#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–11 (বোনাস পর্ব)
ফোন বেজে ওঠার পর একাকী থেমে যায়। এরপর একটা ম্যাসেজ আসলো। ম্যাসেজটা স্ক্রিনেই নোটিফিকেশনের মাধ্যমে দেখা যায়–” ওয়ান্ট টু টক টু ইউ। রিসিভ মাই কল সমুদ্র ।”
সমুদ্র ম্যাসেজ দেখামাত্রই দাঁড়িয়ে গেলো। উপস্থিত সবার চোখ গেল হবু বরের উপর। সমুদ্রের হাতে ফোন ছিলো। সে এক কদম এগিয়ে এসে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। কিছু বলবে মন হয়! লাল টুকটুকে বউ সেজে আয়না এমনটা ভেবেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাণে তার দিকে থমকে দাঁড়ায়। আজ ওনাকে এতো বেশি সুন্দর লাগছে! সবার দৃষ্টি তখন সমুদ্রের দিকে।
সে হাত এগিয়ে দিলো। এটা ভদ্রতাসূচক সব প্রোগ্রামেই বরকে এই টাইপ স্টাইলে কনেকে বিয়ের স্টেজে রিসিভ করতে দেখা যায়। আয়না আলতো করে হাত এগিয়ে দিয়ে তার হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র হাতটা অনেক শক্ত করে ধরে নেয়। তার পানে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দেয় আয়না। সঙ্গে সঙ্গে যেন সমুদ্রের বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সে আস্তেধীরে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আয়নাকে সোফায় বসিয়ে দিলো। ওর আঁচল সোফায় তুলে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের আসনে বসে পড়ে। তখনও ফোনে কল আসছিলো। একনজরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, পাওয়ার বাটন অফ করে দিয়ে পিউকে ইশারায় ডাকে।
পিউ ভাইয়ের ডাকে এগিয়ে আসলে ওর হাতে নিজের ফোনটা দিয়ে বললো, ” তোর কাছে রাখ৷ ফোন অন করবি না।”
পিউ ভাবলো হৈচৈয়ের মধ্যে হয়তো মোবাইল হারিয়ে যাবে এজন্য ভাইয়া তাকে সাবধানে রাখতে বলছে৷ সে বন্ধ করা ফোন হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। সমুদ্রের যেন একটু ঘাম ছু’টলো কপাল বেয়ে। বিয়ের সময়ে সবারই একটু নার্ভাস লাগে তার উপর যদি অতীতের পিছুটান হাতছানি দিয়ে ডাকে?
কাল অব্দি মনের মধ্যে অনেক সংকোচ ছিলো তার। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বিয়েটা না করলে সে সারাজীবন কারো কাছে অপরাধী হয়ে বাঁচবে। নিজে প্রতারণার শিকার হয়েছে, সে জানে একটা ধোঁকা কীভাবে সারাজীবনের কান্না হয়! অন্যকাউকে ওই মরণ যন্ত্রণা দেওয়া নিছক পাপ ছাড়া কিছুই না। আয়নার সঙ্গে সে অন্যায় করতে পারবে না। ইউশা যদি আজ বিয়ের আসরে এসেও তাকে এপ্রোচ্ করত, তবুও ওর কথাতে গলত না সে।
বিভিন্ন চিন্তায় নিমজ্জিত থাকার ক্ষণে, শ্রাবণ তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ” নার্ভাস নাকি ব্রো?”
–” একটু।”
–” কাম অন ভাইয়া, তুমি ছেলে হয়ে এতো নার্ভাস কেন হচ্ছো? আর ওইদিকে ভাবীকে দেখো কতো চিল আছে! ব্রো আজ তো তোমার-ই রাত আর মিয়া তুমি নার্ভাস!”
সমুদ্র আয়নার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মেয়েটা আসলেই অন্যদের সঙ্গে হেসে কথা বলছে। কারা যেনো ওর স্বর্ণের জুয়েলারি গুলো দেখছে। আয়নাও উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছে। হাত নাড়িয়ে-চাড়িয়ে হাতের চুড়ি-আংটি দেখাচ্ছিলো হেসে হেসে। সমুদ্রের ভারী মায়া হলো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। যদি আত্ম অনুশোচনা বলে কিছু থাকে, সেটা সমুদ্রের মধ্যে আগ্নেয়গিরি আকারে উত্তাপ ছড়াচ্ছে৷ মেয়েটার নাকি মা নেই। বাবার কাছে মানুষ হওয়া ভারী আদরের মেয়ে। অথচ একটু আগেও ইউশার কল আসতে দেখে, হয়তো মনের কোনো কালো কোষাংশ ওর কাছে চলে যাওয়ার জন্য তাড়না দিচ্ছিলো! ইউশার সঙ্গে কথা বলার জন্য উত্তেজনা সৃষ্টি করছিলো। কিন্তু তার বিবেচক মন স্বইচ্ছায় তা প্রত্যাখ্যান করলো। মন থেকেই সে তা প্রত্যাখান করেছে। মস্তিষ্কের বিবেকের চেয়ে মনন-বিবেক ঢের শক্তিশালী!
কাউকে ঠকিয়ে সে কোনোদিন সুখী হবে না। তাও আবার এমন কারো জন্য আয়নাকে ঠকাবে, যার কাছ থেকে নিজেই প্রতারিত হয়েছে। এমন লেইম শীট কোনোদিনই তার দ্বারা সম্ভব না। তাছাড়া ইউশা তাকে এখন কিইবা বলবে? সর্যি বলবে? আদৌ দুঃখ প্রকাশে কিছু আসে-যায়? ওসব ভদ্রতা তো বইয়ের পাতায় যুৎসুই। তাকে ফিরে যেতে বলবে? ফিরে যাওয়া কী সম্ভব?
উহু! তার আর আয়নার সম্পর্ক ততোখানি এগিয়ে গিয়েছে, যতোখানি আগালে আর কোথাও ফেরত যাওয়া যায় না। পারিবারিক ভাবে বিয়ে তাদের। মনে মনে চাচ্ছে সবটা যেন সুষ্ঠু ভাবে হোক।
কাজী সাহেবে এসে বসলেন। কাবিননামায় পাতা উল্টাচ্ছিলেন উনি। আর একটু পর বিয়ে পড়ানো শুরু করবেন। ওইযে ওই নিকাহনামায় তাদের দুইজনের নামে একটা চুক্তিপত্র লেখা আছে যেখানে সাফ জানান দিচ্ছে, আজকে এই নিকাহনামায় স্বাক্ষরের মাধ্যমে সে আয়নার ভরণপোষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। এতোবড় দায়িত্ব তো সহজ কথা নয়! কারো সস্তা কলে এমন শক্ত দায়িত্ব ঠুনকো হয়ে যাবে না নিশ্চয়ই!
কাজী সাহেব বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। বললেন, দশ লক্ষ্য টাকা ধার্য ধরিয়া……….. সমুদ্র সবটা শুনলো না। বেশ অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে।
কাজী সাহেব একদম শেষে বললেন, ” বলো মা কবুল।”
সমুদ্র চেয়েও একমুহূর্তে মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। নিশ্চয়ই বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে সকলে তাকে বেহায়া উপাধি দিবে? বউ? আসলেই বউ? হ্যাঁ বউ তো। তবে এখনো কবুল বলেনি। তখনই কানে এসে বাজলো আয়নার কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর। সে তিনবার কবুল বলে দেয়। তারপর মনে হয় কান্নাও করে। ওকে ঘিরে ইতিমধ্যে সকলে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র মাথা উঁচু করে তাকালো।
এবারে কাজী এগিয়ে এসে তার প্রয়োজনীয় কথা সেড়ে তাকে কবুল বলতে বলে। সমুদ্র দু’দণ্ড অপেক্ষা না করে বলে দেয় সেই ঐতিহাসিক শব্দটি। কাবিননামায় তার স্বাক্ষর নিলো। তিনি মোনাজাত ধরলেন। তারপর শুকনো খেজুর বিতরণ হলো। এতো দ্রুত বিবাহের কার্যক্রম সম্পন্ন হলো যে আর অন্য কিছু ভাবার সময় সে পায়নি।
সমুদ্রকে আয়নার পাশে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আয়নার মাথায় ঘোমটা দেওয়া। তাকে ঘোমটা তুলে দিতে বলা হয়। সে দু’হাত এগিয়ে এনে আস্তে করে নেটের কাজ করা দোপাট্টা সরিয়ে নেয়। ফলে আয়নার সঙ্গে আজ এই প্রথম সরাসরি অধিকারস্বরুপ চোখের সাক্ষাৎকার ঘটে। আয়নাও তার দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখ ভেজা-ভেজা। চোখের পাপড়ি ভিজে উঠেছে বিধায় ঘন-ঘন চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। তাদের দুইজনের অনেকগুলো ক্যামেরায় ছবি তুলে নেওয়া হচ্ছিলো। অনেকেই এই মুহূর্ত গুলো স্মৃতিস্বরুপ রেখে দিতে চাচ্ছেন।
সমুদ্র আয়নার পাশে বসেই সেন্টার টেবিল থেকে টিস্যু পেপার টেনে এনে আয়নার হাতে গুঁজে দেয়। আয়না টিস্যু হাতে নিয়ে একপল ওনার দিকে তাকায়।
আলিয়া একটা সুন্দর কাজ করা আয়না এনে বললো, ” দুলাভাই, আপাকে এবারে একটু আয়নায় দেখুন।”
–” সরাসরি তো আয়নাকেই দেখছি। আবার আয়নায় আয়নাকে দেখা লাগবে?”
আলিয়া বলে, ” জি দেখা লাগবে।”
সে সমুদ্রর দিকে মিরর তাক করে রাখলো। সমুদ্রের চোখের সামনে আয়নার প্রতিবিম্ব ভেসে উঠে। ওর নাজুক মুখপানে তাকিয়ে দু’পল সময় নিলো সমুদ্র। এরেঞ্জ ম্যারেজ তাদের। কী বলা উচিৎ? প্রেম-প্রেম কোনো পাঞ্চ লাইন মুখ দিয়ে বের হবে না তার! এতো প্রেম নাই মনে।
সে মিহি কন্ঠে বলে উঠে, ” নব্য প্রস্ফুটিত দায়িত্ব”
সমুদ্রের ভারী বাংলা বুঝি বোধগম্য হয় না কারোরই। তবু তারা হাততালি দিলো। যদিও আরোও রোমান্টিক কিছু শুনতে চাচ্ছিলো সবাই। এবার আয়নার পালা৷ কিন্তু বোকা মেয়েটা লজ্জায় নিজেই মাথা নিচু করে ফেলে। ও আর কী জবাব দিবে৷ সমুদ্রের প্রতিবিম্ব কি ও দেখেছে?
আয়না মিনমিন আওয়াজে কাচুমাচু করে অনেক আস্তে জবাব দিলো, ” আমার স্বামী।”
সমুদ্রের যেন উত্তর শোনার পর বুকে খুব প্রশান্তি এসে আঁছড়ে ঢেউ তুলে। অস্থিরতা নিপাক যায়৷ সে ঘাড় ঘুরে নিজের সদ্য বিবাহ করা বউয়ের দিকে তাকালো মুগ্ধ চোখে। আয়না ফের লজ্জায় কাত হয়ে মাথা নিচু করলো। উনি ওভাবে তাকিয়ে কেন আছে? লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। সে আস্তে করে বলে, ” প্লিজ অন্যদিকে তাকান।”
সমুদ্রও আস্তে করে বলে, ” শুনি নি কি বললে? তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে বলছো? ঠিক আছে থাকলাম এভাবেই। সমস্যা নেই।”
ওনার এমন স্বভাবটা দেখলেই আয়নার গা-জ্বালা দিয়ে উঠে। সবসময়ই যা ইনপুট দেওয়া হয় ওনি এমন এক মেশিন ইনপুটকে উলটো করে আউটপুট বের করবে। ফালতু!
আয়নার বড় ফুপুর ছেলে রাসেল ভাই ক্যামেরা এনেছেন। উনি বলে উঠলো, ” তোমাদের কিছু কাপল পিকচার তুলবো। দেখি একটু কাছে এসে বসো।”
সমুদ্র প্রথমে ভদ্রতাস্বরুপ আয়না থেকে খানিকটা দূরত্ব নিয়ে বসেছিলো। এবারে ওকে আর পায় কে? ও যেন এমন কিছু শোনার অপেক্ষাতেই ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে আয়নার গা ঘেঁষে বসে, কোমড়ে ডান হাত আলতো করে রাখলো। ওনার ছোঁয়া পাওয়ামাত্র আয়নার শিরদাঁড়া কেঁপে উঠে। ইশ! পবিত্র ছোঁয়াতেও এতো বেশি দ্বিধা! কেমন অস্বস্তিতে নিশ্বাস আটকে আসা আসা ভাব!
ছবি তুলার পর একটা ছবি ওদেরকে দেখানো হলো। সমুদ্র ফোন হাতে নিয়ে ছবিটা দেখলো। সে ভেবেছিল তাকে বরবেশে একদম ভালো দেখাবে৷ কিন্তু এই সাদা-সোনালী মিশেলের শেরওয়ানিতে তাকে দারুণ মানিয়েছে। আবার মা যখন জোর করে পাগড়ি পরিয়ে দিলো, তখন জীবনে প্রথম সমুদ্র নিজেকে দু’বার মিররে দেখেছে। নিজেকে বরবেশে দেখে সে নিজেই পরিতৃপ্ত!
ছবিগুলোও দারুণ তুলেছে কাজেই ওকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আমাকে ছবিগুলো দিয়ে দিও আয়না।।”
আয়না ঠেস মেরে বললো, ” মেইল করে?”
সমুদ্র তার দিকে সামান্য অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, ” পিডিএফ আকারে দিও, কেমন? ”
আয়না মুখ ঘুরিয়ে নেয়৷ কি শখ! বিয়ের ছবি নিবে তাও নাকি পিডিএফ করে সেন্ড করতে হবে।
সে বিড়বিড় করে বলে, ” মামা বাড়ির আবদার নাকি?”
সমুদ্র কাছে থাকায় ওর বিড়বিড় করে বলা কথাটা শুনে ফেলে সুধালো, ” শ্বশুড়বাড়ির আবদার!”
আয়না বিষ্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকায়। সমুদ্র তার বিখ্যাত ভ্রু নাঁচার ভঙ্গিমায় হাসলো।
খাওয়ার জন্য তাদের ডাক পড়লো৷ ওদের জন্য সব স্পেশাল আয়োজন। একটামাত্র বড় থালিতে দুইজনকে খেতে দেওয়া হয়েছে। সমুদ্র সামান্য ইতিউতি করতে লাগে। অন্য কারো সাথে সে আবার শেয়ার করে খেতে পারে না। তবে আজ সে চুপচাপ থাকলো। তার বাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা খেয়ে নিয়েছে৷ মাকে দেখা যাচ্ছে সবার গল্প করছেন। মা যে অনেক খুশ সেটা তার অভিব্যক্তিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। আর তার বাবা ইশরাক রহমান আয়নার দাদার সঙ্গে বসে কথা বলছে৷ শায়লা চৌধুরীও উপস্থিত আছেন। ঘরোয়া আয়োজন হওয়ায় আত্মীয়রা নিজেদের মতো গল্প করছেন।
আয়নার ফুপু খাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে থাকলো। যদিও তারা দুইজনের কেউই ঠিকঠাক খেতে পারছে না৷
ফুপু বললেন, ” জামাই বাবা, আয়ু কিন্তু আমাদের খুব আদরের বাচ্চা। ছোট মানুষ কিন্তু ও৷ ওকে তুমি যত্নে রাখবে৷ ”
এমন সময় আয়নার দাদী, সেকালে চিন্তার সরল মনের বৃদ্ধা বলে উঠে, ” কে ছোট মানুষ? জামাই বাবুর সঙ্গে আয়ুর দু’টা বছর আগে বিয়ে দিলে আজ আয়ুর কোলে একটা দুধের বয়সী খোকা থাকত।”
আয়না এমনিতেই লজ্জা পাচ্ছিলো। দাদীর এমন বেঁফাস কথায় তার মুখ-চোখ লজ্জায় একদম টমেটো বনে যায়। ইশ দাদী কেন এসব কথা বললেন? এখন কিভাবে সে ওই বজ্জাত লোকটার দিকে তাকাবে? সমুদ্রও যেন সামান্য চঞ্চল দৃষ্টি ফেলে নানান দিকে।
আয়নার ফুপি বলে উঠে, ” আম্মা কি যে বলো না!”
দাদী এবারে সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” জামাই বাবা, বলো তো আমাদের আয়ুর এবার তাড়াতাড়ি কোল পূর্ণ না উচিত না?”
সমুদ্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠে, বুঝ পায় না কেমন জবাব দিবে? তাই থেমে থেমে বলে, ” জ্বি, তাতো অবশ্যই।”
দাদী হাসিমুখে বললো, ” তাড়াতাড়ি আমাদের আয়ুর কোলে তাহলে একটা পুত আনো বাবা।”
এবারে দাদী কথায় ছেলে হওয়া সত্তেও নিজেরই লজ্জা লাগলো তার। এসব কি যে বলে মুরুব্বি বৃদ্ধরা! স্পার্ম ও দেড়টা মাস সময় নেয়, অথচ বৃদ্ধা দাদী দেড় মিনিটও সময় দিচ্ছেন না! তারা এমনিতেই খেতে পারছিলো না৷ এমন রসালো আলাপে কেবল চামচ নড়াচড়া করতে থাকে।
আয়নার ফুপি বলে উঠে, ” আরে না আম্মা। এতো আগেই বাচ্চা-কাচ্চা নেওয়ার দরকার নাই। আগে ওরা নিজেরা নিজেদের লাইফ ইঞ্জয় করুক। বাচ্চা-কাচ্চা নিলে দুধ খাওয়াইতে আর প্যাম্পপাশ পড়াতেই দিন-রাত যাবে।”
আয়নার আর একমুহূর্ত এসব শুনতে ইচ্ছা করছে না৷ লজ্জায়- শরমে গা গরম হয়ে আসছে৷ মনে হচ্ছে, এখনি মাটি ফাঁকা হয়ে যাক, সে মাটির নিচে গিয়ে কিছু দিন পালিয়ে থাকবে।
সমুদ্র তাদের কথায় সামান্য হাসলো। এরপর আয়নাকে আস্তে করে বলে, ” এতো যে লজ্জায় লাল হচ্ছো। পরে সালাদে টমেটো চাইলে ওনারা ভুল করে তোমার গালটা খেতে দিয়ে দিবে তো। তখন কি করব আমি? হু?”
কেমন বদমাশ লোক! ইচ্ছে করে জ্বালানো হচ্ছে! উফ এতো অসহ্যকর কেন উনি?
খাওয়ার পর্ব শেষ করে যখন আয়না বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বিশাল এক বিপত্তি ঘটলো। আয়নার ঘোমটার কোণা গিয়ে সমুদ্রের হাতঘড়ির চেইনের সঙ্গে আটকে যায়। কি এক ঝামেলা!
আয়না বাম হাত দিয়ে ঘোমটা ধরে টানাটানি করা শুরু করে, কিন্তু লাভের মধ্যে লাভ যা হলো আরোও প্যাঁচিয়ে গেলো ঘড়ির চিকন চেইনের সঙ্গে! সে কি করবে বুঝে পায় না।
আস্তে করে বলে, ” আপনার ঘড়িটা খুলে ফেলেন না।”
–” কেন?”
–” দেখছেন না, আপনার ঘড়ির সঙ্গে আমার আঁচল আটকে গেছে।”
সমুদ্র আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলে, ” এভাবেই থাকুক। সমস্যা কোথায়?”
–” সমস্যা আপনার মাথায়।”
–” গোটা তুমি সহ তোমার আঁচলও তো দূরত্বে চাইছে না। আর দোষ দিচ্ছো আমাকে?”
__________________
২ অক্টোবর তারিখটা যেন ভীষণ অভিশপ্ত হয়ে ঠেকলো ইউশার কাছে। এতোবার কল-ম্যাসেজ দেওয়া সত্তেও সমুদ্র তার ফোন রিসিভ করেনি বরং ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। একটু আগেই তাদের পুরাতন ফ্রেন্ডস স্কোয়াড গ্রুপটায় তাদেরই এক ফ্রেন্ড সমুদ্রের বিয়ের ছবি সেন্ড করলো। সেটা দেখার পর থেকে কোনোকিছুই ভালো লাগছে না ইউশার। সমুদ্রের আসলেই বিয়ে হয়ে গেলো আজ! তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে মানতেও পারছে না সমুদ্র অন্যকাউকে বিয়ে করবে। এতোদিন যাবত ভেবে এসেছে সমুদ্র কেবল তারই ছিলো। কিন্তু আজ থেকে সমুদ্র অন্যকারো! ওরা ডিরেক বিয়ে করে নিলো কেন?
ইউশা হাতে থাকা ফোনটায় ওদের বিয়ের ছবি আরেকবার দেখে একা একা বলে উঠে, ” মেয়েটা কী খুব সুন্দর? আমার থেকে বেশি সুন্দরী তো নয়। তাহলে কেন সমুদ্র তার ফোন না ধরে, তার কথা না শুনে এই মেয়েকে বিয়ে করে নিল? সমুদ্র না আগে বলত সে ইউশাকে ছাড়া বাঁচবে না? আজ কি হলো তবে?”
সে প্রচন্ড শব্দ করে ফোনটা ফ্লোরে চটকা মারে। এরপর গম্ভীরমুখে বললো, ” ফা৷৷(ক হিজ ম্যারিড লাইফ!”
চলবে।
#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–12
রাত তখন দশটা বাজছিলো। সন্ধ্যার পর থেকে আবহাওয়া বেশ খানিকটা খারাপ হতে থাকে৷ ঝড়ো বাতাস বইছিলো। শীতল, মিহি, হিমেল হাওয়ায় মন খারাপের সুবাস ছিলো বুঝি। থেকে থেকে মেঘ চমকাচ্ছিল। বিজলি পড়ার শব্দ কানেও এসেছে বার কয়েক। সমুদ্রকে বাসরঘরে বসতে দেওয়া হলো। আজকে আকদ ছিলো জন্য বউ নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি যাওয়া হবে না। ফলাফল সমুদ্রই আজকে তার শ্বশুড়বাড়ি রাত্রি যাপন করবে। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা মাফিক আয়নার রুমেই সুন্দর করে ফুল দিয়ে একদম সিম্পেলভাবে সাজানো হয়েছে। অতিরঞ্জিত কিছুই নেই। তবুও কেমন বিশেষ কিছুর শোভা পাওয়া যাচ্ছে। শোভাবর্ধক ট্রেতে একপাশে বাদাম আর একটা কাঁচের গ্লাসে গরম গরম দুধ সঙ্গে হলুদ-কেশর মিশিয়ে দিয়েছে, সেটা রাখা হয়েছে। ট্রে’তে গোলাপের লাল পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা। এমনকি বেডের কভারের উপরেও ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজানো। এবং বাড়তি বলতে সেন্টার টেবিলে একটা ফুলের ব্যু’কে রাখা।
ওমনি সময় আয়নাকে এ’ঘরে আনা হলো। সঙ্গে ওর দাদী আর ফুপু ছিলো। ওর শাড়ি বদলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শাড়ির কথা মনে পড়তেই সমুদ্রের চাপা হাসি চলে আসলো। ঘড়ির চিপায় আটকে যাওয়ায় আর কোনোভাবেই ঘোমটার আঁচল চেইন থেকে মুক্ত করা যাচ্ছিলো না। সবার চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র ঘড়ি খুলে ফেলেছিলো। পরে আঁচলের সাইড কেটে ফেলা লেগেছে৷ আপাতত সে দরজার দিকে তাকায়। আয়নাকে সুতির একটা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। চুল খোপা করেছে ও। সমুদ্রের মনে হলো অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ ওকে বেশ বড় লাগছে। মাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং সেকেন্ড ইয়ায়ের স্টুডেন্ট ও। তবে এই মুহূর্তে বয়সে বেশ বড় লাগছে৷ দাদী আবার রুমে ঢুকার আগে ওর মাথায় আঁচল তুলে দিলো। এরপর রুমে আসতেই সমুদ্র নড়েচড়ে উঠলো। সে বুঝে পায় না এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? জীবনে প্রথমবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে তাই সম্পূর্ণ ক্লুলেস।
দাদী আয়নাকে টেনে সমুদ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো, ” জামাই বাবা, এইযে তোমার বউকে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। তুমি তোমার বউকে বুঝায় নাও।”
এমন কথার বিপরীতে কি বলা দরকার সমুদ্র বুঝে পায় না। সে মাথা চুলকানো শুরু করে। আয়নাও মাথা নিচু করে গুটিসুটি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। ফুপি পরিবেশ হাল্কা করার জন্য আয়নাকে সমুদ্রের পাশে বসিয়ে দিয়ে দুইজনের হাত একসঙ্গে করে বলে, ” তোমরা সবসময় হাসি-খুশি থাকো।”
সমুদ্র সৌজন্যতার হাসি হাসে। আয়নার তখন লজ্জায় ঠোঁট তিরতির করে কেঁপে উঠে। ওনারা যাওয়ার সময়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যায়। চোখের সামনে ঘরে কেবল দুজন প্রানী উপস্থিত থেকে গেলো। সমুদ্র হাত ছাড়ছে না দেখে ওর বেশ অস্বস্তি হতে লাগে৷ সে আলতো করে সরাতে চাইলে, সমুদ্র আরেকটু চেপে এসে বসে বললো, ” সেদিন সরল মনে আঘাতপ্রাপ্ত কপালে হাত বুলাতে চেয়েছিলাম কেমন চুরা–ইলের মতো বিহেইভ করলে, দ্যাখো আজ তোমার বাড়ির মানুষ-জন তোমাকে আমার কাছে রেখে দিয়ে চলে গেলো।”
আয়না তার চোখের দিকে তাকায়।
সমুদ্র বলে উঠে, ” দিস ইজ দ্যা পাওয়ার অফ ম্যারিজ।”
আয়না মনে মনে ভাবে আসলেই তো তাই, এতোদিন বাবা কঠোরভাবে বলে আসলো কলেজ-ভার্সিটিতে কোনো প্রেম-ট্রেম না করতে, ছেলেদের সঙ্গে মেশা একেবারেই যাবে না, আর আজ আয়োজন করে তাকে একটা ছেলের সঙ্গে পাঠায় দিচ্ছে!
তবে আয়না বলে উঠে,” আপনি আমাকে চুরাইল বললেন?”
–” ঠিক তা বলিনি।”
–” তাহলে কী বলতে চাইছিলেন?”
সমুদ্রের কাছে বুঝি কোনো যুক্তি নেই বিধায় সে টপিক চেঞ্জ করে বলে উঠে, ” যাও ট্রে’টা এখানে নিয়ে আসো।”
আয়নার ট্রের দিকে তাকায়। ওনার এখন খেতে হবে কেন? একটু আগেই কতোগুলো খাবার খেল!
সে হাত বাড়িয়ে ট্রে আনে সমুদ্রের সামনে। আয়না ট্রে হাতে বসে থাকে। সমুদ্র আয়েসী ভঙ্গিমায় একটা বাদাম তুলে নিয়ে মুখে পুড়ে৷ তারপর বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখে বেশ জোরে বাতাস বইছে। আজ বোধহয় জোরে করে বৃষ্টি হবে। কে জানে?
তারপর দুধের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে বললো, ” শোয়ার আগে গরম দুধ খেলে ঘুম ভালো হয়। তোমার ঘুমের সমস্যা আছে?”
আয়না ট্রে হাতে মাথা নাড়িয়ে জানান দিলো তার ঘুমের সমস্যা হয় না। সমুদ্র ঢক ঢক করে সম্পূর্ণ দুধ খেয়ে ট্রেতে রেখে দেয় গ্লাস। আয়না যখন ট্রে টেবিলে রাখতে পা বাড়ায় উনি বলে উঠে, ” গরম দুধের আরোও একটা বিশেষ উপকারিতা আছে যেটা রাতে বেশ কাজে আসে।”
আয়না বুঝলো না সমুদ্র কি বলছে। বারান্দার দরজা খোলা ছিলো। হুরহুর করে বাতাস আসছিল। সেই সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামার আওয়াজ পাওয়া যায়৷
সে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় এবং বললো, ” আপনি ফ্রেশ হবেন না?”
–” না।”
–” সেকি কেন?”
–” এক্সট্রা কোনো কাপড় আনা হয়নি।”
আয়না চটজলদি আলমারি থেকে একটা সাদা রঙের সুতির পাঞ্জাবি বের করে ওনার সামনে ধরলো। সমুদ্র মনে হয় খুশিই হলো। সে হাত বাড়িয়ে কাপড় নিয়ে সোজা হাঁটা ধরে ওয়াশরুমের দিকে। সমুদ্র যখন বাথরুম থেকে বের হয় তখন বৃষ্টির বেগ এতো বেড়ে গেছে যে রুমের ভেতর বৃষ্টির পানি এসে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছিলো। সে বাধ্য হয়ে আয়নাকে বলে, ” বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলে ভালো হয়।”
আয়না যেন ওনার এইকথায় সামান্য বিচলিত বোধ করলো। বোধহয় একটু ভয়ও পেল। তবুও বারান্দার দরজা লাগিয়ে ভেতরে আসে। এতো অল্প মুহূর্তেই ওর শাড়ীর আঁচলে পানি লেগে ভিজে ওঠে। সমুদ্রের চোখ এড়ালো না বিষয়টি।
সে বললো, ” ফ্যানের সামনে বসো। বাতাসে ভেজা অংশ শুকিয়ে যাবে।”
আয়না বাধ্য মেয়ের ন্যায় সমুদ্রর পাশে এসে বসে পড়লো। হাল্কা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগলো। বাতাসে চুল গুলো কিঞ্চিৎ উড়াউড়ি শুরু করে। সে চুল সামলাতে ব্যস্ত হলে, আঁচল ওড়ে, আবার আঁচল সামলাতে গেলে চুল বাতাসে নাচানাচি শুরু করে৷ কি এক মসিবত! ওনার উপস্থিতি যেন আয়নাকে ভেতর থেকে গুড়িয়ে দিচ্ছে। সবকিছুতই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যা করতে যাচ্ছে সেটা করতে পারছে না৷ আয়নার ধারণা হলো সমুদ্র নিশ্চয়ই তাকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিচ্ছে। মনে মনে ভাবছে মেয়েটা গুড ফর নাথিং!
সমুদ্র নিজের হাত বাড়িয়ে ওর শাড়ির নরম আঁচলখানা মেলে ধরলো। ফ্যানের বাতাসে আঁচল তিরতির করে নড়তে থাকে। নাকি আয়না কেঁপে উঠছে বোঝার উপায় নেই। সমুদ্র তখনো ওর আঁচল সমেত ধরে বসে আছে। আয়না ভুলেও ওনার দিকে তাকাচ্ছে না।
সমুদ্র তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” তোমার দাদীর কথা শোনা যাবে না।”
আয়না তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো।
সমুদ্র দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, ” তোমার কোলে এখনি পুত আনা যাবে না। নাহলে দেখা যাবে বাচ্চাকে ফিডার খাওয়াতে গিয়ে বাবু নিয়ে উলটে পড়ে আছো!”
ওনার রসিকতা পূর্ণ বাক্যগুলো শ্রবণ মাত্র আয়নার তখন অবস্থা নাজেহাল। শরম-রাগের সংমিশ্রণে সে মুচড়ে উঠে ভেতর ভেতর। মন চাইলো এই রুম থেকে, ওই বদমাশ লোকটা থেকে পালিয়ে যেতে!
সমুদ্র সামান্য ঝুঁকে আসে তার দিকে। আয়নার ওইক্ষণে ভীষণ ভয় লাগা কাজ করে। তবে কি এখনই?ওনার মতো লোককে না বলার সাহস নেই আয়নার মধ্যে। তার উপর উনি যতোটা রাগী! যদি আয়নাকে দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দেয়?
–” তুমি কি নার্ভাস হয়ে গেলে নাকি?”
আয়না উত্তর দিতে পারে না৷ উনি ফের প্রশ্ন করে, ” কোনো কারণে ভয় পাচ্ছো?”
আয়না মাথা নাড়িয়ে একবার না বলে, পরক্ষণে হ্যাঁ বলে, ফের না সূচক অর্থ প্রকাশ করে৷ আবার হ্যাঁ বোধক ইঙ্গিত দেয়।
সমুদ্র মুখ উচ্চারণ করে বলে, ” বুঝেছি।”
কাছাকাছি আসার ফলে সমুদ্র খেয়াল করে ওর মেহেদীর রং বেশ গাঢ় হয়েছে৷ একদম গাঢ় খয়েরী। সে ভারী অবাক হলো। কালকেই না কেমন হাল্কা কমলা ছিলো। আজ হুট করে কিভাবে এতো গাঢ় রঙ আসলো? সে হাত বাড়িয়ে আয়নার দু’হাত ধরে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে আয়না যেভাবে কেঁপে উঠলো — সমুদ্রের মনে হতে থাকে খিচুনির রুগী দেখলো সে। নিজের হাতে ওর হাত গুলো ধরে রেখে প্রশ্ন করলো, ” মেহেদীর রঙ অনেক গাঢ় হয়েছে!” এরপর আয়নার দু’হাতের মেহেদীর ঘ্রাণ নিলো নাক দিয়ে। ফলে ওনার ঠোঁটের অল্প পরিসরের ছোঁয়া এসে আছড়ে পড়ে আয়নার তুলতুলে টুকটুকে মেহেদী পড়া হাতে। আয়নার কম্পিত শরীরের কার্যক্রম স্পর্শ না করেও টের পায় সমুদ্র।
আয়নার ডান হাতের তালুতে একদম মাঝে সমুদ্রের নাম লিখা হয়েছে। সমুদ্র ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আসো, শুয়ে পড়ো। তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব। ”
আয়না উঠে আসতে ধরলে, সমুদ্র প্রশ্ন করে, ” বেডের কোন সাইডে শোয় তুমি? কিনারে নাকি দেয়লারে দিকে?”
আয়না উত্তর দেয়, ” মাঝখানে। ”
–” মাঝখানে কেন?”
–” মনে হয় কিনারে শুলে বেড থেকে পরে যাবো।”
–” তুমি দেয়ালের দিকে শোয় তাহলে।”
আয়না উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো।
সমুদ্র প্রশ্ন করে, ” ড্রিম লাইট কেন আবার ?”
আয়না বেডে এসে বসে জবাব দিলো, ” আমি অন্ধকারে শুই না তো এজন্য। ”
সমুদ্র পড়লো বিরাট বিপাকে। এমনিতেই ব্রেক আপের পর থেকে তার তন্দ্রার সমস্যা। ঔষধ নিয়েও কখনও ঘুম পূরুণ হয় না। তার উপর নতুন বিছানা, নতুন গন্ধ। ড্রিম লাইট জ্বলতে থাকলে চোখের পাতাই বন্ধ হবে কীনা সন্দেহ। তবে ড্রিম লাইট অফ করে দিতে বললো না সে। মেয়েটা এমনিতেই তাকে বাঘ-সিংহ ভেবে ভীষণ ভয়ে আছে, চাপে আছে। আবার রুম অন্ধকার করতে বললে ভয়ে কেঁদে ফেলতেই পারে! আয়নার জন্য এটা অস্বাভাবিক কিছু হবে নাহ।
আয়না তাকে টপকে বেডের ওদিকে বসে পড়ে৷ সমুদ্র তার দিকে একবার তাকিয়ে, অন্য দিকে ঘুরে শুয়ে পড়ে, এরপর আয়নার দিকে ঘুরে বলে উঠে, ” রিল্যাক্স, আমি চাই না কালকে সকালে তোমার জ্বর আসুক। সো কুল ডাউন! আরাম করে ঘুম দাও।”
আয়নার মুহুর্তেই সেই অপমান করার দিনটার কথা স্মরণ হলো। এই মানুষটা এতো লজ্জাজনক কথা কীভাবে বিনা দ্বিধায় বলে ফেলে? মুখে কোনো লাগাম নেই৷ কিচ্ছুটি আটকায় না মুখে!
আয়না সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ওদিকে মুখ করে শু’য়ে পড়ে৷ ওনার দিকে ভুলেও আর তাকাবে না। ইচ্ছা করে তাকে অপদস্থ করে সবসময়।
সমুদ্র সামান্য হাসলো। এরপর চোখ খোলা রেখেই শুয়ে থাকে। রাত কয়টা বাজে খেয়াল নেই। তবে আয়নার ভারী নিশ্বাসের শব্দ কানে আসে। একটু পর সে উঠে বসে । আয়না তখন ঘুমের ঘোরে এদিকে ঘুরে আসে৷
সমুদ্র উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু বারান্দার মেঝেতে বৃষ্টির পানি পড়ে আসে। সে পা মাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সিগারেট নেই জন্য আফসোস হলো। সিগারেট খেতে পারলে একটু আরাম পাওয়া যেত।
অনুভূতি কিছুটা বৃষ্টির মতো। বৃষ্টি থেমে গেলেও যেমনটা করে বৃষ্টির ফোঁটা রয়ে, তেমনি অনুভূতি মরে ফেললেও অবশিষ্ট কিছু স্মৃতি আজীবন রয়ে যায়।
এমনই এক বৃষ্টিমুখর রাতে সে আর ইউশা নিউক্যাসেল সিটিতে ঘুরতে গিয়েছিলো। থোরাক্স কার্ড শেষ হওয়ার পর ঘুরতে বেরিয়েছে দুইজনে। তখন কেবল রিলেশনের একদম প্রথম প্রথম। মাখো মাখো প্রেম। সি-বীজ ঘুরে ফিরে আসার পথে হঠাৎ বৃষ্টি পড়া আমম্ভ করলো। ইউশার শখ জাগলো ও বৃষ্টিতে ভিজবে৷ সমুদ্র আবার ইউশার সবধরনের শখ খুব শখ নিয়ে পূরণ করত। তারা যাওয়ার পথের বাস থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভেজে। একদম কোনো চিন্তা ছাড়া, লোকে কি বলবে এসব কিছু না ভেবেই দুইজনে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজলো। লাফালাফি, হাসাহাসি করলো। এরপর সমুদ্র হাঁটু গেড়ে বসে ওকে প্রোপোজও করলো। তখন অবশ্য বয়সে ছোট ছিলো। কেবল ফার্স্ট ইয়ারে ছিলো তাও প্রথম প্রেম, পাগলামির মাত্রা বেশি ছিলো। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করলো।
ভেজা পা নিয়েই রুমে ফিরে আসে, এবং বেডে বসতেই দেখে আয়না ঘুমের ঘোরে একদম বেডের মাঝে এসে ঘুমাচ্ছে। সমুদ্র একটু চেপে এসে আয়নার একদম কাছাকাছি শুয়ে খুব অধিকারবোধ থেকে আয়নার শাড়ির ভাঁজ কিঞ্চিৎ সরিয়ে দিয়ে ওর পেটে হাত গুঁজে দেয়। আয়না গভীর ঘুমেও নড়ে উঠে। ওর শাড়ি একদম এলোমেলো হয়ে আছে৷ সমুদ্র একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেন্টার টেবিলে ওর বন্ধ ফোন পড়ে থাকে।
ড্রিম লাইটের আলোয় খেয়াল হলো আয়নার চোখের কাছটায় একটা চোখের পাপড়ি অযত্নে পরে আছে৷ সে আস্তে করে পাপড়িটা সরিয়ে দিলো। ফুলেল বিছানায় একদমই ঘুম আসছিলো না৷ তবে আয়নার ঘুম দেখে সেও চোখ বন্ধ করে।
_____________________
সমুদ্রের ঘুম ভাঙ্গে আয়নার ডাকাডাকির শব্দে।
–” আর কতো ঘুমাবেন?”
সমুদ্র ঘুমু চোখে বলে, ” বাসর রাত পুরাটা ঘুমায় কাটিয়ে সকালবেলা চেচামেচি করছো কেন?”
ঘুম থেকে উঠেই এমন কথার তোপে পরে আয়না ফের লজ্জা পায়৷ এমনিতেই নিজের গায়ে কারো উপস্থিতি লক্ষ্য করে আজ দ্রুত ঘুম ভাঙ্গে। চোখ খুলতেই নিজের শরীরে ওনার পুরুষালি হাতের ছোঁয়া পেতেই আয়না চমকে উঠে বসে। আবার পরমুহূর্তে বেশ শরমবোধও করলো। সে নিজেই মাঝখানে একদম সমুদ্রের গায়ের কাছে ঘুমের ঘোরে চলে এসেছে সে খেয়াল ছিলো না৷
সমুদ্র উঠে বসে বললো, “জ্বর-টর আসেনি তো রাইট?”
আয়না উঠে দাঁড়িয়ে রুম ত্যাগ করে৷ সমুদ্র মনে মনে নিজের বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। নাস্তা সেড়েই বের হয়ে পড়বে৷
সে যখন নাস্তার টেবিলে আসে, তখন সবাই যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। দাদী তাকে খেতে দিলো। আয়নাও নাস্তা করছিলো।
দাদী জিজ্ঞেস করে, ” বাবা তুমি কি কি খেতে পছন্দ করো?”
আয়নাও কান খাড়া করে শুনার চেষ্টা চালায়। সে ধরে নেয় সমুদ্রের অনেক নামী-দামী খাবার পছন্দ। একে তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকত তার উপর বড়লোকের একমাত্র ছেলে।
সমুদ্র বলে উঠে, ” দেশী খাবার ভালো লাগে। যেমন: কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি, শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা,লাল শাক, করলা ভাজী সহ সব ধরনের দেশি খাবার পছন্দ। ”
আয়নার চোখ কপালে উঠে যায়। দাদী তার উত্তর শুনে খুব খুশি হলেন৷ প্রশ্ন করলেন, ” বাবা সবুজ কচুর ডাল খাও তো?”
–” জ্বি, আলুভর্তার সঙ্গে দারুণ লাগে।”
সকালে নাস্তা সেড়ে রুমে এসেই সমুদ্র মানিব্যাগ পকেট নেয়, তখন আয়না প্রশ্ন করে, ” কোথাও যাচ্ছেন?”
সমদ্র সুধালো, ” বাসায় যাচ্ছি আয়না।”
–” এখনই?”
–” হুম। যেতে হবে। শুনো ফোন দিলে ফোন ধরবা আর অফিস আসবে তাও রেগুলার। আসি।”
আয়নার একদম-ই ওনার দেওয়া বিদায় পছন্দ হলো না৷ ভীষণ মন ভার হলো। কী দরকার এতো জলদি যাওয়ার? কালকেই বিয়ে হলো? আজকেই কেন দূরত্ব? তবে মুখে কিছু বললো না।
একটু পরই সমুদ্র কে তার রুমে ফিরে আসতে দেখা গেল। ওনাকে দেখামাত্র আয়নার মন ভালো হয়ে যায়৷
সমুদ্র বলে উঠে, ” যেতে দিলো না। তোমার বাড়ির লোকজন আমাকে আটকায় রাখছে৷”
আয়নার ওনার কথা শুনে খুব আনন্দ লাগলো। ভালো হয়েছে! নতুন বিয়ে করে আপনাকে কেন এতো জলদি বাড়ি যেতে হবে? বউ রেখে বাসায় যাওয়ার তাড়া কেন?
সমুদ্র দু’বার সারারুম পায়চারি করলো। এরপর আয়নার কাছে ফিরে এসে বললো, ” আমার বাসার সবাই সন্ধায় আসবে। ডিনার করে তারপর যাব৷ আচ্ছা এতোক্ষণ সময় কিভাবে পাড় করব?”
–” জানি না তো!”
–” এক কাজ কর, গুগুলে সার্চ দিয়ে দেখো নবদম্পতিরা কীভাবে সময় কাটায়? হারি আপ!”
আয়নাও সরল মনে গুগলে সার্চ দিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে যেসব আর্টিকেল আসলো তাও ছবি সহ, ওগুলো চোখের সামনে আসামাত্র আয়নার লজ্জায় চোখ-মুখের অবস্থা করুণ! ওনার মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো।
সমুদ্র ওর অবস্থা দেখে শব্দ করে এই প্রথমবার হাসলো। আয়না এই প্রথম ওনাকে হাসতে দেখলো!
চলবে।
#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–13
বিকেলের দিকে আয়নাদের বাসা জমজমাট হলো। সমুদ্রের বাসার সকলেই এলো। ইশরাক রহমান, মিসেস রোদেলা এবং পিউ এসেছে। সঙ্গে স্পেশাল মেহমান হয়ে ইভানা ও তার ছেলে এসেছে। হৈহল্লা করতে করতে ডিনার শেষ করে সবাই আকদে দেওয়া গিফট খুলতে বসলো। সমুদ্রকে আয়নার পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো। সমুদ্রের পরনে গতরাতে সফেদ পাঞ্জাবিটাই রয়ে গেছে৷ ওর হাব-ভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছে নতুন জামাই। আয়নাও আজ শাড়ি পরেই আছে। একে একে সব গিফট আনপ্যাক করা হচ্ছিলো। মেয়ে পক্ষের আয়োজিত অনুষ্ঠান বিধায় বেশিরভাগ উপহার দেখা যাচ্ছিলো ঢালাওভাবে কণেকে উদ্দেশ্য করেই দেওয়া। শাড়ি, জুয়েলারি, জুয়েলারি বক্স কতো কি যে পেয়েছে উপহারে৷
সমুদ্র মুখ ফসকে বলেই দিলো, ” বিয়েতে সবচেয়ে লাভ আয়নারই হলো। সব গিফট তো ওর জন্যই।”
ইভানা আন্টি কথাটা শুনতে পেয়ে বলে উঠে, ” কি যে বলিস না! এইসব তো সমুদ্র তোর ভাগেরই উপহার !”
সমুদ্র খুব বিরক্ত ভরা চাউনি নিয়ে শাড়িগুলোর দিকে তাকায়। আন্টির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নাহলে কোনোদিন বলত যে শাড়ি নাকি সমুদ্রের ভাগের উপহার!
ইভানা আন্টি সমুদ্রের অভিব্যক্তি দেখে হেসে বললো, ” বিশ্বাস করলি না? দাঁড়া ব্যাটা দেখাই তোকে।” এরপর পাশে থাকা একটা ব্লেন্ডারের প্যাকেট ইশারা করে বলে, ” এই ব্লেন্ডারে আয়না জুস বানায় তোকেই তো খাওয়াবে, তাই না?”
সমুদ্র চোখ ছোট ছোট করে আয়নার দিকে তাকালো। আয়না একবারও ওর দিকে তাকায় নি৷ এতে সমুদ্রের ইগো হার্ট হলো। বাসায় গেস্ট আসার পর সমুদ্র দু’বার ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু কেন জানি আয়না ইতিউতি নানান উছিলায় তাকে ইগনোর করে আত্মীয়দের সঙ্গে বিজি ছিলো। তার থেকে এখন ওর কাছে আত্মীয়রাই বড় হয়ে গেলো?
এ’দিকে ইভানা আন্টি থেমে নেই। তিনি আরেকটা চায়ের কাপের সেট দেখিয়ে বলে, ” চা বানিয়ে তোকেই তো খাওয়াবে এই কাপ গুলো দিয়ে। তাহলে বল এসব উপহার কার কাজে বেশি আসছে। ওই বেড কভারে তুই-ই ঘুমাবি৷ তারপর এই যে এতো শাড়ি-জুয়েলারি এসব তোর বউই তো পড়বে৷ হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে তোর বউ-ই তো চুল শুকাবে। সব প্রফিট তো তোর ভাগেই গেলো। ”
সমুদ্রের ব্যবসায়ী মন অংক কষে জানান দিলো, আসলেই উপহার গুলো দিয়ে তার-ই ফয়দা হলো। সংসারে অন্তত একবছর আর কিছু কেনা লাগবে না। একদম যাওয়ার আগ বেলায় আয়না তার দিকে তাকিয়েছিলো। সন্ধ্যা থেকে ওর বুনন করা দূরত্বে সমুদ্র একবারও ওর পানে তাকালো না। বরং সবার আগে দরজা পেড়িয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা হলো৷
আয়নার দাদাভাই বলে উঠে, ” ডাক্তার সাহেব, ভালো থেকো। আগামীকাল আসবে না?”
আয়নার দাদার প্রশ্নে সমুদ্র নিজেই সকলের সামনে বেশ হতবিহ্বল হলো। মানে কালকে আবার কেন সে এ’বাসায় আসবে? একরাতে সে আয়নার এতোবড় দিওয়ানা হয়ে যায়নি সে প্রতিদিন এসে এসে ওর বদনখানা দেখে যাওয়ার লাগবে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টের পায়, আয়না তার দিকে জবাবের অপেক্ষায় অপেক্ষারত।
সে জবাবে বলে, ” কাল থেকে অফিস আমার।”
আর একটা শব্দও বেশি বলে না। ভাবখানা এমন, যেন বাড়তি একটা শব্দ বললে শ’খানেক ইউরো জরিমানা দিতে হয়!
ইশরাক রহমান সকলের কাছে বিদায় জানালেন। তবে ওইসময় আয়নার ভারী মন খারাপ হয়৷ সমুদ্র কী পারত না একবার ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে? সুন্দর করে কিছু মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলতে? ওনার এতো কিসের ভাব? অহংকার অনেক?
আয়না মন খারাপকে পুঁজি করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে।
______________
পরদিন সকাল থেকেই সমুদ্র অফিস যাওয়া শুরু করলো। ওর মধ্যে যেন কোনো পরিবর্তন নেই৷ ছেলেটা এতো কীভাবে অপরিবর্তিত রয়ে গেলো? বিয়ের পর সব ছেলেদের মধ্যেই পরিবর্তন আসে।
সকালবেলা মিসেস রোদেলা নাস্তার টেবিলে বসে ছিলেন। আজ পিউ-সমুদ্র একসঙ্গে খেতে আসে। দুইজনেই বের হবে। পিউ কলেজ যাবে একটা কাজে৷ ওকে সমুদ্র ড্রপ করে অফিস যাবে। সমুদ্র টেবিলে বসে।
মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” আজকে থেকেই অফিস যেতে হবে? আজ বউমাকে নিয়ে ঘুর। তোকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে না তোর বিয়ে হয়েছে। ধ্যাত!”
সমুদ্র কিঞ্চিৎ হাসলো। বিয়ে হলে আবার বোঝা যায় নাকি? সে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” বিয়ে হয়েছে জন্য কি এখন বউয়ের গলা ঝুলে থাকতে হবে? ”
–” ঠিক তাই! আমি তো ভেবেছি তুই বউমার বাড়ি থেকে আসতেই চাইবি না।”
সমুদ্র ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। তার বাড়ির মানুষ-জনও পাগল এক প্রকার৷ একদম আয়নার মতো।
পিউকে ড্রপ করে অফিস আসার পর হঠাৎ তার কেমন যেন আজব অনুভূতি হতে থাকে৷ মন হচ্ছে অফিসের সবাই জেনে গেছে তার বিয়ে হয়েছে। সমুদ্র বাবাকে একটা শর্ত দিয়ে এই বিয়েতে রাজী হয়েছে। শর্তটা হলো আকদ হওয়ার সময়ে অফিস বা প্রোফেশনাল লাইফের কেউ যেন না জানে বিয়ে হচ্ছে। পরে সময়-সুযোগ মতো জানানো যাবে৷ কাজেই পারিবারিক পরিসরে বিয়ে হওয়ায় অফিসের কেউই জানে না। সে স্বাভাবিক থাকার প্রচেষ্টা চালালো বেজায়৷ কিন্তু কোথায় জানি সবকিছুই অন্যরকম লাগে তার৷ মন খচখচ করে বড্ড। দুইবার আয়নার ডেস্কের সামনে গিয়ে দেখে এসেছে৷ ডেস্ক আজ খালি৷ ও নিশ্চয়ই আজ আসবে না। কেন যে মেয়েটা এতো এবসেন্ট থাকে। অসহ্য! লাঞ্চ ব্রেকে সমুদ্র একটু বাইরে গেলো৷ এমনি ছটফট লাগছিলো বিধায় গলির পেছনে দাঁড়িয়ে টংয়ের দোকানে চা খেয়ে সিগারেট ধরালো৷ সিগারেট শেষ করে অলস পায়ে অফিস ফেরত আসে। তখন দুইটা বাজছিলো। পার্ট টাইম জুনিয়ররা দু’টো বাজে অফিসে আসে৷ সমুদ্রের মনে হলো যদি আজ আয়নাও ওদের সঙ্গে আসে তবে একবার চোখের দেখাটা অন্তত হবে। এসব ভেবে সে ঘুরে ঘুরে আয়নার ডেস্কের সামনে দিয়ে নিজের কেবিনে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিলো৷ কোনোকিছু মনে মনে ভাবলে, সেরকমটাই যদি ঘটে তবে সাময়িক একটা খুশি লাগে। সমুদ্রও সাময়িকভাবে খুশি হলো। আয়না ওর ডেস্কে বসে ওয়ান টাইম কাপে কফি খাচ্ছে৷ আজ ও সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে সঙ্গে চুন্ডির লাল ওড়না। ওর মধ্যে নববধূ ভাব রয়েছে৷ লাল ওড়নাটার জন্য? আজ ও মাথায় কাপড় দিয়ে এসেছে।
সমুদ্র ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। সে ইচ্ছা করে ফোন হাতে নিয়ে আয়নার ডেস্ক ক্রস করলো৷ সাধারণত জুনিয়ররা তাকে দেখলে কুশল বিনিময় করে। সালাম দেয়। তাদের অফিসে রুলস আছে, অফিসের কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে সুন্দর করে ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হবে৷ সমুদ্র আশায় ছিলো আয়না তাকে গুড নুন উইশ করবে৷ কিন্তু বিধিবাম! আয়না যেন তাকে দেখলোই নাহ! একদম কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিতে লাগে৷ যেন সমুদ্রের কোনো অস্তিত্ব ই নেই। সমুদ্রের রাগ হলো। আসছে উনি! এমন ভাব যেন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করে মাইক্রোসফট উদ্ধার করছে! আহা এইসব চুনোপুঁটি বাচ্চা সিএসই ইঞ্জিনিয়ারের ভাব দেখলে হাসি পায়৷ একবার বাগে পাই তোমাকে, তখন বাসার রান্নাঘরে সাইনবোর্ড লাগানো হবে যেখানে বড় অক্ষরে লেখা থাকবে ” এখানে CSE ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ভাত রান্না করা হয়।”
সমুদ্র কেবিনে গিয়ে বসে পড়ে৷ প্রতি সপ্তাহের যেকোনো ডেটে জুনিয়র ইন্টার্ণদের নিয়ে তার কেবিনে একটা গোল মিটিং বসে। ডিসকাশন হয়, পরবর্তী সপ্তাহের কাজের প্লান করা হয়। এরপর কফি-কুকিজ খাওয়ানো হয়৷ সমুদ্র আজকে সবাইকে তার কেবিনে ডাকলো তিনটার দিকে। তখন আড়াইটা বাজছিলো। সে ঘড়ির দিকে চেয়ে থেকে বললো, ” মিসেস আয়না, স্বামীকে ইগনোর করলেন কিন্তু বসকে কীভাবে ইগনোর করবেন? জলদি আসুন৷ আম ওয়েটিং ফর ইউ।”
তিনটার দিকে সবাই এসে উপস্থিত হলো। আয়না সবার পরে আসলো৷ তখনো ওর মাথায় কাপড় দেওয়া। সমুদ্র সবার ফাইল চেক করছিলো। আয়নার বেলায় সে নিজ থেকে বললো, ” স্যার একজায়গায় ভুল হয়েছে৷”
সমুদ্র যেন এমন কিছুই শুনতে চায়৷ সে বলে উঠে, ” মিস আয়না আপনি প্লিজ এরপর থেকে জাস্ট বলবেন কোনগুলি ঠিক করেছেন৷ আমি বুঝে নিব বাকিগুলোতে ভুল আছে, সংশোধন প্রয়োজন। ”
সজল ভাইসহ টুম্পা আপুও হাসলো৷ এরপর সজল ভাই বললো, ” আয়না তো জুনিয়র। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে৷”
বোঝাই যাচ্ছে আয়না বেশ ক্ষেপে গেছে। টুপ করে ওর মাথা থেকে ওড়না পরে যায়। সমুদ্রের মন চাইলো, এক্ষুনি গিয়ে তার মাথায় আলতো করে ওড়না জড়িয়ে দিয়ে আসতে৷
সমুদ্র যেদিন প্রথম এই প্রোগ্রামটার জন্য আয়নার সিভি পায়, ওর সেমিস্টার ছিল ২:২। দেখামাত্র রিজেক্ট করে দেয়। কারণ সে ফ্রেশ গ্রাজুয়েট আর ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট নিতে চাচ্ছিলো৷ কানাডিয়ান এক কোম্পানির স্পন্সরশীপে তারা এই ইন্টার্ণ পার্ট টাইম প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করেছে৷ অল্প বেতন, লিমিটেড আওয়ার বেজড জব। ছয়মাস ট্রেনিং সহ কাজ করবে। একটা সার্টিফিকেটও পাবে৷ কিন্তু ইশরাক রহমানের স্পেশাল রেফারেন্সে আয়না এই প্রোগ্রামে সিলেক্টেড হয়৷ সমুদ্র তখনো জানত না আয়নাই সেই মেয়ে ৷ এখন বুঝে আয়না আসলে বউমা কোটায় এই অফিসে আছে৷ নাহ মেয়েটা মেধাবী। ঢাবিতে সিএসই পড়ে। বেশ ব্রিলিয়ান্ট। [ নোট: ঢাবি ক বিভাগ তথা বিজ্ঞান বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট :’কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’ রয়েছে৷ তথ্যটি অনেকের অজানা তাই বিশেষভাবে জানানো হলো। ধন্যবাদ ]
সমুদ্রের ভ্যান ভাঙ্গলো আয়নার ডাকে। আয়না কঠিন গলায় বলে, ” স্যার, আমাকে বিশ মিনিট দিন৷ আমি কারেকশন করে নিচ্ছি।”
সমুদ্র বলে, ” আপনি বসুন। আমি দেখছি। আর সজল ভাই, বাকিদের কাজ ঠিক আছে৷ আপনারা যেতে পারেন আজকে। কফি খান। রিফ্রেশ হন।”
সবাই মনের আনন্দে বের হলে, ওদের অনুসরণ করে আয়নাও বের হতে গেলে, সমুদ্র এক প্রকার ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো, ” আরে, আরে তুমি কেন যাচ্ছো। চুপচাপ বসো বলছি। ”
আয়না সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ে৷ সমুদ্র টুম্পাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আপু দুই কাপ কফির অর্ডার দিয়ে দিতে পারবেন? আর আয়নাও আমার সঙ্গে পাঁচটার দিকে মিটিংয়ে এটেন্ড করবে।”
–” ওকে স্যার।”
টুম্পা আপু যাওয়ার আগে আয়নার দিকে সুন্দর করে হেসে চলে যায়৷ আয়না একা কেবিনে রয়ে যায়৷
ও মন খারাপ করে বলে, ” ইচ্ছে করে আমাকে আটকিয়ে রাখছেন তাই না?”
সমুদ্র বললো, ” আমার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগছে না?”
–” উফ!”
সমুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে হাঁটা ধরে। সে বেশ ঘাবড়ে যায়। লোকটার মতিগতির ঠিক নেই৷ কিছু যদি করে? কিন্তু সমুদ্র তাকে ক্রস করে হেঁটে যাওয়ার সময় মাথার ওড়নাটা আলতো করে তুলে দেয়৷ সে নড়েচড়ে ওনার যাওয়ার পানে তাকায়। উনি ওয়াশরুমে ঢুকলো৷
আয়না ভেবেই কুল পাচ্ছে না কেন সমুদ্র অফিসের সবাইকে তাদের বিয়ের কথা হাইড করলো। আয়না বিয়ের পরেরদিন বাবার মুখে শুনেছে যে তাদের বিয়ের খবর অফিসে এখনো কেউ জানে না। তখন থেকে সমুদ্রর উপর একটা চাপা অভিমান কাজ করছে৷ তাকে সবার সামনে পরিচিত দিতে অসুবিধা কেন তার? দ্বিধা কেন? দরকারও নেই ওনার বউ হওয়ার পরিচয়ের। আয়নার নিজেরই শক্ত পরিচয় আছে। সে নিজে যখন ইঞ্জিনিয়ার আর নতুন করে ওনার পরিচয় লাগবে না৷ ওই ডাক্তার কী পারবে তার মতো ইঞ্জিনিয়ার হতে! হুহ।
সমুদ্র কেন জানি কফি খেল না। আয়নাও সেজন্য আর কফি মুখে নিলো না৷ তারা দুইজন মিটিংয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। আজ ড্রাইভার সঙ্গে আছে৷ পেছনের সীটে বসেছে দুজন। সমুদ্র হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। আয়নার তা দেখে ভারী মায়া হলো৷
সে সুধালো, ” আপনার মাথাব্যথা করছে?”
সমুদ্র চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দেয়, ” না। রাতে ঘুম হয়নি। ”
–” কেন?”
–” বউ ছিল না সেজন্য। বিয়ের পর বউ না থাকলে ছেলেদের রাতে ছাড়া-ছাড়া ঘুম হয়।”
আয়নার কী যে মেজাজ খারাপ হলো। ব্যাটা বিয়ে করেই বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হচ্ছিলি তার উপর দুই রাত ই হলো কেবল। এতেই উনি বউ-বিবাহ বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলো! সে আরোও বাজিয়ে দেখতে চাইলো। বলে উঠে, ” তাহলে বউ থাকলে ভালো ঘুম হয়?”
সমুদ্র এবার চোখ খুলে, হেলান দেওয়া থেকে উঠে পিঠ সোজা করে বসতে বসতে বললো, ” ধুর, কি যে বলেন না, মিস আয়না! বউ সঙ্গে থাকলে তো আরোও ঘুম-ই হয় না৷ রাত জাগা লাগে। ”
বাক্য দু’টো শোনামাত্র আয়নার টসটসে গাল দু’টোয় রক্তিম আভা ফুটে উঠলো। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মনে মনে ভাবে, এই লোক কোনোদিন শুধরাবে বলে মনে হয় না!
______________________
দুইদিন ইতিমধ্যে অতিক্রম হয়ে গেলো। সমুদ্র সেদিন লাঞ্চ ব্রেকের পর গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে বিজি ছিলো। তখন সোয়া তিনটা বাজে। আজকে আয়নার অফিসে আসার কথা ছিলো না। এই দুইদিনের মধ্যে তাদের ফোনেও কোনো কথাবার্তা হয়নি৷ কোথায় জানি একটা পুরু দেওয়াল হানা দিচ্ছে তাদের সম্পর্কে। মিটিংয়ের মাঝে আয়নার নাম্বার থেকে কল আসে৷ সমুদ্র মনে মনে ভীষণ শান্তি পায়। মেল ইগো স্যাটিসফাই হয় তার৷ সে ফোনটা ধরলো না। আর কল আসলোও না। আরোও আধাঘন্টা মিটিং চলমান রইলো। এরপর আলিয়ার নাম্বার থেকে কল আসে। সে ভ্রু কুচকে তাকায়৷ আলিয়ার তো কল দেওয়ার কথা না৷ আয়নার কিছু হলো না তো? সে দিক-বেদিক ভুলে কল ধরলো ব্যস্ত মিটিংয়ের মাঝেই৷
আলিয়া ও’পাশ থেকে ভারাক্রান্ত গলায় বললো, ” ভাইয়া একটা বিরাট বিপদ হয়ে গেছে৷ আপা নাক ফোঁ ড়ালো৷ এরপরে নাকফুল পড়তে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে গেলো। নাক ফুলে গেছে৷ আপার ভীষণ ব্যথা হচ্ছে৷ ব্যথায় আপা কান্না করে বাসা উল্টায় ফেলছে৷ আপনি এসে একটু আপার ব্যথা কমিয়ে দিন।”
সমুদ্র আলিয়ার কথায় কি বুঝলো কে জানে৷ সে এ’প্রান্ত থেকে বলে, ” নাকে ফুল পড়েছে কেন? তোমার আপা নাকে গোলাপ ফুল পড়লো নাকি?”
–” গোলাপ ফুল কেন পড়বে? নাকফুল, ভাইয়া নাকফুল! কানে ফুঁটা করলে যেমন কানের দুল পড়ে, তেমনি নাক ফোঁড়ালে নাকফুল পড়ে।”
সমুদ্র এবার বুঝলো, সে বলে উঠে, ” নাক ফুলে গেছে? পেইন খুব হচ্ছে? আচ্ছা আমি আসছি। একটু ওয়েট করো।”
সমুদ্রের একদম খেয়াল ছিলো না সে মিটিংরুমে বসে আছে। আয়না ব্যথা পেয়েছে শুনে অতি উত্তেজনায় জোরে কথা বলছিলো। আস্তে বলার কথা মনে ছিলো না।
তাদের মধ্যে, রুমে উপস্থিত থাকা একজন মহিলা বলে উঠে, ” নাক ফোঁড়াতে গিয়ে ব্যথা হয় অনেক। তা কে নাক ফোঁড়ালো মিস্টার সাদবিন? কার জন্য এতো ব্যাকুলতা? প্রেমিকা সে?”
সমুদ্র ভেবে পায় না কী জবাব দিবে ওনাকে? অফিসে তো বিবাহের বিষয়টি গোপন রেখেছে৷ পরক্ষণে বিজ্ঞানের একটা অদ্ভুত মজার থিউরি খেয়ালে আসে৷ তা হলো : সকল ক্ষার-ই ক্ষারক কিন্তু সকল ক্ষারক ক্ষার নয়৷ বিজ্ঞানের সঙ্গে সে রিলেট করলো৷
“সকল বউ-ই প্রেমিকা কিন্তু সকল প্রেমিকা বউ নয়। ”
তাহলে যুক্তি অনুযায়ী আয়না তো তার একধরণের প্রেমিকাই! বউ-প্রেমিকা৷
সে প্রফুল্লচিত্তে উত্তর দিলো, ” ইয়েস। ”
চলবে৷