#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২১|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রলয়ের আধোয়া কাপড়চোপড় গুলো ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিল ভূমি। আজ তাড়াতাড়ি করেই সব কাজ সারছে৷ প্রলয় তখনো ঘুমিয়ে ছিল। তাকে আর জাগাল না। দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলো। যাওয়ার আগে দুয়ার ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গেল। সাবিনা ছাড়া কেউই হয়তো ঘুম থেকে ওঠেনি। বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচ তলায় চলে এলো। এরপর ভূমি সোজা রান্নাঘরে চলল। আজ সকলের নাস্তা সে একাই বানাবে। সাবিনা তখন রান্নাঘরে ছিল না। হয়তো আজ তার উঠতে দেরি হবে। হুট করে মাধুরীর বদলে যাওয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না ভূমি। শাশুড়ীর মন যুগিয়ে চলতে হলে‚ তার খেয়াল খুশি মতো কাজ করতে হবে৷ সে কোনো ভূল করেছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছে না৷ কী এমন হলো উনার? ঘণ্টা খানেক সময় ধরে ভূমি রান্নাঘরেই রয়েছে৷ এতক্ষণে সাবিনাও চলে এসেছে৷ ভূমিকে সাতসকালে রান্নাঘরে দেখে অবাকই হলো বটে৷ ত্রস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরের ভেতরে প্রবেশ করল৷ ভূমি তখন মালটা কাটছিল। তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে সাবিনা বলল‚
“আমি থাকতে আপনে এত কাম করতাছেন ক্যান ভাবি?”
“একটু আধটু কাজ করলে কিছু হবে না। আজ তুমি বিশ্রাম নাও। আর নয়তো এখানেই দাঁড়িয়ে থাক।”
“ভাবি আপনে কন আমারে কী করতে হইব! আমি কইরা দিতাছি৷”
“এখন আপাতত কিছু করতে হবে না।”
“ভাইজান জানলে আমার রক্ষা নাই ভাবি।”
“কিছু বলবেন না তোমার ভাইজান।” একটু থেমে ভূমি আবারও বলল‚ “তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাও— তাই তো?”
মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে সাবিনা বলল‚ “হ ভাবি।”
“তাহলে প্লেট বাসন গুলো টেবিলের উপর গুছিয়ে রেখে এসো।”
“আইচ্ছা ভাবি।”
ভূমির কথানুযায়ী সাবিনা কাজে মনোনিবেশ করল। এদিকে রান্নাঘরের কাজ প্রায় হয়েই গিয়েছে। ভূমি ঘরে চলে এলো। প্রলয় এখনো ঘুমচ্ছে৷ সে ডাকল না৷ ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা৷ পড়নের জামাকাপড় পালটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভূমি৷ মাধুরীর কিনে দেওয়া জামা থেকেই একটা নিয়েছে। সেটাই আজ পড়বে।
সকাল সাড়ে আটটা…
সবাই ইতিমধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। পূর্ণতা পুষ্পিতার পরীক্ষা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ওদের খাবার ঘরেই দিয়ে এসেছেন মাধুরী। সামনে পরীক্ষা‚ মানুষের দম ফেলবার সময় নেই। আর এদিকে ওদের দু বোনের সবকিছুতেই উদাসীনতা। পূর্ণতা যদিও একটু আধটু পড়াশোনায় মনোযোগী কিন্তু পুষ্পিতা একেবারেই ছাড়া হাত পা। মেয়েটার মাঝে গম্ভীরতা কবে আসবে? সেই নিয়ে চিন্তিত মাধুরী। এদিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন প্রলয় কোলবালিশ ধরে শুয়ে রয়েছে। ভূমি এই নিয়ে দু দুবার ডেকে গিয়েছে। তবুও এমপি মশাইয়ের ঘুম ভাঙেনি। শেষ বার চেষ্টা করতে এলো ভূমি। ডাইনিং টেবিলে মোর্শেদ শিকদার‚ মাধুরী‚ ফিরোজা এবং অর্পণ উপস্থিত শুধু ওরা দুজনই এখনো ঘর থেকে বের হয়নি। একা যেতেও পারছে না ভূমি। প্রলয়ের মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ডাকতে আরম্ভ করল। কিছুটা নড়েচড়ে উঠল প্রলয়। তার মানে লোকটার ঘুম হালকা হয়ে এসেছে। যাক খুশি হলো সে। চোখ বন্ধ রেখেই ভূমি হাতখানা ধরে ফেলল প্রলয়। এবার চোখ পিটপিট করে তাকাল ভূমির মুখ পানে। ভূমি কিছুটা তাড়া দিয়ে বলল‚
“তাড়াতাড়ি উঠুন আপনার জন্য সবাই খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছেন। সেই কখন থেকে আপনাকে ডাকছি!”
ঘুমুঘুমু ভারী কণ্ঠে প্রলয় বলে উঠল‚ “বরের ঘুম ভাঙাতে হলে আদর দিতে হয়। এ কথা কী তোমার জানা নেই?”
প্রলয়ের মুখে এহেন কথা শুনে লজ্জায় ভূমির কপোলদ্বয়ে রক্তিম আভার দেখা মিলেছে৷ মেয়েটাকে আর লজ্জা দিল না৷ আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠে বসল৷ এরপর তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এলো৷ এইফাঁকে ভূমি বিছানা গুছিয়ে নিয়েছে৷
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল স্যেট করছে আর গুনগুন করছে। ভূমি বুঝতে পারল না হঠাৎ লোকটার হলো কী? মনে এমন আনন্দের উৎস খুঁজে পেল না সে। বিছানায় চুপটি করে বসে রইল। প্রলয় সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। ভূমির কপালে সিক্ত উষ্ণ অধর ছোঁয়াল। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল মেয়েটা৷ প্রলয় বাঁকা হাসল৷ ভুমির কপালের সঙ্গে কপাল মিলাল৷ প্রলয় বলল‚
“আজ আমার ফিরতে দেরি হবে। তুমি আমাকে মিস করবে তো বউ? তাহলে তোমার টানে আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব৷”
কিছুটা পিছিয়ে কম্পিত কণ্ঠে ভূমি বলল‚ “আপনি এসব…”
ভূমিকে আর কিছু বলতে দিল না। ডান হাতের তর্জনী মসৃণ ভাবে ভূমির ঠোঁটের উপর ছোঁয়াল। শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। খেলে গেল শীতল স্রোত। ভূমির অতি সমীপে এগিয়ে এলো প্রলয়৷ দুজনের দূরত্ব ঘোচাল। আলতো হাতে ভূমি মাথায় চুলের পেছনে হাত রাখল প্রলয়। বুক ধুকপুক করছে ভূমির৷ অজানা শঙ্কায় গা শিউরে উঠল৷ অকস্মাৎ দুটো ব্যাকুল অধরোষ্ঠের আলিঙ্গন ঘটল৷ প্রলয় আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল। একটু একটু করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে৷ ভূমির এতটা সমীপে এসে নিজের আটকে রাখা দায় হয়ে পড়েছে৷ ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভূমি। নিশ্বাস আটকে আসছে তার৷ প্রলয়ের শার্ট খামচে ধরেছে। পুরুষালি অবাধ্য হাতের বিচরণ ঘটছে সর্বত্র জুড়ে৷ বেশ কিছু সময় পর ভূমিকে ছেড়ে দিল প্রলয়৷ ভূমির ওষ্ঠে মসৃণ ভাবে ছুঁয়ে বাঁকা হেসে বলল‚
“সামথিং ডিফারেন্ট।”
এই বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়া না প্রলয়। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে বালিশে মুখ লুকাল ভূমি। ভীষণই লজ্জা লাগছে তার৷ এই মুখ কী করে দেখাবে সে। লোকটা দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে৷
মধ্যাহ্নে…
মাথায় শুধু মাধুরীর ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ভূমি আর ভাবতে পারছে না। মাথা ধরে এলো। মন এবং মস্তিষ্ক দুটোই চাইছে‚ তার একটিবার মাধুরীর সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। নিজের ভাবনাকেই অধিক প্রাধান্য দিল সে৷ ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা চাপিয়ে নিচে চলে গেল৷ উদ্দেশ্য মোর্শেদ শিকদারের ঘর৷ সে জানে মাধুরী এখন ঘরেই রয়েছেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল ভূমি৷ ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে ভূমি দুয়ার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন‚
“হঠাৎ আমার ঘরে— কী চাই?”
“মা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“আমার হাতে সময় নেই৷ যা বলার তাড়াতাড়ি বল।”
“আমি কী কোনো দোষ করেছি? না মানে আপনি কী কোনো কারণে আমার উপর রুষ্ট?”
“সেটা জানতে হলে আগে আমাকে এটা বল— তোমার বাবার নাম কী? কী করেন?”
“আমার বাবা কে‚ আমার জানা নেই! আম্মার কাছে অনেক জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু উনি আমাকে কিছুই বলেননি।”
কপাল চাপড়ে মাধুরী বললেন‚ “আমার হয়েছে ফাটা কপাল।”
মাধুরীর কথা ভূমি কিছুই বুঝল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মুখ ঝামটা দিলেন মাধুরী। তিনি এবার সাফ সাফ বললেন‚
“না আছে বাবার পরিচয়‚ না আছে বংশের পরিচয়। সব ঝামেলা আমার ঘাড়ে জোটে।”
এবার ভূমি বুঝতে পারল মাধুরীর এমন ব্যবহারের সূত্রপাত। ব্যাপারটাকে খুবই স্বাভাবিক ভাবে নিল ভূমি। ছোটবেলা থেকে কম কথা তো শুনতে হয়নি তাকে। বরঞ্চ সে এমন ব্যবহারেই অভ্যস্ত। মাধুরী পুনশ্চ বললেন‚
“এবার বুঝেছ আমার এমন ব্যবহার করার কারণ? তোমাকে আমি কোনদিনও মেনে নিতে পারব না। কোনো জার’জ সন্তানকে আমার ছেলের বউ হিসেবে তো কখনোই না৷”
মাথা নিচু করে ভূমি বলল‚ “আমি জা’রজ সন্তান নই৷ আমার বাবা আছেন।”
“তাহলে শুনি কে তোমার বাবা?”
ভূমি কী বলবে ভেবে পেল না! সে তো জানেই না তার বাবা কে? কোথায় থাকে? কী করে? কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল‚ “আমার জানা নেই!”
“তুমি কী ভেবেছ— আমি কোনো খোঁজ খবর নিইনি? এমনিতেই যাকে তাকে আমার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেব?”
ভুমি কিছু বলতে নেবে তার আগেই মাধুরী বললেন‚ “অ্যাই তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও তো৷ তোমাকে আমার একটুও সহ্য হচ্ছে না৷”
করুণ কোমল স্বরে ভূমি বলল‚ “এ বাড়িতে এসে আমি দ্বিতীয় মাকে পেয়েছি। আমাকে কী একটু ভালোবাসা যায় না মা?”
“তোমাকে আমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি!”
ভূমি আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না৷ এখন সবটাই জলের মতো পরিষ্কার। খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে তার বাবা কে? কোথায় থাকে? কী করে? কেন তার মাকে এভাবে একা ফেলে গিয়েছিল? কেন তাদের জীবনটা অন্যদের মতো স্বাভাবিক হলো না? ক্ষিপ্রবেগে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে গেল৷ অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে৷ কেন কেউ তাকে সহজ ভাবে মেনে নেয় না? যে করেই হোক আম্মার কাছ থেকে সব সত্যি জানতেই হবে। ঘরে এসেই মোবাইল থেকে নাজমার নাম্বারে কল লাগাল ভূমি৷ অপাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করছে না৷ হতাশ হয় বিছানায় শুয়ে পড়ল ভূমি। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার৷ কেঁদেকেটে সব ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। চোখ বন্ধ করল ভূমি৷ কয়েক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। ভাগ্যিস প্রলয় এখন বাড়িতে নেই৷ এই কান্না নিয়ে তাহলে আরেক কাহিনি ঘটে যেত৷ এরই মাঝে নাজমার নাম্বার থেকে কল আসতে শুরু করেছে। চট করে চোখ মেলে তাকাল ভূমি। রিসিভ করা নিয়ে সময় ব্যয় করল না সে। নাজমার সঙ্গে ভালোমন্দ কথা বলে‚ ফোনটা মহুয়ার কাছে দিতে বলল ভূমি। মহুয়াকে কোনো কিছুই বলতে না দিয়ে সে আগেই বলল‚
“আমার বাবা কে আম্মা?”
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে ভীষণই অবাক হলেন মহুয়া। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন‚ “আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“তোমাকে বলতেই হবে আম্মা।”
মহুয়া সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন‚ “তোকে কী কেউ কিছু বলেছে?”
কথাটা পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল ভূমি। তার আম্মাকে বলল‚ “হুট করেই জানতে ইচ্ছে হলো আম্মা। এবার অন্তত আমাকে সত্যিটা বল।”
“যেদিন সামনাসামনি দেখা হবে সেদিন সব সত্যি জানতে পারবি।”
গোধূলি লগ্নে…
বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ জুড়ে সফেদ আব উড়ে বেড়াচ্ছে। যা একটু একটু করে রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। বাতাবরণও শীতল৷ আজ দুপুরে তপ্ততা ছিল প্রখর৷ মেঝে এখনো গরম হয়ে রয়েছে। ঘরে এসির হাওয়াও উষ্ণ মনে হয়েছে দুপুরে। ভূমি দু’হাত মেলে দোলনায় বসে রইল। খোলা চুলগুলো বাতাসে দোল খাওয়ার সঙ্গে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আজ এই অসময়ে চুল ছেড়ে রেখেছে৷ গোসল করে আধঘণ্টা হবে হয়তো। ভেজা মেলে রাখা চুলগুলো দেখে প্রশংসা পঞ্চমুখ সাবিনা৷ তার সঙ্গেই ছাদে উঠেছে ভূমি৷ ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না৷ মাধুরীর বলা প্রত্যেকটা কথা কানে বাজছে৷ কান্নারা এসে ভীড় জমাল নেত্র কোণে। গলা ভারী হয়ে আসছে। কান্নারা এসে দলা পাকাচ্ছে। বিষাদের তুমুল আন্দোলনে ভেতরটা র’ক্তাক্ত ক্ষ’তবিক্ষ’ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষণ্ণচিত্তে চেয়ে রইল আকাশ পানে। নিজেকে ভীষণ ভার মনে হচ্ছে৷ হালকা হওয়ার তাড়না পিছু নিয়েছে৷ পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে বিশাল অম্বরে৷ এদিকে সাবিনা আচারের বোয়াম গুলো ঠিক করে রাখল৷ দুপুরে রোদে দিয়েছিল৷ সবগুলোই মাধুরীর বানানো। ভূমিকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে সাবিনা জিজ্ঞেস করল‚
“ভাবি আচার খাইবেন?”
“না আপু। তুমি এগুলো নিয়ে নিচে চলে যাও৷ আমি একটু একা থাকতে চাই।”
“ভাবি আপনের কী মন খারাপ?”
“না। আম্মার কথা একটু মনে পড়ছে।”
সাবিনা দাঁড়াল না। আচারের বোয়াম নিয়ে নিচে চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখল প্রলয় বাড়ি ফিরেছে। সাবিনা কিছুটা কাচুমাচু হয়ে রান্নাঘরের দিকে চলল। প্রলয়কে অতি ভয় পায় কিনা!
“তোর ভাবি কোথায় রে সাবিনা?”
মৃদুস্বরে সাবিনা বলল‚ “ভাবি তো ছাদে।”
“আচ্ছা তুই নিজের কাজে যা।”
কথাটা বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল প্রলয়। ছাদের কাছে এসে ধীর পায়ের ভূমির কাছে গেল৷ দোলনার কাছে দাঁড়িয়ে বলল‚
“আমাকে মিস করছিলে? দেখেছ তোমার টানে ঠিকই চলে এসেছি আমি।”
ভূমি কিছু বলল না৷ কিছু বলতে ইচ্ছেই হলো না তার৷ একই ভঙ্গিতে দোলনায় বসে রইল৷ প্রলয় দোলনায় দোল দিতে শুরু করল৷ চোখ বন্ধ করে রইল ভূমি। কিছুই ভালো লাগছে না তার৷ একটু একাকীত্ব প্রয়োজন। বিষণ্ণতা তার পিছু এ জীবনে ছাড়বে না৷ অনেকটা সময় ধরে ভূমিকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে কিছুটা খটকা লাগল প্রলয়ের। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“তোমার কী মন খারাপ ভূমি কন্যা? কেউ কী তোমাকে কিছু বলেছে?
“আম্মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে৷”
“খুব শীগ্রই তোমার আম্মার সঙ্গে দেখা হবে।”
অতিবাহিত হলো আরও পাঁচটি দিবারাত্রি। সময় খুব তাড়াতাড়িই অতিবাহিত হয়ে যায়৷ চোখের পলকেই চলে যায় যেন৷ এ পাঁচদিনে মাধুরীর ব্যবহার আরও রুক্ষ হয়েছে। সকলের সামনে কথা না বললেও‚ আড়ালে কটু কথা শোনাতে ছাড়েন না তিনি। ভূমিও নীরবে তা সহ্য করে যায়৷ প্রলয়কে কিচ্ছুটি জানতে দেয়নি সে। আম্মার একটা কথা তার সদা মনে পড়ে। গ্রাম ছেড়ে আসার আগে আম্মা তাকে একটা কথা বারবার বলে দিয়েছিলেন‚ “পরিবারের সবাই সমান হবে এমনটাও না৷ ভালোমন্দ মিলিয়েই একটা পরিবার তৈরি হয়। কেউ তোমাকে পছন্দ করবে— আবার কেউ তোমাকে অপছন্দ করবে। তাই বলে তোমাকে হার মেনে নিলে হবে না৷ সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে হবে৷” আম্মার কথাগুলো মনে করে করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভূমি৷ মায়ের প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে৷ এ পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে নিজের করে নিয়েছে ভূমি। এ পাঁচটি দিন বিষণ্ণতায় কাটলেও আজ ভূমি ভীষণ খুশি৷ তার একটা কারণ হচ্ছে‚ তার আম্মা আসছে৷ কতগুলো দিন পর আম্মাকে দেখবে সে৷ আনন্দ ধরে রাখতে পারছে না ভূমি।
গোধূলি বিকেল…
মালঞ্চ নীড়ে সবার আগমন ঘটেছে। ফিরোজার বাপের বাড়ি থেকে সকলেই এসেছেন। ফিরোজার বোন আর ভাইয়ের পরিবার এসেছেন। অর্পণ আর প্রলয় দুজনেই সবার কাছে বড্ড প্রিয়। মাধুরীর বাপের বাড়ি থেকে শুধু উনার ভাইয়ের পরিবার আসবেন। প্রলয়ের নানুমণি এ বিয়ে মানতে নারাজ তাই তিনি আসবেন না বলে দিয়েছেন। কেউ আর তাকে জোর করছেন না। বয়স্কা যেটা মনে করেন সেটাই করেন। উনার উপর দিয়ে কেউ যেতে পারে না। একমাত্র প্রলয় যদি আনতে পারে। কারণ প্রলয়কে বড্ড স্নেহ করেন তিনি। মাধুরীরা দু ভাই-বোন। তিনি ছোটো। যারা এসেছেন সকলেরই ভূমিকে পছন্দ হয়েছে। পছন্দ না হবার কোনো কারণই নেই। মালঞ্চ নীড়ে আজ লোকসমাগমে ভরপুর। মেহমানরা আসতে শুরু করেছেন। একে তো প্রলয়ের জন্মদিন তারউপর আবার রিসেপশন। ফিরোজার বড়ো বোন ফাহমিদা বললেন‚
“মাধুরী তোমার ছেলের বউ দেখছি আগুন সুন্দরী। এত সুন্দর মেয়ে কোথায় পেলে?”
থম মেরে বসে রইলেন মাধুরী। মহিলাদের আসর জমেছে উনার ঘরে। বৈঠকথানায় বাড়ির এবং নিমন্ত্রিত পুরুষদের আসর জমেছে। ভূমিকে এ ঘরে নিয়ে এসেছেন ফিরোজা। এ ঘরে মাধুরী‚ ফিরোজা‚ উনার বড়ো বোন ফাহমিদা‚ ভাইয়ের বউ রাবিয়া বসে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা করছেন। অন্যের মুখে ভূমির প্রশংসা সহ্য হলো না মাধুরীর। ভূমি এখন উনার চোখের বালি। যাকে না পারছেন সইতে আর না পারছেন বের করে দিতে। থমথমে গলায় মাধুরী জবাব দিলেন‚
“এনেছি কোনো এক অজপাড়া গাঁ থেকে।”
মাধুরীর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা স্পষ্ট বুঝতে পারল ভূমি। তবুও কিছু মনে করল না। মনে করেই বা কী লাভ? জোর করে কী আর কারো মনে জায়গা করা যায়? তবে সে জানে একদিন না একদিন হয়তো মাধুরীর মনে জায়গা করে নেবে। তবে সেই দিনটা কবে আসবে তার জানা নেই! চুপটি করে ফিরোজার পাশে বসে রইল সে। ফিরোজা সবই বুঝলেন কিন্তু কিছুই করার নেই উনার। সবাইকে আবারও চুপ করে থাকতে দেখে রাবিয়া বললেন‚
“মেয়েটা বেশ মিষ্টি দেখতে। তা কী কী দিলেন বউমাকে?”
এত কথা পছন্দ হচ্ছে না মাধুরীর৷ ভালো কথাও উনার সহ্য হচ্ছে না৷ ভূমির আজও মনে পড়ে‚ সেদিন কতটা ভালোবেসে কত কী কেনাকাটা করে দিয়েছিলেন মাধুরী৷ আসলেই মানুষ বদলায় কারণে অকারণে। ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগছে। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। মাধুরী বিরক্তি নিয়ে বললেন‚
“দেখতেই তো পাচ্ছেন৷ কোনো কিছুর কমতি রাখিনি৷ একমাত্র ছেলের বউ৷”
ফাহমিদা বললেন‚ “আচ্ছা মাধুরী— কোনো কারণে কী তুমি রেগে আছ অথবা মন খারাপ?”
মাধুরীকে কিছু বলতে না দিয়ে ফিরোজা কথা কাটানোর জন্য বললেন‚ “বাড়িতে অনুষ্ঠান। একটা চিন্তা তো আছেই। রাগ বা মন খারাপ কোনোটাই না৷ ভাবি আসলে একটু চিন্তিত৷ সব যেন ভালোই ভালোই মিটে যায় সেটাই কাম্য।”
অন্যদিকে…
ইরার হোস্টেলের সামনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্পণ। বেশ কয়েকবার ইরার নাম্বারে কল দিয়েছে। কিন্তু রিসিভ হয়নি৷ উপায়ন্তর না পেয়ে অর্পণ দারোয়ানের কাছে গিয়ে ইরার কথা জিজ্ঞেস করল। দারোয়ান হোস্টেলের ভেতরে খবর পাঠাল৷ মিনিট দশেকের মাঝে ইরা গেইটের সামনে এসে দাঁড়াল। অর্পণকে দেখে হেসে দিল৷ তবে তার হাসিটা কেউই দেখল না৷ ঘর্মাক্ত শরীরের কালো শার্ট লেপ্টে রয়েছে৷ বাইকে হেলান দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে অর্পণ। তার কাছে এগিয়ে গেল ইরা৷ তাকে দেখে মাত্রই মোবাইলটা পকেটে রেখে কিছুটা রাগী গম্ভীর স্বরে অর্পণ বলল‚
“মোবাইল কোথায় আপনার?”
ইরা বোকা বোকা চাহনিতে ফোনটা দেখাল। মানে সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে৷ অর্পণ চুপ করে রইল। রাগ হচ্ছে ভীষণ। একে তো সারাদিনের ক্লান্তি। তারউপর এই মেয়ের হেঁয়ালি সহ্য হচ্ছে না। বেশিক্ষণ নীরব আর থাকতে পারল কই? ইরা আগ বাড়িয়ে বলল‚
“আপনি হঠাৎ হোস্টেলের সামনে কী করছেন?”
“ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসো৷”
অবাক হলো ইরা। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল‚ “কেন?”
“তোমার বাবা মা আসছেন সেটা তো তুমি জানোই৷ তাই আমার মা বলেছে তোমাকে এই দুদিন আমাদের বাড়িতে থাকতে৷”
“আমি এখান থেকেই নাহয় আপনাদের বাড়িতে যাব।”
“হঠাৎ এত লক্ষ্মীটি হলেন কী করে?”
মুখ ভেংচি কে’টে ইরা বলল‚ “আমি সবসময় এমনই।”
“আজ বেশি কথা বাড়াতে চাইছি না৷ আমি বড্ড ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসো৷”
মিনমিনে সুরে ইরা ‘আসছি’ বলেই হোস্টেলের ভেতরে চলে গেল৷ এরপর ছোটো একটা ব্যাগ সঙ্গে করে নিয়ে এলো। তাকে দেখামাত্রই অর্পণ বাইকে চড়ে বসল৷ ইরার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে হেলমেট এগিয়ে দিল৷
বৈঠকখানায় হুলুস্থুল কাণ্ড। মাধুরীর মা গুলবাহার এসেছেন। মাকে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি তিনি। খিটখিটে মেজাজটাকেও বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। সকলেই বৈঠকখানায় উপস্থিত। প্রলয় নিজে গিয়ে তার নানুমণিকে নিয়ে এসেছে৷ সেই আসতেই হলো গুলবাহারকে৷ বড়ো নাতির আবদার কিছুতেই ফেলতে পারলেন না তিনি। প্রলয় যখন উনার বাড়িতে গিয়ে আহ্লাদিত হয়ে বায়না ধরল। তখনই বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছে৷ সকাল থেকেই ভূমি মাথায় লম্বা করে ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে৷ মাগরিবের নামায আদায় করেই এখানে এসেছে৷ সে জানতই না প্রলয়ের নানুমণি এসেছে৷ নিচতলা থেকে কথাবার্তার আওয়াজ কর্ণগোচর হচ্ছে। তাই সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। গুলবাহার ভূমিকে দেখে ধীর পায়ে সামনে এসে বললেন‚
“এই বুঝি আমার নাতি বউ?”
প্রলয় গম্ভীর স্বরে বলল‚ “হ্যাঁ নানুমণি।”
ভূমির চিবুক ছুয়ে মুখ উঁচু করলেন গুলবাহার। বিজ্ঞ দৃষ্টিতে দেয়ে রইলেন বেশ অনেকটা সময়৷ এরপর মাধুরীর দিকে তাকালেন। কিছু একটা ইশারা করলেন মাধুরী৷ গুলবাহার এবার জিজ্ঞেস করলেন‚
“তা মেয়ে তোমার নাম কী?”
নিচু স্বরে ভূমি বলল‚ ওয়াজিহা মেহরাব ভূমি।”
“শুনলাম তোমার মা নাকি মানুষের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে। তোমার বাবা নাকি থাকতেও নেই। আরও অনেক কথাই শুনলাম।”
মহিলার কথায় কষ্ট পেল ভূমি। চকিত দৃষ্টিতে একটিবার তাকাল প্রলয়ের দিকে। এরপর আরেকটিবার তাকাল মাধুরীর দিকে৷ মাধুরী হাসছেন। তারমানে এসব কথা তিনিই উনার মাকে জানিয়েছেন৷ ভূমির খারাপ লাগল। ভীষণই খারাপ লাগল আজ৷ বৈঠকখানায় পিনপতন নীরবতা। নীরবতা ঘুচিয়ে প্রলয় তার নানুমণিকে বলল‚
“তুমি আমাকে এভাবে অপমান করতে পারো না নানুমণি।”
“আমি তোকে কখন অপমান করলাম?”
“আমার বউকে অপমান করা মানে আমাকেও অপমান করা৷”
আর কিছু বলতে পারলেন না গুলবাহার। এত যুক্তি দিয়ে কথা বলা উনার মোটেও পছন্দ নয়। তবুও প্রলয়ের কথার উপর কথা বলতে পারলেন না। কখনো বলেনও না। প্রলয় যে উনার বড্ড স্নেহের। মাধুরীর মুখটা আঁধারে ছেঁয়ে গেল৷ ভূমির চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে মজা লুটছিলেন তিনি। এরই মাঝে ইরাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে অর্পণ। নীরবতা মাঝে আবারও হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল৷ ইরাকে দেখেই ফিরোজা খুব বেশি খুশি হয়ে গেলেন। এত এত মানুষের মাঝেও নিজেকে একা মনে হলো ভূমির৷ প্রলয় ছাড়া আর কেউ নেই আজ তার পাশে৷ ছোটো বেলা থেকে বাবা নামক বটবৃক্ষের অভাব তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে৷ বাবা না থাকার হাহাকার হৃদয়কে সহস্রাধিক ক্ষ’তবিক্ষ’ত করেছে৷ এদিকে ইরাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ফিরোজা৷ অর্পণের কাজিনদের সঙ্গে খুব হেসেখেলে ইরা৷ সবার মাঝে ভূমিকে তার খেয়ালই নেই। চুপিসারে ভূমি সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে চলে গেল৷ কেউ তার দিকে খেয়ালই করল না৷
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২২|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
ঘরে এসেই কয়েক ফোঁটা অশ্রুবর্ষণ হলো মৃগনয়না অক্ষিকোটর হতে। কিন্তু মন খুলে কাঁদতে পারল না মেয়েটা৷ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে‚ ঘরে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছে প্রলয়। ওড়না দ্বারা চোখমুখ মুছে একটিবার আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করল৷ অনুমতি পেয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল প্রলয়। সে জানে ভূমির এখন মন খারাপ। কেঁদেছেও হয়তো মেয়েটা৷ মুখটা কেমন লালাভ হয়ে রয়েছে৷ ঘন আঁখিপল্লবও কেমন সিক্ত। ভূমি বিছানার পাশের টেবিলটার সামনে দাঁড়াল৷ পানি পান করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। এই মুহূর্তে অন্যকোনো ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাইছে না প্রলয়। যে কথাগুলো শুনলে মেয়েটার মন বিষিয়ে যাবে৷ ভূমির মন ভালো করার জন্য প্রলয় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল৷ বুকে হাত রেখে বলল‚
“দুদিন ধরে তুমি আমাকে একটুও সময় দিচ্ছ না বউ! আমার শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।”
“আপনার কী শরীর খারাপ করছে? ভাইয়াকে ডাকব?”
মুহুর্তেই ব্যস্ত হয়ে উঠল ভূমি। তাড়াহুড়ো করে বিছানার থেকে নামার জন্য উদ্যত হলো৷ প্রলয় তার হাতটা ধরে ফেলল। গম্ভীর স্বরে বলল‚
“এত বোকা কেন তুমি? বেশ বুঝতে পারছি কয়েক বছরে আমার বাসর করা হবে না।”
লোকটার এহেন লাগামহীন কথাবার্তায় লজ্জায় অভিভূত অঙ্গনার পা দুটো থেমে গেল৷ ভূমিকে টেনে নিজের উপর ফেলে দিল৷ আটকে নিল শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনে৷ প্রলয়ের সান্নিধ্যে এসে কষ্টগুলো মূর্ছা গিয়েছে৷ দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। প্রলয় পুনশ্চ বলল‚
“কেন বোঝ না— তুমি আমার ভীষণ শখের! ভালোবাসি বউ। তোমার নারী মন কেন এই অনুভূতিটা বুঝতে পারে না?”
ভূমি বুঝল লোকটা তার মন ভালো করার চেষ্টা করছে। তা না হলে তার মতো উটকো ঝামেলাকে কেই-বা ভালোবাসবে? নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছে তার। প্রলয়ের উপর থেকে সরে গেল ভূমি৷ দুজনেই উঠে বসল৷ প্রলয় কিছু বলতে নেবে তার আগেই ভূমি বলে উঠল‚
“আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি নিচে যাচ্ছি।”
ভূমি যে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে তা বেশ বুঝল প্রলয়। কিছুক্ষণ আগেও তো মেয়েটা মুচকি হেসেছিল৷ তার কথাতে কী মন খারাপ হলো? কথাটা বলার সময় মেয়েটা তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।
তমসাচ্ছন্ন অম্বর ম্লান করে দীর্ঘ প্রহর কেটেছে। বৈঠকখানায় লোকসমাগম ভীষণ। একে একে সবাই ঠিকই চলে এসেছে। গ্রাম থেকে কিছুক্ষণ আগেই মোড়ল বাড়ির প্রত্যেকে এখন মালঞ্চ নীড়ে এসে পৌঁছেছে। মেহরাব শিকদারও চলে এসেছেন উনাদের সঙ্গে। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারলেন না যে মহুয়া কেন সঙ্গে এসেছেন! পরক্ষণেই ভাবলেন হয়তো মানবতার খাতিরে বাড়ির পরিচারিকাকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন শাহাদাৎ মোড়ল। তারপরও একটা কিন্তু রয়েই যায়৷ সেই কিন্তুটা হচ্ছে মহুয়ার মেয়ে৷ কই মহুয়া তো একা এসেছে৷ তার মেয়ে কোথায়? মহুয়ার মেয়ের কথা ভেবেও কোনো কাজ নেই উনার। তাই সকল ভাবনাকে দূর করে সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন মেহরাব শিকদার। এরপর ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। কতগুলো দিন পর আম্মাকে চোখের সামনে দেখছে ভূমি। অতিমাত্রায় খুশিতে কান্না করে দিল মেয়েটা৷ মায়ের প্রতি অভিমান বাড়ল৷ কেন তাকে বিয়ে দিলেন? কেন নিজের থেকে আলাদা করে দিলেন? গ্রামে তো দিব্যি দুজনের দিন কেটে যেত৷ সমস্ত অপ্রতুলতার মাঝেও দিনগুলো তো আনন্দে কাটত৷ অশ্রুপ্লুত ঝাপসা চোখে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো সে৷ তার পেছন পেছন প্রলয়ও এসেছে৷ বৈঠকখানায় পৌঁছেই মহুয়াকে গিয়ে জাপ্টে ধরল। ক্রন্দনরত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল‚
“কেমন আছ আম্মা? তুমি এমন শুকিয়ে গিয়েছ কেন?”
খুশি মনে মেয়েকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে মহুয়া বলল‚ “আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা৷ অনেকদিন পর দেখছিস তো তাই এমন মনে হচ্ছে৷”
উপস্থিত সকলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে৷ ছোটো সদস্যরাও এখানেই রয়েছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা‚ তাদের মামাতো ভাই রাফি‚ অর্পণের মামাতো কাজিন ভাইবোন লাম আর লামিয়া। তার খালামণির কোনো সন্তানসন্ততি নেই। তবুও তারা দিব্যি আছেন। রাফি আর অর্পণ সমবয়সী। পেশায় পুলিশ৷ লাম আর লামিয়া এবার উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার্থী৷ শাহাদাৎ মোড়ল মহুয়াকে ভূমির মা হিসেবে সকলের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরায় মেহরাব শিকদার তখন নিজের ঘরেই ছিলেন যে কারণে ভূমির পরিচয় উনার জানাই হলো না। মেহমানদের জন্য চারটে কামরা খুলে দেওয়া হলো। মেয়েদের জন্য দুটো ঘর আর পুরুষদের জন্য দুটো ঘর। মহুয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে ফিরোজা রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাড়িতে এতগুলো মানুষ। রাতের খাবার তো তৈরি করতে হবে। উনার পেছন পেছন ফাহমিদা আর রাবিয়াও চলে গেলেন সাহায্য করতে। মাধুরী ঠায় উনার মায়ের সঙ্গে বসে রইলেন। বাড়ির পুরুষেরা এখন বৈঠকখানায় নেই। আসর জমেছে নিচতলার একটি কামরায়। শাহাদাৎ মোড়লও তাদের সঙ্গেই গেলেন। এখানে পুরুষ মেহমানগণ থাকবেন। এদিকে ভূমির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়। সে এগিয়ে গিয়ে মহুয়ার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”
“না বাবা৷ তোমরা সবাই ভালো আছ তো?
“জি আমরা সবাই ভালো আছি৷ আপনাদের বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।”
প্রলয়কে মহুয়ার সঙ্গে হাসিখুশি কথা বলতে দেখে মনে মনে খুবই ক্রুদ্ধ মাধুরী। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ সংবরণ করছেন তিনি। নিজের মাকে রেখে ওই মেয়েটার মাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা সহ্য হলো না উনার। এটা দেখে গুলবাহার বললেন‚
“শাশুড়ীকে পেয়ে মাকে ভুলে যেও না নানুভাই।”
কথাটা পছন্দ হলো না প্রলয়ের৷ কিন্তু সে কিছুই বলল না৷ নাজমা নিজে থেকেই বললেন‚ “এ কেমন কথা মাওই মা? মাকে কেন ভুলে যাবে? আমরা তো জানি প্রলয় খুবই দায়িত্ববান।”
বড়োদের মাঝে কথা বাড়াল না প্রলয়। তারা নিজেরাই সব ঠিক করে নেবে‚ এমনটাই তার ভাবনা। রান্নাঘর থেকে সবটাই শুনলেন ফিরোজা৷ মাধুরী দিনকে দিন কেমন রুক্ষ হয়ে উঠছেন! এতটা স্বার্থপর তো উনি ছিলেন না৷ ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের বিরূপ প্রভাব পড়ছে উনার উপর। তিনি রান্নাঘর থেকেই কিছুটা উচ্চস্বরে বললেন‚
“বেয়ান আপনারা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। অনেকটা পথ তো জার্নি করে এলেন।”
কথাটা উচ্চস্বরে বললেন যাতে করে উনারা শুনতে পারেন৷ প্রলয়ও ফিরোজার কথায় সায় জানাল৷ উনাদের ব্যাগগুলো সে নিজেই তুলে নিল ঘরে রেখে আসার জন্য। ভূমি তার মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। মমতাময়ীর স্নেহমাখা হাতটা অনেকদিন পরেই ধরার সৌভাগ্য হলো তার৷
রাত সাড়ে বারোটা…
ফিরোজা একা হাতে সবদিক সামলে উঠতে পারছেন না। বাড়িতে বিশেরও অধিক মানুষ। সব কাজ সাবিনার উপর রাখাটাও তো কেমন দেখায়! ফাহমিদা আর রাবিয়াও কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। তবে মাধুরীর ভাইয়ের স্ত্রী এ বাড়িতে আসার পর ঘর থেকে বের হননি। বেশি মানুষের মাঝে নাকি উনার অস্বস্তি হয়৷ ইতিমধ্যেই অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। হসপিটাল থেকে দুদিনের ছুটি নিয়েছে অর্পণ। প্রলয় আজ পার্টি অফিসে গিয়েছিল তবে তাড়াতাড়িই ফিরে তার নানুমণিকে নিয়ে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে কাজ করছিল বিধায় ফিরোজা জোর করে ভূমিকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। খাওয়াদাওয়ার পরপরই ঘরে চলে এসেছিল প্রলয়৷ ছাদে ছোটোদের আড্ডা চলছে। ছোটো বেলা থেকেই তার এসব মোটেও পছন্দ নয়। বাকিদের মতো সবার সঙ্গে খুব সহজে সহজ হতে পারে না সে৷ তবে এরা সবাই তো তার পরিবারের সদস্য কিন্তু একা সময় কাটাতে ভীষণ ভালো লাগে৷ তাই সে ঘরেই অপেক্ষা করছে তার ভূমি কন্যার জন্য। বিছানায় শুয়ে একবার এপাশ তো আরেকবার অপাশ করছে৷ এরই মাঝে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি। তাকে দেখা মাত্রই আড়মোড়া ভাঙল প্রলয়। ভূমিকে আজ খুবই চঞ্চল মনে হচ্ছে। মেয়েটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে৷ মেয়েটার হাস্যজ্বল মুখটাই বড্ড ভালো লাগে৷ কখনো এতটা ছটফটে দেখেনি প্রলয়। উঠে বসে ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚
“বিবিসাহেবাকে আজ ভীষণ খুশি খুশি মনে হচ্ছে। কী ব্যাপার?”
ভূমি দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসল৷ ক্ষীণ হেসে বলল‚ “আম্মাকে পেয়ে আমার ভীষণ আনন্দ লাগছে৷”
“আর তোমার এই আনন্দটাই আমার খুব প্রিয়।”
পূর্বাকাশে নবোদিত অরুণের ছটা সমগ্র অম্বর জুড়ে৷ পাখিদের কিচিরমিচির কলরবে ঘুম ভেঙেছে ভূমির। ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিল সে। সকাল সাড়ে সাতটা বাজছে৷ বারান্দায় দুটো চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে৷ প্রতিদিন সকালে তাদের কিচিরমিচিরেই ঘুম ভাঙে তার। ফজরের নামায আদায় করে ঘুমিয়েছিল৷ ভূমি ঝটপট উঠে পড়ল৷ ঘরটা গুছিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিল সে৷ এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রলয় এখনো ঘুমচ্ছে৷ আজ মনে হয় না সে কোথাও বের হবে। কাল এবাড়িতে অনুষ্ঠান রয়েছে৷ মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো ভূমি। অনেকটা সময় মায়ের সঙ্গে কাটাল। শান্তি লাগছে ভীষণ। এরপর ভূমি ঘরে এসে দেখল প্রলয় এখনো চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমচ্ছে। লোকটা কী আসলেই এতটা ঘুমকাতুরে? কই চাচি মার কাছে তো শুনেছে‚ প্রলয় খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে! ভূমির প্রলয়ের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকতে শুরু করল। কিছুটা নড়েচড়ে আবারও ঘুমে তলিয়ে গেল প্রলয়৷ এবার তার বাহুতে ঝাকিয়ে ডাকতে শুরু করল‚
“এমপি মশাই আপনি এখনো ঘুমচ্ছেন? উঠুন তাড়াতাড়ি। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে প্রলয় বলল‚ “আজ আমার শরীরটা ভালো লাগছে না৷”
ভূমির প্রলয়ের কপালে হাত রাখল৷ না! জ্বর তো নেই৷ তাহলে কী হলো লোকটার? ভূমি কিছুটা ব্যস্ত হয়ে প্রলয়কে জিজ্ঞেস করল‚
“আপনার কী খুব বেশি খারাপ লাগছে? আমি কী ভাইয়াকে ডাকব?”
প্রলয় মনে মনে কয়েকটা কথা আওড়াল। কথা গুলো এমন যে‚ “ইস! এসেছে ভাইয়ার দুলালি।” প্রলয়কে চুপ থাকতে দেখে ভূমি আবারও জিজ্ঞেস করল‚
“কী হলো কিছু বলছেন না কেন?”
“অর্পণকে ডাকতে হবে না। তুমি আমার খাবারটা ঘরে নিয়ে এসো৷ বেশি করে নিয়ে আসবে। আমার প্রচুর ক্ষিধে পেয়েছে৷ সবকিছু দ্বিগুণ নিয়ে আসবে। ক্ষিধে পেলে আমি অনেক খাই।”
থম মে’রে রইল ভূমি। লোকটা তার ব্যস্ততাকে তোয়াক্কা না করে খাবার নিয়ে আসতে বলছেন? ভূমিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে মুখের সামনে তুড়ি বাজাল প্রলয়৷ চমকে উঠে তাকাল ভূমি। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ প্রলয় বিছানা ছেড়ে উঠে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে এলো। সকালে এরইমাঝে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মিনিট পাঁচেক পর ট্রেতে করে খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ভূমি। প্রলয় বিছানায় বসে রয়েছে৷ ভূমি তাড়া দিয়ে বলল‚
“আপনি হাতমুখ ধুয়ে আসুন আমি বেড়ে রাখছি।”
প্রলয় বলল‚ “আমি ফ্রেশ হয়ে এসেছি।”
ভূমি খাবারের প্লেটটা প্রলয়ের দিকে এগিয়ে দিল। প্রথম লোকমা নিজে না খেয়ে ভূমির মুখের সামনে তুলে ধরল৷ প্রলয় ইচ্ছে করেই বেশি করে খাবার আনিয়েছে। দুজনে একসঙ্গে খাবে বলে। সময় অতিবাহিত হলো। ভূমি একই ভঙ্গিতে ড্যাবড্যাব করে তার এমপি মশাইয়ের মুখপানে চেয়ে রইল৷ প্রলয় বলল‚
“অপেক্ষা করা আমার মোটেও পছন্দ নয় ভূমি কন্যা। ঝটপট হা কর।”
ভূমি খাবারটা মুখে নিল৷ প্রলয়ের জোরাজুরিতে ভূমিও তার সঙ্গে খেয়ে নিল। সে এবার বুঝতে পারল প্রলয়ের মতিগতি।
দুপুরে…
নিচতলার ঘরে একাই রয়েছেন মহুয়া৷ রান্নাঘর থেকে এদিক সেদিক পর্যবেক্ষণ করছে ভূমি। না এখন কেউ নেই এখানে। দুপুরের খাবার খেয়ে কেউ হয়তো ঘুমচ্ছে আবার কেউ হয়তো নিজেদের ঘরে রয়েছে। বাহিরে ডেকোরেশনের কাজ চলছে৷ কয়েকজন হয়তো সেখানেই রয়েছে৷ মালঞ্চ নীড় মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হচ্ছে। কাউকে বৈঠকখানার কাছে দেখতে না পেয়ে ভূমি তার মায়ের কাছে চলে গেল। বিছানায় বসে ছিলেন মহুয়া৷ সে গিয়ে দরজা আটকে দিল। আকস্মিক এমন হওয়ায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মহুয়া। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন‚
“এভাবে কেউ দরজা লাগায়? বাকিরা দেখলে ভাববে‚ আমি তোকে কুম’ন্ত্রণা দিচ্ছি।”
কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “আম্মা আমার বাবা কে?”
একটা অতীত— একটা সত্যি ভূমির জীবনটাকেই পালটে দিয়েছে৷ বাবা থাকতেও ছোটো থেকে অনাথের মতো বড়ো হয়েছে। কতশত অপ্রতুলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে! এমনও দিন গিয়েছে‚ ঘর খাবার ছিল না৷ শুকনো চিড়ামুড়ি খেয়ে রাত কাটিয়েছে মা মেয়েতে মিলে৷ পান করার মতো পানিটা পর্যন্ত কেউ দিতে চাইত না। সকলের লাঞ্ছনা নীরবে সহ্য করেছে৷ মণিকে ছাড়া তার আর কোনো বন্ধু ছিল না। স্কুলে কেউ তেমন মিশত না। সকলে জা’রজ জা’রজ বলে দূরে সরিয়ে দিত। তার আজও মনে পড়ে। গ্রামে আজিজ মাস্টারের মেয়ের বিয়ে ছিল। জামাল কাকাদের পাশের বাড়িটাই তাদের৷ ভূমি কখনো বিয়ে বাড়িতে যায়নি। বিয়ে বাড়ির পরিবেশ কেমন হয় জানা নেই তার! খুব ইচ্ছে হয়েছিল বিয়ে বাড়ি দেখার। কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে না পেরে আম্মাকে না জানিয়েই চলে গিয়েছিল আজিজ মাস্টারের বাড়িতে। গ্রামবাসী অনেকই নিমন্ত্রিত ছিল সেখানেই। তাকে দেখা মাত্রই সেদিন তেড়ে এসেছিলেন রমিজা। প্রতিবেশী হবার দরুন তিনিও নিমন্ত্রিত ছিলেন৷ সেদিন কম অপমান করেননি তিনি। হাভাতে গোগ্রাসে গিলতে এসেছে এমন কথাও শুনতে হয়েছিল তাকে৷ বাকিরা মজা লুটছিল। মহুয়া এসব ব্যাপারে কিছুই জানতেন না৷ সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ছুটে এসেছিল ভূমি। আজও মনে পড়লে তার ভীষণ কান্না পায়। আঠারো বছর বয়সে কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। আম্মাকেও কম কথা শুনতে হয়নি। আর এই সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র একটা মানুষ দায়ী। এ জীবনে কখনো সেই মানুষটাকে সে ক্ষমা করবে না। বাবারা বুঝি এমনও হয়? নিজের সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মে’রে ফেলতে চায়? ঘৃণায় জর্জরিত হলো অঙ্গনার কোমল হৃদয়।
মহুয়ার কাছ থেকে সত্যিটা শোনার পর নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না ভূমি। আম্মার চোখমুখের দিকে তাকাতে পারছিল না সে৷ খুব করে উপলব্ধি করছিল মহুয়া কাঁদছেন। আম্মার ক্রন্দনরত মুখটা কী করে দেখবে সে? দৌঁড়ে সেখান থেকে প্রস্থান নিয়েছিল ভূমি। ঘরের দরজা চাপিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ নিজেকে ঘৃণা হচ্ছিল খুব৷ শুধুমাত্র তার জন্য তার আম্মার জীবনটা এতটা কষ্টের। সে যদি এই নিকৃষ্ট পৃথিবীতে না আসত তাহলে তার আম্মাকে জীবন নামক লড়াইয়ে নামতে হত না৷ আর না মানুষের কটু কথা নীরবে হজম করতে হত। খুব কাঁদছে ভূমি। বারবার নিজেকে দেখছে আর ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিচ্ছে৷ চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। এরই মাঝে ঘরে এসে ভূমিকে এভাবে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে গেল প্রলয়৷ দ্রুত পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। ভূমি নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেছে প্রলয়কে। অর্ধাঙ্গিনীর এহেন কাণ্ডে অবাক হলো প্রলয়৷ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল‚
“এভাবে কাঁদছ কেন? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে?”
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে। চোখমুখ ফুলে লাল টমেটো হয়ে গিয়েছে৷ নিজের বক্ষঃস্থল থেকে ভূমির মুখখানা তুলল প্রলয়৷ মেয়েটার হঠাৎ কী হলো? কেন এত কাঁদছে? বুঝতে পারছে না প্রলয়৷ কিছুই বলছে না ভূমি৷ এমনকি চোখের দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। ভূমির মাথা ঘুরছে৷ দেহে বিন্দুপরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীরটা৷ প্রলয় আবার জিজ্ঞেস করল‚
“কেন কাঁদছ ভূমি কন্যা? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? আমাকে বল! তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?”
ভূমি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না৷ অথচ তার অনেক কিছু বলার ছিল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে— ‘কেন তার আম্মার সাথে এত বড়ো অন্যায়টা হলো? কেন তাকে সমাজের কাছে জা’রজ সন্তান হিসেবে পরিচিত হতে হলো? কী অন্যায় ছিল তার আম্মার? কী অন্যায় ছিল সেই অনাগত বাচ্চাটার? জন্মের আগেই কেন পরিচয়হীন হতে হলো?’ আবারও কাঁদতে শুরু করল ভূমি। প্রলয় আরও ঘাবড়ে গেল। বেশি কাঁদলে তো মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে৷ বাড়ি ভরতি মেহমান৷ ভূমিকে নিজের সঙ্গে জাপ্টে নিল৷ মেয়েটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে প্রলয়ের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। যদি এমন হত‚ প্রেয়সীর হৃদয় হতে সকল বিষণ্ণতা গ্লানি নিংড়ে নিতে পারত। ভূমির মাথাটা বুকে আগলে নিল প্রলয়৷ মেয়েটার কান্নার বেগ কিছুটা কমেছে৷ কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে হাতে বাঁধন। ভূমির মুখটা তুলতেই প্রলয় বুঝতে পারল মেয়েটা অচৈতন্য হয়ে পড়েছে৷ আলগোছে পাঁজোকোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল সে। ঘুমের ঘোরেও হেঁচকি তুলছে। হুট করে কী হলো ভূমির? কেন এভাবে কাঁদছিল? জ্ঞান ফিরুক তখনই জানতে চাইবে। ভূমির চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে প্রলয়৷
বিকেলে…
ছাদে নাচের রিহার্সাল হচ্ছে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতার পরশু থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তারা আপাতত এসবে নেই। কেউ তাদের জোরও করেনি৷ বেচারিদের তো দম ফেলারও সময় নেই। অর্পণ আর ইরা একটা গানে নাচবে৷ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। আরশ‚ রাফি‚ লাম আর লামিয়া গ্রুপ ডান্স করবে। দুটো দল ভাগ হয়ে গিয়েছে৷ কাপল ডান্স করবে অর্পণ ইরা৷ রোমান্টিক হিন্দি গানে নাচছে দুজনে৷ অর্পণের তালে তাল মেলাচ্ছে ইরা৷ কিন্তু হঠাৎ করেই একটা স্টেপ ভুল করে বসে সে৷ পড়ে যেতে নিলে অর্পণ তাকে ধরে ফেলল। ইরাকে রাগানোর জন্য টিপ্পনী কে’টে বলল‚
“নাচ না জানলে উঠোন বাঁকা।”
“আপনি চুপ থাকুন। আপনাদের ছাদ ভালো না৷ তাই আমি নাচতে পারছি না৷”
“এখন তো এই কথা বলবেই।”
ভেংচি কাটল ইরা। এবার আর মজা নয়। অর্পণ গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “এই গানে তুমি কমফোর্টেবল তো?”
হাই তুলে ইরা বলল‚ “হুম কমফোর্টেবল।”
টাইম ব্রেক চলছে৷ হাঁপিয়ে উঠেছে ওরা৷ কাল সন্ধেবেলায় রিসেপশন৷ হাতে এখনো অনেক সময় রয়েছে৷ মোট চারটা গানে নাচবে ওরা সকলে৷ বেশ মজা করছে ওরা৷ রাতে ছাদে ছোটো করে মেহেন্দির আয়োজন করবে ছোটোরা মিলে৷ বোতলে করে পানি খাচ্ছে ইরা৷ আরশ তার পাশেই বসে রয়েছে। রাফি অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚
“আচ্ছা আমরা সবাই এখানে রয়েছি কিন্তু বর বউ কোথায়? ওদের কোনো পারফরম্যান্স নেই?”
জবাবে অর্পণ বলল‚ “তোরা তো জানিসই‚ ভাই এসব পছন্দ করে না।”
বেজায় বিরক্ত হলো রাফি। প্রলয়কে তার পানসে মনে হয়৷ কোনো রসকষ নেই এর মাঝে। রাফি বলল‚ “ভাই প্রচন্ড নিরামিষ। নিজের বিয়েতে অন্তত একটা রোমান্টিক পারফরম্যান্স দেওয়া উচিত।”
“আরে ইয়ার‚ এসব কথা প্রলয় ভাইয়াকে বলা আর কলাগাছকে বলা একই কথা।”
আরশের কথায় সকলে হেসে উঠলে একত্রে৷ কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়ে ওরা আবারও রিহার্সাল করায় মনোযোগী হলো। সন্ধ্যের পর আরও কাজ রয়েছে৷
চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরে ক্রমাগত পায়চারি করছেন মহুয়া। মেয়ের জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে উনার৷ তখন ওভাবে ছুটে গিয়েছিল এরপর আর দেখা হয়নি। এখন বিকেল হতে চলল। কই মায়ের কাছে তো একটিবারও এলো না৷ মহুয়া ভাবলেন একবার ভূমির ঘরে যাবেন। মেহরাব শিকদার এখনো ভূমির আসল পরিচয় জানেননি এ ব্যাপার অবগত মহুয়া৷ তবে কতক্ষণ সত্যিটা আড়াল থাকবে? মেহরাব শিকদার তো ঠিকই সত্যিটা জেনে যাবে? তখন কী হবে? ভূমির কোনো ক্ষতি করবে না তো লোকটা? এই নিয়েই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন মহুয়া৷ লোকটার ভয়ঙ্কর কিছু সত্যি একমাত্র তিনিই জানেন। এ ব্যাপারে ভূমিকেও তিনি কিছু জানাননি৷ মেহরাব শিকদার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ আতঙ্কিত তা তিনি সেদিন রাতেই বুঝতে পেরেছিলেন। বাকি সত্যিগুলোও ভূমিকে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মহুয়ার পায়চারি করার মাঝেই নাজমা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। মহুয়াকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলেন‚
“তুমি এভাবে পায়চারি করছ কেন মহুয়া?”
নাজমাকে পেয়ে মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার হলো। পদচারণ থেমে গেল মহুয়ার৷ তিনি নাজমার কাছে এগিয়ে গেলেন৷ বাহিরে একটিবার ভালো করে দেখে নাজমাকে বিছানায় বসিয়ে বলল‚
“ভাবি আমার মেয়েটা যে সমস্ত সত্যি জেনে গিয়েছে। ও নিজেকে কী করে সামলাবে? যে বাবা তাকে গ্রহণ করেনি ভাগ্যের পরিহাসে তাদেরই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে সে৷ এসব কিছু কী করে সহ্য করবে?”
“সত্যি কখনো চাপা পড়ে থাকে না মহুয়া৷ একদিন না একদিন সবাই এই সত্যিটা জানবে। তাই অহেতুক চিন্তা কোরো না।”
“তবুও আমার খুব ভয় করে ভাবি। সত্যিটা যেদিন সবাই জানতে পারবে সেদিন কী আমার মেয়েটাকে সবাই মেনে নেবে? আজকাল আমার ভীষণ ভয় হয়। মেয়েটাকে সামলানোর জন্য কী আমি থাকব?”
“এসব কী ধরনের কথা? থাকবে না মানে কী?”
“আমার জীবনটা এখন অনিশ্চিত। তবে আমার মেয়েটাকে একজন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ছেলের হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত।”
চলবে?…..
#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
তিমিরাচ্ছন্ন অন্তরিক্ষে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে৷ ছাদে মেহেন্দির আয়োজন করা আপাতত স্থগিত। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না৷ যেকোনো সময় মেঘ আসতে পারে৷ তবে সবটাই অনিশ্চিত। উপরতলায় একটা ঘরে ভূমিকে মেহেন্দি লাগিয়ে দিচ্ছে ইরা আর লামিয়া৷ প্রলয়ও রয়েছে ওদের সকলের সঙ্গে। সেখানে গান-বাজনা খানাপিনারও আয়োজন হয়েছে৷ তখন জ্ঞান ফেরার পর প্রলয়কে কিছুই বলেনি ভূমি৷ এখনো মুখ ভার করে রয়েছে। কিছু একটা ব্যাপার তো ঘটেছেই যা মেয়েটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অল্প সময়ের জন্য পূর্ণতা পুষ্পিতাও সেখানে উপস্থিত হয়েছে৷ সারাদিন তো অনেক পড়াশোনা করেছে৷ এবার একটু সকলের সঙ্গে সময় কাটানো প্রয়োজন। এদিকে ভূমিকে একনজর দেখতে উপরে যাচ্ছিলেন মহুয়া৷ সেই দুপুরের পর থেকে আর বের হয়নি। দুপুরের খাবার নাকি ঘরেই খেয়েছিল। তারউপর উনার সঙ্গেও তো দেখা করেনি মেয়েটা৷ ভূমির ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন মহুয়া। তখনই দেখতে পেলেন অর্পণ এদিকেই আসছে৷ হয়তো নিচে যাবে। তিনি একদৃষ্টে অর্পণের দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ এ বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো বড্ড ভালো৷ ভূমিকে অল্প সময়েই আপন করে নিয়েছে। আর অর্পণ তো ভূমিরই ভাই৷ হোক তারা দুই মায়ের৷ কিন্তু ভাইবোন তো! বাবা তো একজনই। ভাগ্যের কী পরিহাস? দুটো ভাইবোন ঠিকই মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। মহুয়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“কিছু বলবেন আন্টি?”
অর্পণকে উনার খুবই পরিপক্ব এবং দায়িত্বশীল মনে হয়েছে এই অল্প সময়েই৷ নিজের উপর কিছুটা আস্থা রেখে তিনি বললেন‚ “আমাকে একটা কথা দিতে পারবে বাবা?”
অবাক হয়ে অর্পণ বলল‚ “কী কথা?”
কিছুটা সময় নিয়ে মহুয়া মনে মনে নিজের কথাটা সাজিয়ে নিলেন৷ একটিবার শুকনো ঢোক গিলে বললেন‚
“আমার মেয়েটাকে ছোটো বোনের মতো করে সবসময় আগলে রেখ। সংসার আর সমাজের মারপ্যাঁচ ও বোঝে না৷ কোনো ভুলচুক হলেও ওর পাশে থেক।”
অর্পণ বুঝতে পারল না হুট করে এমন কথা বলার মানে৷ উত্তরের আশায় চেয়ে রইলেন মহুয়া৷ অর্পণ উনাকে আশ্বাস দিয়ে বলল‚
“ভূমিকে আমি আমার বোনই মনে করি৷ ঠিক যেমনটা পূর্ণতা পুষ্পিতা। আমি সবসময় বড়ো ভাইয়ের মতো ওর পাশে থাকব প্রত্যেকটা মুহূর্তে। আমি চিন্তা করবেন না।”
মহুয়া বিরবির করে বললেন‚ “ও তো তোমার বোনই।”
বিরবির করতে থাকা কথাটা শুনতে পেল না অর্পণ। তবুও জিজ্ঞেস করল‚ “কিছু বললেন আন্টি?”
“কিছু না বাবা। তোমার কথা শুনে খুবই নিশ্চিন্ত আমি।”
পূর্ণতা পুষ্পিতা তখন ভূমির সামনে বসে ছিল। দুপাশে বসেছে ইরা আর লামিয়া। দুজনে এতক্ষণ মেহেন্দি লাগিয়ে দিয়েছে। এ ঘরে মহুয়া আসতেই পূর্ণতা পুষ্পিতা সরে গেল। মহুয়াকে জায়গা করে দিল বসার জন্য। এ ঘরে এখন প্রলয়-ভূমি‚ অর্পণ-ইরা‚ পূর্ণতা পুষ্পিতা‚ লাম‚ লামিয়া এবং রাফি উপস্থিত রয়েছে। মহুয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মেয়ের মুখপানে। দুহাত ভরতি মেহেন্দি৷ হলুদ পাড়ের জলপাই রঙা শাড়ি পড়েছে ভূমি। ঘন দীঘল কেশগুচ্ছ বিনুনি গেঁথে ফুলের মালা পেঁচিয়ে রাখা। মহুয়া খুব মনোযোগ দিয়ে মেয়েকে দেখতে লাগলেন। মুখ তুলে একটিবারও তাকাল না ভূমি৷ কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! মহুয়া চেষ্টা করলেন মেয়ের সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু সবার সামনে কিছুই বলতে পারছেন না তিনি। তখনকার ব্যাপারটা নিয়েই মনমরা ভূমি। প্রলয় বুঝল মা মেয়েতে মিলে কিছুক্ষণ কথা বলা প্রয়োজন কিন্তু এখন তা সম্ভব হবে না। ছোটোদের এত শখ করে আয়োজন করা নষ্ট হয়ে যাবে। এরই মাঝে পূর্ণতা পুষ্পিতা বলে উঠল‚
“চল ভাবিমণি আমরা সবাই একটা গ্রুপ সেলফি তুলব।”
ওদের সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও সায় জানাল। মহুয়ার আর সুযোগ হয়ে উঠল না মেয়ের সঙ্গে কথা বলার। ভাবলেন পরে এক সময় কথা বলে দিবেন। মেহরাব শিকদারের সম্পর্কে আরো কিছু সত্যি বলার রয়েছে উনার। মেহরাব শিকদারকে মোটেও ঠিক মনে হচ্ছে না। যেকোনো সময় কিছু একটা করে ফেলতে পারেন তিনি। লোকটা নিজের স্বার্থে সবকিছু করতে পারেন। এ সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই অবগত। তাইতো সময় থাকতেই উনিশ বছর আগেই সরে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তা হতে দিল না। রাফি নিজের ক্যামেরা দিয়ে সকলের ছবি তুলতে শুরু করল। ভূমি তার মায়ের সঙ্গে কখনো ছবি তোলেনি। সকলের সঙ্গে আজ ছবি তুলিয়ে দিয়েছে রাফি। এত মানুষের মাঝে মুখটা তবুও ভার হয়ে আছে ভূমি। মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললেন‚
“তোমরা আড্ডা দাও৷”
মহুয়াকে হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে ইরা বলল‚ “তুমি কোথায় যাবে আন্টি?”
“আমি একটু ঘরে যাব মা। তোমরা আড্ডা দাও।”
মহুয়া একবার ভূমির দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখমুখ এখনো ফুলে রয়েছে। তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন উনার পদ্মিনী খুব কান্না করেছে। আজ সত্যিটা বলা মোটেও ঠিক হয়নি উনার। কাল বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান। কোনো সমস্যা হবে না তো? ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে এলো উনার। এমনিতেই জীবনের সমস্যার কোনো শেষ নেই। ভূমিকে একপলক দেখে ক্ষীণ হাসলেন মহুয়া। এরপর এই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার পথেই দেখা হয়ে গেল মেহরাব শিকদারের সঙ্গে। উনার সঙ্গে ফিরোজা রয়েছেন। লোকটা মহুয়াকে দেখে ক্ষিপ্ত হলেন। দেখে মনে হচ্ছে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। দিনকে দিন কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে! ফিরোজার সামনে কোন কথা বলতে চাইছেন না মহুয়া। নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান নিতে চাইলে মেহরাব শিকদার বলে উঠলেন‚
“মেহমান আছে মেহমানের মতোই থাকবেন। এদিক সেদিক ঘুরঘুর করা বন্ধ করুন।”
মেহরাব শিকদারের এহেন ব্যবহারে ভীষণই অবাক ফিরোজা৷ তবে ব্যাপারটা মোটেও অবাক করলেন না মহুয়াকে৷ তিনি জানেন মেহরাব শিকদারের এমন ব্যবহার করার কারণ। বড্ড আতঙ্কে রয়েছেন মেহরাব শিকদার। না জানি কখন কোন সত্যিটা সামনে চলে আসে৷ মহুয়া কিছুই বললেন না৷ মেহরাব শিকদার পুনশ্চ বললেন‚
“কী হলো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এক্ষুনি নিজের ঘরে যান।”
এবার উনাকে থামিয়ে ফিরোজা বললেন‚ “কাকে কী বলছ? উনি শধু মেহমানই না— এ বাড়ির কুটুম।”
ফিরোজার কথা কিছুই বুঝলেন না মেহরাব শিকদার। বরঞ্চ অবাক হলেন। একবার ফিরোজা তো আরেকবার মহুয়া৷ দুজনের দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚
“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?”
কিছুটা ভয় পাচ্ছেন মহুয়া। সত্যিটা আজ মেহরাব শিকদারও জেনে যাবেন। সত্যিটা তো একদিন জানারই ছিল৷ ফিরোজাকে পর্যবেক্ষণ করছেন মহুয়া৷ মেহরাব শিকদার শুকনো ঢোক গিলছেন বারবার। মনে উঁকি দেওয়া প্রশ্নের উত্তরটা যেন কিছুতেই সত্যি না হয় সেই প্রার্থনাই করছেন তিনি। ফিরোজা বললেন‚
“উনিই তো আমাদের ভূমির আম্মা। কেন— তুমি কী জানো না?”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না মেহরাব শিকদার। গলা শুকিয়ে আসছে উনার৷ যতই অতীতকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন ততই অতীত যেন জেঁকে বসছে। কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছেন না তিনি। মহুয়া তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলেন। গম্ভীর হয়ে উঠল মেহরাব শিকদারের মুখখানা। কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলেন‚
“কী বললে— আবার বল!”
“বললাম‚ মহুয়া হচ্ছে ভূমির আম্মা। কেন তুমি জানো না?”
নিটোল পা দুটো কেঁপে উঠল। তারমানে ভূমি উনার সন্তান। যাকে কিনা উনিশ বছর আগে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলেন। মহুয়া আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না। বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গেলেন। মেহরাব শিকদারের মনে হানা দিল আতঙ্ক। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি! এবার যদি ভূমি নিজের অধিকারের জন্য মুখ খুলে? না! ভূমির মুখ খুলতে দেওয়া যাবে না। যে করেই হোক‚ যা করার উনাকেই করতে হবে। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে উঠলেন তিনি। ঝোঁকের বশে চেঁচিয়ে উঠলেন ফিরোজার উপরে। স্বামীর এমন পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারলেন না তিনি। হুট করে কী হলো লোকটার? গ্রাম থেকে ফেরার পর থেকেই এমন অচেনা মানুষের মতো আচরণ করছেন। প্রেসার ফল করল না তো? ফিরোজা একবার ভাবলেন অর্পনকে সবটা বলবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ছুটে অর্পনের কাছে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু খুলে বললেন। অর্পণ তার মাকে আশ্বাস জানাল যে‚ সে সবটা দেখবে। এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন ফিরোজা। ছেলের উপর খুবই ভরসা উনার।
রাতে…
চুল থেকে ফুলের মালা খুলে রাখছে ভূমি৷ ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখায় খুব চুলকচ্ছে। চুলে টান লাগায় ব্যথাও করছে খানিকটা। রাতের খাবার প্রলয় নিজের হাতেই খাইয়ে দিয়েছে৷ ভূমির হাত এখনো পুরোপুরি ভাবে শুকয়নি। এদিকে খুবই ঘুম পাচ্ছে তার৷ দুপুরে এক দফা ঘুমিয়েছিল কিন্তু তবুও ঘুম হয়নি তার৷ বসে বসেই ঝিমচ্ছে সে। প্রলয় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল ভূমি ঝিমচ্ছে। তখনই মনে পড়ল দুপুরে কান্না করার কথাটা। সে ভূমির কাছে গিয়ে বসল। হাতের মেহেন্দি তুলতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল‚
“তখন এভাবে কাঁদছিলে কেন? কেউ তোমাকে কিছু বলেছিল?”
“অনেকদিন পরে আম্মাকে কাছে পেয়ে খুবই আনন্দ হয়েছিল। আবেগাপ্লুত হয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তাই আরকি!”
প্রলয় বুঝতে পারল ভূমি তার থেকে কিছু একটা লুকতে চাইছে। তাই বিষয়টাকে নিয়ে খুব বেশি ঘাটল না সে। মন ভালো হলে নিজে থেকেই সবটা বলবে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে দুহাতের মেহেন্দি তুলে দিল প্রলয়। কমলাটে রং হয়েছে। ইরা বলেছিল‚ সারারাত থেকে রং ফুটবে। তারজন্য সময়ের প্রয়োজন। ভূমির হাতের মুঠোয় অধর ছোঁয়াল প্রলয়। দুহাতের তালুতে নিজের নাম দেখে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে সে৷ পরক্ষণেই মনে পড়ল‚ কাল তাদেরও একটা পারফরম্যান্স দেওয়ার কথা আছে৷ কিন্তু রিহার্সালই তো করা হয়নি এখনো। ভূমিকে বিছানা ছেড়ে নামিয়ে প্রলয় বলল‚
“তাহলে চলো নাচের রিহার্সালটা করে ফেলি। ওরা তো বেশ সুন্দর নাচ শিখছে। কাল নাকি নাচবে। আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। আমি নাকি ভালো নাচতে পারিনা অথচ ওরা তো জানেই না আমার ঘরে নাচের টিচারই রয়েছে।”
সমস্ত মন খারাপ দূরে ঠেলে ভূমি আতকে উঠল। এখন কী সকলের সামনে নাচতে হবে নাকি? ভারী বিপাকে পড়েছে। সে তো অতটাও ভালো নাচতে পারে না। মায়ের কাছ থেকে একটু আধটু শিখেছিল। আর সকলের সামনে নাচতে গেলে তো লজ্জায় ম’রি ম’রি অবস্থা হবে। প্রলয় এগিয়ে গিয়ে ভূমির দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল।
আকাশ গুড়গুড় করছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে। ঝড়ো হাওয়া আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। বাতাসে চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে৷ শীতল হাওয়ায় গা ভাসাতে বেশ লাগছে ইরার৷ ছাদের এককোণায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে৷ রাত হয়েছে তবে ঘুম আসছে না তার৷ রাতে ছাদে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করার অভ্যেস আছে তার৷ বাড়িতে থাকাকালীন এমন রাত বিরেতে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটাহাঁটি করে সময় কা’টাত। এদিকে ঘুমের ঘোরে পানি খেতে উঠেছে অর্পণ। কিন্তু জগে একফোঁটা পানি অবধি অবশিষ্ট নেই৷ অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়েছে সে৷ ইরাদের ঘরের দরজাটা খোলা৷ ঘরের ভেতর থেকে ঘুম বাতির আবছা আলো বাহির অবধি আসছে। এ ঘরে তো ইরা আর লামিয়া থাকছে৷ কে জেগে রয়েছে? আর দরজাই বা খোলা কেন? বিষয়টাকে খুব একটা তোয়াক্কা না করে নিচে চলে গেল অর্পণ। কিছুক্ষণ পর জগে করে পানি নিয়ে ইরাদের ঘরের সামনে এসেস দাঁড়াল। না এখনো দরজা খোলা। অর্পণ এদিকসেদিক একবার তাকাল৷ ছাদের দরজা খোলার আওয়াজ পেল। তার এখনো মনে আছে‚ বিকেলে নাচ রিহার্সালের পর তো ছাদের দরজা আটকে আসা হয়েছিল। হাতে থাকা জগটা ঘরে রেখে এসে অর্পণ ছাদের দিকে অগ্রসর হলো৷ বাহিরে তীব্র নাতাস বইছে৷ সবকিছু যেন উড়িয়ে দিচ্ছে৷ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। আঁধারিয়া খোলা আকাশের নিচে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইরা। এই রাতের বেলায় মেয়েটাকে এভাবে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে কিছুটা আতকে উঠল অর্পণ। অত্যন্ত ধীর পায়ে সেই শীর্ণ দেহাবয়বের দিকে এগিয়ে গেল সে। হুট করে কারো উপস্থিত অনুভব করে পেছন তাকাল ইরা৷ অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚
“তা ম্যাডাম হঠাৎ এই রাতের বেলা ছাদে একা দাঁড়িয়ে কী করছেন?”
“আপনি বুঝি জানেন না বৃষ্টিময় আবহাওয়া আমার কতটা পছন্দের! তাইতো আবহাওয়া বিলাস করতে এলাম। বেশ ফুরফুরে লাগছে নিজেকে।”
“কিন্তু আমার একদমই পছন্দ নয়। আমার তো সেই আবহাওয়া বিলাসীকে পছন্দ।”
“রাতবিরেতে মজা করতে এসেছেন?”
“মজা কোথায় করলাম? আমি তো সত্যিটা বললাম।”
“তা আপনি এখানে কী করছেন ঘুমাননি কেন? কাল তোর সকাল সকাল উঠে সমস্ত আয়োজন করতে হবে। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।”
“শুধু আমার একার দায়িত্ব নয়। এ বাড়ির সকলের দ্বায়িত্বও বর্তায়।”
“বাকিরা তো মেহমান।”
“বাড়ির সহস্য হতে কতক্ষণ?”
চুপ রইল ইরা৷ আঁধারের মাঝেও তার মুচকি হাসি খুব করে উপলব্ধি করল অর্পণ। সে আবারও বলল‚
“আপনি কৃপা করিয়া নিজের কামরায় অবস্থান করুন। আমার ঘুম আপনা আপনিই চলিয়া আসিবে। আপনাকে ছাদে একা ফেলিয়া তো কোথাও যাওয়া হচ্ছে আমার।”
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নকল করা বন্ধ করুন। আমি এখন ঘরে যাব না। মনে হচ্ছে না বৃষ্টি আসবে বলে। এলে খুব ভালো হত। একটু ভিজতে পারতাম। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না!”
“ভালো হয়েছে মেঘ আসবে না৷ বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে। তখন তো ভাই আর ভূমির রিসেপশনে আনন্দ করতে পারবেন না। বিছানায় শুয়ে বসে সময় কা’টাতে হবে।”
“উফ আপনার ডাক্তারি আপনি আপনার কাছেই রাখুন তো৷ ভাইয়াও মাঝে মাঝে এমন জ্ঞান দেয়।”
“তোমার ভালোর জন্যই বলে— স্টুপিড!”
ভেংচি কাটল ইরা। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। আড়ালেই হাসল অর্পণ। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল। একটা কথা মাটিতে ফেলতে চায় না। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়ায় মেতে ওঠে মেয়েটা।
ভূমিকে পার্লারের মেয়েরা সাজিয়ে দিয়েছে৷ ভ্রু প্লাক না করলে নাকি সাজ সুন্দর হবে না৷ পার্লারের মেয়েটা অনেকবার বলেছে ভ্রু প্লাক করার জন্য৷ কিন্তু ভূমি নিজের সিদ্ধান্তে অত্যন্ত কঠোর। সে ভ্রু প্লাক করবে না মানে করবে না৷ ইরা‚ লামিয়া অনেকবার রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল৷ এরপর প্রলয়ও স্ট্রিক্টলি বারণ করে দিয়েছে৷ তারপর আর কেউই জোর করেনি৷ ভূমিকে সুন্দর করে সাজিয়ে হিজাব করিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ লেহেঙ্গার সঙ্গে ম্যাচিং করে হিজাব আনা হয়েছিল। হাতের চিকন চুড়ি আর মোটা কঙ্কণ পড়ানো হয়েছে৷ কঙ্কণ জোড়া এ বাড়িতে আসার পর থেকে হাতে পড়ে রয়েছে সে৷ কিছুক্ষণ আগেই মাধুরী কিছু গহনা দিয়ে গিয়েছেন। এগুলো প্রলয়ের বউয়ের জন্যই বানানো হয়েছিল৷ সবগুলো খুব যত্নসহকারে ভূমিকে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আজকের জন্য পূর্ণতা পুষ্পিতা পড়াশোনা থেকে ছুটি পেয়েছে। সকালে সব পড়ে রেখেছে যাতে করে কাল পরীক্ষায় কোন সমস্যা না হয়। কাজিনমহলে প্ল্যান ছিল মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি করবে।
“তুমি এখানে বসে থাক! আমি ঝটপট তৈরি হয়ে আসি। নয়তো পরে আর সময় হবে না।”
ঘাড় কাত করে সায় জানাল ভূমি। ইরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ আয়নার সামনে বসে রয়েছে ভূমি। নিজেকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে৷ বেশি মেকআপ করানো হয়নি। হালকার মাঝেই অপরূপা লাগছে। হাতের মেহেন্দি বেশ গাঢ় রং হয়েছে৷ সবাই খুব বলছিল‚ ‘হাতের মেহেন্দির রং গাঢ় হলে না স্বামী আদর করে’ কথাটা যতবার শুনেছে ততবারই লজ্জায় লাল নীল হয়েছে সে। বাকিরা একটু বেশিই লজ্জা দিচ্ছে তাকে৷ সমস্ত মনখারাপ দূর করে ভূমি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে৷ আম্মাকে দেওয়া কথা সে অবশ্যই রাখবে৷ এমন কোনো দিনও হয়নি যে‚ সে তার আম্মার কথা কোনো দিন অমান্য করেছে৷ তবে এই কথাটা কী করে অমান্য করবে? আম্মা যে নিজের কসম দিয়েছেন৷ যতই কষ্ট হোক অতীতকে সে কিছুতেই নিজের বর্তমানে আসতে দেবে না। এরই মাঝে শেরওয়ানির হাত গুটাতে ঘরে প্রবেশ করল প্রলয়৷ আয়নায় সামনে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত নারীকে দেখে হৃৎস্পন্দন যেন সেখানেই থেমে গেল। থেমে গেল কয়েক লহমা। অত্যন্ত ধীর পায়ে ভূমির সমীপে এগিয়ে গেল প্রলয়। চোখের সামনে যেন পুতুল বউ বসে রয়েছে। প্রলয়ের উপস্থিত বুঝতে পেরে সেই পুতুল বউয়ের চোখের ঘন পাপড়ি কেঁপে উঠল৷ বার কয়েক পলকও ফেলল। সময় অতিবাহিত হবার সঙ্গে প্রলয় এগিয়ে গেল তার অর্ধাঙ্গিনীর সমীপবর্তী। কারো হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনতে পেল প্রলয়৷ মস্তিষ্ক ফাঁকা মনে হচ্ছে৷ সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে নিজের কাছে৷ শুকনো ঢোক গিয়ে গলা পরিষ্কার করে প্রলয় বলল‚
“আমাকে কী মে’রে ফেলার চিন্তা করছ?”
প্রলয়ের কথা কিছুই বুঝল না ভূমি৷ লোকটার মাথা কী খারাপ হয়েছে— কীসব উল্টো পাল্টা কথা বলছেন? ভূমি চোখে চোখ রেখে কিছুটা তেজি স্বরে বলল‚
“কীসব উল্টো পাল্টা কথা বলছেন আপনি?”
প্রলয় নিজের বুকে হাত রেখে চোখের চশমা ঠিক করে বলল‚ “ভূমি কন্যার এমন জ্বালাময়ী রূপ দেখে আমার ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে৷ নির্লজ্জ অনুভূতি গুলো বারবার উঁকি দিচ্ছে৷”
কণ্ঠস্বরে উন্মত্ততা। ভূমি চোখ ফিরিয়ে নিল৷ ওই দুচোখে তাকিয়ে থাকা বড়ো কঠিন৷ নে’শা ধরে যায়৷ আস’ক্তি কাজ করে৷ প্রলয় এগিয়ে এসে প্রেয়সীর ললাটে সিক্ত পরশ এঁকে দেয়৷
সবে ভূমির ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে ইরা৷ এতক্ষণ ভূমির সঙ্গে সঙ্গেই ছিল সে৷ সকালে মায়ের কাছ থেকে নীল কাতান শাড়ি নিয়ে এসেছিল পড়ার জন্য। বিছানার উপর শাড়ি‚ অর্নামেন্টস আর মেকআপ করার যাবতীয় সবকিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ইরা দরজা আটকাবে তার আগেই অর্পণ এসে সামনে দাঁড়াল। হুট করে তাকে দেখে খুব অবাক হলো ইরা। অর্পণের হাতে একটা শপিং ব্যাগ। ভেতরে কী আছে জানা নেই ইরার! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইরার দিকে এগিয়ে দিল অর্পণ। ইরা জিজ্ঞেস করল‚
“এটাতে কী আছে?”
“আমি বলব কেন? তুমি নিজেই খুলে দেখে নিয়ো।”
অর্পণের সামনেই পার্সেল খুলল ইরা৷ ভেতরে লাল পাড়ের কালো জামদানী শাড়ি রয়েছে৷ শাড়িটা চোখ ধাধানো সুন্দর। এক দেখেতেই পছন্দ হওয়ার মতো শাড়িটা৷ মনে মনে খুবই খুশি হলো ইরা৷ অর্পণের পক্ষ থেকে এটাই প্রথম গিফট৷ খুশিতে চোখমুখ চিকচিক করছে ইরার৷ পরক্ষণেই ভুরুদ্বয় কুঁচকে অর্পণকে জিজ্ঞেস করল‚
“হঠাৎ শাড়ি গিফট করছেন ব্যাপার কী?”
“কেন আমি কী কিছু গিফট করতে পারি না? এমনিতেই এই শাড়িটা পছন্দ হয়েছিল তাই অর্ডার করে দিয়েছিলাম। তোমার পছন্দ না হলে‚ দাও আমি ফেরত দিয়ে দেব।”
অর্পণ শাড়িটা নিতে নিলে ইরা চট করে হাত সরিয়ে ফেলল। পছন্দের শাড়িটা সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না৷ তাও আবার অর্পণের দেওয়া। ইরা ভেংচি কেটে অর্পণকে বলল‚
“আপনার সাহস তো কম না! আমার শাড়ি ফেরত দেবেন— আমার শাড়ি?”
“তাহলে আজ তুমি এই শাড়িটা পড়বে। কেমন?”
“হুম পড়ব! আপনি এখন আসতে পারেন।”
চোখ ছোটো ছোটো করে অর্পণ বলল‚ “কাজের বেলায় কাজি— কাজ ফুরোলেই পাজি!”
“কীসের মধ্যে কী বলছেন? নিজে তো সেজেগুজে তৈরি। আমি রেডি হব না? নাকি এই কদাকার অবস্থাতেই বাহিরে যাব?”
“সেটা আগে বলবে তো। আমি যাচ্ছি ম্যাডাম। তুমি তাড়াতাড়ি সাজুগুজু করে এসো।”
“আপনি বের হন আগে ডাক্তার সাহেব।”
অর্পণ বের হয়ে যেতেই ইরা দরজা আটকে দিল। বাকিরা সবাই সেজেগুজে তৈরি। শুধুমাত্র সে-ই লেট লতিফা। ইরা শাড়ি পড়তে পারে। তাই একা তৈরি হতে তার কোনো অসুবিধে হবে না। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে তৈরি হতে শুরু করল ইরা। যাওয়ার আগে অর্পণ তাকে দুটো লাল গোলাপ দিয়ে গিয়েছে। সেই ফুলগুলোই আজ খোপায় লাগাবে।
পুরো বাগান জুড়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মালঞ্চ নীড় সেজে উঠেছে রঙিন বাহারী মরিচ বাতিতে। বাগানে স্টেজ সাজানো হয়েছে৷ গোলাপ‚ চন্দ্রমল্লিকা‚ রজনীগন্ধা দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে সবকিছু। বাগানের ছোটো ছোটো গাছগুলোর উপরও মরিচ বাতি দেওয়া হয়েছে।
চলবে?…..