রণরঙ্গিণী প্রেমরঙ্গা পর্ব-৪+৫

0
4

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

সকাল সকাল ফর্মাল ড্রেসআপে তৈরি হয়ে বসে আছেন মেহরাব শিকদার। একটা জরুরি কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হবে৷ কেন— কী কারণে তা কাউকে বলতে পারছেন না তিনি। ফিরোজা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন তবে মেহরাব শিকদার বারবারই এড়িয়ে গেছেন উনাকে। যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। একপ্রকার না খেয়েই তিনি মালঞ্চ নীড় থেকে বেরিয়ে গেলেন।

খাবার টেবিলে নানা রকমের খাবার সাজিয়ে রাখা রয়েছে৷ সবকিছুই আজ মাধুরী নিজের হাতে তৈরি করেছেন৷ মোর্শেদ শিকদার‚ প্রলয়‚ অর্পণ আগেই নিজেদের চেয়ারে বসে আছেন। এ বাড়ির একটা নিয়ম হচ্ছে— সবাই একসঙ্গে খাওয়া শুরু করেন। এদিকে প্রলয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে তৃপ্তিও এলো। সে গিয়ে সোজা প্রলয়ের পাশে বসতে নিল। আবারও প্রলয় রাশভারী কণ্ঠে বলল‚

“যারতার পাশাপাশি আমি বসি না৷ আপনি প্লিজ পূর্ণ অথবা পুষ্পর পাশে গিয়ে বসুন।”

মোর্শেদ শিকদার রাগী স্বরে বললেন‚ “এ কোন ধরনের ব্যবহার তোমার?”

আবারও অপমানিত বোধ করল তৃপ্তি। লোকটার সমস্যা কী? কেন বারবার তাকে এভাবে অপমান করছে? মাধুরী কিছুটা চোখ রাঙিয়ে প্রলয়কে বললেন‚

“মেহমানদের সঙ্গে কী কেউ এই ধরনের আচরণ করে?”

“তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত— আমি এমনই।”

“তৃপ্তি মা‚ তুমি কিছু মনে কোরো না।”

“কোনো ব্যাপার না আন্টি৷ আমি কিছু মনে করিনি।”

তৃপ্তি গিয়ে পূর্ণর পাশে বসল। প্লেটে খাবার দিলেন মাধুরী। খাবার খাওয়ার ইচ্ছেই ম’রে গেছে তৃপ্তির। বারবার মাধুরী আন্টির কথা শুনতে গিয়ে তাকে অপমান হতে হচ্ছে। ছোটো থেকে আজ অবধি কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। তবে আজ? ভাবতেই গলা ঝেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার৷ খাবার নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করছে তৃপ্তি। মাধুরী আহ্লাদে গদগদ সুরে বললেন‚

“এ কী তৃপ্তি— তুমি তো দেখছি কিছুই খাচ্ছ না। পূর্ণ তরকারির বাটিটা এদিকে দে তো।”

“আন্টি প্লিজ আপনি ব্যস্ত হবেন না।”

এই মেয়েকে দেখে এত আদিখ্যেতা করার মানে প্রলয় আগে থেকেই বুঝতে পেরেছে। তবে সে তো দমে যাবে না। আর না মায়ের উদ্দেশ্যকে সফল হতে দেবে।

রাক্ষুসে রোদ্দুর তপ্ততা ছড়াচ্ছে মেদিনীর বুকে। নীলচে অম্বর জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে শুভ্র তুলোর ঝাঁক৷ সাঁই বেগে ট্রেন ছুটছে। তপ্ত শীতল মিশ্রিত বাতাস বইছে পুরো কেবিন জুড়ে। ট্যুরের কথা বলতে দেরি— তিনজনে বাক্সপেটরা গুছিয়ে ছুটেছে রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে৷ অনলাইনে টিকিট কে’টে রেখছিল মৃত্তিকা। যেন সে এই অপেক্ষাতেই ছিল। এখন সময়টা দুপুর। ওরা রওনা হয়েছে এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে৷ সকালে চটজলদি কিছু নাস্তা টাইপ খাবার বানিয়ে নিয়েছিল মৃত্তিকা। লুচি‚ সবজি‚ সাদা আলুর তরকারি আর সুদর্শিনী প্রয়োজনীয় সবকিছু। এমনিতেই থাকা খাওয়ার বন্দবস্ত সে আগেই করে রেখেছে৷ গ্রামে বেড়াতে আসার ইচ্ছেটা অনেকদিন ধরেই ছিল। তবে সময়ের স্বল্পতার কারণে কিছুই হয়ে উঠছিল না৷ তনুজার কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমচ্ছে সুদর্শিনী। ইদানীং প্রচুর ঘুম পায় তার৷ যখনই সময় পায় তখনই ঘুম। প্রেগন্যান্সির সময় এমনটাই হয় হয়তো। তনুজা বোনঝির মাথায় আলতো পরশ এঁকে দিচ্ছেন। মৃত্তিকা ওদের মুখোমুখি বসেছে৷ তার দৃষ্টি এখন বাহিরের দিকে স্থির। ক্ষিপ্রবেগে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। অপরপ্রান্তের গাছ-গাছালি‚ দোকানপাট যেন ট্রেনের সঙ্গেই উল্টো পথে ছুটছে। দুচোখ মুদে দীর্ঘ নিশ্বাস নিল মৃত্তিকা। শহর থেকে অনেকটা দূর চলে এসেছে। প্রাকৃতিক পরিমন্ডলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকছে৷ চোখ বন্ধ রেখেই উপভোগ করল মৃত্তিকা। তনুজা এদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। মেয়েটা দিনকে দিন কেমন নিস্পৃহ হয়ে যাচ্ছে। রণরঙ্গিণী রূপে সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে অহর্নিশ।

পশ্চিমাকাশ উজ্জ্বল লালচে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। উড়তে থাকা আবগুলোও একই বর্ণ ধারণ করেছে৷ দেখে মনে হচ্ছে অম্বরে র’ক্তজবার মেলা বসেছে। সাদা রঙা গাড়িটা একটা পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ পরিত্যক্ত বাড়ির ইটের দেয়াল খসে খসে পড়ছে। মরিচাধরা ভাঙা জানালা ঝুলে রয়েছে। উঠোনে গজিয়ে ওঠা আগাছা গুলো জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। দোচালা বিশিষ্ট বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে। মেহরাব শিকদার গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার কাছে গেলেন। কিছু পুরোনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। গভীর চিন্তায় ডুব দিল মেহরাব শিকদার।

“আমি মা হতে চলেছি মেহরাব।”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর কথা শুনে স্তব্ধ‚ নির্বাক হয়ে রইল মেহরাব শিকদার। এই সন্তান তো তার চাই না। ঘরে বউ রয়েছে‚ তিন বছরের ফুটফুটে ছেলে রয়েছে। এই সন্তান পৃথিবীতে এলে তো তার সাজানো সংসার ধ্বংস হয়ে যাবে। না— এ কিছুতে হতে পারে না৷ রুক্ষ স্বরে মেহরাব শিকদার বললেন‚

“বাচ্চাটা নষ্ট করে দাও মহু!”

মেহরাব শিকদারের মুখে এহেন কথা কর্ণগোচর হতেই নিটোল পা দুটো টলে উঠল। নিঃসাড় দেহ নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল৷ এই নিকৃষ্ট লোকটাকে এতদিন ধরে ভালোবেসে এসেছে৷ ঘৃণায় জর্জরিত গর্ভিণীর কোমল হৃদয়৷ কম্পিত কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল‚

“এমন কথা বোলো না গো। এটা তো আমাদের প্রথম সন্তান তাইনা?”

“আমার ঘরে বউ আছে— বাচ্চা আছে।”

দুহাত দ্বারা কান বন্ধ করল৷ এত বড়ো মিথ্যে! এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা! সবকিছুই অবিশ্বাস্য লাগছে৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল মেয়েটা৷ ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল‚

“ক..কী বললে তুমি?”

“ঠিকই শুনেছ তুমি। তিন বছরের ছেলে আছে আমার।”

“এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা কেন করলে তুমি?”

“আমি কিছু জানি না৷ শুধু এইটুকু বলতে পারি— এই সন্তানের কোনো দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।”

“এ-ও তো তোমারই অংশ৷ ওর প্রতি অবিচার কেন?”

“আমার সুখের সংসার ছারখার হয়ে যাবে। প্লিজ মুক্তি দাও আমায়।”

তাচ্ছিল্য করে হাসল রমণী। কণ্ঠনালিতে হরতাল নেমেছে। মফস্বলের সরল মেয়েটাকে একটা ছোট্টো সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে একটুও বুক কাঁপছে না এই লোকটার৷ নৃত্যশিল্পী হবার স্বপ্ন বুঝি এখানেই শেষ। নেত্রপল্লব হতে কয়েক ফোটা অশ্রুবর্ষিত হলো৷

একটা রাশভারি কণ্ঠে অন্যমনস্ক চেতনায় পানি পড়ল। কিছুটা হকচকিত‚ বিমূঢ় ভাব এলো মেহরাব শিকদারের গভীর মুখপানে। চোখের সামনে যেন পুরোনো অতীত ভেসে উঠল৷ প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘর্মাক্ত মুখশ্রী মুছে নিলেন মেহরাব শিকদার। দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন৷ ক্রস্ত কণ্ঠে ড্রাইভারকে বললেন‚

“রাসেল গাড়ি ঘোরাও। মোড়ল বাড়িতে যাবে।”

হায়দার আলী স্কুলের মাঠে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে৷ বিরোধী দলের নাজিম চৌধুরী এই সমাবেশের আয়োজন করেছেন৷ আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এই সমাবেশ আয়োজিত হয়েছে৷ পুরো মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। উত্তর দিকে স্টেজ সাজানো হয়েছে আর সামনে শত শত চেয়ার বিছিয়ে রাখা। এমনটাই শুনেছে প্রলয়। স্কুলের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়ের গাড়িটা৷ প্রলয় ড্রাইভিং সিটে বসা। তার পাশেই অর্পণ রয়েছে৷ বাহিরে কোনো কাজ পড়লে ছেলেটা তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে৷ এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে চায় না৷ প্রতিনিয়ত নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে যেন। ফোনে ক্রমাগত কল আসছে অর্পণের৷ ইরা কল করছে৷ প্রলয় বুঝতে পারল। সে অর্পণকে বলল‚

“কথা বলছিস না কেন ওর সাথে?”

“কল ধরলেই বলবে দেখা করার জন্য।”

“তো যা— দেখা করে আয়।”

“তোমাকে ছেড়ে এখন কোথাও যাব না আমি।”

“সবসময় এমন আঠার মতো সেঁটে থাকিস কেন? আমার কিন্তু ভয় করে!”

প্রলয়ের কথায় বোকা বনে গেল অর্পণ। চেয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে৷ সে বলল‚

“কীসের মধ্যে কী বলছ ভাই?”

প্রলয় আবারও বলল‚ “আমি কী তোর জিএফ নাকি?”

“প্লিজ ভাই তুমি চুপ কর! তুমি মুখ খুললেই আমার অস্বস্তি হয়।”

শব্দ করে হেসে উঠল প্রলয়। অর্পণ কল রিসিভ করে মিনমিনে স্বরে বলল‚ “আমি আসছি।” প্রলয় গাড়ি স্টার্ট দিল৷ কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়ে অর্পণকে নামিয়ে দিল। অর্পণ চলে যেতেই প্রলয় আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল৷ উদ্দেশ্য পার্টি অফিস। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে বাকিদের সঙ্গে। পার্টি অফিসের কাছ অবধি চলে এসেছে৷ গাড়ি স্পিড কমাতে গিয়েই বুঝতে পারল— গাড়ি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রলয়। কী করে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! এমন পরিস্থিতে কখনো পড়তে হয়নি তাকে৷ নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে৷ মনে মনে বারবার আল্লাহর নাম স্মরণ করছে প্রলয়৷ সামনে থেকে একটা ট্রাক ছুটে আসছে। বারবার হর্ন বাজাচ্ছে। শত চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছে না প্রলয়৷ বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে। গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রাক আর গাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নেই। ড্রাইভারও চেষ্টা করছে গাড়িটা সাইড করার। মুহূর্তেই প্রলয়ের গাড়িটা উল্টে একটা বড়ো আম গাছের কাছে গিয়ে ঠেকল। আশেপাশের অনেক মানুষই ছুটে এসেছে এখানে। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই।

মাথায় প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছে। ভ্রুর কাছে এক টুকরো কাঁচ খুব গভীর ভাবে গেঁথে রয়েছে। অল্পের জন্য চোখে লাগেনি। কয়েক টুকরো কাঁচ ছিকটে এসে গেঁথেছে প্রলয়ের বাহুতে৷ টপটপ করে র’ক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে৷ কপাল কে’টেও র’ক্ত ঝড়ছে। ধবধবে পাঞ্জাবিটা র’ক্তরঞ্জিত রূপ নিয়েছে। কাটখোট্টা শরীর নিমিষেই দূর্বল‚ নিঃসাড় হতে শুরু করল। চোখ বন্ধ করার আগে ভূমির হাস্যজ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তাকে দেখে যেন খিলখিলিয়ে হাসছে৷ সেই হাসির রিনিঝিনি শব্দ মাদল বাজতে শুরু করেছে৷

খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। অর্পণ এখানে এসেছে সবে দশ মিনিট হলো। রেস্টুরেন্টের বাহিরে ইরা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। অর্পণকে নিয়েই রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করল ইরা। মেনু কার্ড দেখে— ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করল অর্পণ। ওয়েটার চলে যেতেই ইরা জিজ্ঞেস করল‚

“কাল রাতে কী হয়েছিল তোমার?”

“কিছু হয়নি আমার। আ’ম অ্যাবসোলুটলি ফাইন।”

“তুমি যতই আড়াল করার চেষ্টা করো— তোমার মন তো একটু হলেও বুঝি আমি।”

অর্পণ কিছু বলল না৷ ইরার থেকে মুখ ফিরিয়ে আশেপাশে তাকাল। রঙিন বাতি দিয়ে সাজানো সিমসাম রেস্টুরেন্ট৷ সফট মিউজিক বাজছে৷ এখানে বেশিরভাগই কপোত কপোতীরা রয়েছে৷ অর্পণের থেকে কোনো রকম উত্তর না পেয়ে ইরা আবারও জিজ্ঞেস করল‚

“আঙ্কেল অথবা প্রলয় ভাইয়ার জন্য আপসেট?”

একটুও চমকাল না অর্পণ। মুখে কিছু না বললেও মেয়েটা তাকে কতটা বোঝে৷ অথচ মন খারাপের দিনে এই মেয়েটাকেই সে বেশি অবহেলা করে৷ ইরার হাতটা ধরে‚ আশ্বস্ত করে বলল‚

“আমার জন্য চিন্তা কোরো না ইরাবতী। কালকের করা ব্যবহারে আমি অত্যন্ত দুঃখিত।”

“তুমি প্লিজ এভাবে বোলো না৷ আমার তোমার জন্য চিন্তা হয় কিন্তু আমি জানি— আমার অর্পণ খুব স্ট্রং৷”

মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে অর্পণ বলল‚ “ইয়াহ!”

এমন সময় অর্পণের ফোনে কল এলো। কল রিসিভ করার পর অপরপ্রান্ত থেকে এমন একটা খবর এলো যে‚ সে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না৷ এমন একটা পরিস্থিতে কে-ইবা নিজেকে স্থির রাখতে পারে? তার ভাইয়ের যে এক্সিডেন্ট হয়েছে৷ এখন কী অবস্থায় রয়েছে তারও কোনো খবর নেই। খাবার না খাওয়া স্বত্তেও বিল প্যে করে দিল অর্পণ। এরপর ইরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি করে একটা সিএনজিতে উঠে পড়ল দুজনে৷ মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করল অর্পণ। আজ যদি সে তার ভাইকে একা না ছাড়ত তাহলে হয়তো এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটত না৷ ইরা শক্ত করে অর্পণের হাতটা ধরে রেখেছে। আধ ঘণ্টার মাঝেই হসপিটালের পৌঁছে যায় দুজনে। ওদের হসপিটালেই প্রলয়কে আনা হয়েছে। এই তো ঘণ্টা খানেক আগেও আসার সময় প্রলয়ের সঙ্গেই এসেছিল৷ সুস্থ স্বাভাবিক ভাইকে এমন অবস্থায় দেখবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি অর্পণ। ইতিমধ্যেই এই খবরটা বাড়িতে পৌঁছে গেছে৷

খুবই নিভৃতে আড়ালে চিকিৎসা করা হচ্ছে প্রলয়ের৷ অর্পণ নিজ দায়িত্বে ভাইয়ের চিকিৎসা করছে। তবে এ খবর প্রেস মিডিয়া অথবা শত্রুপক্ষের কানে গেলে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে যাবে৷ অর্পণ কাউকে কিছু জানতে চাইছে না। তবে আসল দোষীকে তো শাস্তি পেতেই হবে৷

সকলের অস্থিরতায় সন্ধ্যে গড়িয়েছে খুবই অদ্ভুত ভাবে৷ মসজিদে মাগরিবের আজান পড়েছে। হসপিটালের করিডরে ক্রমাগত পায়চারি করছেন মোর্শেদ শিকদার। ছেলের চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে উনার। মেহরাব শিকদারকে কলে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নেটওয়ার্ক নেই। এদিকে ছেলের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছেন না মাধুরী। ফিরোজা সামলাচ্ছেন উনাকে। পূর্ণতা আর পুষ্পিতাকে তৃপ্তির কাছে রেখে এসেছেন উনারা। মেয়ে দুটো হসপিটালে আসার জন্য খুব কান্না করছিল। কিন্তু হসপিটালে এত ভীড় না বাড়ানোই ভালো। এরই মাঝে কেবিন থেকে বের হয়ে এলো অর্পণ। ওকে দেখা মাত্রই মোর্শেদ শিকদার জিজ্ঞেস করলেন‚

“প্রলয় কেমন আছে?”

কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই অর্পণ বলল‚ “ভয়ের কোনো কারণ নেই জেঠু। ক্ষ’তগুলো কিছুটা গভীর ছিল আর কপালে চারটে সেলাই লেগেছে। ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে৷ ভাই সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

“ওকে কী বাড়িতে নিয়ে যাবি নাকি হসপিটালেই থাকবে?”

“বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া যাবে৷”

দুজনের কথার মাঝখানেই ফোড়ন কা’টলেন মাধুরী। ব্যাকুল চিত্তে অর্পণের হাত আঁকড়ে জিজ্ঞেস করলেন‚

“আমার ছেলেটা কেমন আছে? সুস্থ হয়ে যাবে তো?”

কিছুটা আশ্বাস দিয়ে অর্পণ বলল‚ “তুমি চিন্তা কোরো না জেঠিমা। ভাই খুব শীগ্রই সুস্থ হয়ে যাবে।”

গ্রামে সন্ধ্যা হতে রাত নেমে আসে। রাস্তাঘাটেও মানুষের আনাগোনা কমে যায়৷ উঠোনের তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালিয়েছেন গৌরী৷ সম্পর্কে তিনি তনুজার ননদ হন। আর এই রাজবংশী পরিবারের মাথা। তনুজা উনার ননদের ভিটেয় উঠেছেন৷ অসময়ে মেয়েটার বায়না পূরণ করছে এখানে থাকতে হচ্ছে। না জানি কখন কোন কথা বলে ওঠেন তিনি৷ মৃত্তিকা উনার চোখের বালি। এই নিয়ে খুবই চিন্তায় আছেন তনুজা। এদিকে শাঁখ বাজানো হয়ে এলে গৌরী বললেন‚

“আমার একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ বৌদিভাই। ও মেয়েকে এদিকে সেদিক টই টই করতে বারণ করে দেবে৷ আমার বাড়িতে কোনো অনাচার আমি সইতে পারব না। এই তোমাকে আমি বলে দিলুম।”

“আহা ঠাকুরঝি এভাবে বোলো না৷”

“তোমাদের আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না বাপু।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তনুজা৷ মৃত্তিকা পছন্দ করেন না গৌরী। প্রথম থেকেই মেয়েটা তিনি হেলাফেলাই করে গেলেন। আবছা আঁধারিয়ায় দোতলা বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলেন মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে মৃত্তিকা সেখান থেকে চলে গেল৷ তনুজা উনার ননদের দিকে তাকিয়ে বললেন‚

“আমি ঘরে যাচ্ছি।”

গৌরী কিছু বললেন না। শঙ্খটা হাতে করে নিয়ে মন্দিরে চলে গেলেন। কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় প্রথম ঘরটায় প্রবেশ করলেন তনুজা। ঘুমন্ত সুদর্শিনীর মাথার কাছটায় বসে রয়েছে মৃত্তিকা৷ দরজা খানিকটা চাপিয়ে তনুজা সেখানেই গেলেন। নিজে থেকেই বললেন‚

“পিসিমণির কথায় কিছু মনে করিস না মা। তুই তো জানিসই সে কেমন?”

“আমি কিছু মনে করিনি মামনি।”

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মাথার কাছটায় বসেই সুদর্শিনীকে ডাকতে শুরু করল মৃত্তিকা৷ তনুজা বিছানার অপর প্রান্তে বসেছেন৷ কয়েকবার ডাকার পরও যখন সুদর্শিনী উঠল না তখন মৃত্তিকা বলল‚

“অ্যাই দিদিভাই— তুই এত ঘুমকাতুরে কবে হলি? আগে তো এমন ছিলি না?”

তনুজা বললেন‚ “এ সময় খুব ঘুম পায় এটাই স্বাভাবিক।”

সুদর্শিনী উঠে বসল৷ বিকেলে হালকা কিছু খেয়েই জম্পেশ ঘুম দিয়েছিল৷ জার্নি করে প্রচণ্ড অলসতা তাকে কাবু করছিল৷ এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে। সে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল‚

“চাইলে তুইও আমার সঙ্গে ঘুমতে পারিস। আমি একটুও মাইন্ড করব না।”

“বয়েই গেছে আমার। আমি মোটেও তোর মতো ঘুম কাতুরে নই।”

“মাসিমণি! তোমার কী মনে হয় না— আমাদের মৃত্তিকাকে বিয়ে দেওয়া উচিত?”

“কীসের মধ্যে কী বলছিস দিদিভাই?”

তনুজা বললেন‚ “ও ভুল কী বলেছে? তুই একটু ওকে বোঝা মা। আমি তো কতই বলি— আমার কথা শুনলে তো!”

“আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি৷ এখানে এইসব অযৌক্তিক কথাবার্তা না বললেই নয়?”

“আমার তো বয়স হয়েছে! আমার কিছু হয়ে গেলে তুই তো একা হয়ে যাবি মা।”

তনুজার কথায় খারাপ লাগা শুরু হলো। একমাত্র তার জন্য এত দুশ্চিন্তা করেন তিনি। কথা কাটানোর জন্য মৃত্তিকা বলল‚

“মামনি তুমি আবার ওইসব কথা বলা শুরু করেছ?”

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

প্রলয়কে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে৷ বাড়িতে আসার পরপরই মাধুরী ব্যস্ত হয়ে পরলেন ছেলের সেবা শুশ্রূষা করায়। রান্নাঘরে ঢুকেছেন অনেকটা সময় হলো৷ প্রলয়ের জন্য স্যুপ বানাবেন। পূর্ণতা পুষ্পিতার পড়াশোনা আজ লাটে উঠেছে৷ দুটোতে মিলে ভাইয়ের হাত ধরে দুদিকে বসে রয়েছে৷ তৃপ্তিকে যে প্রলয় একদমই পছন্দ করছে না তা সে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে৷ তাইতো একবার প্রলয়ের সামনে পর্যন্ত যায়নি সে৷ যথাসম্ভব আড়ালে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একা একা থাকতেও ভালো লাগছে না৷ সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। তৃপ্তি একবার রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিল৷ মাধুরী সবজি কাটছেন৷ ভেতরে প্রবেশ করল সে৷ সেই সঙ্গে মাধুরীকে জিজ্ঞেস করল‚

“আন্টি আমি সাহায্য করি?”

“আমার কাজ প্রায় হয়ে গিয়েছে।”

তবুও দাঁড়িয়ে রইল তৃপ্তি৷ কোনো কথা নেই দুজনের মাঝে। মাধুরী নিজের মতো করে রান্না করছেন। নীরবতা কা’টিয়ে তৃপ্তি জিজ্ঞেস করল‚

“আন্টি আমি কাল সকালে চলে যেতে চাই।”

ঘাড় বাকিয়ে তৃপ্তির দিকে তাকালেন মাধুরী। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন‚

“কী বলছ এসব?”

“আপনি যা চাইছেন সেটা আমি করতে পারব না।”

“কেন?”

“মানুষের মন থেকে স্মৃতি মুছে ফেলা কী এতই সহজ? আমি আপনার ছেলের সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি তাতে বেশ ভালোই বুঝতে পারছি— উনি উনার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন।”

“সেই ভালোবাসাই তোমাকে মুছে দিতে হবে।”

“সেটা আমি করতে পারব না আন্টি।”

“তোমাকে পারতেই হবে৷ এখন ঘরে যাও৷ আমার অনেক কাজ পড়ে আছে৷ ছেলেটা এখন অসুস্থ।”

রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল তৃপ্তি। মাধুরী ছেলের জন্য স্যুপ রান্নায় মনোনিবেশ করলেন। এই সুযোগে ফিরোজা এসে রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিলেন।

সকালে…..

❝কিছু স্বপ্ন কিছু মেঘলা কিছু বইটই ধূলো লাগা
কিছু ইচ্ছে সাড়া দিচ্ছে এই বসন্ত রাত জাগা
মম চিত্তে পাশ ফিরতে আজ পলাশ ফুলের কাব্য
নীতে নৃত্যে ফুল ছিড়তে শুধু তোমার কথা ভাবব
আজ হাওয়া বেপরোয়া দিল সন্ধ্যে পাখির ঝাঁক
এই দিকে লাল বেল ফুল হৃদ মাঝারে থাক
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…লাগল
নীল দিগন্তে বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল… বসন্তে
নীল দিগন্তে!❞

[রবীন্দ্র সঙ্গীত]

নাচ শেষ হতেই করতালি দিতে শুরু করল সকলে৷ এখানে সকলে বলতে গৌরী রাজবংশীকে বাদ দিয়ে— তনুজা‚ সুদর্শিনী‚ অর্জুন‚ রিখিয়া আর অহনা৷ সকালেই অহনা বায়না ধরেছিল নাচ দেখবে৷ এমনিতে সবাই জানে মৃত্তিকা বেশ ভালো নাচ করে। একটা রিয়েলিটি শো’তে প্রথম স্থান পেয়েছিল সে৷ অহনার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও তালে তাল মিলিয়েছে। সকলের ইচ্ছে পূরণ করতেই রবীন্দ্র সঙ্গীতে নাচ করল মৃত্তিকা। ওকে এভাবে নাচতে দেখে মুখ ঝামটা দিলেন গৌরী। নাচটা যে ভালো লেগেছে সেটা তিনি মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে তিনি ঠিকই বুঝলেন৷ সকলের আনন্দে পানি ঢেলে গৌরী চেঁচিয়ে বললেন‚

“বলি শুধু নাচ দেখলেই কী পেট ভরবে লো?”

একটু থেমে গৌরী আবারও বললেন‚ “কী গো বউমা— তুমিও দেখছি এদের তালেই তাল মেলাচ্ছ!”

রিখিয়া চট করে উঠে দাঁড়াল। মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে বলল‚ “যাচ্ছি মা।”

দ্রুত পায়ে প্রস্থান নিল রিখিয়া৷ শাশুড়ীকে সে ভীষণ ভয় পায়। কিছুটা ভীতু প্রকৃতির সে৷ মনঃক্ষুণ্ন হলো সকলের৷ মায়ের প্রতি চরম বিরক্তি প্রকাশ করল অহনা। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। সবাই উঠোন ত্যাগ করল।

দুপুরে…

মাত্রই প্রলয়ের খবরটা পেলেন মেহরাব শিকদার। খবরটা পাওয়া মাত্রই ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটলেন তিনি৷ যে কাজে এসেছিলেন সেটা অন্তত ভাইপোর জীবনের থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ রাসেল গাড়ি ড্রাইভ করছেন আর মেহরাব শিকদার ফোন বের করে অর্পণের নাম্বারে বারবার ডায়াল করছেন। ছেলেটার ফোনে কিছুতেই কল লাগছে না৷ চলন্ত গাড়ির জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করতেই হকচকিয়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। গলা শুকিয়ে এলো উনার। হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। কম্পিত স্বরে আওড়ালেন “ভূ..ভূমি!” দ্রুত জানালার কাঁচ নামিয়ে বাহিরের দিকে তাকালেন। কই কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না? তবে কী সবই উনার মনের ভুল?

সময়টা দুপুর হলেও রোদের তপ্ততা অতটাও ঝাঁজালো নয়। হলদে আলোয় গায়ের রং ঝলমল করছে৷ লম্বা চুলগুলো বিনুনি গাঁথা। হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠছে। বেগুনি রঙা শাড়ির আঁচলটা কাঁধ জুড়ে জড়িয়ে নেওয়া। অহনাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে মৃত্তিকা৷ অহনা-ই জোর করে নিয়ে এসেছে তাকে৷ এই মেয়ের ঘরে বসার দুদণ্ড স্বস্তি নেই। সারাক্ষণ ঘোরাঘুরি আর সখীদের সঙ্গে খেলায় মজে থাকা। কিছুটা ডানপিটে স্বভাবেরও। এ মেয়েকেই গৌরী চোখে হারান। দুই ছেলের মাঝে এই একটি মাত্র মেয়ে উনার। ছোটো ছেলে এখন শহরে রয়েছে৷ হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। স্বামী গত হয়েছে অনেকগুলো বছর অতিবাহিত হয়েছে। মেয়ে‚ ছেলে আর বউমাকে নিয়েই উনার সংসার।

মৃত্তিকার হাতে কয়েকটা গাঁদা ফুল দিয়েছে অহনা। কমলা‚ হলুদ রঙের ফুলগুলো থেকে সুবাস ছড়াচ্ছে। দুজনের একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে৷ অহনা একবার পেছনে উঁকি দিয়ে মৃত্তিকা বিনুনি দেখে মিটিমিটি হাসল। এরপর লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল‚

“দিদি তুমি খুব সুন্দর।”

দাঁড়িয়ে পড়ল মৃত্তিকা৷ তাকে অনুসরণ করে অহনাও থেমে গেল৷ গাল এলিয়ে হেসে মৃত্তিকা বলল‚ “মোটেও আমি সুন্দর নই— বরং তোর দেখার চোখ সুন্দর।”

“সুন্দরীরা কখনো স্বীকার করে না যে‚ সে সুন্দর।”

“হয়েছে পাঁকা পাঁকা কথা বলতে হবে না৷”

“এক মিনিট।”

“আবার কী হলো?”

“আরেকটা প্রশংসা করতে ভুলে গেছি। তোমার লম্বা চুলগুলোও খুব সুন্দর। কী দাও গো চুলে?”

এই মেয়ের কাণ্ড দেখে কপাল চাপড়াল মৃত্তিকা৷ হাসি পাচ্ছে ভীষণ। অহনার গাল টিপে বলল‚

“সপ্তাহে দুদিন শ্যাম্পু করি আর মামনি সেই ধোয়া চুলে তেল দিয়ে দেয়।”

একটু থেকে মৃত্তিকা আবারও বলল‚ “হয়েছে প্রশ্ন করা?”

হাঁটতে হাঁটতেই একটা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। বাড়ির সামনের দিকটায় বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। ঘরবাড়িও খুব একটা নেই। মাঠে ছোটো বাচ্চারা গোল্লাছুট খেলছে৷ মৃত্তিকা ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। ছোট্টো উঠোন বিশিষ্ট বাড়িটা শূন্য ব্যাকুলতায় উৎকণ্ঠিত। অবহেলায় পড়ে থাকা বাড়িটার দেয়াল খসে খসে পড়ছে। উপরের টিনগুলো মরিচা ধরে গিয়েছে৷ একপ্রকার পরিত্যক্তই বলা যায়।

“হ্যাঁ রে অহনা এই বাড়িটা কাদের? পরিত্যক্ত ভুতের বাড়িটা দেখে— গা ছমছমে করছে।”

“আমিও জানি না গো দিদি।”

“ভরদুপুরে এখানে থাকার দরকার নেই। তেনারা যদি কোনো ক্ষতি করে।”

হয়েছে কাজ। অহনা এমনিতেও যা ডরুক। আজ মনে হয় না সে এদিকসেদিক ছোটাছুটি করবে বলে৷ অহনা ভীতু গলায় জিজ্ঞেস করল‚

“তুমি আমাকে ভয় কেন দেখাচ্ছ দিদি?”

“আমি কোথায় ভয় দেখালাম? বাড়িটা দেখে তোর কী মনে হচ্ছে না— এখানে প্রেতাত্মা থাকতে পারে বলে?”

“দয়া করে থাম দিদি৷ আমার ভীষণ ভয় করছে। দৌঁড়ে পালানোর মতো জোর আমার পায়ে নেই৷”

অহনার কথায় শব্দ করে হেসে উঠল মৃত্তিকা৷ সে তো মজা করছিল৷ কিন্তু মেয়েটা দেখছি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছে।

“পাগলি মেয়ে— এসব প্রেতাত্মা বলতে কিছু হয় না৷ চল বাড়ি ফিরে যাব৷”

“তুমি আমাকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলছ তাই-না?”

মাথা দুই দিকে ঝাকিয়ে মৃত্তিকা বলল‚ “উঁহু! সত্যি বলছি।”

“পুষ্করিণী পাড়ে যাবে দিদি?”

“এখন সোজা বাড়িতে যাব। বুঝতেই তো পারছিস একটু এদিকসেদিক হলে উনি আমার উপর কীভাবে রেগে যান।”

“তুমি মায়ের কথা বলছ?”

“আর কার কথা বলব?”

“মায়ের কথায় তুমি কিছু মনে কোরো না দিদি। মা একটু রাগী তবে মনটা অনেক ভালো। আমি জানি না উনি তোমাকে এত অপছন্দ কেন করে!”

“এত ভাবতে হবে না। চল বাড়ি যাই। ওহ হ্যাঁ— পুষ্করিণী পাড়ে বিকেলে যাব৷”

“আচ্ছা।”

মাত্রই ভরপেট খাইয়ে গিয়েছেন মাধুরী। ছেলেকে নিয়ে তিনি ভীষণই উদ্বিগ্ন। এই তো নিজের হাতে সাড়া দুপুর রান্না করলেন। এরপর নিজের হাতে ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হলে তিনি। জম্পেশ খেয়ে এখন দুচোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসছে প্রলয়ের৷ চোখে ছোটো হয়ে এসেছে। তবুও জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল সে৷ দৈবাৎ সমীরণে ঝুলে থাকা পর্দাগুলো উড়ছে৷ এবার চোখ বন্ধ করে রইল সে। দরজা খোলার প্রতিধ্বনি হতেই চোখ মেলে তাকাল। নিভৃতে ঢেকে রাখা গ্লাসটা বিছানার পাশের টেবিলের উপর রাখল তৃপ্তি। তাকে দেখা মাত্রই ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রলয় সোজা হয়ে বসল। ত্রস্ত কণ্ঠস্বরে বলল‚

“আপনি আবারও আমার ঘরে এসেছেন? যান বের হয়ে যান আমার ঘর থেকে।”

“প্লিজ আপনি উত্তেজিত হবেন না৷”

তবুও শান্ত হলো না প্রলয়। কিছু বলতে নেবে তার আগেই তৃপ্তি আবারও বলল‚ “আপনি আমাকে যতটা খারাপ ভাবছেন ততটা খারাপ আমি নই।”

চুপ করে রইল প্রলয়। মায়ের প্রতি সুপ্ত রাগ এই মেয়েটার উপর চড়াও হয়েছে৷ তৃপ্তি বলল‚

“আমি জানি আপনি কেন আমার সাথে এরকম ব্যবহার করছেন।”

অবাক চোখে তাকাল প্রলয়। তৃপ্তি ক্ষীণ হেসে বলল‚

“আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হবেন না আপনি। আমি কারো জায়গা দখল করতে আসিনি৷”

“তাহলে আপনার উদ্দেশ্য কী?”

অকপটেই তৃপ্তি জবাব দিল‚ “বন্ধুত্ব।”

বুঝতে পারল না প্রলয়। তৃপ্তিকে শুধাল‚ “মানে?”

“মানে এই যে‚ আমি এখানে এডমিশন টেস্টের জন্য এসেছি। তবে আপনি যেহেতু চান না তাই কালই এখান থেকে চলে যাব৷”

কিছু বলল না প্রলয়। মুখ ফিরিয়ে জানালার বাহিরটা অবলোকন করল। তার নীরবতা আঁধার নেমে এলো তৃপ্তির মুখপানে। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। প্রলয়ের ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বালিশের কাছ থেকে ফোনটা বের করে কাউকে কল করল। কল রিসিভ হতেই প্রলয় বলল‚

“যেই কাজটা দিয়েছিলাম সেটা হয়েছে?”

অপরপ্রান্তে কী কথা হলো তা শোনা গেল না৷ “…….”

“সবগুলোকে আমার চাই অ্যাট এনি কস্ট।”

“…….”

মুঠোফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল প্রলয়। রাগে শরীর কাঁপছে ক্রমাগত। রাগের মাঝেও কঠিন স্বরে প্রলয় বলল‚

“রাজনীতি করতে গিয়ে একটা জিনিস ভুলে গিয়েছিস ইট ছুড়লে পাটকেলের আঘা’ত তো পেতে হবে। নাজিম চৌধুরী এবার যে পাল্টা আঘা’ত আমিও ছুড়ব! প্রলয় নিজের খেলা দেখাবে এবার। সামলাতে পারবি তো?”

ঠোঁট উঁচু করে কয়েকবার ‘চ’ উচ্চারিত হলো৷ প্রলয় হাসল অস্বাভাবিক ভাবে৷ টেবিলের উপরে রাখা জুসটা ঢকঢক করে খেয়ে নিল৷ টেস্টটা বেশ অন্যরকম। ভালোই লেগেছে খেতে।

বিকেলে…

দিবসান্তের দীপ্তিমান নীলাম্বর। প্রকাণ্ড সূর্যটার আবছায়া পুষ্করিণীর নিটল জলে দৃশ্যমান। শানবাঁধানো ঘাট‚ নিরিবিলি পরিবেশে হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে মৃত্তিকা আর অহনা। এখানে বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগছে। পুষ্করিণীর অপরপ্রান্তে বড়ো একটা তেঁতুল গাছে৷ কাঁচা পাঁকা তেঁতুল ঝুলে রয়েছে৷ তেঁতুল দেখেই জিভে জল এলো অহনার। কিন্তু যখন থেকে শুনেছে তেঁতুল গাছে শাঁকচুন্নি থাকে; সেদিন থেকেই তেঁতুল তার অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। অহনাকে লোভ লাগানোর জন্য মৃত্তিকা বলল‚

“তেঁতুল খাবি অনা?”

মাথা দু দিকে ঝাকিয়ে বলল‚ “খাব না৷”

আলতো করে হাসল মৃত্তিকা। হিম শীতল বাতাস বইছে সেখানে। মৃত্তিকা বলল‚ “এখানে এসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।”

“আমি প্রায়শই পুষ্করিণী পাড়ে এসে বসে থাকি।”

“তুই না এত ভীতু— এখানে আসতে তোর ভয় করে না?”

“অভ্যেস হয়ে গেছে৷ এখানে এলে আমার ভয় করে না।”

“দুপুরে তো খুব ভয় পাচ্ছিলিস?”

আজ তার ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গিয়েছে৷ মেকি হাসল অহনা। তবে হাসিটা ছিল মিষ্টি। মেয়েটার হাসি সুন্দর। মনে মনে একটা ডাকনাম দিল মৃত্তিকা। ‘সুহাসিনী’ বেশ মানাবে নামটা। আনমনে জলে পা নাচাচ্ছে৷ এক দু ফোটা জল ছিটে আসছে বৈকি। অহনার দেখাদেখি মৃত্তিকাও ডুবে থাকা সিঁড়িতে পা ভেজালো। শীতল জলে শরীর শিরশির করে উঠল।

সবে বাড়ি ফিরেছেন মেহরাব শিকদার। বাড়িতে ফিরেই প্রথমে প্রলয়ের ঘরে গেলেন। প্রলয় তখন গভীর ঘুমে আচ্ছাদিত। ছেলেটাকে সহিসালামতে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। পুরোটা রাস্তায় চিন্তা করে করেই ফিরেছেন তিনি। ছোটো থেকে প্রলয় উনার খুব আদরের। মেহরাব শিকদার ভাইপোর কাছে এগিয়ে গেলেন। ঘুম ভেঙে গেল প্রলয়ের৷ আধবোজা চোখ পিটপিট করল৷ কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে চোখ মেলে তাকাল। মেহরাব শিকদার জিজ্ঞেস করলেন‚

“ঠিক আছিস তুই?”

প্রলয় তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল‚ “এক বছর আগেও ভালো ছিলাম না— এখনো ভালো নেই আমি।”

“কী হয়েছে তোর? আর এক্সিডেন্টই বা কী করে হলো?”

“আমি ভালো নেই চাচ্চু। কেন করলে এমনটা? আমার সুন্দর জীবনটা যে বিভীষিকাময় হয়ে গেছে।”

কথাটা বলতে গিয়েও কণ্ঠনালি কাঁপছে৷ মেহরাব শিকদার স্পষ্ট বুঝলেন ভাইপোর কষ্টটা। কোনো উত্তর দিতে পারলেন না তিনি। বিনাবাক্য ব্যয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খোলা দুয়ারে তাকিয়ে প্রলয় বলল‚

“জানতাম কোনো উত্তর দিতে পারবে না তুমি৷ বাকিরাও কোনো উত্তর দিতে পারবে না। যেখানে আমার নিজের মা-ই আমাকে বিষাদের নীল সাগরে ছুড়ে ফেলেছেন— সেখানে তোমাদের দোষ তো কোনো দোষই না।”

নীরদ অম্বর রং পাল্টেছে। দিবসপতি হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। মেদিনী তমসাবৃত হচ্ছে ভীষণ ভাবে। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃত্তিকা৷ বাড়িতে ফিরে এসেছে আরও অনেকটা সময় আগেই৷ এসেই গৌরীর কবলে পড়তে হয়েছে দুজনকে৷ কথাও শুনতে হয়েছে বেশ কয়েকটা। তার একটা কারণ হচ্ছে— বারবার বারন করা স্বত্তেও কেন এদিকসেদিক টইটই করছে৷ মৃত্তিকা সারাটা সময় চুপ করে থাকলেও চুপ থাকেনি অহনা আর অর্জুন। ভাইবোন দুটোতে একই ধাঁচের বলা যায়। রাগ যেন নাকের ডগায় গিয়ে ঘোরে। রাগটা নিশ্চয়ই মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে৷ ছড়িয়ে রাখা আঁচলটা কাঁধে তুলে নিল মৃত্তিকা। তাকে দেখেই সুদর্শিনী গম্ভীর স্বরে বলল‚

“গ্রামে এসে তো দেখছি তুই আমাকে ভুলেই গিয়েছিস!”

মৃত্তিকার কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না। এমনিতেই মনটা তার ভালো নেই৷ হুটহাট মনখারাপেরা এসে জড়িয়ে ধরেছে তাকে৷ সেই দুপুর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে৷ তবে পুষ্করিণী পাড়ে বসে থাকতে ভালোই লাগছিল। বাড়িতে ফিরে আবারও সেই আগের অবস্থা৷ আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে সুদর্শিনী আবারও বলল‚

“একা একাই দেখছি পুরো পাড়া টো টো করে ঘুরে এসেছিস। আমাকে সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করিসনি।”

“তোকে নিয়ে হুটহাট কোথাও বের হওয়া বারণ৷ আর অনা আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটাকে শত বারণ করেও কোনো কাজ হয়নি।”

তবুও মন ভরল না সুদর্শিনীর। মুখটা আঁধার করেই রাখল৷ মৃত্তিকা গিয়ে গা ঘেঁষে বসল৷ সুদর্শিনীর গলা জড়িয়ে আহ্লাদে গলায় বলল‚

“আমার সোনা দিদি— রাগ করে না। কাল সকালে তোকে নিয়ে হাঁটতে বের হব।”

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সুদর্শিনী বলল‚ “গলব না আমি। কাল ঢাকা ফিরে যাব আর এই মেয়ে আমাকে বলছে কাল সকালে হাঁটতে বের হবে। এখন বুঝতে পারছি— এখানে এসে আমার লাভ কিছুই হলো না।”

সুদর্শিনীর পেটের কাছে মুখ এনে মৃত্তিকা ফিসফিসিয়ে বলল‚ “তোর মাকে একটু বোঝা না‚ মিম্মির সঙ্গে যেন রেগে না থাকে।”

“উঠে বোস— আমার সুড়সুড়ি লাগছে।”

উঠে বসল মৃত্তিকা। সুদর্শিনী আবারও বলল‚

“ট্রেনের টিকিট কে’টেছিস?”

“হ্যাঁ। কাল সকাল দশটার দিকে রওনা দেব।”

“আচ্ছা৷”

“কিছু খাবি দিদিভাই?”

“কী খাব?”

“তুই পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”

রাতে…

হসপিটাল থেকে ফিরেছে অর্পণ। আজ সারাদিন ভীষণ কাজের প্রেসার ছিল। আজ দুটো অপারেশন ছিল। দুটোই সাকসেসফুল হয়েছে৷ একটা অপারেশন সকালে ছিল আর আরেকটা শেষ বিকেলে। সকালে অল্প কিছু খেয়েই হসপিটালে ছুটেছিল। বাড়ি ফিরেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরের দরজা আটকে দিল অর্পণ। একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। পড়নে কালো চেক শার্টটা না খুলেই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল৷ ফুল স্পিডে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় ইরার সঙ্গেও কথা হয়নি। মেয়েটা হয়তো অভিমানে গাল ফুলিয়েছে। প্যান্টের পকেট থেকে মুঠোফোন হাতে নিয়েই ইরাবতীর নাম্বারে ডায়াল করল৷ রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হলো। হয়তো তার কলেরই অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। ফোনটা কানের কাছে ধরতেই কিছু অভিযোগের বুলি রিনরিনে ধ্বনির মতো বেজে উঠল। চোখ বন্ধ রেখেই অর্পণ গাল এলিয়ে হাসল।

ইরার সঙ্গে কথা বলা শেষ হতেই অর্পণ উঠে বসল। ফোনটা চার্জে বসিয়ে‚ বিছানার অপরপাশে গেল৷ ওয়ারড্রবের তৃতীয় ড্রয়ার খুলে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল অর্পণ। গোসল করলে হয়তো শরীরটা ঝরঝরে লাগবে। এদিকে প্রলয় তাকে কল করছে। পায়ে চোট পাওয়ার ফলে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। আর অন্য কাউকে দিয়েও অর্পণ ডাকিয়ে নিতে পারবে না সে। দুজনের ঘর পাশাপাশি হওয়া স্বত্তেও প্রলয় কল করে অর্পণকে ডাকছে সে। একটা জরুরি কাজেই ক্রমাগত কল করছে।

প্রায় আধঘণ্টা পর অর্পণ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছে নিল সে। অসময়ে গোসল করেছে— চুল না শুকালে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। বিছানার উপর ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে রয়েছে৷ ওয়াশরুমে ঢোকার আগে এগুলো বের করে রেখে গিয়েছিল সে৷ ঝটপট টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে ফোনটা হাতে দিল। প্রলয় বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে তাকে। হয়তো জরুরি কোনো তলবে ডাকছে৷ অর্পণ তার ঘর থেকে বের হয়ে প্রলয়ের ঘরে গেল। দরজায় নক করে বলল‚

“আসব?”

ভেতর থেকে প্রলয়ের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। “এসো!”

ভেতরে প্রবেশ করল অর্পণ। প্রলয় বিছানায় বসে রয়েছে। তাকে দেখা মাত্রই প্রলয় বলল‚

“তোকে কিছু বলার আছে অর্পণ।”

“কী বলবে ভাই?”

“দরজা আটকে এখানে এসে বোস।”

প্রলয়ের কথা শুনল অর্পণ। দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসল। প্রলয় বলল‚

“এ কদিনের ঝামেলায় তোকে একটা কথা আমার বলাই হয়নি।”

অর্পণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “কী কথা?”

“হুবহু ভূমির মতো একটা মেয়েকে দেখেছি আমি।”

প্রলয়ের কথা বিশ্বাস হলো না অর্পণের। ভূমি তো একবছর আগেই মা’রা গেছে। সঙ্গে সেই নিষ্পাপ বাচ্চাটাও৷ তারউপর ওই লা’শ! অর্পণ আর কিছুই ভাবতে পারল না। কম্পিত কণ্ঠস্বরকে খাদে নামিয়ে বলল‚

“তোমার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে ভাই৷”

“আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। তুই প্রমাণ চাস তো?”

“কীসের প্রমাণ?”

“ডিএনএ রিপোর্ট।”

“ডিএনএ!”

“হুম ডিএনএ। ল্যাবে টেস্ট করতে দিয়েছিলাম৷ মন বলছে ও আমার ভূমি। কিন্তু মন বললেই তো হবে না তার জন্য পোক্ত প্রমাণ প্রয়োজন।”

“এসব তুমি কবে করলে?”

“সেদিন তোকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিয়ে একফাঁকে ল্যাবে গিয়েছিলাম।”

দুদিন আগে…

অর্পণকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিয়ে প্রলয় গাড়ি নিয়ে সোজা একটা ল্যাবের সামনে এসে থামে। এখানে তার একজন বন্ধু চাকরি করে৷ অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে প্রলয় গাড়ি থেকে নামল৷ একবার এদিকসেদিক তাকিয়ে এরপর ল্যাবের ভেতরে চলে গেল। তাকে দেখা মাত্রই এগিয়ে আসে সোহেল। দুজনের মাঝে ভালো মন্দ অনেক কথাই হয়। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রলয় তার প্যান্টের পকেট থেকে দুটো ছোটো প্যাকেট বের করে। সোহেলের হাতে প্যাকেট দুটো দিয়ে সবকিছু বলে। প্রথমেই নাকচ করে দেয় সোহেল।

“প্লিজ না করিস না৷ আমার জানাটা খুব দরকার।”

“স্যার জানতে পারলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।”

“কিছু হবে না৷ যা হবে আমি সামলে নেব। প্লিজ তুই না করিস না।”

“ঠিক আছে। তবে তোকে একদিন অপেক্ষা করতে হবে।”

“কাজটা একটু তাড়াতাড়ি করে দেওয়ার চেষ্টা করিস ভাই।”

“ইনশাআল্লাহ।”

তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ল্যাব থেকে বের হয়ে এলো প্রলয়৷ সবকিছু ঠিকঠাক হলে কালই সব সত্যির উদঘাটন হবে। মৃত্তিকার সত্যিটা সামনে আসবে। প্রলয় এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল৷ এরপর আবারও গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

এখন…

প্রলয়ের কথা এতক্ষণ চুপটি করে শুনছিল অর্পণ। অনেকটা সময় চুপ থেকে আবারও জিজ্ঞেস করল‚

“রিপোর্ট পেয়েছ?”

“সেদিনই তো এক্সিডেন্ট হলো। ভেবেছিলাম— পার্টি অফিসের কিছু কাজ শেষ করে‚ ল্যাবে যাব রিপোর্ট আনতে। তার আগেই যা ঘটার ঘটে গেল।”

“তাহলে সোহেলকে বল পার্সেল পাঠাতে।”

“না! একদম না।”

অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”

“রিপোর্টটা তুই নিজে গিয়ে নিয়ে আসবি৷”

“সে নাহয় আমি নিয়ে এলাম। তার আগে এটা বল— মেয়েটার বাড়ি কোথায়?”

“খোঁজ লাগিয়ে জানতে পেরেছিলাম মেয়েটা নাকি এডভোকেট মাহেন্দ্র রায়চৌধুরীর মেয়ে।”

“তাহলে তো মেয়েটা সনাতন ধর্মের৷ আমাদের ভূমি কী করে হতে পারে?” হয়তো তোমারই ভুল হচ্ছে৷”

“আমি কিছু জানি না। আমার মন যে মানতে চায় না৷ মন বলে ভূমি আছে। সে আমার কাছে পাশেই আছে৷ মনের শান্তির জন্যই নাহয় রিপোর্ট এনে দিস৷”

“ভাই তোমাকে আরেকটা খবর দেওয়ার আছে।”

প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚ “কী?”

“ওই জা’নোয়ার দুটোকে গোডাউনে আটকে রাখা হয়েছে।”

“আটকেই থাকুক। কোনো খাবার দিবি না৷ একটু খাবারের জন্য ওরা এক এক লহমা তরপাবে। ওরাও তো জানুক— সেহরিশ আরশান প্রলয় আতিথেয়তার কোনো কমতি রাখে না। সংসদ নির্বাচনের আগে আমি কোনো র’ক্তার’ক্তি চাই না।”

“আচ্ছা৷ রাত হয়েছে। তুমি এখন শুয়ে পড়৷ আমি আসছি।”

“হুম আয়!”

চলবে?…..