লেবু পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0
1

#লেবু
৪৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

[সতর্কতা : এই পর্বটিতে রোম্যান্টিসিজম আছে। শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্করাই পড়বেন। হ্যাপি রিডিং!]

মিষ্টি একটা হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। দিনে পর্দার পুরু স্তর ভেদ করে রোদ এসে ছেয়ে যায় ঘরটাতে। অথচ আজ রোদের কোনো আভাস নেই। সম্ভবত আজ বৃষ্টি হবে। পিটপিট করে চোখদুটো খুলে নিজের অবস্থান দেখে লজ্জায় আবারও তড়িৎ গতিতে তা বুজে ফেলল সাবা। লাজুক একটা মিষ্টি হাসিও ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।

সারা শরীরে বিচিত্র এক ক্লান্তি। তবুও ভালো লাগার কোনো শেষ নেই সাবার মাঝে। শাফকাত সযত্নে দুহাতে আগলে রেখেছ তাকে। দুজনে এতটাই কাছাকাছি যে সাবার ঠোঁট বাধ্য হচ্ছে শাফকাতের উন্মুক্ত বুকটাকে স্পর্শ করতে।

তার নড়াচড়ায় শাফকাতের ঘুম ভেঙে গেল না-কি আগে থেকেই সে জেগে ছিল সাবা বুঝতে পারলো না। কিন্তু আচমকা তার স্পর্শে সারা শরীরে তরঙ্গ খেলে গেল। সাবার চোখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলোকে দৃঢ় হাতের নরম স্পর্শে সরিয়ে দিল শাফকাত। গাঢ় একটা চুমু খেলো তার ঘাড়ে। প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো সাবা।

শাফকাত তার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ঘুম ভাঙলো?”

সাবা শাফকাতের বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেই অস্ফুটস্বরে বলল, “হুঁ।”

শাফকাত ধীরস্থিরভাবে তার বুক থেকে সাবার মুখটা তুলে নিজের দিকে ফেরালো। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে শাফকাত তাকিয়ে আছে তার দিকে। উপভোগ করছে তার লজ্জা। লজ্জায় সাবা একবার চোখ নামিয়ে রাখলো। আবার ঠিক পরমুহূর্তেই আবেদনময় শাফকাতকে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে চোখ তুলে তাকালো।

শাফকাত তার লজ্জারাঙা গাল দুটোতে পরপর কতগুলো চুমু খেয়ে বলল, “সকাল সকাল তোমাকে এত সুন্দর লাগে কেন বলো তো? শুধু তাকিয়েই থাকতে মন চায়।”

সাবা কী বলবে ভেবে না পেয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, “ছাড়ুন আমি উঠবো।”

শাফকাত তাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠাট্টার সুরে বলল, “সারারাত তুমি তুমি ডেকে এখন আবার আপনি? ভালোই!”

শাফকাত গত রাতের কথা মনে করিয়ে দিয়েই লজ্জায় কান দুটো গরম হয়ে গেল সাবার। এত লজ্জা কাল কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল কে জানে? নিতান্ত নির্লজ্জের মতোই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শাফকাতকে তুমি ডেকে ফেলেছিল সাবা। অবশ্য এর জন্যে কোনো আফসোস তার মধ্যে নেই।

শাফকাত চিন্তিত সুরে বলল, “নাহ্! তুমি তো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে লেবু।”

সাবা অবাক গলায় বলল, “কেন?”

শাফকাত গাঢ় স্বরে বলল, “এত সুন্দর একটা রাত আমাকে উপহার দিলে। এখন আমারও তো তোমাকে কিছু দেওয়া উচিত। কী দিই বলো তো? না-কি রাতটা তোমার জন্যেও উপহার ছিল?”

সাবা হেসে ফেলে বলল, “উফ! আপনি থামবেন?”

“আবারও আপনি?”

উষ্ণ মিষ্টতার মাঝেই দিনটা শুরু করলো সাবা। দিনের প্রথম ভাগ কী কখনো তার কাছে এতটা সুখময় ছিল? সাবা কিছুতেই মনে করতে পারলো না।

গোসল সেরে শুভ্র একটা সালোয়ার কামিজ পরে বেরিয়ে এলো সাবা। পুরোটা সালোয়ার কামিজ জুড়ে সাদার ওপরে সাদা রঙেরই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফুল। জর্জেট ওড়নার ওপরেও রয়েছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফুলের ছোঁয়া। বেশি একটা সাজলো না সাবা। চোখে গাঢ় কাজল, আর কানে লম্বা রূপার দুল আর হাতে সাদা কাঁচের চুড়ি।

সাবা তৈরি হতে হতে শাফকাতও গোসল সেরে বেরিয়ে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফোনে কাকে যেন ফোনে ধমকাচ্ছে। সাবা শেষবারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে একটু একটু করে পা বাড়ালো বারান্দার দিকে।

শাফকাতকে এক পলক দেখেই উষ্ণ হাওয়া বয়ে গেল সাবার গা বেয়ে। পুরুষ মানুষ এতটা আকর্ষণীয় হবে কেন? এটা তো নিতান্তই অবৈধ!
শাফকাতের পরনে ঢিলেঢালা হাওয়াইয়ান হাফ শার্ট। কালো শার্টটার ওপরে সাদা রঙয়ের এলোমেলো রঙয়ের ছিটে। ফোন কথা বলতে বলতে আচমকা চোখের সামনে এসে পড়া চুল সরিয়ে নিলো। তার এতটুকু কাণ্ডেই তরঙ্গ খেলে গেল সাবার সারা শরীর বেয়ে।

সাবাকে বারান্দার বাইরে চোখে পড়তেই দ্রুত ফোনালাপ সেরে তার কাছে এলো শাফকাত।
তার দিকে কয়েক মুহূর্ত গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “চলো!”

হাত বাড়িয়ে নির্দ্বিধায় সাবার হাতটাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে গেল শাফকাত। এখানে ঘুরে বেড়াবার মতো তেমন জায়গা নেই। তাদের ভিলা থেকে কিছু দূরেই সুন্দর একটা রিসোর্ট আছে। সেখানেই ঘুরতে যাচ্ছে তারা। সারাটা দিন ওখানেই কাটাবে বলে আজকের জন্যে গোটা রিসোর্টটাই বুক করে রেখেছে শাফকাত।

গাড়ি রিসোর্টের সামনে এসে থামতেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল সাবার গা বেয়ে। সবগুলো রিসোর্ট ইটের তৈরি। একেকটা রিসোর্টের আশেপাশে অনেকগুলো ফুলের টপ। গাদা, বেলি, রজনীগন্ধায় ছেয়ে আছে পুরো জায়গাটা।

কয়েক পা পেরিয়ে যেতেই বড় একটা কাঠের ব্রিজ। ব্রিজের দুপাশে আবার সুন্দর ডেকোরেশন করা। ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে রিসোর্টের রেস্টুরেন্ট। সেখানেই ব্রেকফাস্ট করলো দুজনে।

ব্রেকফাস্ট করতে করতে সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “এখানে আর কোনো ঘোরার জায়গা নেই? রিসোর্টের সামনে আর কতক্ষণ ঘুরবো?”

শাফকাত মজার ছলে বলল, “পেছনেই জঙ্গল আছে। যাবে?”

সাবা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ যাবো!”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “সিরিয়াসলি?”

সাবা একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “সিরিয়াসলি! চলো না, অনেক মজা হবে!”

মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু পর পর মেঘ গুড়গুড় করছে। তবুও শাফকাত আর সাবা নির্ভয়ে পা বাড়ালো জঙ্গলের দিকে।

লম্বা লম্বা ঘাস, বড় বড় নাম না জানা গাছ, রং বেরঙের প্রজাপতি আর সাবার ঠোঁটের সার্বক্ষণিক হাসি। কয়েক মুহূর্তের জন্যে শাফকাতের মনে হলো এই পৃথিবীতে নেই সে। ভিন্ন যে পৃথিবীতে এসে পড়েছে, যেখানে কেবলই প্রশান্তির ছড়াছড়ি।

শাফকাতের হাতটা শক্ত করে ধরে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে সাবা। হাসিমুখে বলল, “জায়গা কি সুন্দর না!”

শাফকাত গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “না।”

সাবা আহত ভঙ্গিতে বলল, “না? কী যে বলো তুমি!”

“জঙ্গলের মধ্যে সুন্দরের কী পেলে তুমি?”

“জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। এই আনন্দটাই সুন্দর।”

শাফকাত কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী রকম আনন্দ?”

সাবা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। কিছু মানুষ সমুদ্রে পা ভিজিয়ে আনন্দ পায়, কিছু মানুষ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আনন্দ পায়। আর আমি জঙ্গলে হারিয়ে যেতে আনন্দ পাই।”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে কিন্তু হাসিমুখে বলল, “আর এগোলে কিন্তু সত্যিই হারিয়ে যাবো।”

সাবা শাফকাতের চোখের দিকে তাকিয়ে অন্যরকম সুরে বলল, “আমার কোনো সমস্যা নেই। তোমার সাথে তো থাকবো।”

শাফকাত ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “তার মানে এখন আমার সাথে হারিয়ে যেতেও ভয় নেই।”

“না। কোনো ভয় নেই।”

শাফকাত থমকে দাঁড়ালো। তার দেখাদেখি থেমে গেল সাবাও। থেমে যাওয়ার কারণ অবশ্য জিজ্ঞেস করলো না। সে অব্যক্ত প্রশ্নের উত্তর শাফকাতের চোখ দুটোতেই খুঁজে পেলো নিমিষেই।

শাফকাত ঘোরগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, “এখানে কিন্তু আর কেউ নেই।”

সাবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল শাফকাত। কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে ফিসফিস করে বলল, “শুধু আমি আর তুমি।”

সাবা শাফকাতের বুকে হাত রেখে তাকে ঠেলে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে আতঙ্কিত গলায় বলল, “শাফকাত এখানে না।”

শাফকাত মোহাবিষ্ট কণ্ঠে বলল, “কেন? তুমিই তো বললে তোমার কোনো ভয় নেই।”

সাবা হেসে ফেলে বলল, “হ্যাঁ কিন্তু…”

কিন্তু কী তা জানার ইচ্ছা রইলো না শাফকাতের মাঝে। তার প্রবল ইচ্ছারা আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছে সাবার ঠোঁট দুটোর মাঝে। সেই ইচ্ছা পূরণের তাগিদেই একহাতে সাবার কোমর জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে তার ঘাড় স্পর্শ করে নিজের ঠোঁট দুটো দিয়ে আঁকড়ে ধরলো সেই ঠোঁট।

সাবা কাঁপতে কাঁপতে দুটো হাত রাখলো শাফকাতের কাঁধে। মেয়েটার কম্পন যেন আগুন ধরিয়ে দিলো শাফকাতের সারা শরীরে। আরও একটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় তীব্র গতিতে চুমু খাচ্ছে তার লেবুকে।

কতটা সময় পর সাবাকে ছাড়লো তার হিসাব কারও কাছেই নেই। শাফকাতের কপালে কপালে ঠেকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে হাঁপাচ্ছে সাবা। দুজনের নিঃশ্বাস মিলে মিশে একাকার। শাফকাত নিষ্পলকভাবে উপভোগ করছে সেই মোহনীয় দৃশ্য।

সাবা চোখ খুলে শাফকাতের দিকে তাকাতেই যখন ওই ঘোরলাগা দৃষ্টির কবলে পড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আবারও চোখ বুজে ফেলল লজ্জায়।

শাফকাত তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “আমার সাথে হারিয়েও তুমি শান্তি পাবে না লেবু।”

সাবা অস্পষ্ট গলায় বলল, “লাগবে না শান্তি!”

“তাই না?”

তড়িৎ গতিতে সাবার ঘাড়ে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো শাফকাত। গহীন জঙ্গলে, লোকচক্ষুর আড়ালে অবাধ্য এই আদরে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লো সাবা।

জঙ্গলের আর গভীরে গেল না তারা। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই আবারও ফিরে এলো রিসোর্টে। এখানে বড় একটা সুইমিং পুল আছে। সুইমিং পুলের আশেপাশে লম্বা লম্বা ডেক চেয়ার। ডেক চেয়ারে না বসে সুইমিং পুলেই পা ডুবিয়ে বসলো দুজনে।

শাফকাত সাবার হাতটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে বলল, “এটা কিন্তু আমাদের হানিমুন না সাবা। তোমাকে প্রপোজ করার জন্যে সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল, তাই এখানে নিয়ে এসেছি। হানিমুনে আমরা আরও সুন্দর কোনো জায়গায় যাবো।”

সাবার ঠোঁট জুড়ে লাজুক হাসির লুকোচুরি চলছে। হাসিটা মুছে ফেলার কোন প্রকার চেষ্টা না করেই সাবা বলল, “প্রোপোজ তুমি করলে কোথায়?”

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “না মানে, তুমি না করলে তো আমাকেই করতে হতো। কী আর করা?”

সাবা মুগ্ধ গলায় বলল, “এই জায়গাটাও অনেক সুন্দর। তোমার কেন ভালো লাগছে না বুঝলাম না। চারদিকে এত সবুজ!”

“অনেক বার এসেছি এজন্যে হয়ত।”

“ওহ হ্যাঁ! তোমাকে তো ফ্যাক্টরি ভিজিটের জন্যে মাঝেমধ্যেই আসতে হয়।”

সাবা কথাটা শেষ করার আগেই লক্ষ্য করলো শাফকাত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ঘাড়ের দিকে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো দৃশ্য চোখের সামনে।

সাবা অবাক গলায় বলল, “কী?”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “পিঁপড়া।”

শাফকাতের হাত সাবার ঘাড়ের দিকে অগ্রসর হতেই সাবা আঁতকে উঠে বলল, “মারবে না কিন্তু। সরিয়ে দাও।”

“কামড় দিচ্ছে তোমাকে!”

“দিক। এতটুকু কামড়ে কী আসে যায়?”

শাফকাত সেই লাল পিঁপড়াকে সাবধানে সরিয়ে দিয়ে বলল, “সেটাই। কাল রাতে এত এত কামড় খেলে, এতটুকু কামড়ে কী-ই বা আসে যায়।”

সাবা লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে বলল, “কী শুরু করলে তুমি?”

শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “শুরু তো তুমি করেছো লেবু।”

সাবা চোখ বড় বড় বড় করে বলল, “আমি? কীভাবে?”

শাফকাত সাবার কানের কাছে ঠোঁট মিশিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এমনি এমনিই তো আমার মাথাটা বিগড়ে যায়নি। বিগড়ে যেতে বাধ্য করেছো তুমি।”

শাফকাতের অবাধ্য ইচ্ছেরা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আগেই সাবা তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, তুমি আমার নাড়ি-নক্ষত্র মুখস্থ করে রেখেছ। অথচ আমি তোমার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে কিছুই জানি না। এটা কিন্তু ঠিক না।”

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “তো জেনে নাও!”

সাবা সাবধান করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “অনেক লম্বা লিস্ট কিন্তু।”

শাফকাত সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “চিন্তা নেই লেবু। তোমার জন্যে আমার ধৈর্য কখনোই ফুরাবে না।”

সাবা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোমার প্রিয় গান কোনটা?”

“এত এত প্রিয় গান, তার একটা বেছে নেওয়া সম্ভব না-কি?”

“তা ঠিক। কিন্তু ধরো কেউ তোমাকে বলল বাকিটা জীবন কেবল একটা গান শুনেই কাটাতে হবে। অন্য কোনো গান শুনতে পারবে না। তখন কোন গানটা বেছে নেবে?”

শাফকাত সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, “তখন কোনো গানই বেছে নেবো না। সারাজীবন একটাই গান শুনতে শুনতে সেটার প্রতি আর কোনো ভালোলাগা থাকবে না। প্রিয় গানটাও অপ্রিয় হয়ে যাবে।”

সাবা মুগ্ধ হয়ে শুনলো তার কথাগুলো। শাফকাতকে নতুন করে আবিষ্কারের পর থেকে তার যে গুণটা সাবাকে সব থেকে বেশি আকৃষ্ট করেছে, তা হলো তার কথা বলার ধরন। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে কী করে?

সাবা মুগ্ধতার একটা হাসি হেসে বলল, “কোন ধরনের বই তোমার ভালো লাগে?”

“সায়েন্স ফিকশন।”

“তোমার প্রিয় হলিডে ডেস্টিনেশন?”

“ইটালি।”

“প্রিয় আর্টিস্ট?”

“জয়নুল আবেদীন। এক সেকেন্ড! তোমার প্রিয় আর্টিস্ট কে? এটা তো আমি জানি না।”

সাবা মজার ছলে বলল, “কেন? এই নিয়ে আমি কোনো পোস্ট করিনি বলে?”

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যাঁ।”

“আমার প্রিয় আর্টিস্ট পিকাসো।”

আর কোনো প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে কয়েক মুহূর্তে নীরবতার মাঝেই কাটালো সাবা। অবশেষে মাথায় জেগে উঠলো একটা দুষ্টু প্রশ্ন।

কোনোমতে হাসি চেপে রেখে সাবা বলল, “তোমার প্রিয় ফল কী?”

সাবার দুষ্টুমি টের পেয়ে তাতে প্রশ্রয় দিয়ে বলল, “আগে কোনো প্রিয় ফল ছিল না। কিন্তু এখন…”

সাবা হেসে ফেলে বলল, “লেবু?”

“হ্যাঁ লেবু! আমার প্রিয় ফল আর প্রিয় মানুষ, দুটোই লেবু।”

খিলখিল করে হেসে উঠলো সাবা। বরাবরের মতোই তার হাসিতে হেসে উঠলো চারপাশ।

“তোমার প্রিয় সিনেমা কোনটা?”

“সিনেমা এখন আর খুব একটা ভালো লাগে না। একটা হলেই হলো। তোমার?”

সাবা ভাবনায় বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “আয়না!”

মুহূর্তেই গাম্ভীর্য ধারণ করলো শাফকাতের চোখ-মুখ। নিজের প্রযোজিত সিনেমা সাবার পছন্দ তালিকার শীর্ষে থাকায় কোথায় আনন্দিত হবে, তা না বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল।

শাফকাত বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “ওহ প্লিজ!”

সাবা জোর গলায় বলল, “তোমাকে পটানোর জন্যে বলছি না কিন্তু। এমনকি আমি তো জানতামই না তুমি আয়নার প্রডিউসার। বিয়ের পর জেনেছি। আমি যখন নতুন নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন রিলিজ হয়েছিল সিনেমাটা। নতুন বান্ধবীদের সাথেই হলে গিয়েছিলাম। সেই থেকেই আয়না আমার সব থেকে প্রিয়!”

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “হয়েছে, হয়েছে। অত ভালোও না সিনেমাটা।”

সাবা অবাক গলায় বলল, “কী যে বলো তুমি শাফকাত? কত্ত সুন্দর একটা সিনেমা আয়না। উফ! আরশাদ হকের অ্যাক্টিং!”

এবার বিরক্তির সব সীমা পেরিয়ে গেল শাফকাত। যে মানুষটাকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না, সাবার মুখে তার প্রশংসা শুনে রীতিমতো কান গরম হয়ে গেল।

সাবা হেসে ফেলে বলল, “কী ব্যাপার? এত রাগ করার কী আছে?”

শাফকাত পুরো ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “কিছুই নেই। চলো লাঞ্চ করতে যাই!”

আরশাদের প্রসঙ্গ উঠে আসতেই শাফকাত মনে মনে নোট করে রাখলো ঢাকায় ফিরেই সুজানা এবং মাহমুদের কাছ থেকে ওর ব্যাপারে খোঁজ নেবে।

কাজে ভালোই অগ্রগতি হচ্ছে দুজনের। মাহমুদের সাজেশন অনুযায়ী আরশাদের পরবর্তী সিনেমার নায়িকা হিসেবে অডিশনে ডাকা হয় সুজানাকে। মেয়েটা অডিশনে খুব একটা ভালো না করলেও পরিচালক তাকে চূড়ান্ত নায়িকা হিসেবে বেছে নেয়। এর পেছনেও ছিল মাহমুদের হাত। সিনেব্লাস্ট থেকে মোটা অঙ্কের একটা চেক নিয়ে পরিচালকের পকেটে পুরে দিতেই কাজ হয়ে যায়।

আরশাদের সঙ্গে সিনেমার শুটিং সুজানা শুরুও করে দিয়েছে। এখন শাফকাতের কথা মতো প্ল্যানটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই হয়।

শাফকাতের আকস্মিক রাগের পর আরশাদ হক প্রসঙ্গ আর দ্বিতীয়বার টেনে আনল না সাবা। বেশ কয়েকটা বিনোদন নিউজ আর্টিকেল থেকে সে জেনেছিল, আরশাদের সঙ্গে শাফকাতের বোঝাপড়া খুব একটা ভালো নেই। কয়েক বছর আগে শাফকাতের প্রোডাকশন হাউজ সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার একটা সিনেমার প্রস্তাব আরশাদ ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই তাদের বন্ধুত্বে জায়গা করে নেয় তিক্ততা।

বিশাল এই রিসোর্টের আরেকপ্রান্তে গেল তারা লাঞ্চ করতে। ছাদখোলা এই রেস্টুরেন্টে প্রত্যেকটা টেবিলের ওপর প্রকাণ্ড আকারের ছাতা। চেয়ার, টেবিল, মেঝে – সবই কাঠের।

গতকাল থেকে বিদেশি খাবার-দাবার খেতে খেতে সাবা ক্লান্ত। তাই অর্ডার করলো তার পছন্দের বিরিয়ানি। বিরিয়ানি পরিবেশন করা হলো খুব সুন্দর করে। কারুকাজ করা ছোট হাঁড়িতে বিরিয়ানি, তার ওপরে বেরেস্তা দিয়ে পরিবেশন করা।

সাবা চোখ বন্ধ করে আয়েশি ভঙ্গিতে বিরিয়ানি খাচ্ছে। আর শাফকাত বারবার আড়চোখে দেখছে তাকে।

খেতে খেতেই সাবা হঠাৎ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “কাঁচা মরিচ দিয়ে খেয়ে দেখো! দারুণ লাগে।”

শাফকাত দৃঢ় গলায় বলল, “অসম্ভব!”

সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “অসম্ভবের কী হলো? তুমি তো ঝাল পছন্দ করো!

“তাই বলে কাঁচা মরিচ খেতে হবে?”

“হ্যাঁ খেতে হবে!”

সাবার জোরাজুরিতে শাফকাত আপত্তি করলেও, সে যখনই কাঁচা মরিচ হাতে নিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে উদ্যত হলো, তখন আর কোনো আপত্তি রইলো না তার। বাধ্য ছেলের মতো কাঁচামরিচে কামড় দিলো। তবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝালে জ্বালাপোড়া করতে শুরু মুখের ভেতরটা। সঙ্গে সঙ্গে হেসে ফেলল সাবা।

শাফকাত ঝালে হাসপাস করতে করতে বলল, “এই তোমার ব্যাগে পানি আছে না? দাও তো তাড়াতাড়ি!”

টেবিলের ওপর পানি থাকা সত্ত্বেও কেন সাবার ব্যাগের পানি চাইলো বুঝে উঠতে পারলো না সাবা। তবুও কোনো প্রশ্ন না করে, ঠোঁটে লুকোচুরি খেলতে থাকা হাসিটাকে একপ্রকার
লুকিয়ে রেখেই হ্যান্ডব্যাগ থেকে তার পানিভর্তি কাঁচের বোতলটা বের করলো সাবা। বাড়িয়ে দিলো শাফকাতের দিকে।

ঝালে ছটফট করে সত্ত্বেও হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটা নিলো না শাফকাত।

তীক্ষ্ম স্বরে বলল, “বোতলে মুখ লাগিয়ে খেয়েছো?”

ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি অথচ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সাবা। এই ছেলেদের কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারছে না।
গত রাতে এত কিছু ঘটে গেল! অথচ সে কি-না পড়ে আছে বোতলে মুখ লাগানো নিয়ে।

ভ্রু কুঁচকেই সাবা বলল, “না!”

হঠাৎ সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। খালি চোখে হয়ত সে হাসি ধরা দেখাও যাবে না। তবুও তা ধরা পড়লো সাবার চোখে।

শাফকাত দ্রুত সেই হাসিটা মুছে ফেলে বোতলটা নিলো সাবার হাত থেকে। কয়েক মুহূর্ত রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখে শাফকাত পানি না খেয়ে আবারও বোতলটা ফিরিয়ে দিলো সাবার দিকে।

সাবা অবাক গলায় বলল, “পানি পানি করে তো জ্বালিয়ে মারলে! এখন পানি না খেয়েই ফেরত দিচ্ছো কেন?”

শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাও।”

“কেন?”

শাফকাত মৃদু ধমকের সুরে বলল, “এত প্রশ্ন করবে না তো! যা বলছি তাই করো।”

নিতান্ত কৌতূহল নিয়েই সাবা বোতলে মুখ লাগিয়ে এক চুমুক পানি খেলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শাফকাত বোতলটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে, ঠিক যে জায়গায় তার লিপস্টিকের চিহ্ন সে জায়গায় ঠোঁট রেখে এক চুমুকে প্রায় অনেকটা পানি খেয়ে ফেলল। পুরোটা সময়েই ধ্বংসাত্মক চাহনিতে দমিয়ে রাখলো সাবাকে।

রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো সাবার গাল দুটো। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন শীতল ছেলেটা যে ভেতরে ভেতরে এতটা অসভ্য, কে জানতো?

দিনভর আকাশটাকে মেঘাচ্ছন্ন করে রাখার পর সূর্যাস্তের ঠিক পর পর প্রকৃতির দয়া হলো তীব্র বর্ষণে ধরণীকে ভিজিয়ে দেওয়ার। বৃষ্টি এখনো পুরোদস্তুর নামেনি। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, একটু পর পর মেঘ গুড়গুড় করছে আর ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। বলাই বাহুল্য, ভারী বৃষ্টির পূর্ব লক্ষণ।

গাড়ির বন্ধ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “এই সময়ে রওনা দেওয়াটা ঠিক হলো না শাফকাত। যদি গাড়ির ওপর একটা বাজ পড়ে?”

শাফকাত ড্রাইভ করতে করতে দৃষ্টি সামনের দিকে নিক্ষেপ করে রেখে বলল, “তাহলে দুজনেই একসাথে মরে যাবো। সমস্যা কী?”

সাবা থমথমে চোখে তাকালো শাফকাতের দিকে।

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “কেন? মরতে। চাও না আমার সাথে?”

সাবা গোমড়া মুখে বলল, “না। হাজার বছর বাঁচতে চাই তোমার সাথে।”

ভারী বর্ষণ শুরুর আগেই ভিলার সামনে গাড়িটা এসে থামলো। সাবা গাড়ি থেকে নেমে একপ্রকার ছুটতে উদ্যত হলো। শাফকাত অবশ্য ধীরেসুস্থেই নামলো। সাবা ভিলার সামনের জায়গার অর্ধেকটা পাড় করেও ফেলেছে। হঠাৎ শাফকাত পেছন থেকে ডাকলো তাকে।

“লেবু?”

থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে ফিরে তাকালো সাবা। শাফকাত লম্বা লম্বা পা ফেলে তার একদম কাছাকাছি এসে বলল, “I love you!”

হেসে ফেলল সাবা। বর্ষণের গতি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। তবুও একবিন্দু নড়লো না সাবা। যে জানে শাফকাত তাকে ভালোবাসে, তার নিজের মুখেও শুনেছে ভালোবাসার কথাটা। তবে তিন শব্দের এই বাক্যটা যেন ভিন্ন এক আলোড়নে পাগল করে তুলল তাকে।

সাবা প্রত্যুত্তরে একই কথা বলতে যাবে তার আগেই শাফকাত তার দুটো গালে দৃঢ় স্পর্শে দুটো হাত রেখে বলল, “এই কথা শুনতে শুনতে কখনো বিরক্ত হয়ে যেও না প্লিজ। তোমাকে হাজারবার ভালোবাসি বলেও আমার শান্তি হবে না। মনে হবে কিছু একটা বলা হয়নি।”

জোড় গতিতে বৃষ্টি নেমেছে। ঝড়ো হাওয়ায় সাবার চুল উড়ছে। বৃষ্টির ঝাপটা মুখের ওপরে এসে পড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটা শাফকাতের চুল বেয়ে বেয়ে মুখের ওপরে পড়ছে।

তার ভেজা চুলগুলো ছুঁয়ে দিয়ে সাবা বলল, “I love you too!”

এক নিমিষে সাবাকে কোলে তুলে নিলো শাফকাত। সাবা টাল সামলাতে না পেরে শক্ত করে খামচে ধরলো তার শার্ট।

শাফকাত ঘোরগ্রস্থের ন্যায় সাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজীবন এভাবেই আমাকে সহ্য করতে হবে কিন্তু। পারবে?”

শাফকাতের ভেজা চুল আর খোঁচা খোঁচা গাড়ি বেয়ে বৃষ্টির জল এসে পড়লো সাবার মুখের ওপরে। রীতিমতো শিউরে উঠলো সাবা। আরেকটু শক্ত করে তার শার্টটা খামচে ধরে বলল, “আর কোনো উপায় আছে?”

“উপায় থাকলে?”

“উপায় থাকলেও তা আমার কোনো কাজে আসতো না। আমি তো আজীবন তোমার কাছেই আটকা পড়ে থাকবো।”

শাফকাত দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “তাই না? চলো, তোমাকে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেবো আমার কাছে আটকা পড়ার মজা!”

দুহাতে শাফকাতের গলা জড়িয়ে সাবা হঠাৎ লক্ষ্য করলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি তীক্ষ্ম। যেন গায়ে কেউ পাথরের টুকরো ছুঁড়ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, শিলা বৃষ্টি!

সাবা আরেকটু শক্ত করে শাফকাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “শাফকাত ভেতরে চলো! আমার ভয় লাগছে।”

শাফকাত সাবাকে কোলে নিয়েই এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আচ্ছা! গিয়ে?”

লজ্জায় লাল হয়ে সাবা মুখ লুকিয়ে রাখলো শাফকাতের মুখের কাছে। সর্বাঙ্গ ভিজে একাকার হওয়া সত্ত্বেও এই বুকটার মাঝে বিচিত্র এক উষ্ণতা অনুভব করলো সাবা।

ভিলার ভেতরে প্রবেশ করে সাবাকে একেবারে দোতলায় নিয়ে গেল শাফকাত। টিনের চালে ঝোড়ো গতিতে একের পর এক শিলার বর্ষণ যেন বাড়তি উন্মাদনা জাগাচ্ছে মনে। খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে শীতল হাওয়া এসে স্পর্শ করলো দুজনকে। তবুও সেই হাওয়ার শীতলতা তাদের ভেতরকার উষ্ণতাকে হারাতে ব্যর্থ।

তাদের শোয়ার ঘরে একটা কাঠের স্টাডি টেবিল আছে। কোল থেকে নামিয়ে সেটার ওপরেই সাবাকে বসালো শাফকাত। তার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সর্বনাশা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক টানে সরিয়ে ফেলল তার ওড়নাটা।

সাবা লজ্জায় চোখ বড় বড় করে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই এক নিমিষে সেই ওড়না দিয়েই সাবার চোখ দুটো বেঁধে দিলো শাফকাত।

সাবা বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে বলল, “এসব কী হচ্ছে শাফকাত?”

শাফকাত তার ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। ভেজা ঠোঁটে শাফকাতের শীতল স্পর্শ পেয়ে বরফের ন্যায় জমে গেল সাবা।

শাফকাত গাঢ় স্বরে বলল, “কোনো কথা না। বাইরে ভয় লাগছিল বলে ভেতরে নিয়ে এলে। অথচ বুঝলেই না ভেতরে বাইরের থেকে বেশি ভয়।”

শাফকাতের এ কথায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো সাবার। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে গেল। একেকটা নিঃশ্বাস ফেলতে যেন যুদ্ধ জয় করার মতো কষ্ট হচ্ছে সাবার।

শাফকাত সাবার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে মুখ ডুবিয়ে দিলো তাতে। আলতো কামড়ে এলোমেলো করে ফেলল সাবার অন্তরাত্মাকে। ভয়ানক কম্পন ধরিয়ে দিলো তার সারা শরীরে।

সাবার কানের লতিতে কয়েক দফা গাঢ় চুমু খেয়ে শাফকাত কানে কানে গাঢ় স্বরে নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “Kiss me!”

তরঙ্গের ন্যায় কী যেন একটা খেলে গেল সাবার সারা শরীরে। নিজ থেকে ওই কাজ করার চেয়ে লজ্জায় মূর্ছা যাওয়াও ঢের ভালো।

সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কীভাবে? আমি তো দেখতেই পাচ্ছি না।”

শাফকাত দুষ্টু গলায় বলল, “চুমু খাওয়ার জন্যে দেখতে হয় না-কি?”

লজ্জায় এবার রীতিমতো কান দুটো গরম হয়ে গেল সাবার।

শাফকাত আবারও দুষ্টু গলায় বলল, “তোমার পক্ষে তো কোনো কিছুই অসম্ভব না। এই অসাধ্য সাধন করতে তাহলে এত ভয় কীসের?”

ভয়ের কিছুই নেই। লজ্জায় একাকার অবস্থা মেয়েটার। তবুও লজ্জায় নিজেকে কাবু করলো না সাবা। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ভেজা হাতটা রাখলো শাফকাতের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে। বদ্ধ চোখেই হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নিলো শাফকাতের পুরুষালি ঠোঁট।

কাছেই কোথাও বজ্রপাত হলো। ভয়ংকর ওই শব্দে কেঁপে উঠলো সাবা। তবুও দমে গেল না। বুকের মাঝে সাহস সঞ্চার করে একটু একটু করে এগিয়ে গেল শাফকাতের ঠোঁটের দিকে।

ওই ঠোঁট দুটোতে ঠোঁট রাখতেই মিইয়ে গেল সাবা। কম্পিত ঠোঁট দুটো দিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুমু খেয়েই সরে আসতে উদ্যত হলো। তবে শাফকাত আলম এতটুকু সন্তুষ্ট হওয়ার পাত্র নয়।

শক্ত করে সাবার কোমর জড়িয়ে ধরে বাইরের বর্ষণের চেয়েও তীব্র গতিতে চুমু খাচ্ছে সাবার ঠোঁটে। যেন এক চুমুতেই ধ্বংস করে ফেলবে মেয়েটার ভেতর বাহির।

সাবার কী যে হলো! লজ্জার মাথা খেয়ে, পাগলপ্রায় সাবার হাত দুটো ব্যস্ত হয়ে গেল শাফকাতের শার্টের বোতাম খুলতে। বদ্ধ চোখে একেকটা বোতাম খুলতে সময় লাগছে বেশ। তবুও পিছপা হওয়ার কোনো লক্ষণ তার মাঝে নেই।

সবগুলো বোতাম খুলে শার্টটা টেনে খুলে ফেলল সাবা। কম্পিত হাত রাখলো শাফকাতের ভেজা বুকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। এটা কী করলো সে! লজ্জায় একাকার হয়ে গেল সাবা।

শাফকাত তার ঠোঁট ছেড়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “দেখেছো! বলেছিলাম না? তোমার পক্ষে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়!”

বাইরের শিলাবৃষ্টি আর ঘরের ভেতরের প্রেমবৃষ্টিতে গা ভাসিয়ে যেন আজ পূর্ণতা পেলো শাফকাত-সাবার জীবনের নতুন অধ্যায়।

(চলবে)

#লেবু
৫০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

আজ সাবার ব্যস্ততার শেষ নেই। পরবর্তী রিপোর্টের জন্যে ছোটাছুটি করেছে দিনভর। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা ভিক্ষাবাণিজ্য নিয়ে রিপোর্টটা সাজিয়েছে সে। সাবার অনুসন্ধানে উঠে আসে, ভিক্ষুকদের একাংশের মাথার ওপরে ছায়া হয়ে আছে একটি চক্র। ভোরের আলো ফুটলেই এরা, পঙ্গুত্বের কিংবা অন্ধত্বের শিকার এসব ভিক্ষুকের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আছে। দিন পেরোলেই আবার তাদেরকে ফিরিয়ে আনে নিজস্ব আস্তানায়। দিনভর ভিক্ষাবৃত্তি করে যে কটা টাকা তারা পায়, তার পুরোটাই চলে যায় এই চক্রের পকেটে।

এদের গোপন আস্তানায় চুপিসারে ভিডিও ধারণ করতে যায় সাবার টিম। ভেতরে ঢুকে যদিও অনুসন্ধান করতে পারেনি। বাইরে থেকে যতটুকু ক্যামেরায় ধারণ করতে পেরেছে, ততটুকুই এই চক্রের মুখোশ উন্মোচনের জন্যে
যথেষ্ট।

ভোর বেলা সেই আস্তানায় বাইরে গাড়িতে লুকিয়ে থাকে সাবার টিম। ক্যামেরায় উঠে আসে এক পঙ্গু বৃদ্ধকে কোলে করে বের হচ্ছে টুপি পরা এক যুবক। তাদের সাবধানে অনুসরণ করে সাবার গাড়ি। আস্তানার কিছুটা দূরেই এক ফুটওভার ব্রিজের ওপর বৃদ্ধকে রেখে যুবক চলে যায়।

দিনভর দূর থেকে বৃদ্ধর কর্মকান্ড ক্যামেরায় ধারণ করে সাবা। তার কাছে আবার সাদা একটা স্পিকারও রয়েছে। স্পিকারে বাজছে করুণ সুরের গান। সেই গানের সুরে বেশির ভাগ মানুষের মন না গললেও, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দুয়েক টাকা বৃদ্ধের সামনে থাকা প্লাস্টিকের বাটিতে রাখার মতো মানুষও নেহায়েত কম নয়।

সূর্যের আলো ডোবার কিছু পরেই আবারও আগমন ঘটে টুপিওয়ালা যুবকের। প্লাস্টিকের বাটিতে পড়ে থাকা সবকটা টাকা সবার আগে চলে যায় তার পকেটে। অবশেষে আবারও বৃদ্ধকে কোলে তুলে ফিরিয়ে আনে আস্তানায়।

সাবা বেশ বুঝতে পারছে, আবারও আলোড়ন তুলতে যাচ্ছে তার তৈরি করা রিপোর্ট। এই চক্রের মুখোশ উন্মোচন হলে এমন আরও অনেক চক্রই ধরা পড়বে। পঙ্গুত্ব এবং অন্ধত্বের শিকার এই অসহায় মানুষগুলোর ওপরেও অত্যাচার বন্ধ হবে।

দিনভর বৃদ্ধের ওপর নজরদারি করে সেই ফুটেজ এডিটিং সেকশনে দিয়ে এলো সাবা। আগে ধারণ করা ফুটেজের সঙ্গে এই ফুটেজ যুক্ত করে তৈরি করা হবে সম্পূর্ণ রিপোর্ট। সাবা ভিডিও এডিটরদের নির্দেশনা দিয়ে এলো কীভাবে ভিডিওটা সাজানো হবে। হাতে সময় থাকলে সে নিজেই এডিট করতে বসে যেত। কিন্তু হাতে বিন্দুমাত্র সময় নেই। আগামীকালই আবার নেমে পড়তে হবে নতুন রিপোর্ট নিয়ে।

সাবা নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়াচ্ছে, হঠাৎ তার সামনে পড়লেন আফসানা করিম।
তিনি চিন্তিত গলায় ডাকলেন, “সাবা?”

সাবা ব্যস্ত পা দুটোকে থামিয়ে ভদ্রভাবে বলল, “জি আপা?”

“আমার কেবিনে একটু আসবে?”

সাবা বাধ্য মেয়ের মতো এডিটর সাহেবাকে অনুসরণ করে তার কেবিনে পৌঁছে গেল।

আফসানা করিম তার চেয়ারে বসলেন। ইশারায় সাবাকে তার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসতে বললেন। সাবার চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ছায়া। বেশ বুঝতে পারছে আফসানা করিম যা বলতে যাচ্ছেন, তা মোটেও স্বস্তিদায়ক হবে না।

আফসানা করিম ইতস্তত করে বললেন, “সাবা, আমরা এই রিপোর্টটা প্রচার করতে পারবো না।”

সাবা বিস্মিত গলায় বলল, “মানে? কেন?”

আফসানা করিম ঢোক গিলে বললেন, “তোমরা যে আজ ওই আস্তানার বাইরে থেকে শুট করেছ, এটা ওরা কোনোভাবে টের পেয়েছে। চ্যানেলে থ্রেট এসেছে।”

সাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “চ্যানেলে তো প্রথম থ্রেট আসেনি আপা। আমরা ক্রাইম নিয়ে কাজ করি। ক্রিমিনালদের থ্রেট তো আসবেই।”

আফসানা করিম হ্যাঁ-সূচক সূচক মাথা নেড়ে বললেন, “তা ঠিক। কিন্তু… এই চক্রের মাথার ওপরে অনেক প্রভাবশালী মানুষের ছায়া আছে। সেটা তুমিও জানো।”

সাবা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে কড়া গলায় বলল, “জানি আপা। এদের ভাগ্য ভালো রিপোর্টে আমি কারও নাম উল্লেখ করিনি, কিংবা করতে পারিনি।”

আফসানা করিমকে ক্ষীণ খোঁচা দিয়েই কথাটা বলল সাবা। তার মতে, চ্যানেলকে টিকে থাকার জন্যে অনেক বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়। অপরাধে প্রভাবশালী মানুষের নাম উঠে এলেও, তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়। তার এই নিয়মের কারণেই সাবা অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীর নাম তা তুলে ধরতে পারে না রিপোর্টে।

একটা চ্যানেলকে টিকে থাকার জন্যে প্রভাবশালীদের নয়, জনগণকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। আর জনগণকে সন্তুষ্ট রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে সত্যকে তুলে ধরা। এটা কে বোঝাবে আফসানা করিমকে?

আফসানা করিম ক্ষীণ গলায় বললেন, “তোমার ওপর একবার অ্যাটাকের চেষ্টা হয়েছে সাবা। আবারও হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? চ্যানেলেও হামলা হতে পারে।”

সাবা ভদ্রতার হাসি হেসে বলল, “আপা, এত কষ্ট করে এই রিপোর্ট তৈরি করলাম। নিশ্চয়ই হার্ড ড্রাইভে ফেলে রাখার জন্যে নয়? রিপোর্টটা প্রচারিত হবে। আমার ওপর অ্যাটাক হলেও হবে, চ্যানেলের ওপর হামলা হলেও হবে।”

“কিন্তু সাবা…”

সাবা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না আপা। আমি সিইও স্যারের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।”

আফসানা করিমের কেবিন থেকে বেরিয়ে সাবা সত্যি সত্যিই সিইও সাহেবের কেবিনে গেল। দীর্ঘ সময় লাগলো এই রিপোর্ট প্রচারে তার অনুমতি পেতে। প্রথম প্রথম তিনিও আফসানা করিমের মতো বেঁকে বসেছিলেন। সাবা তার রিপোর্টের আদ্যপান্ত বুঝিয়ে বলতেই তিনি সন্তুষ্ট হলেন।

কেবিনে ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সাবা। কাজ করতে করতে রাত নয়টা বেজে গেল। এত রাত অবধি কখনোই অফিসে থাকতে হয় না তাকে। হাতে ফোনটা নিতেই গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল সাবার। ৮ টা ১৩ মিনিটে শাফকাত ফোন করেছিল তাকে, পরপর দুবার।

তখন তো সাবা আফসানা করিমের কেবিনে। ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল বলে খেয়ালই করেনি। আজ দিনভর ব্যস্ততার কারণে শাফকাতের সঙ্গে কথা হয়েছে মাত্র দুবার। শেষ বার কথা হয়েছিল দুপুরের দিকে।

ইশ! ছেলেটাকে একবার জানানো উচিত ছিল আজ তার দেরি হবে। নিশ্চয়ই চিন্তা করছে শাফকাত। তীব্র অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো সাবাকে। নিজেকে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনো ভুল করবে না। তবুও পদে পদে নিজের অজান্তেই ভুল করে ফেলছে প্রতিনিয়ত!

সাবা কাঁপা কাঁপা হাতদুটো দিয়ে ডায়াল করলো শাফকাতের নম্বরে। কানের কাছে শক্ত করে চেপে ধরলো ফোনটা। এতটুকু সময়ই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে একাকার অবস্থা।

হৃদস্পন্দন এক লাফে আরও বেড়ে গেল যখন কয়েকবার রিং বাজার পরও অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ করলো না শাফকাত। ছেলেটা নিশ্চয়ই মারাত্মক রেগে গেছে! আজ সাবার কপালে নির্ঘাত শাফকাতের কড়া ধমক লেখা আছে।
ছেলেটার কোনো দোষ নেই। তার ঠান্ডা মাথা বিগড়ে দেওয়ার জন্যে সাবাই দায়ী।

কম্পিউটার বন্ধ করে, ব্যাগ গুছিয়ে কোনমতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো সাবা। তার বডিগার্ড এবং ড্রাইভার নিচেই রিসিপশনে অপেক্ষা করছিল। সাবাকে দেখতেই তারা গাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

পথে আরও একবার ফোন করলো সাবা শাফকাতকে। এবার রিসিভ করলো না ফোনটা। দুশ্চিন্তায় সাবার হাত-পা কাঁপছে। বাড়ি ফিরে শাফকাতকে কী বলবে, তাই ভেবে পাচ্ছে না।

কী অদ্ভুত ব্যাপার! ঘন্টাখানেক আগেও কী দৃঢ়তা নিয়ে আফসানা করিমের মুখোমুখি হলো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলো। অথচ তার সব দৃঢ়তা এই মানুষটায় এসে শেষ হয়ে যায়। দৃঢ়তার বদলে তীব্র আতঙ্ক জায়গা করে নিয়েছে তার মনে। সাবা কিছুতেই শাফকাতকে হারাতে চায় না। তার ভালোবাসায় মিশে থাকতে চায় বাকিটা জীবনে। ভালোবাসাকে হারানোর ভয়তেই হয়তো এই আতঙ্ক।

কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলেন আতিয়া আলম।

উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “সাবা এসেছো? তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?”

সাবা ব্যস্ত গলায় বলল, “আজ অনেক ছোটাছুটি করেছি তো। মা শাফকাত এসেছে?”

“হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগেই তো এলো। ঘরেই আছে।”

সাবা কোনমতে বলল, “আমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে আসছি মা।”

বাড়ি ফিরেই তাড়াহুড়ো করে ঘরে চলে আসা অভদ্রতার লক্ষণ কিনা কে জানে? তবুও শাফকাতের মুখোমুখি হওয়া জন্যে মনটা ছটফট করছে বলে দোতলায় উঠে এসেছে সাবা। ঘরের বাইরে এসে পৌঁছাতেই আবার থমকে দাঁড়ালো। বুকটা কেঁপে উঠলো কয়েক দফা। এবার শাফকাতের মুখোমুখি হওয়ার আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেল সে।

তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে দরজাটা খুলল। ঘরে আলো জ্বলছে, শাফকাত নেই। বাথরুম থেকে শাওয়ারের পানি ঝড়ার শব্দ আসছে। সাবা লম্বা লম্বা পা ফেলে বিছানার এক পাশে বসলো। কয়েক দফা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।

নিজেকে শান্ত করতে সক্ষম হলেও শাফকাতকে কীভাবে শান্ত করবে ভেবে পেলো না সাবা। ছেলেটা যে কী পরিমাণ রেগে আছে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

শাওয়ারের পানি ঝড়ার শব্দ থেমে গেল। ধ্বক করে কেঁপে উঠলো সাবার হৃদপিণ্ড। মিনিট কয়েক পর বাথরুমের দরজা খুলে গেল। সাদা টি শার্ট, কালো ট্রাইজার পরিহিত স্নিগ্ধ শাফকাত আলম বেরিয়ে গেল। তাকে দেখে মনের মাঝে নতুন করে প্রেমে পড়ার অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দমিয়ে রাখলো সাবা। ব্যস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালো।

তাকে দেখে সূক্ষ্ম একটা হাসি হেসে শাফকাত বলল, “এসেছো লেবু?”

মুহূর্ত খানিকের জন্যে অবাক না হয়ে পারলো না সাবা। শাফকাতের কণ্ঠে ক্রোধের বদলে স্বাভাবিকতাকে বড্ড অস্বাভাবিক লাগছে।

সাবা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে অনুতপ্ত সুরে বলল, “I’m so sorry Shafkat! আমি বুঝতেই পারিনি এতটা দেরি হয়ে যাবে। আরও আগেই চলে আসতাম, কিন্তু অফিসে একটা ঝামেলা হয়ে গেল। তোমার ফোনটাও খেয়াল করিনি।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল সাবা।

তার কাঁধে হাত রেখে শাফকাত শান্ত গলায় বলল, “শান্ত হও সাবা। এত কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন? আমি তো জানি আজ তোমার ফিরতে দেরি হবে। শুট থাকলে তো দেরিই হয়।”

সাবা চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি আমার ওপরে রাগ করোনি?”

শাফকাত হেসে ফেলে বলল, “এই মেয়ে! তোমার কী মনে হয় রাগ করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই?”

শাফকাতের হাসি দেখেও অবিশ্বাস দূর হলো না সাবার মাঝ থেকে। অবিশ্বাসের সুরে সে বলল, “মানে সত্যি রাগ করোনি?”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “রাগ করলে খুশি হতে? ঠিক আছে এখনই রাগ করছি!”

এবার সাবা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। নিজেও লাজুক হাসি হেসে বলল, “ধুর! আমি আরও ভাবলাম এখনি তোমার কাছে বকা খাবো।”

শাফকাত নরম স্বরে বলল, “তোমাকে আমি কখনো অকারণে বকাঝকা করি না লেবু। তুমি খুব ভালো করেই জানো।”

সাবা অনুতাপমাখা কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমার তো উচিত ছিল একবার তোমাকে ফোন করে জানানো, যে ফিরতে।”

শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “এত গিল্টি ফিল করতে হবে না। নিশ্চয়ই কাজে ব্যস্ত ছিলে তাই ভুলে গেছ। আমার সাথেও তো এমন হয়। তুমি তো কখনোই আমার ওপরে রাগ করো না।”

সাবা মজার ছলে বলল, “এই তুমি কে? আমার শাফকাত তো এতটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল না।”

শাফকাত সোজাসাপ্টা উত্তরে জানিয়ে দিলো, “সবটাই তোমার দোষ।”

(চলবে)

#লেবু
৫১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“উফ মা! তোমার হাতের ইলিশ পোলাওয়ের কাছে বড় বড় শেফদের রান্নাও হার মানবে!”

বাচ্চাটার প্লেটে ধোঁয়া ওঠা ইলিশ পোলাও তুলে দিতে দিতে কথাটা যেন পরিষ্কার শুনতে পেলেন ফাহমিদা বেগম। মনে হলো যেন এই তো, ডাইনিং টেবিলের একেবারে কোণার চেয়ারে পা তুলে বসে আয়েশি ভঙ্গিতে কথাটা বলল আহনাফ। এক বছরেরও বেশি সময় হলো ছেলেটা পৃথিবীতে নেই। তবে আজও তার কণ্ঠস্বর জীবন্ত মায়ের মনে।

পৃথিবী থেকে একটা মানুষ ইচ্ছা করে বিদায় নিতে পারলেও মায়ের মন থেকে পারে না। মা তার প্রত্যেকটা সন্তানের জন্যে মনের মাঝে তুলতুলে নরম ঘর তৈরি করে রাখেন। যে ঘরে তার সন্তান চির সজীব, চির চঞ্চল।

বেঁচে থাকলে আজ আহনাফ ছত্রিশের ঘরে পা রাখতো। জন্মদিনের এই দিনটায় কোনোকালেই ঘরে পাওয়া যেত না তাকে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যেত। ফিরতো সন্ধ্যারও পর।

একবার এই জন্মদিনে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে দল বেঁধে চলে গেল সোনারগাঁওতে। মাকে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার পরপরই ফিরে আসবে। তবে তীব্র যানজটে আটকা পড়ে যাওয়ার কারণে আহনাফ বাড়ি এসে পৌঁছায় রাত এগারোটার দিকে।

ফাহমিদা বেগম এদিকে আত্মীয়-স্বজন ডেকে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়েছেন। যার জন্যে এত আয়োজন, সেই যদি উপস্থিত না থাক তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের মনে অভিমান জমার কথা। ফাহমিদা বেগমও একরাশ অভিমান নিয়ে সেদিন ছেলেকে বলেছিলেন, “আমি আর কোনোদিনও তোর জন্মদিন আয়োজন করবো না! মিলিয়ে নিস!”

মিলিয়ে বোধ হয় নিচ্ছে আহনাফ। এখন তো আর তার জন্মদিন পালনের সুযোগ নেই। আজ তারা যা পালন করছে, তার নাম জন্মবার্ষিকী। কী আজব ব্যাপার! একটা মানুষের অনুপস্থিতি কীভাবে গোটা একটা দিনকে বদলে দিতে পারে। এই পরিবারের জন্যে আজকের দিনটা ছিল আনন্দমুখর, অথচ আজ সকলের মনেই যেন নেমে এসেছে বিষাদের কালো মেঘ।

আজ সাবাদের বাড়িতে এসেছে বেশ কিছু এতিম শিশু। এই দিনটায় তাদের ডাকা হয়। ফাহমিদা বেগম আহনাফের পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেন। যত্ন নিয়ে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ান।

বাড়িজুড়ে বাচ্চারা শোরগোল করছে। শোকের ছায়া তো আর ওদের স্পর্শ করতে পারে না। উচ্ছলতাই ওদের একমাত্র অবলম্বন। সাবাদের আত্মীয়-স্বজনেরাও এসেছেন। আহনাফের অনুপস্থিতি নিয়ে আজ আর কোনো অভিযোগ নেই তাদের। নিচু গলায় ছেলেটার স্মৃতি রোমন্থন করতে ব্যস্ত তারা।

বসার ঘরের একদম শেষ প্রান্তে জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে আছে সাবা। দেয়ালে ঝুলন্ত ভাইয়ার হাস্যোজ্বল ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বরাবরের মতো আজও কাঁদতে পারলো না। বেদনায় নীলও হয়ে যেত পারলো না। অন্তর জুড়ে আজ কেবলই শূন্যতা। এই বিচিত্র শূন্যতা বারবার ফিরে এসে ঘ্রাস করে নেয় তাকে।

বাড়ির প্রত্যেকটা কোণে মানুষের আনাগোনা। কেবল সাবার কাছেই কেউ ঘেঁষছে না। ভাইয়ার মৃত্যু মেয়েটাকে কতটা বিধ্বস্ত করে দিয়েছে তা কারোরই অজানা নয়। সাবাকে তাই একা একা নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করার সুযোগ দিচ্ছে সকলে।

অবশ্য শাফকাত সেই সুযোগ দিলো না তাকে। একটু একটু করে সাবার কাছে এগিয়ে গেল। নরম স্পর্শে সাবার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠলো সাবা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাফকাত। রক্তশূন্য চোখদুটো আর শুকনো মুখটা জানান দিচ্ছে সাবার ভেতরের চলতে থাকা তোলপাড় কতটা ভয়ানক।

শাফকাত শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ঠিক আছো সাবা?”

নিতান্তই অহেতুক একটি প্রশ্ন। শাফকাত জানে সাবা ঠিক নেই। ভাইয়ার স্মৃতি বিজরিত এই বাড়িতে পা রাখলেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় তার অন্তরাত্মা।

সাবা ভাঙা গলায় বলল, “হুঁ।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাফকাত। সাবার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট জানান দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে কতটা কষ্ট পাচ্ছে সে।

শাফকাত নরম স্বরে বলল, “আমার সাথে একটা জায়গায় যাবে?”

সাবা কোনো প্রশ্ন করলো না। ঘাড় কাত করে সায় জানালো। যেন এই দমবন্ধকর বাড়িটা থেকে কোনোক্রমে বের হতে পারলে সে বাঁচে। যতক্ষণ এখানে থাকবে, ভাইয়ার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াবে।

সকলের সামনেই সাবাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো শাফকাত। নিঃশব্দে গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে বসে চোখদুটো বুজে ফেলল সাবা। মাথার ভেতরটা সেই সকাল থেকে দপদপ করছে। প্রত্যেকবার শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন মনে হচ্ছে এই হাওয়া ছারকার করে দিচ্ছে তার ফুসফুসকে।

হাতের ওপর দৃঢ় একটা হাতের স্পর্শ পেলো সাবা। চোখ খুলে শাফকাতের দিকে তাকালো। তার চোখ দুটো স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, “আমি আছি তো তোমার কাছে!”

মলিন হাসি হাসলো সাবা। তবে হাসলো না শাফকাত। অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা নিয়েই গাড়ি স্টার্ট দিলো। পুরোটা পথ কেউ কোনো কথা বলল না। চোখ বুজে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো সাবা। নিশ্চয়ই শাফকাত তার মন ভালো করার চেষ্টা স্বরূপ সুন্দর কোনো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে। মন আজ ভালো হবে না সাবার। তবুও শাফকাতের এই চেষ্টার জন্যেই মুগ্ধতার সুপ্ত একটা হাওয়া বয়ে গেল তার গা বেয়ে।

গাড়ি থামলো মিনিট বিশেক পর। চোখ দুটো একটু একটু করে খুলতেই সাবা দেখলো, কোনো প্রশান্তিময় সুন্দর জায়গায় তারা আসেনি। এসেছে শাফকাতের সাইবার নিরাপত্তার কোম্পানি ‘Infinite Safety’ এর হেডকোয়ার্টারে। গাড়ি মূল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন গার্ড ব্যস্ত ভঙ্গিমায় দরজা খুলছে।

সাবা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে শাফকাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে নিয়ে এলে কেন?”

শাফকাত সাবার গালে একটা হাত রেখে বলল, “গেলেই দেখতে পাবে।”

সাবার বিভ্রান্তি এবং কৌতুহল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে শাফকাত তাকে নিয়ে সোজা চলে এলো বেজমেন্টে। অফিসের প্রথম বেজমেন্ট গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় বেজমেন্টে সংরক্ষণ করে রাখা হয় জরুরি ডকুমেন্ট।

লিফট দ্বিতীয় বেজমেন্টে এসে থামতেই সাবার হাত ধরে তাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো শাফকাত। যতদূর চোখ যায়, ততদূর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কেবল বড় বড় কেবিনেটে অসংখ্য ফাইলপত্র। তাদের বডিগার্ড বা কোনো সিকিউরিটি গার্ডও আসেনি সঙ্গে। শাফকাত লম্বা লম্বা পা ফেলে সাবাকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

সাবা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এখানে কী শাফকাত? আমার কিন্তু এখন ভয় লাগছে।”

শাফকাত হালকা গলায় বলল, “আমি পাশে থাকতেও ভয়?”

“না কিন্তু…”

শাফকাত সাবাকে নিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাদা রঙের দরজার আড়ালে ছোট্ট এই ঘরটা বানানো হয়েছে বেজমেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গার্ডদের জন্যে।

শাফকাত থেমে থেমে বলল, “দরজাটা খোলো!”

সাবা অনিশ্চয়তায় ভরা বিস্মিত চোখে তাকালো শাফকাতের দিকে। বিচিত্রভাবে খচখচ করছে বুকের ভেতরটা। অবচেতন মন স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, এই দরজার পেছনে এমন কিছু রয়েছে যা তার প্রত্যাশারও বাইরে।
শাফকাতকে আর কোনো প্রশ্ন না করে কম্পিত হাতে দরজার লকে মোচড় দিলো সাবা।

অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘর। ঘরের এক কোণে সামান্য হলদেটে আলো। ঠিক যেন সাবার দেখা ওই স্বপ্নের মতো। দরজার সামনে পাথরের ন্যায় জমে দাঁড়িয়ে রইলো সাবা। পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি অবশিষ্ট রইলো না তার শরীরে।

শাফকাত আলতো স্পর্শে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভয় পাচ্ছো লেবু?”

সাবা সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। পৃথিবী তাকে চেনে নির্ভীক একটা মেয়ে হিসেবে। অথচ সেও ভয় পেতে জানে, দুর্বলতা
ঘ্রাস করে নেয় তাকেও। এ সত্য পৃথিবীর কাছে অকল্পনীয় হলেও, শাফকাতের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক। তার মতো করেই তার ভয়গুলোকে আপন করে নিয়েছে শাফকাত।

শাফকাত সাবাকে সাহস যুগিয়ে তার হাতটা ধরে ঘরের ভেতরে এক পা রেখে বলল, “চলো আমার সাথে।”

অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের শেষ মাথায় নিয়ে যাচ্ছে শাফকাত তাকে। একটু একটু করে এগিয়ে যেতে যেতে আবছা একটা অবয়ব দৃশ্যমান হতে লাগলো। কাঠের চেয়ারের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রাখা একটা মেয়ের অবয়ব। কালো কাপড় দিয়ে তার মুখ বাঁধা, পরনে গোলাপী সালোয়ার কামিজ। এলোমেলো চুল চোখের সামনে পর তার মুখটায় ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে।

সাবার বুকটা এত জোরে ধড়ফড় করছে যে নিজেই শুনতে পাচ্ছে নিজের বাড়ন্ত হৃদস্পন্দন। মানুষের উপস্থিতি মেয়েটা নড়ে উঠলো। এক ধাক্কায় একটু বেড়ে গেল সাবার হৃদস্পন্দন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। চোখদুটোতে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেল। এর কারণ অবশ্য স্পষ্ট সাবার কাছে। মেয়েটা কে? সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর সে আঁচ করতে পেরেছে।

মেয়েটার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো শাফকাত। তার দেখাদেখি থেমে গেল সাবাও। ক্ষীণ আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেয়েটার চোখদুটো। সাবার ধারণাই সত্যি হলো। মেয়েটা ইতি।

যে ইতির কারণে তার ভাইয়াকে এত এত অপমান বয়ে নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো, সেই ইতি। বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে সাবা এক পলক তাকালো শাফকাতের দিকে। তবে তার চোখমুখ ভাবলেশহীন। একরাশ কঠোরতা ওই চোখদুটোর মাঝে।

শাফকাত সাবাকে কথা দিয়েছিল, যে করেই হোক এই মেয়েটাকে সে খুঁজে বের করবে। শাফকাত তার কথা রেখেছে। যে মেয়েটা এতদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিল তাকে খুঁজে এনেছে। কীভাবে শাফকাত ইতিকে খুঁজে পেলো? কী করে এই ঘরে বন্দি করলো? কোনো প্রশ্নই জেগে উঠলো না সাবার মনে।

তার চোখের সামনে তার ভাইয়ার খুনি। খুনি তো বটেই। শরীরে আঘাত করে প্রাণ কেড়ে নিলেই কি কেবল তাকে হত্যা বলা যায়? প্রাণে আঘাত করে প্রাণ কেড়ে নেওয়াও তো এক প্রকার হত্যা।

দিনের পর দিন এই মুহূর্তটাকে কল্পনায় দেখেছে সাবা। ইতিকে খুঁজে পেলে কী করবে তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। তবে বাস্তবে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার পর সবটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনো পরিকল্পনাই আর কাজে আসছে না।

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “কী করতে চাও তুমি ওর সাথে?”

সাবার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। চোখদুটো বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।

শাফকাত দুহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “সাবা? তুমি না অনেক সাহসী? ভেঙে পড়লে চলবে? তুমি ভেঙে পড়লে এই মেয়েটাকে শাস্তি কে দেবে?”

একবার ইতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সাবা। কেমন তেজি চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ বেয়ে আরেক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ার আগেই নিজের হাতে মুছে ফেলল সাবা।

শাফকাত আবারও একই প্রশ্ন করলো তাকে, “কী করবে ওর সাথে?”

সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “একটু… একটু কথা বলি?”

শাফকাত হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো সাবার দিকে। যতগুলো উত্তর সাবার কাছ থেকে সে প্রত্যাশা করেছিল, তার মধ্যে কোথাও এই উত্তরটা ছিল না।

তবুও সাবাকে ইতির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিলো শাফকাত। ধীরস্থিরভাবে তাকে বসালো ইতির সামনে থাকা একটা কাঠের চেয়ারে।

সাবার কম্পিত চোখদুটো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইতির দিকে। আজই কি তবে মিলবে তার জীবনের সকল প্রশ্নের উত্তর?

(চলবে)