#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–23
রহমান এন্ড সনস্ ম্যানসনের তিনতলার বারান্দায় ইশরাক রহমান বসে আছেন। যদিও বাসার নাম রহমান এন্ড সনস্ কিন্তু তার পিতা ইমতিয়াজ রহমানের একটাই ছেলে। এমনকি ইশরাক রহমানের ও একটাই ছেলে। তবুও বাড়ির নাম রহমান এন্ড সনস্ কেন রাখা হয়েছে এ এক আজব কারবার। এমনকি তাদের বিজনেজ গ্রুপের নামও এটাই। তার বাবার রেখে যাওয়া নাম অনুসরণ করেই বছর পর বছর চলছে। নাম পরিবর্তন হয়নি। আজকের রাতটা খুব সুন্দর। পূর্নিমা আজ। আকাশে একফালি চাঁদের দেখা মিলছে। বারান্দায় হুহু করে বাতাস বইছে। দূর থেকে হাসনাহেনা গাছের ফুলগুলোর সুবাস নাকে আসছে। রোদেলার ছাদে ঝুলিয়ে রাখা উইন্ডচার্মের বাতাসে সুর তুলে টুংটাং আওয়াজও ভেসে আসছে৷ বসুন্ধরায় রাত হলে মনে হয় নির্জন কোনো গ্রাম। কেবল প্রাইভেট কার চলে। দূর-দূরান্ত কোনো দোকান-পাট নেই। তবে মশার উপদ্রব খুব। এজন্য রোদেলা গ্রিল আর বারান্দায় নেটের জাল দিয়েছে যেন মশা না ঢোকে।
এমন সময় পেছনে থেকে মিসেস রোদেলা এসে ডাক দিলো, ” আবেগ, চা দিবো?”
ইশরাক রহমান হাল্কা হেসে বলে, ” না, না। সমুদ্রের আম্মু, তুমি এসে বসো। কিছু কথা আছে।”
মিসেস রোদেলা বারান্দায় সাজানো চেয়ার টেনে আবেগের সামনাসামনি বসলেন। বাসার প্রতিটা কোণা খুব যত্ন করে সাজানো। রোদেলা খুব শৌখিন মানুষ। তাদের ড্রয়িং-ডাইনিং, বারান্দা খুব সুন্দর করে সাজানো। কেবল সমুদ্রের রুমটাই এ’বাসার সবচেয়ে অখাদ্য রুম। সবসময়ই অগোছালো রাখবে।
সে বসতেই আবেগ বলে উঠে, ” সমুদ্র ফিরেছে?”
–” হ্যাঁ, একটু আগে এলো। খেয়েই ঘুমাতে গেছে। ওর সাথে কোনো কথা আছে? তাহলে ডাক দিবো?”
–” না। ভাবছি ওদের দুই ভাই-বোনের নামে সব সম্পত্তি বন্টন করে দিবো। সব কিছু উইল করে দিয়ে যাই। বলা যায় না, ভবিষ্যতে কি হবে। সমুদ্রের এখন নিজের সংসার আছে। যেকোনো সময় অন্যকোথাও শিফট হতে চাইতে পারে। আমরা না থাকলে, আদৌ সমুদ্র ওর বোনের অধিকার ঠিকমতো দিবে কিনা, জানি না।”
–” আমার ছেলে এমন না। ও ঠিক ওর বোনের প্রাপ্ত অধিকার বুঝায় দিবে। পারলে নিজের ভাগের গুলোও দিয়ে দিবে। তবে তোমার যেহেতু ইচ্ছা, তুমি উইল করে যাকে যা দিবে লিখে দিয়ে পারো।”
আবেগ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠে, ” সমুদ্রের কাজে এবারে আমি স্যাটিসফাইড। ওর বিয়ের অনুষ্ঠান ঘটা করে কবে করতে চাচ্ছে?”
–” কিছু বলেনি তো। ওকে আর জোর করবো না। ওরা দু’জন সময় নিক। তারপর যখন চায়, আসবে। বাসার দরজা সবসময়ই বউমার জন্য খোলা। ”
–” আকদের পর ওদের একবারও এ’বাসায় দাওয়াত দিলে না, কেমন শ্বাশুড়ি তুমি? একদম জল্লাদ!”
মিসেস রোদেলা হেসে বলে উঠে, ” আমার মতো ইয়ং এন্ড মডার্ণ শ্বাশুড়িকে তুমি জল্লাদ বলছো? সমুদ্রর সঙ্গে বের হলে, মানুষ বলে আমি ওর বড় বোন।”
আবেগ বলে উঠে, ” শায়লা কি ওই বাসায় উঠেছে?”
–” কি জানি। ওর সাথে যোগাযোগ কম রাখি। আচ্ছা তুমি এতোদিন পর ফাহাদকে কই থেকে খুঁজে বের করলে?”
–” আর বলো না। সবটাই কাকতালীয় ব্যাপার। মেঘ তো আমার জুনিয়র ছিলো। ভার্সিটিতে একই হলে ছিলাম। কিন্তু ভার্সিটির পর যোগাযোগ ছিলো না। শুধু জেনেছিলাম মেঘ বিসিএস ক্যাডার হয়ে সরকারি বড় পোস্টে আছে। বিয়ে করেছে। বাচ্চা আছে। এইটুকুই। এরপর শায়লার মাধ্যমে আবার দেখা হলো। আমার অপারেশনের পর তো অফিস যাওয়া বাদ দিলাম৷ এক ভাই দাওয়াত দিলো। আমাদের সব বিজনেস পার্টনারদের দাওয়াত করলেন উনি। তুমি তো ওই দাওয়াতে যাও নি। কি যেন হলো তোমাদের! সমুদ্র ঝামেলা করছিলো। আমি পিউকে নিয়ে গেলাম। ওইদিন দাওয়াতের অনুষ্ঠানে শায়লা মেঘের সঙ্গে আসে। ওরা তার ক’টা দিন আগেই কোর্ট ম্যারেজ করেছে। এজন্য দাওয়াতে শায়লা তার হাসবেন্ডকেও এনেছিলো সবার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। আমি তো মেঘের ব্যাপারে জানতাম না। শায়লা কোর্ট ম্যারেজ করবে এটা শুনেছিলাম৷ কিন্তু মেঘের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে বসতে চলেছে জানায়নি। মানে শায়লা আসলে জানত না আমি আর মেঘ রুমমেট ছিলাম। ওই অনুষ্ঠানেই জানতে পারলো আমি আর ফাহাদ পূর্বপরিচিত। ফাহাদের ডাকনাম কিন্তু আবার মেঘ। এতোদিন পর পুরাতন মানুষ দেখে খুশিই হলাম৷ কোনোদিন ভাবিও নি আবার মেঘের সঙ্গে দেখা হবে৷ একসঙ্গে অনেক গল্প করলাম। তবে ওর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর খবর আবার শায়লার সঙ্গে বিবাহ সব শুনে অবাক-ই লাগে।”
মিসেস রোদেলা জানতেন শায়লা তার পুত্রবধূর বাবাকে বিয়ে করেছে। অন্য কোনো শ্বাশুড়ি হলে হয়তো অনেক ঝামেলা করত এই ইস্যু নিয়ে৷ কিন্তু রোদেলা এসব কিছুই করবে না। শায়লাও ওর পরিচিত আর আয়ুর বাবা ও পরিচিত মানুষ। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি, খোটা মারার স্বভাব তার মধ্যে নেই। আয়ু তাকে খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটাকে বিয়ে করে তার ছেলের মধ্যে কতো পজিটিভ পরিবর্তন আসছে। এখন রাত করে বাড়ি ফেরে না। সময়মতোই আসে বাসায়। বিয়ের মাত্র ক’টা দিন পার হলো, এতেই এতো পরিবর্তন ছেলের মাঝে! তবে, মিসেস রোদেলার কেন যেন শায়লাকে খানিকটা সুবিধাবাদী মহিলা লাগে। মানে খুব একটা পছন্দ করতো না। একটু দূরত্ব রেখে চলাফেরা করত। কিন্তু শায়লা-ই তার বিপদে এসে দাঁড়ালো এজন্য সে কৃতজ্ঞ তার উপর। এখন সমুদ্র শায়লার সঙ্গে এতো বেশি ক্লোজ হয়েছে। তাদের বিজনেজের থার্ড পার্টি শায়লা। শায়লার এনে দেওয়া বিজনেজম্যানদের সঙ্গে ডিল করছে সমুদ্র। প্রোজেক্টের কাজ চলছে। সেদিন ইভানাও বলছিলো শায়লার এতো আনাগোনা কেন? উত্তর দিতে পারেনি কোনো সে।
সে প্রশ্ন করে, ” সমুদ্রের জন্য প্রস্তাব কি তুমি আগে দিয়েছিলে?”
–” ওই অনুষ্ঠানেটাতে আমি এমনি বলছিলাম আমার ছেলের জন্য একটা মেয়ে দেখতে৷ শায়লা টুকটাক ঘটকালি করে তো তাই বলেছিলাম। ওরা ওইসময় কিছু বলেনি। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ পর কি যে হলো, শায়লা কল দিয়ে ওর বাসায় ডাকে৷ আমি অসুস্থ ছিলাম জন্য ওর বাসায় যেতে চাইনি। পরে ও আর মেঘ আমাদের বাসায় এলো। খেয়াল আছে না? ওইদিন তোমার সামনেই তো প্রস্তাব দিলো।”
মিসেস রোদেলা অতীতের দিনগুলো স্মরণ করলো। একদিন হুট করে দুপুরের পর শায়লা আসলো। সঙ্গে ওর হাসবেন্ড। শায়লাকে দ্বিতীয়বার জীবন গুছাতে দেখে রোদেলা খুশিই হয়। যখন দেখলো, শায়লার হাসবেন্ড আবেগের ভার্সিটির জুনিয়র তখন তো আরোও বেশি ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলো। ওদের এমন না বলে আসায় রোদেলা কীভাবে আপ্যায়ন করবে এটা ভেবেই কূলকিনারা পাচ্ছিলো না। ফাহাদ সাহেব প্রথম এসেছেন বাসায়। ভারী আপ্যায়ন না করলে মন খচখচ করবে। সমুদ্র-পিউ দুইজন ই বাসায় ছিলো না। পাতিলে যখন পোলাও বসায়, তখন আবেগ তাকে এক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ডাকলো। ওইদিন মেয়ের বাবা-ই প্রস্তাব রাখে। আবেগ তো মেয়ের কিছুই আর দেখেনি। ওর ভার্সিটির জুনিয়র, রুমমেটের মেয়ে মানে ওর মেয়ের মতো। ব্যাস আর কিছু দেখবে না। মিসেস রোদেলা স্বামী যা বলে তাতেই মত দেয়। উনিও আর আপত্তি করেনি। শুধু শায়লা একবার বায়োডাটা জোর পূর্বক দেখালো। মেয়েটা এতো মিষ্টি দেখতে তাও নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। তারা সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যায়। সমুদ্র রাজী হলেই আগাবে বলে জানায় ফাহাদ সাহেবকে। সেদিন-ই আয়না সিএসইতে পড়ে শুনে আবেগই বলে, ওদের কোম্পানিতে আইটি বেসড একটা ইন্টার্ণশীপের প্রোগ্রাম অরগানাইজড করা হয়েছে। আয়নাও জয়েন করুক। তাহলে সমুদ্রের সঙ্গে অগ্রীম পরিচয় হবে। জানা-শোনা হবে। দু’জনেরই সুবিধা হবে। ট্রেনিংটা মেয়েটার ক্যারিয়ারের জন্যও ভালো। ফাহাদ রাজী হয়, মেয়েকে হবু শ্বশুড়ের কোম্পানিতে ইণ্টার্ণ করতে দেওয়ার জন্য। তবে ইন্টার্ণ করার আগে কিছু বলেনি আয়নাকে। সম্পূর্ণ বিষয়টিই হাইড রাখা হয়৷ ও শুধু জানত তার আব্বুর পরিচিত সিনিয়রের কোম্পানির আইটি সেক্টরে একটা পার্ট টাইম জব অফার দিয়েছে। ওনার ছেলের সাথে যে এক প্রকার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছে এটা প্রথমে সমুদ্র-আয়না দুইজনের কেউই জানত না। দুই পক্ষই একটা কথা সাফ বলে দিয়েছিল, ছেলে-মেয়ে আপত্তি করলে, তারা জোর করবে না। এমনকি বিয়ের সম্পর্ক না আগালেও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ করবে না। ওরা যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই মেনে নেওয়া হবে।
মিসেস রোদেলা বেশ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনেন। এরপর বলে উঠে, ” ফাহাদ ভাই নিজের বিয়ের কয়েকদিন পরেই মেয়ের বিয়ের জন্য এতো অস্থির হলো কেন? এখনকার মেয়েরা গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিয়ে করে, বয়স তো খুব পেরিয়ে যাচ্ছিলো না আয়ুর।”
আবেগ থমকালো সামান্য বিষয়টা এভাবে তো একদম ভাবে নি। তবে ফাহাদ বলেছিল ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আবেগ বলে, ” বাবার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে জন্য ওর মেয়ের ভালো প্রস্তাব আসবে কিনা এসব নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলো মনে হয়।”
মিসেস তরোদেলা আর কোনো প্রশ্ন করলেন৷ অতীত নিয়ে এতো মাথাব্যথা নেই তার৷ পুত্রবধূকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার। শিক্ষিত, স্মার্ট মেয়ে। একদম মনের মতো একটা বউমা পেয়েছে৷
_________________________
আয়না রুমে বসে আছে। আজকে বাসায় অনেক গেঞ্জাম। আত্মীয়-স্বজন অনেকেই এসেছেন। দাদাভাইকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। সে একদম সুস্থ। তাকে দেখতেই অনেকে আসতে চাচ্ছিলো। এজন্য বাবা সবার জন্য একটা ডেট ফিক্সড করে গেট টুগেদার আয়োজন করেছে। তাদের বাসায় প্রায়শ এমন দাওয়াতের আয়োজন হয়। মেহমান, আত্মীয়রা আসেন। বাবার এক বাবুর্চি-ই ঠিক করা আছে। কল দিয়ে বলে দিলে ডেকচি ভর্তি রান্না করে আনবে। আয়নার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন কেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। এ’ আটদিনে সমুদ্র একবারও আসেনি তাদের বাসায়। খুব নাকি ব্যস্ততা ওনার। হুহ!
সন্ধ্যা সাতটার দিকে সমুদ্রের বাবা-মা আর বোন আসলো। সঙ্গে ওর ফুপু ইভানা আন্টি। যাকে ও ওর আরেক মা বলে পরিচয় করিয়েছে। ইভানা আন্টির ছেলেও এসেছে৷ কিন্তু যার শ্বশুড়বাড়ি সে-ই এসে পৌঁছে নি। আয়নার এতো রাগ উঠে। সে অনেকদিন পর আজ শাড়ি পরেছে। এতো অশান্তির পরও সমুদ্র আসছে ভেবে হাল্কা সেজেছে। কিন্তু ওনার নাকি ব্যস্ততা। আসতে দেরি হবে আবার নাও আসতে পারে। আয়নার মন চাচ্ছে ওনার অফিসে গিয়ে সব কাগজ-পত্র ছিঁড়ে ফেলতে! কাকে ব্যস্ততা দেখায় উনি? আয়নাকে তাকে গুণাই ধরে না।
মিসেস রোদেলা সবার সঙ্গে আলাপ করে আয়নার রুমে ঢুকে। আয়না তখন ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেছে। শ্বাশুড়িকে আসতে দেখে সে ফোন রেখে দিয়ে মুচকি হাসি দেয়। একটু নার্ভাস ও লাগে বটে৷
মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” ওয়াও মা। তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। মাশাল্লাহ।”
–” থ্যাঙ্কিউ আন্টি আই মিন……. ”
আয়নার মুখ দিয়ে মা শব্দটা বের হচ্ছিলো না কেন জানি। এতোদিন ধরে এই ডাকে কাউকে ডাকেনি। হুট করে “মা” শব্দটা মুখে আনতেও কষ্ট হচ্ছিলো৷ রোদেলা আচমকা ওর কপালে একটা চুমু খেল। এরপর সোনার একটা চেইন গলায় পড়িয়ে দেয় এবং বললো, ” তুমি আমাদের বাসায় একবারও গেলে না। শ্বাশুড়িকে পছন্দ হয়নি নাকি?”
–” না,না। ছিঃ এসব কি বলছেন আন্টি আই মিন আম্মু। ”
আম্মু বলার সময় ওর চেহারাটা মলিন দেখায়। রোদেলা তা খেয়াল করে বলে, ” তুমি আমাকে মামণি বলে ডেকো কেমন? ”
আয়নার এই সামান্য বিষয়টা এতো ভালো লাগলো। সে মিসেস রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে। ওকে জড়িয়ে ধরে রোদেলা বলে উঠে, ” আমারও মা ছিলো না। আমি এই কষ্টটা বুঝি সোনা।”
সেদিনের অনুষ্ঠানে অনেকে আসলেও সমুদ্র এলো না। আয়না একফাঁকে ওকে কল দিলো। প্রথমে সরাসরি কল কেটে দিলো। আয়না পুনরায় কল দিলে কল রিসিভ হলো। ও’পাশ থেকে গম্ভীরমুখে বলে, ” কি? ”
–” কি মানে কি?”
–” কি মানে হলো হোয়াট।”
–” ধ্যাত। আসলেন না কেন আজ? সবাই এসেছে। ”
–” তুমি দাওয়াত দিয়েছো যে আসবো?”
–” বাবা বলেনি আপনাকে?”
–” বউ কে আমার?”
–” উফ! মেয়েদের মতো এমন নাক ফুলিয়ে অভিমান কেন করছেন?”
–” অভিমান কী স্ত্রীবাচক শব্দ নাকি? রাখছি। তুমি বরং অন্যদের সঙ্গেই ভাব জমাও। আমার থাকা-না থাকায় কী আসে?”
আয়নার কেন জানি হাসি পেলো। এসব কথা-বার্তা তার মতো রাশভারি কারো কাছে শুনবে আশা করেনি। ওনার মুখে এমন অভিমানী বাক্য মানায় না৷
সে হেসে ফেলে। যদিও বা হাসি আটকাতে চাচ্ছিলো।
সমুদ্র বলে উঠে, তুমি হাসলে? বাহ ওয়াও। ভাবলাম আমাকে কনভিন্স করবে। বাট ভুলেই গেছিলাম তোমার তো ইলেকট্রিক্যাল মন। রাখি।”
আয়না বুঝতে পারে না কী এমন হলো! অনেকবার কলে ট্রাই করেও আর রিসিভ করে না ও।
পরদিন দুপুরের আগেই আয়না আবার সমুদ্রকে কল লাগায়৷ প্রথমে না ধরলে, আয়না ম্যাসেজ দিলো, আপনি ফোন না ধরলে অফিসে গিয়ে হাঙ্গামা করব৷ অফিসের সব কাগজ ছিঁড়ে রেখে আসবো। সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে৷
আয়না বলে উঠে, ” আপনি এখন বাসায় আসুন।”
–” সময় নাই।”
–” লাঞ্চব্রেকে আসুন।”
–” না।”
–” আমি কিছু জানি না৷ আপনি এক্ষুনি আসবেন। বলে দিলাম।”
এরপর আয়না ফোন কেটে দেয়। তার ধারণা সমুদ্র তার বলায় আসবে না। আদৌ তাদের মধ্যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। ওনার নিশ্চয়ই কাজ ফেলে আয়নার সঙ্গে মিট করার ইচ্ছা নাই।
ঠিক দশ মিনিট পর কল আসে। ও ভাবে সমুদ্রের কল৷ কিন্তু স্ক্রিনে যখন রঙ্গন নামটা দেখে অবাক হলো। রিসিভ করতেই রঙ্গন বলে, ” কিরে তোর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দু’দিন ধরে ক্লাসে আসোস না। সব ঠিকঠাক? ”
–” হ্যাঁ।”
–” বিবাহিতা হয়ে গেলে আর পড়তে মন চায় না নাকি?”
–” আরে না। বাসায় একটু সমস্যা ছিলো।”
–” কি সমস্যা?”
আয়না কথা এড়িয়ে গিয়ে বলে, ” দাদাভাই সিক। ”
— ” আমি আর সুব্রত তোর বাসার কাছেই। আসি?”
–” এখন?”
–” হ্যাঁ। ”
এভাবে তো ফ্রেন্ডদের মুখের উপর না করা যায় না। সে বলে উঠে, ” আচ্ছা আয়৷”
সত্যি ওরা দশ মিনিট পর আয়নার বাসায় আসলো। ড্রয়িংরুমেই বসে ওরা। হালিমা বুয়া চা-নাস্তা দেয় খেতে। আয়না টুকটাক কথা বলতে থাকে।
রঙ্গন বলে উঠে, ” বিয়ে করলি জানালি না অব্দি আমাকে।”
–” আমি সেকশনের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে একবারেই সবাইকে বলেছিলাম।”
–” ওই গ্রুপে আমি এক্টিভ না জানোস-ই তো। ”
–” কাউকেই পার্সোনালি বলি না।”
–” আমি তোর সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম। একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জন্য তুই ফ্রেন্ডশিপ এভাবে নষ্ট করলি! ”
ওমন সময় সুব্রত প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠে, ” চিকেন ফ্রাই টা সেই মজা দোস্ত। রঙ্গন খা তুইও।”
এমন সময় মেঘ ডাকে। বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস। ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। আয়না দ্রুত পেছনের বারান্দায় চলে যায়৷ কাপড় শুকাতে দিয়েছে। ভিজে গেলে আরেক বিপদ। পেছনের বারান্দায় গেলে ঘরের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র থাকে না৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হিমেল হাওয়া উপভোগ করে ফিরে আসে। তখনই রঙ্গন বললো, ” ভাইয়া এসেছে। সোজা তোর রুমে ঢুকে পড়লো।”
আয়না ভ্রু কুচকে তাকালো। এক সেকেন্ড সময় নিলো সবটা বুঝে উঠতে। এরপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। সে রুমে যেতেই অবাক, সমুদ্র তার বেডে কপালে হাত রেখে শু’য়ে আছে। আয়নাকে দেখেও যেন দেখলো না।
আয়না হতভম্বও হলো আবার অজানা এক আনন্দ এসে ভর করে। আয়নার কথা রেখেছেন তবে। এসেছেন উনি!
তাকে চুপ থাকতে দেখে সমুদ্র বলে উঠে, ” লাঞ্চব্রেকে আমি টুকটাক মেডিকেল রিলেটেড স্টাডি করি। তোমার কথায় সব ফেলে আসলাম।”
–” সর্যি জানতাম না যে আপনি লাঞ্চব্রেকে পড়েন৷”
–” খেতে দাও। খিদে পেয়েছে অনেক।”
–” আসেন।”
সমুদ্র উঠে ডাইনিং টেবিলের দিকে আগায়। আয়না রান্নাঘরে চলে যায়। সুব্রত আর রঙ্গন বসে ছিলো। সমুদ্রের সঙ্গে দু’একটা কথা বললো৷
আয়না রান্নাঘর থেকে ফিরতেই রঙ্গন বলে, ” আয়ু শুন। আমরা যাচ্ছি।”
আয়না বাধ্য হয়ে ওদেরকে বিদায় দিতে যায়। এরমধ্যেই হালিমা বুয়া সমুদ্রকে সব খাবার বেড়ে দেয়৷ কিন্তু সমুদ্র একটা কিছুও মুখে না দিয়ে রুমে ঢুকে পরে৷ আয়না ফিরে আসতেই দেখে টেবিলে সব খাবার পরে আছে। সে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমে ফিরে আসে৷
সমুদ্র বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছে৷ আয়না আসতেই জিজ্ঞাসা করে, ” তোমার সিজি কত?”
–” মেয়েদের বয়স, ছেলের স্যালারি আর ছাত্রদের সিজি জিজ্ঞেস করতে হয় না।”
–” ফালতু কথা রাখো। নিশ্চয়ই তোমার সিজি এর অবস্থা ভালো না। ভালো রেজাল্ট করবে কীভাবে? সারাদিন ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে আড্ডা। ভার্সিটি বা বাসায় সবখানে আড্ডা দেওয়া।”
সে বুঝে সমুদ্র রেগে আছে কিন্তু হুট করে রাগ কেন করলেন? অবশ্য ওনার রাগার কোনো ভ্যালিড রিজিন লাগে না৷
আয়না নিজে সমুদ্রের পাশে বসে বলে, ” আপনি খান নি কেন?”
–” তোমার বাসায় খাওয়ার জন্য আসিনি।”
–” ক্ষুধা লেগেছে বললেন আবা…. ”
–” ক্ষুধা মরে গেছে। মাথা ব্যথা করছে।”
সমুদ্র হুট করে আয়নার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আয়না নড়েচড়ে উঠলো।
সে বুঝতে পারছে যে খুব রেগে আছে৷ কিন্তু কেন? ঠিক রাগ না কেমন জেলাস ফিল হচ্ছে। আয়নার বাসায় ওর ছেলে ফ্রেন্ডরা কেন আসবে? কী আজব! এতে জেলাস ফিল করার কী আছে? ভার্সিটির ফ্রেন্ড-ই তো। জেলাস কেন হচ্ছে সে?
প্রেম থাকলে জেলাস হয় প্রেমিক। তবে কী?
তখনই আয়না বলে উঠে, ” বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন৷ আমার কোলে কেন?”
সমুদ্র জবাব দেয় না। ওদিকে দরজা খোলাই ছিলো। দাদী এসে একবার এই দৃশ্য দেখে গেছে। কি লজ্জা। আয়নার লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলে। সমুদ্রও টের পেয়েছে দাদী এসেছিলেন, তবুও সরে নি বরং উনি যাওয়ার পর আয়নার পে-/টের সঙ্গে নাক ঘঁষে। আরোও ঘনিষ্ঠ হয়ে শু’য়ে থাকে মটকা মেরে। লজ্জায় আয়নার দূরে কোথাও দৌড়ে পালাতে মন চাচ্ছে।
আয়না যতোবারই বলে উঠে বালিশে মাথা রাখেন। সমুদ্র যেন ততোই গা ছেড়ে দেয় তার উপর। একটা মানুষ এতো পরিমাণ ঘাড়বেকা কেমনে হয়?
চলবে।
#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur ( ছদ্মনাম)
Part–24
আয়না যতোবারই বলে উঠে বালিশে মাথা রাখেন। সমুদ্র যেন ততোই গা ছেড়ে দেয় তার উপর। একটা মানুষ এতো পরিমাণ ঘাড়বেকা কেমনে হয়?
–” আয়না, আমার মাথা টিপে দেও একটু। স্বামী সেবা করো।”
আয়না বাধ্য বালিকার ন্যায় ওনার মাথায় হাত বুলায়, চুলে বিলি কেটে দেয়। সমুদ্র পরম আরামে চোখ বুজে ওর কোলে শু’য়ে থাকে। আধাঘন্টা উপর আয়নার ওনার মাথা টিপে দিচ্ছে, তাও নাকি মাথাব্যথা সাড়ে না। এদিকে আয়নারই হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। কোমড় লেগে যাচ্ছে।
সে হাত থামালেই ওনার দুষ্টুমি শুরু হয়ে যায়। এতো বজ্জাত! আয়না একটু আগে চুলে বিলি কেটে দেওয়া থামায়, সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ খুলে তার পানে তাকালো। এরপর আয়নার পে ;টে কাতুকুতু দেওয়া শুরু করে। আয়নার আবার কাতুকুতু বেশি। কোনোভাবে-ই এসব সহ্য করতে পারে না সে। ব্যাঙের মতো লাফ দিতে চায় কিন্তু একটা দামড়া ভারী শরীর তার কোলে থাকায় সরতেও পারে না৷ পুনরায় বাধ্য হয়ে মাথায় বিলি কেটে দেওয়া শুরু করে।
এরপর বলে উঠে, ” আপনার গলা ব্যথা করবে কবে?”
–” গলা ব্যথা করলে ডাক্তার দেখাবো৷”
আয়না মাথায় হাত বুলানো থামিয়ে দিয়েছিলো কথা বলার ফাঁকে। সমুদ্র ফের ওর পানে দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকায়। ওনার ওমন চাউনি দেখামাত্র আয়নার ভয় হতে থাকে। না জানি আবার এই লোক কী করে বসে!সমুদ্র একটু ঘাড় কাত করে হাতে ভর দিয়ে শু’য়ে থেকে বলে, ” তোমরা এই যুগের মেয়েরা খুব ফাজিল তো। দু’মিনিটও স্বামীসেবা করতে চাও না। খুব অলস। আগের যুগের নারীরা দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা সেবা দিতো!
আয়না নাক ফুলিয়ে বলে, ” তাহলে আগের যুগের মেয়েকে বিয়ে করতেন। এই যুগের মেয়ে কেন বিয়ে করলেন।”
–” এতো কথা বলো তুমি! অথচ এক মিনিট ও মাথা টিপে দিতে পারো না।”
–” প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে আপনার সেবা করছি। আর বলছেন মাত্র এক মিনিট? ”
সমুদ্র ভ্রু কুচকে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। চারটার বেশি বাজছে। ও বলে উঠে, ” ঘড়ির মাথা নষ্ট।”
–” আপনার চোখ ও মাথা দু’টোই নষ্ট।”
এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র আয়নাকে চেপে ধরে একদম বিছানায় ফেলে দেয়। মানুষ বালিশ যেভাবে বিছানায় ফেলে ওভাবে উনি আয়নাকে একপ্রকার শু’ইয়ে দেয়। আয়না টাল সামলাতে পারে না। একপ্রকার বিছানায় পড়ে যায় সে। সমুদ্র ওর উপর ঝুঁকে এসে ওর কপালের উপর পড়ে থাকা চুল গুলোয় ফুঁ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কপালে গরম ভাব অনুভব করে আয়না। লাজ, লজ্জা, শরম সব সমার্থক শব্দ ব্যবহার করলেও ওর লজ্জা বহিঃপ্রকাশ সম্ভব না।
সে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। সমুদ্র ওর কপালে পড়ে থাকা অবশিষ্ট জেদি চুলগুলো নিজের ঠোঁট দিয়ে ইচ্ছা করে আস্তে আস্তে সরাতে ব্যতিব্যস্ত হতে থাকে। যেন আয়নার কপালে পড়ে চুলগুলো ভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় সরানোই তার একমাত্র লক্ষ্য। আয়না ঘন-ঘন ওমন পাগলাটে উষ্ণ ছোয়া সহ্য করতে পারেনা। শেষের ক’টা উড়ন্ত চুল সমুদ্র ওর মুখে নিয়ে থু করে ফেলে দেয়।
এরপর বলে, ” শ্যাম্পু করো না চুলে? চুলে এতো ময়লা কেনো?”
কথাটি শোনামাত্র আয়না সমুদ্রের বুক বরাবর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কিল দিতে লাগে৷ সমুদ্র ওর উপর সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দেয় এবং নিজের হাতের মুঠোয় আয়নার হাত ধরে ফেলে। হাতে হাত কিছু পল ধ–স্তাধ–স্তি চলে। আয়না চায় ওর হাত দু’টি মুক্ত করে নিতে, অন্যদিকে সমুদ্র চায় ওর হাত শক্ত করে ধরে রাখতে। অবশেষে সমুদ্র জয়ী হয়। সে নিজের দু’হাত আয়নার দু’হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে গুজে দেয়। আয়না আর চোখ খোলার সাহস পায় না।
সমুদ্র বলে উঠে, ” এতো তেজ যে দেখাচ্ছো, সামান্য ছুঁ’তেই কাপাকাপি করো যেন শরীরের ভেতর ভূমিকম্প যাচ্ছে!”
আয়না একবার চোখ মেলে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সমুদ্র ওর দিকে আগাচ্ছিলো। ভাবেও নি সে মুখ ঘুরিয়ে ফেলবে ও। সমুদ্র মুখ থুবড়ে আয়নার গলা বরাবর পড়ে। ওর মেজাজ ভীষণ চটে। এই মেয়েটা সবসময় কই মাছের মতো নড়চড় করে সব বিগড়ে দেয়। কই মাছকে সামলাবে না রোমা–ন্সে ফোকাস করবে সে?
সমুদ্র বলে উঠে, ” আমার মতো ইয়ং এন্ড হ্যান্ডসাম হাসবেন্ড থাকা সত্ত্বেও ঘুরেফিরে তুমি সাদা দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে থাকো। তোমার উচিত ছিলো কোনো বুইড়া, স্যুগার ড্যাডি বিয়ে করা। তাইলে ঠিক হত। ওই বুইড়া রে সারাদিন ইনসুলিন দিতা আর হসপিটালে নিয়ে যাইতা। তাই ঠিক ছিলো তোমার জন্য। আমার মতো সুদর্শন পুরুষ তোমার জন্য না।”
আয়না ওর দিকে তাকাতেই সমুদ্র মুখ নিচু করে ওর গ–লায় মুখ ডুবায়। মাতোয়ারা হতে থাকে।আলতো কা৷ মড় বসায়। গ–লার জায়গাটা লাল হয়ে আসে। আয়না ছু’টার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে।
এমন সময় দরজার ও’পাশ থেকে আলিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। ও এদিকেই আসছে। আপা করে ডাকছে৷
আয়না তৎক্ষনাৎ সরে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে বললো, ” দরজা লক করা নেই।”
সমুদ্র সরতে চায় না, সে বলে উঠে, ” আশ্চর্য! তুমি আর তোমার চৌদ্দ গুষ্টি মিলে আমার রোমা–ন্সের বারোটা বাজাও। কোনো প্রাইভেট মোমেন্ট দেও না।”
সমুদ্র হাল্কা সরে আসতেই ওনাকে বিছানায় ধাক্কা মেরে আয়না রুম ছেড়ে যেতে ধরলে, সমুদ্র বেডে শু’য়েই বললো, ” সুন্দরী পালাচ্ছো কেন?”
আয়না জবাব দেয় না। বেরিয়ে যায়। সমুদ্র একা একাই মুচকি হেসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। আজকে হাফ ডে করবে ভেবে নিয়েছিলো। বিছানায় একটা কোলবালিশ ছিলো। সে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে বলে, ” কী বা– লের জীবন! বউ থাকতেও কোলবালিশ লাগে!”
সমুদ্র নাক ডেকে ঘুমালো। খুব আরামের ঘুম দিলো ও। এমন গভীর ঘুম ঘুমিয়ে ছিল এইচএসসি শেষ এক্সাম দিয়ে এসেছে। আজ এতোদিন পর মাত্র দু’ঘন্টায় এতো আরামদায়ক ঘুম দিলো। অনেকদিন এমন শান্তিতে ঘুমায়নি সে । ও যখন ঘুমাচ্ছিলো আয়না রুমে এসে বসে ছিলো। ঘুমন্ত সমুদ্রের নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে মাথায় বুলি কেটে দেয়।
হুট করে সমুদ্রের ফোন বেজে উঠে। সাইলেন্ট করা নাই। ভাবলো ওনার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে, এজন্য ফোন হাতে নিতেই পুনরায় কল বেজে উঠে। ও না চাইতেও রিসিভ করে৷ ফোনের ও’পাশ থেকে এক ভদ্রলোক কথা বলে উঠে। উনি বললেন আজ সমুদ্র অফিসে নেই কেন।
আয়না কি বলবে ভেবে পায় না। ও বলে, ” ওনার মাথাব্যথা এজন্য অফিস করতে পারেনি।”
ভদ্রলোক সমুদ্রের ফোনে মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ” আপনি কে বলছেন? মানে সাদবিন রহমানের কে হন আপনি? ”
আয়না একবার ঘুমন্ত সমুদ্রের দিকে তাকায়। উনি নাকি অফিসের কাউকে খোলাসা করে কিছু বলেনি। আয়না গম্ভীরমুখে জবাব দিলো, ” আমি ওনার কেউ হই না।”
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন এরপরে বলে, ” ইন্টারেস্টিং তো! ভাইয়ের পার্সোনাল ফোন আপনার কাছে আর বলেন কেউ হন না। ওয়েল, মিস জানেন কী? এই কেউ হই না টাইপ সম্পর্ক গুলো অনেক গভীর হয়। ভাই ফ্রি হলে একটু কল দিতে বলবেন। রাখি।”
আয়না ফোন রাখতে গিয়ে কেন জানি মোবাইল অন করে। এরপর আবার সমুদ্রের দিকে একপল তাকায়। ফোনে পাসওয়ার্ড দেওয়া। সে বড় আশা নিয়ে নিজের নাম লিখে কিন্তু ফোন ওপেন হয় না। ও সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে দেয় টেবিলের উপর।
সমুদ্র যখন উঠে তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। সে রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে আয়না নেই রুমে। সে রুম ছেড়ে বের হয়। খাবারের গন্ধে মো মো করছে চারপাশ। বাসার পরিবেশ তার কাছে স্বাভাবিকই লাগছে। তবে শায়লা আন্টি বলেছিলো, আয়না আর আলিয়া নাকি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলছে না। ওদের দু’বোনকে একটু বুঝাতে যেন বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ না করে। সমুদ্র ভেবে পায় না কী বুঝাবে ওকে। এরচেয়ে বরং ওরা সবটা মেনে নেওয়ার জন্য সময় নিক। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে সে নাক গলাতে চায় না৷ ইন ফ্যাক্ট সমুদ্র এটাও চাচ্ছিলো না যে সে আয়নাকে ওর বাবার সেকেন্ড ম্যারেজ নিয়ে খোলাসা করুক। এটা ওর বাবা বা শায়লা আন্টির জানানো উচিত ছিলো। কিন্তু ওনারা ভয় পাচ্ছিলো আয়না বাজে ভাবে রিয়্যাক্ট করবে কীনা৷ এতোদিন যেহেতু বিয়ের খবর গোপন রাখতে পারলো, তাহলে জানাতে কী অসুবিধা কে জানে? শায়লা আন্টি অনুরোধ করে বলেছিলো যেন সমুদ্র নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গিয়ে সবটা ক্লিয়ার করে ওকে জানায় আর বুঝায়। উনি রিকুয়েষ্ট করেছে জন্য সমুদ্র না করতে পারেনি। রাজী হয়ে যায়। কিন্তু এটার প্রভাব তাদের রিলেশনেও পড়ছে। আয়নার ভাবখানা এমন যে সমুদ্র তার বাবার বিয়ের ঘটক। কিন্তু সত্য এটাই সমুদ্র নিজেও কিছু জানতো না। এসব ওই মাথামোটা মেয়েটাকে কে বোঝাবে!
সে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলো। দুপুরে খায়নি। ক্ষুধা লেগেছে বেশ। সে বসতেই আয়না খাবার সার্ভ করে ছিলো। ফ্রাইড রাইস বানানো হয়েছে। সন্ধ্যায় কে ফ্রাইড রাইস খায়? কিন্তু এতো ক্ষুধা লাগছে। সে খাওয়া শুরু করে। দাদী আর আলিয়াও এসে বসলো ওর সাথে।
দাদী বলে উঠে, ” দিদাভাই, চা খাবা?”
–” জি, তবে চিনি ছাড়া দিবেন।”
আয়না অবাক হলো উনি চিনি ছাড়া চা খান! ওহ এইজন্য তোমার মধ্যে কোনো চিনি নাই মানে মিষ্টি আরকি। সে দ্রুত চা বানাতে রান্নাঘরে চলে যায়। কাপে চিনিসহ চা এনে টেবিলে রাখে।
সমুদ্র ওইসময় বলে উঠে, ” আলিয়া, আপু, আমাকে এক গ্লাস পানি দিতে পারবে?”
আলিয়া সমুদ্রের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। ওর ছোট বোনের সমান। তাও ওকে সম্মান দিয়ে আপু বলে ডাকে। তথাকথিত দুলাভাইদের মতো আজাইরা কথা বলে না। আলিয়া আর দাদা-দাদি ও ওর সাথে খেতে বসেছে। এই বাসায় সবার নিজের প্লেট-গ্লাস- মগ আছে৷ সমুদ্রের জন্যও গ্লাস আনা হয়েছে যেটায় এখন চা আছে৷ টেবিলে কেবল এক্সট্রা বলতে আপার মগ আছে।
আলিয়া বলে, ” ভাইয়া অন্যসব গ্লাস গুলো শোকেজে। আপনি আপার মগে পানি খান।”
একথা শোনামাত্র সমুদ্রের অভিব্যক্তি দেখবার মতো ছিলো কাজেই আয়না বলে, ” যা, শোকেজ থেকে বের কর গ্লাস।”
আলিয়া খাচ্ছিলো। খাওয়ারত অবস্থায় উঠে যাবে যা অভদ্রতা। তাই সমুদ্র বলে, ” যেটায় ইচ্ছা দাও।”
আলিয়া পানি ঢেলে দিলো। সমুদ্র খাওয়া-দাওয়া করলো। চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝলো বউ তার যা বলবে উল্টাটা করবে। আয়নার দিকে তাকায় একবার। কিছু বলে না। কিন্তু ভুলেও গ্লাস থেকে পানি খাচ্ছে না। চা খাচ্ছে, ফ্রাইড রাইস খাচ্ছে কিন্তু আয়নার মগে পানি খায় না একবারও।কেউ লক্ষ্য না করলেও আয়না এটা খেয়াল করে। একটু আগেই ওকে পাওয়ার জন্য কেমন উতলা হচ্ছিলো আর এখন বউয়ের মগে পানি খেতে ওর ঘেণা লাগছে। আয়না খুব আহত হলো। কেন উনি ওর মগ থেকে পানি খাবে না? এতো কিসের সমস্যা!
আয়না উঠে দাঁড়িয়ে শোকেজের দিকে যাবে, এমন সময় সমুদ্র ওর মগে চুমুক দেয়। আয়না এ-দৃশ্য দেখে পা চালানো থামিয়ে দেয়।
সন্ধ্যাতেই একদম ডিনার সেরে সমুদ্র জানালো আগামী শনিবার ওর এক স্কুলের খুব ক্লোজ ফ্রেন্ডের বিয়ের প্রোগ্রাম। সেখানে আয়নাকে নিয়ে যাবে। আয়না সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে, ” রবিবার আমার কুইজ আছে। অনেক পড়া বাকি।”
এটা শোনার পর সমুদ্র তাকে দ্রুত পড়ার টেবিলে বসিয়ে দিল। এরপর আদেশ দেয়, ” বই খুলো। যে সাবজেক্টের উপর এক্সাম সেটা এখন থেকে পড়ো। আরোও পাঁচদিন আছে। হয়ে যাবে সব পড়া।”
আয়না চোখ গোল গোল করে বলে, ” পাঁচদিন পর এক্সাম এখন থেকে কেন পড়বো?”
–” তো কবে পড়বে?”
–” আমরা ইঞ্জিনিয়ার’রা সবসময় পরীক্ষার আগের দিন রাতে পড়ি।”
সমুদ্র হতভম্ব হলো ওর কথা শুনে। এরপর ধমক দিয়ে পড়াতে বসালো। আয়না ধমক খেয়ে ল্যাপটপে কোডিং করা শুরু করে।
সমুদ্র কড়া গলায় বলে, ” আগামী পাঁচদিন আমি রেগুলার এসে তোমাকে দুইঘন্টা করে পড়াতে বসাবো। আশা করি আগের দিন রাতে না পড়লেও এক্সাম ভালো হবে।”
কুইজের জন্য একরাত পড়লেই যথেষ্ট তবুও উনি প্রতিদিন আসবেন, এই উছিলায় ওনাকে দেখতে পারবে। এজন্য আয়না নীরব থাকে। কোডিং কিছুই হয় না। মাথা হ্যাংক মেরে গেছে। একটু পরপর ওই নীল চোখের দিকে তাকাচ্ছিলো সে। যদিও বা আয়নার ওনার ফ্রেন্ডের বিয়ে এটেন্ট করার একদম ইচ্ছা নাই। ছুঁতা খুঁজছে কীভাবে না যাওয়া যায়। উনি অনেক জ্বালায় ওকে। এরকম জ্বালানী লোকের সঙ্গে বিয়ে খেতে যাবে না সে। তার উপর উনি প্রোফেশনাল লাইফে বিয়ের খবর ডিসক্লোজ করেনি। বন্ধুমহলে করেছে কিনা জানা নাই। সে নানা অযুহাত দেখায় না যাওয়ার। সমুদ্র সব অযুহাত ভেস্তে দেয়। শেষ অযুহাত ছিলো কুইজের সাবজেক্টটা অনেক কঠিন। আগের দিন না পড়লে ফেইল আসবে। তবুও সমুদ্রের সঙ্গে যুক্তিতে পারে না। ও পড়ানোর সময় আধাঘন্টা বাড়ায় দেয়। একদিন আসতে পারেনি। সেদিন জুম মিটিং করে টানা দুইঘন্টা আয়নাকে পাহারা দিয়ে পড়ায়।
আয়না শনিবার জানতে পারে যে আগামীকালের এক্সাম ক্যানসেল। সে হতাশই হলো। যদিও, পরীক্ষা পিছিয়েছে জানা সত্ত্বেও, সকালেও আয়না আরেকদফা অযুহাত দিয়ে বলে যে কুইজের পড়া কঠিন অনেক। রাতে বাইরে গেলে ফেইল আসলে সমস্যা হতে পারে।
সমুদ্র ফোনেই ওকে বলে, ” পাঁচদিন ধরে পড়ছো একই পড়া স্টিল এই কথা! তোমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে গরুর জন্য ঘাস কাটা উচিত। গবেট কোথাকার। আমরা মেডিকেলে আইটেমের জন্য বড়জোর বাইশ ঘন্টাও টাইম পাইতাম না। আর তুমি ছয়দিন ধরে পড়েও এসব বলো।
আয়নার মুখ কালো হয়ে আসে। আসলে কুইজটা ফ্যাক্ট না। ফ্যাক্ট হলো আয়নার-ই যাওয়ার ইচ্ছা নাই। বিভিন্ন কারণে বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা করে না তার। উনি যতোই আগ্রহ দেখাক। আয়নার যেতে মন চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ও না গেলে ওনাকে একটু শায়েস্তা করা যাবে।
বিকেলের দিকে রেডি হয়ে থাকতে বলেছিলো সমুদ্র কিন্তু সমুদ্র ওর বাসায় পৌঁছে দেখে আয়না এখনো রেডি হয়নি। সমুদ্র সোজাসাপটা রেডি হতে বলে ওকে। একপ্রকার টেনে ওয়াশরুমে পাঠায়৷ আয়না অনিচ্ছায় ওয়াশরুমে যায় মুখ ওয়াশ করতে।
এমন সময় আয়নার ফোনে অর্পার কল আসে৷
আজকে সমুদ্র রিসিভ করে। অর্পা সৌজন্যবশত ওর সাথে কথা চালিয়ে যায়। সমুদ্রের মনে হচ্ছে, অর্পা খুব রিল্যাক্সড আছে। কালকে ওর এক্সাম কিন্তু ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ছুটি।
সে প্রশ্ন করে, ” অর্পা কাল তোমাদের কুইজ না?”
–” না তো৷ ভাইয়া।”
–” আর ইউ সিউর? আয়না বললো কুইজ আছে।”
–” ছিলো, ভাইয়া। ক্যান্সেল হয়ে গেছে। আয়নাই গ্রুপে জানালো যে আগামীকালকের কুইজ স্থগিত। ”
মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সে ফোন কেটে দিয়ে, ফোনটা চটকা মারে।
তখনই আয়না বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ” শাড়ি পড়ব?”
–” তোমার কাল কুইজ না?
–” হ্যাঁ। হার্ড সাবজেক্টের কুইজ। জানেন তো।”
–” যেতে চাচ্ছিলে না। আমিই ফোর্স করলাম। সর্যি। তোমার ডিস্টার্ব হবে। যাওয়ার লাগবে না।”
কথাগুলো খুব কর্কশ গলায় বলে বেরিয়ে যায়। আয়না পেছনে থেকে দু’বার ডাকে কিন্তু সাড়া পায় না। আয়নার কলিজা ধক্ করে উঠে। সে বুঝতে পারে না কী করবে৷ সেই মুহুর্তে অর্পা কল আসে। কল ধরতেই ও জানালো ওর সমুদ্রের সঙ্গে কথা হলো একটু আগে। পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার খবর সে জানিয়েছে।
আয়নার মাথায় হাত। উনি যে রাগী, এই মিথ্যা বলার জন্য নিশ্চয়ই এতো খেপেছে। এখন কী করবে সে? ওনার রাগ কীভাবে ভাঙ্গাবে? সবকিছু এতো জটিল কেন হচ্ছে। ধ্যাত! জীবনটাই প্যারাময়!
চলবে।
#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–25
রাস্তার ধারে সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় আবৃত রাস্তা-ঘাট। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা ৷ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ। সমুদ্র কোনো কিছু ঠাণ্ডায় মাথা ভাবতে পারছে না। একধ্যানে গাড়ি চালাচ্ছে আর নিরবিচ্ছিন্ন ভাবনা-চেতনায় ব্যস্ত। আয়নার এহেন আচরণ ওকে বড্ড ভাবাচ্ছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না, স্বাভাবিক রীতিমত এরেঞ্জ ম্যারেজ করার পরও এতো জটিলতা কেন? আর দশ-বারোটা বৈবাহিক সম্পর্কের মতো তাদের সম্পর্ক আগাচ্ছে কেন? কেন? আয়নার ব্যবহারে সে স্পষ্টভাবে অবহেলা দেখতে পাচ্ছে। এক জীবনে বহু পরিমাণ অবহেলার স্বাদ গ্রহণ করেছে। ইউশার বিষয়টাও এতো প্যাথেটিক নয়। কিন্তু আয়নার ক্ষেত্রে বিষয়গুলো– সবটা ভিন্ন। তাদের মধ্যে কোনো থার্ড পার্সন নেই, স্টীল সবটা কেন এতো খাপছাড়া? কেন ও এতো উদাসীন? মুখে কিছু বলে না। সমস্যা কী তাও জানায় না। ওর উদাসীনতা বড্ড ভাবায় সমুদ্রকে।
কমিউনিটি সেন্টারের সামনে এসে গাড়ি থামালো সে। সব ফ্রেন্ডদেরকে ইতিমধ্যে জানিয়েছে ওয়াইভ সহ আসছে। এখন আয়নাকে দেখতে না পেলে সবাই হরেকরকম প্রশ্ন তুলবে। নতুন বউ দেখার জন্য সবাই মুখিয়ে আছে যেন। নীলাও আসছে। ও নিশ্চয়ই মাথা খাবে। সে পার্কিং লটেই বসে থাকে। ইচ্ছা করে দেরিতে যাবে। এখন একদম যেতে মন চাচ্ছে না। গাড়িতে বসেই সিগারেট ধরায় সে।
আয়না নিজের রুমে মন খারাপ করে বসে আছে। তার সত্যি খুব খারাপ লাগছে। গিল্ট ফিল হচ্ছে এখন। এক্সপ্লেনেশন দেওয়ারও সময় দিলো না। এখন কী করবে সে? মাথা কাজ করছে নাহ। অসহায় লাগছে। একটু পর আলিয়া ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করে, ” ভাইয়া কী রেগে বের হয়ে গেলো আপা?”
আয়না অসহায় মুখ করে ছোট বোনের দিকে তাকায়। আলিয়ার যা বোঝার বুঝে যায়৷ নিশ্চয়ই দু’জনের মধ্যে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। যদিও মুখে কেউ কিছু বলে নি।
আয়না নিজ থেকে মুখ কালো করে বলে, ” ওনাকে আমি রাগিয়ে দিয়েছি। ইচ্ছা করে না আবার অনিচ্ছাতেও না।”
–” ওহো কি যে বলো বুঝিই না।”
–” কী করবো এখন?”
আলিয়া বোনকে বলে উঠে, ” ভাইয়া তো চলে গেছে কি আর করবে? তোমার আর বিয়ের প্রোগ্রামে যাওয়া হচ্ছে না। পারলে ভাইকে কিছু গিফট দিয়ে দিও। রাগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে।”
–” সে’বার আমি যখন রাগ করলাম, উনি আমার প্রিয় চকলেট দিলো। কিন্তু আমি কী দিবো!”
–” চকলেট দেও।”
–” ধ্যাত, উনি চকলেট খায় না।”
আলিয়াই মুখ ফসকে বলে, ” তাইলে সিগারেট দেও গিফট। ওটাতেই খুশি হবে।”
কথাটা বলার সাথে সাথে আলিয়া মাথা চুলকে বের হয়ে যায় রুম ছেড়ে। আয়না ভাবতেই থাকে। যে করে হোক ওনার রাগ ভাঙ্গানো লাগবে। তার দোষে সবটা হয়েছে। এখন তাকেই সব ঠিক করা লাগবে৷ জনাব ডাক্তার উরফ বিজনেসম্যান সাহেব যতোক্ষন না রাগ ফেলে দিচ্ছে, সে তাকে তার মতো করেই জ্বালিয়ে যাবে।
_______________
ঠিক রাত আটটার পর বিয়ের প্রোগ্রামে ঢুকে সমুদ্র। সাদা শার্ট আর কালো স্যুট পরেছে আজ। প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে জমে গেছে। গেস্টরা এসে গেছে। সে ঢুকে ফ্রেন্ডদের খুঁজতে লাগে। এরমধ্যেই তন্ময় যার বিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আন্টি কেমন আছো জিজ্ঞেস করেই দ্বিতীয় প্রশ্ন ছু’ড়লেন,নতুন বউ কোথায়? সমুদ্র ওর ফ্রেন্ডদের সবাইকে জানিয়েছে বিয়ের কথা। সে সুবাদে ওদের অভিভাবকরাও জানেন।
সমুদ্র জবাব দিতে পারেনা। হাল্কা হাসে শুধু। এজন্য দেরিতে এসেছে। একঘন্টাও থাকবে না সে। পেছনে থেকে ওর ফ্রেন্ডদের গ্রুপের কেউ একজন ডাক দিলো। সে পেছনে ঘুরতেই দেখলো, স্টেজের সামনে থেকে দ্বিতীয় রো’তে ওর পুরা ফ্রেন্ড সার্কেল গ্রুপিং হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে গল্প করছে। সে ইশারা করে জানায় আসছে ও’দিকটায়। আন্টিও ব্যস্ত আজ। কাজেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও কিছু বলার সময় পান না। সমুদ্র ফ্রেন্ডের কাছে গিয়ে কথা বলে।
ওরাও সৌজন্যমূলক কথার ফাঁকে বারবার জিজ্ঞেস করে ভাবী কই? ভাবীকে আন। ভাবীকে রেখেই এদিকে আসলি কেন? ভাবী কী খেতে বসে গেছে?
সমুদ্র কোনোকিছুরই জবাব দেয় না। ওদের কীভাবে বলবে ওদের ভাবী তো এলোই না। বলতেও দ্বীদ্ধা কাজ করছে। সমুদ্র বিড়বিড় করে বলে, ” আসেনি।”
কিন্তু আস্তে বলায় ওরা শুনে না। ভুল শুনে। একজন বলেই দেয়,” কিরে ভাবী পিছে নাকী!”
সমুদ্র বলে, ” ধুর না। ও আস……. ”
এমন সময় পেছনে থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে আসে। ” হ্যাঁ ওনার পেছন পেছন আসছি।”
সমুদ্র পিলে চমকে উঠে। নারীকণ্ঠটি তার পরিচিত। এটা তো আয়নার ভয়েজ। ওর ভয়েজ এখানে কেন শুনলো সে? পেছনে তাকায় না একবারও। মেয়েটা অন্য কেউ, অন্যকারো সাথে এসেছে। আয়না আসেনি। কিন্তু তার সমস্ত যুক্তি,চিন্তাভাবনা কে ভেস্তে দিয়ে আয়না তার পাশে এসে দাঁড়ালো। ওর আঙ্গুলে আঙ্গুলে ছু’য়ে দেয় খানিক। সবার সঙ্গে বেশ মিষ্টিসুরে কথা বলতে আরম্ভ করে। ছবিতে সবাই আয়নাকে দেখেছে। তাই চিনতে ওদের সমস্যা হয়নি। সমুদ্র একবারও তাকায় না ওর পানে৷ তবে ওর হাতের ছো’য়ায় হঠাৎ কোথায় জানি কম্পন ধরে। হয়তো হৃদয়ে। ওই অকেজো হৃদয়ে আজ হঠাৎ অনুভূতি ফুটছে যেন! মনের কোনো কোণে যেন ভালো লাগারা হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে আড়চোখে একটা বার শুধু তার দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই মেয়েটা আয়না তো? নাকি তার ভ্রম। ও কীভাবে এলো, কেন এলো, এতো পারফেক্ট টাইমে কীভাবে এলো কিছু ই জিজ্ঞেস করা হলো না।
বেগুনি জামদানীতে ওকে সুন্দর লাগছে সেটা জীবনেও বলবে না। হুহ!
কথাত ফাঁকে সকলেই গোল হয়ে বসে। আয়নাকে সবাই গুরুত্ব বেশি দিচ্ছে। আয়নাও সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে যেন ওদের সঙ্গে কতোদিনের পরিচয় ওর। দেখে মনে হচ্ছে, ওর কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু সমুদ্র পারেনা আনন্দ করতে । সে একপাশে চুপচাপ বসে থাকে আর একটু পরপর ওকে দেখে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আজ আয়নার বুদ্ধি খুলেছে যেন। সমুদ্র যতোবারই লুকিয়ে বা আড়ালে থেকে ওকে দেখার চেষ্টা করেছে ততোবারই আয়নার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোরও ধরা খেতে পছন্দ করে না, সেখানে সে লেজকাটা শেয়াল হয়ে বারংবার ধরা খাচ্ছে। ওর সব ফ্রেন্ডরা মিলে একটা ট্যুরের আয়োজন করতে চাচ্ছে। শ্রীমঙ্গল এ একটা রিসোর্টে। সমুদ্র সরে এসে রেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ায়। রেস্টরুম বলতে হৈচৈ মুক্ত ছোট একটা রুম। ব্যাকস্টেজে। তবে নন-এসি।গুমোট রুম। একটু পরই প্রথম ব্যাচের আহার পর্ব। এদিকটায় ভীড় নেই বললেই চলে। রেস্টরুমটাও জনমানবহীন ছিলো। সে এসে প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসতেই দু’মিনিটের ব্যবধানে আয়না তাকে অনুসরণ করে চলে আসে৷ সমুদ্র তা দেখামাত্র বিরক্ত হয়।
আয়না তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর জামদানী শাড়িটা একটু নিচে নেমে গেছে বোধহয়। নিশ্চয়ই ঠিকমতো শাড়ির ভাঁজ তৈরি করতে পারেনি। ফর্সা অনাবৃত পে–টের খানিক অংশ দেখা যাচ্ছে৷ সমুদ্রের বিরক্তির মাত্রা আরোও বৃদ্ধি পেলো।
সে চোখ গরম করে আয়নার পানে তাকিয়ে বলে উঠে, ” এখানে কেন আসছো? যাও স্টেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। আমার কাছে কী?”
–” আপনার কাছেই তো সব।”
–” লেইম কথা বাদ দেও। ওকে?”
–” সবাই মিলে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। রিসোর্ট বুক করা হয়েছে।”
–“আমরা যাবো না।”
–” না, যাবো৷ আমি আমাদের নাম দিয়ে দিয়েছি। রুমও বুকিং হয়ে গেছে। কাপল রুম আমাদের জন্য।”
–” আমার কাজ আছে। অফিস আছে। আমি যাবো না। ইচ্ছা হলে তুমি একাই যাও।”
–” শুক্র-শনি বার আবার কিসর অফিস?”
সমুদ্র কথা বাড়ায় না। মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আয়না পার্স খুলে একটা গিফট বের করে। র্যাপিং করা।”
আয়না ওর হাতে গুঁজে দেয় এরপরে বলে, ” খুলে দেখুন।”
সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে টান মেরে র্যাপিং পেপার ছিঁড়ে ফেলে।যেন পেপার ছেঁড়ার মাধ্যমে নিজের রাগের মাত্রা বোঝাতে চাচ্ছে ও। প্যাকেট খুলতেই দেখলো দু’টো বিদেশি দামী ব্রান্ডের সিগারেটের প্যাকেট। সে চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই প্রথম সে উপহার হিসেবে সিগারেট পেলো।
আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তুমি সিগারেট কেন এনেছো?”
–” আমি রাগ করেছিলাম বলে আমার প্রিয় কিটক্যাট দিলেন, তাই ভাবলাম আপনি রাগ করেছেন জন্য আপনার প্রিয় সিগারেট দিই।”
সমুদ্র সব রাগ কপূর্রের ন্যায় উবে যায়। এতো কিউট চিন্তা করে জোশ একটা গিফট দিয়েছে ও! তবে মোটেও তা আয়নাকে বুঝতে দেয় না। এতো জলদি রাগ পড়ে যাওয়ার কথা আয়নাকে বলে দিলে ওর রাগের দাম কমে যায়।
রাগ আর শেয়ার বাজারের মূল্য কমতে থাকলে, দাম থাকে না।
সে সিগারেট প্যাকেটে ঢুকিয়ে বলে, ” এমন মেকাপ করে সিগারেট কিনতে গেছো পুরা এলাকাবাসী জেনে যায়নি?”
–” দারোয়ান কে নিয়ে আনিয়েছি।”
সমুদ্র সোজাসুজি গেইটের দিকে যেতে ধরলে আয়নার বাহু ধরে বলে, ” সর্যি তো! আচ্ছা আপনার রাগ এখনো কমেনি? তাহলে কান ধরি? আপনি বললে উঠা-বসা ও করবো। তাও প্লিজ নর্মাল হন।”
সমুদ্র ভ্রু কুচকে রেখেই জবাব দেয়, ” তোমার মধ্যে এতো ছেলেমানুষী ভাব কেন? আজব!”
আয়না ওনার কথা শোনার অপেক্ষায় না থেকে কানে হাত দিতেই সমুদ্র বলে উঠে, ” এই এই কি করছো? কেউ দেখলে আমাকে নারী নির্যাতন মামলায় জেলে ঢুকায় দিবে। কান থেকে হাত নামাও।”
আয়না কান থেকে হাত নামিয়ে সমুদ্রের দিকে ছু’টে আসতে গেলে, শাড়ির কুচির সঙ্গে স্যান্ডেলের হিলের অংশ লেগে হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে পড়ে যেতে নেয়। ভাগ্য সহায় ছিলো। সমুদ্র সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় ওর বুকের উপর হুমড়ি খায়। সমুদ্রের টাল সামলাতে ভারী কষ্ট হয়। পাশের দেয়ালের সঙ্গে পিঠ গিয়ে ধাক্কা খায়৷ লাগেও খুব। তবে প্রকাশ করে না। বেশ শক্ত করেই আয়নাকে ধরে থাকে। ও আস্তে করে ধরে থাকলে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে চিটপাটাং হবে ও।
সমুদ্র ওর কোমড় চেপে ধরেই ঝারি মারা কণ্ঠে বলে, ” এভাবে এতো লাফালাফি করো যে পরে গেলে কী হত? মাজা ভে–ঙে হসপিটালাইজড হওয়া লাগত।”
আয়না ওর কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। বুকে লেপ্টে থাকে যেমন করে কোনো বড় গাছকে আটকে মরা লতা-পাতা লেপ্টে থাকে৷ সমুদ্রের কোনো জানি লাগে। সবটা অন্যরকম লাগে৷ কেমন লাগছে এর উত্তর তার চাই। সে আবেশে চোখ বুজে ফেলে। কে জানি উত্তর দেয় শান্তি লাগছে বড়। কে দিলো উত্তরটা? কারো কথা শোনা যাচ্ছে৷ কিন্তু ও কারো কথা শুনছে চায় না এই মুহূর্তে ৷ শুধু অনুভব করতে চায়।
আয়নার অনাবৃত আচলের ফাঁক গলে ওই হলদে দুধে আলতা পেটে হাত চালায়। এক প্রকার খা–মচে ধরে। অবিন্যস্ত হাত চঞ্চলতা বাড়ায়। দুজন এতো কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে যে ওর কম্পিত হওয়াও সে অনুভব করে৷ ওর উষ্ণ নিশ্বাস সবটা তার মধ্যে অন্তঃরাল থেকে শিহরণী সংকেত দিচ্ছে। অসহ্যরকম আরাম লাগে। সে সমস্ত বলপ্রয়োগ করে আয়নাকে নিজের বুকের সঙ্গে আরোও জোরে আগলে নেয়। নিজের ভার ছেড়ে দেয় দেয়ালে। সমুদ্রের মনে হলো আয়না তার হৃদপিণ্ডটা ঠাণ্ডা করে দিলো। পারলে ওকে বুকের সঙ্গে পি–&ষে নিত। একদম ব্লে–ন্ড করে বুকে ঢুকিয়ে নিবে।
–” শুনছেন কী বলছি?”
–” না।”
সমুদ্র বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়। তার কিছু শুনতে মন চাচ্ছে না৷ এভাবেই যুগ যুগ কাটিয়ে দিতে চায়৷ কিন্তু আয়নার এখনই কথা বলতে হবে৷ কথা না বললে যেন ভারতবর্ষ ধ্বং–স হবে।
সে একটু মাথা উঁচু করে বলে, ” আমার কুঁচি খুলে গেছে।”
–” কি খুলে গেছে?”
–” শাড়ির কুঁচি। শাড়ি যেকোনো সময় খুলে যাবে।প্লিজ কোনো ব্যবস্থা করেন।”
সমুদ্রের সঙ্গে সঙ্গে টনক নড়ে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ” এ’সব কী বলো?”
আয়না তখন ব্যস্ত হয়ে আঁচল ধরে নিচু হয়ে কুঁচি দেখছিলো। সমুদ্র দ্রুত ছু’টে গেইট লক করে দেয়। মেয়েটার যদি কোনোদিকে খেয়াল থাকে। এই মুহূর্তে যদি কেউ ভেতরে ঢুকে পরে! গেইট লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই সমুদ্রের যেন হতবুদ্ধি হওয়ার উপক্রম। ছোট্ট করে দু’বার ঢোক গিললো। যা সামনে দেখছে এ’সব দৃশ্য দেখলে যেকারো মাথা খারাপ হয়ে যাবে। ও সমস্ত কুঁচি খুলে ওগুলো পুনরায় ভাঁজ করছে। আঁচলের বালাই নাই। নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্লাউজের হাতা উলটে আছে। সমুদ্র একবার মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ব্রাশ করে নিল এতে রক্ত সঞ্চারিত ঠিকঠাক মতো হয়। প্রেশার বাড়লে এমন করা লাগে। তাহলে আরাম লাগে। প্রোফেসর এডরিন এটা বলেছিলো।
সে এক পা, দু’পা এগিয়ে আসতেই আয়না ওর আঁচলখানা সমুদ্রের হাতে তুলে দিয়ে বলে, ” শাড়িটা এতো ভারী, কোনোভাবেই কুঁচি হচ্ছে না৷ একটু নিচু হয়ে কুঁচি গুলো ঠিক করে দিতে পারবেন?”
–” আমি জীবনেও শাড়ি পড়া দেখিনি।”
–” তাই বলে কুঁচি ঠিক করে দিতে পারবেন না? একদম ডাস্টবিনের মতো কথা বললেন।”
–” ঠিক করে শাড়ি পড়িয়ে দিলে বলবে কাকে আগে পড়াতাম শাড়ি। এসব ঝামেলায় আমি নাই।”
আয়না মুখ ফুলিয়ে বলে, ” না এসব কিছু বলবো না।প্লিজ হেল্প।”
সমুদ্র আবার কেউ সাহায্য চাইলে না করে না। জোর গলায় বলে, ” আঁচল ধরো।আর হ্যাঁ একদম কই মাছের মতো লাফালাফি করবা না।”
ওর শাড়ির কুঁচি কোনোরকমে ভাঁজ দিয়ে সেভটিপিন মেরে দেয়। যদিও বা সুন্দর হয়নি কিন্তু চলনসই। খুলে পড়ার অন্তত সম্ভাবনা নেই। সমুদ্র নিজেও অবাক হলো কেমনে পারলো সে কুচি ভাঁজ করতে?
শাড়ি পড়ানো হতেই আয়নার ওর দু’হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” শুনেন।”
সমুদ্রের হাত ছিলো ওর কুচিদ্বয়ের ভাঁজে। এরপর গভীর মনোযোগ দিয়ে অনাবৃত অংশগুলো ঢেকে দেয়। তারপর সুধায়,” বলো।”
–” তাকান আমার দিকে।”
সমুদ্র মাথা উঁচু করতেই আয়না ওর বাম গালে একটা চু-মু বসায়। এরপর ছেড়ে দিয়ে বলে, ” থ্যাংকস। শাড়ি ঠিক করে দেওয়ার জন্য।”
এরপর ডান গালে আবারোও আলতো করে ঠোঁট ছু’য়ে দেয়। ছেড়ে দিয়ে বলে, ” এন্ড সর্যি।”
সমুদ্র হতভম্ব হয়ে হ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে, চোখ গোল গোল করে৷ সে একদম বরফের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গালে এখনো লাল লাল লিপস্টিকের দা?&গ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র ডান গালটায় যেখানে চু–মু বসিয়েছে সেখানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে যে ওর পথ আটকে থামাবে সে উপায় নেই। আয়না একপ্রকার দৌঁড়ে রেস্টরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে৷
স্টেজের সামনেই নীলার সঙ্গে দেখা। নীলা আয়নাকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খায়। অবিরাম বকবক করতেই থাকে ওর সাথে।
সমুদ্রের সম্পূর্ণ ফ্রেন্ড গ্রুপ মিলে বর-বউয়ের সঙ্গে ফটোসেশান করে। তারপর খেতে যায়৷ খাওয়ার সময় ওয়েটারকে আয়না বলে উঠে, ” ডাক্তার সাহেব কে লেগপিজ দিবেন।”
সমুদ্রের এতো মেজাজ খারাপ হয়। ওর সব ফ্রেন্ডরা হেসে দেয়। এতো বুড়া হওয়ার পর মানুষ-জন এ বয়সে আর লেগপিজ চায় না। এখন বাচ্চাদের লেগপিজ খাওয়ানোর বয়স যাচ্ছে। ওদের হাসতে দেখে ওয়েটারও হেসে দেয়। তারপর বলে, ” দিচ্ছি স্যার।”
সমুদ্র মুখ-চোখ শক্ত করে খেতেই থাকে৷ এমন সময় হুট করে ওর বাম পায়ে সুর–সুরি অনুভূতি হয়। বাম পাশে আয়না বসেছে৷ সে চোখ নিচু করে দেখলো, আয়না স্যান্ডেল খুলে ওর পায়ের আ–ঙ্গুল দিয়ে ওকে কাতু–কুতু দিয়ে ইচ্ছা করে জ্বালাচ্ছে৷ সমুদ্র চোখ গরম করে আয়নার দিকে তাকায়। আয়না ওইসময় গভীর মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার অভিনয় করে। দ্বিতীয়বার এমন করলে সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়৷ এক ফ্রেন্ড প্রশ্ন করে, ” কি হলো?”
সমুদ্র পড়ে বিপাকে। বউয়ের দুষ্টামির কথা তো পাবলিকভাবে বলা যায় না। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
–” পানি নিবো।”
টেবিলের মাঝখান থেকে পানি নিয়ে গ্লাসে ঢেলে নেয়। ওদের দু’জনের চোখাচোখি হতেই সমুদ্র ইশারায় বুঝায় কাজটা ভালো হচ্ছে না। আয়না ভ্রুক্ষেপহীন। সে ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসি হাসে। সমুদ্র ওর কাতুকুতু দেওয়া সহ্য করতে থাকে। এগুলো একদা সেও করেছে। তার সূত্র তার উপরই প্রয়োগ করছে।বেয়াদব মেয়ে!
খাওয়া শেষে চেয়ারে বসতেই নীলা ওর ছোটো মেয়েটাকে আয়নার কোলে তুলে দিয়ে বলে, ” নুহা মামনি কিছুক্ষণ নতুন মামীর সঙ্গে থাকো। আম্মু-আব্বু খেয়ে নিক ততোক্ষণে।”
আয়না বাচ্চা খুব সুন্দর মতো রাখতে পারে৷ ও একদম দক্ষদের মতো এতো ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। সমুদ্র অবাক হয়। সে ডাক্তার হয়েও এতো ছোট বাচ্চা নিতে পারেনা। ইন ফ্যাক্ট বাচ্চাই কোলে নেয় না। সে বলে উঠে, ” তোরা বাচ্চা অন্যের কাছে ফেলে রেখে খাওয়া-দাওয়া করবি? কেমন নির্দয় মা তুই!”
নীলা সমুদ্রের দিকে তাকায় এবং বললো, ” তোরও এমন মিনি সাইজ আসবে৷ তখন বুঝবি মজা। দেখবো বাচ্চা কোলে রাখে কেমনে খাস তুই। বাচ্চার কান্না থামাতে গিয়ে আর খাইতেই পারবি না। এরচেয়ে এখন থেকেই দ্রুত ট্রেনিং নে।”
আয়না বাবু কোলে নিয়েই বলে, ” ওনার আসলেই ট্রেনিংয়ের দরকার আছে। নাহলে দেখা যাবে বাবুর সেরিলাক নিজেই খেয়ে বসে আছে। ওদিকে বাচ্চা ক্ষুধায় কাঁদছে।”
নীলা আর আয়না দুজনে সমুদ্রকে পচাতে পেরে খুব হাসলো। মাকে হাসতে দেখে ছোটো নুহাও ফোকলা দাঁতে হাসি দিলো। সমুদ্র মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আয়না প্রশ্ন করে, ” আপনি বাচ্চা কোলে নিতে জানেন তো? নিয়েছেন কোনোদিন? ”
–” হসপিটালে নিয়েছিলাম। অনেক আগে।”
আয়না অবাক নয়নে বলে উঠে, ” তাহলে আসলেই আপনার ট্রেনিং দরকার। আপু ঠিকই বলছে। আচ্ছা চেয়ারে বসুন। আমি দেখাচ্ছি কীভাবে বাচ্চা কোলে নিতে হয়। তারপর নুহাকে কোলে নেন।”
সমুদ্র সরে এসে বলে, ” একদম নিজের বাচ্চা হলেই কোলে নিবো ওকে।এর আগে না।”
আয়না অবাক চোখে তাকালে সমুদ্র বলে উঠে, ” তুমি দেখি ভালোই বাচ্চা সামলাতে জানো। আমার তো সুবিধাই তাহলে।”
সবার সঙ্গে বিদায়ের বেলা নীলা একফাঁকে সমুদ্রকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে, ” ইউশা দেশে এসেছে, জানিস?”
সমুদ্র ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে বলে, ” না।”
–” এভাবে হুট করে কেন আসলো? কি চায়?”
–” ওর ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই না। আসি।”
আয়নাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতেই আয়নার মোবাইলে ওর বাবার ফোন আসে। আয়না ফোন কেটে দেয়। দাদা অসুস্থ থাকার সময় বাবা বাসাতেই ছিলো। কিন্তু গত দু’দিন রাতে বাসায় আসেনি। নিশ্চয়ই ওই মহিলার বাড়ি ছিলো। আয়না অবশ্য বাবার সঙ্গে কথা বলে না। চেহারাও দেখায় না। মুহুর্তের মধ্যে সমুদ্রের ফোন বেজে উঠে। ফাহাদ সাহেব কল দিয়েছেন। সমুদ্র রিসিভ করে কথা বলে নেয়৷
এরপর গাড়ি চালাতে চালাতে বললো, ” আজকে তুমি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছো। বিয়ে বাড়িতে এমন করে? রীতিমতো সিডি– উস করছিলে। আমি ভদ্র জন্য সহ্য করতে পেরেছি।”
আয়না চোখ গোল গোল করে তাকায় ওনার পানে। নীল আর বাদামী চোখের মণির মিলন ঘটে। সমুদ্র গাড়ির মোড় ঘুরিয়ে একটা অন্ধকার গলির ভেতর গাড়ি থামায়। আয়না ভয় পায়। যদিও উনি সঙ্গে আছেন। নিরাপদ ই থাকবে। তবুও এমন কোলাহল বিহীন, যানবাহন বিহীন অন্ধকার গলিতে গাড়ি থামানো রিস্কি লাগলো তার। একটা ল্যাম্পপোস্ট ও নেই আশেপাশে।
সমুদ্র আচানক ওর বাহুতে টান মারে। আয়না হেলে ওর দিকে ঠলে পড়ে৷ সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ” এখন জ্বালানোর পালা আমার।”
আয়না কিছু বলবে সে’সময় টুকুও পায় না ও৷ তার আগেই সমুদ্র ওর অ–ধর–জোড়া মিলিয়ে ফেলে ওর অ//ধর জোড়ার সঙ্গে। আপনা-আপনি কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় ওর। ওর চোখ রসগোল্লার মতো বড় আর গোল হয়ে যায় ক্ষণেই। আবেশে, আবেগে, লজ্জায় সব ধরনের অনুভূতির নতুন এক ফিউশানে উৎপন্ন অনুভূতির সাগরে ডুবতে ডুবতে আয়না উনার শার্ট খা–মচে ধরে। কতোক্ষণ পার হয় কে জানে৷ পেছনে থেকে গাড়ির গ্লাসে কিল দেওয়ার আওয়াজে হুশ আসে ওদের৷
সমুদ্র সরে এসে ঠোঁ–ট মুছে লুকিং গ্লাস দিয়ে ব্যাকভিউ দেখে। গলির মোড়ে আরেকটা গাড়ি এসেছে৷ কিন্তু সমুদ্রের পার্ক করা গাড়ির জন্য আগাতে পারছে না জন্য গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসেছে। হয়তো কয়েকবার হর্ন দিয়েছে৷ গা–লি-গালাজও করছে।
ওই সময় এই জগতে থাকলে তো গাড়ি সাইড করবে সে?
আয়না বলে উঠে, ” বেশি রোমিও গিরি করলে এমনই হবে।”
চলবে।