হয়তো তোমারই জন্য পর্ব-০৯

0
2

#হয়তো_তোমারই_জন্য
#পর্বসংখ্যা_৯
#সাদিয়া_তাসনিম

সাঁঝ সবে মাত্র কলেজ থেকে ফিরেছে। আজ তেমন একটা ক্লাস হয়নি। বারোটার দিকেই ছুটি হয়ে গেছে। আজকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে দাবাদাহ। গ্রীষ্মের শুরুতে যে গরম পরে নি তা হয়তো আজই পড়ে প্রকৃতি তার ক্ষোভ মেটাচ্ছে।
তারপর কলেজ থেকে বের হয়ে একটা রিকশাও পায়নি সাঁঝ তাই বাধ্য হয়ে এতোটা পথ হেঁটে এসেছে। প্যাচ পেচে ঘামে সে ভিজে নেয়ে একেকার অবস্থা। অস্বস্তিকর ভাবে বেড়েই চলেছে ঘামের নিঃসরণ। সাঁঝ নিজের দূর্বল শরীরটা টেনে নিয়ে এসে তালুকদার বাড়িতে প্রবেশ করলো। আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্যানের সুইচটা দিয়ে সোফায় উপর গিয়ে বসে পড়লো। সাঁঝ নিজের হিজাবটা খুলে নিজের বেনী করা চুলটাও খোঁপা করে বসলো। তার এতো গরম লাগছে যে সে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। সাঁঝ চোখ বুঁজে নিজের মাথাটা সোফার উপর এলিয়ে দিলো তারপর উচ্চ শব্দ তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

‘ আম্মুম্মুম্মুম্মু… একটু পানি দিয়ে যাও।’

কিছু সময় কাটলো কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। সাঁঝ আবারও তার আম্মুকে ডেকে আগের কথাটা বলে উঠলো। একেতে সাঁঝ অলস তারপর আবার এখন সে ক্লান্ত এখন সে মোটেও উঠে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে খাবে না। যখন দুইবার ডাকার পরও তার আম্মু কোনো কথা বলো না তখন সাঁঝ নিজের চোখ খুলে সামনে তাকালো। সামনের দিকে তাকাতেই সে নিজের চোখ গোল গোল করে নিলো। সে দেখলো সৌহার্দ্য তার দিকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এগিয়ে আসছে। সৌহার্দ্য কয়েক মূহুর্তের মধ্যে পানির গ্লাসটা সাঁঝের সামনে ধরে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ নে ধর।’

সৌহার্দ্যের এমন অপ্রত্যাশিত আগন সাঁঝে চমকে দিলো। সে একবার সৌহার্দ্যর দিকে তাকালো। সৌহার্দ্যের দিকে তাকাতেই সাঁঝের খড়খড়ে মরুভূমির মতো মনটা শীতল হয়ে গেলো। এতো ক্লান্তির পরও সাঁঝের মুখমণ্ডল স্নিগ্ধ হয়ে গেলো। সৌহার্দ্যকে আজ এখানে দেখে তার ভিতরটা উথাল-পাতাল করে উঠলো। সাঁঝ না চায়তেই তার মনে বারবার প্রশান্তির বাতাস খেলে গেলো সৌহার্দ্যকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার হৃৎস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে গেলো এক নিমিষেই। প্রতিবারের মতো তাকে চমকে দিয়ে সৌহার্দ্য মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ কী দেখছিস? জানি আমি হ্যান্ডসাম কিন্তু এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার কিছু নেই।’

সৌহার্দ্যের এমন ধারার কথা শুনে সাঁঝ বিরক্তিতে নিজের চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। সৌহার্দ্য এসেছে বলে তার মধ্যে যে এক ধরনের ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করছিলো তা সৌহার্দ্যের এমন কথায় যেনও মরে গেলো। সাঁঝ সৌহার্দ্যের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আপনি আর হ্যান্ডসাম? সো ফানি? বিশ্বাস করেন ভাইয়া, আমি প্রহর ভাইয়ার মতো সুন্দর পুরুষ মানুষ আর দেখিনি।’

সৌহার্দ্য সাঁঝের কথাটা শুনে সে সাঁঝের দিকে কিছুটা ঝুঁকি গিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

‘ প্রহর ভাই বুক হয়ে গেছে ওদিকে নজর দিয়ে লাভ নেই।’

সাঁঝ সৌহার্দ্যের কথাটা শুনতে শুনতে গ্লাসের সব পানি শেষ করে দিলো। গ্লাসটা মুখের কাছ থেকে নিচে নামিয়ে নিজের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলে উঠলো,

‘ নজর কখন দিলাম? আমি তো শুধু বললাম প্রহর ভাইয়ের মতো সুন্দর পুরুষ আমি দেখিনি।’

সাঁঝের কথাটা শুনে সৌহার্দ্য সাঁঝের চোখের দিকে তাকালো। সাঁঝ আগে থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো কিন্তু সাঁঝ আজ নিজের চোখ অন্য দিকে ঘোরালো না। সৌহার্দ্য সাঁঝের চোখে চোখ রেখে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আমার দিকে তাকা দেখতে পাবি আমি নিশ্চিত। ‘

সৌহার্দ্যের কথা শুনে সাঁঝ বিরক্তিতে বলে উঠলো,

‘ আপনি তো একটা খাম্বা। আপনার দিকে তাকালে রাস্তায় খাম্বা থাকে না, আমার তার কথা মনে পরে। চিকনা-পাতলা, সাদা ধবধবে, লম্বা খাটাশ আপনি। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় তখন খাম্বাগুলোর দিকে তাকালেই আপনার কথায় মনে পরে যাই। ‘

‘ খুব বেশি বকবক করছিস আজকাল তাই না?’

‘ হাল্কা একটু। আচ্ছা ভাইয়া আমি আপনাকে একটা কথা বলবো?’

‘ সেই ধরেই তো বলেই চলেছিস।’

‘ আপনার না আর অল্প একটু ওজন গেইন করলে ভালো লাগবে। আমি বড়আম্মুকে বলে দিবেনি যেনও সে আপনাকে বেঁধে বেশি বেশি খাবার খাওয়ায়।’

‘ তুই রান্না করতে শেখ, আমাকে বেঁধে খাওয়াতে হবে না, এমনি এমনি সব চেটেপুটে খেয়ে উঠবন।’

‘ চাষা বাঁচে আশায় আর এখানে দেখি সৌহার্দ্য বাঁচে আমার হাতের রান্না খাওয়ার আশায়। জানেন সেদিন কী হয়েছে? ‘

‘ কী? ‘

‘ আমি আর লুবনা বিরিয়ানি রান্না করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু লুবনা আমাকে দিয়ে জোর করে বিরিয়ানিতে হলুদ দেওয়ায়ছে। রান্না করার পর সেটা বিরিয়ানি খেতে কম খিচুড়ি লেগেছে বেশি। আর আপনি বসে আছেন কবে আমি রান্না শিখবো তারপর আপনি খেয়ে মোটা হবেন আল্লাহ! ‘

সৌহার্দ্য সাঁঝের এমন মুখ করা দেখে হাসালো। সে একবার সাঁঝের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।’

সাঁঝ উঠে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু কিছু একটা মনে পরতেই সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ ভাইয়া নুপুরটা কী আপনি দিয়েছেন?’

সৌহার্দ্য সাঁঝের কথাটা শুনে কোনো দ্বিধা ছাড়ায় বলে উঠলো,

‘ হুম।’

‘ কখন দিলেন?’

‘ বিগত বারো ঘন্টার মধ্যে। ‘

‘ অসহ্য। ‘

কথাটা বলে সাঁঝ নিজের রুমের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো ঠিক তখনই আবারও সৌহার্দ্য বলে উঠলো,

‘ শোন।’

সাঁঝ থেকে গিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে উঠলো,

‘ কী?’

‘ তুই দিন দিন ভুতের মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছিস। নিজের যত্ন নে আর আমার উপর দয়া কর।’

সাঁঝ সৌহার্দ্যের কথাটা শুনে নিজের মুখ কুঁচকে নিলো। সৌহার্দ্যের কথার বিপরীতে সাঁঝ মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,

‘ থ্যাংকস ফর ইউর কমপ্লিমেন্ট। আমি জানি, আমি দিন দিন ভূতের মতো হয়ে যাচ্ছি আপনি যদি আর একটু উৎসাহ দেন তবে এখনই বট গাছে পা ঝোলাতে চলে যাচ্ছি। ‘

‘ মানে সব কথাতে মজা বের করবে, বেয়াদব একটা। যা রুমে যা।’

দুপুর দুইটা দশ মিনিট,

সাঁঝ নিজের খাবারের প্লেটটা হাতে, টিভির সামনে বসে এনিমি দেখছে আর খাবার খাচ্ছে। বাংলাদেশে মাত্র একটা চ্যানেলই আছে যেখানে হিন্দিতে ডাব্লিং করে দেয়। সাঁঝ এক লোকমা খাবার মুখে তুলছে আর দশ মিনিট ধরে টিভির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আজ তার মা বাড়িতে নেয় বলে কেউ এসে সাঁঝের এমন কাজের জন্য থাপ্পড়ও লাগাতে পারছে না। এতোক্ষণ সাঁঝ ড্রয়িং রুমে একাই বসে টিভি দেখছিলো কিন্তু কোথা থেকে হুট করে সৌহার্দ্য আর সাঈদ সেখানে এসে পড়ে। সাঈদ এসেই সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে উঠে,

‘ এই সব বাচ্চারা মানুষ হলো না এখনও কার্টুন দেখে।’

সাঈদের কথাটা শেষ হতে না হতেই সাঁঝ টিভির দিক থেকে এক ঝটকায় নিজের মুখটা তুলে সাঈদের দিকে তাকায়। সাঈদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,

‘ ভাইয়া তুমি সারা জীবন গাধায় রয়ে গেলে? কার্টুন আর এনিমির মধ্যে পার্থক্য কী সেটাও জানো না এখনও ছিঃ । ‘

‘ কার্টুন বাচ্চারা দেখে আর এনিমিও বাচ্চারা দেখে বুঝছি?এই হিসেবে হিসাব সিম্পল। দুইটাই একই জিনিস। ‘

‘ সৌহার্দ্য ভাইকে কোন দিক থেকে বাচ্চা মনে হয় তোমার?’

‘ কেনও সৌহার্দ্যকে বাচ্চা লাগবে কেন?’

‘ সৌহার্দ্য ভাই আমাকে বলেছিলো এনিমি দেখতে। ভাইয়া নিজেও দেখে জিজ্ঞাসা করো।’

সাঈদ সাঁঝের কথাটা শুনে সৌহার্দ্যের দিকে আড়চোখে তাকালো। সৌহার্দ্যের দৃষ্টি তখন নিজের ফোনের দিকে নিবন্ধ। সাঈদ সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে উঠলো,

‘ কী ভাবছিস তুই?’

সাঈদের কথাটা শুনে সৌহার্দ্য নিজের ফোনের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সাঁঝের উদ্দেশ্যে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ ভাবছি এই গাধীটা শ্বশুর বাড়িতে গেলে কীভাবে সকলের সামনে টিভিতে কার্টুন চালিয়ে দেখবে আর খাবার খাবে সেটাই।’

সৌহার্দ্য সাঁঝকে কটাক্ষ করে কথাটা বলেও সাঁঝের মনে হলো সৌহার্দ্য তার জন্য চিন্তা করে কথাটা বলেছে তাই সাঁঝও সৌহার্দ্যের সাথে তাল মিলিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ কথাটা মাঝে মাঝে আমিও ভাবি ভাইয়া।’

‘ সাঈদ আমার হয়ে গাধীটার মাথায় একটা চড় দে তো। আমি ওরে বলেছি নিজের ইংরেজিকে ইম্প্রুভ করতে চায়লে ইংরেজিতে ডাব করা কয়েকটা এনিমি দেখবি কিন্তু দেখ ও কী করছে? হিন্দি দেখছে, অসভ্য একটা। ‘

‘ হিন্দিতে দেখলে যে ফিলিংসটা আসে তা ইংরেজিতে দেখলে আসে না ভাইয়া ।’

‘ এই জন্যই কোনো গুনী ব্যক্তি বলেছিলো গাধাকে যতোই পেটাও তাকে কখনো ঘোড়া বানাতে পারবে না।’

সাঁঝ টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে তার বিপরীত সোফায় বসে থাকা সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য তখন নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ টিভিটা বন্ধ করে, টিভির রিমোট সাঈদের গায়ে চেলে মেরে সৌহার্দ্যকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘ আপনি গাধা। সবসময় উল্টো পাল্টা নাম ধরে ডাকবে। ভাল লাগে না কেলা। ‘

কথাগুলো বলে সাঁঝ সেখানে আর দাড়ালো না গটগট করে চলে গেলো সেখান থেকে।

‘ দেখেছিস সাঈদ ও আবারও কেলা বলে গেলে? ওকে আজ আমি ছাঁদ থেকে যদি ধাক্কা না মেরেছি। ‘

সৌহার্দ্য সাঁঝকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেও সেগুলোর কিছুই সাঁঝের কানে গেলো না।

চলবে…