে পারবো না। যা বলছি তাই করবে। আর যে পারফিউমটা মেশাবে, সেটা গায়ে মেখেই একদিন আরশাদের বউকে হাগ করবে। আই অ্যাম শিউর, কোনো না কোনোদিন সে সেটে যাবে। তুমি সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে। তোমার পারফিউমের গন্ধ তার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া জরুরি।”
সুজানার মাথায় কী ঢুকলো কে জানে। আদৌ কিছু ঢুকলো কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। তবুও মুখে বলল, “আচ্ছা বস।”
শাফকাত আবারও বলল, “যা বলছিলাম! শুটিংয়ের শেষ দিনে তুমি আরশাদের গাড়িতে লিফট চাইবে। আরশাদ ভদ্র ছেলের মতো তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়েও দেবে। কিন্তু দুনিয়া জানবে ভিন্ন গল্প।
পারফিউমের গন্ধ পেয়ে আরশাদের বউ সেদিন কিংবা পরদিন তোমাকে কল করবে। না করলে, তুমি নিজে থেকেই কল করবে। তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করে, আরশাদের সঙ্গে তোমার অ্যাফেয়ার চলছে কিনা – সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করবে।”
বিস্ময় খেলে গেল উপস্থিত সকলের মাঝে। সকলে ভেবেছিল, শাফকাতের সকল রাগ আরশাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কে ফিল্মসের ওপর। কিন্তু তার ক্ষোভটা যে ব্যক্তি আরশাদের ওপর, তা এখন স্পষ্ট।
শাফকাত আবারও কণ্ঠে সেই শীতলতা ফিরিয়ে এনে বলল, “বলবে তুমি অনেক আগে থেকেই তাকে পছন্দ করতে। আরশাদও সায় দিতো। তুমি অ্যাক্ট্রেস মানুষ, রংচং মাখিয়ে আরও ভালো করে বলতে পারবে।”
সুজানা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “জি বস।”
“তারপর বলবে গত রাতের কাহিনী। গাড়িতেই আরশাদ তোমার সাথে ইন্টিমেট হওয়ার চেষ্টা করে, তুমিও সায় দাও। তারপর তোমাকে নিয়ে আরশাদ তোমার ফ্ল্যাটে যায়। তোমরা আবারও ইন্টিমিট হও।”
সুজানা এবার যেন আকাশ থেকে পড়লো। শাফকাতের উদ্দেশ্য কেবল আরশাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা বা তার ক্যারিয়ারকে সংকটের মুখোমুখি করানো নয়। শাফকাতের উদ্দেশ্য আরশাদের সংসার ভাঙা!
সুজানা আমতা আমতা করে বলল, “বস… বললাম না হয়। উনি কি আমার এসব কথা বিশ্বাস করবে?”
শাফকাত ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “একদমই না। আরশাদের প্রেমে গোটা দেশের মেয়েটা অন্ধ। তার স্বয়ং বউ অন্ধত্বের সব সীমা ছাড়িয়ে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক!”
সুজানা আবারও অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই শাফকাত বলল, “তোমার কথাগুলো বিশ্বাস করানোর জন্য আরশাদের বউকে তুমি কতগুলো ছবি পাঠাবে।”
“কার ছবি বস?”
“তোমার ব্রেইনটাও দেখি রাশেদ সাহেবের মতো ডিফেক্টেড! তোমার আর আরশাদের ছবি।”
সুজানা আঁতকে উঠে বলল, “ছবি? ছবি কোথায় পাবো? আমরা তো…”
শাফকাত শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ছবি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ঠিক সময়মতো তোমার কাছে ছবি পৌঁছে যাবে। আরশাদ আর তোমার এআই দ্বারা এডিটেড ছবি।
আরশাদের সংসার ভাঙার পর আমাদের কাজ হবে ওর ক্যারিয়ার ধ্বংস করা। এত বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা খ্যাতি, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা। তুমি ওই ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করবে সুজানা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার ডিলিট করে ফেলবে। সাথে কিছু নকল কল রেকর্ডও থাকবে, সেগুলোও পোস্ট করবে। দেশে বেকারত্ব যেভাবে বেড়েছে, ওই কম সময়ের মধ্যেও ছবিগুলোর স্ক্রিনশট নিয়ে ভাইরাল করিয়ে দেওয়ার মতো মানুষের অভাব হবে না।
তার কিছুক্ষণ পর তুমি লম্বা একটা স্ট্যাটাস দিয়ে লিখবে, আরশাদ তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছে। তুমি ওর মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলার জন্যেই ছবিগুলো পোস্ট করেছিলে। এখন তুমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছো।”
সুজানা আগ্রহ নিয়ে উৎকণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, “তারপর বস?”
“তারপর সেদিনই ঢাকা থেকে বেনাপোলে পৌঁছে যাবে। আমার লোকজন তোমাকে বর্ডার ক্রস করতে হেল্প করবে। আর মাহমুদ তোমাকে সবসময়ই গাউড করবে।”
মাহমুদ ইতস্তত করে বলল, “স্যার? একটা প্রশ্ন ছিল।”
“কী?”
“যদি কোনোভাবে ধরা পড়ে যাই?”
“ধরা পড়ার কোনো চান্স নেই। তবুও যেই ধরা পড়বে, যে বলবে এসব তুমি নিজ থেকে করেছো আরশাদের প্রতি জেলাস হয়ে। আরশাদ কী আর করবে! বড়জোর পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে। জেল থেকে কীভাবে তোমাদের বের করে আনতে হয় সেটা আমি দেখবো।”
বহুক্ষণ পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শাফ
কাত। ব্যর্থতা কেবলই তার গোটা জীবনটাকে ঘিরে থাকবে কেন? সুপারস্টার আরশাদ হকও এবার পাক তার স্বাদ! ভালোবাসা সব সময় তাকে ঘিরে রাখবে কেন? এবার আরশাদও স্বাদ পাক ভালোবাসার মানুষের দেওয়া যন্ত্রণার!
(চলবে)