ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-০১

0
487

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur
Part–1

— ‘ শুনেছি মেয়েদের বিয়ের পর প্রথম প্রথম সর্বাঙ্গে বিষব্যথার জন্য প্রায় জ্বর আসে,নববধুরা সারারাত জেগে থাকে, রাতে ঘুমায় না জন্য অসুখ লেগে থাকে, টানা অসুস্থ থাকে । আপনি কী নববধু যে ঘন ঘন অসুস্থ হচ্ছেন? এতো ছুটি চাওয়ার কারণ কি মিস. আয়না? ‘

অপমানের সুরে কথা গুলো বললো আয়নার অফিসের বস সাদবিন রহমান সমুদ্র। ওনার মতো রাগী, বদমেজাজি, ইগোয়েস্টিক, ঘাউড়া, ঘাড়ব্যাকা ও ঘাড়ত্যাড়াও না সোজা ঘাড়-উল্টো লোক আয়না তার জীবনে দেখেই নি বললে চলে। এমন বি শ্রী অপমানসূচক ঠেস মা-রা কথায় অপমান, লজ্জায় তার মুখশ্রী লাল হয়ে এসেছে। গা ঘিনঘিন করে উঠে তার । আশেপাশে তার কলিগরা মিটমিটিয়ে হাসছে তার উপর। আয়না লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে ওড়না দিয়ে হাত প্যাঁচাতে থাকে৷

কি বাজে পরিস্থিতি তৈরি করলেন উনি! একটা মানুষ কিভাবে কোনো মেয়েকে এভাবে ডাবল মিনিং কথার ছলে সকলের সামনে অপমান করতে পারে? আয়নার রাগে-অপমানে, দুঃখে কান গরম হয়ে আসে৷

–‘কি হলো চুপ যে? নতুন বিয়ে করেছেন নাকি তবে, হু ?’

আয়না উত্তর না দিয়ে ছোট করে বলে, ‘ সর‍্যি স্যার।’
কিন্তু মনে মনে বললো, সর‍্যির গুষ্টি কিলাই! তোকে আমার একবিন্দু সহ্য হয় না রে চান্দু। নিজেকে কি ভাবিস তুই? বদ লোক কোথাকার। খাটাশ বস কোথাকার। আমি কালকেই চাকরি ছেড়ে দিব। রিজাইন লেটারে সাইন করেই তোর মাথায় ময়লার ডাস্টবিনের তিনদিনের বাসি ময়লা ফেলবো। হুহ।’

সমুদ্র এতোক্ষণ পর তার দিকে মুখ তুলে তাকালো, হাতে আয়নার তৈরি করা ফাইল। সে বলে উঠে, ‘ মন কোথায় পরে থাকে আপনার? আকাশে নাকি বিয়ের ঘরে? একটা কাজও ঠিকমতো শেষ করেন নি আবার ছুটি চান?’

–‘ লাগবে না, লাগবে না স্যার ‘

সমুদ্র ঠান্ডা কিন্তু তেজি কণ্ঠে বলে, ‘ আজকের মধ্যে গত সপ্তাহের সব পেন্ডিং কাজ শেষ করে অফিস ছাড়বেন। এ্যাম আই ক্লিয়ার?’ কথাটা বলেই হাতে থাকা ফাইল ছুঁড়ে মারলো সামনের দিকে৷ ছুঁড়ে মারার বেগ একটু বেশি ছিলো কিনা , সজোরে শব্দ তুলে নিচে ছুটে এসে আয়নার পায়ের কাছে পড়লো৷

আয়না ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ .ই…ইয়েস স্যার ‘

সমুদ্র বলে উঠে, ‘ বাকিদের কাজ ঠিক আছে৷ আপনারা যেতে পারেন।’ এরপর আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি ও গিয়ে ভুল গুলো সংশোধন করুন।’

আয়না সবার সঙ্গে চটজলদি বেরিয়ে যেতে চাইলো। এই বদমেজাজি বেয়াদব লোকটাকে একমুহূর্ত আর দেখতে চায় না। অসহ্য লাগে জাস্ট ওনাকে। ওনার চেহারা দেখা মানেই দিন খারাপ যাওয়া। অসহ্য! অসহ্য! তার কি এমন অপরাধ যে এতো বাজে ভাবে অপমান করলো? শুধু আজ হাফ ডে-ই তো চেয়েছিলো! আর গত সপ্তাহে জ্বরের অজুহাত অফিসে একদিনও আসে নি সেজন্য এতো ইনসাল্ট করা কি ঠিক? এই লোকের বউয়ের কপালে নিশ্চয়ই বিরাট বড় দুঃখ আছে। ওনার যে ব্যবহার কোনো মেয়ে বিয়েই করবে না ওনাকে । বিয়ের আসরেই ওই লোকের গোমড়া চেহারা দেখে ভাগবে ডাম সিউর৷

আয়না রুমের বাইরে যেতে ধরলে ফের পিছু ডাকে সমুদ্র। বলে উঠে, ‘ মিস. আয়না, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। বাকিরা যেতে পারেন৷’

সমুদ্রর আদেশ শোনামাত্র আয়নার সঙ্গে থাকা অন্যরা রুম ত্যাগ করলো দ্রুত। আয়না দাঁড়িয়ে রইল৷

সমুদ্র এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আয়নার অস্বস্তিতে মনের মধ্যে গুমোট অনুভূতি ঘুরপাক খায়। তাকে কেন একা রেখে দিলো? কি করবে তার সঙ্গে? মে–রে পুতে দিবে নাতো! ওনার যা রাগ এক-দুই টা রাগের বশে খু—- ওনার জন্য তেমন কোনো ঘটনাই নয়। এই লোকের কেবিনে একা থাকা, চিড়িয়াখানার ক্ষুধার্ত বাঘের খাঁচায় আটকা পড়ার সমতুল্য। কেন এই লোক আগ বাড়ায় তার সঙ্গে কথা বলতে চায়? সমুদ্র ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বললো, ‘ আপনার সমস্যাটা কী?’

–” বললাম তো স্যার, লাগবে না ছুটি, সর‍্যি৷”

–” ব্যথা আছে নাকি শরীরে এখনো?”

আয়না বুঝে পায় না কোন ধরনের ব্যথার কথা বলছেন বস। সে চোখ তুলে তাকায়৷

–“বিয়ের পর মেয়েরা এক বিশেষ ধরনের পেইন কিলার খায়। পেইন কিলার খেলে আর কোনোরকমের ব্যথা থাকে না। ব্যথা না থাকলে জ্বর ও আসবে না, সিক লিভ ও লাগবে না, রাইট?”

কথাগুলো আয়নার চোখে চোখ রেখে বলেই ফিচেল শয়তানী হাসি হাসে সে।

আয়না মাত্র বুঝলো ব্যাটা আবার তাকে হেনেস্তা করতে আজেবাজে বকে যাচ্ছে৷ একটা সামান্য ইস্যু নিয়ে এতো বাজে বাজে ইঙ্গিতে অপমান করে কী মজা পাচ্ছে সে? আর এই ব্যাটা এতো বিবাহিত নারী সম্পর্কে জ্ঞান রাখে কেমনে?

আয়না একটু জোরে শব্দ করে বলে, ” আমি অবিবাহিত। ”

আয়না সামনের দিকে না তাকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা আগাতে ধরলেই বন্ধ কাঁচের দরজার সঙ্গে কপালে আঘাত লাগে। সে কপালে হাত দিয়ে আউ বলে শব্দ করে।

সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে তার আঘাত প্রাপ্ত কপালটায় নিজ হাত স্পর্শ করায়৷ ওমনি যেন আয়নার গায়ে বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে তড়িৎবেগে সমুদ্রের হাত নিজের শরীর থেকে ঝটকায় সরে দিয়ে বলে উঠে, ” আপনি কোন সাহসে আমার কপালে হাত দিলেন?”

সমুদ্র যুতসই জবাব দিতে পারে না। আয়না প্রায় চিল্লিয়ে বলে উঠে, “, আপনার কোনো অধিকার নেই আমার কপালে স্পর্শ করার। নিজের লিমিটের মধ্যে থাকবেন।”

সমুদ্র সবটা শুনে না, কেবল ‘অধিকার’ শব্দটা তার কানে বাজে ভীষণ জোড়ে৷

ঠাণ্ডা, শীতল কণ্ঠে বললো, ‘ বের হয়ে যাও। আর ভুলেও নিজের চেহারা দেখাবে না।’

__________________

আয়না বসের কেবিন থেকে বের হতেই তার কলিগরা তাকে জ্বালানো শুরু করলো। সে এসবে বিরক্ত হয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। বহুত কাজ পড়ে আছে।এমনিতেই মন-মেজাজের কোনোটাই ভালো নেই তার৷
গত পাঁচদিনের ফাইল সব রিচেইক দিতে হবে। আজ আর জলদি বাসায় ফেরা হবে না৷ ধ্যাত! বেয়াদব লোকটা ইচ্ছা করে তার সঙ্গে এমন করলো। অন্যদের সঙ্গে ডিসকাস করে সবাই মিলে কাগজপত্র তৈরি করেছে। তাহলে সবারটা ঠিক থাকলে তারটা ভুল যাবে কেন? এসব তাকে ঝামেলায় ফেলার পায়তারা ছাড়া বৈকি কিছু ই নাহ। আয়নার মন চাচ্ছে গিয়ে ওনার চুল ধরে টানতে। হতচ্ছাড়া বেটা যেদিন যেদিন অফিস আসে, সবার শ্বাস নেওয়া হারাম করে ছাড়ে৷

আয়না টানা চারটা ঘন্টা কাজ করে যখন সব ফাইল রেডি করে, তার অফিসে আর কেউ অবশিষ্ট নেই। সবাই চলে গেছে অফিস ছেড়ে। সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে ইতিমধ্যে। সে দ্রুত সমুদ্রের রুমের দিকে ছুটলো। এই সময়ে সমুদ্র কেবিনে থাকে না। ফাইল রেখেই সে এক দৌড়ে বাসায় চলে যাবে। ব্যাটার চেহারা দেখতেও চায় না আর সে।

আজকে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাসায় নিশ্চয়ই সকলে চিন্তা করবে। সমুদ্রের কেবিন পুরা ফাঁকা। তার পিএ দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। তাকে দেখে এগিয়ে এসে, হেসে বলে, ” গুড ইভিনিং৷”

আয়না ব্যস্ততা নিয়ে বলে উঠে, ‘ তোমাদের বদমেজাজি স্যার কোথায়?”

মেয়েটা সুন্দর করে হেসে বলে, ‘ স্যার বেরিয়ে গেছে। ফাইল রেখে যাও। স্যার কালকে চেইক করবেন৷”

আয়নার মনে মনে ভাবে, বেয়াদব বস ! তাকে এভাবে গাঁধার মতো কামলা খাটিয়ে নিজে আগে আগে বেরিয়ে গেছে। আয়েশ করছে। বেটা আসলেই খাটাশ। মানুষকে বিপাকে ফেলে দিতে পছন্দ করে। যতোসব।

সে ফাইল ডেস্কে রেখে ফুরফুরে মেজাজে অফিস থেকে বের হবে এমন সময় যার মুখ দর্শন করতে চায়না ঠিক তার মুখের সামনে এসে পড়লো সে। সমুদ্র তখন ফোনে কার সাথে যেন গল্প করছিলো। আয়না তাকে পাশ কেটে চলে যেতে ধরলে ঠিক তার সামনে এসে রাস্তা আটকায় সমুদ্র। সে তখনো ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল।

আয়না না চাইতেও দাঁড়িয়ে গেলো৷ সমুদ্র ফোন কেটে তার দিকে সন্দেহমূলক দৃষ্টিতে তাকালো৷

আয়না আগ বাড়ায় বললো, ‘ ফাইল গুলো আপনার ডেস্কে রেখে এসেছি।’

–‘ যান তাহলে।’

আয়না হনহন করে বেরিয়ে আসে অফিসের বাইরে যেন সে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু আজ যেন বিপদ পিছু ছাড়তে নারাজ। প্রতিদিন পাঁচটার মধ্যে এদিকে অনেক সিএনজি রিকশা পাওয়া যায় কিন্তু আজ একটা কাকও নেই। রাস্তা পুরা ফাঁকা৷ আয়নার চিন্তা বেড়ে গেল। সে বাসায় পৌঁছাবে কিভাবে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতেই সমুদ্র এসে তার পেছনে দাঁড়ালো তবে কিছু বললো না। একটু পরই পার্কিং লট থেকে কালো এক্স করোলা গাড়ি এসে থামে।

সমুদ্র তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘ কারো হেল্প লাগলে, জানাতে পারে সে ।’

আয়নার কানে কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র সে সোজা বামদিক ধরে পথ আগায়।

সমুদ্র রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” অভদ্র মেয়ে।”

আয়না রাস্তার ধারে বসা ফুচকা স্টলে গিয়ে থামে। সে এক্সট্রা ঝাল, বোম্বে মরিচের ঝাল সহ ফুচকা অর্ডার দিলো। আজ যা যা টলেরেট করেছে, এখন ঝাল ফুচকা না খেলে তার মাথা ঠাণ্ডা হবে না৷ ফুচকার প্লেট হাতে আসতেই সে খুশি হয়ে যায়, কিন্তু খুশি নিমিষেই হারিয়ে যায় যখন দেখলো তার খাটাশ বস ঠিক হেঁটে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। আয়না ফুচকা হাতে নিয়েই সম্পূর্ণ ঘুরে অন্যদিকে তাকায়। সমুদ্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ফের আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, আয়না তখন সঙ্গে সঙ্গে আবারো অন্যদিকে ঘুরে যায়৷

সমুদ্র মুখে উচ্চারণ করে বলে, ” মেয়ে তো পুরাই তারছিঁড়া!”

আয়না অন্যদিকে ঘুরে ফুচকা খাচ্ছিল। সমুদ্র ঠিক তার পেছনে দাঁড়ালো এবং পকেটে হাত গুঁজে বলে, ” আবার কি সমস্যা হলো? পেটে ব্যথা নাকি? মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে পালাচ্ছেন কেন?”

আয়না পেছন দিকে তাকিয়েই বলে, ” পালাচ্ছি না, আপনার আদেশ পালন করছি।”

সমুদ্রের খেয়াল হলো সকালে একবার বলেছিল যেন আর চেহারা না দেখায়। সে বলে উঠে, ” এখন অফিস আওয়ার না সো চেহারা দেখতে আমার অসুবিধা নেই।”

আয়না এবার তার দিকে ঘুরে তাকায়। সমুদ্র একটু ভ্যাবাচেকা খেল। মেয়েটা ঝালে একদম কাহিল। নাকের পাটা আর ঠোঁট একদম টকটকে লাল হয়ে গেছে ঝালে। চোখ দিয়েও বুঝি পানি গড়াচ্ছে৷

সমুদ্র ফুচকা ওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে, ” বিল কত?”

— ” আমি দিচ্ছি।”

সমুদ্র তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লোকটাকে একশ টাকা দিয়ে দিল।

আয়না প্লেট ফেরত দিয়ে সমুদ্র থেকে দূরে সরে যেই না অন্যদিকে হাঁটা দিবে, ওমনি সমুদ্র তার হাত খপ করে ধরে ফেলে। আয়না চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে এর আগেই সমুদ্র ভীষণ জোড়ে ধমক দিয়ে বলে, ” আর কোনো কথা বলবে না। সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠো। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”

–” আপনার চেয়ে বেশি খারাপ অন্য কেউ হবেও না। খারাপ হওয়ার প্রতিযোগিতায় আপনি একতম স্থানে আছেন।”

সমুদ্র কিছু বলে না। সে আয়নার হাত ধরেই আগায় গাড়ির দিকে। গাড়ির সামনে সে ফ্রন্ট ডোর খুলে দিয়ে বলে, ” আজকে মেইনরোডের দিকে শ্রমিক আন্দোলন। ”

–” আমি রিকশা দিয়ে চলে যাব।”

–” পাগল নাকি! এদিকে কোনো যানবাহন পাওয়া যাবে না আজ।”

–” তাহলে হেঁটে যাব।”

–” সাট আপ! চুপচাপ বসেন গাড়িতে। আপনার জন্য দুইঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”

আয়না অবাক নয়নে তাকিয়ে বলে, ” আমার জন্য অপেক্ষা কেন করবেন?”

–” কৈফিয়ত দেই না আমি। ” বাক্যটা ভীষণ কর্কশ গলায় বলেই আয়নাকে একপ্রকার জোড় করে গাড়িতে বসিয়ে সজোরে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজা লাগানোর আওয়াজে আয়নার আত্মা কেঁপে উঠে৷ উফ! এতো রাগ কেন এই লোকের! এই লোক কী ড্রাইভিং সীটে এসে বসছে? শীট! শীট! সে মোটেও ওনার এতো কাছাকাছি বসতে চায় নাহ!

চলবে।