ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
286

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–26

আয়না জামা-কাপড় প্যাকিং করছে। আজকে বৃহস্পতিবার বিকেল। আজকে রাতে বাসে করে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছে তারা। সে ভীষণ এক্সাইটেড। যদিও বা সমুদ্রের একদম ইচ্ছা ছিলো না যাওয়ার। ও নাকি এ’দুদিন বিছানায় পরে পরে ঘুমাতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আয়নার জোড়াজুড়িতে ওনার না ‘হ্যা’ তে রুপান্তর হয়৷ আয়না কেন জানো খুব শখ করে একটা লাল জর্জেটের শাড়ি সঙ্গে নেয়। চা-বাগানে কেউ শাড়ি পরে বলে মনে হয় না কিন্তু তবুও সে সঙ্গে রাখে শাড়ি। অপেক্ষায় থাকে সমুদ্রের আসার। ও অফিস সেরে একবারে এ’বাসায় আসবে। ফোন হাতে নিলো।

খানিক বাদেই আয়নার রুমে টোকা পরে৷ আয়না বুঝলো এটা বাবা। বাবা-ই এভাবে টোকা দেয় দরজায়৷ সে নিশ্চুপ থাকে। কয়েকবার নক করে বাবা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। আয়না একবারও তাকায় না বাবার দিকে৷

ফাহাদ সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বলে, ” যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শেষ।”

–” দেখতে-ই তো পারছো।”

ফাহাদ সাহেব হতাশ হয়ে মেয়ের দিকে তাকালো। আয়নার একটা বদ অভ্যাস আছে। সে রেগে গেলে বা কষ্ট হলে কখনোই গলায় স্বর চরাও করে চিৎকার দিতে পারে না। তার জায়গায় অন্যকেউ হলে নিশ্চয়ই বাবার সঙ্গে এখন ঝগড়াঝাটি, চিল্লা-পাল্লা শুরু করে দিতো। কিন্তু সে পারে না। মনের মধ্যে সব কষ্ট চাপা দিয়ে রাখে। এভাবে মনকে আর কতোদিন চাপে রাখবে কে জানে?

ফাহাদ সাহেব বলেন,” সকালে নাস্তা খেতে ডাইনিং টেবিলে আসো না কেনো? রুমে কেন খাচ্ছো? তোমাদের সঙ্গে একবেলাই খাই। দুপুর আর রাত তো পেরিয়ে যায় কাজেই।”

আয়না কিছু বলে না। নিশ্চুপ থাকে৷ ফাহাদ সাহেব পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে টেবিলে রেখে বললো, ” বাইরে যাচ্ছো, টাকা সবসময় কাছে রাখবে। সাবধানে থাকবা।”

আয়না বলে উঠে, ” টাকা লাগবে না। নিয়ে যাও তোমার টাকা।”

ফাহাদ সাহেব রাগলেন না। ছোট থেকে মেয়েদের এতো আদরে-যত্নে মানুষ করেছেন যে বকা দিলে নিজেরই খারাপ লাগে। তার উপর মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। দু’দিন বাদে শ্বশুড়বাড়ি যাবে। এমন দিনে রাগারাগি করতে চান না আর।

সে আয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,” বাবার উপর রাগ করে কতোদিন থাকবে মা? ক্ষুদ্র একটা জীবন। তোমরা রেগে থাকলে আমি তো থাকতে পারি না। কষ্ট হয় অনেক। বাবাকে মাফ করা যায় না?”

আয়না ওর বাবার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ” যাও তো বাবা এখান থেকে। ভালো লাগে না৷ তুমি কখনো ভাবো আমাকে নিয়ে?”

–” সবসময় ভাবি, মা। তোমাদের জন্য ভাববো না তো কার জন্য ভাববো বলো?”

–” তুমি সবসময় তোমার দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা ভাবো।”

ফাহাদ সাহেব কিছুটা থমকালেন। এরপর কিছু বললেন না। তিনি আসলে জানেন না কি করবে এমন পরিস্থিতিতে? আয়না কোনোভাবেই তার সঙ্গে স্বাভাবিক হচ্ছে না৷ অপরদিকে শায়লা চাচ্ছে এ’বাসায় এসে থাকতে। ওর নাকি একা দমবন্ধ লাগে। ওর ঘর-সংসার চাই। একদিকে মেয়ের রাগ-জেদ, অন্যদিকে শায়লার প্রাপ্ত অধিকার। কীভাবে দুটো’বিষয় একসঙ্গে সামলাবেন তিনি? সে ফোঁস করে দম ফেলেন। আয়নাকে জানাতেই পারলেন না শায়লা আসবে খুব দ্রুত এ’বাসায়।

সমুদ্র সন্ধ্যার পর আয়নার বাসায় আসে। সে আসতেই আয়না খুব সুন্দর করে হাসলো তাকে দেখে। এতোক্ষণের জমে থাকা সব কষ্ট মুহুর্তের মধ্যে উবে যায়। সমুদ্রও ফিরতি হাসি ফেরত দেয়। দু’জনের মধ্যে এখন সবটা বেশ গোছালো। মনোমালিন্যর ছিটেফোঁটাও নেই। অথচ দু’দিন আগেই দু’জন দু’দিকের সড়কে পা মাড়াচ্ছিলো।

সমুদ্র এসেই আয়নার এক হাত ধরে টান মেরে বললো, ” কী ব্যাপার? রেডি হয়ে বসো আছো দেখছি? ও বুঝেছি হানিমুনে যাওয়া জন্য তর সইছে না?”

–” এই হানিমুনে কে যাচ্ছে?”

–” তুমি আর আমি।”

–” মোটেও হানিমুনে যাচ্ছি না। ”

–” বিয়ের পর ঘুরতে যাওয়াকেই হানিমুন বলে। বুঝছো?”

আয়না বলে উঠে, ” না। এটা হানিমুন না। আপনার সব ফ্রেন্ডের সঙ্গে যাচ্ছি। সো ইউ ক্যান সে ”ইটস ফ্রেন্ডমুন বাট প্লিজ হানিমুন নাহ।”

সমুদ্র হতাশ চোখে তাকায় এরপর বলে, ” চা দেও, চা খেয়ে মনের ব্যথা দূর করি।”

–” মনের ব্যথা মানে?”

–যার বউ হানিমুনকে ফ্রেন্ডমুন বানায় তাকে তো চা খেয়েই মনের দুঃখ-ব্যথা সারাতে হবে। বুঝলে আয়না, আমার লাভ-ক্ষতি নাই। জীবনটাই ক্ষতির খাতা।”

আয়না ওকে একবার ভেংচি কাটলো।

রাত আটটার মধ্যেই সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে বের হয়। ওর অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়েকজন ফ্রেন্ড-সিনিয়র, জুনিয়র এসেছে। যার বিয়েতে গিয়েছিলো ওর সাথে স্কুল থেকে পরিচয় হলেও দু’জন অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গিয়েছিলো। ওভারওল দশ-বারো জন ফ্রেন্ড তাদের স্পাউজ নিয়ে একটা রিসোর্টে গেট টুগেদার আয়োজন করেছে। মেডিকেলের ফ্রেন্ড বাদেও আরোও কয়েকজন আছে, কারা কারা আছে সমুদ্র খোঁজ নেয়নি। কিন্তু দেখা গেলো ওর ফ্রেন্ডরা বিশাল আয়োজন করেছে। অস্টেলিয়ায় এ’সময় ভ্যাকেশন চলছে। ওদের ব্যাচের বাঙ্গালী বেশ ক’জন এসেছে দেশে। সবাইকে নাকি জানানো হয়েছে। ধারণা করা যাচ্ছে বিশজন পার হয়ে যাবে। মিনি বাস নেওয়া হয়েছে৷ সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে শেষের দিকের বামপাশের’রো তে বসে। আয়না জানালার ধারের সীটে বসবে বললো। সমুদ্র নিজে সবসময় জানালার ধারে বসে৷ ইন ফ্যাক্ট ফ্লাই করার সময়ও উইন্ডসীটে বসার ট্রাই করে। তবে আজ আর বসলো না। আয়নাকে সীট দিলো৷

আয়নাকে বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে। ওকে আনন্দিত হতে দেখে সমুদ্রেরও ভালো লাগছিলো। তারা আগেভাগেই এসে পড়েছে৷ অনেক ফ্রেন্ডরা এখনো এসে পৌঁছে নি। যারা আসছে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। একটু পর নীলা আর ওর হাসবেন্ড আসলো। সমুদ্র আয়না দু’জনে অবাক হলো। ওর আসার কথা ছিলো না। হুট করে কেন আসলো?

সমুদ্র জিজ্ঞেস করে, ” কিরে তুই না বললি যাবি না?”

নীলা চোখ-মুখ শক্ত করে বলে, ” তোরা আনন্দ করবি আর বসে থাকবো আমি? এটা হয় না৷ তাছাড়া তোরে কল দিলাম কল ধরিস না কেন? এট লিস্ট ম্যাসেজ তো দেখবি।”

–” ফোনে চার্জ নাই।”

সমুদ্রের নীলার ভাবমূর্তি দেখে মনে হলো ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চাচ্ছে৷ কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না৷ সে আমলে নেয় না৷ আয়নার গা ঘেঁষে বসে পরে৷ খানিক বাদে বাস শ্রীমঙ্গলের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিছুক্ষণ গান বাজানো হল। রাত বাড়লে যাত্রীদের ঘুমের ডিস্টার্ব যেন না হয় সেজন্য গান বন্ধ করে দিয়ে লাইট নিভিয়ে দেওয়া হলো।

লাইট নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের দুষ্টামি বাড়ে। সে সোজাসোজি একদম আয়নার কোমড় প্যাচিয়ে ধরে নিজের বুকের দিকে টেনে নেয় ওকে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেনা সীটের হ্যান্ডেল থাকার জন্য।

বিরক্তি মুখে বলে উঠে, ” বা–লের হ্যান্ডেল।”

আয়না ফিক করে হেসে ফেলে এরপর বলে, ” ইদানীং আপনি অসভ্য ম্যাক্স প্রো হয়ে গেছেন। আগে তো এমন ছিলেন না।”

–” আগে কেমন ছিলাম?”

–” আগে শুধু অসভ্যই ছিলেন, যেটা তাও সামলানো যাচ্ছিলো কিন্তু এখন একদম আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছেন।”

সমুদ্র ওর কানের কাছটার চুলের গোছা সরিয়ে দিয়ে নিজের মুখ ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, ” এক্সট্রিম লেভেলের রোমান্টিক হওয়ার আগেই আউট অফ কন্ট্রোল বলছো। এক্সট্রিম হলে তো বলবে কন্ট্রোল আউট অফ আর্থ!”

আয়না ক্ষণেক কেঁপে সরে যেতে চায়। কিন্তু সমুদ্র ওর কোমড় আঁকড়ে ধরে ছিলো। ওকে সরতে দেখে সমুদ্র ওকে টেনে নিজের বুকের কাছে হেলিয়ে শু’ইয়ে দিয়ে বলে, ” মিসেস. আয়না, সরে গেলে তো হবে না। এখন তো কাছের আসার গল্প চলছে।”

আয়না চুপ থেকে ওর বুকে কিল বসায়৷

–” এইযে বুকে খালি সুযোগ পাইলেই কিল বসাও, হৃদয়টা তো ভেঙেচুড়ে যায়।”

______________

শ্রীমঙ্গল যখন পৌঁছে তারা তখন ভোর চারটা। অন্ধকার ই আছে এখনো। বাস একদম রিসোর্টের সামনে এসে থেমেছে৷ আয়না তখন সমুদ্রের বুকে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। একদম আরামের ঘুম। এমন আরামের ঘুম অনিদ্রায় ভোগা মানুষদের চোখ দিয়ে দেখেই শান্তি মিলে। ওর একদম তাকে ডাকতে মন চায় না৷ সে আরেকটু শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে, ওর ফোলা ফোলা গালে হাত ছো’য়ালো এরপর কপালে চুমু দিতেই পেছনে থেকে নীলা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ” কারো নজর না লাগুক। থু।”

সমুদ্র খানিক লজ্জা পায় এভাবে বন্ধুর সামনে ধরা খাওয়ায়। সে স্মিত হাসে কেবল।

রিসোর্টে যেতে হবে কিন্তু আয়না ঘুমে, উপায় নেই বিধায় আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” আয়না, উঠো। দেখো পৌঁছে গেছি। আয়না?”

আয়না চোখ পিটপিট করে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে সমুদ্রের চেহারা ভেসে আসে। ও মুচকি হেসে তাকে ‘ শুভ সকাল” বলে।

সে মাত্র জাগ্রত হতেই নিজেকে সমুদ্রের বুকে দেখে৷ একদম বুকে গুটিসুটি মেরে কোলে শু’য়ে থাকার মতো অবস্থায় আছে। ইতিমধ্যে বাস থেকে ওর সব ফ্রেন্ডরা স্পাউজদের নিয়ে বাস থেকে নামছে। এদিকটা ক্রস করেই বেরিয়ে যাচ্ছে। যারা যাচ্ছে সবাই এই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। এতোগুলা মানুষের সামনে কোন আক্কেলে তাকে বুকে নিয়ে বসে থাকে। মানে এনার আর কোনো কাণ্ডজ্ঞান হবে না!

সে উঠে বসেই সবার আগে বললো, ” এভাবে সবার সামনেই আপনি আমাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন? লজ্জা নাই কোনো?”

–” সমস্যা কোথায়? আমার বউকেই তো কোলে নিয়েছি। অন্যের বউকে নিলে সমস্যা ছিলো।”

আয়না রুঢ় কন্ঠে বলে, ” আমি কী বাচ্চা নাকি যে কোলে নিয়ে থাকবেন? আর শখ কতো অন্যের বউকে কোলে নিতে চান? আরেকবার এই কথা বললে মাথার সব চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।”

সমুদ্র চোখ টিপ মেরে বললো, ” বাচ্চা না বাট বেবিগার্ল তো তাই না? সেইম বাট ডিফারেন্ট।”

হোটেল রুমে যাওয়ার পর সমুদ্র দেখলো তাদেরকে একটা হানিমুন প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। হানিমুন প্যাকেজে শুধু রুম স্পেশালি ডেকোরেশন করা থাকে৷ সে যেন এতেই আকাশের চাঁদ হাতে পায়। এতো খুশি হলো রুমে ঢুকে। আয়না কিছুটা অবাক নয়নে রুমের ডেকোরেশন দেখছে। কি সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো। জানালার ভিউ এত্তো সুন্দর! বারান্দায় একটা ঝুলানো নেটের দোলনা টাইপ আছে৷ বেড টাইপের দোলনা। একদম শুয়ে পড়া যাবে সেখানে। ও দৌড়ে গিয়ে বারান্দার দোলনার মতো জায়গায় শুয়ে পরে। হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে।

সমুদ্র ওর কাণ্ড দেখে হাসে। ফাহাদ সাহেব জানিয়েছে তার মেয়েরা খুব একটা বাইরের পরিবেশে যায়নি। স্কুল-বাসা এভাবেই দিন পার করেছে৷ এজন্য বুঝি মুক্ত প্রজাপতির মতো উড়াউড়ি করছে এখন।

আয়না একদম ছোটবাচ্চার মতো দোলনায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে বারান্দায় দাঁড়াতেই মুগ্ধ হলো। এতো নির্মুল বাতাস। তার উপর আয়নার খিলখিল হাসি৷ সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর কি ভেবে একদম আয়নার পাশে গিয়ে সেও শু’য়ে পরে।

আয়না ভ্রু কুচকে বলে, ” আপনার ভারে মনে হচ্ছে রশি ছিড়ে পড়বে।”

–” কিহ! আমাকে তুমি ইনডাইরেক্টলি ভারী বলছো?”

আয়না মাথা নাড়ায়। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওর উপর শু’য়ে পরে। আয়না নড়েচড়ে উঠলো। সমুদ্র নিজের মুখ ওর কাছে আনতেই আয়না দ্রুত ওর ঠোঁটে নিজের হাত রেখে কিছু করা থেকে আটকে রেখে বললো, ” মিষ্টার ওশেন, এটা আপনার বেডরুম না!”

সমুদ্র ভ্রু কুচকে মুখ দিয়ে ‘আম্ম’ শব্দ করে। আয়না দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। সমুদ্রর ঠোঁট ছাড়া পেতেই ও জবাব দিলো,

–” বেডরুমের চেয়েও অধম হলো হানিমুন কটেজ।”

সমুদ্র নিচু হতে ধরলে আয়না হাসতে হাসতে ওকে ধাক্কাতে লাগে এরপর বলে উঠে, ” চলেন নিচে ব্রেকফাস্ট করবো।”

–” ব্রেকফাস্ট ই তো করতে দিচ্ছো না। খালি বাঁধা দেও।”

আয়না দ্রুত ওকে সরিয়ে দিয়ে কেটে পরে। ওনাকে ফেলে রেখেই সে নিচে চলে যায়। সমুদ্র দু’মিনিট টি-গার্ডেন ভিউসহ বারান্দায় শুয়ে আরাম করে। এরপর আস্তেধীরে টি-শার্ট চেঞ্জ করে একটা শার্ট আর ট্রাউজার গায়ে দিয়ে বের হয় সকালের নাস্তার জন্য। ব্যুফে ব্রেকফাস্ট। সবাই নিশ্চয়ই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করছে৷

সে নিচের ফ্লোরে এসে এদিকে-ওদিকে তাকাতেই দেখলো লম্বা এক টেবিলে তার বন্ধুরা বসে আছে। নীলা-আয়নাও আছে। সে এগিয়ে যেতে লাগে। কয়েক কদম আগাতেই চোখ সামনের দিকে পড়ে, ক্ষণেই পা আসাড় হয়ে আসে। স্তব্ধ হয়ে এক’পল থমকে দাঁড়ায়। কাকে দেখলো সে মাত্র? চোখের ভুল নাতো! চোখ আপনা-আপনি বড় হয়ে আসে। ওর অভিব্যক্তি দেখে যেকেউ বলে দিতে পারবে যে ওর ভেতর দিয়ে বড়সড় ঝড় বয়ে গেলো। কেমন শূন্য কিন্তু গরম চোখে তাকিয়ে থাকে। চেয়ার সামনে থাকা সত্তেও বসে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের পলক ফেলে না। আয়না একবার তার দিকে তাকিয়ে বসতে বলে তবুও বসে না সমুদ্র।

গোল টেবিলের একদম আয়নার বিপরীতে বসে থাকা ব্যক্তি তার নারী কণ্ঠে রিনরিন সুর তুলে বলে,” হাই, কেমন আছো সমু….আ সমুদ্র। অনেকদিন পর দেখা।”

সমুদ্র প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ থাকে।

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
part–27 (বোনাস)

চোখের সামনে নিজের এক্সকে দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে সমুদ্র। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। ইউশার উপস্থিতি এ’আসরে কখনোই আশা করেনি। চোখ জুড়ে আঁধার দেখে। স্মৃতির মানসপটে কিছু আবছা সুন্দর-বিশ্রী স্মৃতি ভেসে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়। কপালের রগ স্পষ্ট দেখা যায়৷ সে ইউশার বলা কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসো রুমে।”

আয়না নিজেও সামান্য চকিত উঠে ওনার আজব ব্যবহারে। একজন ফ্রেন্ড সৌজন্যবশত কৌশল বিনিময় করছে অথচ উনি জবাব তো দিলোও না তাকালাও না একবারও। এতো আনকালচার’ড ব্যবহার কেন? উপরন্তু গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে রেগে আছে।

সে নরম গলায় বলে, ” আচ্ছা, আপনি যান, আমি চা নিয়ে আসছি।”

ইউশা এবারে দ্বিতীয়দফায় বলে উঠে, ” সমুদ্র কথা বললে না যে?”

সমুদ্র সে প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করে। আয়না ওর হয়ে সাফাই গেয়ে ইউশাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” উনার মনে হয় মাথাব্যথা করছে। এজন্য চলে গেলো।”

ইউশা ব্রেডে জেলি লাগাতে গিয়ে থেমে গিয়ে বললো, ” ওর তো মাথাব্যথার সমস্যা নাই।”

কথাটা বলেই কেমন চুপসে গেলো। এরপর একদম চুপ মেরে যায় যেন বোমা মারলেও মুখ দিয়ে কথা বের হবে না৷ আয়না ভ্রু কুচকে তাকায়। মেয়েটাকে দেখলে মনে হবে বাঙ্গালী কিন্তু কাছ থেকে মিশলে বোঝা যায় ও কেবল দেখতেই বাঙ্গালী বাকি সবকিছুই ভীনদেশীর মত। তবে বাংলা জানে। নামটাও সুন্দর। ইউশা। দেখতেও অনেক সুন্দর। একটু বেশিই মনে হয় সুন্দর। কিন্তু উনি কী সমুদ্রকে খুব ভালোমতো চেনেন? কীভাবে জানলো সমুদ্রের মাইগ্রেন বা মাথাব্যথার ইস্যু নেই? আয়না প্রশ্ন করত কিন্তু সমুদ্রের জন্য চা আর ব্রেকফাস্ট এসে যাওয়ায় সে উঠে চলে যায়৷

হোটেল রুমে ঢুকতেই সিগারেটের গন্ধ নাকে আসে। আয়না নিজে ব্যক্তিগতভাবে সিগারেটের স্মেল নিতে পারে না। সিগারেটের স্মেল নাকে গেলেই নিশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তার। কিন্তু উনি তো এভাবে সম্মুখীনে কোনোদিন সিগারেট ধরায় না৷ আজ তবে নিয়ম ভঙ্গ হলো কেনো?

আয়না ডাক দেয়, ” শুনেন।”

সমুদ্র বারান্দা থেকে একবার ওকে দেখে নিয়ে সিগারেট ফেলে, সরিয়ে দিয়ে, ভেতরের দিকে এসেই বলে উঠে, ” আয়না, চলো পরের বাসে ঢাকা ব্যাক করি।”

এটা শোনামাত্র সে বিষ্ময়ে হা হয়ে যায়। চোখ কপালে উঠে যায়। বলে কী এই ছেলে? আসার তিনঘণ্টাই পেরুলো না এরমধ্যেই নাকি ব্যাক করবে৷

সে বলে, ” মোটেও না। মাত্র আসলাম। কিছু ই তো দেখলাম না। না ঘুরেই যাবো নাকি?”

–” দেখার তেমন কিছু নাই। ওই সবুজ পাতা ছাড়া আর কিছু নাই দেখার মতো।”

আয়না তার হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিয়ে বলে, ” খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।”

— “সর‍্যি উদ্ধার করতে পারলাম না তোমাকে। খাচ্ছি না।”

–” হুট করে কী হলো আপনার? কেমন আজব ব্যবহার করছেন। ওই আপুর সঙ্গেও রুড বিহেভিয়ার করলেন। কি হয়েছে বলুন তো‌!”

–” জার্নি করার জন্য খারাপ লাগছে। এখন খারাপ লাগা শরীর নিয়ে মানুষের সঙ্গে গপ্পো করতে হবে? এটাই চাইছো?”

–” এটা একবারও চাই নি।”

সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে বিছানায় শু’য়ে পড়ে। এরপর চার্জে থাকা ফোন অন করতেই দেখে গতকাল রাতেই নীলা তাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলো যে ইউশাও আসবে। ওর কমন ফ্রেন্ড শ্রেয়শীর মাধ্যমে এ ট্যুরে ইনভাইটেশন পেয়েছে। সমুদ্র ফোন জোরে ফেলে দেয়। আয়না সামান্য চমকে উঠে। সমুদ্র শরীর খারাপ লাগছে বাহানা দিয়ে দুপুর অব্দি বিছানায় গড়াগড়ি খায়।খাবার অব্দি খায় না সে।

দুপুরের দিকে নীলা আসে সঙ্গে নুহাকে কোলে নিয়ে। আয়না আজও নুহাকে কোলে নিয়ে খেলতে ব্যস্ত থাকে। এই ফাঁকে দুই বন্ধু বারান্দায় যায়৷ আয়নার আড়ালে দু-একটা কথা বলতে চায়।

নীলা ধমকের সুরে বলে,” ফোন অফ রাখোস কেন?”

সমুদ্র বলে, ” চার্জ ছিলো না বা-?ল। ও এখানে কেন এসেছে?”

–” আমি কিভাবে বলব? জানার পর আমি নিজেই শকড। ও তোদের মধ্যে কোনো ঝামেলা করবে না তো? আয়নাকে সব বলে দেয় যদি?”

–” এই-বার ও কোনো ঝামেলা করলে আই ইউল কি–ল হার। আর কি বলবে ও? কোন মুখে বলবে সে? শুনো তোমার হাসবেন্ডকে আমি চিট করেছি?”

–” নট ফানি এট ওল ভাই। আমার ভয় হচ্ছে। তুই নিজ থেকে কেন সত্যটা বলিস না?”

তখনই আয়নার হাসির শব্দ কানে আসে। নিশ্চয়ই নুহাকে নিয়ে খেলার ছলে হাসছে।

সমুদ্র ঢোক গিলে অসহায় মুখ করে ছোট করে বলে, ” কী বলবো বল? আমি সাহস পাইনা। শুধু প্রাক্তন হলেও কথা ছিলো। কিন্তু ও যে ইহু–দি। মাতৃসূত্রে ই–সরা–য়েলী। ওকে ভালোবেসে আমি নিজের দেশ, জাতী, পরিবার একপ্রকার ত্যাগ করতে ধরেছিলাম। পিতার কাছে ত্যাজ্যপুত্র। মায়ের অবাধ্য ছেলে। এসব বললে আমাদের রিলেশনে ভয়ংকর প্রভাব পড়বে। আপাতত আমি মানসিকভাবে এতো স্ট্রং নাই। এমনও হতে পারে এসব শুনে আয়না আমার থেকে দূরে সরে পড়লো। পারবো না ওইসব কালো অতীতের ব্যাখা দিতে। নিজেরই ভয় লাগে।”

–“একদিন না একদিন তো বলতেই হবে।”

–” বলবো খুব শীঘ্রই।”

দুপুরের পর সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে রিসোর্ট ঘুরতে বের হয়। সব মিলিয়ে ওর ক্লান্ত লাগে। সে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। কিন্তু আয়না ছু’টে, ঘুরে বেড়ায়, ছবি তুলে। কোনদিকে যাচ্ছে-আসছে ও-ই ভালো জানে। সমুদ্র বসে থেকেই ওকে দেখছে। বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়। ও আনমনে আয়নার অনেক গুলো ছবি তুলে নিজের ফোনে।

এমন সময় ইউশার আগামন ঘটে। আজ গুনে গুনে একবছর পর দেখা৷ ও আগের মতোই আছে। একদম চেঞ্জ হয়নি। সমুদ্র সরে যেতে ধরলে ইউশা পথ আটকায়। বলে উঠে, ” চলে যাচ্ছো কেন?”

সমুদ্র থামে। কিন্তু কিছু বলে না৷

ইউশা-ই বললো, ” কেমন আছো? ”

–” ভালো। একচুয়ালি খুব ভালো আছি। আলহামদুলিল্লাহ। ”

–” তোমার ওয়াইফের সঙ্গে দেখা হলো। লেকের ধারে বসে ছিলো। আমিও ওদিকেই ছিলাম।”

–” ও আচ্ছা।”

–” বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো।”

সমুদ্র একটু সরে ওর থেকে দূরে পাশাপাশি দাঁড়ায় যেন একে অপরের চেহারা না দেখতে পায়। তবে আয়নার নাম শুনে ও নিজ থেকে বলে,” আমার ওয়াইফ অনেক সুইট না?”

–ইয়েস সি ইজ এ ভেরি সুইট গার্ল আই হাভ এভার সীন বাট ডু ইউ লাভ হার?”

সমুদ্র চকিতে উঠে ওর এই প্রশ্নে। তবে খুব সাবধানে বলে উঠে, ” তোমার মুখে ভালোবাসা ওয়ার্ডটা মানায় না।”

–“তাহলে কার মুখে মানায়? তোমার? তুমি নিজেও বিয়ের আগ মুহুর্তে আমায় কল করেছিলে। কেন ফিরতে চাচ্ছিলে যদি এতোই লয়্যাল হও।”

সমুদ্র সবটা শুনলো। ওইদিনের করা সেই একটা ভুল তাকে এভাবে ইউশার সামনে অপমানিত করে ছাড়লো।

সে শান্ত স্বরে মাথা ঠান্ডা রেখে শক্তপোক্ত ভাবে বললো, ” তখনো আমি ওর মায়ায় বাঁধা পড়িনি এজন্য আবার গন্ধযুক্ত ডোবায় ঝাপাতে চাইছিলাম। জানো তো পোকারা ভুল করে বারবার জলন্ত আগুনে ঝাপ দিয়ে মরে। আমারও ওই অবস্থা হচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলে না যে ওকে ভালোবাসি কিনা। দেন দ্যা আন্সার ইজ ইয়েস, আই লাভ মাই ওয়াইফ। ইউ নো, একটা টক্সিক জীবন থেকে ও আমাকে উদ্ধার করেছে। সুন্দর একটা গোছালো লাইফ উপহার পেয়েছি ওর থেকে। ”

–” আমার প্রশ্নের উত্তর এটা না।”

সমুদ্র হেসে বলে, ” কি উত্তর চাও? তুমি ভাবছো আমি এখনো তোমার প্রতি উইক? নাহ! বিয়ের দিন থেকে আমি তোমাকে সম্পূর্ণ ভাবে ভুলে গেছি। সেদিনের করা ভুলের জন্য আমি গিল্ট। বাট এম টোটালি ডান উইথ ইউ। ইটস ওল ওভার টুইংকেল কারোল।”

ইউশা একটু ভ্যাবাচেকা খায়। এই নামে সমুদ্র ওকে ডাকেনি কোনোদিন। এছাড়াও এর আগে সমুদ্রকে এতো শক্তভাবে ওর সাথে কথা বলতে দেখেনি। সবসময়ই নরমভাবে বলতো কথা। ওর এই পরিবর্তনে অবাক না হয়ে পারে না। তবুও দমে না সে।

বলে উঠে, ” এতোই যখন প্রেম তাহলে তোমাদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই কেনো?”

সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, ” মানে কি?”

ইউশা আত্নবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে, ” তোমাদের মধ্যে ফিজি–৷ ক্যাল কিছু হয়নি কেন?”

প্রাক্তনের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে ও বেশ রেগে যায়। মন চাচ্ছিলো থা–প্পড় মারতে কিন্তু ভীনদেশী কালচারে এসব খুব খোলামেলা আলাপ হয়।

সে শান্ত থাকলো। কিন্তু নিশ্চুপ।

ইউশা-ই বলে উঠে, ” তোমার ওয়াইফ নিজেই বলেছে।”

–” এসবও জিজ্ঞেস করো? রাবিশ ম্যান! কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কেউ এভাবে জানতে চায়। এতো লাইফলেস কেন? আমার মনে হচ্ছে, আমার ওয়াইফ, আমার সংসার দেখে তুমি ঈর্ষাবোধ করছো। নতুন বয়ফ্রেন্ড তৃপ্তি দিতে পারছে না?”

ইউশা একটু সংকোচবোধ করে। সমুদ্র ভুল বলেনি। ওর আসলেই আয়নাকে দেখে জেলাসি ফিল হচ্ছে। যদিও সে নিজেই সমুদ্রের উপর চিট করেছিলো। তাও মনে হচ্ছে আরেকবার সমুদ্রের ভালোবাসা পেলে ধন্য হত। কেমন পাগলার মতো ওকে ভালোবাসত সমুদ্র? অথচ সে অবহেলা দিয়েছে শুধুই। এখন সমুদ্রের এমন ড্যাম কেয়ার ভাব তার সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। সমুদ্র যেভাবে তার জন্য পাগল ছিলো ইউশা ভেবেছিলো ওকে দেখামাত্র সমুদ্র সব ফেলে চলে আসবে কিন্তু ও হাই অব্দি বলে নি। উপরন্তু যার জন্য সমুদ্রের সঙ্গে সে চিট করে, ওই ব্যক্তির সঙ্গেও আর সম্পর্ক নেই তার।

ইউশা কনফিডেন্সর সাথে বলে, ” তুমি এখনো ভালোবাসো আমাকে তাই না?”

সমুদ্র এই কথায় হাসলো খুব। এতে অপমানিত বোধ করে সে৷

সমুদ্র বলে উঠে, ” শোনো, পারলে আমি অতীত মুছে দিতাম। আমার আফসোস হয় কেনো আমাদের সাক্ষাৎ হলো। এরচেয়ে একদম প্রথমেই আয়নার সঙ্গে দেখা হলে মন্দ হতো না।”

_____________________

সন্ধ্যায় বারবিকিউ এর আয়োজন করা হয়। অন্ধকার নামলেই রিসোর্টের দোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে সবাই একত্রিত হয়ে বারবিকিউ তৈরিতে ব্যস্ত। সমুদ্র নিজে কয়লা জ্বালিয়ে বারবিকিউয়ের মুরগীর পিজ নাড়াচাড়া করছে।

বারবিকিউ পার্টতে আয়না লাল শাড়িটি পড়েছে। ও সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা কথা বলছে৷ সমুদ্র বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। আজকে ওকে দেখতে এতো সুন্দর কেন লাগছে? চোখ ফেরাতে পারছে না সে।

এমন সময় নিয়াজ বলে উঠে, ” সমুদ্রের কণ্ঠে অনেকদিন হলো গান শুনি না। সমুদ্র একটা গান গা৷ আমাদের এই বারবিকিউ পার্টি পরিপূর্ণ করে দে।”

আয়না তখন জুস খাচ্ছিলো। সে প্রশ্ন করে, ” উনি গান গেতে পারেন?”

আয়নার এহেন প্রশ্নে সমুদ্রের সব ফ্রেন্ডরা হেসে ফেলে।ইউশাও উপস্থিত ছিল।

ও এতোক্ষণে মুখ খুললো , ছাদে আসার পর একটা কথাও বলেনি। ও বলে উঠে, ” আয়না, তুমি জানোই না সমুদ্র গায়?কেমন ওয়াইফ তুমি? ”

আয়নাকে সামান্য দমতে দেখা গেলো। তবে সমুদ্র ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ” আমি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছি সেজন্য জানে না। পরিস্থিতির সাথে অনেক অভ্যাস বাদ দিতে হয়। আমি গান গাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি আরোও আগে থেকেই। ও আমার লাইফে নতুন এসেছে তাই জানে না।”

সবাই চুপ হয়ে গেলো সমুদ্র-ইউশার বাকবিতন্ডায়।
তবে আয়নার শখ জাগলো ওনার কণ্ঠে গান শুনবে। ও অনুরোধ করে বলে, “প্লিজ আজকে আবার গান গেয়ে শুনান। আমার খুব আপনার গলায় গান শুনতে মন চাচ্ছে।”

সমুদ্র তৎক্ষনাৎ প্রস্তাব নাকচ করে দিলো। সে একবার ইউশার দিকে তাকালো। ওর চোখে কেমন জিতে যাওয়ার আনন্দ। অপরদিকে আয়না মুখ গোমড়া করে আছে।

এরপর দু’দণ্ড সময় নিয়ে কি যেন ভেবে নিয়ে বলে, ” আমার বউয়ের ইচ্ছা পূরণ করা-ই আমার দায়িত্ব।ওর কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখতে চাই না। ওর জন্য হলেও তাহলে দু’লাইন গাই।”

মুহুর্তেই সব বন্ধুরা হাত তালি দিয়ে হৈচৈ শুরু করলো। সিটি বাজালো দু’জন বন্ধু। সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সমুদ্র গলার কণ্ঠ আসলেই সুন্দর। কেমন মায়া জড়ানো গানের কণ্ঠ ওর। ছায়ানটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলো। আয়না ওইসময় একগাল হাসি হাসে।

গিটার হাতে নিয়েই গলার স্বর একটু উঁচু করে বলে, ” দিজ সং ইজ ফর মাই বিলাভটেড ওয়াইফ। আয়না, শুধু তোমার জন্য!”

গিটারে সুর তুলে মাথা নিচু করে গাওয়া শুরু করে,

“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু
তোমায় যতনে”

সে মাথা উঁচু করে একটু হেঁটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে বাকি লাইনগুলো গাইলো।

” দুধে আলতা গায়ের বোরন
রুপ যে কাঁচা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাখো
চোখ যেন পরে না।
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন তো আর মানে না।”

আয়নার ওই মুহূর্ত গুলো কেমন রুপকথার মতো লাগছিলো। একটা ঘোর কাজ করছিলো। মোহময় চোখে সমুদ্রের দিকে তাকায় থাকে সর্বক্ষণ। পলক ফেলতে মন চায় না তার। পয়েন্ট ওয়ান ন্যানো সেকেন্ডও এই দৃশ্য মিস দিতে ইচ্ছুক না মন৷

সমুদ্র ওকে একবার ঘুরিয়ে এনে নিজের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে গাইতে থাকে,” তোমায় মন দিলাম, সোহাগ দিলাম, নিলাম আপন করে।”

এরপর কোমড়ে হাত রেখে একটু কাপল ডান্স দেওয়ার ভঙ্গিমায় অনেকটা নিকটে অবস্থান করে দু’জনে। ওনার পারফিউমের সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হতে থাকে আয়না।

আয়না ওর হাত আকড়ে ধরে। মৃদ্যু আলো-ছায়ায় ওর কেমন লাগতে থাকে। ওনার শার্ট অপর হাত দিয়ে ধরে ফেলে যেন ছেঁড়ে দিলেই উনি চলে যাবে কোথাও।

সমুদ্র গান গাওয়া থামিয়ে আস্তে করে বলে, ” ম্যাডাম, এটা আপনার বেডরুম না। আমি কোনো হানিমুন করতে আসিনি। ছাড়ুন। লোকে দেখলে বলবে মেয়েটার খুব ইয়ে তো!”

আয়না সঙ্গে সঙ্গে সরে যায়, ভীষণ লজ্জা পায় ও। সমুদ্র আলতো হেসে শেষ দু’লাইন গায়,
“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু
তোমায় যতনে।”

গান শেষ হওয়ার পর আয়নার ধ্যান ভাঙ্গে সমুদ্রের ‘ইউশা’ বলে ভীষণ জোড়ে চিৎকারের শব্দে। তবে সমুদ্র থেমে নেই। শব্দ করে নাম উচ্চারণ করেই থেমেই নেই, গিটারটা জোরে করে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে ছু’টে যায় ছাদের কর্ণারে।

আয়না সহ সবার দৃষ্টি সে’দিকেই গেলো। ইউশা ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর স্কার্ফে বারবিকিউয়ের জলন্ত আগুন লেগে গেছে কিন্তু ও খেয়াল করেনি৷ সমুদ্র নাম ধরে ডাকায় তাকাতেই খেয়াল হতেই প্যানিক হয়৷ বলতে গেলে উপস্থিত সবার মধ্যে ভয়ের আভাস ঢুকে যায়। তবে ভাগ্য সহায় ছিলো, সমুদ্র সময় মতো ওর কাছে গিয়ে স্কার্ফ টান মেরে ফেলে দেয়, নিয়াজ কোথা থেকে পানি এনে আগুনে পানি ঢালে। বড় কোনো দুর্ঘটনা হতে বেঁচে যায় ও। পরবর্তীতে পার্টির আমেজে ভাটা পড়লো। সমুদ্র বারবিকিউ স্ট্যান্ডের সামনে আয়নাকে আসতেই দেয় নি। নীলার সঙ্গে ওইদিকে বসায় রাখে। বারবিকিউ বানানোর পর ওয়ান টাইম প্লেটে সার্ভ করা হয়।

সে প্লেট নিয়ে আয়নার কাছে যায়৷ ওইসময় আবহাওয়া কিঞ্চিৎ খারাপ হয়। বাতাস বইতে শুরু করে। হুহু বাতাসে গরম প্লেট নিয়ে শাড়ি-চুলের উড়াউড়িতে বেশ বিরক্ত হয় আয়না। সমুদ্র তা খেয়াল করে। সে খাবারের প্লেট নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললো, ” খাও এখন আরাম করে।”

আয়না খাচ্ছিলো কিন্তু ওর জেদি, অবাধ্য চুল উড়ছে। সমুদ্র একটু পরপর চুল সরিয়ে কানের পিছে রাখছিল। ওমন সময় ইউশা একবার এদিকটায় এসে ওদেদ দেখে ফিরে চলে যায়।

খাওয়ার পর্ব চুকে যেতেই মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে সবাই রুমে ফিরে যায়। কিন্তু ছেলেরা বোতল খুলে। আজ অনেকদিন পর সমুদ্র ও খেলো। ফ্যামিলির সাথে থাকে জন্য ও খায় না এসব ছাইপাঁশ। কিন্তু আজ ফ্রেন্ডরা ফোর্স করে।

সকলেই হাল্কা টুকটাক পান করে।

নিয়াজ বলে উঠে, ” কিরে ব্যাটা। আমি তো ভাবছিলাম তুই ভাবীর সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকবি। তুই এখনো এখানে কী করস? রাত পাড় হলে আফসোস করবি তো।”

ফ্রেন্ডদের এমন লাগামহীন কথায় সমুদ্র ধমক দিয়ে বলে, ” চুপ কর।”

তাদের আরেক রিয়াদ ফ্রেন্ড ও একটু বেশি করে ফেলেছে। ও বলে উঠে, ” আমার হানিমুনে আমরা রুম ছেড়ে বেরই হতাম না। আর তুই দেখি গ্রহ আর পৃথিবীর মতো দূরত্ব মেইনটেইন করিস।”

নিয়াজ বলে, ” সায়ন হারা—মি আগেই কইসে তোর ভাই চিকিৎসা দরকার।”

রিয়াদ ফের বলে উঠে, ” দোস্ত ভাদ্র মাস আর হানিমুন সিজন দুইটাই বছরে একবার আসে। জিলে আপনি জিন্দেগি ভাই।”

নিয়াজ বলে, ” ভাগ্না-ভাগ্নি দেখেই অস্ট্রেলিয়া যাই।”

ওরা সমুদ্রের হানিমুন উপলক্ষে আরেকটা খুলে। এগুলো সব বাহানা। ওতোক্ষণ সমুদ্র জাস্ট অল্প একটু এক ঢোক গিলেছিলো। এবারে ওরা কেউ শুনেনি। অনেক গুলো খাওয়ায় দেয় যার অর্ধেক ও মুখ থেকে ফেলে দেয়। তাতেই মাথা টলকাতে থাকে। সবটা খেলে নির্ঘাত মাতা–ল হত।

হোটেল রুমে আসতেই ক্যান্ডেল লাইট জ্বালানো দেখলো সে। ফুলের গন্ধে মাত–লামি আরোও এক স্কেল যেকারো বেড়ে যাবে। তার চোখ একজনকে দেখার জন্য তৃষাতুর। চোখ ঠিকই তার প্রয়োজন কে খুঁজে নেয়।

আয়না তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আছড়াচ্ছে। শাড়ি খুলেনি, ড্রেস চেঞ্জ করেনি এখনো। ওর আঁচল ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চুল সামনের দিকে থাকায় ওর অনাবৃত ফর্সা পিঠ দৃশ্যমান। আজকে সমুদ্রের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। স্টেবেল থাকাকালীন খুব পার্ফেক্টলি নিজেকে সামলে চলে৷ কিন্তু আজকে ও যেন নিজেই জলোচ্ছ্বাস। সবকিছু ভে–ঙে দিতে মন চাচ্ছে।

দুজনার হৃদয় ভেঙেচুড়ে একসঙ্গে কুমোড়ের মাটির পাতিলের মতো নতুন করে দু’টো হৃদয় গড়তে মন চাচ্ছে। নিজের হৃদয়ের কিছু অংশে ওর হৃদয়ের খণ্ডাংশ রাখতে চায়।

সমুদ্র এগিয়ে এসে ওর কাঁধে থুতনি রেখে পরপর গালে চু– মু খেতে থাকে। আয়নার টনক নড়ে। সে অস্থির হয়ে উঠে যেতে চাইলে সমুদ্র আটকে রেখে বললো, ” বারন আছে নাকি কোনো?”

–” হুম”

–” তাহলে মিসেস রহমান, আজকে আপনার কোনো বাঁধা মানছি না কেমন? আর যদি বেশি কই মাছের মতো লাফাও, তাহলে আজকে বেঁধে ফেলবো।”

–” ছিঃ! কেমন অসভ্য আপনি! এসব কী বলেন? আর গা দিয়ে এমন স্মেল কেনো আসছে?”

সমুদ্র মুখ গোমড়া করে বলে, ” আমার গায়ের গন্ধ তোমার ভালো লাগেনা বুঝি। ব্রান্ড নিউ তাতেই এই দশা। পুরাতন হলে ফেলেই দিবা আমাকে।”

সমুদ্রর হাত ওর কোমড় থেকে আস্তে করে সামনে অগ্রসর হয়। অবাধ্য হাত দু’টো অস্থিরতা বাড়ায়৷ সমুদ্র ওর মুখ আয়নার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, ” তোমার মুখেও গ–ন্ধ তাও তো আমি থেমে থাকিনি। কতো লম্বা সময় ধরে ফিল দিলাম কেবল ভালোবাসা-বাসি আছে বলে।”

ওনার এমন পিত্তি জ্বলা মার্কা কথায় আয়না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঘুরলেই সমুদ্র ওকে টেনে একদম নিজের কোলে তুলে নেয়। কোনো কথা নেই, সিগনাল ছাড়াই। আয়না হতভম্ব হয় কিন্তু সমুদ্র মিচকা শয়তানের মতো হাসে যেন ওই কথাটা মাছের টোপ ছিলো। মাছ টোপ মুখে দিতেই জাল দিয়ে আটকে ফেললো। ওকে পাজকোলে তুলে বেডের দিকে পা বাড়ায়৷

দুজনেই ফুলের পাপড়ি যুক্ত বিছানায় বসে। মোমবাতির আলোয় সমুদ্র একবার নিজের বউকে দেখে নেয়। লাল শাড়িতে ওকে এতো বেশি অপরুপ লাগছে। ইচ্ছা করেই ওর মাথা খারাপ করার জন্য এই মেয়ে বোধকরি লাল শাড়ি পড়েছে কারণ ও খুব জানে সমুদ্রের লাল শাড়ির প্রতি দুর্বলতা আছে। লাইট নিভিয়ে কেবল ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে রাখলো। ঘরময় লো-লাইটে, টিপটিপ মোমবাতি, বারান্দা থেকে আসা হিমেল বাতাসে, ফুলের গন্ধে কেবল ভালোবাসাময় সুবাস। সমুদ্র ফুলের কিছু পাপড়ি আয়নার মুখে আস্তে করে ছিটিয়ে দিয়ে বলে, ” গরম লাগছে অনেক।”

–” এসি অন করেন।”

–” না। শার্ট খুলবো।”

ঘর্মাক্ত শরীর থেকে নেশায় বুদ থাকা সমুদ্র শার্টের বোতাম খুলতে পারছিলো না। ভুলভাবে বোতাম টান মারছে। আয়নার মায়া হলো। সে নিজ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোতাম খুলে দেয়। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে সাদা শার্টটা ফ্লোরে ছু’ড়ে মারে। এরপর আয়নার চোখে, মুখে, ঠোঁটে, কপালে, ঘাড়ে আলতো হাত ছু’য়ে আদর করতে থাকে। ওনার নীলচে চোখের দিকে তাকিয়ে আয়নার মায়া হয়। ও গিয়ে ওনার কপালের ঘাম মুছে দিয়ে চোখে আলতো চুমু বসায়। এতেই যেন কাল হলো। শান্ত ছেলেটা কেমন অশান্ত হয়ে গেলো ঠিক যেমন শান্ত সমুদ্র আচানক ফুলে-ফেঁপে, ফুঁসে কেমন ক্ষ্যাপাটে, দুর্বার হয়। আয়নাকে নিয়ে বেডে শু’য়ে পরে। আয়নার উপর শুয়ে সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়ে বলে,

“তোমার জ্বর আসার কারণ হতে চাই, পাখি।”

আয়না কেঁপে উঠে ওনার কথায়। বরফের মতো জমে আসে ওর শরীরের রক্ত। কেমন অস্থির লাগে৷ নিশ্বাস ভারী হতে থাকে তার৷ লজ্জায় লাল হয়ে আসে মুখ। ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনা সে।

আজ সত্যি সমুদ্র ভীষণ অশান্ত ছিলো। অধৈর্যও বটে যেন এখনি, এই মুহূর্তে আয়নাকে হাসিল করতে তৎপর। ও বেডসাইডে থাকা মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। এরপর এলোপাথাড়ি ভাবে আয়নার কপালে, গালে ঠোঁট ছু’য়ালো। নিজের দু’হাতের আঙ্গুলগুলো আয়নার হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে গুঁজে দেয়। ওর অমান্য মন আজ সবটা অমান্য করে বসে। গলায় আলতো করে ঠোঁট ছো’য়ায়। আয়না তিরতির করে কেঁপে উঠে। সমুদ্র ওই তিরতির কচি পাতার মতো কম্পিত ঠোঁটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেমন মোহ কাজ করে তার মধ্যে।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘড়ির কাঁটা ও হৃদস্পন্দনের গতি পর্যায়বৃত্ত গতিতে ঘুরতে থাকে। দু’জনের হৃদপিণ্ড ভীষণ তীব্রভাবে ধুকপুক করে একে-অপরকে খুব কাছ থেকে পেতে চায়। একসময় কাছাকাছিও আসে তারা। হয়তো এতো টা কাছাকাছি আসাই ভালোবাসার শেষ প্রান্ত, শেষ পর্যায়।

বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে হিমেল বাতাসে মোমবাতির আলো নিভতে থাকে, নিভতে থাকে সমুদ্র-আয়নার ভেতরকার দাউদাউ মনন-আগুন। বাতাসে সাদা পর্দা উড়তে থাকে। রাত গভীর হয়। আকাশে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলে। দূরে কোথাও মেঘ ডাকে। বিদ্যুৎ চমকায় থেকে থেকে।

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–28

পরেরদিন খুব সুন্দর একটা সকাল প্রকৃতি উপহার দিলো। একদম মেঘমুক্ত স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, রোদময় আকাশ। এমন আবহাওয়া সকল ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য আর্শীবাদ। পর্দার ফাঁক গলে যখন সূর্যের আলো চোখে-মুখে এসে লাগে, বরাবরই সমুদ্রের ঘুম ছু’টে যায়। কাল রাতে দেরিতে ঘুমালেও, খুব গভীর ঘুম ঘুমিয়েছে। সে চোখ মেলে আশেপাশে তাকালো। আয়না এখনো তার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে। ওর নিষ্পাপ, কোমল মুখখানা দর্শনমাত্র সমুদ্রের মুখে হাসি ফুটে। ও খানিক সময় নিয়ে এলোমেলো চুল নিয়ে খেলে। গতকালকের হ্যাংওভার কেটে গেছে, তবে এখন এই মুহূর্তে টায়ার্ডও লাগছে খুব। মস্তিষ্কের কোথাও সূক্ষ্ম একটা ক্লান্তিবোধ আছে৷ লেবুর পানি খেলে ভালো লাগতো বুঝি। ঘড়ির কাটায় মাত্র সাতটা বাজে। এতো সকালে উঠে লাভ নেই ভেবে সে ফের চোখ বুজে। আয়না তখন সামান্য নড়ে উঠে ঘুমের মাঝে। সমুদ্র বাঁধন হাল্কা করতেই ও ওপাশ ঘুরতে চায় ঘুমের মধ্যেই। কিন্তু সমুদ্রের হিংসুকে মন কোনোভাবেই আজ আয়নার ছো’য়া অন্যকোথাও মাড়াতে দিতে রাজী নয়। ওর সব উষ্ণতার অধিকারী কেবল সে! মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমন্ত আয়নাকে আস্তে করে টেনে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়৷ এরপর কপালে আলতো ঠোঁট ছো’য়ায়। অবসাদ থাকায় একটু পরেই তার তন্দ্রাভাব এসে যায়৷

আরোও কিছু সময় পর, আয়নার ঘুম ভাঙ্গে। সে নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো৷ সমুদ্রর উম্মুক্ত বুকে নিজেকে আবিষ্কার করামাত্রই লজ্জায় ফেটে পড়ে। গতকালকের সব স্মৃতি ভেসে উঠতেই সে পারলে বালিশে মুখ লুকায়। ভাগ্যিস উনি জাগ্রত অবস্থায় নেই। থাকলে এতোক্ষণে আয়নার কয়েক শত’বার লেগ পুলিং করে ক্ষ্যান্ত হতো। সে উঠে আসতে চাইলে টান অনুভব করে। চোখ বুলিয়ে দেখলো সমুদ্রের হাত তার কাঁধে হেলে আছে। সে ওর হাত সরাতে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে। এরপরে কী ভেবে ঘুমন্ত সমুদ্রের ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট ছো’য়ালো। আয়না ভেবেছিলো উনি ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সমুদ্র চোখ খুলে বলে উঠে, ” এই কী করলা এটা?”

আয়না ভড়কে উঠে বলে উঠে, ” কি করলাম?”

–” আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিলে কেনো? হু? নিরীহ, ঘুমন্ত একটা ছেলের সুযোগ নিচ্ছো? দস্যি মেয়ে কোথাকার!”

আয়না হা হয়ে যায়। সারারাত যে ডাকাতি চালালো সে-ই সকালবেলা ডাকাত হয়ে অন্যকে দস্যি উপাধি দেয়? এ কেমন আজব বিধি?

সমুদ্র অবশ্য ওর হা হয়ে যাওয়া মুখ দেখে গলে না। ওকে টান মেরে নিজের দিকে টেনে বলে, ” তুমি অন্যদের কাছে আমাদের মধ্যকার অতি-ব্যক্তিগত তথ্য চালান করো কেন?”

–” মানে?”

–” লেকের ধারে কাকে কী বলেছো? তোমার এইসব হেয়ালির জন্য মানুষ আমাকে যেকোনো সময় কলি– কাতা হারবাল উপহার দিবে, সে খেয়াল আছে?”

আয়না জিহবায় কামড় বসায় এরপর বলে, ” ওহহো! আপনার ফিমেল ডক্টর ফ্রেন্ডটা নর্মালি বলছিলো কোনো কনসালট্যান্ট লাগবে কীনা? রেগুলার কোন মেডিসিন নিচ্ছি? আমি উত্তরে বললাম কিছু নেই না তো!”

সমুদ্র মুখ কালো হয়ে গেলো। ডাক্তারের ফাঁদে এভাবে তার ইঞ্জিনিয়ার বউ আটকা পড়লো? ইউশা ভদ্র ভাষায় ওর মুখ থেকে চালাকি করে এ’তথ্য বের করেছে৷

সে আয়নাকে আরোও চেপে ধরে বলে, ” বোকা মেয়ে!”

আয়না মেকি রাগে নাক ফুলালো। সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র ওর নাকফুলের উপর প্রগাঢ় অনুভূতিসম্পন্ন চু–মু বসিয়ে নরম গলায় বলে, ” আজ তবে সেই ফিমেল ডক্টরের কাছে গিয়ে কনসালট্যান্ট নেও। প্রেসক্রিপশন নিও।কাজে লাগবে।”

আয়না দ্রুত ওনার বুকে মুখ লুকানো। সমুদ্র শব্দ করে হাসে। ওনার হাসির শব্দ শোনামাত্র আয়না বুকে কিল বসায়। সমুদ্র জিজ্ঞেস করলো, ” আমার বুকের সঙ্গে তোমার এতো শত্রুতা কিসের? ”

কিছুক্ষণ পর সমুদ্র জিজ্ঞেস করলো, ” উঠবে না আজ? রাতে ঘুম হয়েছে তো ঠিকঠাক? ”

প্রশ্নটা ইচ্ছা করে ওকে লজ্জা দেওয়ার জন্য করা। পৃথিবীবাসীর অঘোষিত নিয়মই হলো দুর্বলকে তার ওই দুর্বলতা নিয়ে আঘাত করা।

তবে আজ আয়না একদম টানা তেজি গলায় বলে, ” আপনি আর ঘুমাতে দিলেন কই? এখন দয়া করে সরুন। ঘুমাবো আমি।”

সমুদ্রের চোখ কপালে উঠে যায়। সে ভাবেওনি আয়না এমন বেখাপ্পা কথা বলবে। সে বলে, ” না। না। এখন উঠতে হবে। ব্রেকফাস্ট টাইম শেষ হয়ে যাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট না করতে গেলে, সারা রিসোর্টের মানুষ বুঝে যাবে তুমি কাল রাতে ঘুমাও নি।”

আয়না দ্রুত উঠে পড়ে। সমুদ্রও উঠে বলে, ” যাও দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আসো। দশটায় ব্যুফে টাইম শেষ। এখন সাড়ে নয়টা বাজে।”

–” দশ মিনিটের মধ্যে কীভাবে ফ্রেশ হবো? আমার দাঁত ব্রাশ করতেই তো বিশ মিনিট লাগে।”

–” বিশ মিনিট ধরে দাঁত ব্রাশ করেও এই হাল!”

আয়না ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে, ” কেমন হাল?”

–” বললে কষ্ট পাবে। আচ্ছা শুনো, অনেক আগে ফিজিক্সে পড়েছিলাম একটা মোটর বিশ মিনিটে যে কাজ করে, একসঙ্গে সেইম দক্ষতার মোটর কাজ করলে টাইম অর্ধেক লাগে। তুমি চাইলে আই ক্যান হেল্প ইউ তাহলে দশ মিনিটের মধ্যে তুমি ফ্রেশ হতে পারবে৷”

আয়না ওনার কথা শুনেই ঘাবড়ে যায়। পাগল লোক বলে কী? সে একপ্রকার দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। একটু পর ফ্রেশ হয়ে বের হয়েই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। ভেজা চুল ফ্যানের বাতাসে নড়াচড়া করে শুকানোর চেষ্টা করছে। সমুদ্র তখন ফোন স্ক্রল করছিলো। সে আসায় ফোন রেখে একদম ড্রেসিং টেবিলটার দিকে আগায়। দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমলো। সে একদৃষ্টিতে আয়নাকে অবলোকন করছে। কমলা আর সাদা মিশেলের ঘের’আলা সুতির আনারকলি কুর্তিতে ওকে দারুণ মানাচ্ছে। একদম লিভিং বাটারফ্লাই যেনো! ওর ঘোর কাটে আয়নার অভিযোগ সুরে।

আয়নার ডান হাতের অনামিকা আঙুল ওর গলার সাইডের লাল হয়ে আসা ক্ষতপ্রাপ্ত স্থানে। ও চোখ-মুখ লাল করে বলছিলো, ” আপনি একটা খা– টাশ।”

সমুদ্র ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে নিজের পরনের টি-শার্ট খুলে ফেলে। আয়নার চেহারা সে-মুহুর্তে দেখার মতো ছিলো। ভীষণ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। তবে সমুদ্র পেছন ঘুরে নিজের পিঠ প্রদর্শন করে। তারপর বলে উঠে, ” পিঠের যে অবস্থা করেছো, নিশ্চয়ই দুইটা সেলাই লাগবে। জং লি বিল্লি কোথাকার!”

আয়না লজ্জা পাওয়া চেহারা নিয়ে জিহ্বায় কামড় বসায়।

উম্মুক্ত বুক নিয়ে সামনে ঘুরে সে আয়নার হাতে থাকা সাদা সুতার কাজ করা ওড়নাটা গলার উপর দিয়ে সুন্দর করে পড়িয়ে দিয়ে বলে, ” মাই লিভিং বাটারফ্লাই!”

আয়নার ওই মুহুর্তটা এতো মোহময় লাগে। সে মায়া-মায়া চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে রইল।

ব্রেকফাস্ট টাইম পাড় হওয়ার পর তারা বের হয়। আয়না নিরিবিলি একটা টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট অর্ডার দেয়। সমুদ্র ওর বন্ধুদের কাছে যায়। আজকের রাতে ফেরার পালা। বিকেলেই ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হবে।

নিয়াজ আর রিয়াদ বসে ছিলো সুইমিংপুলের পাশে।
সিগারেট খাচ্ছিলো। ওকে দেখামাত্র সিগারেট অফার করে বসে। ও সুখটান মেরে পুলের ধারে বসে৷

রিয়াদ টিটকারি মেরে বললো, ” তোরে হাসিখুশি লাগছে অনেক। ঘটনা কী?কালকে ভাবীর পাশেই যাইতেছিলি না আর আজকে ভাবীর থেকে দূরেই সরলি না।”

সমুদ্র বলে, ” আমি সবসময়ই হাসিখুশি থাকি।”

নিয়াজ ওকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে, ” ব্যাপার কি রে ব্যাটা? ব্রেকফাস্টের জন্য এলি না কেন?”

–” ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো৷

–“এই সকালেই গোসল করে বাবুসাহেব সেজে এসেছিস? ”

সমুদ্র যেকোনো ভদ্র উত্তর দিত, কিন্তু এই প্রশ্ন করার সময় ইউশা এসে দাঁড়ালো তার পাশে। সে ইচ্ছা করে বলে, ” বউ নিয়ে ঘুমালে সকালে গোসল করেই বের হতে হয়, জানোস না বুঝি কিছু!”

ওর ফ্রেন্ডরা হাসলো। ইউশা দ্রুত সরে যায়। সমুদ্রের কাছে বিয়ে করা উপলক্ষে ট্রিট চাইলো দুপুরে। সমুদ্র সবাইকে চাইনিজ খাওয়াবে বলে ঘোষণা দিলো।

ইউশা লাউঞ্জের ভেতর আসতেই দেখে আয়না বসে নাস্তা খাচ্ছে। তাকে দেখে আয়না-ই হাত নেড়ে হাই জানায়। সে এগিয়ে যায় আয়নার দিকে। ওকেই খুশি-খুশি লাগছে বড্ড। আয়নার চুলও ভেজা।

দুজনের মধ্যে দু’টো কথা হতে না হতেই ওয়েটার আসে। আয়নাই ডেকেছিলো। সে দু’টো ম্যাংগো জুস ওর্ডার দিয়ে ওয়েটারকে বলে, ” একটা জুস স্যারকে দিয়ে আসবেন।”

ইউশা তখন বলে, ” সমুদ্রের জন্য ওর্ডার দিচ্ছো?”

–” হ্যাঁ।”

ইউশা সরাসরি ওয়েটারকে বলে উঠে, ” স্যারের জন্য তাহলে একটা পাপায়া জুস বানান।”

ওয়েটার আচ্ছা ম্যাম বলে চলে যায়। ইউশাও কিছু না বলে উঠে পড়ে৷ খানিক বাদে সমুদ্র জুস খেতে খেতে ফিরে এসে আয়নার টেবিলে জুসের গ্লাস দেখে বলে, ” থ্যাংকস আয়না, আমার প্রিয় জুস খাওয়ানোর জন্য। অনেক দিন পাকা পেপের জুস খাই না৷ মন একদম ভালো হয়ে গেলো।”

সে জুস খেতে খেতে লবিতে বসলো৷ কিন্তু আয়নার কপালে সরু ভাজ দৃশ্যমান হয়৷ ওই আপু কীভাবে জানলো সমুদ্রের পাপায়া জুস পছন্দ?

___________________

আলিয়া ফোনে শ্রাবণের সঙ্গে কথা বলছিলো। শ্রাবণ ও’পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো, ” এখনো আপসেট আছো?”

ও আলিয়ার বাড়ির ঘটনা জানে সব। আলিয়া আনমনা হয়ে বলে, ” না।”

–” তাহলে বের হও। চল মিট করি কোথাও।”

–” না। মুড নাই।”

–” অন্য বফ-গফরা কতো ডেটে যাচ্ছে। তুমি আসো না কেনো?”

আলিয়া ঝাড়ি মেরে বললো, ” আমি তোমার গফ না বুঝছো?”

–” না। বুঝিনি।”

–” উই আর নট ইন এ রিলেশনশীপ।”

–” তাহলে কীসে আছি আমরা? সিএনজি-শীপে?”

আলিয়া ওর কৌতুকে হাসলো এবার বলে, ” আমরা অনলি জাস্ট ফ্রেন্ড।”

–” না। না। এটা জাস্ট ফ্রেন্ডের নমুনা না। আই থিংক আমরা, ফ্রেন্ডস উইথ এক্সট্রা কেয়ার এন্ড এটেনশনে আছি।”

–” এতোদিন শুনে এলাম ফ্রেন্ডস উইথ এক্সট্রা বেনিফিট। তুমি আবার এটা কোন নতুন টার্ম আবিষ্কার করলে?”

শ্রাবণ বেশ জ্ঞানী ভাব নিয়ে কথা বললো, ” ফ্রেন্ড এর সঙ্গে বেনিফিট বিষয়টা আমার বাজে লাগে। তাছাড়া তোমার কাছে আমি কিছুটা মোর দ্যান ফ্রেন্ড, লেস দেন বয়ফ্রেন্ড টাইপ পার্সন। বাট আমার কাছে তুমি শখের নারী। ইন হিন্দি পাসান্দিদা অওরাদ।”

আলিয়ার বেশ মনে ধরলো কথাগুলো। কিন্তু ওইসময় বেল বেজে উঠে। এ অবেলায় কে এলো? সে বলে, ” বাসায় কেউ এসেছে। রাখি।”

–” ফ্রেন্ড উইথ এক্সট্রা কেয়ারকে ইগনোর করা উচিত না।”

–” শাট আপ।”

আলিয়া গেইট খুলতেই অবাক হলো। শায়লা চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে তাও দুই বক্স মিষ্টির দামী গিফটবক্স নিয়ে। সে হাসি হাসি মুখে ভেতরে এসে বললো, ” আব্বুর সঙ্গে কথা হয়েছে?”

–” নাতো।”

–” কল দেয়নি তোমায়? খুশির সংবাদ শুনোনি?”

খুশির সংবাদ শব্দটা কানে বাজলো ওর৷ উদ্ভট এক চিন্তায় তার কপালের ঘাম ছু’টতে লাগে। কি হতে পারে সুসংবাদ? ওনার জন্য যা সু, তাদের দু’বোনের কাছে তা কু। উনি কী প্রেগন্যান্ট নাকি? আপা বলেছে বাবা আরোও কয়েক মাস আগেই বিয়ে করে ফেলেছিলো। আলিয়ার কান্না করার মতো অবস্থা। উনি যদি আসলেই প্রেগন্যান্ট হয়, ভার্সিটি গেলে সে মুখ দেখাতে পারবে না। সবাই বলবে আলিয়ার মেয়ের বয়েসী বোন। শ্রাবণ ও হাসবে তার উপর।

শায়লা চৌধুরী থেমে নেই৷ উনি আলিয়াকে ডাইনিং টেবিলের বসিয়ে, রান্নাঘর থেকে প্লেট এনে পুডিং আর মিষ্টি সার্ভ করে খেয়ে দেয়। তারপর ওদের দাদা-দাদীর রুমে যায়। আয়না ফোন অন করে দেখে বাবা চল্লিশ মিনিট আগে একবার কল দিয়েছিল কিন্তু ওইসময় শ্রাবণের সঙ্গে কল এনগেজড ছিলো তার। সে ঢোক গিললো।

শায়লা ফিরে এসে দেখল আলিয়া কিছুই খায় নি। সেও তার বিপরীতে বসে বলে, ” সুসংবাদ শুনো নি এখনো?”

আলিয়া ভয়ে ভয়ে বলে, ” আপনি কী প্রেগন্যান্ট আন্টি?”

শায়লা চমকালো এরপর হেসে ফেলে। ওইসময় আলিয়ার খুব ইমব্রেসড ফিল হলো।

শায়লা চৌধুরী বলে উঠে, ” তোমার আব্বুর প্রোমোশন হয়েছে।”

আলিয়ার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। শায়লা চৌধুরী বলে, ” তোমার আব্বু এখন অনেক বড় পজিশনে আছে। দায়িত্বও বেড়ে গেছে। কাজের চাপও বাড়বে৷”

আলিয়া পুডিং মুখে দিলো। কথা ঘুরানোর জন্য সে বলে, ” পুডিং ভালো হয়েছে। আমার পুডিং এমন হয় না। ভেঙে যায় সবসময়।”

–” আমি বানিয়েছি তোমার জন্য। তুমি একা আছো বাসায় সেজন্য তোমার পছন্দের পুডিং বানিয়ে আনলাম। একদিন ফ্রি থাকলে, আমি তোমাকে পুডিং বানানো শেখাবো। পুডিংয়ে সবকিছু পরিমাণ মতো দিতে হয়,নাহলে পুডিং ভালো হয় না। এক্সটা করে বেকিং পাউডার দিলে আর ভাঙ্গে না।”

আলিয়া বলে, ” ও।”

দুপুরের দিকে ফাহাদ সাহেব আসলেন। তখন শায়লা চৌধুরী রান্নাঘরে ছিলো। তাকে বাসায় আসতে দেখে শায়লা চৌধুরী বলে, ” খালি হাতে এলে কেনো? মিষ্টি কোথায়?”

ফাহাদ সাহেব বলে উঠে, ” মিষ্টি আনার কথা একদম খেয়াল ছিলো না৷”

এরপর আলিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” মা, তোমার আপার সঙ্গে কথা হয়েছে? ওরা কেউ ফোন ধরছে না।”

–” না, আব্বু।”

_______________

দুপুরে রিসোর্টের কর্মচারী সহ ওদের সঙ্গে আসা সব ফ্রেন্ডদের সমুদ্র চাইনিজ খাওয়ায়। ইউশাও এসেছিলো। কিন্তু একটু পর ও চলে যায়। ওকে ডাকতে কেবল শ্রেয়সী যায় পিছু, খানিক বাদে ও একাই ফিরে আসে। সবাই অনেকদিন পর একসঙ্গে অনেক মজা করে। এরপর ওর ফ্রেন্ডরা ওদের কংগ্রাচুলেড করতে বড়সড় একটা কেক এনে উপহার দেয়। কেকের উপর ইউনিক এক লেখা ছিল তা হলো:

“ডক্টর প্লাস ইঞ্জিনিয়ার ইজ ইকুয়াল বায়োটেক লোডিং।”

সমুদ্র তার বন্ধুদের বুদ্ধির প্রশংসা করতে বাধ্য হলো। কেক কেটে সমুদ্র সবার আগে আয়নাকে খাওয়ায় একফাঁকে বলে উঠে, ” তারপর, বায়োটেকের আম্মু! আমার পুচকে বায়োটেক কবে আসছে?”

আয়না ওর হিল দিয়ে একটা লাথি মারে সমুদ্রের পায়ে। সমুদ্র আউ বলে সরে যায়।

খাওয়ার পর শেষবারের মতো তারা চা-বাগান ঘুরে দেখছিলো। এবারের ট্যুরে বন্ধুরা কোয়ালিটি টাইম কাটানোর জন্য কেবল রিসোর্টেই ছিলো। বাইরে বের হয়নি। বিকেলেই বাস। হাতে সময় একদম নেই৷

আয়না চা-বাগানের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর একটু পরপর ওর ঘের দেওয়া আনারকলি নিয়ে ঘুরছে। খিলখিল করে হেসে সমুদ্রের দিকে তাকায়।

সবুজে ঘেরা চা-বাগানে কমলা রঙের আয়না যেন একরাশ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলো। ওর উপর থেকে সমুদ্র চোখ ফেরাতে পারে না৷ চারপাশে খালি সবুজ, সারি সারি চা-পাতার বাগান। উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। দূর-দূরান্ত যতোদূর চোখ যায় কেবল সবুজ এবং সেই সবুজের মাঝে এক টুকরো কমলা যেন আয়না। প্রাকৃতিক দৃশ্যর নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর আয়নার মুক্তা ছড়ানো হাসিতে সমুদ্র আকৃষ্ট না হয়ে পারেনা। লবি থেকে একটা লাল গোলাপ তুলে এনেছিলো লুকিয়ে ৷

সে আয়নার হাত টান মেরে একটু এগিয়ে গিয়ে বিনা অনুমতি নিয়েই ওর কানে গোলাপ গুঁজে দিয়ে বলে, ” তোমার কানে গোলাপ মানায় ভালো।”

–” কীভাবে জানলেন?”

মেয়েটার প্রশ্ন করার স্বভাব ভালো লাগে না তার। সে আয়নার কাছে গিয়ে তাকে নিজের দিকে এনে বলে, ” মেহেদীর দিনে দেখেছি।”

–” আপনার মনেও আছে?”

–” আছে।”

আয়না দুষ্টুমি করে বলে, ” আমাদের বিয়ের তারিখ মনে আছে?”

সমুদ্র মাথা চুলকে বলে, ” ভুলে গেছি।”

আয়না ওর বুকে আবারো কিল বসাতে গেলে সমুদ্র খপ করে ধরে ফেলে ওকে নিজের দিকে টেনে একদম বুকের সঙ্গে লেপ্টে নিয়ে বলে, ” আমি তোমার বন্ধু বা ছোট ভাই না, হাসবেন্ড আমি। যখন-তখন মারবা না, বুঝছো?”

আয়না মাথা ঝাকায়। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ওর ওড়না সরিয়ে দিয়ে বলে, ” হাসবেন্ড এর সঙ্গে যখন-তখন মারামারি না, রো–মন্স করতে হয়।”

আয়না ওর ওড়না টানতে টানতে কাদো কাদো মুখে বলে, ” কেউ দেখে ফেলবে তো।”

সমুদ্র ওর কাণ্ড দেখে হেসে ক্ষতপ্রাপ্ত স্থানে আদুরে ভঙ্গিমায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” সর‍্যি ফর দ্যাট। আজোও ফার্মেসী ঘুরে আসা হলো না।”

–” আপনি কেমন মানুষ ? সাথে প্রয়োজনীয় মেডিসিন কেন রাখেন না?”

–” আমি ডাক্তার, ফার্মেসীর দোকানদার না যে সব রকম ঔষধ ,প্রোটে–কশন ইত্যাদি মালামাল নিয়ে ঘুরবো।”

আয়না সরে আসতে চাইলে সমুদ্র ওইখানটায় ঠোঁট ছু’ইয়ে বলে, ” তারপর আমার বায়োটেকের আম্মু! আপনার তো ফ্রেন্ডমুন করার কথা! কিন্তু আমার মতো হান্ডসাম ছেলের উপর লোভ সামলাতে না পেরে ডিরেক হানিমুন সেরে নিলে। এখন আপনার লোভ সামলাতে না পারার এ’দায়ভার নিশ্চয়ই আমার নয়।”

আয়না সরতে চাচ্ছিলো কিন্তু সমুদ্র গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ওর মুখে ছুঁ’য়ে দেয়। যে জায়গায় পাপড়ি ছোঁ’য়ায় সে জায়গায় টুপ করে চু–মুও দেয়।

বিকেলের দিকে তারা চা-বাগান চা-পাতা দিয়ে তৈরি চা খেয়ে রওনা হলো। বাসে আয়নার হাল্কা জ্বর আসলো। সে সমুদ্রের কাধে মাথা রেখে শু’য়ে ছিলো।

_______________

সেদিন রাতে শায়লা চৌধুরী ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে তার বাসায় থাকলো। আলিয়া কিছু বলতে পারলো না। দাদীও চান শায়লা চৌধুরী থাকুক। একাকী গতি করতে পারবে না সে। আপাও নেই। একা বাবার সঙ্গে তর্ক করার সাহস তার নেই। এম্নিতে মনোবল তার দুর্বল। তার উপর ঝামেলা করলে তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে এটা তো নিশ্চিত। তার উপর সে পাবলিকে কোথাও চান্স পায় নি। প্রাইভেটে পড়তে হবে, এমন পরিস্থিতিতে বাবাকে রাগিয়ে দেওয়া ভুল হবে। আপার শ্বশুড়বাড়ি আছে, নিজে পাবলিকে পড়ে। পড়তে টাকাও লাগে না৷ কিন্তু আলিয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সে ন্যাশনালে পড়তে চায় না। প্রাইভেটে পড়তে হলে, বাবার সাপোর্ট ছাড়া সে নিঃস।ঢাকায় সে একলা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেও পারবে না। আপার শ্বশুড়বাড়ি গিয়েও থাকবে না।এরচেয়ে সৎমায়ের সঙ্গে থেকে বাবার টাকায় লাখটাকা সেমিস্টার ফ্রি দিয়ে থাকাই ভালো। এজন্য চুপ থাকে। সেদিন রাতে শায়লা চৌধুরী এ’বাসায় থাকেন৷

চলবে।