রণরঙ্গিণী প্রেমরঙ্গা পর্ব-০৬

0
4

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অন্ধিকা কা’টিয়ে ময়ূখমালা উঁকি দিচ্ছে৷ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারিপাশ। বিশাল অম্বর নীলাভ মেঘের আড়ালে ঢেকে রয়েছে। আকাশে শুভ্র আর নীলচে তুলোর ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে৷ ভোরের পাখিদের কলকাকলি জানান দিচ্ছে প্রভাত নেমেছে মেদিনীর বুকে৷ সুদর্শিনীকে সঙ্গে করে হাঁটতে বের হয়েছে মৃত্তিকা৷ দুজনে মিলে খালি পায়ে শিশির ভেজা দূর্বাঘাসের উপর সমান তালে হাঁটছে৷ নীরবতা কাটিয়ে সুদর্শিনী বলল‚

“ব্যস্ত শহরের কোলাহলের চাইতে গ্রামের এই নীরবতা অসম্ভব সুন্দর। তোর জামাইবাবুকেও নিয়ে আসা উচিত ছিল।”

মৃত্তিকা কোনো প্রত্যুত্তর করার আগেই সুদর্শিনী আবার বলল‚ “আমিও না— কী না কী বলছি! তোর জামাইবাবুকেই বা পাব কোথায়! সে তো কাজে ব্যস্ত৷”

“নেক্সট টাইম আমরা জামাইবাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব।”

“হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস।”

“দিদিভাই তুই কী পুষ্করিণী পাড়ে যাবি? অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করবে সেখানে গেলে।”

“তুই এখনো জিজ্ঞেস করছি? নিয়ে চল আমাকে। আমি অবশ্যই যাব।”

সুদর্শিনীকে নিয়ে মৃত্তিকা পুষ্করিণী পাড়ে গেল। তেঁতুল গাছের কাঁচা পাঁকা তেঁতুল দেখে জিভে জল চলে এলো সুদর্শিনীর। কাল বিকেলে পুষ্করিণীর পাড় থেকে যাওয়ার সময় কয়েকটা তেঁতুল সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল৷ বেশ তৃপ্তি নিয়ে লবণ শুকনো মরিচের গুড়ো মিশিয়ে তেঁতুল খেয়েছিল সুদর্শিনী।

“তুই কাল এখান থেকেই আমার জন্য তেঁতুল নিয়ে গিয়েছিলি?”

চোখের পলক ঝাপ্টে মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে মৃত্তিকা বলল‚ “হুম।”

“আমরা কী আরও কিছু তেঁতুল সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব?”

মৃত্তিকা কিছুটা মজার ছলে বলল‚ “মনে হয় না দেবে বলে।”

মনঃক্ষুণ্ন হলো সুদর্শিনীর। সে কিছুটা ক্ষীণ স্বরে বলল‚ “ওহ!”

ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা বাজে৷ ব্যাগ বইখাতা গুছিয়ে নিয়েছে তৃপ্তি। তার কথানুযায়ী আজই সে গ্রামে ফিরে যাবে৷ আর কখনো শহরে আসার নাম নেবে না আর না পড়াশোনার নাম নেবে৷ আজই সব স্বপ্ন লাটে উঠিয়ে ফিরে যাবে বাবা মায়ের কাছে৷ বাড়িতে মহিলামহল আর প্রলয়কে ছাড়া কেউই নেই। সকালে নাস্তার পাঠ চুকিয়ে অর্পণ আর মেহরাব শিকদার হসপিটালে গিয়েছে৷ মেহরাব শিকদারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে। অর্পণের কাজ যেন আরও বেড়াছে। আজও একটা ক্রিটিকাল অপারেশন রয়েছে। সকালের নাস্তা করেই বাবা ছেলে মিলে বেরিয়ে পড়েছে৷ অবশ্য অর্পণ আগেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। মোর্শেদ শিকদারও বেরিয়েছেন। তিনি একটু অফিসে গিয়েছেন। ব্যবসায় কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে! প্রলয় তার বাবার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল কিন্তু মাধুরী কিছুতেই যেতে দিলেন না।

বৈঠকখানায় বসে টিভিতে খবর দেখছিল প্রলয়৷ তখনই তৃপ্তি তার ব্যাগ নিয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল৷ বাড়ির প্রত্যেকের থেকে আগেই বিদায় নিয়েছিল সে৷ এক্ষুনি বের হবে। দেরি হলে হয়তো ট্রেনের টিকেটও পাবে না৷ সদর দরজার দিকে তৃপ্তি যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই তার বুকের ভেতরটা ছটফট করছে৷ হুট করে প্রলয়ের ডাকে সে থেমে গেল৷ সেই সঙ্গে হৃৎস্পন্দনও যেন একটু একটু করে বাড়তে শুরু করছিল।

“আপনি এখানে থাকতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

হকচকিয়ে গেল তৃপ্তি। স্তম্ভিত ত্রস্তনয়নে চেয়ে রইল প্রলয়ের দিকে। প্রলয়ের কাছ থেকে এমন কথা কস্মিনকালেও আশা করেনি সে। কী রিয়েকশন দেবে ভেবে পাচ্ছে না! প্রলয় আবারও বলল‚

“তবে আমার ঘরে হুটহাট ঢুকে পড়বেন না৷ আমি পছন্দ করি না।”

কথা বলতে দেরি প্রলয়ের চলে যেতে দেরি হয়নি। পায়ের ব্যথাটা কমলেও ক্ষ’তগুলো এখনো শুকোয়নি। ক্ষ’তগুলো এখনো বেশ তাজা। সময়ের সাথে সাথে ক্ষ’ত শুকিয়ে গেলেও হৃদয়ে জমে থাকা ক্ষ’তগুলো বয়ে বেড়াতে হয় চিরকাল। এদিকে তৃপ্তিও বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। প্রলয় হয়তো এতক্ষণে তার ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছে৷ ঘটলও তাই। তৃপ্তি দাঁড়িয়ে দেখল বন্ধ দরজাখানা। মাধুরী দোতলায় করিডর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তৃপ্তিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক হলেন। তৃপ্তির বাহুতে স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করলেন‚

“এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তুমি তো বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলে?”

“আমি কোথাও যাব না আন্টি।”

“হঠাৎ সুবুদ্ধি কী করে ফিরল?”

“সুবুদ্ধি মানে?”

“এইযে তুমি যাওয়া ক্যান্সেল করলে।”

“আপনার ছেলের নাকি আমাকে নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই। তাই আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

“এই তো বুদ্ধিমতীর পরিচয় দিলে। তুমিই পারবে আমার ছেলের মন জয় করতে। তাইতো তোমাকে আমি এখানে এনেছি।”

তৃপ্তি প্রত্যুত্তর করল না। ব্যাগটা নিয়ে পূর্ণতা পুষ্পিতার ঘরে চলে এলো৷ অতিথিশালা পরিষ্কার করানো হয়নি তাই এদের দুই বোনের ঘরেই থাকতে দিয়েছেন মাধুরী। তৃপ্তিকে ফিরে আসতে দেখে‚ দুই বোনের হাসিখুশি মুখটা মিইয়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছে তৃপ্তি চলে যাওয়ায় খুব খুশি ছিল দুজনে। কিন্তু তাকে আশায় জল ঢেলেছে তাদের বড়ো ভাইয়া৷ এদিকে তৃপ্তিকে দেখে বেশ খুশি মনে হচ্ছে। খুশির কারণও চট করে ধরে ফেলল দুটোতে। দুজনকে হঠাৎ করে চুপ করে যাওয়ায় তৃপ্তি আহ্লাদে গদগদ সুরে বলল‚

“তোমরা দুই বোন খুব সুইট সেটা কী তোমরা জানো?”

“বোকাসোকা পূর্ণতা বলল‚ “হ্যাঁ সবাই এমনটাই বলে। একচুয়্যালি সবাই আমাদের দুজনকে বারবিডল বলে ডাকে।”

একটিবার তালি বাজিয়ে তৃপ্তি বলল‚ “বাহ্!”

পূর্ণতা পুষ্পিতা একে অপরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তৃপ্তি নিজে থেকেই মেয়ে দুটোর গাল টেনে দিল। পছন্দ হলো না পুষ্পিতার। তার চিত্তচাঞ্চল্য স্বভাব তাকে চুপ থাকতে দিল না। অতিশয় কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল‚

“গাল টেনে দেওয়া আমি মোটেও পছন্দ করি না৷ সো কিপ ডিস্টেন্স।”

মুখের উপর এভাবে বলে ফেলায় ইতস্তত বোধ করল তৃপ্তি৷ কথা কাটাতে পূর্ণতা বলল‚

“তোমাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে— কী ব্যাপার আপু?”

“একটু খুশি৷”

একটু থেকে তৃপ্তি আবারও বলল‚

“একচুয়্যালি আমি হোস্টেলে একদম থাকতে পারি না৷ তোমাদের ভাইয়া যেহেতু আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন তাই আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷ কাল রাতে খুব টেনশনে ছিলাম কারণ এক রাতে মধ্যে কী করে থাকার ব্যবস্থা করতাম?

তৃপ্তির অসুবিধেটা বুঝল পূর্ণতা পুষ্পিতা। একটু আগে করা ব্যবহারে অনুশোচনা হলো পুষ্পিতার৷ অজান্তেই খারাপ ব্যবহার করেছে। সে তো এমন নয়৷ তৃপ্তি আবারও বলল‚

“হোস্টেলে খাবার মুখে তোলা যায় না৷ পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। বড়ো দাদুমণি আমাকে ঢাকায় মানে তোমাদের বাড়িতে পাঠালেন। পড়াশোনায় এবার হয়তো মনোযোগী হতে পারব। ভাবতে খুব খুশি খুশি লাগছে আমার৷”

তৃপ্তির কথা শেষ হতেই পুষ্পিতা এসে জড়িয়ে ধরল৷ নিজের করা খারাপ ব্যবহারের জন্য মনে মনে ভীষণ অনুশোচনায় ভুগছে সে৷

“আ’ম স্যরি আপু৷ শুধু শুধু তোমাকে খারাপ মনে করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের ভাবিমণির জায়গা নিতে এসেছ।”

তৃপ্তি এবার বুঝল সবকিছু৷ মেয়ে দুটোর মাঝে এখনো বাচ্চামো স্বভাবটা রয়েই গিয়েছে৷ তৃপ্তি গাল এলিয়ে হেসে বলল‚

“আমি এখানে কারো জায়গা নিতে আসিনি পাখি৷ আসলে আন্টির কথায় আমি সেদিন তোমাদের ভাইয়ার ঘরে ঢুকেছিলাম কিন্তু উনি যে এভাবে রেগে যাবেন সেটা ভাবতে পারিনি৷ বড়ো দাদুমণি আমাকে বলেছিল আমি এ বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পারব।”

এবার পূর্ণতা বলল‚ “অবশ্যই তুমি আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পারবে আপু।”

“তোমরা সত্যিই খুব কিউট। একদম গোলুমোলু।”

দুপুর দেড়টা…

সাঁই বেগে ট্রেন ছুটছে। সিটে মাথা হেলান দিয়ে রয়েছে সুদর্শিনী। খুব গা গোলাচ্ছে তার। তনুজা অনেকবার বলেছেন একটু ঘুমিয়ে নিতে। কিন্তু অস্বস্তির কারণে ঘুম আসছে না কিছুতেই৷ মুখোমুখি বসে সবটা খেয়াল করল মৃত্তিকা। সে সুদর্শিনীকে জিজ্ঞেস করল‚

“অ্যাই দিদিভাই তেঁতুল খাবি?”

মাথা তুলে তাকিয়ে সুদর্শিনী জিজ্ঞেস করল‚ “এ সময় তেঁতুল পেলি কোথায়?”

“তুই ভুলে গেলি? কালই তো তুই বললি বেশ কিছু কাঁচা পাঁকা তেঁতুল সঙ্গে করে নিয়ে নিতে।”

“তোর মনে আছে?”

“বাহ্ রে! আমার দিদিভাইয়ের খেতে ইচ্ছে করেছে আর আমি আনব না— তা কী করে হয়?”

“সবদিকেই তোর খেয়াল থাকে৷ কী মিষ্টি রে তুই!”

ব্যাগ থেকে বড়ো দেখে দুটো তেঁতুল বের করে সুদর্শিনীর হাতে দিল৷ সঙ্গে কাগজে মুড়িয়ে রাখা লবণ। অহনা দিয়েছিল৷ বলেছিল পথে প্রয়োজন পড়তে পারে। তার কথাই সত্যি হলো। এই যে এখন কাজে লেগে গেল। ঢাকা ওরা পৌঁছে গিয়েছে৷ আর হয়তো আধঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিতে হবে।

বিকেলের লালচে রোদ আছড়ে পড়ার কথা৷ অথচ বিশাল অম্বর জুড়ে কৃষ্ণ মেঘমালায় ভরপুর। বাতাবরণও শীতল। মৃদুমন্দ সমীরণে হৃদয় জুড়িয়ে যায় যেন৷ শরীর মন দুটোই ফুরফুরে হয়ে ওঠে। শত বারণকে অবজ্ঞা করে মৃত্তিকা এসেছে লেকের ধারে৷ তনুজা বারবার বারণ করেছিলেন কারণ ঘণ্টা দুয়েক আগেই ওরা বাসা পৌঁছেছে। একটু তো বিশ্রাম নিতেই হয়৷ এদিকে জার্নি করে খুবই ক্লান্ত সুদর্শিনী। এসেই হাল্কা কিছু খাবার খেয়ে জম্পেশ ঘুম দিয়েছে৷ ঘুরতে যাওয়ার মজা হারে হারে টের পাচ্ছে সে। গোসল করে বের হতেই মৃত্তিকা শুনতে পেল তার ফোনটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছে৷ শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজেই ক্রস্ত হস্তে মুঠোফোন খানা হাতে নিল। উপমা কল করছে। কেন কল করছে জানা নেই৷

অন্যদিকে…

“সাবিনা তুই রান্নাঘরে যা আমি আসছি।”

“আইচ্ছা খালাম্মা।”

জুসের গ্লাসটা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল সাবিনা। মাধুরী একবার এদিকসেদিক তাকালেন৷ না! এখন কেউ নেই৷ বিকেলের এই সময়টায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে৷ উনি তো যাচ্ছিলেন প্রলয়ের ঘরের দিকে৷ ছেলেটা ঘুমিয়েছে কি-না দেখার জন্য। করিডরেই তৃপ্তিকে দেখতে পেলেন তিনি। চট করেই সকালের কথা মনে পড়ে গেল উনার। পূর্ণতা পুষ্পিতার সঙ্গে বলা প্রত্যেকটা কথা শুনেছেন তিনি। এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন তৃপ্তিকে‚

“সকালে কী যেন বলছিলে পূর্ণ পুষ্পকে?”

মাধুরীর কথায় অবাক হলো তৃপ্তি। স্তম্ভিত স্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “কী বলার কথা বলছেন আন্টি?”

“এই যে— তুমি এই বাড়িতে শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য এসেছ৷ অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই তোমার? শোন মেয়ে এই বাড়িতে থাকতে হলে তোমাকে আমার প্রত্যেকটা কথা শুনতে হবে। প্রলয়কে তোমাকে হাতে রাখতে হবে৷ ওকে নিজের আয়ত্তে আনতে হবে। ভূমির নাম চিরতরে মুছে ফেলতে হবে প্রলয়ের জীবন থেকে। অবশ্য এই কাজটা আমার আরও অনেক আগেই করার প্রয়োজন ছিল। কয়েকমাস তো ভালোই ছিল কিন্তু ইদানীং আবারও আমাকে ছেলেটা ওই অলক্ষ্মীর নাম জপছে৷”

“আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না আন্টি৷ আমি তো জাস্ট নিজের দল ভারী করার চেষ্টা করছি। এ বাড়িতে টিকে থাকতে হলে— আপনার ছেলের মনে জায়গা করতে হলে আমাকে তো কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে তাই না?”

“এ বাড়িতে থাকতে হলে— নিজের স্বপ্ন পড়াশোনা পূরণ করতে হলে আমি যা বলব তাই-ই শুনতে হবে তোমাকে। মনে থাকবে?”

“হ্যাঁ আন্টি মনে থাকবে। আপনি যা চাইছেন তাই-ই হবে।”

মাধুরীর যা বলার ছিল তিনি তা বলেই করিডর থেকে প্রস্থান নিলেন। উনি যাওয়া মাত্রই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল তৃপ্তি। এতক্ষণ যেন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ছিল সে৷ স্বপ্নকে হাতে রাখতে হলে এই মহিলার তালে তাল মেলাতে হবে৷ তৃপ্তি মনে মনে কয়েকটা কথা আওড়াল‚

“আপনি যত যাই-ই বলুন— আপনার কোনো কথা শুনতে আমি বাধ্য নই। এই তৃপ্তি এতটাই ফেলনা নয় যে জোর করে অন্যের জায়গা নিতে চাইবে। আপনার ব্যাপারে ফিরোজা আন্টি আমাকে সবকিছুই বলেছেন। আপনার কোনো ইচ্ছেই পূরণ হবে না আন্টি।”

প্রলয়ের ঘরের সামনে এসে মাধুরী দেখলেন দরজা চাপিয়ে রাখা। তিনি টোকা দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই বুঝতে পারলেন দরজা খোলাই রয়েছে। তিনি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন৷ প্রলয় বিছানায় বসে মোবাইলে গেইম খেলছে৷ মাধুরীও গিয়ে ছেলের মুখোমুখি বসলেন। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন‚

“তোকে একটা কথা বলব বাপ?”

গেইম খেলতে খেলতেই প্রলয় বলল‚ “বল— শুনছি আমি।”

“তৃপ্তি মেয়েটা কী এতটাই খারাপ? দেখতে শুনতে ভালো৷ ভালো বংশের আর পড়াশোনাও করছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে যা বাপ।”

আবারও একই কথা৷ দাবিয়ে রাখা রাগটা তড়তড় করতে বাড়তে শুরু করল৷ এ জীবনে ভূমির জায়গা যে কাউকেই দিতে পারবে না সে৷ কেন মা সেটা বুঝতে চাইছেন না? অহেতুক ঝামেলা প্রতিনিয়ত হচ্ছে এই একটা কারণে। নিজের রাগকে সংযত করল প্রলয়। তাকে চুপ থাকতে দেখে মাধুরী মনে করলেন ছেলের মন হয়তো একটু একটু করে গলছে। আরেকটু ঘি তিনি ঢেলেই দিলেন।

“আমারও তো ইচ্ছে হয় তোর সন্তানসন্ততির মুখ দেখবার।”

হাজার চেয়েও রাগটা আর সংযত করা গেল না৷ প্রলয়ের রাগ যে তুঙ্গে চড়েছে। এবার যে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় আসবেই আসবে। প্রলয় চেঁচিয়ে বলল‚

“তুমি কী চাইছ আমি এই বাড়ি থেকে চিরকালের জন্য চলে যাই?”

“তোর কী মায়ের জন্য একটুও মন কাঁদে না?”

“এই সমস্ত ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল আমার ক্ষেত্রে কাজে দেবে না এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও।”

থমথমে হয়ে গেল মাধুরীর মুখখানা৷ ছলে বলে কৌশলেও ছেলের মন গলানো যাচ্ছে না। কতকাল এভাবে একা দহনে পুড়বে ছেলেটা। উনারাও যে খুব শখ আহ্লাদ রয়েছে ছেলেকে নিয়ে৷ ছেলের বউ আসবে‚ নাতি নাতনির মুখ দেখবেন। প্রলয় মুঠোফোনটা রেখে বলল‚

“তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ? বললাম তো আমাকে একটু একা থাকতে দাও। কেন অশান্তিতে রাখছ আমাকে?”

“আমি তোকে অশান্তিতে রাখছি?”

“তুমি নিজেই বুঝে নিয়ো। এখন প্লিজ যাও। আমি ঘুমাব।”

মনঃক্ষুণ্ন হলো মাধুরীর। বড়ো বড়ো পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে দরজাটা ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। প্রলয় একবার জানালার বাহিরের দিকে তাকাল। কৃষ্ণবর্ণীয় কাদম্বিনীর মেলা বসেছে৷ অন্তরিক্ষে দিবসপতি লুকোচুরি খেলছে। দুপুরেও বাতাবরণ পরিষ্কার ছিল। প্রলয় বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। রুক্ষ গম্ভীর কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল‚

“সেদিন তুমি ঠিকই বলেছিলে ভূমি। ‘যে নারী প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে হারিয়ে যায়— তাকে আর সহজে ফিরে পাওয়া যায় না’। তোমার কথাই সত্যি হচ্ছে৷ তোমাকে আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তোমাকে পাবার আশায় প্রতিটা মুহূর্ত আমি একটু একটু করে তড়পাচ্ছি।”

ব্যাকুল হয়ে উঠেছে প্রলয়। যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে ডিএনএ রিপোর্টের রেজাল্ট জানার জন্য ততই তার কৌতূহল বাড়ছে৷ বারবার অর্পণের নাম্বারে কল করছে। লাগাতার হোয়াটসঅ্যাপেও কল করছে শুধুমাত্র ব্যাকুল হৃদয় একটু শান্ত করার জন্য।

এইতো সবে ল্যাব থেকে বের হয়েছে অর্পণ। ডিএনএ রিপোর্ট তার হাতের মুঠোয়। এর ভেতর কী অপেক্ষা করছে জানা নেই তার।

“হ্যালো ভাই!”

“হ্যাঁ বল!”

“ভাই রিপোর্ট পেয়েছি৷”

“তুই একটু খুলে দেখ না— ওতে কী লেখা আছে৷”

অনুমতি পেতেই কাগজটা খুলে ফেলল অর্পণ। ভেতরে কী লেখা আছে তা জানার জন্য সে-ও খুব আগ্রহী। সত্যিটা জানার কৌতূহল এক ধাপ করে বাড়ছে৷ কাঁধের সাহায্যে ফোনটা কানে চেপে রেখেছে অর্পণ। কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করল। গোটা গোটা অক্ষরের কয়েকটা লেখা তবুও যুগ যুগ সময় লাগছে পড়তে।

“কী হলো পেলি?”

“ভাই তোমাকে আমি পরে কল ব্যাক করছি।”

“আবার কী হলো?”

কথাটা বলার আগেই অর্পণ কলটা কে’টে দিল৷ চোখের সামনে চেনা কাউকে দেখে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো৷

মন মোর মেঘের সঙ্গী‚
উড়ে চলে দিগ্‌দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ-বর্ষণ-সঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম॥
মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে
ক্বচিৎ-ক্বচিৎ চকিত তড়িত আলোকে।
ঝঞ্জনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে।
কলো-কলো কলমন্দ্রে নির্ঝরিণী
ডাক দেয় প্রলয়-আহ্বানে॥
বায়ু বহে পূর্বসমুদ্র হতে
উচ্ছল ছলো-ছলো তটিনীতরঙ্গে।
মন মোর ধায় তারি মত্ত প্রবাহে
তাল-তমাল-অরণ্যে
ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে॥

[রবীন্দ্র সঙ্গীত]

“ভূমি!”

চোখে পানি টলমল করছে৷ অর্পণ শরীরের সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে চেঁচিয়ে উঠল। হঠাৎ করেই পা দুটো থেমে গেল মৃত্তিকার। ঘুঙুরের ঝুমঝুম শব্দটাও নিভে গেল। অর্পণ দৌঁড়ে এসে দাঁড়াল মৃত্তিকার সামনে৷ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ ‘তার বোন আর নেই’ এটাই এতদিন ধরে মেনে এসেছে। আজ সেই বোনকে চোখের সামনে দেখছে। অর্পণ নিজ থেকে স্নেহময় স্পর্শে মৃত্তিকার হাতখানা আঁকড়ে ধরল। ভাঙা গলায় মৃদু স্বরে বলল‚

“ভাইয়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কী এতই সোজা?”

অর্পণের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা৷ কোনো কিছুর প্রতি আবেগ কাজ করছে না৷ অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে নিজেকে৷ তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে মৃত্তিকা বলল‚

“আপনি কী বলছেন কিছু বুঝতে পারছি না! কে আপনি? আর আমার হাতই বা কেন ধরেছেন?”

অর্পণ তবুও মৃত্তিকার হাত দু’খানা ছাড়ল না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে আদরের বোনকে দেখতে লাগল। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে অর্পণ আবারও বলল‚

“মানলাম আমাদের মা দুটো তাই বলে কী আমরা আলাদা? তুই আমার বোন। সেদিন আমি তোর পাশে থাকতে পারিনি। তার ব্যর্থতা আমাকে আজও কুড়ে কুড়ে খায়৷ আমার অপারগতার জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করে দিস বোন!”

আশেপাশের সংখ্যাল্প লোকসমাগম। যারা আছে তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। অর্পণ চেয়েও কাঁদতে পারছে না। চোখে অশ্রুবিন্দু কানায় কানায় ভরপুর। অর্পণের কথায় মৃত্তিকা গভীর মনোনিবেশ করছে। না চাইতেও শ্বাস আটকে যাওয়া কান্না গুলো আঁখিপল্লবে স্পষ্ট হলো। মুহূর্তেই ঝরঝর করে অশ্রুকণার রূপ ধারণ করে গৌর কপোল জুড়ে গড়িয়ে পড়ল। এ কেমন টানাপোড়েন মাঝে যাচ্ছে সে?

চলবে।