রণরঙ্গিণী প্রেমরঙ্গা পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
3

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

[প্রাপ্তবয়স্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

কলেজ জীবনে প্রলয়ের মাত্র তিনজন বন্ধু ছিল৷ যারা তার খুব কাছের। অনার্স পড়াকালীন সময়ও ওরাই তার প্রিয় বন্ধুদের তালিকায় ছিল৷ ভাগ্য সহায় ছিল তার চারজন একই ভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টে চান্স পেয়েছিল৷ এখন জাহিদ‚ নাঈম আর মুশফিকা তিনজনই ঢাকার বাহিরে সেটেল্ড। তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারা তাদের পরিবার নিয়েই এসেছে আজ৷ মুশফিকাকে সবসময় মুশফিক ভাই বলে ডাকত প্রলয়। এ নিয়ে জাহিদ আর নাঈম কম মজা উড়াত না। প্রলয়ের দেখাদেখি ক্লাসের বাকি সহপাঠীরাও মাঝে মাঝে মজা করে মুশফিক ভাই বলে ডাকত। রাগে গাল ফুলিয়ে রাখত মুশফিকা। সেই জন্য রাগাতেও বেশ ভালোই লাগত৷ মুশফিকা এখন চট্টগ্রাম থাকছে৷ স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ আছে৷ জাহিদ আর নাঈমেরও বিয়ে হয়েছে৷ নিজেদের স্ত্রীকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তারা৷ বন্ধুদের মাঝে এতদিন শুধুমাত্র প্রলয়ই সিঙ্গেল ছিল৷ এখন তো সিঙ্গেল তকমাটাও মুছে গেল। বিয়ে করার কথা বলতেই যে ছেলেটা নাক সিটকাত সেই ছেলেটাই হুট করে একদম অচেনা একটা মেয়েটা বিয়ে করে আনল। ব্যাপাটা শুনে ওরাও বেশ অবাক হয়েছিল। তবে ‘জন্ম মৃ’ত্যু বিয়ে’ তিনটাই আল্লাহ নিজে ঠিক করে রাখেন। এতে তো আর মানুষের কোনো হাত নেই। মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য সমস্ত আয়োজন আগে থেকেই করে রাখা হয়েছে। নতুন বর বউ একে অপরের হাত ধরে হেঁটে আসছে স্টেজের কাছে। প্রলয় তখনও তার বন্ধুদের দেখেনি। সে তো বিভোর হয়ে আছে তার ভূমি কন্যাতে৷ মেরুন রঙা লেহেঙ্গায় দারুণ মানিয়েছে তার অঙ্গনাকে। গৌর অঙ্গে ফুটে উঠেছে যেন। বুক ধুকপুক করছে৷ নিগড় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ক্রমশ। এ রূপে তো কখনো দেখেনি। সে মনে করে এরকম জ্বালাময়ী রূপ শুধুমাত্র তার অর্ধাঙ্গিনীরই রয়েছে৷ প্রেয়সীর রূপের আগুনে সে নিজেকে বারবার ঝলসাতেও রাজি। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি কেড়েছে এই ❝প্রলমি❞ জুটি৷

প্রলয়ের বন্ধুরা এবং তাদের পার্টনাররা সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ তাদের হাতে কোল্ড ড্রিংকস। প্রলয় ভূমিকে ওদের কাছেই গেল। ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য৷ বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন পরেই দেখা হচ্ছে তার। এমনিতে কথা হয়। প্রলয়কে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরল জাহিদ৷ তারপর পিঠে চাপড় মে’রে বলল‚

“কী রে মামা বিয়ে করে বন্ধুদের ভুলে গেলি?”

“তোদের ভূলে গেলাম কখন? কাল বিকেলেও না আমাদের কথা হলো?”

প্রলয়ের কথা দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠল জাহিদ৷

ভূমিকে বেশ বিজ্ঞ দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে রয়েছে মুশফিকা সহ বাকি দুজন অর্থাৎ জাহিদ আর নাঈমের স্ত্রীগন৷ অনেকের নজরই এখন ভূমির দিকে। এদিকে মুশফিকাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রলয় বলল‚

“কম দেখ! নজর লাগিয়ে দিবি নাকি?”

“এত সুন্দরী বউ কোথায় পেলি কালাচাঁন?”

“বলব না। তার আগে তুই আমাকে কালাচাঁন বলা বন্ধ কর৷ সেই কলেজ লাইফ থেকে বলে আসছিস। হাঁপিয়ে যাস না?”

“না রে। তোকে কালাচাঁন বললে এনার্জি আরও বাড়ে৷”

“বউয়ের সামনে অন্তত অফ যা। প্রেস্টিজ আর রাখলি না আমার।”

এরই মাঝে রিফাত‚ জাহিদ আর নাঈমও এখানে চলে এসেছে৷ মুশফিকা আর প্রলয়ের কথা মাঝে নাঈম ফোড়ন কে’টে বলল‚

“বউয়ের সামনে আবার প্রেস্টিজ কীসের? যা হবে সব খুল্লাম খুল্লা হবে।”

ভূমি মাথা নিচু করে রেখেছে ভূমি। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে৷ প্রলয় মৃদু ধমকে নাঈমকে বলল‚ “চুপ থাক বেশরম।”

“ওহ! এখন আমরা বেশরম হয়ে গিয়েছি? আপনি ধোয়া তুলসি পাতা!”

ভারী ফর্সা মুখে সহসাই চিন্তার ভাজ৷ আম্মাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা হয় ভূমির। মাধুরী সুযোগ পেলে কটু কথা বলতে ছাড়েন না। তবুও চুপচাপ সব হজম করে নিচ্ছে। এতটা ধৈর্যশক্তি ভূমি তার মায়ের কাছ থেকেই পায়। মায়ের জন্য অতশত চিন্তার মাঝেও মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলেছে ভূমি। আস্তে আস্তে মানুষজন আসতে শুরু করেছে৷ স্টেজে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়েছে তাকে। ক্যামেরাম্যান রাফি নিজেই সকলের সঙ্গে ছবি তুলে দিচ্ছে৷ মেহমানদের খাওয়াদাওয়ার পালা চলছে৷ প্রলয় নিজে দায়িত্ব নিয়েছে কারণ তার অতি গুরুত্বপূর্ণ নিমন্ত্রিত একজন এসেছেন। সেই বিশেষ ব্যক্তি হচ্ছে বিরোধী দলের নাজিম চৌধুরী। ব্যক্তিগত ভাবে লোকটাকে একদমই পছন্দ না। তবুও অনেক হিসেবনিকেশ রয়েছে এই লোকের সঙ্গে। জনগণও তো দেখুক প্রলয় বিরোধী দলের লোকেদেরও আপ্যায়ন করতে পিছুপা হয় না। ভূমির সঙ্গে ছবি তুলবেন বলে ফিরোজা মেহরাব শিকদারকে ধরে নিয়ে এসেছেন। ভূমি আড়চোখে একবার মেহরাব শিকদারকে দেখে নিল৷ কিছুই বলার নেই তার। এত অন্যায় করার পরও লোকটার চোখমুখে অনুতাপসূচক কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। দিব্যি নিজের মতো রয়েছেন। রাফি ওদের তিনজনের ছবি তোলার জন্য উদ্যত হতেই ভূমি বলে উঠল‚

“রাফি ভাইয়া একটু অপেক্ষা করুন।”

“কী হয়েছে ভাবি? কোনো সমস্যা?”

“না ভাইয়া কোনো সমস্যা না। আমি আরও দুজনকে ডেকে আনতে চাই।”

এই বলে স্টেজ থেকে নেমে গেল ভূমি এরপর অর্পণ আর মহুয়াকে জোর করে স্টেজে নিয়ে এলো৷ এরপর হাসি মুখে বলল‚

“আমার অনেক ইচ্ছে আপনাদের সঙ্গে আমার আর আমার আম্মার একটা ছবি থাকবে।”

ভূমি সরল আবদারে ফিরোজা হেসে উঠলেন৷ ভূমিকে মাঝখানে রেখে একপাশে মেহরাব শিকদার আরেকপাশে মহুয়া দাঁড়ালেন। মহুয়ার অন্য পাশে অর্পণ আর মেহরাব শিকদারের পাশে ফিরোজা দাঁড়ালেন৷ রাফি উনাদের পাঁচজনের গ্রুপ ছবি তুলে দিল৷ এবার ভূমিকে মাঝেখানে রেখে একপাশে মেহরাব শিকদার আরেকপাশে অর্পণ দাঁড়াল। ওদের দুপাশে আবার ফিরোজা আর মহুয়া দাঁড়ালেন। এভাবেই অনেকগুলো ছবি তোলা হলো। সুযোগ বুঝে সিঙ্গেল ছবিও তুলিয়ে নিল ভূমি। বিষয়টাকে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি৷ সকলে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছেন। তবে মেহরাব শিকদার ঠিকই বুঝে নিলেন ভূমি সব সত্যিই ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে।

আবহাওয়া শীতল। মৃদুমন্দ সমীরণে বাগানে থাকা গাছের পাতাগুলো দুলে উঠছে। তারাও যেন পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে৷ মেহমানদের খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ৷ সকলেই খেয়ে নিয়েছে। রিসেপশনের আয়োজন তো সবে শুরু হয়েছে। সকলের দৃষ্টি এখন ❝প্রলমি❞ জুটির দিকে আটকে রয়েছে৷ হঠাৎ ভূমির সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে প্রলয়। শেরওয়ানির পকেট থেকে ছোটো একটা বক্স বের করল। এরপর ভূমির দিকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলতে শুরু করল‚

“আমার জন্য ভালোবাসা হচ্ছে একটা পদক্ষেপ‚ জীবনকে দ্বিতীয় ধাপে এগিয়ে নেওয়ার। তুমি কী আমার সঙ্গে জীবনের প্রত্যেকটা ধাপ অতিক্রম করবে নির্মলা ভূমি কন্যা?”

ছোটো একটা বক্তৃতা দিয়ে প্রলয় নিজের কথা শেষ করতেই জাহিদ আর নাঈম শিস বাজাতে শুরু করল। প্রলয়ের গম্ভীর কণ্ঠে আজ শঙ্কা‚ আসক্তি‚ মন্ত্রমুগ্ধতা সবকিছুই মেশানো ছিল। কথাগুলো বলতে গিয়েও সময় নিয়েছে অনেকটা। উপস্থিত সকলে একসঙ্গে “স্যে ইয়েস!” বলছে৷ ভূমি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে নজর বুলাল। মহুয়া দাঁড়িয়ে রয়েছেন নাজমার সঙ্গে৷ মায়ের উচ্ছ্বসিত হাসি মুখটা দেখে ভালো লাগল তার৷ ভূমি তার বাঁ হাতটা প্রলয়ের দিকে এগিয়ে দিল৷ অনামিকায় ছোটো ছোটো পাথরের সোনার আংটি পড়িয়ে দিল প্রলয়৷ ফর্সা হাতে জ্বলজ্বল করছে আংটিটা৷ লাইটের আলোতে চিকচিক করে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।

মিউজিক বক্সে “পারাম সুন্দারী” গানটা বাজছে৷ ইরা‚ লামিয়া‚ পূর্ণতা আর পুষ্পিতা সমান তালে নাচছে৷ রাতে একটুখানি রিহার্সাল করেছিল ইরা আর লামিয়ার সঙ্গে। অডিয়েন্সরা একটু পরপর শিস বাজিয়ে উঠছে৷ এই গানটা তাদের প্ল্যানের বাহিরেই ছিল৷ যেহেতু পূর্ণতা পুষ্পিতা উপস্থিত ছিল না৷ শেষ সময়ে এসে গানটাকে যোগ করা হয়েছে৷ অল্প সময়েই যতটুকু পেরেছে রিহার্সাল করেছে ওরা৷ তিন মিনিটের গানটা শেষ হতেই সবাই করতালি দিতে শুরু করল৷ এরপর ছেলেদের অর্থাৎ অর্পণ‚ আরশ‚ রাফি আর লামের পারফরম্যান্সের পালা৷ মেয়েরা সরে গিয়ে ছেলেদের নাচের জন্য জায়গা করে দিল। গান বাজতে শুরু করল। “জামাল কুদু” গান বাজছে৷ গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকে হাত তালি দিচ্ছে৷ এদিকে ছেলেদের নাচ দেখে হাসছে মেয়েরা। এরা মূলত একটা বাজি ধরেছিল। অডিয়েন্স থেকে ভোট নেওয়া হবে। কোন দল বেশি সুন্দর নাচতে পারে৷ তারউপর আবার কাপল ডান্সও রয়েছে। দুই মিনিটের গানটা শেষ হতেই সকলে করতালি দিল৷ এই রাউন্ডে মেয়েরা এগিয়ে গিয়েছে৷ এবার কাপল ডান্স দিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড উদ্ভোদন হবে। আর উদ্ভোদন হবে ❝প্রলমি❞ জুটির মিষ্টি একটা কাপল ডান্স দিয়ে। সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাগানে শুধুমাত্র মরিচ বাতি গুলো জ্বলছে। স্টেজের সামনে খালি জায়গাটায় প্রলয় আর ভূমি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ সকলের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য দুজনের উপর আলো এসে আছড়ে পড়ল। প্রলয় ভূমির দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷ ইশারায় হাতটা ধরতে বলছে বারবার। মনে সাহস সঞ্চার করে ভূমি তার কম্পিত হাত খানা প্রলয়ের হাতের দিকে বাড়িয়ে দিল। অতি সাবধানে ভূমির সঙ্গে পায়ে পা মেলাচ্ছে প্রলয়। রাতে যতটুকু শিখেছিল তাতে দুজনে বেশ ভালো নাচছে৷ এত মানুষের সামনে নাচতে গিয়ে বারবার লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে ভূমি।

হতে পারে রূপকথার এক দেশে‚ রাতের এ আকাশে এক ফালি চাঁদ;
তোমার আমার চিরকাল..
তুমি আমি হাতে রেখে হাত‚ ছুয়ে দিয়ে আঙুলে আঙুল;
দেখতে পারো কিছু আদুরে সকাল..
হতে পারে এ পথের শুরু‚ নিয়ে যাবে আমাদের অজানায়;
তুমি আমি আমাদের পৃথিবী‚ সাজিয়ে নিব ভালোবাসায়;
ভালোবাসি বলে দাও আমায়‚ বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল!
তুমি শুধু আমারই হবে‚ যদি কর মিষ্টি এ ভুল;
হাতে হাত রাখতে পারো‚ সন্ধি আঙুলে আঙুল;
ভালোবাসা বাড়াতে আরও হৃদয় ভীষণ ব্যাকুল!

করতালিতে মেতে উঠল আজকের আয়োজন। সকলের মাঝেই ভীষণ উল্লাস। জাহিদ আর নাঈম শিস বাজিয়ে ‘ফাটিয়ে দিয়েছিস মামা’ চেঁচিয়ে বলছে বিধায় এত কোলাহলের মাঝেও প্রলয় তা আবছা শুনতে পেল। প্রলয় আর ভূমি সেখান থেকে সরে গেল। এবার অর্পণ আর ইরার নাচ৷ মিউজিক বক্সে “তুমি আমার অনেক শখের” গানটার টোন বাজতে শুরু করেছে৷ বাকিরা অর্থাৎ আরশ‚ রাফি‚ লাম‚ লামিয়া‚ পূর্ণতা আর পুষ্পিতা উৎসাহ দিচ্ছে৷ ইরা নিজে থেকেই অর্পণের হাতটা ধরল৷ পায়ে পা মেলাতে শুরু করল দুজনে।

কেউ তোমাকে ভীষণ ভালোবাসুক‚
তুমি আর শুধু তুমি ছাড়া‚ অন্য কিছু না বুঝুক;
কেউ তোমার কোলে মাথা রেখে ভীষণ হাসুক;
তুমি একটু দূরে গেলে‚ লুকিয়ে আনমনে ভীষণ কাঁদুক;
তুমি তো চেয়েছিলে ঠিক এমনই একজন‚
দেখ না আমি পুরোটাই তোমার ইচ্ছে মতন;
তুমি আমার অনেক শখের খুঁজে পাওয়া এক প্রজাপতি নীল‚
আমি রংধনু রঙে সাজিয়েছি দেখ একাকাশে স্বপ্নীল!

নাচ শেষ হতেই আবারও করতালি দিতে শুরু করল সকলে৷ এবার পালা আরশ‚ রাফি‚ পূর্ণতা‚ পুষ্পিতা‚ লাম এবং লামিয়া৷ ওরা ছয়জন গ্রুপ হয়ে নাচবে৷ ওদের নাচের পর “আভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হ্যে” এই গানে সবাই একসঙ্গে নাচবে। এদিকে প্রলয় ভূমিকে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসাল। ভারী লেহেঙ্গা‚ গহনা আর মেকআপে নিজেকে আরও বেশি ভারী মনে হচ্ছে ভূমির। তবে সব সহ্য করে নিচ্ছে। এমন দিন তো আর ফিরে আসবে না৷ প্রলয় নিজে পছন্দ করে এই লেহেঙ্গাটা কিনেছিল সেদিন। সঙ্গে ম্যাচিং করে নিজের জন্য শেরওয়ানি। এতসব বেহায়াপনা আদিখ্যেতা সহ্য হলো না মাধুরীর। তবুও তিনি হজম করে নিচ্ছেন সব। এত মানুষের মাঝে আজ আর নতুন করে সিনক্রিয়েট করলেন না মাধুরী। বাড়ির সম্মান নিয়ে তিনি বেশ কঠোর। উপস্থিত সকলকে উপস্থিত রেখে প্রলয় ভূমির সামাজিক বিয়েটা সেরে ফেলা হবে আজ৷

রাত সাড়ে বারোটা…

রিসেপশন পার্টি শেষ হয়েছে ঘণ্টা খানে সময় আগে৷ প্রলয় আর ভূমি কাউকেই ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না কাজিনমহলের কেউ। নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে ঘরটা সুন্দর করে সাজিয়েছিল৷ লেহেঙ্গা পাল্টে ভূমিকে জরজেটে লাল রঙা একটা শাড়ি পড়িয়েছে ইরা৷ লাল গোলাপ দিয়ে ভূমিকে ফুল কন্যা সাজিয়েছে৷ হালকা করে সাজিয়ে ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক লাগিয়েছে ইরা৷ মনে মনে ভাবছে প্রলয় আজ ভূমিকে দেখে চোখই ফেরাতে পারবে না৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল থেকে তাদের পরীক্ষা শুরু। মাধুরী কঠোর ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার জন্য৷ ভূমিকে ঘরে দিয়ে আসা হলো। কিন্তু প্রলয়কে কিছুতেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো না৷ কাজিনমহলের দাবি দশহাজার টাকা ছাড়া প্রলয়কে কিছুতেই ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না৷ বেশি তর্কাতর্কি করতে হয়নি। প্রলয় সঙ্গে সঙ্গেই টাকা পরিশোধ করে দিয়েছে ওদের৷ টাকা পেয়ে সব পালিয়েছে এখান থেকে৷

প্রলয় ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। বিছানার উপর বসে রয়েছে ভূমি। ঘরে ক্যান্ডেল লাইট জ্বালিয়ে রাখা৷ হরিদ্রাভ আলোয় নির্মলাকে ভীষণই অভিলাষিণী লাগছে। আজ কী করে প্রলয় নিজেকে সামলাবে? নিজেকে সামলে রাখা যে প্রতিনিয়ত দায় হয়ে পড়ছে৷ ভেতরে অনুভূতির তীব্র দহন। অর্ধাঙ্গিনীকে কাছে পাওয়ার তাড়নায় ব্যাকুল পূর্ণবয়স্ক শ্যাম পুরুষ। প্রেমোন্মত্ততায় জর্জরিত উষ্মা দেহ। পকেট থেকে একটা খাম ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে ভূমির খুবই সমীপে এগিয়ে গেল প্রলয়। মৃদু স্বরে সালাম জানাল ভূমি। সালামের উত্তর দিয়ে ভূমির হাত দুখানা ধরল প্রলয়৷ হাত দুটো ঘেমে একাকার অবস্থা। পুরুষ মানুষ হয়েও ঘাবড়াচ্ছে কিছুটা। লজ্জা জেঁকে ধরেছে সেই শ্যাম পুরুষকে। ভূমি উপলব্ধি করল মৃদু কম্পন। লাজে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। কী করে সামলাবে সবটা? ভীষণ ভয় করছে তার। প্রলয়ের সামনে থাকতেও লজ্জা লাগছে ভীষণ। এদিকে প্রলয় নিজের অনুভূতিগুলোকে সহ্য করতে না পেরে ভূমির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল‚

“জান আর সহ্য হচ্ছে না৷ প্লিজ! অনুভূতির তীব্র জোয়ারে প্রাপ্তবয়স্ক হৃদয় প্রেয়সীকে কাছে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ছে৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনা বড্ড দায় হয়ে যাচ্ছে৷ নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে৷ মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়ছে। আমার এই অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দেবে ভূমি কন্যা?”

পিলে চমকে উঠল ভূমির৷ এ কেমন অন্যায় আবদারের কথা বলছে প্রলয়? লজ্জা আর দোটানায় মূর্ছা যাচ্ছে ভূমি। রাত হয়েছে। সকলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে শুয়ে পড়েছে৷ সে পালাবেই বা কোথায়? প্রলয়ের কাছ থেকে পালানোর সাধ্যি আছে নাকি? কদাপি নহে! প্রলয়ের আকুতিভরা কণ্ঠস্বর এড়াতে পারল না সে। প্রলয়ের হাতখানা আঁকড়ে ধরল সে। নীরবতায় উত্তর পেয়ে গেল প্রলয়। সিক্ত অধরোষ্ঠ জোড়ার আলিঙ্গন ঘটল। অর্ধাঙ্গের বিচলিত কামনীয় স্পর্শে ব্যাকুল অঙ্গনা নিজেকে সামলে রাখতে পারল না৷ পুরুষালি রুক্ষ হাতে স্পর্শ সর্বাঙ্গ জুড়ে বিচরণ করতে শুরু করল৷ স্পর্শ গুলো একটু একটু করে রুক্ষ হতে শুরু করল। আদুরে ব্যথার গোঙ্গাতে শুরু করল অঙ্গনা। প্রলয়ঙ্কারী বিচরণ সহ্য করতে পারছে না কিছুতেই। আবেশে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল৷ প্রলয় নেশালো কণ্ঠে বলে উঠল‚

“তুমি যে এতটা কোমল জানা ছিল না।”

লোকটার মুখে কিছুই আটকায় না। লজ্জায় দুহাত দ্বারা মুখ লুকাল ভূমি। মুখ থেকে হাত সরাল প্রলয়। গ্রীবায় প্রেমময় স্পর্শ ছুঁইয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। চিনচিনে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে এলো ভূমির। প্রলয় কিছুটা ঝুঁকে ব্লাউজের হুক খোলায় মনোনিবেশ করল। আবছা আঁধারে প্রলয়কে দেখে বুকটা ধক করে উঠল ভূমি। লোকটা উন্মাদ হয়ে উঠেছে। সমস্ত লাজ উঁকি দিল ভূমির গৌর কপোল জুড়ে। লাল টমেটো হয়ে গিয়েছে। আফসোস ঘরটা আঁধারিয়ায় আচ্ছন্ন। তা না হলে প্রলয় হয়তো গৌর কপোলে আরেক দফা অধর ছুঁইয়ে দিত। প্রলয় একবার মুখ তুলে ভূমিকে দেখে নিল। অধর কোণে হাসির রেখা প্রসারিত করে বলল‚

“লজ্জা পেলে তোমাকে বেশ লাগে ভূমি কন্যা। একটু সহ্য করে নিয়ো সবটা!”

কথাটা বলেই ভূমিকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিল। আবারও ভূমির অধরোষ্ঠে নিজের অধরোষ্ঠ মেলাল। সুখস্পর্শে দুচোখ মুদে এলো ভূমির৷ সারা শরীর জুড়ে অনুভূতির তীব্র বিচরণ। উন্মুক্ত দুটি দেহ মেতে উঠল অনুভূতির সুমধুর লীলায়। ব্যাকুল রজনি কিছু সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল।

সকল গ্লানি কাটিয়ে একটি সুন্দর সকাল উদয় হয়েছে ধরিত্রীর বুকে। সকাল থেকেই মালঞ্চ নীড়ে কোলাহল লেগে রয়েছে। বাড়িতে তো কম মানুষ নেই। প্রায় পঁচিশ জনের মতো সদস্য রয়েছেন। রান্নাঘরে নাস্তার বন্দোবস্ত করছেন ফিরোজা‚ ফাহমিদা আর রাবিয়া। সাবিনা কে ঘর পরিষ্কার করানোর কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন ফিরোজা। এদিকে আজ শাহাদাৎ মোড়ল উনার পরিবার নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবেন। মহুয়াও তাদের সঙ্গে গ্রামে ফিরে যাবেন। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে তো একাধারে বেশিদিন থাকা যায় না। মোর্শেদ শিকদার অনেকবার বারণ করেছেন শাহাদাৎ মোড়লকে। কুটুম মানুষ দিন দুয়েক তো থাকাই যায়। কিন্তু শাহাদাৎ মোড়ল রাজি হলেন না। খালি বাড়ি রেখে এসেছেন৷ তারউপর গ্রামে ব্রিজ বানানোর কাজ চলছে৷ অনেক দায়িত্ব উনার কাঁধে। আরশও তার বাবা মায়ের সঙ্গে গ্রামে ফিরে যাবে। ইরাও তার হোস্টেলে ফিরে যাবে। বাকি মেহমানরাও আজ ফিরে যাবে। সবাই নিজেদের কাজ থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন। তার ওপর লাম লামিয়ার পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে এই মাসেই। রাফির ডিউটি কাল থেকে শুরু তাই তাদেরও আজ ফিরে যেতে হবে। তবে গুলবাহার হয়তো কিছুদিন মেয়ের কাছেই থাকবেন। যাওয়ার ব্যাপারে তিনি এখনো কিছু বলেননি। তিনি ফজরের আযান পড়ার আগেই ঘুম থেকে ওঠেন। বৈঠকখানা অথবা রান্নাঘরে নতুন বউকে দেখতে না পেয়ে গুলবাহার বললেন‚

“তা তোর ছেলের বউ কোথায়—এখনো পড়ে পড়ে ঘুমচ্ছে? বেলা তো কম হলো না!”

কিছুটা বিরক্তি নিয়ে মাধুরী বললেন‚ “আমি কিছু জানিনা। সব কী আর আমার হাতে আছে নাকি?”

“এখনো সময় আছে লাগাম টেনে ধর।”

প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না মাধুরী। মোর্শেদ শিকদার‚ মেহরাব শিকদার‚ অর্পণ নিজেদের কাজে বের হবে নাস্তা করেই। মাধুরী উঠে গেলেন কারণ মোর্শেদ শিকদারকে উনার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে হাতে হাতে এগিয়ে দিতে হয়। তিনি নিজেদের ঘরে চলে গেলেন। অন্যদিকে বাকিরা নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়বেন উনারা। এইজন্য রান্নার দিকটা ফিরোজা নিজেই সামলাচ্ছেন৷ এই নিয়েও আরেক ঝামেলা। সবটা কেন উনাকে একা করতে হবে? বাড়ির বউ কেন পড়ে পড়ে ঘুমচ্ছে?

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৫|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

পড়নের সেই লাল জরজেট শাড়িটা বিছানার এক কোণায় পড়ে৷ বিছানা আর মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ জানালা দুয়ার হুট করে খোলা। তবে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা৷ সফেদ পর্দা গুলো বাতাসের তালে তাল মিলিয়ে উড়ছে৷ বালিশের উপর কনুইয়ে ভর করে এপাশ ফিরে ঘুমন্ত ভূমি কন্যাকে দেখে যাচ্ছে প্রলয়। নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে মেয়েটা৷ পাতলা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে রাখা। গ্রীবার দুটো জায়গায় লালচে আদুরে দাগ। চুলগুলো এলোমেলো। খোলা চুল বিছানার অপাশের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ভূমির কপালের উপর থাকা একগুচ্ছ চুল ডান হাত দ্বারা ঠিক করে দিল প্রলয়৷ আঁখিপল্লব কিছুটা কেঁপে উঠল ভূমির। ঘুম হালকা হয়ে আসছে৷ গ্রীবায় থাকা লালচে দাগটায় আলতো হাত ছোঁয়াল৷ চোখ বন্ধ রেখেই আড়মোড়া ভাঙল মেয়েটা। পাশে প্রলয়কে এভাবে আস’ক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। শরীরের উপর থেকে চাদরটা খসে পড়ল৷ একবার গভীর ভাবে তাকিয়ে দেখল প্রলয়। ভূমিকে এভাবে দেখে নেশ ধরে যাচ্ছে তার৷ ফর্সা উন্মুক্ত পেট দৃশ্যমান। প্রলয় নিজেকে সামলে বলল‚

“এ রূপেও তোমাকে দারুণ লাগছে।”

ভূমি এবার নিজের দিকে তাকাল। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল মুহূর্তেই। চুল দ্বারা নিজেকে ঢেকে নিল সে৷ শুধুমাত্র পেটিকোট আর ব্লাউজ পড়ে রয়েছে। প্রলয় একদৃষ্টে চেয়ে ছিল৷ বিছানার কোণে পড়ে থাকা শাড়িটা কোনো মতো শরীরে পেঁচিয়ে বিছানা ছাড়তে নিলে‚ শরীরে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভূত হলো। কিছু ব্যথা আদুরেও হয়। ত্রস্ত হস্তে হাত খোপা করে ফেলল ভূমি৷ যার দরুন গ্রীবায় লালচে দাগ ভেসে উঠল। গৌরবর্ণে জ্বলজ্বল করছে। ভূমির হাতটা ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল প্রলয়৷ শরীরের সেই চিনচিনে ব্যথায় “আহ্!” বলে আর্তনাদ করে উঠল৷ ভূমির উপর কিছুটা ঝুঁকে বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল‚

“লেগেছে?”

দুটো দৃষ্টি বিনিময় হলো৷ সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ভূমি৷ প্রলয়ের চোখের দিকে সে কখনোই তাকিয়ে থাকতে পারে না। ঘোর লেগে যায়৷ আকর্ষণ অনুভূত হয়৷ লজ্জা করছে ভীষণ। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই মূর্ছা যাচ্ছে ভূমি। শরীরের উপর জড়িয়ে রাখা শাড়ি আর চাদরটুকু খিঁচে ধরে রেখেছে। অর্ধাঙ্গিনীর লজ্জা মিশ্রিত হাসি দেখে প্রলয় ফিসফিসিয়ে বলল‚

“আমাদের মাঝে যতটুকু দূরত্ব ছিল সেটা কাল রাতেই ঘুচিয়ে দিয়েছি। আর কোনো লজ্জা নয়। এখন থেকে তুমি আমার আমি তোমার।”

ঘাড় বাঁকিয়ে ভূমি একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল সাড়ে আটটা বাজতে চলল। তার মানে বেলা অনেক হয়েছে। মাথা আর শরীর ঝিমঝিম করছে। চিনচিনে ব্যথা সর্বাঙ্গ জুড়ে। রাতে ঘুম হয়নি ঠিক করে। প্রলয় তাকে ঘুমতে দেয়নি। অলসতা কাবু করছে ক্রমশ৷ শুধু শুয়ে থাকতেই ইচ্ছে করছে৷ উঠে গোসল যে করবে সেই ইচ্ছাটুকু অবশিষ্ট নেই। নিচে যাবে তো দূরের কথা। চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে রয়েছে। এবার অন্তত সমস্ত অলসতাকে দূর করতে হবে৷ প্রলয়ের বুকে হাত রেখে সরানোর চেষ্টা করল ভূমি৷ কিন্তু পুরুষালি শক্তির সাথে কী আর তার শক্তি চলবে? ভূমিকে হারিয়ে দিতে প্রলয় নিজের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল৷ গৌর কপোলে শব্দ করে অধর ছোঁয়াল। তার এহেন কাজে বোকা বনে গেল ভূমি৷ প্রলয় এবার নিজে থেকেই সরে গেল৷ ছাড়া পেয়েই বিছানা ছাড়ল ভূমি। ওয়ারড্রব থেকে নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ছুটে গেল।

অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করে বের হয়েছে ভূমি। ঝটপট তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছে হাত খোপা করে নিল৷ মাথায় বড়ো করে ওড়না পেঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে৷ তার ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রলয় গোসল করতে ঢুকেছিল। সে সুযোগ বিছানা আর ঘর ঝাড়ু দিয়ে এসেছে। যা বেহাল দশা ছিল ঘরটার। যে কেউ দেখলেই মজা উড়াত। ভাগ্যিস কেউ ডাকতে আসেনি। বৈঠকখানার কাছে আসতেই সেখানে গুলবাহারকে দেখতে পেল ভূমি৷ সে গিয়ে উনাকে সালাম জানাল। সালাম গ্রহন করলেন গুলবাহার। জিজ্ঞেস করলেন‚

“কী গো নাতি বউ এখন বুঝি সময় হলো ঘুম থেকে ওঠার?”

মাথা নিচু করে নিল ভূমি৷ সত্যিই আজ দেরি হয়ে গিয়েছে৷ এমনটা তো কখনো হয়নি। শরীর ক্লান্ত থাকায় মূলত ঘুমটা গাঢ় ছিল৷ কিন্তু এমপি মশাই তো জেগে ছিলেন তাহলে কেন ডেকে দিলেন না? ইতিমধ্যেই সকলে নাস্তা করে নিয়েছে৷ শুধু বাকি রয়েছে পূর্ণতা পুষ্পিতা‚ প্রলয় আর সে৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একদম তৈরি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দুবোন পড়তে বসেছিল৷ ভূমি ওদের চার জনের জন্য নাস্তা বেড়ে রাখল। এরই মাঝে স্কুল ড্রেস পড়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে চলে এসেছে পূর্ণতা পুষ্পিতা। ভূমি ওদের দুজনকে আগে খেতে দিয়ে দিল৷ ওরা খেতে শুরুও করে দিল৷ তা না হলে পরে দেরিও হয়ে যেতে পারে৷ প্রলয় ওদের দুজনকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে যাবে। ভূমির ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। আপাতত আর কোনো কাজ নেই নেই। কিছুক্ষণ পর হয়তো প্রলয় বের হবে৷ ঘরে এসে দেখল এরই মাঝে প্রলয় তৈরি হয়ে নিয়েছে। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট৷ শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখা। আঁটসাঁট দীর্ঘ দেহে শার্টটা দারুণ মানিয়েছে। দরজার সামনে পা দুটো থমকে গেল৷ ভূমি একদৃষ্টে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। আয়নায় প্রলয় ঠিকই ভূমির প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করল। হাত দ্বারা নিজেকে আড়াল করে প্রলয় বলল‚

“আইলা বউ! চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছ? কী লজ্জা— কী লজ্জা!”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভূমি। দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো না৷ তাই সে গিয়ে বিছানায় বসল৷ হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে প্রলয় তার সামনে এসে দাঁড়াল। কিছুটা ঝুঁকে ভূমির গালে শীতল হাতের স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল‚

“শরীর খারাপ লাগছে?”

মাথা দু দিকে ঝাকিয়ে ভূমি বলল‚ “উহু!”

বিছানার পাশের ড্রয়ার থেকে একটা একটা ঔষধের প্যাকেট ভূমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল‚

“এই পিলটা খেয়ে নিয়ো। আমার দেরি হচ্ছে একটু বের হতে হবে৷ তারউপর পূর্ণ পুষ্পকে স্কুলে দিয়ে আসতে হবে।”

ভূমি জিজ্ঞেস করল‚ “এটা কীসের ঔষধ?”

“তোমাকে এত জানতে হবে না। তুমি মনে করে খেয়ে নিয়ো। আমি আসছি।”

ভূমির কপালে অধর ছুঁইয়ে প্রলয় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল বিশ্রাম নিতে৷ ভেজা চুলগুলো বিছানাতেই মেলে দিল ভূমি। মাথার উপর ফ্যান খটখট শব্দ করে ঘুরছে৷ এতে করে চুলগুলো তাড়াতাড়ি শুকিয়েও যাবে তাই আর এসি চালাল না এখন। এরই মাঝে ইরা এলো৷ যাওয়ার জন্য সে একদম তৈরি। শুধুমাত্র ভূমির থেকে বিদায় নিতে এসেছে৷ ভূমি সেই ঔষধের প্যাকেটটাকে বের করে ইরার হাতে দিল৷ ছোটো ছোটো সাদা আর লাল ট্যাবলেট রয়েছে ভেতরে৷ ভূমি জিজ্ঞেস করল‚

“এটা কীসের ঔষধ আপু?”

ইরা আড়চোখে তাকাল৷ ভূমি কিছুটা হেসে বলল‚ “ভূলে গিয়েছিলাম। এটা কীসের ঔষধ ইরা?”

ভূমির হাত থেকে প্যাকেটটা নিল ইরা৷ এরপর ভূমিকে বলল‚ “এগুলো তো জন্ম নিরোধক পিল। সাদাগুলো জন্ম নিরোধক আর লালগুলো আয়রন ট্যাবলেট যা পিরিয়ডের সময় খায়।”

“এই ঔষধ না খেলে কিছু হবে?”

“হ্যাঁ হবে তো!”

বোকা স্বরে ভূমি বলল‚ “কী?”

“বেবি হবে মানে বাচ্চা।”

ভূমি মনে মনে ভাবল ঔষধটা খাবে না। প্রলয় যখন যখন খেতে বলবে তখন ফেলে দেবে৷ একবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলে আর রাগ করে থাকতে পারবে না৷ প্যাকেটটা সেভাবেই বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে দিল ভূমি। ইরা তার কাছে থেকে বিদায় নিতে এসেছিল৷ কিছুক্ষণ পর হয়তো হোস্টেলে চলে যাবে। অর্পণ তাকে পৌঁছে দিয়ে হসপিটালে যাবে৷ মেহরাব শিকদার আগেই বেরিয়ে পড়েছিলেন। শাহাদাৎ মোড়লও নিজের পরিবার নিয়ে কিছুক্ষণ পর রওনা হবে৷ এরই মাঝে মহুয়া এলেন ভূমির ঘরে। আম্মাকে দেখা মাত্রই ভূমি সেই ঔষধের প্যাকেটটাকে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল৷ ইরা চলে গেল৷ মা মেয়েকে একাকী কথা বলার সুযোগ করে দিল। ভূমির মন খারাপ হলো। আজ তার আম্মা চলে যাবে। আবার না জানি কবে দেখা হয় আম্মার সঙ্গে। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। আম্মাকে কাছে পেয়ে কতটা খুশি ছিল সে। নেত্র যুগল অশ্রুপ্লুত হয়ে ঝাপসা হলো। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুকণা গড়িয়েও পড়ল। মহুয়া মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন। ক্রন্দনরত কণ্ঠে ভূমি বলল‚

“এখানে দুদিন থেকে গেলে হত না আম্মা? মাত্র দুটো দিন তোমাকে কাছে পেলাম। এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যাচ্ছ আম্মা?”

“মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যে বেশিদিন থাকতে হয় না রে মা।”

“এটা তো তোমারও শ্বশুর বাড়ি।”

“চুপ! এই কথা আজ বলেছিস‚ আর কোনোদিন যেন এই কথা তোর মুখ দিয়ে না বের হয়।”

চেঁচিয়ে উঠলেন মহুয়া। কেঁপে উঠল ভূমি৷ তার আম্মা ভীষণ রেগে গিয়েছেন সে বেশ বুঝতে পারল তা। ভূমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে নেবে তার আগেই মহুয়া ভূমিকে এমন কিছু কথা বললেন‚ যেগুলো না জানালেই নয়। কিছু সত্যি এখনই বলে রাখা প্রয়োজন। ভূমি মোটেও ঘাবড়াল না৷ এই লোকের থেকে এমনটাই আশা করা যায়। যে নিজের অনাগত সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চায়। তার থেকে বড়ো অন্যায় এ পৃথিবীতে আর একটা হয় না। যাওয়ার আগে মহুয়া একটা কথা বলে গেলেন‚

“সম্পর্ক হলো মুঠোয় ধরে রাখা জলের মতো। ঠিকই ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইবে। কিন্তু তোদের হতে হবে কড়ঙ্গাকৃতির।”

একটু থামলেন তারপর ভূমির গালে স্নেহময় হাত রেখে; কান্না সংবরণ করে বললেন‚ “ভালো থাকিস মা। সুখী হ।”

নিমজ্জিত দুপুর। রোদের ছিটেফোঁটা নেই৷ এক কথায় একটি বিরস দিবস। সকালে বাড়ির সব মেহমানরাই চলে গিয়েছেন৷ মহুয়াও গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। মায়ের জন্য মন খারাপ ছিল ভূমির। ঘর থেকে আর বের হওয়া হয়নি। ঘণ্টা দুয়েক সময় ঘুমিয়েই পাড় হয়েছে৷ শরীরটা এখন কিছুটা ভালো লাগছে। খুবই চনমনে লাগছে। কাল বাড়ি ভরতি মানুষ ছিল আর এখন বাড়িতে শুধুমাত্র গুলবাহার‚ মাধুরী‚ ফিরোজা‚ সাবিনা আর সে। বাকিরা নিজেদের কাজে। পূর্ণতা পুষ্পিতার পরীক্ষা সকাল দশটা থেকে শুরু হয়েছে৷ এখন সাড়ে বারোটা বাজে৷ পরীক্ষা শেষ হবে দুপুর একটায়৷ কিছুক্ষণ পরই যোহরের আযান পড়ে যাবে৷ বিছানার চাদর সকালেই পাল্টে ফেলা হয়েছিল৷ ওয়াশরুম থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে এলো ভূমি। তারপর ঘরটা মুছে নিল৷ ঘরের জানালাগুলো খুলে দেওয়া। সাঁই বেগে দখিনা বাতাস ঘরের ভেতরে আছড়ে পড়ছে। খটখট করে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। মেঝে তাড়াতাড়িই শুকিয়ে যাবে। ঝড়ের গতিতে বিনে থাকা আধোয়া কাপড়গুলো ধুয়ে বারান্দায় মেলেও দিল৷ কাজগুলো তাড়াহুড়ো করেই করতে লাগল সে। অদূরেই আযানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে এলো। নামায আদায় করেই ঘর থেকে বের হবে। ফিরোজা হয়তো একা হাতে রান্নার কাজ করছেন। ধীরে সুস্থে নামাজ আদায় করে ঘর থেকে বের হলো ভূমি। যাওয়ার আগে ঘরের দরজা ভালো করে চাপিয়ে দিয়ে গেল। শশব্যস্তভাবে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। রান্নাঘরে শুধু সাবিনা কাজ করছে। বৈঠকখানায় কেউ নেই। হয়তো রান্নার ভার সাবিনা উপর দিয়ে বাকিরা নিজের ঘরে রয়েছেন। ভূমি ঝটপট রান্নাঘরেই গেল। তরকারি বসানো হয়েছে। শুধু ভাত‚ ডাল আর ডিম সেদ্ধ হয়েছে। এখনো দুটো রান্না বাকি রয়েছে। সবজি দিয়ে রুই মাছ আর টমেটো দিয়ে শিং মাছের ঝোল রান্না হবে। একটি চুলোয় রুই মাছের তরকারি ইতিমধ্যেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেক চুলোয় দুধ গরম বসানো হয়েছে। সাবিনা ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছে। দুটো ডিম দেখে ভূমি জিজ্ঞেস করল‚

“দুটো ডিম দিয়ে কী হবে?”

“এই দুইডা তো পূর্ণ পুষ্প আফার লাইগা। খালা বারবার কইয়া দিছে যাতে হেরা আইলেই দুধ আর ডিমখানা দুই বইনেরে দিয়া দেই।”

“হ্যাঁ‚ আমি খেয়াল করেছি সকালে পূর্ণ পুষ্প কেউই ডিম খেয়ে যায়নি। শুধু দুটো করে পরোটা আর গোশত খেয়েছিল। অথচ সবার জন্যই ডিম সেদ্ধ করা ছিল। আমি শুনেছি পরীক্ষা সময় নাকি পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। তাতে পড়া মনে থাকে।”

“কিন্তু ভাবি হেরা ডরায়।”

অবাক হলো ভূমি। ডিম খাওয়া নিয়ে আবার কীসের ভয় পাওয়া? ডিম তো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এমনিতে তো ওরা প্রতিদিনই সকালে ডিম আর দুধ খেয়ে নেয়। তাহলে আজ কী হলো? ভূমি সাবিনাকে জিজ্ঞেস করল‚

“ভয় পায় কেন?”

“পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে‚ ডিম খাইয়া গেলে নাকি পরীক্ষায় আন্ডা পাইব! এই নিয়া তো ছুডু ভাইজান ম্যালা ক্ষ্যাপায় হ্যাগো দুই বইনেরে।”

সাবিনার কথা শুনে হেসে দিল ভূমি। সঙ্গে করে সাবিনাও হাসছে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে৷ একটা বাটিতে শিং মাছ ভিজিয়ে রাখা হয়েছে। আলু সেদ্ধ‚ পেঁয়াজ‚ কাঁচামরিচ‚ টমেটো আর ধনিয়াপাতা কেটে রাখা রয়েছে। ভূমি ত্রস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল‚

“আপু তুমি বাকি কাজগুলো করে নাও আমি শিং মাছের ঝোলটা রান্না করছি।”

সাবিনা বলল‚ “আমি করতে পারমু। আপনি ঘরে যাইয়া আরাম করেন। সকালে বড়ো ভাইজান কইয়া গেছিল‚ আপনেরে যাতে কাজ করতে না দেই।”

“আমি তো অসুস্থ নই। আমি করতে পারব। তাছাড়া আমি চাইনা এই নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক।”

ভূমির কথার ইঙ্গিত বুঝল সাবিনা। ক্ষীণ স্বরে বলল‚ “তাইলে ভাবি আপনার সামনে দাঁড়ায় থাকেন আমি কাম করতাছি।”

“তুমিও তো সেই সকাল থেকেই কাজ করছ।”

“আমার অভ্যাস হইয়া গেছে।”

“আর কোনো কথা না আপু। তুমি দাঁড়িয়ে থাক‚ আমি রান্না করছি৷”

শিং মাছ হতে বরফ ছুটে গিয়েছে। ময়লা পানিটুকু ফেলে দিল ভূমি৷ দুধ গরম হয়ে গিয়েছে৷ চুলো থেকে নামিয়ে রাখল সাবিনা৷ পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তাকে আর কিছু করতে দেয়নি ভূমি। সে সবগুলো উপকরণ দিয়ে মাছগুলোকে ভালোভাবে কষিয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে ঢেকে দিল। চুলোর আঁচ প্রথমে বাড়িয়ে দিয়ে মিনিট পাঁচেকের জন্য ঢেকে দিল। এরপর তরকারি বলক উঠতেই চুলার আঁচ আবারো মাঝারি আঁচে করে দিল। সবটাই দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল সাবিনা৷ সে জিজ্ঞেস করল‚

“ভাবি আমি তাইলে লেবু কাইট্টা রাখমু?”

আঁখিপল্লব ঝাপ্টে সায় জানাল ভূমি। ফ্রিজ থেকে দুটো লেবু বের করে ভালোমতো ধুয়ে কে’টে রাখল সাবিনা। সদর দরজার কলিং বেলটা বাজতে শুরু করেছে। ঘড়িতে একটা পনেরো বাজে। হয়তো পূর্ণতা পুষ্পিতা চলে এসেছে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলে দিল। যেটা ভেবেছিল সেটাই। পূর্ণতা পুষ্পিতা চলে এসেছে। তাকে দেখেই দুবোন হেসে উঠল। পরীক্ষা কেমন হয়েছে সে কথা পরেও জিজ্ঞেস করা যাবে! ভূমি সদর জায়গার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। পূর্ণতা পুষ্পিতা বৈঠকখানায় এসে সোফার উপর বসল। দুজনের ব্যাগ টি টেবিলের ওপর রাখা। ভূমি এসি চালু করে দিল। দু-বোনেরই ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। পূর্ণতা ক্লান্ত স্বরে বলল‚

“ভাবিমণি একটু ঠান্ডা পানি খাওয়াবে? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।”

“আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।” কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে ছুটল ভূমি। তাড়াহুড়ো করে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বোতল বের করল। এরপর জগে ঢেলে নিল সঙ্গে দুটো গ্লাস নিল। এদিকে সোফায় আয়েশ করে বসেছে দুটোতে। গা থেকে অ্যাপ্রোন খুলে রেখেছে। দুজনকে পানি দিয়ে জগটাকে টি টেবিলের উপর রেখে দিল। পূর্ণতা পুষ্পিতাকে দেখে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ভূমি জিজ্ঞেস করল‚

“এত ঘেমেছ কেন? গাড়ি করে আসনি?”

“না ড্রাইভার আঙ্কেল তো যাইনি। তাই আমরা রিকশা করে চলে এসেছি। ভাগ্যিস পুষ্পিতার কাছে টাকা ছিল।”

“সে কী? তোমাদের বড়ো ভাইয়া তো উনাকে বারবার বলে দিয়েছিলেন।”

“থাক সেসব কথা৷ আমরা ঘরে যাচ্ছি৷”

পূর্ণতার কথা শেষ হতেই পুষ্পিতা বলল‚ “রান্নাবান্না হয়েছে? পরীক্ষা দিয়ে বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে ভাবিমণি।”

ভূমি কিছু বলবে তার আগেই পূর্ণতা ফোড়ন কে’টে বলল‚ “মাত্রই না ঝালমুড়ি খেতে খেতে এলি।”

পূর্ণতার কথার পিঠে পুষ্পিতা ভেংচি কে’টে বলল‚ “আমি ভাত খাব৷ ভাতের ক্ষিধে কী আর ঝালমুড়ি দিয়ে মেটে?”

পুষ্পিতার বাহুতে চাপড় মে’রে পূর্ণতা বলল‚ “পেটুক একটা।”

এরপর দুবোন নিজেদের ঘরে চলে গেল। ভূমি রান্না ঘরে চলে এলো। তরকারি থেকে ঝোল অনেকটা কমে ঘন হয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে হয়েও গিয়েছে। চুলো থেকে তরকারির পাতিল নামিয়ে ফেলল সে৷ একটা সার্ভিং বোলে তরকারি ঢেলে নিল। সাবিনাকে দিয়ে প্লেট‚ গ্লাস আর পানির জগ সবকিছু ডাইনিং টেবিলের রাখতে পাঠিয়ে দিল। রান্নাবান্নার কাজ শেষ। ভূমি একবার গুলবাহারের ঘরে উঁকি দিল। ভদ্রমহিলা নামাজ পড়ছেন। তাই আর বিরক্ত করল না। আলগোছে দরজা চাপিয়ে চলে গেল ভূমি। ফিরোজা আর মাধুরী নিজেদের ঘরেই রয়েছেন। ভূমি সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। রান্নাঘরের উষ্ণ তাপে ঘেমে গিয়েছে সে।

ভরপেট খাওয়ার পর শরীর মিইয়ে আসছে। আবারও ঘুম পাচ্ছে তার। যে-ই না শুতে নেবে তার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্তি নিয়ে বালিশের পাশে অযত্নে পড়ে থাকা ফোনটা তুলে নিল। স্ক্রিনে “এমপি মশাই” লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। মুখে হাসি ফুটে উঠল ভূমির। তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে গম্ভীর সেই কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হওয়ার আগেই সালাম জানাল। প্রলয়ও সঙ্গে সঙ্গে সালাম গ্রহণ করল। ভূমি ভাবল আর কী জিজ্ঞেস করা যায়? তার ভাবনার মাঝেই প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“কী করছিলে তুমি? এখন শরীর খারাপ লাগছে?”

“না। আপনি যাওয়ার পরে ঘুমিয়েছিলাম।”

“দুপুরে খেয়েছ?”

“জি আমি খেয়েছি। আপনি খেয়েছেন?”

“হ্যাঁ খেয়েছি। তা ম্যাডাম আমাকে কী একটুও মিস করা হচ্ছে না?”

ভূমি উল্টো প্রশ্ন করল‚ “কেন?”

“কেন আবার! কাল তোমাকে এত এত ভালোবাসা দিলাম। ভাবলাম হয়তো মিস করছ!”

প্রলয়ের কথায় লজ্জা পেল ভূমি। অধর কোণে উঁকি দিল লজ্জা মিশ্রিত মিষ্টি হাসি। নিমীলিত কণ্ঠে বলল‚ “আপনার মুখে কিছু আটকায় না!”

“লজ্জা পেলে কী বউকে বেশি বেশি আদর দিতে পারব নাকি?”

এসব লাগাম ছাড়া কথায় তরুণী লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে। লোকটা ইচ্ছে করেই তাকে লজ্জায় ফেলছে। এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে সে। ভূমি কথা বাড়াল না। তবে একটা কখন খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু বলা আর হলো না৷ কথাটা এমন যে‚ “এমপি মশাই আপনি বড্ড দুষ্টু!” ভূমিকে চুপ থাকতে দেখে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“তা বিবিসাহেবা কী কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছেন?”

হকচকিয়ে গেল ভূমি। শশব্যস্তভাবে বলে ফেলল‚ “কই না তো!”

আনমনেই হেসে উঠল প্রলয়৷ ভূমিকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল‚ “পিল খেয়েছিলে?”

মিথ্যে বলতে ইচ্ছে না হলেও ভূমি আজ মিথ্যে বলল। সত্যি বললে যদি প্রলয় রেগে যায় তাই সে সত্যিটা চেপে গেল। মুখে বলল‚ “হুম!”

প্রলয় পুনশ্চ বলল‚ “আমার শরীরে একফোঁটা এনার্জিও অবশিষ্ট নেই গো বউ।”

ভূমি বিচলিত হয়ে বলতে লাগল‚ “মানে? আপনার কী শরীর খারাপ করছে?”

“এত ব্যস্ত কেন হচ্ছ? আমার তো তুমি নামক এনার্জির প্রয়োজন। ইচ্ছে করছে ছুটে তোমার কাছে চলে আসি৷”

আলগোছে বিছানায় শুয়ে পড়ল ভূমি। ডান হাত দ্বারা মুখ ঢেকে নিল। লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। সকালে লোকটার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না৷ সকালে খাওয়ার সময়ও কেমন মুখ টিপে হাসছিল! ভাবনার ঘোর কাটল প্রলয়ের শীতল কণ্ঠস্বরে।

“তোমার লজ্জা মাখা মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷”

প্রলয় কল কে’টে দিয়ে ভিডিও কল দিল৷ বুক টিপটিপ করছে ভূমির৷ লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি জেঁকে বসেছে। তবুও কল রিসিভ করল সে৷ তাকে দেখা মাত্রই বুকে হাত রাখল প্রলয়। যাক এতক্ষণে কলিজা ঠান্ডা হয়েছে তার৷ অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে ভূমি৷ আর প্রলয় তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।

চলবে?…..

#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |২৬|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

অবিরত দিনান্ত মূর্ছা গিয়েছে৷ মেদিনীতে নেমে এসেছে ঘোর আঁধারিয়া৷ হুট করেই আবহাওয়া খারাপ করেছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে। টিমটিমে মোমবাতির শিখা মৃদুমন্দ সমীরণে কেঁপে উঠছে। ভূমি ঘরেই রয়েছে। মাগরিবের নামায আদায় করার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে৷ আজ আইপিএসে সমস্যা দেখা দিয়েছে। চলছে না। এদিকে প্রলয় এখনো বাড়ি ফেরেনি। বাকিরা সবাই যে যার ঘরে রয়েছেন৷ বিছানার উপর বসে একটা হাদিসের বই পড়ছে ভূমি৷ বইটা ফিরোজা দিয়েছেন তাকে। ফিরোজার ঘরে গল্প‚ উপন্যাস আর ইসলামিক বই দিয়ে ভরপুর। তিনি বই পড়তে খুবই পছন্দ করেন। সেই সঙ্গে বই সংগ্রহ করাতেও উনার বেশ আগ্রহ। যখনই সময় পান নিজে গিয়ে পছন্দ করে‚ পড়ে তারপর বই কেনেন। ভূমি এখন নবীর জীবনী পড়ছে৷ মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই টিমটিমে আলোয় বই পড়তে তার বেশ ভালো লাগছে। গ্রামের বাড়ির মতো অনুভূতি আসছে। ছোটো বেলায় এভাবেই কুপি জ্বালিয়ে পড়ত৷ তাদের তো বিছানা ছিল না তাই মেঝেতেই মাদুর বিছিয়ে তারপর পড়ত৷ দিনগুলো কতই না সুন্দর ছিল। এশারের আযান পড়েছে। বইটা বন্ধ করে বিছানার উপর রেখে ভূমি ওয়াশরুমে চলে গেল ওযু করবে বলে৷ আগে নামাজ আদায় করবে তারপর আবারও বইটা পড়বে৷ পঁচিশ পৃষ্ঠা অবধি পড়া হয়েছে তার৷ বই পড়ার মাঝেও বেশ সময় কাটছিল।

রাত নয়টা…

কলিং বেল চাপতেই সাবিনা সদর দরজা খুলে দিল৷ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে প্রলয় সোজা নিজের ঘরে চলে এলো। কারণ বৈঠকখানায় এখন কেউই নেই৷ পূর্ণতা পুষ্পিতা তাদের ঘরে পড়ছে৷ প্রলয় নিজের ঘরেই চলে এলো৷ এসে দেখল ভূমি বিছানার উপর বসে আছে। মোমবাতি জ্বলছে। জ্বলজ্বল করতে থাকা মোমবাতির উজ্জ্বল লালচে হলুদ আলো ভূমির সর্বাঙ্গে আছড়ে পড়ছে৷ প্রলয় দরজা আটকাতে উদ্যত হলো। হঠাৎ হওয়া শব্দে চমকে উঠল ভূমি। চোখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। প্রলয়কে দেখতে পেয়ে কিছুটা স্থির হলো৷ বিছানা ছাড়ে নামল সে। এখন নিশ্চয়ই প্রলয় ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম যাবে। বলার আগেই ভূমি ওয়ারড্রব থেকে প্রলয়ের জন্য ট্রাউজার‚ টিশার্ট বের করে রাখল বিছানার উপর। তোয়ালে খানা হাতে নিয়ে তার কাছে গেল। ইতিমধ্যেই প্রলয় তার হাত থেকে ঘড়িটা খুলে ফেলেছে। বুকের কাছ থেকে সাদা শার্টের বোতাম দুটো খুলে ফেলেছে। বুকের লোমশ গুলো আঁধারে দেখা গেল না। তবে এরই মাঝে বিদ্যুৎ চলে এলো। প্রলয়ের উন্মুক্ত বুক দৃষ্টিগোচর হলো। ভূমি চোখ ফিরিয়ে নিল। লজ্জারা হানা দিচ্ছে৷ হাতে থাকা মোবাইলটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলল প্রলয়৷ এরপর ভূমিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।

“ফ্রেশ পরে হব। আগে বউকে আদর করে নিই।”

ভূমি বাহানা খুঁজতে লাগল৷ হুট করেই বলে উঠল‚ “দরজা খোলা আছে। যেকেউ চলে আসতে পারে!”

প্রলয় তোয়াক্কা করল না৷ বরঞ্চ ভূমির গ্রীবায় সিক্ত পরশ দিয়ে আস’ক্তিমাখা কণ্ঠে বলল‚

“এই বাহানা কাজে দেবে না। নতুন কিছু ভাবো।”

ভূমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভূমির ললাটে আলতো পরশ এঁকে দিয়ে আবারও বলল‚ “তোমায় আদরে আদরে মুড়িয়ে রাখব সোনা।”

কথাটা বলতে দেরি ভূমিকে পাঁজোকোলে তুলতে দেরি হয়নি। আচমকা কোলে তুলে নেওয়ায় ভয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করল ভূমি। প্রলয়ের মতিগতি ঠিক লাগছে না তার। লোকটার তপ্ত নিশ্বাস গায়ের উপর আছড়ে পড়ছে৷ এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। প্রলয়ের গলা জড়িয়ে ধরেছে সে। ভয়ে আছে যদি পড়ে যায়? তাহলে তো তার কোমর ভাঙবে। কিন্তু সে জানেই না প্রলয় তার ভূমি কন্যাকে কখনোই আঘাত পেতে দেবে না। চোখে মেলে তাকাল ভূমি। প্রলয় তাকে বিছানায় সন্তর্পণে শুইয়ে দিয়ে বলল‚

“তোমার এমপি মশাইয়ের এ জীবন থাকতে কোনো আঘাত তোমাকে ছুঁতে পারবে না ভূমি কন্যা। আর হ্যাঁ‚ এত পালাই পালাই করছ কেন? দুপুরে বলেছিলাম না আমার শরীরে বিন্দুমাত্র এনার্জি নেই৷ এনার্জি পেতে হলেও মিষ্টির ছোঁয়া প্রয়োজন।”

ভূমি তাড়াতাড়ি করে শোয়া থেকে বসে পড়ল৷ অধর কোণে মুচকি হাসির ছোঁয়া৷ প্রলয়ের কথা বোধগম্য হয়নি এতটা অবুঝ নয় সে। তাকে দেখে এমপি মশাইও বাঁকা হাসল৷ ভূমির পা টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। সিক্ত ওষ্ঠের ছোঁয়া একে দিল সঙ্গে সঙ্গেই। জোড়া অধরোষ্ঠের আলিঙ্গনে দম আটকে আসার উপক্রম। প্রলয়ের পিঠ খামচে ধরল ভূমি। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। লোকটা ব্যাকুল হয়ে তার ওষ্ঠদ্বয়ের উপর চড়াও হয়েছে৷ অনুভূতির তীব্র উচ্ছ্বাস সর্বাঙ্গে। শিরা উপশিরায় র’ক্ত ছলকে উঠল৷ দেদারসে হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করল৷ কোমল হাত দ্বারা প্রলয়ের চুলের পেছনে আকড়ে ধরল সে। ইতিমধ্যেই ভূমি কন্যার বুকের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে নিয়েছে প্রলয়৷ কোমরে হাত রেখে নিজের অনেকটা কাছে টেনে নিল ভূমিকে৷ যতটা কাছে টানলে দুটি দেহের দূরত্ব ঘুচয়! সময় বয়ে যায়। প্রলয় আরও ব্যাকুল হতে শুরু করেছে৷ এরই মাঝে কেউ এসে দুয়ারে কড়া নাড়ল। হঠাৎ করে শব্দ হওয়ায় ঘাবড়ে গেল ভূমি। প্রলয়কে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বলিষ্ঠ দেহের এই লোকের সঙ্গে সে পারবে? প্রলয় নিজের মাঝে নেই। ভূমিকে আরও কাছে পাওয়ার তাড়নায় মেতে উঠেছে সে৷ ভূমির অধরোষ্ঠে আরও রুক্ষ ভাবে আলিঙ্গন করতে শুরু করল। উন্মাদ হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। এবারও প্রলয়কে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল ভূমি। অসহায় মুখ করে সেই গম্ভীর চোখের দিকে তাকাল৷ প্রলয় থেমে গেল৷ হুট করেই রেগে গেল। তবে ভূমির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করল না৷ আবারও দরজার কেউ কড়া নাড়ছে। এবার যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা নিভে গেল। প্রলয় উঠে বারান্দায় চলে গেল। মেঝে থেকে নিজের ওড়নাটা গায়ে আর মাথায় ভালো করে পেঁচিয়ে দরজা খুলে দিল ভূমি। অর্পণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রলয়ের সঙ্গে তার একটু দরকার ছিল। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দরকার। মাথা নিচু করে ভূমিকে জিজ্ঞেস করল‚

“ভাই ঘরে আছে?”

ভূমি মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে বলল‚ “জি!”

অর্পণের গলার আওয়াজ শুনেই ঘরে চলে এসেছে প্রলয়। এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন অর্পণকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। বুকের কাছ থেকে শার্টের বোতাম খোলা৷ হাত গুটিয়ে রাখা৷ অর্পণ আড়চোখে প্রলয়কে দেখে জিজ্ঞেস করল‚

“কী হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন ভাই?”

সব সময়কার মতো আজও প্রলয়ের ত্যাড়া জবাব‚ “তোকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে তাই তাকিয়ে আছি।”

প্রলয়ের কথা শুনে মাথায় হাত অর্পণের। তার ভাই বিয়ের পরও শুধরোবে না৷ চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে অর্পণ বলল‚

“ভেবেছি বিয়ে হয়েছে এবার অন্তত তোমার ওসব উদ্ভট কথাবার্তা থেকে রেহাই মিলবে। কিন্তু তা আর হলো কই? তুমি সেই একই আছ।”

“তুই আমাকে রেহাই দিলি কোথায়? সেই তো বাগড়া দিতে চলেই এলি।”

প্রলয়ের কথার মানে অর্পণ বুঝতে না পারলেও ভূমি ঠিকই বুঝতে পেরেছে। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে হেসে উঠল৷ বড়ো বড়ো চোখের শাসানো দৃষ্টিতে তাকাল প্রলয়। যেন চোখ দিয়ে বলছে‚ ‘আজ আর রক্ষে নেই’ ভূমি আর দাঁড়াল না প্রলয়ের সামনে। দুই ভাইকে কথা বলতে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল৷ রাতের খাবার কারোরই খাওয়া হয়নি এখনো। ভূমি নিচে চলে গেল৷ খাবার গরম করতে হবে। সবাই হয়তো কিছুক্ষণ পরই খেতে বসবে৷

ফিরোজা আর ভূমি সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। গুলবাহার আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। উনার আবার ব্লাড সুগার। খাওয়াদাওয়া পর ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়েন। প্রলয়ের গ্লাসটাতে পানি ভরে দিয়ে পাশেই বসে পড়ল ভূমি৷ নিজের প্লেটে আজ অল্প করে ভাত নিয়েছে৷ খেতে ইচ্ছে করছে না৷ এদিকে সকলে খেতে শুরু করে দিয়েছে৷ খাওয়ার এক পর্যায়ে প্রলয় জিজ্ঞেস করল‚

“পরীক্ষা কেমন হয়েছে পূর্ণ পুষ্প?”

“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো হয়েছে বড়ো ভাইয়া৷”

“বাকিগুলোর প্রস্তুতি কেমন?”

“সবগুলোই ভালো।”

পুষ্পিতা বলল‚ “আমার ম্যাথ নিয়ে সমস্যা আছে।”

মাধুরী চটে গেলেন মেয়ের উপর। ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন‚ “সারাবছর কী করেছিস? আগে বলিসনি কেন?”

পানি পান করে মোর্শেদ শিকদার বললেন‚ “এ নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে৷ খাওয়ার সময় শুধু শুধু মেয়েটার উপর চেঁচিয়ো না তো।”

“হ্যাঁ আমি কিছু বললেই তো তা চেঁচানো হয়ে যায়।”

কেউ কিছুই বলল না। যে যার মতো খাওয়ায় মনোযোগী হলো। ভূমি প্রলয়ের পাতে ভাত আর তরকারি দিল। এরপর নিজেও খেতে শুরু করল। আড়চোখে একবার মাধুরীর দিকেও তাকিয়েছিল। আজ আর তেমন কিছুই বললেন না তিনি। হয়তো উনার রাগ কমে আসছে কিছুটা।

সবে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসেছে অর্পণ। সময় কাটছে না তার। আজ সারাদিনে একবারও ইরার সঙ্গে কথা হয়নি। মেয়েটা নিজে থেকেও একটিবার কল করেনি। সে দিয়েছিল কিন্তু ধরেনি। হয়তো ফোন কাছে ছিল না। এমনিতে তো ঘণ্টা পর পর কথা হয় তাদের৷ অর্পণ ভাবল ইরাকে একবার কল করবে। যেই ভাবা সেই কাজ৷ চার্জিং থেকে ফোনটা নিয়ে ইরার নাম্বারে ডায়াল করল সে৷ রিং হবার সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল ইরা। অর্পণ জিজ্ঞেস করল‚

“কী করছিলে?”

“পড়ছি।”

“তাহলে মোবাইল হাতে কেন?”

“রুটিন দেখছিলাম তখনই আপনি কল করলেন। তা বলুন কোনো দরকার?”

“সারাদিন যে একটিবারও কল দিলে না?”

“আসলে আমার সেমিস্টারের রুটিন দিয়েছে। প্রচুর পড়তে হবে।”

“তাহলে বিরক্ত করলাম৷ তুমি পড়। আর হ্যাঁ‚ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে৷ রাত জাগবে না৷ বাকি পড়া কাল কভার করবে।”

ফোন কানে রেখেই ইরা বলল‚ “হুম!”

কল কে’টে দিল অর্পণ। ফোন আবারও চার্জিং এ দিয়ে বিছানা ঘুছিয়ে শুয়ে পড়ল। অবশ্য এখন তার ঘুম আসবে না। প্রতিদিন এই সময়টাতে ইরার সঙ্গে কথা বলে৷ তবে আজ তো ইরা ব্যস্ত তার সে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল।

বিছানায় শুয়ে এপাশ অপাশ করছে প্রলয়। অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন ভূমি ঘরে আসবে। খাওয়া শেষ হতেই সে তো ঘরে চলে এলো কিন্তু বিবিসাহেবার আসার নামগন্ধও নেই৷ নিচে কী করছে এখনো? এদিকে তার বরমশাই যে অপেক্ষা করতে করতে অক্কা পাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই মোটেও! প্রলয় হতাশ! খুবই হতাশ! যখন তখন বউকে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না৷ প্রলয় একবার বিছানার ডানপাশে যাচ্ছে তো আরেকবার বিছানার বাঁ পাশে যাচ্ছে৷ সময় যেন কাটছেই না৷ কিছুক্ষণ এভাবেই গড়াগড়ি খেয়ে বারান্দায় চলে গেল প্রলয়৷ দুদিন ধরে সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি। শশীশূণ্য অম্বরে ঘোর আঁধারিয়া। মৃদুমন্দ সমীরণে অপরাজিতা গাছের লতাপাতা গুলো দুলছে৷ বারান্দায় হরিদ্রাভ আলো জ্বলছে৷ রেলিঙে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলয়৷ দৃষ্টি স্থির রেখেছে বিস্তীর্ণ অন্ধিকা অম্বরে। সময় থমকে গেছে তার৷ আজ দুপুরে একটা প্রেস কনফারেন্স ছিল৷ আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে বহু প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়েছে৷ প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলেই প্রলয়ের কথাগুলো লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। মোবাইলে সেগুলোই একটিবার দেখল সে৷ মাথা ধরে গিয়েছিল তার৷ একটা সিগারেট ধরাল প্রলয়৷ পরপরই উষ্ণ ধোঁয়া বাতাসে বিলীন করে দিল৷ আজকাল সিগারেটের ধোঁয়াতেই স্বস্তি মেলে না৷ ভূমি ঘরে এসে দরজা আটকে দিল৷ প্রলয়কে না পেয়ে একবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকাল৷ না! দরজা তো বাহির থেকে বন্ধ। এরপর দেখল বারান্দার দরজা হুট করে খোলা৷ সে ভেবেই নিল প্রলয় এখন বারান্দায় রয়েছে৷ তাই সে বিছানা গুছিয়ে‚ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল বাঁধতে আরম্ভ করল। বিকেলে ফিরোজা চুলে তেল লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঘন দীঘল কেশে একা তেল দিতে পারে না ভূমি৷ বিয়ের আগে সবসময় আম্মা তাকে তেল লাগিয়ে দিতেন। কুপির সেই টিমটিমে আলোয় মাদুর পেতে বসে তেল লাগানোতেও এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস কাজ করত। এখানে তো মুখ ফুটে বলতেও দ্বিধাবোধ হয় যে‚ “আমাকে চুলে তেল লাগিয়ে দিন।” ছোটো বেলা থেকেই আম্মা তার চুলে তেল লাগিয়ে দিতেন। এই চুলের যত্ন সবসময় তার আম্মাই করতেন৷ চুল বাঁধতে গিয়েও আম্মার কথা খুব মনে পড়ল ভূমি। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এরই মাঝে বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এলো প্রলয়। ভূমিকে আয়নার সামনে বসে থাকতে দেখে রাগ হলো তার৷ ঘরে এসেছে কিন্তু তাকে একটিবার ঘরে ডাকল না‚ ভাবতেই আরেক দফা রাগ হলো। তখন অর্পণ চলে আসায় খুবই বিরক্তবোধ হচ্ছিল। বউয়ের সাথে প্রেম করেও শান্তি নেই। কেউ না কেউ ঠিকই বাগড়া দিতে চলে আসবে! আজ অর্পণ এসেছে কাল অন্য কেউ আসবে। তারউপর তার অবস্থা দেখে ভূমিও হাসছিল। হুট করেই সেই কথাটা মনে পড়ে গেল তার। আয়নায় ভূমির প্রতিবিম্ব দেখেই বলল‚

“তখন খুব হাসা হচ্ছিল?”

চট করে ভূমি আয়নায় তাকাল। প্রলয়ের প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ লোকটা তার থেকে তিন হাত দূরত্বে রয়েছেন। লোকটা ঠিকই মনে রেখেছে। ভূমি না জানার ভান করে বলল‚ “কখন? আমার তো মনে পড়ছে না!”

ধীর পায়ে এগিয়ে এলো প্রলয়। ভ্রু উঁচিয়ে ভূমিকে একবার দেখল৷ সে জানে ভূমি ইচ্ছে করেই এমন করছে৷ ক্ষীণ হেসে ভূমির দিকে কিছুটা ঝুঁকে প্রলয় বলল‚

“এখন তো মনে পড়বেই না৷ তা আমি মনে করিয়ে দিই? তাহলে হয়তো মনে পড়বে তুমি কখন আর কোন কারণে হাসছিলে?”

প্রলয়ের গা থেকে সিগারেটের ধোঁয়ার বিদঘুটে গন্ধ আসছে৷ গা গুলিয়ে উঠছে ভূমির৷ সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না তার৷ কিন্তু লোকটা যে ওয়াদা করেছিলেন কখনো ধূমপান করবেন না। তাহলে সেই কথা মিথ্যে ছিল? ভূমির মন খারাপ হলো। মুখ ফিরিয়ে নিল প্রলয়ের দিক থেকে। কিঞ্চিৎ অভিমান উঁকি দিল৷ অভিযোগ করতে ইচ্ছে হলো৷ বলতে ইচ্ছে হলো‚ “কেন আপনি কথা দিয়েও কথা রাখলেন না? আপনি তো জানেন সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না৷” কিন্তু কিছুই বলতে পারল না ভূমি। প্রলয় তার আরেকটু ঝুঁকে৷ মসৃণ ওষ্ঠে শব্দ করে ওষ্ঠ ছোঁয়াল। এরপর ভূমির দিকে তাকিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল৷ ভূমি ওড়না দ্বারা নিজের মুখ চেঁপে ধরল। অর্ধাঙ্গিনীর চিবুক ছুঁয়ে মুখটা নিজের দিকে ফেরাল। প্রলয় বলল‚

“ভুল হয়ে গেছে৷ কিন্তু তুমি চাইলেই সিগারেটের এই উটকো গন্ধকে দূর করতে পারো।”

ভূমি অবাক চোখে তাকাল। এভাবে তাকাতে দেখে প্রলয় বাঁকা হাসল। ভূমির বাহু ধরে উঠিয়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসাল। নিজে থেকে গিয়েই বারান্দার দরজা আর ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। ঘুম বাতি জ্বলছে৷ হুট করে আলো নিভে যাওয়ায় সবকিছুই অন্ধকার লাগতে শুরু করেছে। কিছুটা সময় যেতেই ঘুম বাতির আবছা আলোয় সে দেখতে পেল প্রলয় একদম তার সামনে৷ চমকে উঠল সে৷ কিছুটা ভয় পাওয়ায় বুকে দুহাত চেপে রেখেছে৷ ভূমিকে বিছানায় শুইয়ে দিল প্রলয়৷ এতটা সময় অপেক্ষা করানোর শাস্তি তো পেতেই হবে৷ ভূমির উপর ঝুঁকে প্রলয় বলল‚

“নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে ঘন ঘন প্রেম আর আদর পাবে এটাই স্বাভাবিক৷”

ভূমিকে বিছানার সঙ্গে চেপে ওষ্ঠাদ্বয় মিলিয়ে দিল৷ খুবই রুক্ষ ভাবে চুম্বন সৃষ্টি করছে প্রলয়৷ নিজেকে নিয়ে ভূমির মাঝে কোনো খারাপ লাগা রাখবে না সে৷ না আর সিগারেট ধরবে। বেশ কিছুক্ষণ পর ভূমির ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে গ্রীবাদেশে নেমে এলো প্রলয়৷ মুহূর্তেই কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভূত হলো ভূমি। চিনচিনে ব্যথার সঙ্গে হালকা জ্বালাও করছে৷ সমস্ত ভর ভূমির উপর৷ বিছানার সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে মেয়েটা৷ এদিকে বিছানার গদি থেকেও ভূমিকে বেশি কোমল মনে হলো প্রলয়ের। ভূমিকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেশালো শান্ত স্বরে বলল‚

“এতটা কোমল না হলেও পারতে! মাঝে মাঝে তো আমার ভয় হয়‚ কখন না জানি গলে যাও।”

প্রলয় আবারও মগ্ন হলো তার ভূমি কন্যাতে। তীব্র অনুভূতির চাবুকাঘাতে মূর্ছা যাচ্ছে দুটি দেহ৷ আবারও সেই সুমধুর লীলায় মেতে উঠল কপোত-কপোতী। সাক্ষী হয়ে থাকল একটি নির্জন প্রহর৷

রাতে দুটো…

একাধারে সিগারেটের ধোঁয়া বিলীন করছেন মেহরাব শিকদার। ঘুম আসছে না কিছুতেই। কিছু একটার চিন্তা উনাকে ঘুমতে দিচ্ছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে এসেছেন তিনি। এরই মাঝে দুটো সিগারেট পুড়িয়ে ফেলেছেন। ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছেন ফিরোজা৷ রাত তো কম হয়নি। মেহেরব শিকদার নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য বড্ড চিন্তিত। কী হবে যখন ফিরোজা সব সত্যি জেনে যাবেন? তিনি যে বড্ড ভালোবাসেন নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে৷ মাথা ধরে আসছে উনার। অতীতের একটা ভুল সিদ্ধান্তে জীবনটা ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু সেই ঘটনার জন্য মোটেও অনুতপ্ত নন তিনি। সেই অধ্যায় তো তখনই শেষ করে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু অতীত পিছু ছাড়লে তো! তবে যা-ই হোক অতীত আর কিছু সত্য থেকে কখনোই পর্দা তোলা যাবে না৷ দরকার পড়লে নিজের পথের কা’টা তিনি যে কোনো মূল্যেই উপড়ে ফেলবেন। ঘুম না হওয়ায় চোখ অসম্ভব লাল হয়ে রয়েছে৷ তিনি আর সময় অতিবাহিত না করে ঘরে ফিরে এলেন৷ ফিরোজার চুলে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে কয়েকটা কথা ভীষণ ভাবে আওড়ালেন।

“আমার তোমাকে হারানোর বড্ড ভয় হয় ফিরোজা৷ অতীতকে আমি কিছুতেই তোমার সামনে আসতে দেব না৷ তার জন্য যা করতে হয় আমি করব৷ আমি মোটেও পিছুপা হব না৷ মহুয়া আর ভূমিকে আমার বর্তমানে কিছুতেই পদার্পণ করতে দেব না। তুমি আর অর্পণই তো আমার সব।”

কিন্তু আফসোস ফিরোজা উনার একটা কথাও শুনতে পেলেন না৷ শুনলে হয়তো গল্পটা অন্যরকম মোড় নিত৷ মেহরাব শিকদার অন্যপাশে শুয়ে পড়লেন৷ রাত তো কম হলো না৷ এবার একটু ঘুমনোর চেষ্টা করা প্রয়োজন। সকালে হসপিটালেও যেতে হবে৷ ঘুমতে না পারলে সারাদিন মাথা ব্যথা থাকবে৷

প্রত্যুষে…

নীলিমায় ধূসর রঙা মেঘের ঝাঁক। বাতাসের তালে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভূমির বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে প্রলয়। মেয়েটাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে৷ একটু নড়াচড়া করার সু্যোগটুকু নেই। ঘুমের মাঝে নিজের উপর ভার কিছু অনুভূত হলো ভূমির৷ সূর্য এখনো উদয় হয়নি। তবে সকাল হতে শুরু হয়েছে। ভূমির ঘুম হালকা হয়েছে৷ একটু একটু করে চোখ মেলে তাকাল সে৷ ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য এখনো অনেকটা সময় বাকি রয়েছে। এদিকে তাকে ঘুমের ঘোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে প্রলয়। বহু কষ্টে হাত বের করে প্রলয়কে সরানোর চেষ্টায় লেগে পড়ল ভূমি। প্রথম কয়েকবার ব্যর্থ হলেও মিনিট দুয়েক পর ঠিকই সফল হলো। ভূমি বিছানা ছেড়ে নামল। ওয়ারড্রব থেকে নিজের প্রয়োজন জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ছুটে গেল। তাড়াহুড়ো করেই গোসল সারবে৷ কাল ফজরের নামাজ আদায় না করে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। বেলা করে ঘুম ভেঙেছে। শাশুড়ী মা তো এসব মোটেও পছন্দ করেন না৷ রোজ দেরি করে ঘুম ভাঙা তারও পছন্দ না৷ এখন থেকে প্রলয়কে বলবে প্রতিদিন তার ফোনে এলার্ম দিয়ে দিতে৷ এরই মাঝে গোসল করে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল৷ এরপর ভেজা কাপড় গুলো বারান্দায়। জানালার ধারে ঝুলে থাকা পর্দা গুলোকে সরিয়ে জানাল হুট করে খুলে দিল ভূমি৷ প্রত্যুষের তেজি সমীরণ এসে ভীড় জমাল পুরো ঘরময়৷ শীতল সমীরণে গা শিরশির করে উঠল৷ ভেজা চুলগুলো মেলে দিল ভূমি৷ এখন হয়তো কেউ-ই ঘুম থেকে ওঠেনি৷ সবে সাড়ে ছয়টা বাজছে৷ তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো ভালো করে মুছে নিল চট করে৷ প্রলয় ঘুমচ্ছে এখনো। তাকে আর জাগাল না সে৷ এ বাড়িতে আসার পর জেনেছে লোকটা একটু ঘুমকাতুরে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন৷ রাতে ঘুমানও দেরি করে৷ একটা দেড়টা অবধি জেগে থাকার অভ্যেসও রয়েছে এমপি মশাইয়ের।

চলবে?…..